জীবনের মোড় পরিবর্তন
আগের বছরের পরীক্ষা বর্জন করে আমি যখন পরের বছরের এম্. এসসি. (M. Sc.) পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম সেই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যা আমার পরবর্তী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল । আগেই বলেছি, আমার দাদা সেই সময় শিলচরের একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন । তাঁর পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছে হল । ওঁর ইচ্ছানুযায়ী আমি ওঁর জন্য ঐ পরীক্ষার এক সেট ফর্ম ও প্রসপেক্টাস নিয়ে এলাম । যোগ্যতা নির্ধারক নিয়মাবলী থেকে আমি দেখলাম দাদা ইতিমধ্যে ঐ পরীক্ষার নির্ধারিত সর্ব্বোচ্চ বয়স সীমা পেরিয়ে গেছেন । দাদাকে আমি তা জানিয়ে দিলাম, দাদার আর পরীক্ষায় বসা হল না । পরীক্ষার বিষয়সূচী পড়ে দেখলাম আমি সহজেই এই পরীক্ষায় বসতে পারি, আমার বয়সও উর্দ্ধসীমার মধ্যে রয়েছে (পরীক্ষার বৎসরের ১লা জানুয়ারী তারিখে অনধিক ২৪ বৎসর) । আমি আরও অবগত হলাম যে এই পরীক্ষা দিতে হলে এটাই আমার শেষ সুযোগ; ঐ বছরই আমি এই পরীক্ষার নির্ধারিত সর্বোচ্চ বয়স সীমা পেরিয়ে যাব । আমি মনস্থির করে ফেল্লাম আর ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে দিলাম । যথাসময়ে আমি পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা, ১৯৬৭ দিলাম ।
অন্তর্বর্তীকালিন শিক্ষকতা
আমার এম্. এসসি. পরীক্ষার তখনও বেশ কয়েক মাস দেরী ছিল । আমি ঐ পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করলাম । সেই অবস্থায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ফল প্রকাশের অপেক্ষায় থাকাকালীন আমি মাস দুয়েকের জন্য বরানগরের একটি হাইয়ার সেকেণ্ডারী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলাম । এর আগে আমার স্নাতোকত্তর পাঠক্রমের দ্বিতীয় বর্ষে আমি প্রোঃ শ্রীবাস্তব উপাধিধারী পদার্থবিদ্যার জনৈক প্রথিতযশা অধ্যাপকের স্নাতক শ্রেণীতে পাঠরত পুত্রকে কিছুদিন পড়িয়েছিলাম ।
১৯৬৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ফল
এর মধ্যে কোন এক সময়ে পাব্লিক সার্ভিস কমিশন থেকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ইন্টারভ্যুয়ের ডাক পেলাম । নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে ইন্টারভ্যু দিতে কোলকাতার ভবানী ভবনে হাজির হলাম । ইন্টারভ্যুয়ে [1] যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি জানতাম নিঃসঙ্কোচে সেগুলোর উত্তর দিলাম, যেগুলোর উত্তর জানতাম না সেগুলো সম্পর্কে সরাসরি আমার অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম । কোন ক্ষেত্রেই আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম না । আমি দুর্ভাবনাহীন ভাবে সাহসের সঙ্গে ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হয়েছিলাম; সেই সময় চাকুরী যোগাড় করার আমার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না । যতদূর মনে করতে পারি আমি ইন্টারভ্যুয়ে ৭০% এর অধিক নম্বর পেয়েছিলাম ।
সেই সময় এই ধরণের পরীক্ষার পথপ্রদর্শক হিসাবে কোন প্রতিষ্ঠান বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল না । আমি এই পরীক্ষা বা ইন্টারভ্যুয়ের জন্য আলাদা করে কোন প্রস্তুতিও নিই নি । সাধারণ জ্ঞান ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (ঐ পরীক্ষার একটি বাধ্যতামূলক বিষয়) ব্যতিরেকে অন্যান্য বিষয়ে আমার ছাত্রজীবনে তদবধি অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই এই পরীক্ষায় বসেছিলাম । তথাপি সফল প্রার্থীদের মধ্যে আমি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম ।
আমার স্নাতোকত্তর হোস্টেলের বন্ধুদের কয়েকজন আমার প্রথম হওয়ার খবর আমার কাছে নিয়ে এসেছিল; যে খবরের কাগজে ফল প্রকাশিত হয়েছিল তারই একটি হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত বন্ধুরা ভোরবেলা আমার কাছে ছুটে এসেছিল ।
আমার প্রথম হওয়ার রেকর্ড তখন পর্যন্ত অমলিন রাখতে পারায় আমি খুশী হয়েছিলাম ।
আই. এ. এস এর জন্য বয়সের প্রতিবন্ধকতা
