মেখলিগঞ্জ মহকুমা শাসকের বর্তমান অফিস ভবনের একাংশের চেহারা
সূচীপত্রের যে কোন বিষয়ের উপর ক্লিক করে সেই বিষয় সংক্রান্ত অংশে যাওয়া যাবে ।
সূচীপত্র
বদলী ও দায়িত্বগ্রহণ
বহরমপুর থেকে আমি কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমায় বদলী হলাম ।
১৯৬৮ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে আমি যখন বহরমপুরে প্রশিক্ষণাধীন সেই সময় কোচবিহার জেলার অবেক্ষাধীন উপশাসক ও উপসমাহর্তা হিসাবে আমার বদলীর সরকারী নির্দেশ পেলাম । তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে ঐ জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমায় আমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল । মেখলিগঞ্জ একটি অবহেলিত ও নৈরাশ্যজনক স্থান হিসাবে পরিচিত ছিল । অফিসাররা ওখানে বদলী হওয়াকে সর্বতোভাবে পরিহার করার চেষ্টা করতেন । বহরমপুরে আমার অতিরিক্ত জেলাশাসক অনীশ মজুমদার[1] মহাশয় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি ওখানে যেতে ইচ্ছুক কি না । সম্ভবতঃ আমি ওঁর মাধ্যমে আমার এই বদলীর নির্দেশ বাতিল করাতে পারতাম । কিন্তু আমার মনে হয়েছিল কর্ম্মজীবনের প্রারম্ভেই দুরূহ ও অন্তরবর্তী (interior) অঞ্চলে কাজ করাটা সমীচীন । ইতিমধ্যে লব্ধ আমার নির্বিশঙ্ক মানসিকতাও বোধহয় এ বিষয়ে আমাকে প্ররোচিত করেছিল । পূর্বাপর বিবেচনা না করে কেবল ধারণার আর আবেগের বশবর্তী হয়ে নেয়া এই সিদ্ধান্ত আমার পরবর্তী জীবনে ও চরিত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল । ঐ স্থানের নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা সম্পর্কে আমার যদি কোন প্রত্যক্ষ ধারণা থাকত তবে অবশ্যই আমার সিদ্ধান্ত অন্যরূপ হত ।
যাহোক, আমি ১৯৬৮ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর আমার নতুন পদে যোগ দিলাম । শয্যাসামগ্রীর একটি ছোট হোল্ডল এবং একটি স্টীলের ট্রাঙ্কে কিছু পরিধেয়, পাঠ্যবস্তু ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে আমি মেখলিগঞ্জে পৌঁছেছিলাম । আমার বস্তুসামগ্রীর মধ্যে বহরমপুরে থাকাকালীন কোন সংযোজন ঘটেনি । ফলে যা নিয়ে চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলাম তাই নিয়েই এখানে এলাম । ব্যাঙ্কের বইতে অবশ্য মাইনে থেকে খরচের উদ্বৃত্ত শ পাঁচেক টাকা ইতিমধ্যে যোগ হয়েছিল ।
আমার কর্মস্থান ও বাসস্থানের বাস্তব চিত্র
পরিমার্জিত ডাকবাংলোর ২০১৫ সালের চিত্র
ডাকবাংলোর প্রশস্ত প্রাঙ্গনে দশকের পর দশক অরক্ষিত ভগ্নপ্রায় কাঠামোর ২০১৫ সালের চিত্র ।
মেখলিগঞ্জের মহকুমা শাসকের নিয়ন্ত্রণাধীন একমাত্র ডাকবাংলোতে ‘নান্যং পন্থা’ হয়ে আমি দু বছরের কাছাকাছি সময় বাস করেছি । অনধিক চার হাজার জনসংখ্যা বিশিষ্ট ক্ষুদ্র এই জনপদে অবিবাহিত যুবকের জন্য ভাড়াবাড়ী লভ্য ছিল না । এখানকার এই তথাকথিত ডাকবাংলোটি আমি বহরমপুরে পৌঁছে যে ডাকবাংলোয় ছিলাম তার থেকেও নিম্নমানের ছিল । বাংলো শব্দটি-ই এখানে একটি মিস্নৌমার বা নামের অপপ্রয়োগ (misnomer) বলা যেতে পারে । বস্তুতঃ এটি শোভনীয় ভাবে বাসেরই উপযোগী ছিল না ।
কিন্তু চাকুরী জীবনের প্রভাতে পর পর দেখা প্রথম দুটি ডাকবাংলোই এরূপ নিম্নমানের হওয়ায় এই নামের রাত্রি যাপনের সরকারী আবাসগুলি সম্পর্কেই আমার মনে এক বিরূপ ধারণা তৈরী হয়েছিল । এই তথাকথিত ডাকবাংলোটি আমি বহরমপুরে পৌঁছে যে ডাকবাংলোয় ছিলাম তার থেকেও নিম্নমানের ছিল । বাংলো[2] শব্দটি-ই এখানে একটি মিস্নৌমার বা নামের অপপ্রয়োগ (misnomer) বলা যেতে পারে । বস্তুতঃ এটি শোভনীয় ভাবে বাসেরই উপযোগী ছিল না । তবে ইতিমধ্যে সরকারী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় বহরমপুরের মত তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়া এবার হল না । তবে চাকুরী জীবনের প্রভাতে পর পর দেখা প্রথম দুটি ডাকবাংলোই এরূপ নিম্নমানের হওয়ায় এই নামের রাত্রি যাপনের সরকারী আবাসগুলি সম্পর্কেই আমার মনে এক বিরূপ ধারণা তৈরী হয়েছিল । আমার এই মনোভাবের পরিবর্তন হয় পরে যখন আমি কোচবিহার, বর্ধমান ও অন্যান্য জেলা শহরের ডাকবাংলোগুলি দেখি যেগুলি অপেক্ষাকৃত উন্নত মানের ছিল । তবে তখন দু-একবারের বেশী আমার আর ডাকবাংলোয় থাকার প্রয়োজন হয় নি, জেলায় গেলে সাধারণতঃ সার্কিট হাউসেই থাকতাম।
মেখলিগঞ্জের এই ডাকবাংলোটি ছিল টিনের ছাদ দেয়া দুজনের উপযোগী দুটি স্বল্পপরিসর দু কামরার পাকা বাড়ী । দুটি কামরার মধ্যবর্তী স্থলে ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুম গোছের একটি সামান্য বড় ঘর ছিল । সেখানে একটি উপবৃত্তাকার টেবিল ও গুটিকয়েক চেয়ার ছিল । কামরা দুটির প্রতিটিতে ছিল একটি করে একক শয্যা, আয়নাযুক্ত একটি ছোট টেবিল ও একটি চেয়ার । প্রতিটি কামরার সাথে কাঠের কমোড সহ একটি করে সংলগ্ন ছোট বাথরুম ছিল । কমোডে পরিত্যক্ত মল প্রতিদিন জমাদারকে দৈহিকভাবে অপসারণ করতে হত । বাড়ীটিতে বিজলী ছিল না । জলের জন্য চৌহদ্দির ভিতর একটি বৃত্তাকার কুঁয়ো ছিল । (বর্তমান কালের চিত্র বাম পার্শ্বে) অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্ম্মচারীরা কুঁয়ো থেকে জল তুলে বাথরুমে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করত । চৌহদ্দিটি ছিল দীর্ঘ পরিসর । এর ভিতর একটি টিনের চালায় বাংলোয় অবস্থানকারীদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা ছিল । বাংলোর পরিধির ভিতর বিভন্ন ধরণের কয়েকটি গাছের মধ্যে একটি তালগাছও ছিল । এটিকে দেখলেই ছোটবেলায় পড়া কবিগুরুর সেই "তালগাছ" কবিতাটি আমার মনে পড়ে যেত,
"এক পায় দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে" ।
বাংলোর একটি ঘর প্রায় সময়ই খালি থাকত । প্রকৃতপক্ষে আমিই ছিলাম বাংলোর একমাত্র বাসিন্দা, অনেকটা বাংলোর অঙ্গনে স্বগোত্রীয় একটি মাত্র তালগাছের মত । উপযুক্ত বিকল্প বাসস্থানের সংস্থান না থাকায় আমাকে দু বছরের অধিক সময় এই ব্যবস্থা মেনে নিতে হয়েছিল । মনে হয় বাল্য ও কৈশোর জীবনের অভিজ্ঞতা আমার এখানকার অবস্থানকে সহনীয় করে তুলতে সাহায্য করেছিল ।
বামপার্শ্বের দ্বিতীয় চিত্রটি মূল ডাকবাংলো ভবন ব্যতিরেকে প্রাঙ্গনমধ্যে স্থিত অন্যান্য কাঠামোগুলির বর্তমান অবস্থা (ডিসেম্বর ২০১৫) নির্দেশ করছে । বিস্ময়কর ভাবে আমার এখানে অবস্থানকালের পর কালের আঘাতের ক্ষয়ক্ষতি ব্যতীত এই কাঠামোগুলোর কোন পরিবর্তন হয় নি । দীর্ঘ কয়েক দশক সময়ের মধ্যে এদের কোন রক্ষণাবেক্ষণও হয় নি । পুণর্গঠিত ডাকবাংলো এবং এই পরিত্যক্ত কাঠামোগুলো এক চমকপ্রদ বৈপরিত্যের নিদর্শন । এই কাঠামোগুলো নিরীক্ষণ করে আমাদের সময়কার ডাকবাংলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা গঠন করা যেতে পারে । কথিত বৈপরিত্যের সঙ্গে সমতা রেখে আমার সময়কার একমাত্র তালগাছটিও যেমন ছিল তেমনি আছে ।
চাকুরীস্থল ও বাসস্থান সম্পর্কে আমার অনুভূতি
মেখলিগঞ্জ নামের যে গ্রামীন শহরে আমাকে দীর্ঘ চার বৎসরের অধিক কাল বাস করতে হয়েছিল সেখানে উৎকৃষ্ট জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় অনেক উপাদানের অভাব থাকায় আমাকে যথেষ্ট মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল । বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্নতা ও আমোদপ্রমোদের অভাব আমার অন্তরে বিষণ্ণতা ও হতাশার সৃষ্টি করত । বয়ঃসন্ধিকাল থেকে আমি কখনও এরূপ নিস্তেজ পরিবেশে বাস করিনি । যে ডাকবাংলোতে আমাকে থাকতে হয়েছিল তাও বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে অত্যন্ত নিম্নমানের ছিল ।
তবে আমাকে এটাও স্বীকার করতে হবে যে ঐ বাড়ীতে অবস্থান আমার কাছে অবিমিশ্র কষ্টের ছিল না । এটি আমার মধ্যে সুপ্ত কাব্যিক ও রোমান্টিক অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলত । প্রায়শঃ আমি প্রকৃতির বাসিন্দা হয়ে যেতাম । কৃষ্ণপক্ষের রাতে আমার ঘরে অতিথি হয়ে আসা জোনাকির ঝাঁক এখানে ওখানে মিটমিটে আলোর দীপ্তি দিয়ে আমাকে সঙ্গ দিত । শুক্লপক্ষের রাতে চাঁদের কোমল আলো ঘরের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে এক মাায়াবী বাতাবরণের সৃষ্টি করত । জ্যোৎস্না-স্নাত শয্যায় শুয়ে দূর আকাশে চাঁদ দেখতে দেখতে আমি যেন এক স্বপ্নের জগতে চলে যেতাম । বর্ষাকালের গভীর রাতে কখনও কখনও মেঘের গর্জনে ও বিদ্যুতের চমকে আমার ঘুম ভেঙে যেত । বিছানায় শুয়ে টিনের ছাদে বর্ষণের সুরেলা ধ্বনির সঙ্গে দূরাগত ঝিঁঝিঁর ডাকের সংমিশ্রণের মধুর ঐকতানে আমি আবিষ্ট হয়ে পড়তাম । মাঝে মাঝে বজ্রনিনাদে বাড়ীটি কেঁপে কেঁপে উঠত । মধ্যরাতের নির্জনতায় আমি একা শুয়ে শুয়ে এই রোমাঞ্চকর আবহ উপভোগ করতাম । থেকে থেকে আমি বিশেষ কারো সঙ্গ কামনায় ব্যকুল হতাম । আমার মধ্যে এক রোমাণ্টিক ভাবের উদয় হত ।
