রাইটার্স বিল্ডিংস্, কোলকাতা
দায়িত্বভার গ্রহণ ও অবস্থিতি
১৯৮৭ সালের ২রা মার্চ আমি রাইটার্স বিল্ডিংসে শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের উপসচিব পদে যোগদান করি । এই বিভাগে আমি প্রায় তিন বৎসর কর্মরত ছিলাম ।
কর্তব্য ও দায়িত্ব
আমি দপ্তরের সেই শাখার ভারপ্রাপ্ত ছিলাম যা খনি ও খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত বিষয় দেখাশোনা করত । সেই সুবাদে আমি খনি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক সরকারী নীতি প্রণয়নের ও সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধেয়ক প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । খনি ও খণিজ সম্পদ অধিকার (Directorate of Mines & Minerals) ও পশ্চিমবঙ্গ খণিজ সম্পদ উন্নয়ন নিগম (West Bengal Mineral Development Corporation) এই শাখার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ছিল । কয়লা খনির ব্যাপারে রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত অংশটুকু এই শাখার কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল । অপ্রধান খণিজ পদার্থ যথা বালি, মাটি, পাথর, নুড়ি ইত্যাদি উত্তলোনের জন্য জমি লিজের দরখাস্ত ও প্রধান খনিজ পদার্থ প্রাপ্তির প্রত্যাশামূলক খননের (Prospecting License) লাইসেন্সের দরখাস্ত এই শাখায় বিবেচিত হত । এই শাখা থেকেই ঐ সব বিষয়ে লীজ বা লাইসেন্স দেয়া হত ।
আমার এখানকার কার্যকালে আমি কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গ চিনি শিল্প নিগমের (West Bengal Sugar Industries Corporation) অতিরিক্ত দায়িত্বেও ছিলাম ।
জেলা সফর
এই বিভাগে অবস্থানকালে লীজ সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয় সমস্যা সম্পর্কে অবগত হতে আমি অপ্রধান খনিজ সম্পদে সম্বৃদ্ধ কয়েকটি জেলা সফর করেছিলাম । এই সময়ে আমি লীজের দরখাস্ত সুপারিশ করার সময় কি কি বিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে জেলার খনিজ পদার্থের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম । সেতু ও রাজপথের বিধিবদ্ধ নিষিদ্ধ দূরত্বের মধ্যে বালি তোলা রোধ করতে প্রতিরোধমূলক কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা নিয়েও আলোচনা হয় ।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও তা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
এখানে আমি একটি বিষয়ের অবতারণা করছি যেখানে আবেদনকারীর লীজ প্রত্যাখ্যান করার সরকারী আদেশের বিরুদ্ধে আনা রিট পর পর আদালতে ব্যর্থ হয়েছিল । প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের প্রতি যথাযথ অভিনিবেশ সহকারে আমি বিষয়টিকে পরীক্ষা করেছিলাম । হুগলী জেলার কোন এক লীজধারীর পুত্র তার পিতার বালি উত্তোলনের লীজ নবীকরণের দরখাস্ত করেছিল । নবীকরণের প্রস্তাব সহ সংশ্লিষ্ট ফাইল আমার কাছে পেশ করা হলে আমি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম লীজধারী মৃত এবং লীজের মেয়াদ অতিক্রান্ত । আমার বক্তব্য ছিল লীজধারীর মৃত্যু হওয়ায় ওর নামে লীজ নবীকরণ হতে পারে না । আমার আরেকটি বক্তব্য ছিল লীজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় এবং সেই হেতু ঐ সময় অবর্তমান থাকায় লীজের অন্তর্ভুক্ত এমন কোন সম্পত্তি ছিল না যা মৃতের উত্তরাধিকারীরা তাদের নামে হস্তান্তরিত করার দাবী করতে পারে । আমার আশঙ্কা ছিল আবেদনকারী আদালতে যাবে । আমি সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা উল্লেখ করে স্পিকিং অর্ডারের খসড়া তৈরী করলাম । যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে লীজ নবীকরণ আবেদন প্রত্যাখানের আদেশ জারী হল ।
আদেশের বিরুদ্ধে আবেদনকারী প্রথমে হাইকোর্টের একক বেঞ্চে রিট করল, কিন্তু হেরে গেল । মাননীয় বিচারপতি তাঁর সিদ্ধান্তে বললেন এই আদেশে হস্তক্ষেপ করার কোন কারণ দেখছেন না । আবেদনকারী একক বেঞ্চের আদেশের বিরুদ্ধে ডিভিসন বেঞ্চে আপীল করল । কিন্তু সেখানেও একক বেঞ্চের আদেশই বহাল রইল । আমার জ্ঞানমতে বিষয়টির এই ভাবেই নিষ্পত্তি হয়েছিল ।
এই উদাহরণটি এটা দেখাতেই উল্লেখ করলাম যে সরকারী স্তরে যদি এ ধরণের বিষয় যথাযথ বিবেচনায় ও উপযুক্ত কারণ দিয়ে নিষ্পত্তি করা যায় তবে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ অনেকটাই আটকানো যায় । দুষ্ট লোকেরাও আইনের ফাঁক দিয়ে অনভিপ্রেত সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হয় ।