আই. এ. এস্. (IAS) এবং অন্যান্য সর্বভারতীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরীর জন্য ইউনিয়ন পাব্লিক সার্ভিস কমিশন পরিচালিত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় আমি বসার সুযোগ পাই নি । যতদিনে আমি এই সকল সার্ভিস সম্পর্কে জানলাম ও আগ্রহী হলাম ততদিনে আমি এই পরীক্ষার জন্য নির্দ্দিষ্ট সর্ব্বোচ্চ বয়সসীমা (সেই সময় যা ছিল ২৪ বৎসর, পরীক্ষার বৎসরের ১লা আগস্টের হিসাব অনুযায়ী) পেরিয়ে এসেছি । এরপর কয়েকবার বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রতিবারই আমি সেই নতুন সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর ।
ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসার পর আমার লক্ষ্যে কোন বিশেষ বৃত্তি বা পেশা নির্দিষ্ট ছিল না, যদিও নিত্য নতুন উদ্ভাবনের গবেষণা আমাকে আকৃষ্ট করত । আমি কখনও সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার কথা ভাবিনি । সিভিল সার্ভিস বলে যে কোন ক্যারিয়ার আছে তাই আমি জানতাম না । এর কারণ সম্ভবতঃ আমার ছোট শহরে বড় হওয়া ও আমার পারিবারিক পশ্চাৎপট যা আমি আগেই বর্ণনা করেছি । সেই সময় আমাদের মত পশ্চাদ্পদ এলাকায় মধ্যবিত্ত পরিবারেও খুব কম লোক ক্যারিয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল বা এই বিষয়ে মাথা ঘামাত; কদাচিৎ পরিবারে বা বন্ধুদের মধ্যে ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা হত । আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ত তার কোন প্রশ্নই ছিল না । অনেক বাড়ীতেই খবরের কাগজের চল ছিল না । টেলিভিসন এর আবির্ভাব ঘটেনি । প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য কোচিং সেন্টারও চালু হয়নি । ক্যারিয়ার সংক্রান্ত তথ্যাদির ভিত ছিল অত্যন্ত দুর্বল ।
মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা মূলতঃ জীবিকা নির্বাহের কাজে লিপ্ত থাকতেন; ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় বা মানসিকতা কোনটাই তাদের ছিল না । পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা কদাচ তাদের সাহায্য পেত । ছেলেমেয়েদের মধ্যেও আজকের মত ক্যারিয়ার ভিত্তিক মানসিকতা ছিল না । আমার মত অনেকেরই জীবনের কোন পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য ছিল না ।
আমার মূল লক্ষ্য ছিল আমরা যে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিলাম তা থেকে বেরিয়ে আসা । আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি তাতে খুব বড় কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না, যদিও পরবর্তীকালে নিজেদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করে আমি কয়েকটি সংশয়ী পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, যার কোনটাই ফলপ্রসূ হয় নি । কেউ কেউ এটাকে মধ্যবিত্ত মানসিকতা বলতে পারেন, তবে তাও এক্ষেত্রে হবে আলংকারিক ।
উল্লেখ্য কোলকাতায় আসার পর আমার স্নাতকোত্তর শ্রেণীর বন্ধুবান্ধদের মধ্যেও সিভিল সার্ভিস বা অন্যান্য ক্যারিয়ার সংক্রান্ত কোন আলোচনা কখনও শুনিনি । আমার নিজের ক্ষেত্রে আমার স্নাতকোত্তর হোস্টেলের সহ-আবাসিক বিজন সাহা আই. এ. এস্. হওয়ার পরই আমি এই সার্ভিস সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম । পরের বছর আমার আরেক সহ-আবাসিক প্রণব রায় আই. এ. এস হয় । বিজন এক বছর ও প্রণব দু বছর যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে বিশেষ কোচিং নিয়ে আই. এ. এসে সাফল্য লাভ করে । ঐ সময় যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিশেষ কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল । ঐ ব্যবস্থা মাত্র দু বছর চালু ছিল । যে সময় বিজন আই. এ. এস হল সেই সময়ের মধ্যে আমি এই পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সর্ব্বোচ্চ বয়সসীমা অতিক্রম করে গেলাম, আমার সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে গেল । আমার মেধা ও দক্ষতা দুই-ই ছিল, কিন্তু সময় আমার সঙ্গে ছিল না । পরবর্তীকালে আমি এমন কয়েক জন আই. এ. এস অফিসার দেখেছি যাদের মধ্যে আমার বিচারে মেধা ও দক্ষতা দুয়েরই অভাব ছিল ।
পাদটীকা
[1] ইন্টারভিউ বোর্ডে অন্যান্য স্বনামধন্যদের মধ্যে বোর্ড অব রেভিন্যু-এর মেম্বার কে. কে. সেন, আই. সি. এস., রসায়নের প্রখ্যাত অধ্যাপক পি. কে. রক্ষিত, মৌলানা আজাদ কলেজের অধ্যক্ষ, কমিশনের চেয়ারম্যান প্রভৃতি ব্যক্তিরা ছিলেন ।