ছেড়ে আসার ৪৩ বৎসর পর আমার এক কালের বাসস্থান
২০১৫ সালে মেখলিগঞ্জ ভ্রমণের সময় আমার নজরে আসে আমার এককালের বাসস্থান ডাকবাংলোটির পূর্ণ সংস্কার হয়েছে (শিরনামযুক্ত চিত্রটি উপরে বাম পার্শ্বের প্যনেলে প্রদর্শিত)। পুনর্ঘঠিত ডাকবাংলোয় একটি সম্মুখ বারান্দা যুক্ত হয়েছে । আমাদের সময় বাংলোর প্রতিটি কক্ষে একটি করে ছোট জানালা ছিল । এই জানালা দুটির আয়তন বাড়িয়ে প্রামাণ্য মাপের করা হয়েছে । বারান্দা থেকে সরাসরি নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশের জন্য বারান্দার দিকে দু পাশের কক্ষ দুটির প্রবেশদ্বার তৈরী হয়েছে । পুরনো কালে কেবল ডাইনিং হল থেকে নির্দ্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করা যেত । বাহ্যতঃ কক্ষ দুটির পরিমাপও বৃদ্ধি পেয়েছে । তবে তা যাচাই করে দেখার সুযোগ আমার হয়নি । বাংলোটিতে বিদ্যুৎ ও এসি সংযোগ দেয়া হয়েছে, বাথরুম ও টয়লেট ব্যবস্থারও আধুনিকিকরণ হয়েছে । এক কথায় ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকের বৈপরীত্যে বাংলোটিকে এখন বাসযোগ্য করা হয়েছে । কিন্তু যেমন পূর্বে বলেছি, প্রাঙ্গন মধ্যস্থিত অন্যান্য কাঠামোর কোন পরিবর্তন হয়নি ।
মহকুমা শাসক ব্যতীত অন্যান্য আধিকারিক
নববিবাহিতা স্ত্রী ছবি সহ বলাই
এখানে বরিষ্ঠতায় মহকুমা শাসকের পরবর্তী স্তরের অফিসারের (যাকে সেকেন্ড অফিসার বলা হত) জন্য একটি সরকারী বাসস্থান নির্দিষ্ট ছিল । আমি যখন এখানে আসি সেই সময় এই বাড়ীটি আমার বরিষ্ঠ (senior) সহকর্ম্মী বলাই চন্দ্র চক্রবর্তীর দখলে ছিল । সে তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বাস করত । শীঘ্রই বলাই এবং ওর স্ত্রী ছবি আমার ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছিল । আমরা একবার শীতকালে ফুন্টশিলিং পিকনিক করতে গিয়েছিলাম । সেখানে শুষ্ক বালাসোন নদীর খাতে তোলা এই দম্পতির একটি ছবি বাম পার্শ্বের প্যানেলে দেখা যাচ্ছে ।
আমি যখন মেখলিগঞ্জে কাজে যোগ দি সেই সময় মহকুমা শাসকের অফিসে বলাই-ই একমাত্র অন্য অফিসার ছিল । বলাই ১৯৬৬-ব্যাচের WBCS (Executive) অফিসার ছিল । বলাই প্রায়শঃ আমায় দুপুরের বা রাতের আহারে নিমন্ত্রণ করত । ওর স্ত্রী তখনও রান্নাবান্নায় পারদর্শিনী হয়নি । ওদের একটি রান্নার লোক ছিল, নাম দাসু । দাসুই রান্না করত ও গৃহকর্ত্রীকে রান্না শেখাত । বলাইর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে । আমরা একই বাড়ীতে বাস করি । এই সমবায় মালিকানা ভিত্তিক বাড়ীতে আমার অংশগ্রহণে মূল অবদান বলাইরই । দুর্ভাগ্য বশতঃ প্রায় এক দশক পূর্বে বলাইর স্ত্রী পরলোক গমন করেন । বর্তমানে বলাই অবিবাহিত পুত্রকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে রয়েছে ।
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বলাই মেখলিগঞ্জ থেকে বদলী হয়ে যায় । বলাইর বদলির পূর্বে অমল কিস্কু নামে একজন ডব্লুবিসিএস অফিসার ওর স্থলাভিষিক্ত হয় । শ্রী কিস্কু সাঁওতাল শ্রেণীভুক্ত ও বিবাহিত ছিল । ওর জাতিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য অনুযায়ী ও ছিল সহজ, সরল । অফিস থেকে কিছু দূরে ভাড়া বাড়ীতে ও সস্ত্রীক বসবাস করত । একবার সাইকেলে অফিসে আসার পথে অ্যাক্সিডেণ্টে পড়ে ওর পা ভেঙ্গে যায় । পায়ে প্লাস্টার নিয়ে ওকে কয়েক সপ্তাহ শয্যাশায়ী থাকতে হয় । ওকে তখন বাড়ী থেকে কাজ করতে দেয়া হয়েছিল ।
সেকেণ্ড অফিসারের সরকারী বাসভবন: সেথায় আমার দিনগুলি
সেকেণ্ড অফিসারের বাসভবন: ২০১৫-সালের চিত্র
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বলাই বদলী হয়ে মেখলিগঞ্জ ছেড়ে চলে যায় । ঐ সালের নবেম্বর মাসে আমি ডাকবাংলো ছেড়ে সেকেন্ড অফিসারের জন্য নির্দ্দিষ্ট এই বাসভবনে চলে আসি; বরিষ্ঠতায় আমি তখন সেকেন্ড অফিসার । আমার নতুন বাসস্থানের পেছনে মেখলিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের সরকারী কোয়ার্টার ছিল, উত্তরে ছিল পুলিসের সার্কেল ইনস্পেক্টরের বাসস্থান । দক্ষিণের বাড়ীগুলোতে থাকত সাবজেলার ও জেলের ওয়ার্ডাররা । আমার বাসভবনের সীমানা চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল; সামনে ও পেছনে একটি করে ফটক (gate) ছিল । মূল ফটকটি ছিল পেছন দিকে, থানার ওসির কোয়ার্টারের বিপরীতে । আমার বাসভবন ও সাবজেলের ওয়ার্ডারদের বাড়ীগুলোর মাঝে তিনটি বিশালকায় পুরণো সেগুন গাছ ছিল, যার প্রতিটির পরিসীমার পরিমাপ ছিল কয়েক মিটার । এই গাছগুলোর পাশে আমার বাংলোর চৌহদ্দির ভেতর একটি কলাগাছের ঝোপ ছিল । এই প্রেক্ষাপটে ভোরের আলো-আঁধারিতে উপলব্ধ কতকগুলো স্মরণীয় মুহূর্ত মাঝে মাঝে মনকে নাড়া দিয়ে যায় । আমার মেখলিগঞ্জ অবস্থানের এক উল্লেখযোগ্য অংশ (এক বৎসর চার মাস কাল) আমি এই মাঝারি মাপের বাংলোয় একাকী কাটিয়েছি । আমাসু নামে একটি স্থানীয় ছেলে আমার রান্নাবান্না ও এটা-সেটা কাজ করে দিত । আমাসু ভাল রাঁধুনি ছিল না; তবে ওকে দিয়েই আমি কোনভাবে চালিয়ে নিতাম । খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমি কোনদিনই খুঁতখুঁতে ছিলাম না । কয়লার উনুনে রান্না হত । এল পি জি তখনও চালু হয় নি ।
আমার বাসভবনের পশ্চাতে মেখলিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের বাসভবন
আমার বাসভবনের চৌহদ্দির বাইরে জেলওয়ার্ডদের কোয়ার্টারের গা ঘেঁসে অতিকায় একটি অতি প্রাচীন সেগুন বৃক্ষ । হেডওয়ার্ডারের কোয়ার্টারের পশ্চাতে এই বৃক্ষটির তলদেশে একটি সরু পায়ে-চলা পথ ছিল ।
আমার বাঙ্লোর পাশে জেলের হেডওয়ার্ডারের কোয়ার্টারের এই সেই পশ্চাদদিক যেখানে প্রাতঃকালে নিকটের কোন বাসভবন থেকে আমাতে আগ্রহী একজন শুভার্থিনী এসে দাঁড়াতেন ।
মহকুমা শাসকের অফিস ও একই প্রাঙ্গনে অন্যান্য অফিস সমূহ
মহকুমা শাসকের অফিসের কর্মচারীবৃন্দ
মেখলিগঞ্জ মহকুমা শাসকের তদানীন্তন অফিস ছিল কতগুলো ছোট ছোট পাকা বাড়ীর সমাহার । এর মধ্যে একটিতে কোর্ট রুম ও ব্যাঙ্কিং ট্রেজারী অবস্থিত ছিল । এই পুরণো বাড়ীটিতে বিদ্যুৎ ছিল নাা । এখানেই কোর্ট সংলগ্ন অংশে আমার ও বলাইর অফিস চেম্বার ছিল । বিদ্যুৎহীন বাড়ীটিতে গরমকালে হাতে টানা পাখার ব্যবহার হত । ঐ সময় পাখা টানার জন্য পাঙ্খাপুলার নামে চতুর্থ শ্রেণীভূক্ত কয়েকজন মরসুমী কর্মচারী নিয়োগ করা হত ।
অপর একটি সন্নিহিত বাড়ীতে ছিল মুন্সেফ কোর্ট ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস । একাকীত্বের স্বাভাবিক নিয়মে তরুণ সাব-রেজিস্ট্রার শীঘ্রই আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল । মুন্সেফ কোর্টটি ছিল সার্কিট কোর্ট, মাসে নির্দ্দিষ্ট দিনগুলোতেই কোর্ট বসত । সার্কিট মুন্সেফও মেখলিগঞ্জে থাকতেন না । বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর মুন্সেফ কোর্টের বাড়ীটি বিচারবিভাগীয় কোর্টে রূপান্তরিত হয় ।
মেখলিগঞ্জ মহকুমা শাসকের অফিসে একাধিক সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ কর্মচারী ছিলেন । এঁদের পুরোধা ছিলেন বড়বাবু মলিনা মোহন সরকার । তিনি কাজপাগলা মানুষ ছিলেন । অফিস শুরুর অনেক আগে থেকে অফিস শেষের অনেক পর পর্যন্ত তাঁকে অফিসে পাওয়া যেত । বন্যা, ইলেক্সন ইত্যাদি জরুরীকালীন অবস্থায় তিনি নাওয়া খাওয়া ভুলে অফিসেই পড়ে থাকতেন । তিনি ছিলেন কর্ম্মদক্ষতা ও বিশ্বস্ততার পরাকাষ্ঠা । তদানীন্তন নাজিরবাবু বিজয় চক্রবর্তী ও ত্রাণ শাখার দায়িত্বে থাকা পুটুবাবুও (দেবব্রত দত্ত) অত্যন্ত সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ ও কর্ম্মদক্ষ ছিলেন ।
প্রশাসনিক আদালত ও ট্রেজারী বিল্ডিং
বিচার বিভাগীয় আদালত বিল্ডিং
মেখলিগঞ্জে আমি যে সকল মহকুমা শাসকের সঙ্গে কাজ করেছি
মেখলিগঞ্জে আমি চারজন মহকুমা শাসকের কাছে কাজ করেছি যাঁদের সকলেই ছিলেন আমাদের সার্ভিসের বরিষ্ঠ সদস্য (senior member) । প্রথম মহকুমা শাসক বাদল চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন একজন বর্ণময় ব্যক্তিত্বের মানুষ । তিনি ইংরেজিতে কথা বলতে ও নিজেকে বাদল সি কাউড্রে নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন । তিনি নিজের বাংলোতে একাকী থাকতেন; তাঁর স্ত্রী সম্ভবতঃ অন্য কোন পেশায় অন্যত্র বসবাস করতেন । তিনি সদালাপী ও কবিতার রসজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন । লোকে বলত মহিলাদের প্রতি ওঁর দুর্বলতা ছিল । আমি বেশীদিন ওঁর সাথে কাজ করিনি । এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে ওঁকে হঠাৎ মেখলিগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে হয় । আমি তখন হলদিবাড়ীতে[3]।
