ঝাড়গ্রামের প্রবেশপথে
সূচীপত্রের যে কোন বিষয়ের উপর ক্লিক করে সেই বিষয় সংক্রান্ত অংশে যাওয়া যাবে ।
সূচীপত্র
মহকুমা শাসকের কার্যভার গ্রহণ
১৯৭৯ সালের ২৮শে এপ্রিল আমি ঝাড়গ্রামের মহকুমা শাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করি । দীর্ঘদিন ঝাড়গ্রামের পরিচিত মুখ হওয়ায় প্রশাসনিক কারণে এখানকার মহকুমা শাসকের নিয়োগে আমি আগ্রহী ছিলাম না । এই নিয়োগ এড়াতেও চেয়েছিলাম, সম্ভব হয় নি । তবে এই পূর্ব্ব-পরিচিতির একটি সুবিধাজনক দিকও ছিল ।
এর পূর্ব আমি ডিপিএপির প্রোজেক্ট অফিসার হিসাবে প্রায় তিন বৎসর কাল ঝাড়গ্রামে ও পাইরেপের প্রোজেক্ট অফিসার হিসাবে দুই বৎসরের কিছু কম সময় ঝাড়গ্রাম মহকুমার অন্তর্ভুক্ত নয়াগ্রামে কাটিয়েছি । ফলতঃ এই মহকুমা এলাকা সম্পর্কে আমার ভাল জ্ঞান ছিল । এই এলাকার অফিসাররাও অধিকাংশই আমার পরিচিত ছিলেন । এই বিষয়গুলি সাবলীল ভাবে মহকুমা প্রশাসন পরিচালনা করতে সহায়ক হয়েছিল ।
প্রশাসনিক স্তর
ঝাড়গ্রামে ৮টি উন্নয়ন ব্লক ও ৬টি থানা ছিল । বিনপুর ও গোপীবল্লভপুর থানা এলাকায় দুটি করে ব্লক ছিল; বিনপুর থানা এলাকার দুটি ব্লক হল বিনপুর ১ নং (সদর-লালগড়) ও বিনপুর ২নং (সদর-বেলপাহাড়ী), গোপীবল্লভপুর থানা এলাকার ব্লক দুটির নাম হল গোপীবল্লভপুর ১ নং (সদর- ছাতিনাশোল) ও গোপীবল্লভপুর ২নং (সদর-বেলিয়াবেড়া) । সত্তরের দশকের প্রথমে গোপীবল্লভপুর ছিল নক্সাল ক্রিয়াকলাপে উত্তপ্ত । নক্সাল আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা সন্তোষ রাণার (১৯৪২ - ২৯ শে জুন ২০১৯) বাড়ীও এই বেলিয়াবেড়া অঞ্চলেই ছিল ।ঝাড়গ্রাম মহকুমার বাকী ব্লকগুলি ছিল ঝাড়গ্রাম সদর, জাম্বনি, সাঁকরাইল ও নয়াগ্রাম ।
৬টি থানা ছিল ঝাড়গ্রাম, জাম্বনি, বিনপুর, গোপীবল্লভপুর, সাঁকরাইল ও নয়াগ্রাম ।
প্রধান উপজাতিসমূহ
ঝাড়গ্রাম মহকুমায় বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে রয়েছে মূলতঃ সাঁওতাল, মুণ্ডা, সবর ও লোধা । তা ছাড়া এক বৃহৎ অংশ মাহাতোও এখানে বাস করে । ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে উপজাতিদের শতকরা হার জনসংখ্যার ২৯.৩৭% । জনসংখ্যার ২০.১১% তপশিলী জাতিভুক্ত ।
এসডিওর কর্মতালিকা
এসডিওর কোন সুনির্দিষ্ট কর্ম তালিকা বা ওয়ার্ক-চার্ট নেই । মহকুমার সাধারণ প্রশাসন ছাড়াও এসডিওকে আরো অনেক বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হয় এবং মহকুমায় জনসেবায় নিযুক্ত অন্যান্য বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হয় । মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে এসডিও মহকুমার নির্বাহী বিচার ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকেন । পদাধিকার বলে তিনি জনসেবামূলক কিছু সরকারী ও বেসরকারী এজেন্সীরও নেতৃত্বে থাকেন । জেলা সদরের বাইরের মহকুমায় এসডিও জেলের অধিক্ষক (Jail Superintendent) হিসাবে জেল প্রশাসনেরও দায়িত্বে থাকেন। ব্লক স্তরের প্রশাসন ও উন্নয়নের সামগ্রিক দায়িত্বও এসডিওর উপর ন্যস্ত । স্বভাবতঃই এসডিও তার এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন । আমি এখানে আমার ঝাড়গ্রামের এসডিও হিসাবে কার্যকালে ঘটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর কয়েকটিকে তুলে ধরেছি ।
গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের জব্ এ্যাসিস্টেণ্ট পদে প্রার্থী বাছাই
আমি এমন একটা সময়ে মহকুমা শাসকের দায়িত্ব নিয়েছিলাম যখন ১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েৎ নির্বাচন শেষে নতুন পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠান ক্ষমতায় এসেছে। নির্বাচনোত্তর নতুন ব্যবস্থায় প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একজন করে জব এ্যাসিস্টেণ্ট নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয় । এই সকল পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মহকুমা শাসককে দেয়া হয় । মহকুমা শাসককে এই কাজে সাহায্য করার জন্য পঞ্চায়েত প্রতিনিধি ও সরকারী আধিকারিকদের নিয়ে মহকুমা শাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয় ।
