ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ী
দায়িত্বভার গ্রহণ
১৯৭৬ সালের ৫ই আগস্ট আমি ঝাড়গ্রামে Midnapore Drought Prone Programme Agency (সংক্ষেপে DPAP) [মেদিনীপুর খরাপ্রবণ এলাকা প্রোগ্রাম এজেন্সী]) নামক প্রতিষ্ঠানের প্রোজেক্ট অফিসারের শীর্ষ পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করি ।
প্রোজেক্ট বিষয়ক
ডিপিএপি একটি বহুমুখী প্রকল্প; এটি খরাপ্রবন এলাকা উন্নয়নে ভারত সরকার দ্বারা প্রতিশ্রুত একটি পরিকল্পনা । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল । পশ্চিমবঙ্গে এরূপ আরো দুটি প্রকল্প ছিল, একটি বাঁকুড়ায় ও অন্যটি পুরুলিয়ায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন কল্পে প্রতিটি জেলায় জেলাশাসককে চেয়ারম্যান ও প্রকল্প রূপায়নে অংশগ্রহণকারী বিভাগীয় জেলা আধিকারিকদের সদস্য করে একটি করে নন্ফার্ম সমিতি গঠন করা হয় । প্রোজেক্ট অফিসার হন সমিতির সদস্য-সচিব ।
অফিস প্রতিষ্ঠা
আমি যখন প্রোজেক্ট অফিসার হিসাবে দায়িত্ব নিই, সেই সময় ডিপিএপি এজেন্সীর কোন অফিস বা কর্মচারী ছিল না । বস্তুতঃ ঐ এজেন্সীর কোন অস্তিত্বই ছিল না । আমাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হল । সদ্য আমি একটি অফিস গুটিয়ে এসেছিলাম । এবার অন্য একটি নতুন অফিস স্থাপনের দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হল । অফিস স্থাপনে বিলম্ব হলে প্রকল্প চালু করতেও দেরী হবে । কিন্তু ঝাড়গ্রামে অফিস বাড়ী পাওয়া যাচ্ছিল না । আমাকে বাধ্য হয়ে একত্রে অফিস ও বাড়ীর জন্য একটি বড় বাড়ী ভাড়া করতে হল । অফিস ও বাড়ী একত্রে রাখার বিরোধী হওয়া সত্বেও তাই করতে হল । ঝাড়গ্রামের জামদা নামক এলাকায় পান্না পাল নামক জনৈক ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি বাড়ী ভাড়া নিলাম । এর ভেতরের অংশে আমার বাসস্থান ও বাইরের অংশে অফিস স্থাপিত হল । এখানে আমার জীবনের একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনা হয় ।
ভাড়া করা বাড়ীটির অফিস ও বাড়ীর অংশের জন্য আলাদা আলাদা ন্যায্য ভাড়া মেদিনীপুরের ভূমিসংস্কার অফিসের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের মাধ্যমে নির্ধারিত হল। আমার বসবাসের অংশের নির্ধারিত ভাড়া আমি এজেন্সীকে দিয়ে দিতাম । ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী এজেন্সী সম্পূর্ণ ভাড়া বাড়ীর মালিককে মিটিয়ে দিত । অফিসের উপযুক্ত ঘর ভাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অফিস আলাদা করে নিয়েছিলাম । তবে তা ঘটেছিল দীর্ঘদিন পর।
অফিস বাড়ী ঠিক হওয়ার পর প্রথমেই একটি সাইক্লোস্টাইল মেসিন কিনলাম যা কর্মীনিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরীর কাজে ব্যবহার করেছিলাম । পরে অফিস চালু হলে ঐটি অফিসের দৈনন্দিন কার্যে ব্যবহৃত হয় ।
কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমি সর্ব্বপ্রথম একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীকে এজেন্সী অফিসের অস্থায়ী অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে নিয়োগ করলাম । তারপর কর্মসংস্থান কেন্দ্রের তালিকা থেকে ও কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রাপ্ত যোগ্য প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচন করে অনুমোদিত পদগুলি পূরণ করি । পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র নিজে তৈরী করে পরীক্ষার দিন সকালে স্বহস্তে সাইক্লোষ্টাইল করে পরীক্ষাহলে পাঠিয়ে দী । পরীক্ষা পরিচালনা করতে অবশ্য আমাকে মহকুমাশাসকের অফিসের কর্মচারীদের সাহায্য নিতে হয়েছিল ।