বাদল চৌধুরীর পরে এলেন ১৯৫৯-ব্যাচের ডব্লুবিসিএস অফিসার সিদ্বার্থ মিত্র । তিনি অধস্তন অফিসারদের ছুটি দিতে দ্বিধা করতেন । নিজের ছুটিতে যাওয়ার প্রয়োজন হলে সহকর্মী বলাই ও আমার মত অবেক্ষাধীন অফিসারদের দায়িত্বে মহকুমার ভার ছেড়ে দিয়ে নির্বিদ্বিধায় চলে যেতেন । কিন্তু আমার বা বলাইর ছুটির প্রয়োজন হলে সর্বদা জেলাশাসকের কাছ থেকে বিকল্প অফিসার চাইতেন । বিকল্প অফিসার পেলেও ছুটি কমানো থেকে শুরু করে নানারূপ টালবাহনা করতেন । আমার মনে আছে আমি যখন বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে শিলচর গিয়েছিলাম সেই সময় চিঠি দিয়ে আমাকে তড়াতাড়ি কাজে যোগ দিতে বলেছিলেন, যদিও তখন আমার জায়গায় বিকল্প অফিসার পোস্টেড ছিল । আমি অবশ্য ঐ চিঠির কোন গুরুত্ব দিই নি । আমার বিশ্লেষণে শ্রীমিত্রের মধ্যে প্রশাসন পরিচালনা করার প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল । মনে হয় তিনি সন্ধিগ্ধচিত্তও ছিলেন ।
এরপর মহকুমা শাসক হয়ে এলেন ১৯৬০-ব্যাচের ডব্লুবিসিএস অফিসার সলিল রঞ্জন ভৌমিক । তিনি নিতান্ত ভাল মানুষ ছিলেন । ওঁর স্ত্রী মঞ্জরী বৌদি ভাল গান করতেন । ওঁদের একটি ৫।৬ বছরের ছেলে ছিল রাজা[4] । সলিলদার মা ও ওঁদের সাথে থাকতেন । নির্বাচন পরিচালন পদ্ধতির অনেক কিছু আমি সলিলদার কাছ থেকে শিখেছিলাম । সলিলদা বলতেন, "নির্বাচন পরিচালনা মেয়ের বিয়ে দেয়ার মত ব্যাপার । প্রতি স্তরে প্রতিটি কাজ নিখুঁত হওয়া চাই ।" শ্রীভৌমিকের কার্যকালেই মেখলিগঞ্জে আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল । এ বিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছি । বিয়ের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে মঞ্জরী বৌদি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন । ভৌমিকদার মাও আমার নববিবাহিতা স্ত্রী স্বপ্নাকে (ডাক নাম) বিশেষ স্নেহ করতেন ।
মেখলিগঞ্জে আমার কার্যকালের অন্তিম পর্যায়ে মহকুমা শাসক হয়ে এলেন ১৯৬২র ব্যাচের ডব্লুবিসিএস অফিসার দীপঙ্কর গঙ্গোপাধ্যায় । আমি ওঁর কাছে অল্প কিছুদিনই কাজ করেছি । মানুষ হিসাবে দীপঙ্করদা ভাল হলেও অতিমাত্রায় ক্যারিয়ারিষ্ট ছিলেন । সম্প্রতি (২০১৮) তিনি প্রয়াত হয়েছেন ।
মেখলিগঞ্জে আমি ১৯৬৮ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর খেকে ১৯৭২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চার বৎসরের অধিক সময় কাটিয়েছি । এই সময়ে আমার বৃত্তিগত ও ব্যক্তিগত জীবনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আমি এখানে বর্ণনা করছি ।
(ক) ১৯৬৮ সালের উত্তরবঙ্গের বিধ্বংসী বন্যা
মেখলিগঞ্জে কাজে যোগ দেয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমি আসাম ও উত্তরবঙ্গের বিধ্বংসী বন্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম । সালটা ছিল ১৯৬৮ । পূজোর ছুটিতে মা-বাবার সাথে দেখা করতে আমি শিলচর গিয়েছিলাম; ওঁরা তখন দাদার সঙ্গে শিলচরে থাকতেন । পূজোর ছুটি শেষে অফিস খোলার কথা ছিল ৭ই অক্টোবর । ৫ই অক্টোবর আমি ট্রেনে কর্ম্মক্ষেত্রের উদ্দেশে যাত্রা করি । আমার কর্ম্মক্ষেত্রের নিকটতম রেল স্টেশন নিউ ময়নাগুড়ি পর্যন্ত টিকেট ছিল । কিন্তু আমি ট্রেনে কেবল গৌহাটি (অধুনা গুয়াহাটি) পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম । বন্যার জন্য গৌহাটির পরবর্তী অংশে ট্রেন বাতিল করে দেয়া হয়েছিল । গৌহাটি পৌঁছে আমি আরও জানতে পেরেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের যে অংশে আমার কর্মস্থল তাও ভয়াবহ বন্যার কবলে । এমতাবস্থায় আমার কাছে দুটি বিকল্প ছিল । এক, বাড়ী ফিরে গিয়ে যাতায়াতের অগম্যতার কথা জেলা শাসক ও মহকুমা শাসককে জানিয়ে ছুটির আবেদন করা । দুই, ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছনোর চেষ্টা করা । আমার বিবেচনায় মনে হল সিভিল সার্ভেণ্ট হিসাবে এই বিপদের দিনে ত্রাণকার্যে সহকর্মীদের সাহায্যার্থে আমার এগিয়ে যাওয়া উচিত । আমি দ্বিতীয় বিকল্পটিই বেছে নিলাম । বন্যা পরিস্থিতিতে ট্রেণ বন্ধ থাকলেও আসাম স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন বন্যাকবলিত এলাকায় যেখানে সম্ভব সেখানে তাদের নিয়মিত পরিষেবার পরিবর্তে একটি স্কেলিটন সার্ভিস চালাচ্ছিল । আমি সেরূপ একটি বাসের সন্ধানে আসাম স্টেট ট্রান্সপোটের কেন্দ্রীয় ডিপোয় এলাম । ধুবড়ী পর্যন্ত একটি বাস পাঠানো হবে জেনে গৌহাটি থেকে বাসে যাওয়া ঠিক করে ধুবড়ীগামী সেই বাসে উঠলাম । ধুবড়ী হল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সীমান্তবর্তী আসামের একটি জেলা শহর যেখান থেকে আমি স্থলপথে সহজেই আমার কর্ম্মস্থলে পৌঁছুতে পারতাম । জায়গায় জায়গায় বন্যার জল কেটে, কোথাও বা ঘুরপথে এগিয়ে বাস ধুবড়ী পৌঁছুল । কিন্তু সেদিন আমি ধুবড়ী পেরিয়ে যেতে পারলাম না । কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত বক্সিরহাটের সঙ্গে ধুবড়ীর সংযোগকারী রাস্তায় পাগলাধরা নামক নদীর উপর একটি সেতু ছিল । সেই সেতুর উপর দিয়ে সেদিন নদীর জল ঘূর্ণাকারে আবর্তিত হয়ে প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছিল; কোন গাড়ীর পক্ষে সেতু অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব ছিল না । আমি ধুবড়ীতে একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম । পরদিন সকালে (৭ই অক্টোবর, ১৯৬৮) নদীর জল কমে গিয়ে সেতুর অবস্থা স্বাভাবিক হলে আমি বাসে বক্সিরহাট গিয়ে সেখান থেকে অন্য একটি বাসে কোচবিহার পৌঁছুই ।
কোচবিহারে আমি জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করি ও তাঁর নির্দেশমত কোচবিহারেই (ডাকবাংলোয়) রাত্রি যাপন করি। ভাস্কর ঘোষ[5] ছিলেন জেলাশাসক ।
মেখলিগঞ্জ যাতায়াতের কোন গাড়ীঘোড়া চলছিল না । মেখলিগঞ্জের মহকুমা শাসকের গাড়ী (Jeep) বন্যার আগে মেরামতির জন্য কোচবিহার এসেছিল ও মেরামতি শেষে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল । কোচবিহার পৌঁছুবার পরের দিন সকালে আমি মেখলিগঞ্জের কয়েকজন কর্ম্মচারীকে, যারা বন্যায় আটকে পড়েছিলেন, নিয়ে মহকুমা শাসকের ঐ গাড়ীতে মেখলিগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম । রাস্তার অবস্থা ছিল শোচনীয়; কোথাও কোথাও ভেঙে গিয়ে দুভাগ হয়ে গেছে, কোথাও বা বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে । অনেক জায়গায় পিডব্লিউডি ভাঙা রাস্তার পাশে বিকল্প পথ (diversion) তৈরী করেছিল; কোথাও কোথাও ঐ কাজ তখনও চলছিল । রাস্তায় ও রাস্তার পাশে স্থানে স্থানে গবাদি পশুর মৃতদেহ পড়ে ছিল । কোথাও কোথাও পথিপার্শ্বস্থ নয়নজুলির প্রবহমান জলের স্রোতে পশুপক্ষীর মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছিল । আশেপাশে পড়ে থাকা জীবজন্তুর মৃতদেহের দুর্গন্ধে ভরে গিয়েছিল । দূরে দেখা যাচ্ছিল বন্যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ী । সে এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য । যা হোক, ঝুঁকিপূর্ণ এই যাত্রা শেষে আমি গাড়ীটি নিয়ে দিনান্তে মেখলিগঞ্জে প্রবেশ করলাম (৮ই অক্টোবর, ১৯৬৮) । বন্যার পর এই গাড়ীটিই প্রথম মেখলিগঞ্জে প্রবেশ করেছিল । মেখলিগঞ্জ শহরের রাস্তায় কালভার্ট ভাঙ্গা থাকায় গাড়ীটি সেদিন অফিস পর্যন্ত যেতে পারেনি । ফেরার পথে ভাঙা কালভার্টের আগে সিংপাড়া নামক মহল্লার কাছে মহকুমা শাসক বাদল চৌধুরীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল । তার পরণে ছিল গামছা, যা পরে তিনি সম্ভবতঃ ভাঙা কালভার্টের নালা পেরিয়েছিলেন । ঐ অবস্থায় তিনি স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন । গাড়ী ও আমাকে ফিরতে দেখে তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন ।
ফেরার পর আমি বন্যাত্রাণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । এর অল্প দিন পরেই হলদিবাড়ীর (মেখলিগঞ্জ মহকুমার অপর একটি ব্লক ও থানা) বিডিও. কে বন্যাত্রাণে সাহায্য করতে আমাকে হলদিবাড়ী চলে যেতে হয়েছিল । জীবনে এই প্রথম বন্যাজনিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম; প্রশাসনিক স্তরে বন্যার্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্ম্মে নিযুক্ত থেকে সেই বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম ।
[ঐ সময় হলদিবাড়ীর বিডিও ছিলেন নিরূপম মণ্ডল । মানুষ হিসাবে নিরূপম ছিলেন শৌখিন, আমোদে ও মিশুকে; খানিকটা ক্যাসুয়াল, গান করতে ভালবাসতেন । উনি অবিবাহিত ছিলেন, একাই থাকতেন । হলদিবাড়ীতে থাকাকালীন আমি ওর অতিথি হয়ে ওর বাড়ীতেই ছিলাম ।]