আমার এলাকায় ৮১টি গ্রাম পঞ্চায়েত ছিল এবং সেই অনুযায়ী ৮১ জন প্রার্থী নির্বাচনের প্রশ্ন ছিল । মহকুমা শাসক হিসাবে আমার একটি প্রথম কাজ ছিল এই নির্বাচন সম্পূর্ণ করা আর তা নিরপেক্ষ ভাবে ও সততার সাথে করা । এই প্রার্থী নির্বাচন বাইরের সর্বপ্রকার হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ পরিহার করে নিরপেক্ষ ভাবে সম্পন্ন করতে কতগুলো বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছিলাম । সরকারী নির্দেশ ছিল লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন হবে । বিস্তারিত মহকুমা শাসক কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করবেন ।
কমিটির সঙ্গে আলোচনাক্রমে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৬০% লিখিত ও ৪০% মৌখিকের মধ্যে বিভাজন করা হল । লিখিত পরীক্ষায় যোগ্যতামান স্থির হল ঐ পরীক্ষার নির্ধারিত মোট নম্বরের ৪০ শতাংশ । চারজন আধিকারিক ও তিনজন পঞ্চায়েত প্রতিনিধিকে নিয়ে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার বোর্ড তৈরী হল । ইণ্টারভিউতে সাতজন সদস্যের পৃথক পৃথক ভাবে প্রদত্ত নম্বরের সরল গড়কে প্রার্থীর প্রাপ্ত নম্বর বলে গণ্য করার সিদ্ধান্ত হল । এই পদ্ধতিতে কোন প্রার্থীর ক্ষেত্রে কোন সদস্যের নম্বর প্রদানে পক্ষপাতিত্ব থেকে থাকলে তা সংশোধিত হয়ে যেত । আরো সিদ্ধান্ত হল লিখিত পরীক্ষা হবে ব্লকভিত্তিক অর্থাৎ প্রতিটি ব্লকের অন্তর্গত সব গ্রামপঞ্চায়েতের প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা একই সাথে ঐ ব্লকের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষাকেন্দ্রে হবে । লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরীর দায়িত্ব নিজের হাতে রাখলাম ।
আমি বুঝেছিলাম প্রার্থী নির্বাচনে রাজনৈতিক বা সদ্য গঠিত পঞ্চায়েতীরাজ কর্ম্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হলে নিজেকে ব্যক্তিগত ভাবে প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে । তাই প্রথম পর্যায়ে প্রার্থী নির্বাচন কমিটিকে প্রত্যয়ে নিয়ে উপর্যুক্ত মূল নির্বাচন পদ্ধতি স্থির করলাম ।
পরবর্তী পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন দিনে ভিন্ন ভিন্ন ব্লকের প্রার্থীদের পরীক্ষার দিন স্থির হল । নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আমি নিজে তৈরী করে পরীক্ষার দিন সকালে আমার ব্যক্তিগত তত্বাবধানে আমার গোপনীয় বিষয় সংক্রান্ত অফিসে টাইপ ও কপি করাতাম । পরে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য সীল করা খামে তা সংশ্লিষ্ট বিডিওর নিকট পাঠানো হত । উত্তরপত্রে প্রার্থীর নাম, নং ও পরিচয়জ্ঞাপক অন্যান্য বিবরণী লিপিবদ্ধ করার অংশের নীচে উত্তরপত্রের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটি সচ্ছিদ্র রেখা থাকত ।
পরীক্ষাশেষে উত্তরপত্র সংশ্লিষ্ট বিডিওর তত্বাবধানে ফিরে এলে আমি নিজে প্রতিটি উত্তরপত্রে একটি কোড নং দিয়ে নাম ঠিকানা লেখা অংশটি ছিঁড়ে নিয়ে আলাদা করে রাখতাম । সংশ্লিষ্ট ব্লকের সমস্ত উত্তরপত্রের ছিন্ন অংশ আলাদাভাবে একটি খামে সীলবদ্ধ অবস্থায় আমার গোপনীয় বিভাগে সুরক্ষিত থাকত । মূল্যায়ন হয়ে উত্তরপত্র ফিরে এলে কোড নম্বরের মাধ্যমে প্রার্থীকে সনাক্ত করে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে মেধা তালিকা তৈরী হত ।
অননুক্রমিক ভাবে বাছাই করা (Randomly selected) বিডিওদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল । যথার্থ মূল্যায়নের জন্য আদর্শ উত্তরপত্রও সঙ্গে দেয়া হয়েছিল । বিডিওদের মূল্যায়নের পর কিছু শতাংশ উত্তরপত্র আমি নিজে নমুনা পরীক্ষা করেছিলাম । লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে যারা যোগ্য বিবেচিত হল সেই সব প্রার্থীকে ইণ্টারভিউ বোর্ডের সম্মুখে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হল । প্রতিটি গ্রামপঞ্চায়েতের প্রত্যেকটি যোগ্য প্রার্থীর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর যোগ করে তিনজনের একটি মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয় । তালিকার সর্বপ্রথম উপলভ্য (available) প্রার্থীকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে তালিকাটি সংশ্লিষ্ট গ্রাম প্রধানকে পাঠানো হয় । প্রার্থী নির্বাচন ন্যায়সঙ্গত ও যথাযথ হয়েছিল । রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিল ।