একই সঙ্গে অফিসের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করি । পরে প্রকল্পের কাজে সমন্বয় সাধনের জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে মহেন্দ্র মহেন্দ্র থেকে একটি ফাইভার-গ্লাস জীপ গাড়ী ক্রয় করি । আমার যোগদানের ৬ মাসের মধ্যে অফিসে পূর্ণোদ্দমে কাজ আরম্ভ হয়ে যায় । অবশ্য যেমন সরকারী ক্ষেত্রে সচরাচর হয়ে থাকে, সমবায় ও পশুপালন দপ্তর থেকে প্রাপ্য একজন করে বিষয়বস্তু বিশারদ পেতে অনেক দেরী হয়েছিল।
আর্থিক বিলি ব্যবস্থা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন
সরকার থেকে প্রকল্পের অর্থ সহায়ক অনুদান (grant-in-aid) হিসাবে পাওয়া যেত এবং তা এজেন্সীর ব্যাঙ্ক এ্যাকাউণ্টে জমা করা হত । এজেন্সীর ব্যাঙ্ক এ্যাকাউণ্ট চেয়ারম্যান তথা জেলাশাসক ও প্রোজেক্ট অফিসার যৌথভাবে চালনা করতেন । ভারত সরকারের নির্দেশক নীতি অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরী করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের জেলা আধিকারিকদের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হত । প্রকল্প রূপায়নে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান থেকে এজেন্সী জেলা আধিকারিকদের প্রয়োজনানুযায়ী অর্থ যোগান দিত ।
জেলাশাসকের সুবিধা অনুযায়ী প্রকল্পের বিভিন্ন সেক্টরে কাজকর্মের অগ্রগতি নিরীক্ষণার্থে নিয়মিত মিটিং হত । রাজ্যস্তরেও এরূপ অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও আন্তর্বিভাগীয় বাধাবিপত্তি দূরীকরণার্থে মাঝে মধ্যে কোলকাতায় মিটিং হত । ঐরূপ মিটিং এ সংশ্লিষ্ট অধিকৃত্যক ও বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতেন । এ ছাড়া প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট নিদর্শে সরকারের নিকট নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে হত । শুষ্ক জমি চাষ (Dryland Farming) , ক্ষুদ্রসেচ, ভূমি সংরক্ষণ, মৎস উন্নয়ন, অরণ্যায়ন, সেচ ইত্যাদি খরাপ্রবন এলাকার পক্ষে বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয় সেক্টরগুলি এই কর্মসূচীর আওতাভুক্ত ছিল ।
স্থানীয় এসডিও র সঙ্গে সম্পর্ক: ঘটনা ও অভিজ্ঞতা
আমি যখন ডিপিএপির প্রোজেক্ট অফিসার হয়ে এলাম তখন ঝাড়গ্রামের এসডিও ছিলেন প্রথমে শ্যামাপদ নন্দী ও পরে রামসেবক বন্দ্যোপাধ্যায় । শ্রীনন্দী আমার যোগদানের পর অল্প কিছুদিনই ঝাড়গ্রামে ছিলেন । শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার ভাল বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । আইএএস অফিসার হিসাবে এটি ছিল রামসেবকের প্রথম পোস্টিং; ওর অনেক কিছু শেখার ছিল । ব্লক পরিদর্শনে অথবা ঝাড়গ্রামের অন্য কোথাও বিশেষ কোন কাজে গেলে উনি প্রায়শঃই আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন ।
১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে আমি ওর সাথে নির্বাচনের কাজে নিযুক্ত ছিলাম । সেই সময়ের একটি ঘটনার কথা আমি এখানে উল্লেখ করছি । সেটা ছিল নির্বাচনের দিন । আমি রামসেবকের সাথে ওর চেম্বারে, যেটা নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ হিসাবে কার্যকরী ছিল, বসেছিলাম । খবর এল যে বনবাসী সমাচার নামের একটি স্থানীয় খবরের কাগজের প্রতিবেদক ভোটকেন্দ্রের ভিতরের ছবি তুলছেন । প্রতিবেদকের কাজটি ছিল বেআইনী । আমাকে বসতে বলে এসডিও বেরিয়ে গেলেন । কিছুক্ষণ বাদে হাতে একটি ক্যামেরা নিয়ে ফিরলেন । আমায় বল্লেন ক্যামেরার ছবিগুলি উনি ডেভেলাপ করাবেন । উত্তরে আমি ওকে জানালাম নির্বাচনী আইন অনুযায়ী তিনি তা পারেন না । আইন অনুযায়ী ফটোর নিগেটিভ ক্যামেরা থেকে বার করে সূর্যালোকে প্রকাশ করে ছবি নষ্ট করে দিতে হবে । রামসেবক ডেভেলাপ করাতে বদ্ধপরিকর, আমিও কিছুতেই তা করতে দেব না । খানিকক্ষণ দড়ি টানাটানির পর হার মেনে রামসেবক যথার্থ পদ্ধতি