পরের কয়েক মাস আমরা বন্যার্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং তৎসহ সেই সম্পর্কিত বিষয়ে উর্দ্ধতন অফিসারদের পরিদর্শন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম ।
১৯৬৮ সালের এই বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলপাইগুড়ি শহর, যেখানে অনেক মানুষের ও অসংখ্য গবাদি পশুর মৃত্যু হয় । দার্জিলিং পাহাড়ে কালিম্পং এর রাস্তায় তিস্তাবাজার । এরই সন্নিকটে পাহাড়ী এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবিশ্রান্ত বর্ষণে তিস্তানদীর জলরাশি স্ফীত হয়ে নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত জলপাইগুড়ি শহরের নিকটবর্তী দোমোহনী নামক স্থানে ঐ নদীর বাঁধ ভেঙ্গে এই ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছিল । তারিখটা ছিল ৩রা অক্টোবর, সময় মধ্যরাত্রি ।
এই বিধ্বংসী বন্যার পর কে কে সেন, আইসিএস মহাশয়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী উত্তরবঙ্গে বর্ষাকালে নদীর জলস্তরের পরিমাপক অঙ্কের পরিপ্রেক্ষিতে হলুদ, লাল ইত্যাদি সংকেত আগাম জারির ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় ।
প্রসঙ্গক্রমে এই বন্যা আমার শিক্ষাজীবনের শংসাপত্র ও মার্কশীট সহ অত্যাবশকীয় কিছু নথিপত্রের প্রভূত ক্ষতি করেছিল । পূজোর ছুটিতে বাড়ী যাওয়ার সময় আমি যে ডাকবাংলোয় থাকতাম সেখানে নথিপত্রগুলো একটি স্টিলের ট্রাঙ্কে তালাবন্ধ অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম । বন্যার জল ট্রাঙ্কের ভিতরে ঢুকে কাগজপত্রগুলোর ক্ষতি সাধন করে । সেই সময় আমার স্কুলজীবনে পুরস্কার স্বরূপ পাওয়া কয়েকটি বইও নষ্ট হয় ।
মহকুমা শাসককে নিগ্রহ
আমি যখন হলদীবাড়িতে বন্যাত্রাণের কাজে ব্যাপৃত সেই সময় মেখলিগঞ্জে একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যার ফলশ্রুতি হিসাবে মহকুমা শাসক নিগৃহীত হন । বিমানবাহিনীর একটি বিমান মেখলিগঞ্জের অন্তর্গত তিস্তানদীর চর এলাকায় জলবন্দী বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রীর প্যাকেট ফেলছিল । এরূপ দুটি প্যাকেট দিকভ্রষ্ট হয়ে মেখলিগঞ্জের স্কুলমাঠে জমায়েত মানুষজনের ওপর পড়ে ও দুজন লোকের মৃত্যু হয় । এসডিও. বাদল চৌধুরী ও জেলাশাসক ভাস্কর ঘোষ ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন । উত্তেজিত জনতা এসডিওর উপর চড়াও হয়, তিনি গুরুতর আহত হন । তাঁকে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরিত করতে হয় । পরে সুস্থ হলে তাকে অন্যত্র বদলী করা হয়েছিল।
বিমান থেকে জনতার ওপর প্যাকেট পড়ার ব্যাপারে এস. ডি. ওর কোন ভূমিকা ছিল না । তবে তাঁকে কেন জনতার আক্রোশের শিকার হতে হল? দ্বিতীয়তঃ ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেণ্ট উপস্থিত ছিলেন । তা সত্বেও আক্রমণের জন্য কেন দ্বিতীয় স্তরের প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব এসডিও. কে বেছে নেয়া হল? তবে কি কেউ ব্যক্তিগত বিদ্বেষ চরিতার্থ করার জন্য এই ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছিল কি না জানিনা ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মেখলিগঞ্জ পরিদর্শন
যতদূর স্মরণ করতে পারি, এই ভয়াবহ বন্যার পর উত্তরবঙ্গ পরিদর্শনে এসে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মেখলিগঞ্জে এসেছিলেন । মেখলিগঞ্জের মত গ্রামীন শহরে প্রধানমন্ত্রীর মত ব্যক্তিত্বের আগমনের সম্ভবতঃ এটিই একমাত্র ঘটনা । কোচবিহারের তদানীন্তন জেলাশাসক ভাস্কর ঘোষ মহাশয় নিজে গাড়ী চালিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মেখলিগঞ্জের অবস্থা দেখিয়েছিলেন । প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় SPG র মত নিরাপত্তা সংস্থার তখনও জন্ম হয়নি । রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যতিরেকে কেবল প্রধানমন্ত্রীর প্রধান ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ওঁর সঙ্গে ছিলেন ।
(খ) পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন: ১৯৬৯ ও ১৯৭১
১৯৬৯ সালের প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচন হয় । নির্বাচন পরিচালনার কাজে যুক্ত হওয়ার ও এ বিষয়ে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের এটাই ছিল আমার প্রথম সুযোগ । মহকুমায় কর্মরত থাকায় নির্বাচন পরিচালনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সবিস্তারে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল । এই নির্বাচনে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে দ্বিতীয় যুক্ত ফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে । জ্যোতি বসু এই সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী হন । মন্ত্রীসভা ১৯৬৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী শপথ নেয় । এই সরকার মাত্র ১৩ মাস ক্ষমতায় ছিল ।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়, দু বছর সময়কালে দ্বিতীয় বার । নিজের সরকারের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি পদত্যাগ করলে এই নির্বাচন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে । মেখলিগঞ্জ মহকুমায় আমি এই দ্বিতীয়বার নির্বাচন পরিচালনার কাজে যুক্ত হলাম । ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে আমি ইতিমধ্যেই কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম, এবার তা আরো সম্বৃদ্ধ করার সুযোগ পেলাম ।
ARO (Assistant Returning Officer) হিসাবে এই মহকুমার অন্তর্গত হলদিবাড়ী থানা এলাকার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে আমাকে হলদিবাড়ী পাঠানো হল । ঐ সময় নক্সাল আন্দোলনের জন্য জলপাইগুড়ি উপদ্রুত অঞ্চল ছিল । মেখলিগঞ্জ থেকে হলদিবাড়ী যেতে জলপাইগুড়ির এক বিস্তীর্ণ এলাকার মধ্য দিয়ে যেতে হত । নক্সাল হানার[6] আশঙ্কায় ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ছাড়াও ভোটপত্রপূর্ণ ভোটবাক্স হলদিবাড়ী থেকে মেখলিগঞ্জ গণনাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পথে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়েছিল । ভোটপত্রপূর্ণ ভোটবাক্সগুলো গণনাকেন্দ্রে পাঠাবার আগে সেগুলো হলদিবাড়ী নির্বাচনী অভ্যর্থনা কেন্দ্রে (Election reception centre) নিরাপদে সংরক্ষণের বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরী করা ও তা কার্যকরী করাও যথেষ্ট আয়াসসাধ্য ছিল । ভোটবাক্সগুলো গণনাকেন্দ্রে পরিবহনকালে সেনাবাহিনীর সাহায্যও নিতে হয়েছিল । পরিকল্পনা অনুযায়ী আধাসামরিক ও জেলাপুলিশের কনভয় ভোটবাক্সগুলোকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর কনভয় দূর থেকে তা অনুসরণ করে । হলদিবাড়ী থানা এলাকার ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন আধিকারিক হিসাবে আমি ও আমার সঙ্গে হলদিবাড়ীর বিডিও কনভয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম । নিরাপদ স্থানে পৌঁছে আমরা সেনাবাহনীর উদ্দেশে পূর্বনির্ধারিত সংকেত দিলে সেনা কনভয় ফিরে যায় । শেষরাতে আমরা হলদিবাড়ী থেকে রওয়ানা হয়ে কোন ঘটনা ছাড়াই ভোরবেলা মেখলিগঞ্জ পৌঁছুই ।
ঐ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন গণনা পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন করেছিলেন । পরিবর্তিত পদ্ধতিতে প্রার্থীগত ভাবে প্রকৃত গণনা শুরু করার আগে নির্বাচনী ক্ষেত্রের অন্তর্গত সমস্ত ভোটকেন্দ্রের ভোটপত্রগুলোর একত্র সংমিশ্রণ প্রথা প্রবর্তন করা হয় । এর ফলে গণনা বিলম্বিত হয় । আমরা রাতভর গণনা প্রক্রিয়া চালু রেখে গণনা সম্পূর্ণ করি ও পরদিন ফল ঘোষণা করি । এই পদ্ধতির ফলে কোন্ এলাকার লোক কোন্ রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তা নির্ধারণ করা দুষ্কর হয়ে পড়ে ।
(গ) পিতৃবিয়োগ:
১৫ই আগস্ট, ১৯৬৯
আমার পিতা সারদা চরণ দাস
মৃত্যু ১৫ই আগস্ট. ১৯৬৯
সেটা ছিল ১৯৬৯ সালের ১৬ই আগষ্ট । বাবা-মা তখন শিলচরে দাদার কাছে । দাদার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেলাম, বাবা আগের দিন পরলোকগত হয়েছেন । মাত্র মাসখানেক আগে আমি শিলচরে মা-বাবাকে দেখে এসেছিলাম । বার্ধক্য ব্যতীত অন্য কোন রোগের খবর ছিল না, বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হল । টেলিগ্রাম পাওয়ার সাথে সাথে আমি শিলচরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম । আমি গিয়ে বাবার দেহ দেখতে পাই নি; আমি যখন শিলচর পৌঁছুই ততক্ষণে দেহের সৎকার হয়ে গেছে । আমার পৌঁছুতে দু দিন লেগেছিল; সেকালে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় দেহ সংরক্ষণের (embalming) ব্যবস্থা শিলচরে ছিল না । আমি দাদার সাথে মিলে শেষকৃত্যের সমস্ত আচারানুষ্ঠান যথাযথ ভাবে পালন করি । শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাওয়ার পর আমি নিজ কর্ম্মস্থলে ফিরে আসি ।