প্রাথমিক ভাবে কয়েকজন গ্রাম প্রধান তাদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত না হওয়ায় নির্বাচিত প্রার্থীকে নিয়োগপত্র দিতে অস্বীকার করেন । এই ক্ষেত্রগুলিতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় । শেষ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই মেধা তালিকার সর্বপ্রথম উপলভ্য প্রার্থীই নিযুক্ত হয়েছিল ।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমি যে পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচন করেছিলাম তাতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সরকারী ইউনিট খুশী ছিল না । কিন্তু ওদেরকে এটা মেনে নিতে হয়েছিল কেননা পদ্ধতিটিতে কোন ত্রুটি ছিল না বা কারো বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগও ওঠে নি ।
বর্গা নথিভুক্তকরণ
আমার মহকুমা শাসকের কার্যকালে বর্গা নথিভুক্তকরণের (Barga recording) জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কার্যক্রম অপারেশন বর্গা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল । অন্যান্য স্থানের মত ঝাড়গ্রাম মহকুমায়ও এই কাজ পূর্ণোদ্দমে চলছিল । বর্গাদারদের এ বিষয়ে সচেতন করতে গ্রামাঞ্চলে সান্ধ্য শিবিরের আয়োজন করা হত । মহকুমার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক হিসাবে আমিও সময় সময় এরূপ শিবিরে উপস্থিত থাকতাম । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এটি ছিল একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক কার্যক্রম । হাজার হাজার বর্গাদার এই সময় যে জমিতে তারা বর্গাচাষ করত সেই জমির দলিলে নিজেদের নাম (বর্গাদার হিসাবে) নথিভুক্ত করায় । এর সুফল ওরা পরে পেয়েছিল । অপারেশন বর্গা ছিল ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের অধীনস্থ ভূমি সংস্কার এবং ভূ-বাসন শাখার যৌথ প্রয়াস । এই কার্যক্রম এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ভূবাসন ও জরিপ অধিকর্তা স্বয়ং অনেক সময় সান্ধ্য শিবিরে উপস্থিত হতেন ।
আনন্দোৎসব
ঝাড়গ্রাম মেলায় আদিবাসী নৃত্য
ঝাড়গ্রাম মেলা নামে একটি বার্ষিক মেলা ঝাড়গ্রামে অনুষ্ঠিত হত । এই উদ্দেশে একটি মেলা কমিটি ছিল যার সভাপতি ছিলেন মহকুমা শাসক ও সচিব ছিলেন মহকুমা কৃষি আধিকারিক । মেলায় আদিবাসী শিল্প ও সংস্কৃতিকে জনসমক্ষে তুলে ধরা হত । প্রদর্শনী ও বিক্রির উদ্দেশ্যে আদিবাসী হস্তশিল্পজাত দ্রব্যের স্টল স্থাপিত হত । মেলা প্রাঙ্গনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত । সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ মেলায় আসতেন । মেলায় কোন প্রবেশমূল্য ছিল না ।
ঝাড়গ্রাম উন্নয়ন পর্ষৎ: ঝাড়গ্রামের উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রকল্প রচনা ও রূপায়নের উদ্দেশ্যে ঝাড়গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রীর সভাপতিত্বে ঝাড়গ্রাম উন্নয়ন বোর্ড নামে একটি পর্ষদ ছিল । পর্ষদের অফিসের সরাসরি দায়িত্ব ছিলেন একজন সহকারী ইঞ্জিনিয়ার । তিনি গুটিকয়েক কর্মচারী নিয়ে বোর্ডের বিশেষ প্রকল্পগুলির দেখাশোনা করতেন ।
একটি স্থায়ী ভোট গণনা কক্ষ নির্মাণ
প্রতিবার নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে ভোট গণনার জন্য মহকুমা শাসকের অফিস প্রাঙ্গনে একাধিক অস্থায়ী কাঠামো তৈরী করে ভোট গণনা করা হত | এই অবস্থার আংশিক উন্নতিকল্পে ১৯৮০ সালের প্রাক নির্বাচন সময়ে নির্বাচনের বরাদ্দিকৃত অর্থ থেকে আমি মূল অফিস বিল্ডিং এর পশ্চাৎ দিকে একটা পাকা গণনা কক্ষ তৈরী করাই | কক্ষটিতে গণনা কালে মহকুমার সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটবাক্স সংরক্ষণের সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা ছিল |
নয়াগ্রামে লোধাহত্যা
আমি ঝাড়গ্রামের এসডিও থাকাকালীন নয়াগ্রাম থানা এলাকায় ১৩ জন লোধা হত্যার এক বীভৎস ঘটনা ঘটে । চাঁদাবিলা নামক স্থানের সন্নিকটে সুবর্ণরেখা নদীর বালিয়াড়িতে মৃতদেহগুলি পাওয়া গিয়েছিল । হত্যাকারীরা ছিল অজ্ঞাত পরিচয়, তবে তারা সাঁওতাল গোষ্ঠিভুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল ।
অপসৃয়মান লোধা উপজাতি ঐতিহাসিক ভাবে সাঁওতালদের জ্ঞাতিশত্রু । এরা নানারকম অপরাধমূলক কর্মে লিপ্ত থাকে । বৃটিশ সরকার এদেরকে অপরাধী উপজাতি বলে বিজ্ঞাপিত করেছিলেন । স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ১৯৫২ সালে ঐ নির্দেশনামা প্রত্যাহার করেন । লোধারা মূলতঃ অরণ্যবাসী । বিভিন্ন সময়ে সরকার এদেরকে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পুনর্বাসনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন ।