অনুযায়ী ছবিগুলো নষ্ট করে দিলেন । সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীপুরের জেলাশাসক তথা জেলা নির্বাচন আধিকারিকের কাছ থেকে এসডিওর কাছে ফোন । জেলাশাসক জানতে চাইছেন এসডিও কোন ক্যামেরা ধরেছেন কি না । ইতিবাচক উত্তর পেয়ে জেলাশাসক জানতে চাইলেন ওটা কি করা হয়েছে । এসডিও যথাযথ অবস্থা জানাবার পর জেলাশাসক ও এসডিওর মধ্যে আরো কিছু কথা হয় যা আমার শ্রুতির বাইরে ছিল । কিন্তু সবশেষে এসডিওর যে কথাটি আমার কাণে এল তা হল, "কিন্তু মিঃ দাস যে আমাকে নষ্ট করে দিতে বল্লেন ।" বিষয়টি এভাবেই নিষ্পত্তি হয়েছিল । জেলাশাসক ছিলেন হীরক ঘোষ মহাশয় (বর্তমানে মৃত,২০২২ ) ।
একদা রামসেবক এসডিও থাকাকালীন তদানীন্তন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব জে সি সেনগুপ্ত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার কোন একটি প্রকল্প পরিদর্শনে ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ী ব্লকে এসেছিলেন । রামসেবক পরে আমাকে বলেছিলেন পরিদর্শনকালে আপ্যায়নজনিত চা-বিস্কুটের মূল্যও শ্রী সেনগুপ্ত তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন । তখনকার অফিসারদের সততার মান সত্যি কত উঁচু ছিল !
অনেকদিন পর রামসেবক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বর্ধমানের জেলাশাসক । ওর অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাকে নির্বাচনের কাজে আসানসোল মহকুমায় নিয়োগ করলেন । সালটা ছিল ১৯৮৭, আমি সদ্য শিল্প-বাণিজ্য দপ্তরে উপসচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি । নির্বাচন পরিচালনা কাজে সাহায্য করতে আমাকে তখন কয়েক সপ্তাহ বার্ণপুরে ইস্কো গেস্ট হাউসে (জেলা প্রশাসন আয়োজিত) শিবির করে থাকতে হয়েছিল । ভোট গণনা প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পরই আমি ফিরেছিলাম । আমাকে এটা স্বীকার করতে হবে আমরা (আমি ও আমার সহকর্মী সুশান্ত সেন) যখন আসানসোলে অবস্থান করছিলাম তখন শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সাচ্ছন্দ্যের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন । ওর অধস্তন অফিসারদের বলে দিয়েছিলেন আমরা ওর অতিথি, আমাদের যেন কোন অসুবিধা না হয় । সঞ্জয় মিত্র যিনি পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব হয়েছিলেন তখন বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) ছিলেন ।
প্রশিক্ষণ: উপস্থিতি, আকর্ষক ঘটনা ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন
--------------------------------------------
কর্ণাটকের হাসান জেলায় অবস্থিত বেলুরের মন্দির
শ্রাবণবেলাগোলায় গৌতেমশ্বর বাহুবলীর মূর্তি
প্রোজেক্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় আমি মহীশূর শহরের উপকন্ঠে এলোয়াল নামক স্থানে ডিপিএপির একটি সর্বভারতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যোগ দিয়েছিলাম । কর্মসূচিটি ছিল দিন পনেরোর । এই প্রশিক্ষণের জন্য আমি বিমানে মাদ্রাস (তখনও চেন্নাই নাম হয়নি) হয়ে বাঙ্গালোর পৌঁছুলাম । মাদ্রাসে বিমান পরিবর্তন করে বাঙ্গালোর এসেছিলাম হল ( HAL বা Hindustan Aeronautics Limited) এর তৈরী বিমান ৭৪৭ এ করে। বাঙ্গালোর পৌঁছুতে রাত হয়ে যাওয়ায় বাঙ্গালোরের একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম । আমার কর্মজীবনে এটাই ছিল প্রথম বিমানযাত্রা । পরদিন সকালে বাঙ্গালোর থেকে মহীশূরগামী পর্যটক-ট্রেণ বৃন্দাবন এক্সপ্রেসে চেপে মহীশূর পৌঁছুলাম । প্রায় তিন ঘণ্টায় আমি মহীশূর পৌঁছেছিলাম; স্টেশন থেকে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রশিক্ষনের জন্য রিপোর্ট করলে কর্মকর্তারা আমাকে প্রশিক্ষণস্থলে নিয়ে গেলেন । প্রশিক্ষণটি ভারত সরকারের অর্থানুকূল্যে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন শিক্ষণ (Development Studies) বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল ।