আমার কাছে বাবার সর্ব্বশেষ স্মৃতি ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের, যখন আমি দাদার বিয়ের পর পরিবারের সকলের সাথে কয়েকদিন কাটাতে ছুটি নিয়ে শিলচর গিয়েছিলাম । দাদা বিয়ে করে এলাহাবাদ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় আমি ওদেরকে গৌহাটি থেকেই বিদায় জানিয়েছিলাম; বাড়ী যেতে পারি নি । এবার আমার ছুটি শেষে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ফেরৎ যাত্রার প্রাক্কালে বাবা আমাকে বিদায় জানাতে বাড়ীর চৌহদ্দির বাইরে এসেছিলেন, আমি আশীর্বাদ নিতে নীচু হয়ে ওর পা ছুঁয়েছিলাম । সেই শেষবার, আমি আমার পিতাকে দেখেছিলাম । এই চিত্র আমার অন্তরে চিরতরে খোদিত হয়ে আছে । বাবা আমার খুব প্রিয় ছিলেন।
বাবার প্রতি আমার গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল । বাবা একজন সত্যিকারের ফাইটার ছিলেন । দেশ ছাড়ার পর পরিবারকে রক্ষা করতে কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন । বাবার প্রেস প্রতিষ্ঠার পর স্কুলের সময় বাদ দিয়ে যতটা সম্ভব বাবার সাথে সাথে থেকে আমি প্রেসের কাজকর্মে বাবাকে সাহায্য করেছি । জীবনে কোনদিন বাবার কথার অবাধ্য হই নি। আর তাই বোধহয় ছাত্রজীবনের অস্থিরচিত্ততা ও নানা ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও হারিয়ে যাইনি; মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি । ছোটবেলায় পড়েছি,
"पिता धर्म्मः पिता कर्म्मः पिताहि परमं तपः ।
पितरि प्रीतिमापन्ने प्रियन्ते सर्व्वदेवता ॥"
দুঃখজনক ভাবে আজকের যুগে পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে । ছেলে-মেয়েদের কথায়-বার্তায় আচার-আচরণে তা প্রতিমুহূর্তে পরিষ্ফুট হয়ে ওঠে । শুধু তাই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে তা মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারেও পর্যবসিত হয় । সংবাদ মাধ্যমে কখনও কখনও সন্তান-সন্ততি দ্বারা বৃদ্ধ পিতামাতাকে গৃহ থেকে বিতাড়ণের এমনকি হত্যার ঘটনারও সংবাদ প্রকাশ পায় । সম্ভবতঃ এটা যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার কুফল । নিউক্লীয় পরিবারে একক বা দ্বৈত ভাবে সব কিছু ভোগ করে এই যুগের ছেলেমেয়েরা অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে । মানিয়ে নেয়ার এই গতিশীল (Dynamic) যুগে অভিষ্ট লাভের উদ্দেশ্যে ভালমন্দ ভেদাভেদ করার উপযুক্ত শিক্ষাও এরা পায় না, নৈতিক শিক্ষা ত দূরে থাক ।
(ঘ) ১৯৭০ সালের বন্যা ও আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী
এরপর এল ১৯৭০ সালের বন্যা । সেটা ছিল আগস্ট মাসের প্রথম । মেখলিগঞ্জ মহকুমা বন্যার প্রকোপে পড়ে । স্থানীয় বিডিওকে সাহায্য করতে বন্যার্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে আবার হলদিবাড়ী পাঠানো হয় ।
(ঘ) (১) সেনা তলব
পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমি নৌকো ও সৈনিকের আকারে সেনাবাহিনীর সাহায্য তলব (requisition) করি । সেদিন ছিল ৯ই আগস্ট । আমি যে সেনা অফিসারের কাছে সেনা তলবের অধিযাচন (requisition) প্রদান করি তিনি সেই সময় হলদীবাড়ী এলাকায় সদলে বন্যা সংক্রান্ত নিরীক্ষায় প্রবৃত্ত ছিলেন । এখানে আমি আমার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কাজ করেছিলাম এবং তা করেছিলাম যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে । পরবর্তী কালে কোনরূপ জটিলতা দেখা দিলে তার দায় সম্পূর্ণরূপে আমার উপর বর্তাত । জেলায় জেলাশাসকের নীচের কোন আধিকারিকের সেনা তলব করার ক্ষমতা নেই । আমার জেলাশাসক অকুস্থল থেকে ২০০ কিমি এর অধিক দূরত্বে ছিলেন । জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য আমাকে এই তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল । অবশ্য বিষয়টি আমি টেলিফোনে জেলাশাসককে জানিয়ে রেখেছিলাম । জেলাশাসকের তরফে ex post facto অনুমোদনও পরবর্তী সময়ে সেনাকর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে আমার সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে প্রবল বন্যায় বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সমগ্রী সংগ্রহ করতে বা বাঁধ মেরামত করাতে আমি সরকারী টেন্ডার পদ্ধতি সম্পন্ন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব কি না । আমার উত্তর ছিল এক্ষেত্রে জীবন ও সম্পদ রক্ষার তাগিদই অগ্রাধিকার পাবে ।
(ঘ) (২) সেনা নিয়োজন ও তজ্জনিত সমস্যা
তলবি সেনা প্রসঙ্গে আমাকে স্বীকার করতে হবে মেজর গণপতি যিনি এই সেনাদলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মানুষ হিসাবে সজ্জন, খুবই অমায়িক ও পারদর্শী ছিলেন । বন্যাত্রাণে তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন ।
সেনাবাহিনীর নিযুক্তি নিয়ে এল আনুষঙ্গিক সমস্যা । একদিন সকালে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা তথা সংশ্লিষ্ট এলাকার বিধানসভা সদস্য (MLA) অমর রায় প্রধান[7] মহোদয় আমাকে ফোন করে কর্মরত সেনাদলকে অবিলম্বে পরিবর্তনের দাবি জানালেন; আগের সন্ধ্যায় এই দলের কোন এক সৈনিক একটি স্থানীয় মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছিল । আমি মেজর গণপতির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম । মেজর জানালেন তিনি বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ করছেন এবং আশা করছেন সন্ধ্যার মধ্যে দোষীকে চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবেন । আমি এমএলএ মহাশয়কে অবস্থা জানালাম । আমার অভিমত হিসাবে আরও জানালাম যে ওঁর দাবিমত এই দলের পরিবর্তে অন্যদল নিয়ে এলেও সেই দলের কেউ যে এরূপ ঘটনা ঘটাবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই । তাছাড়া অপরাধী চিহ্নিত হয়ে শাস্তি প্রাপ্ত হলে এই দলের আর কেউ এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে সাহস করবে না । সন্ধ্যাবেলা মেজর আমাকে জানালেন দোষী চিহ্নিত হয়েছে ও যথাযোগ্য শাস্তির জন্য যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে । বিষয়টির এখানেই নিষ্পত্তি হয়েছিল ।
(ঘ) (৩) ত্রাণের দাবীতে বিক্ষোভ
সেই সময় বিডিও হলদিবাড়ীর অফিসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তাদের অনুগামীদের মধ্যে ত্রাণ বন্টনের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে ঘন ঘন বিক্ষোভ আন্দোলন সংঘটিত করতেন । এটা ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচীর অঙ্গ । কখনও কখনও মেজর তার কার্যোপলক্ষে এলাকা ভ্রমণকালে ঐ সময় অফিসে উপস্থিত হতেন । আমি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছি না দেখে তিনি আশ্চর্য হতেন । পরে আমি ওঁকে বলেছিলাম যদিও বিষয়টির মধ্যে রাজনীতির উপাদান রয়েছে বিক্ষুদ্ধ লোকগুলো আমাদের নিজেদের লোক ও ওরা বিপদের মধ্যে আছে । ওদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার আগে একটা পর্যায় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ।
শীঘ্রই এমন একটা ঘটনা ঘটল যা আমাদেরকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করল । ৩রা সেপ্টেম্বর (সাল ১৯৭০) কিছু এলাকার লোক তাদের পঞ্চায়েৎ প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে বিডিও অফিসের সম্মুখে জমায়েত হল । অকুস্থল পরিদর্শন করে ত্রাণ বিভাগের কর্মীরা ত্রাণ প্রাপকদের যে তালিকা তৈরী করেছিলেন সেই তালিকায় ত্রাণ পেতে অযোগ্য বলে কিছু লোকের নাম বাদ গিয়েছিল । জমায়েতের দাবির মধ্যে ঐ বাদ যাওয়া লোকগুলোকেও ত্রাণের আওতাভুক্ত করার দাবিও ছিল । পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের সাথে দাবিগুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর স্থির হল দুসপ্তাহের জন্য নতুন তালিকা স্থগিত থাকবে এবং ঐ সময়ের মধ্যে কিছু এলাকা পুনরায় সার্ভে করা হবে । তাদের অন্যান্য দাবি দাওয়া নিয়েও আলোচনা চলছিল । এমতাবস্থায় সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাইরের জমায়েত হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠল ও ইট পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করল । ছোঁড়া ইটের আঘাতে একজন কর্তব্যরত পুলিশ কন্স্টেবল আহত হল, বিডিওর অফিসের টেবিলের কাঁচ ফেটে গেল । জনতা জোর করে অফিসে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল । আমি তখন ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে জমায়েতকে বে-আইনী ঘোষণা করলাম ও পুলিশকে বলপ্রয়োগ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে নির্দেশ দিলাম । মৃদু লাঠিচার্জ হল, জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল । পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল । এরপর আমি যতদিন হলদীবাড়ি ছিলাম বিডিও অফিসে কোন বিক্ষোভ সমাবেশ হয়নি ।