লোধা হত্যার এই বীভৎস ঘটনার কয়েক দিন পূর্বে আমি নয়াগ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলাম । সেই সময় আমি জানতে পারি চাঁদাবিলায় স্থাপিত পুলিশ শিবির গুটিয়ে নেয়া হয়েছে ও এর ফলে ঐ এলাকায় অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপ যথা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে । জনসাধারণ পুলিশের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং সাধারণ ভাবে এই ধারণা তৈরী হচ্ছে যে এই সব অপরাধে লোধারা জড়িত । প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে আমার আশঙ্কা হল সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিশোধের ঘটনা ঘটতে পারে । আমি এক অশুভ অনুভূতি নিয়ে সদর দপ্তরে ফিরলাম । ফিরেই আমি নয়াগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির উপর আমার মূল্য়ায়ন সম্পর্কে অবহিত করে মেদিনীপুরের পুলিশ প্রধানকে (SP) চিঠি পাঠালাম । চিঠিতে আমি পুলিশ প্রধানকে চাঁদাবিলায় পুলিশ শিবির পুনর্স্থাপন করে এলাকায় নিয়মিত নজরদারীর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলাম । জেলাশাসক ও মহকুমা পুলিশ আধিকারিককেও আমি অবহিত রেখেছিলাম ।
আমার জ্ঞানমতে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এর কয়েক দিনের মধ্যেই এই জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয় । এই ঘটনা প্রশাসনকে সজোরে নাড়িয়ে দিয়েছিল । কল্যাণমূলক পদক্ষেপ সহ লোধাদের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল ।
আমার ধারণা আমার চিঠি অনুসারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা যথাসময়ে গ্রহণ করলে এই মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যেত । তবে যাদের হাতে মূল নিয়ন্ত্রণ, যারা হয়ত পরিস্থিতিকে রক্ষা করতে পারতেন, তারা কিছুই করলেন না । ঘটনার পর জেলাশাসক আরক্ষাধ্যক্ষের (Superintendent of Police) কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমার চিঠির উপর কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল । পরবর্তী অবস্থান আমার জানা নেই ।
যে কোন কারণেই হোক এই গণহত্যার বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন দেখা যায় নি । এই হতভাগ্য মানুষজনের পক্ষে দাঁড়াবার কোন সংঘটন তদবধি গড়ে ওঠেনি । ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলার মত যথেষ্ঠ সংখ্যা না থাকাই হয়ত এর কারণ । এই মর্ম্মান্তিক ঘটনার দায় তদানীন্তন জেলাপুলিশের কোনভাবেই এড়াবার উপায় ছিল না । জানি না, শেষ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কি না ।
জেলা পরিষদ সদস্যের বিডিওকে অপমান: শাস্তি প্রাপ্তি
আমার কার্যকালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল; এবারেরটি ছিল রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ । একদিন, আমি তখন সবেমাত্র দুপুরের আহার শেষ করেছি, সেই সময় পুলিশ আর টির (RT: Radio telegraph) মাধ্যমে গোপীবল্লভপুর ১ নং ব্লকের বিডিওর কাছ থেকে সংবাদ পেলাম স্থানীয় জেলা পরিষদ সদস্য ওঁর সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন, তাই উনি ব্লক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন । আমি ফেরত আর টিতে বিডিওকে জানালাম, আমি ঘটনাস্থলে যাচ্ছি, আমি না পৌঁছুনো পর্যন্ত তিনি যেন ব্লক ত্যাগ না করেন । আমি তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বেরোতে যাচ্ছি, জেলাশাসকের ফোন । জেলাশাসক আমাকে নিশ্চিত করতে বল্লেন, বিডিও যেন স্থান ত্যাগ না করে বা এফ আই আর (FIR) না করে । আমি জেলাশাসককে জানালাম, আমি ঘটনাস্থলে যাচ্ছি । আমি যদি দেখি জেলাপরিষদ সদস্য অন্যায় করেছেন তবে আমিই বিডিওকে এফ আই আর (FIR) করতে বলব ।