এটি একটি সর্বভারতীয় প্রশিক্ষণ ছিল । সারা ভারতের ডিপিএপি জেলাগুলির শীর্ষ প্রোজেক্ট আধিকারিকরা এতে যোগ দিয়েছিলেন । পশ্চিমবঙ্গের তিনটি প্রোজেক্টের আমরা তিনজন প্রোজেক্ট অফিসারই গিয়েছিলাম । দুপুরের খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫:৩০ পর্যন্ত ক্লাস চলত । বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অতিথি বক্তারা ক্লাস নিতেন । মূলতঃ উন্নয়নকেন্দ্রিক বিষয়, শুষ্ক এলাকা চাষ, খরাপ্রবণ এলাকার বিশেষ সমস্যা ও সমাধানের উপায় ইত্যাদি ক্লাসের বক্তৃতা ও আলোচনায় প্রাধান্য পেত ।
আমি এখানে একটি বিশেষ ঘটনার কথা স্মরণ করছি যার সঙ্গে প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর কোন সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু যা আমাকে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল । আমাদের প্রশিক্ষণস্থলের নিকট মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রীর ক্লাস হত । ক্লাসের বিরতিকালে ঘটনাচক্রে অনেক সময় আমরা দু পক্ষের মুখোমুখি পড়ে যেতাম । আমি লক্ষ্য করলাম ছাত্রীদের মধ্যে একটি তামিল মেয়ে (বেশ সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গিনী) আমার প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে ; স্বল্পদূরে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার সময় ও মাঝে মাঝে আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে, ঠোঁটে স্মিত হাসি । আমি বিচলিত হইনি বল্লে মিথ্যা বলা হবে । আমার বয়স তখন ৩২ । কিন্তু আমি নিজেকে সংযত করে বিষয়টি উপেক্ষা করলাম । আমি তখন বিবাহিত ও আমার একটি শিশুসন্তান রয়েছে । ওদের জীবনে দুর্বিপাক আসুক আমি চাই নি । কিন্তু আমার মনের মুকুর থেকে ঐ নারীকে একেবারে মুছে ফেলতে ও পারিনি ।
প্রশিক্ষণকালে আমাদেরকে বেলুর ও শ্রাবণবেলাগোলায় ঐতিহাসিক স্থান দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । এই দুটি স্থানই কর্ণাটক রাজ্যের হাসান জেলায় । বেলুর হোসলা রাজত্বের প্রথম দিকের রাজধানী ছিল । এটি হোসলা রাজত্বকালের কারিগরি দক্ষতার অপূর্ব নিদর্শন চেন্নাকেশব মন্দিরের জন্য বিখ্যাত । মন্দিরটি আমরা দেখেছিলাম, মন্দিরটির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম । উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত মন্দিরটির একটি চিত্র বাম পার্শ্বে সন্নিবিষ্ট হয়েছে । অবশ্য চিত্রটিতে মন্দিরটির সৌন্দর্যের কিছুই প্রতিফলিত হয় নি ।
শ্রাবণবেলাগোলা জৈন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান । এই স্থান তালকড়ের পশ্চিম গঙ্গা বংশের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নৈপুণ্যের শীর্ষে পৌঁছেছিল । এখানে একটি স্বল্পোচ্চ পাহাড়চূঢ়ায় নিরাবরণ গৌতমেশ্বর বাহুবলীর একটি বিশালাকার পাথরের মূর্তি স্থাপিত রয়েছে । এই মূর্তিটি দর্শনের জন্য আমাদেরকে বহু সংখ্যক সিঁড়ি ভাঙ্তে হয়েছিল । উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত মূর্তিটির একটি চিত্র পার্শ্বে প্রদর্শিত হল ।
End of the course Group Photo: Training on Integrated Development of Drought Prone Areas, Mysore University (Dec 13 – 25, 1976). Sitting L to R (Professors & Officials conducting the program): Dr. DC Jayasankar, Dr. Ps Tiwari, Prof. VK Natraj, Dr. RP Misra, Dr. KV Sundaram (Jt. Director, Planning Commission), Mr. R. N Achyutha (Course Coordinator), Mr. BS Bhooshan. I am standing second row 3rd.