(ঙ) ১৯৭১ সালের বাংলাদেশী উদ্বাস্তু সমস্যা
এরপর এল বাংলাদেশ উদ্বাস্তু সমস্যা । বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে হাজার হাজার বাংলাদেশী মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে মেখলিগঞ্জ মহকুমায় আশ্রয় নেয় । এই সমস্যা মূলতঃ এই মহকুমার হলদিবাড়ী ব্লকেই সীমাবদ্ধ ছিল । অবিরাম উদ্বাস্তু স্রোতে হলদিবাড়ীর জনসংখ্যা প্রতিদিন বাড়তে লাগল এবং অনতিবিলম্বে তা স্বাভাবিক জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল । এই উদ্বাস্তুরা হলদিবাড়ী থানা এলাকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, যেখানেই খালি জায়গা পেল সেখানেই আশ্রয় নিল । এর ফলে খাদ্য, বাসস্থান, পরিধেয় ও জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হল । হঠাৎ আসা এত লোককে গ্রহণ করার মত প্রশাসনিক প্রস্তুতি ছিল না । ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে কয়েকদিন সময় লেগেছিল । সমস্ত স্কুল ও অন্যান্য খালি সরকারী বাড়ী পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় এই সময় কিছু লোককে প্রথম কয়েকদিন খোলা জায়গায় থাকতে হয়েছিল । বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এরা মাঠে ঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করে জনস্বাস্থ্যের বিপদ ঘটাতে লাগল । অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসনকে সর্বশক্তি দিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছিল । এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের সক্রিয় সহযোগীতা আমরা পেয়েছিলাম ।
এই সময় প্রশাসনিক নির্দেশে মাঝে মাঝে আমাকে হলদিবাড়ী যেতে হত ।
(ঙ) (১) উদ্বাস্তুদের জন্য অস্থায়ী শিবির
সমস্যার সমাধানে জরুরী ভিত্তিতে অস্থায়ী কাঠামোতে বাড়ী তৈরী করে উদ্বাস্তুদের জন্য শিবির তৈরী করা হল । শিবির পরিচালনার জন্য অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করা হল, নিরাপত্তার জন্য প্রহরী মোতায়েন করা হল । উদ্বাস্তুর সংখ্যা অত্যধিক হওয়ায় সবাইকে হলদিবাড়ীতে স্থান দেয়া সম্ভব হল না । কোচবিহারের জেলাশাসকের তৈরী পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকিদের কোচবিহারের অন্যান্য মহকুমায় ছড়িয়ে দেয়া হল ।
বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি জেলাশাসক মহোদয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় । এই সমস্যা সমাধানে জেলাশাসক মহাশয় একাধিকবার হলদিবাড়ী পরিদর্শন করেছেন । সেই সময় কোচবিহারের জেলাশাসক ছিলেন বরদা চরণ শর্মা । যতদূর মনে পড়ে কোচবিহার জেলায় ১৯৭১ সালের এই বাংলাদেশী উদ্বাস্তু সমস্যা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য জেলাশাসক বরদা চরণ শর্মা সরকার কর্তৃক বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন । বাংলাদেশ সীমান্তের অন্যান্য কয়েকটি জেলার জেলাশাসকরাও সরকার কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছিলেন ।
(ঙ) (২) অবাঙ্গালী উদ্বাস্তু
পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত বাঙ্গালীদের সঙ্গে কিছু অবাঙ্গালী মুসলমানও পালিয়ে এসেছিল । এই অবাঙালী উদ্বাস্তুদের যথাযথ প্রহরায় মেখলিগঞ্জ থানার অন্তর্গত প্রথমে জামালদহ ও পরে চ্যাংড়াবান্ধা নামক স্থানে আলাদা ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল ।
(১) বিচার সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা
মেখলিগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় গরুচুরি ও বেআইনী অনুপ্রবেশের ঘটনা প্রায়শঃই ঘটত । তৃতীয় শ্রেণীর ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিচারপতি (ম্যাজিস্ট্রেট) হিসাবে আমি এই সকল ও অন্যান্য ছোটখাট অপরাধের বিচার করতাম । এইভাবে আমি আদালত পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। প্রশাসন থেকে বিচার ব্যবস্থা পৃথক হওয়ার পর আমার বিচার ক্ষমতার অবলুপ্তি ঘটে । এই পৃথকিকরণ কোচবিহার জেলায় ১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে হয়েছিল । আমি বিচারক হিসাবে প্রদত্ত ক্ষমতা দেড় বছরের অধিক কাল প্রয়োগ করেছিলাম । বিচার ব্যবস্থা পৃথক হওয়ার পর আমাকে প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করা হল । আমি তখন অপরাধ নিবারণ মূলক বিষয়গুলির নিষ্পত্তি করতাম ।
(২) গাড়ী চালানো শিক্ষা
মেখলিগঞ্জেই আমি প্রথম গাড়ী চালাতে শিখেছি । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পূণর্বাসনের ব্যবস্থাকল্পে গাড়ীসহ যে সকল সরকারী ড্রাইভার নিযুক্ত হয়েছিল তারা এ বিষয়ে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল । আমি বরাবরই একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী । আমি শীঘ্রই গাড়ী চালনায় দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে গেলাম । কোচবিহার, হলদিবাড়ী ইত্যাদি দূরবর্তী জায়গায় সরকারী সফরে যাওয়ার সময় আমি নিজেই গাড়ী চালাতাম, যদিও ড্রাইভার পাশে থাকত । এইভাবে আমি জাতীয় সড়কে গাড়ী চালাবার অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিলাম । আমার তখন ড্রাইভিং লাইসেন্স[9] ছিল না, যদিও আমি যে পদে কর্মরত ছিলাম তাতে লাইসেন্স পাওয়াটা মোঠেই কঠিন ছিল না । সৌভাগ্যবশতঃ আমি গাড়ী চালাতে গিয়ে কোন অ্যাক্সিডেণ্ট ঘটাইনি যার জেরে লাইসেন্সবিহীন গাড়ী চলানোর জন্য আমার সাজা হতে পারত ।
(৩) ব্যাঙ্কবিহীন ট্রেজারী প্রশাসনের অভিজ্ঞতা
সেকালের পশ্চিমবঙ্গে যে গুটিকয়েক ট্রেজারীতে সরকারী নগদ লেনদেনও হত তার মধ্যে মেখলিগঞ্জ ছিল একটি । বৃহদাংশ জেলায় সেই সময় সরকারী নগদ লেনদেন হত মূলতঃ স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে । ঐ সময় নগদ লেনদেন-যুক্ত এই ধরণের ট্রেজারীতে কাজ করা ছিল এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা । কোলকাতায় ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও জেলায় স্টেট ব্যাঙ্ক সরকারের নগদ লেনদেনের দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে ট্রেজারীর কাজকর্মের বিষয়ে শিক্ষালাভের এটা ছিল একটা অপূর্ব সুযোগ । মেখলিগঞ্জ সাবট্রেজারীতে বিরাট সংখ্যক পুরণো অচল মুদ্রা ব্যতিরেকে চালু টাকার নোট, বিভিন্ন মূল্যের কোর্ট ফি, ননজ্যুডিসিয়েল স্ট্যাম্প, পোস্টেজ স্ট্যাম্প ইত্যাদি ডাবল লক পদ্ধতিতে স্ট্রং রুমে সংরক্ষিত থাকত । এই ডাবল লকের একটি চাবি থাকত ট্রেজারী আধিকারিকের কাছে, অপরটি অ্যাকাণ্টেণ্টের কাছে; দুজন একত্র না হলে তালা খোলা যেত না । বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ট্রেজারী স্ট্রং রুমে সংরক্ষিত হত ।
আইন অনুযায়ী জেলাশাসককে বৎসরে একবার প্রত্যেক ট্রেজারী পরিদর্শন করতে হয় । ঐ সময় ট্রেজারীতে রক্ষিত সমস্ত চালু ও অচল টাকা ও মুদ্রা এবং সকল ধরণের স্ট্যাম্পের মজুদ সংশ্লিষ্ট রেজিষ্টারের উল্লিখিত সমাপনী সংখ্যার সঙ্গে সমতা যাচাই করা বাধ্যতামূলক । পশ্চিমবঙ্গ ট্রেজারী নিয়মাবলী অনুযায়ী অচল মুদ্রাগুলি ওজন করে যাচাই করা হত ।
সাবট্রেজারীর জন্য নগদ টাকা জেলা-ট্রেজারীর মাধ্যমে চাহিদাপত্র পাঠিয়ে কোচবিহার স্টেটব্যাঙ্ক থেকে সংগ্রহ করা হত এবং পুলিশ প্রহরায় তা মেখলিগঞ্জে নিয়ে আসা হত । টাকা পয়সা গণনা, গ্রহণ ও বিতরণের জন্য মেখলিগঞ্জ সাবট্রেজারীতে পোদ্দার নামে একটি বিশেষ পদ ছিল ।
(৪) দলিল দস্তাবেজ নথিভুক্তকরণ
ছুটি বা অন্য কারণে নিয়মিত সাবরেজিষ্টারের অনুপস্থিতিতে সাবরেজিষ্টার হিসাবে কাজ করতে গিয়ে দলিল দস্তাবেজ নথিভুক্তকরণের বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করি।
(৫) জেল প্রশাসনে অভিজ্ঞতা