সংবিধানের ২২৬ ধারায় সরকারের বিরুদ্ধে অসংখ্য কেস হয় যার অনেকগুলিই ক্ষুব্ধ ব্যক্তিজনের দ্বারা সরকারের নিকট আনীত বিভিন্ন বিষয়ের যথাযথ নিষ্পত্তি না হওয়ার দরুণ হয় । এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে কোর্টের কাছে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হয় ।
পশ্চিমবঙ্গ চিনি শিল্প উন্নয়ন নিগমে আমার অভিজ্ঞতা
এই বিভাগে থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গ চিনি শিল্প উন্নয়ন নিগমের পরিচালন অধিকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল । শিল্প বাণিজ্য দপ্তরের সচিব পি কে সরকার মহাশয় যখন ঐ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে সরাতে চাইলেন তখন তাঁর ইচ্ছায় আমি এই অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করি । শ্রীসরকার একজন সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন । আমি ১০ই আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে এই পদে যোগ দিই । ঐ বছরেরই ৩০ শে ডিসেম্বর কার্যভার ত্যাগ করি ।
এখানে কর্মরত থাকার সময় নিগমের বিভিন্ন বিষয়ে নানাধরণের বেনিয়ম আমার নজরে আসে । বীরভূমের আমেদপুরে নিগমের একটি চিনিকল ছিল । এই কলটিকে সক্রিয় রাখতে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রাংশ ও উপাদান প্রচুর পরিমাণে ক্রয় করতে হত । কিন্তু কোন ক্রয় নীতি ছিল না, কোন যথার্থ ইনভেণ্টরি বা স্টক রেজিষ্টার ছিল না । ক্রয় করার পদ্ধতি স্বচ্ছ ছিল না, প্রতিষ্ঠিত নিয়মানুসারী ছিল না। বিষয়টি দুর্নীতি নির্দেশক ছিল । কিন্তু আখ পেষাইর মরসুমের পূর্বে উপলভ্য সময়ের মধ্যে মিলের স্বাভাবিক ক্রিয়া অক্ষুণ্ণ রেখে কোন বৃহত্তর সংশোধন করা বা পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না । যেখানে সম্ভব সংশোধন করার চেষ্টা করেছিলাম । এ বিষয়ে জড়িত কিছু কর্মীকে সনাক্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম ও পারচেজ অফিসারকে ছুটিতে পাঠিয়েছিলাম । আমি বুঝেছিলাম পারচেজ অফিসারের উপরের স্তরেরও কেউ কেউ এর সাথে জড়িত । কিন্তু সময়ের অভাব ও কার্যের পরিধি আমাকে আর এগোতে দেয় নি । তবে আমি দপ্তরকে অবহিত করে রেখেছিলাম । আমার স্বল্প সময়ের অবস্থানে যতটা সম্ভব আমি নিগমের গঠনতন্ত্রকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে ও ছিদ্রপথ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছি ।
নির্বাচন পরিচালন কার্যে নিয়োজন
যেমন আমি পূর্বে (আমার ডিপিএপিতে কার্যকালের বিবরণীতে) বলেছি, এই দপ্তরে যোগদানের সাথে সাথেই আসানসোল মহকুমায় নির্বাচন পরিচালন কার্যে বর্ধমানের জেলাশাসককে সাহায্য করতে আমাকে নিয়োজিত করা হয় । দপ্তরে যোগদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখ্যসচিব আমায় ডেকে পাঠিয়ে বলেন, "আসানসোলের ইলেকশনের কাজে কি সব গণ্ডগোল হয়েছে, বর্ধমানের ডিএম আপনাকে চাইছেন । আপনাকে আসানসোল যেতে হবে, ওখানে ক্যাম্প করে কয়েক দিন থাকতে হবে ।" না বলার প্রশ্নই ছিল না; চলে গেলাম । নির্বাচন সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত ওখানে রইলাম, বার্ণপুর ইসকো (IISCO) গেষ্টহাউসে আমাদের (আমি ও আমার এক জুনিয়র সহকর্মীর) থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল । সতীশ তিওয়ারী নামে একজন তরুণ আইএএস অফিসার তখন আসানসোলের এসডিও ছিলেন । মূলতঃ ভোটকেন্দ্র অনুসারী ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও বিভাজনের বিষয়টি তালগোল পাকিয়ে ছিল । এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল । স্থানীয় কর্মচারী ও অফিসারবৃন্দ সহ সকলের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও পরিশ্রমে সমস্যাগুলির কাজ চালাবার মত সমাধান সম্ভব হয়েছিল । নির্বাচনও যথাযথভাবে সমাধা হয়েছিল । ফলাফল ঘোষণার পর আমরা ফিরে এসেছিলাম ।
নির্বাচন পরিচালনা একটি অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রক্রিয়া । যথাযথ জ্ঞান ও বিস্তারিত পরিকল্পনার অভাবে গুরুতর সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে । আসানসোলের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল । তা ছাড়া প্রশাসনিক নেতৃত্বেরও অভাব ছিল ।
শিল্প-বাণিজ্য দপ্তর থেকে বিদায়
১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারী রাজ্যপালের উপসচিব হিসাবে কাজে যোগ দিতে আমি শিল্পবাণিজ্য বিভাগ ছেড়ে যাই । তদানীন্তন রাজ্যপাল টি ভি রাজেশ্বর আমার ও আমার এক সহকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়ে আমাকে এই পদে নির্বাচিত করেছিলেন ।