আমি গোপীবল্লভপুর পৌঁছুলাম এবং বিডিও, বিডিও অফিসের কর্মচারী ও অন্যান্য আধিকরিকদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনাটির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেলাম । সমস্ত কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ ছিল, ওরা ইতিমধ্যেই কলম ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছিল । আমি বিডিওকে অবিলম্বে স্থানীয় থানায় এফ আই আর করতে পাঠালাম ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি যিনি পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মন্ত্রীসভায় একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়েছিলেন বিডিও অফিসে উপস্থিত হলেন । সঙ্গে ছিলেন সিপিএম এর মেদিনীপুর জেলা সেক্রেটারী দীপক সরকার মহোদয় । মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিডিওকে এফ আই আর না করার পরামর্শ দিতে আমাকে অনুরোধ করলেন ও বল্লেন যে ওদের পার্টির তরফ থেকে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে । ইতিমধ্যে এফ আই আর হয়ে গেছে জেনে এক সপ্তাহ তা কার্যকর করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করলেন । আমি রাজী হলাম. কিন্তু জানালাম যে এক সপ্তাহ পর এফ আই আর স্বয়ংক্রিয় ভাবে চালু হয়ে যাবে , । আমি থানার ওসি ও মহকুমা আধিকারিককে ঐ ভাবেই নির্দেশ দিলাম । সাতদিন পর যেন এফ আই আর এর প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায় তা আমি নিশ্চিত করেছিলাম ।
পরবর্তীকালে আমি জেনেছিলাম ঐ দোষী জেলা পরিষদ সদস্যকে ওর দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে । অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে মুলতুবী এফ আই আর অনুযায়ী ওর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলাও শুরু করা হয় ।
আমার অনুরোধে কর্মচারীদের সেদিনের কলম ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া হয় । যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দরুণ বিডিও ব্লক ত্যাগ করে যাওয়ার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেন । সংশ্লিষ্ট বিডিও ছিলেন রণজিৎ মাইতি ।
এক্ষেত্রে কেন আমাকে কঠোর হতে হয়েছিল
প্রশাসনের স্বার্থে আমাকে নিশ্চিত করতে হয়েছিল অপরাধী যেন বিনা শাস্তিতে পার না পেয়ে যায় । অন্যথায় দুষ্টলোক এই ধরণের ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হবে এবং যে কোন রাম, শ্যাম, যদু, মধু নিজেদের পছন্দমত কাজ না হলে বিডিও অফিসে ঢুকে বিডিওকে হেনস্থা করবে । এইরূপ পরিস্থিতি দূরবর্তী এলাকায় কর্মরত বিডিও বা অন্য অফিসারদের দক্ষতার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন করা কঠিন করে তুলবে । মহকুমার দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক হিসাবে আমার কর্তব্য আমার অফিসারদের যতটা সম্ভব সুরক্ষা দেয়া । আমার এইরূপ অভিমত জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও সিপিএম এর ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারিকেও জানিয়ে দিয়েছিলাম ।
কেন এই ঘটনায় রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য দেখা যায় নি
সিপিএম তখন বছর খানেক ক্ষমতায় এসেছে । নেতারা সব ছিলেন আদর্শে উৎসর্গীত, সৎ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল । তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ভদ্র, রুচিশীল ও যথার্থ শিক্ষিত । তাঁরা শক্ত হাতে হাল ধরতে চেয়েছিলেন । আমি যতদূর দেখেছি সভাধিপতি ছিলেন ন্যয়নিষ্ট ব্যক্তি । আমলারাও মূলতঃ ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও পক্ষপাতহীন ।
আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ধরণের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ কতটা সম্ভব হত আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলই বা তার দোষী সদস্যকে শাস্তি দিতে এগোত বা সমর্থ হত সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে । বছরের পর বছর ধরে সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ বিষিয়ে গেছে ।
দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম
আমার দ্বিতীয়া কন্যা ঝিলমিল ওরফে অনসূয়া ঝাড়গ্রামেরই একটি নার্সিংহোমে জন্মগ্রহণ করে । আমার প্রথমা কন্যার ৬ বছর পরে জন্ম নিয়ে ও আমাদের জন্য অনেক খুশী আর আনন্দ নিয়ে এসেছিল । সন্তান পুত্র বা কন্যা যাই হোক না কেন আমার কাছে তা সমান ছিল । এ ব্যাপারে আমার কোন পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নই ছিল না । আমার শিশুকন্যা আমার কাছে ততটাই বরণীয় যতটা সে পুত্র হলে হত । আমার একটাই আকাঙ্খা ছিল, পুত্র বা কন্যা যাই হোক না কেন সে বা তারা যেন মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, কোনদিন যেন কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয় । দুর্ভাগ্যবশতঃ বাস্তবে তা ঘটেনি । যা চাই নি, তাই হয়েছে ।
আমার দ্বিতীয়া কন্যা অনসূয়া ।
জন্ম ২৯শে এপ্রিল, ১৯৭৯
লোকসভা নির্বাচন পরিচালনা