মহকুমা শাসক পদাধিকারবলে ছিলেন জেলের অধিক্ষক । সেই সুবাদে জেলের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যাবলীর দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হয়েছিল । বিভিন্ন জেলে কয়েদীদের নিম্ন মানের খাদ্য সরবরাহ করার অভিযোগ সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম । মেখলিগঞ্জ সাবজেলের দায়িত্বে থাকাকালীন কন্ট্রাক্টার যখন কয়েদীদের জন্য নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আসত মাঝে মাঝে সেই সময় আমি খাদ্যের মান পরীক্ষার জন্য জেল পরিদর্শনে যেতাম । একবার নিম্ন মানের সামগ্রী সরবরাহ করার জন্য আমি একজন কন্ট্রাক্টারকে সতর্কও করেছিলাম । জেলের কিছু ওয়ার্ডার, যারা কন্ট্রাক্টারের সাথে যোগসাজসে ছিল তারা, এর ফলে বিক্ষুদ্ধ হল । এই বিক্ষুদ্ধরা আমি জেল পরিদর্শনে গেলে আমাকে আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র করল । কিন্তু আমার শুভানুধ্যায়ীর মাধ্যমে খবরটা আমি আগেই পেয়ে গেলাম । ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হল ।
কাজের এই অংশ থেকে আমি জেল প্রশাসনের অভিজ্ঞতা লাভ করলাম ।
(৬) চাকুরীতে স্থায়ীকরণ
মেখলিগঞ্জে থাকাকালীন চাকুরীতে স্থায়ীকরণের (Confirmation) সমস্ত সর্ত আমি পূরণ করেছিলাম । চাকুরী স্থায়ীকরণের (Confirmation ) সরকারী নির্দেশনামাও আমি এখানেই পেয়েছিলাম ।
মেখলিগঞ্জের কথা
হলদিবাড়ী-মেখলিগঞ্জ সংযোগকারী তিস্তা সেতু
মেখলিগঞ্জে তিস্তা নদীর তীরে একটি বিশেষ স্পটের দৃশ্য
মেখলিগঞ্জে তিস্তা নদীর খাতের একটি দৃশ্য
মদন মোহন মন্দির, মেখলিগঞ্জ
মেখলিগঞ্জ সেকেণ্ড অফিসারের বাংলোর প্রাঙ্গন সংলগ্ন একটি প্রাচীন সেগুন গাছ
জায়গা হিসাবে মেখলিগঞ্জের কথা বলতে গিয়ে বলতে হয় তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত এটি কোচবিহার জেলার একটি ছোট মহকুমা শহর যা তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্থান তথা অধুনা বাংলাদেশের সীমানা সংলগ্ন । এই মহকুমার দুটি থানা মেখলিগঞ্জ ও হলদীবাড়ি তিস্তা নদীর দ্বারা পরস্পর বিযুক্ত । সড়কপথে এক থানা থেকে অপর থানায় যেতে হলে জলপাইগুড়ি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা অতিক্রম করে যেতে হত । সম্প্রতি (ফেব্রুয়ারী ২০২১) তিস্তা নদীর উপর জয়ী সেতু নামে পশ্চিবঙ্গের দীর্ঘতম সড়ক সেতুটি (দৈর্ঘ্যে ৩.৮ কিমি) চালু হওয়ায় থানাদুটির মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে ।
দহগ্রাম নামক তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্থানের বৃহত্তম ছিটমহল মেখলিগঞ্জ থানার অন্তর্গত কুচলিবাড়ী নামক স্থানের সন্নিকটে অবস্থিত । অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত পানবাড়ি থানার মূল ভূখণ্ড থেকে এই ছিটমহল মাত্র তিন বিঘা ভারতীয় ভূখণ্ডের ব্যবধানে পৃথকীকৃত । ভূখণ্ডের এই তিন বিঘা পরিমাপের জন্যই স্থানটির নাম তিন বিঘা । ভারত-ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে এই ছিটমহলে যাতায়াতের একটি সংযোগকারী পথ (corridor) বর্তমানে চালু রয়েছে । ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী এই করিডোরটি চালু হয় । ভারতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য ১ঘণ্টা সময় বাদ দিয়ে করিডোরটি ২৪।৭ চালু থাকে । ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের সময় এখানে গুলি বিনিময় হয়েছিল ।
আমাদের সময় মেখলিগঞ্জ শহরের জনসংখ্যা ছিল অনধিক চার হাজার । সেই সময় এখানে পৌরসভা ছিল না; সরকার মনোনীত সদস্য দ্বারা গঠিত টাউন কমিটি নামক সংস্থার মাধ্যমে স্বায়ত্ব শাসন পরিচালিত হত । বাসগৃহগুলি সব ছিল কাঠের তৈরী, চাল ছিল ঢেউখেলানো টিনের (corrugated iron sheets) । ভারতে অন্তর্ভূক্তির পূর্বে কোচবিহার জেলা (মেখলিগঞ্জ যার অন্তর্গত) মহারাজার অধীনে একটি দেশীয় রাজ্য ছিল । শোনা যায় মহারাজার রাজত্বকালে অধিবাসীদের পাকা ছাদের বাড়ী করার অনুমোদন ছিল না । অথবা হতে পারে অত্যধিক বৃষ্টিপাত বা ভূমিকম্পের দরুণ এরূপ গঠনপ্রণালী গ্রহণ করা হয়েছিল । আসামেও এরূপ গঠনের বাড়ীঘর অনেক দেখা যায় । সরকারী বাসস্থান ও অফিস বাড়ীগুলি অবশ্য প্রায় সবই ছিল ঢালাই ছাদের পাকা বাড়ী ।
এসডিও অফিসের সন্নিকটে বাজার এলাকায় কতগুলো ছোট ছোটো দোকান ছিল; বাজার এলাকায় সাপ্তাহিক হাট বসত । মেখলিগঞ্জে বোরলী নামক এক প্রকার ছোট মাছ পাওয়া যেত । ঐ মাছগুলো ছিল খুব সুস্বাদু কিন্তু পাওয়া যেত খুব কম ।
নিকটতম জেলা শহর ছিল জলপাইগুড়ি, দূরত্ব ৪৭ কিমি. । অপরদিকে হ্রস্বতম পথে, যা বর্ষাকালে অগম্য ছিল, মেখলিগঞ্জের জেলা শহর কোচবিহার ছিল ১০৭ কিমি. দূরে । বর্ষাকালে ৩১ নং জাতীয় সড়ক ধরে ঘোরপথে মেখলিগঞ্জ থেকে কোচবিহার যেতে হত । পরবর্তীকালে মাথাভাঙ্গা শহরের নিকট মানসাই নদীর উপর পঞ্চানন সেতু নামক একটি স্থায়ী সেতু তৈরী হওয়ায় জেলা শহর কোচবিহারের সাথে মেখলিগঞ্জের সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে ।
মেখলিগঞ্জে একটি জুনিয়র হাই ও একটি হায়ার সেকেন্ডারী স্কুল ছিল, কোন কলেজ ছিল না । মহকুমা সদর হলেও এখানে মহকুমা হাসপাতাল ছিল না, ছিল একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র । এখানে কোন ব্যাঙ্কও ছিল না যে কারণে এখানকার ট্রেজারী ছিল ব্যাঙ্কিং ট্রেজারী অর্থাৎ সরকারী নগদ লেনদেনও এখানে ট্রেজারীর মাধ্যমেই হত । আমার অবস্থানের শেষ পর্যায়ে এখানে একটি ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয়েছিল । কিন্তু সেটি স্টেট ব্যাঙ্ক না হওয়ায় ট্রেজারীর সাথে সংযুক্ত হতে পারে নি ।
বাইরের সাথে রেলপথে এখানকার যোগাযোগ ছিল না । নিকটস্থ রেল স্টেশন ছিল ২০-২৫ কিমি দূরে ময়নাগুড়ি নামক স্থানে । ১৯৬৮ সালের বন্যার পূর্বে অবশ্য মেখলিগঞ্জ থেকে ৮ কিমি দূরত্বে মেখলিগঞ্জ থানার অন্তর্গত চ্যাংড়াবান্ধা নামক স্থান পর্যন্ত একটি ব্রাঞ্চ লাইন ছিল । বন্যায় তা ভেসে যায় । পরবর্তীকালে আমার মেখলিগঞ্জে অবস্থান কালের মধ্যে এই রেলপথের পুনর্স্থাপন হয়নি ।
শহরটি এত ছোট ছিল যে পায়ে হেটে অল্পক্ষণের মধ্যে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পরিক্রমণ করা যেত । ৪/৫ খানা সাইকেল রিক্সা ছিল যা মূলতঃ মহিলা, বৃদ্ধ ও অশক্তরাই ব্যবহার করতেন । বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল সড়ক পরিবহন । উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুযায়ী কয়েকটি বাস চালাত এবং তাই ছিল সব । মেখলিগঞ্জ থেকে সকাল ৬টায় প্রথম বাসটি ছেড়ে যেত । শেষ বাসটি ছিল বিকেল ৪টায় । মাঝখানে তিনটি ট্রিপ ছিল ৯টা, ১২টা ও ২ টায় । বিকেল ৪টার পর মেখলিগঞ্জ বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত । মেখলিগঞ্জে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এখনও (২০১৫ সাল) সড়ক পরিবহন যদিও যানবানের বিভিন্নতায় ও পৌনঃপৌনিকতায় উপলভ্যতা বহুগুণ বেড়েছে ।
মেখলিগঞ্জে একটি-ই পাকা রাস্তা যা আবার শহরে প্রবেশ ও শহর থেকে নির্গমনের মাধ্যম । সায়াহ্নে শহরের মুষ্টিমেয় তরুণ-তরুণীকে এই রাস্তায় পদচারণা করতে দেখা যেত ।
মহকুমা শাসকের সরকারী একটি জীপ গাড়ী ছাড়া এখানে অন্য কোন সরকারী বা ব্যক্তিগত ছোট গাড়ী বা ট্যাক্সি ছিল না । তবে পরবর্তীকালে বাংলাদেশী উদ্বাস্তু সমস্যার মোকাবিলায় বিদেশী সহ বিভিন্ন ধরণের কয়েকটি সরকারী গাড়ী মহকুমায় এসেছিল ।
মেখলিগঞ্জের অসম্পূর্ণতার অনেকগুলি-ই ইতিমধ্যে দূরীভূত হয়েছে বলে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার মেখলিগঞ্জ ভ্রমণকালে মনে হয়েছে ।
বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত জন
মেখলিগঞ্জে অসামরিক অফিসারদের সংখ্যা ছিল খুব কম; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ছিল নীরস । এখানে লব্ধ কয়েকজন ভাল বন্ধুর সাহচর্যে আমি আমার দীর্ঘ চার বৎসরের অধিক অবস্থানকালের বেশীর ভাগ সময় কোনভাবে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলাম । এখানে লব্ধ বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ছিল আমাদের সার্ভিসের বলাই চন্দ্র চক্রবর্তী, রেজিষ্ট্রেশন সার্ভিসের দীপক মুখার্জি ও সতীশ কুমার তানেজা । তানেজাকে কিছুদিন আমার সেকেণ্ড অফিসারের কোয়ার্টারেও রেখেছিলাম । তানেজা পরে ডব্লুবিসিএস এ যোগদান করে । ১৯৮১ সালে আমি যখন সেন্সাসের ডেপুটি ডিরেক্টর হয়ে উত্তরবঙ্গে এলাম, তানেজা তখন দার্জিলিংএ অন্যান্য বিষয়ের সাথে সেন্সাসের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক হিসাবে নিযুক্ত ছিল । সেই সময় একবার সেন্সাসের কার্যোপলক্ষে দার্জিলিং ভ্রমণকালে সপরিবরে তানেজার বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেছিলাম । তখন তানেজার স্ত্রীর সাথে পরিচয় হয়েছিল । ওদের দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ছিল ।
মেখলিগঞ্জে সীমানা সুরক্ষায় নিযুক্ত বিএসএফ এর কয়েকজন সহকারী কম্যান্ডেন্টের সঙ্গেও আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল । বিপুল সেনগুপ্ত, সমীর মিত্র, হরবচন সিং গিল আমাদের বিএসএফের বন্ধু ছিল । বিপুল পরে বিএসএফ এর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে কলেজের লেকচারার পদে যোগ দেয় । সমীর বিএসএফের ডিআইজি পদ থেকে অবসর নিয়ে কোলকাতায় বসবাস করছে । গিল বদলী হয়ে কাশ্মীর চলে গিয়েছিল । ওর পরের খবর জানা নেই ।
কোচবিহার জেলায় বিচার ও শাসন ব্যবস্থা আলাদা হয়ে গেলে আমরা আমাদের মধ্যে কয়েকজন চমৎকার বিচারক অফিসার পেয়েছিলাম । এদের মধ্যে সুখেন্দু বিকাশ দাসগুপ্ত, অসিত বরণ লাহিড়ী, বিনয় কর বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । অসিত বরণ লাহিড়ী পরে কোলকাতা হাইকোর্টের জজ হয়েছিলেন । বাকী দুজনের সম্পর্কে চাকুরীর শীর্ষ অবস্থান জানা নেই ।
"এস্এসবি"র সাব-এরিয়া অরগেনাইজার জীবন কানাই সাহা ছিলেন আমার বিশেষ বন্ধু । তিনি কোচবিহারে থাকতেন, মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত ভাবে কখনও বা মধ্যরাত্রে হাজির হতেন । অবশ্য ওঁর কাজের জন্যই ওঁকে যাতায়াতের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হত । মেখলিগঞ্জে এলে উনি আমার বাসভবনেই থাকতেন । আমার বিয়ের পর একবার উনি সপরিবারে আমাদের কাছে ছিলেন । ওর স্ত্রীও খুব মিশুকে ও আমোদে ছিলেন । আমাদের খুব ভাল কেটেছিল । বহু বছর পর সেদিন ওঁর খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম উনি বছর দশেক পূর্বে (২০২২ সালের সাপেক্ষে) পরলোক গমন করেছেন । জীবনকানাইদা একজন সত্যিকারের ভাল মানুষ ছিলেন ।
আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু দীপু আমি থাকাকালীন দুবার মেখলিগঞ্জে বেড়াতে এসেছিল; একবার আমার প্রাক-বিবাহ পর্বে আরেকবার বিবাহ পরবর্তী পর্বে । বলা বাহুল্য দুবারই ও আমার কাছে ছিল । বহু দিন পর আমি কয়েকটা দিন খুব আনন্দে কাটিয়েছিলাম ।
এখানে থাকাকালীন আমি একবার আমার কলেজের বন্ধু দেবাশীষ নন্দীর সঙ্গে দেখা করতে নাগরাকাটা নামক জায়গায় গিয়েছিলাম। দেবাশীষ যাদবপুর থেকে মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহকারী ইঞ্জিনিয়ার পদে নাগরাকাটায় নিযুক্ত ছিল । আমরা সারাদিন কলেজের দিনগুলির স্মৃতিচারণ করে আনন্দে কাটিয়েছিলাম ।
মেখলিগঞ্জের রাজনৈতিক চিত্র
আমি যখন মেখলিগঞ্জে কাজে যোগ দি তখন এখানকার বিধানসভা সদস্য ছিলেন কংগ্রেসের মধুসূদন রায় । ওঁর সঙ্গে আমাদের ভাল সম্পর্ক ছিল । উনি কখনও কখনও আমাদের সঙ্গে গল্পগুজবে বা খেলাধূলায় যোগ দিতেন । পরবর্তী কালের নির্বাচনে মধুসূদনবাবু ফরোওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী হলদিবাড়ীর অমর রায় প্রধানের[8] কাছে হেরে যান । অমর রায় প্রধান একজন সজ্জন ও অমায়িক ব্যক্তি ছিলেন । হলদিবাড়ীতে কর্ম্মরত থাকা কালে দেখেছি কোন সমস্যার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান উনি মেনে নিতেন ।
মেখলিগঞ্জে ফরোওয়ার্ড ব্লকের স্থানীয় নেতৃত্বে ছিলেন সত্যেন মজুমদার মহোদয় । আমি মূলতঃ ট্রেজারী অফিসার হিসাবে কর্মরত থাকায় ওর সঙ্গে আমার মিথষ্ক্রিয়া ছিল যৎসামান্য । তবে সহকর্মী বলাইর কাছে শুনেছি উনি এসডিওর কাছে ডেপুটেশন দিতে এসে প্রায়ঃশই মারমুখী হয়ে উঠতেন । এস. ডি. ওর কাছ থেকে ওকে দূরে সরিয়ে রাখতে গিয়ে বলাই প্রায়ই ওর সাথে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ত ।
আমোদ-প্রমোদ ও সঙ্গীসাথীর অভাব
মেখলিগঞ্জে আমরা যে জিনিষের সবচেয়ে বেশী অভাব বোধ করতাম তা হল আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা । সিনেমা দেখতে হলেও আমাদেরকে নিকটবর্তী জলপাইগুড়ি শহরে যেতে হত । আমোদ-প্রমোদ বলতে এখানে ছিল শীতের মরসুমে যাত্রার আসর আর মাঝে মধ্যে ফুটবল টুর্ণামেন্ট । যাত্রায় কোলকাতার নামী-দামী যাত্রা কোম্পানীগুলি অংশ নিত । মাঝে মাঝে বিশষতঃ সহকর্মী বলাই বদলী হয়ে যাওয়ার পর রাত জেগে যাত্রা দেখতাম । খেলাধূলায় আমার ত কোনদিনই কোন আকর্ষণ ছিল না । সঙ্গী-সাথী বলতে ছিল অফিসের সহকর্মী বা অন্য কোন অফিসের গুটিকয়েক সরকারী আধিকারিক ।
উপসংহার
অন্তিম বিশ্লেষণে আমি এটাই বলতে চাই নীরবতা ও শান্তির খোঁজে দু-একদিনের সাময়িক অবস্থানের জন্য মেখলিগঞ্জ যথেষ্ট ভাল। কিন্তু শহরের পশ্চাদ্পদ বিশিষ্ট কাউকে যদি কর্মক্ষেত্র হিসাবে এখানে দীর্ঘদিন থাকতে হয় এবং সে যদি অবিবাহিত হয় তবে তার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে । তবে ইতিমধ্যে সংঘটিত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে।
মেখলিগঞ্জ সম্পর্কে আমার অনুভূতি
মেখলিগঞ্জ সম্পর্কে আমার অনুভূতি
মেখলিগঞ্জে আমার সুদীর্ঘ অবস্থান কালে বাইরের পৃথিবীর সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল । যোগাযোগের অভাবে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে । মেখলিগঞ্জে সরকারী বৃত্তের বাইরে খুব অল্প সংখ্যক লোকই ছিল যাদের সঙ্গে ব্যাক্যালাপ করা যেত । যদিও আমি কয়েকজন ভাল বন্ধু যোগাড় করেছিলাম তারা আমার অন্তরের শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি । জায়গাটি ছিল কোলকাতা থেকে অনেক দূরে । সেই কারণে এবং এখানে কর্মরত আধিকারিক সংখ্যার সীমাবদ্ধতা হেতু আমি কদাচিৎ কোলকাতা গিয়ে আমার সেখানকার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ বা মহানগরীর জীবন উপভোগ করতে পারতাম । পাঠ্যবস্তুর অভাবে আমার পড়ার অভ্যাসও নষ্ট হতে লাগল । এখানে একটা ভাল বইয়ের দোকানও ছিল না । স্থানীয় সার্বজনিক গ্রন্থাগার আদ্যিকালের বইয়েই পূর্ণ ছিল, নতুন বই বিশেষ পাওয়া যেত না । প্রায়শঃ অফিসের পর সময় কাটানো আমার কাছে দুরূহ হয়ে উঠত । একটি ট্রেন্সিস্টার কেনার পর আমার এই অবসর সময়ের কিয়দংশ আমি আলস্যভরে গান শুনে কাটাতাম । রেডিও সিলোন প্রোগ্রামে আমিন সাহানীর উপস্থাপিত সঙ্গীতমালা আমার বিশেষ প্রিয় ছিল । আমার হঠাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্তের পশ্চাতে অব্যবহৃত অবসরের আধিক্য, এখানকার নির্বান্ধবতা ও প্রাণহীনতা মূলতঃ দায়ী । মেখলিগঞ্জে বাস গ্রামে বাসের সমতুল্য ছিল । জন্ম থেকে এখানে আসার আগে পর্যন্ত আমি হয় জেলা শহরে নয় মহানগরীতে বাস করেছি । দুঃখকষ্টের মধ্যে থাকলেও ঐ সকল স্থানে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করেছি । মেখলিগঞ্জের নির্জীব গ্রাম্য পরিবেশে বাস করা আমার পক্ষে মোটেই সুখকর ছিল না । এখানে একাকীত্বের চরম বেদনা আমি অনুক্ষণ অনুভব করেছি ।
তবে একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে মেখলিগঞ্জ মহকুমার ভৌগলিক গঠন হেতু আমি এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম যা সচরাচর আমার ঐ সময়ের জ্যেষ্ঠতায় (Seniority) উপলভ্য হয় না ।
এখানে আমি যা হারিয়েছি
পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় আমার জীবনে মেখলিগঞ্জ নামক অধ্যায়টি না থাকলেই বোধহয় ভাল হত । এ কথা সত্যি যে কর্ম্মক্ষেত্রে ও ব্যক্তিগত জীবনে এখানে আমি বিভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি; এখানেই আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে । কিন্তু এখানে আমি হারিয়েছিও অনেক কিছু । আমার যৌবনের শ্রেষ্ঠ চার বৎসর সময় আমাকে এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় বিসর্জন দিতে হয়েছে । দীর্ঘদিন এরূপ পরিবেশে অবস্থানের ফলে আমার চিন্তন ক্ষেত্রেও সঙ্কোচন ঘটে । সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবন বিহীন এই জায়গায় একাকীত্বের তীব্র যন্ত্রণা আমি তিল তিল করে ভোগ করেছি । কেন অফিসাররা এখানে আসতে ভয় পায় তা আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি।
মেখলিগঞ্জ থেকে আমি বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমায় বদলী হলাম । ১৯৭২ সালের ১৯শে ডিসেম্বর আমি মেখলিগঞ্জ ছেড়ে যাই ।
পাদটীকা
[1] ইনি পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব হয়েছিলেন ।
[2] পরে আমরা ওটাকে “ভূতবাংলো” আখ্যা দিয়েছিলাম ।
[3] তিস্তা নদীর অপর পারে মেখলিগঞ্জ মহকুমার আরেকটি থানা ও ব্লক ।
[4] দুর্ভাগ্যবশতঃ পরবর্তীকালে মোম্বাইতে দুর্ঘটনায় ও একটি পা হারায় ।
[5] ইনি পরবর্তীকালে এক সময় ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সচিব ছিলেন । প্রসার ভারতীর চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন ।
[6] নক্সালরা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না ।
[7] ইনি পরে সাংসদ (MP) হয়েছিলেন ।
[8] Deleted
[9] নিজের দীর্ঘসূত্রিতার জন্য কর্মজীবনে লাইসেন্স নেয়া হয়ে উঠেনি যদিও জেলায় কার্যকালে ইচ্ছা প্রকাশ করলেই লাইসেন্স পেতে পারতাম । এমনকি হাওড়ায় কর্মরত থাকাকালীন লাইসেন্স প্রদানকারী আধিকারিক আবেদনপত্র হাতে ধরিয়ে দেয়া সত্বেও আবেদন করা হয়নি ।