ঝাড়গ্রামে কর্মরত থাকাকালীন আমি ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সহকারী রিটারনিং অফিসার হিসাবে ঝাড়গ্রাম মহকুমার বিধানসভা নির্বাচন ক্ষেত্রগুলোর এক্তিয়ারভুক্ত অঞ্চলে নির্বাচন পরিচালনা করেছিলাম । প্রসঙ্গত এটা ছিল সেই নির্বাচন যার ফলে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন ।
প্রজাতন্ত্র দিবস, ১৯৮০ । এসডিও হিসাবে ঝাড়গ্রামে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ।
ঝাড়গ্রামে প্রজাতন্ত্র দিবস ১৯৮০ । এসডিও হিসাবে গার্ড অফ অনার পরিদর্শন ।
আমার প্রস্থানের প্রাক্কালে ঝাড়গ্রামের পরিস্থিতি
ঝাড়গ্রামে আমার কার্যকালের শেষভাগে অশান্তি-উপদ্রবের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল । গোড়ার দিকে আমি ঝাড়গ্রামকে দেখেছিলাম শান্ত ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান । এখানকার জল হাওয়াও স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব উপকারী ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দানা বাধায় ও ঝাড়খণ্ড পার্টির উত্থানের ফলে ঝাড়গ্রাম ক্রমে ক্রমে অশান্ত হয়ে পড়ে । এইসব ঘটনা আমি নিয়মিত প্রদেয় গোপনীয় পাক্ষিক প্রতিবেদনে জেলাশাসকের গোচরে আনতাম যা পালাক্রমে সরকারের নিকট পৌঁছুত । তদানীন্তন ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত) ঐ পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়গ্রাম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন । পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিরাজমান অবস্থায় আমাকে ঝাড়গ্রামে থেকে যেতে বলেছিলেন । আমি ইতিমধ্যে অন্যত্র বদলী হয়ে গিয়েছিলাম ।
আমি ইতিমধ্যে চলে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম এবং মানসিক ভাবেও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম । এটি নিয়ে নতুন করে ভাবার পক্ষে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল । আমার অনুরোধে মন্ত্রীও জোর করলেন না । আমি যথাসময়ে ঝাড়গ্রাম ছেড়ে চলে গেলাম । আজ পেছনে তাকালে মনে হয় সেদিন আমি মন্ত্রীর কথায় রাজী হয়ে গেলে আমার বড় মেয়ের পড়াশোনার পক্ষে তা ভাল হত । জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ হয়ত ও অনেক বেশী পেত ।
ঝাড়গ্রাম থেকে প্রস্থান
ভারত সরকারের সেন্সাস উপ অধিকর্তা নিযুক্ত হয়ে ১৯৮০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর আমি ঝাড়গ্রাম মহকুমা শাসকের দায়িত্বভার ত্যাগ করি। আমার কনিষ্ঠা কন্যার বয়স তখন চার মাস । ঝাড়গ্রামে আমার উত্তরসূরী নিযুক্ত হলেন কাটোয়ায় কর্মরত আইএএস অফিসার অসীম বর্মন । ওঁর আসতে দেরী থাকায় আমি আমার অব্যবহিত অধস্তন আধিকারিককে দায়িত্বভার ন্যস্ত করি ।
ঝাড়গ্রাম মহকুমা শাসক হিসাবে আমার বিদায় সম্বর্ধনা । রয়েছেন এসডিও অফিসের অফিসারবৃন্দ, বিডিওরা, মহকুমা কৃষি আধিকারিক ও ঝাড়গ্রাম উন্নয়ন পর্ষদের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ।
ঝাড়গ্রামের সামাজিক জীবন
এখানে ডাক্তারদের মধ্যে অনেক ভাল বন্ধু ছিলেন । এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন একাধারে ডাক্তার ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক ললিত কুমার পাহাড়ী (এক্ষণে প্রয়াত) । আমার কনিষ্ঠা কন্যা ওরই নার্সিংহোমে ওর এবং ওর স্ত্রীর তত্বাবধানে জন্ম নিয়েছিল । ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের চিকিৎসকদের মধ্যে শিশু চিকিৎসক ডাঃ সেনগুপ্ত (প্রথম নাম বিস্মৃত) ও চক্ষু বিশারদ ডাঃ রঞ্জন রায় এবং ওদের স্ত্রীরা আমাদের ভাল বন্ধু ছিলেন । ওঁরা আমাদের বিশেষ অন্তরঙ্গ ছিলেন । আমার ছোট কন্যার জন্মের পর ডাঃ সেনগুপ্ত নিয়মিত ওর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আমার বাংলোয় আসতেন । একবার আমার ছোট মেয়ের তড়কা হয়েছিল । খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ সেনগুপ্ত ও ডাঃ পাহাড়ী ছুটে এসেছিলেন । যতক্ষণ না মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হল ততক্ষণ দুজনেই ওর পাশে ঠায় বসেছিলেন । আমার মেয়ের বয়স তখন ২-৩ মাস । ঐ দিনই ভূ-বাসন ও জরিপ অধিকর্তা দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যয় ঝাড়গ্রাম পরিদর্শনে এসেছিলেন । ওর মিটিং এ আমার থাকার কথা ছিল । কিন্তু মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার পরবর্তি অফিসারকে মিটিং এ পাঠিয়েছিলাম । পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু মনে করেন নি । পরে দেখা হলে মেয়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন ।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ভবতোষ মণ্ডল ছিল ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা । এখানে আসার পর শীঘ্রই ওর পরিবারের সাথে আমার পরিবারের পরিচিতি ও ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল ।
আমার নিজের অধীনস্থ এবং ঝাড়গ্রামে কর্মরত অন্যান্য বিভাগের অফিসারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ । বাইরের অফিসারদের নাম করতে গেলে যাদের কথা মনে আসে তারা ছিলেন মহকুমা তথ্য আধিকারিক কল্যাণ ঘোষ, পূর্ত বিভাগের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার অসীম মূখার্জি, ঝাড়গ্রাম পলিটেকনিকের অধ্যক্ষ মিঃ চন্দ, মহকুমা কৃষি আধিকারিক গোরাচাঁদ মূখার্জি, ইত্যাদি । এদের কয়েকজনের বাসভবনে আমাদের যাতায়াত ছিল । কল্যাণ ঝাড়গ্রামে থাকাকালীন বিয়ে করেছিল । ওর বিয়ের পার্টিতে খুবই আনন্দ হয়েছিল ।
আমার দ্বিতীয় অফিসার মৃদুল দাসগুপ্ত ছিলেন প্রমোটেড । ওঁর পুত্র এবং কন্যা রেশমী উভয়েই মেধাবী ছাত্র ছিল । মানুষ হিসাবে উনি সজ্জন ছিলেন; সর্বদা হাসিখুশী থাকতেন, ওকে কখনও রাগতে দেখিনি । তৃতীয় অফিসার মোহনলাল গুপ্ত ছিল বিহারের লোক । ওরও এক ছেলে, এক মেয়ে ছিল । দুর্ভাগ্যবশতঃ ওর মেয়েটি ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী । কোলকাতায় কর্মরত থাকাকালীন এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মোহন প্রাণ হারায় ।
আমরা ঝাড়গ্রামে বসবাসকারী অফিসারদের সঙ্গে যতটা সম্ভব সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতাম ।
আমার সময় মহকুমা পুলিশ আধিকারিক ছিলেন প্রথমে বি কে রায় ও পরে কানাই লাল বসু । প্রশাসনিক দিক থেকে এঁদের দুজনের কারো সঙ্গেই আমার কোন সমস্যা হয় নি ।
ঝাড়গ্রাম কেমন
মল্লদেব রাজত্বে ঝাড়গ্রাম মল্লভূমির রাজধানী ছিল । কথিত আছে সম্রাট আকবর ১৫৯২ সালে মান সিংকে এখানে পাঠিয়েছিলেন । সাঁওতাল, ভূমিজ, লোধা ইত্যাদি স্থানীয় আদিবাসী শাসকদের পরাজিত করতে সর্বেশ্বর সিং ও তার জ্যাষ্ঠ ভ্রাতাকে নিয়োগ করা হয়েছিল । সর্বেশ্বর সিং রাজপুত সেনা ও অশ্বারোহী বাহিনীর সাহায্যে জঙ্গলখণ্ডের গভীর অরণ্যে মল্ল উপজাতিদের পরাস্ত করেন । সর্বেশ্বর সিং পরে ঝাড়গ্রামকে রাজধানী করে নতুন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । মান সিংহ সর্বেশ্বর সিং ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে এখানে রেখে দিয়ে যান ।
যে সুদৃশ্য রাজপ্রাসাদে মল্লদেবরা বাস করতেন তা এখনও এই শহরে বর্তমান । মল্লদেব বংশের উত্তরসূরী বীরেন্দ্র বিজয় মল্লদেব সত্তর ও আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন । তিনি কংগ্রেস দলভুক্ত ছিলেন ।
বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত ঝাড়গ্রাম মহকুমাটি এক্ষণে জেলায় উন্নীত । ঝাড়গ্রাম শহরটি ছবির মত । রাস্তাগুলি দু পাশে দীর্ঘ তরুরাজির মধ্য দিয়ে সম্প্রসারিত । ঝাড়গ্রাম মহকুমা তথা জেলার ভূপ্রকৃতি তরঙ্গায়িত । উত্তরের বেলপাহাড়ী ও কাঁকড়াঝোরের চমকপ্রদ পরিসীমা থেকে দক্ষিণে এঁকে বেঁকে চলা সুবর্ণরেখা নদীর গতিপথ দ্বারা আবদ্ধ । কাঁকড়াঝোর ও হাতিবাড়ী দুটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র । বনবিভাগের তত্বাবধানে ও পরিচালনায় দুটিতেই রেস্ট হাউস রয়েছে । কাঁকড়াঝোর বাংলো থেকে রাত্রি বেলা দূরের জামসেদপুরকে একটি আলোকিত বর্তিকার মত দেখায় । ঝড়ের রাতে হাতিবাড়ী বাংলো থেকে সুবর্ণরেখা নদীর গর্জন শুনতে পাওয়া যায় । সেই গর্জন হৃদয়ে ভয়মিশ্রিত রোমাঞ্চের সৃষ্টি করে ।
মহকুমা শাসকের বাংলো
মহকুমা শাসকের বাংলো একটি অতি সুন্দর বাসস্থান, শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, শালে সেগুনে পরিবৃত । বাংলোর অঙ্গনে দু-চারটি কাজু গাছ, বাংলোর বিস্তৃত প্রাঙ্গনে মরসুমী ও আলঙ্কারিক পুষ্পের বাগান । এর এক অংশে এসডিওর গোপনীয় বিষয়সংক্রান্ত অফিস ছিল । একটি ফাঁকা অংশে মহকুমা কৃষি আধিকারিক গোরাচাঁদ মুখার্জির (বর্তমানে প্রয়াত) সাহায্যে আলু চাষের ব্যবস্থা করেছিলাম । ফলন মোটামুটি ভালই হয়েছিল । জেলে বন্দী সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরা এসডিওর বাংলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে নিয়োজিত হত । প্রসঙ্গক্রমে, এসডিও পদাধিকার বলে সাবজেলের অধ্যক্ষ ।
এই বাংলোর ও ঝাড়গ্রাম অবস্থানকালীন পূর্ববর্তী বাসস্থানের কিছু মধুর স্মৃতি আমার হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে আছে ।
বর্তমান কালের এসডিও বাংলো । এখানে জন্ম নেয়া আমার ছোটকন্যা প্রবেশপথে দণ্ডায়মানা ।
অনুভূতির বন্ধন
৫ বৎসর ১০ মাসের অধিক সময় আমি ঝাড়গ্রাম মহকুমায় বিভিন্ন ক্ষমতায় কর্মরত ছিলাম । এই সময় আমি একটি অফিস গুটিয়েছি, অপর একটি অফিস শূন্য থেকে শুরু করে অফিসের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, কর্মচারী ও অফিসারদের স্ব স্ব স্থানে স্থাপন করে অফিসটিকে সম্পূর্ণ চলমান অবস্থায় আনতে সমর্থ হয়েছি । এসডিও হিসাবে নিয়মিত প্রশাসনিক কার্য ব্যতীত আমি বেশ কয়েকটি জটিল অবস্থা সামলেছিলাম ও গুরুতর আইন শূঙ্খলা পরিস্থিতি না ঘটার বা নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম । অনস্বীকার্য সিভিল সার্ভেণ্ট হিসাবে ঝাড়গ্রামের এই অনধিক ছয় বৎসরের অভিজ্ঞতা আমার অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ।
আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা ও ঝাড়গ্রাম
ঝাড়গ্রামে একটি সিনেমা হল ছিল । আমি একবার স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ঐ হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম । সিনেমা চলাকালীন ইঁদুর আমার মেয়ের আঙুল কামড়ে দেয় । এরপর আমরা আর ঐ হলেও যাইনি বা ঝাড়গ্রামে থাকাকালীন কোন সিনেমাও দেখিনি । স্বভাবতঃই মেয়ের নিরাপত্তা সর্বাগ্রে বিবেচ্য ছিল ।
ঝাড়গ্রামে থাকাকালীন আমার বড় মেয়ের স্কুলে ভর্তির বয়স হয় । ওর বয়সী মেয়েদের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখে ও স্কুলে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করে । আমি ওকে সন্ন্যাসীনিদের দ্বারা পরিচালিত ঝাড়গ্রামের রামকৃষ্ণ সারদা বিদ্যাপীঠে কেজি শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দি । পরে ওকে রাণী বিনোদমঞ্জরী সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাই । ও মনোযোগ সহকারে পড়াশুনো শুরু করে । পড়াশোনার প্রতি ওর অনুরাগ ও আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল । এই সময় আমি ঝাড়গ্রাম থেকে বদলী হয়ে যাই । পরে মন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী চাইলেও আমি এখানে থাকার মেয়াদ বৃদ্ধিতে রাজী হলাম না । এই বদলী আমার মেয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল, যা পরবর্তীকালে হয়ত ওর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছিল । এর ফলে পরবর্তী জীবনে ওর জীবনধারায় মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে । যদিও এই বদলী প্রত্যাহার করাবার সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় তা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না ।
ক্রোড়পত্র
পরবর্তীকালে নবেম্বর ২০১৬ সালে ঝাড়গ্রাম ভ্রমণের সময় আমি দেখছি ১৯৭৪-৮০ সালে আমি যে সকল স্থানে কর্ম্মরত ছিলাম সেই সকল এলাকার প্রভূত উন্নতি হয়েছে । এগুলোকে নিম্নলিখিত ভাবে তালিকাভুক্ত করা যায়:
১ । ঝাড়গ্রাম শহরে জুবিলীমার্কেট এলাকায় রেললাইনের উপর একটি ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে যার ফলে রেল লাইনের দ্বারা বিভাজিত ঝাড়গ্রামের দুই অংশের মধ্যে যাতায়াত সহজতর হয়েছে ও এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ হয়েছে ।
২ । ঝাড়গ্রাম এসডিও অফিসের প্রাঙ্গন ঘিরে একটি বেষ্টনি দেয়াল তৈরী হয়েছে । এর দ্বারা অফিস প্রাঙ্গনে প্রশাসনিক ও পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের সুবিধা হয়েছে ।
৩। শহর চতুর্দিকে বিস্তার লাভ করেছে ।
৪ । পুরণো ৬নং জাতীয় সড়কের সংযোগকারী নয়াগ্রাম যাওয়ার রাস্তার প্রভূত উন্নতি হয়েছে । রাস্তাটি এখন রাজ্য সড়কের তকমা পেয়েছে ।
৫ । সুবর্ণরেখা নদীর উপর এখন কুটিঘাট (গোপীবল্লভপুর - ১) ও ভসরাঘাটে (নয়াগ্রাম) সেতু তৈরী হয়েছে (২০১৬ সালে চালু)। এর দ্বারা ঝাড়গ্রাম থেকে মেদিনীপুরের দাতন, কেশিয়াড়ী, দীঘা ও তৎপরবর্তী স্থানগুলিতে যাতায়াতের সুবিধাজনক বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে । এগুলি গোপীবল্লভপুর ও নয়াগ্রামের মানুষের জীবন সহজতর করবে ।