প্রশিক্ষণের সমাপ্তি: স্থান ও অধিবাসীদের সম্পর্কে আমার অনুভূতি
প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে আমরা মাত্র দু সপ্তাহকাল মহীশূরে ছিলাম । এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও এই শহর ও তার অধিবাসীরা আমার হৃদয়ে একটি কোমল স্থান অধিকার করে নিয়েছিল । এরপরেও আমি দুবার মহীশূর পরিদর্শন করেছি, একবার ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার (আইএএস) প্রতিষ্ঠাকরণ প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসাবে ভারতদর্শন কর্মসূচিতে সহকর্মীদের সাথে, পরে অন্যবার আমার স্ত্রী ও কনিষ্ঠা কন্যার সাথে । এই সব ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ আমার ইংরেজী ওয়েবসাইটের ট্র্যাভেলগ পেজ এ দেয়া আছে ।
বন্যাত্রাণের জরুরী কাজে নিযুক্তি
আমি ডিপিএপিতে (DPAP) কর্মরত থাকাকালীন ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল । দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলা ও কোলকাতা বন্যার করাল গ্রাসে পড়েছিল । রাজ্য সরকার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অফিসারদের নিযুক্ত করেছিলেন । অবিভক্ত মেদিনীপুরে ঘাটাল ও তমলুকের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ । স্বপন চক্রবর্তী নামে একজন আইএএস অফিসারের সঙ্গে একত্রে আমি তমলুকের বন্যাত্রাণের কাজে নিযুক্ত হলাম । স্বপন চক্রবর্তী তখন ছিলেন মেদিনীপুরের সেট্লমেণ্ট অফিসার । আমরা এক সাথে তমলুকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম । তমলুক পৌঁছুনো কষ্টকর ছিল; অনেক চেষ্টা করে আমরা পৌঁছেছিলাম । আমরা সকালে যাত্রা শুরু করে কাঁথি হয়ে সন্ধ্যায় তমলুক পৌঁছুলাম । স্বাভাবিক অবস্থায় মেদিনীপুর থেকে তমলুক যেতে দু-আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে । আমাদের পাঁশকুড়া দিয়ে তমলুক পৌঁছুবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল; দামোদর নদের সেতুর পর থেকে জাতীয় সড়ক বন্যার দরুণ অগম্য হয়ে গিয়েছিল । সড়কের উপর দিয়ে খরস্রোতে বন্যার জল বয়ে যাচ্ছিল ।
কল্যাণ বাগচী তখন তমলুকের অতিরিক্ত জেলাশাসক । তিনি বন্ধুভাবাপন্ন অহংবোধবিবর্জিত একজন সুন্দর মানুষ ছিলেন । ওঁর স্ত্রী ও রুচিশীলা, মিশুকে ও অতিথিপরায়ণা ছিলেন । পরে ওর মাকেও দেখেছি; মাতৃসমা ও আন্তরিক ছিলেন ।
বন্যাত্রাণে তমলুকে আমি আমার ডব্লুবিসিএসের ব্যাচমেট মহকুমা পুলিশ অফিসার কীরিট সেনগুপ্তের বাড়ীতে ওর অতিথি হয়ে ছিলাম । ওর পরিবার তখন অন্যত্র ছিল । তমলুক পৌঁছুবার পরদিন কীরিট ও আমাকে মেচেদা নামক তমলুকের একটি ব্লকে পাঠানো হল । খবর ছিল যে স্থানীয় বাসিন্দারা কাকটিয়ায় অবস্থিত মেচেদা বিডিও অফিসের দ্বিতলে আশ্রয় নিয়েছে । বিডিও চিত্তরঞ্জন দাস খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছেন । আমরা নৌকা করে মেচেদার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম । রাস্তার উপর দিয়ে কোমর সমান জল বয়ে যাচ্ছিল । চার দিক থেকে বাড়ী ভেঙ্গে পড়ার আওয়াজ আস্ছিল আর সেই সাথে শোনা যাচ্ছিল সাহায্য ও উদ্ধারের আর্তি । আমাদের মনে হল উদ্ধার কাজে নৌকা ছেড়ে দেয়া উচিত । নৌকা ছেড়ে দিয়ে আমরা কোমরজলে হেঁটে এগোতে লাগলাম । জল ভেঙ্গে তমলুক থেকে কাকটিয়ার বিডিও অফিসের ৮ কিমি দূরত্ব যেতে আমাদের অনেক বেশী সময় লেগেছিল; আমরা সন্ধ্যাবেলা পৌঁছুলাম । পৌঁছে আমরা একটি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের ট্রেইলার থেকে অধিক রাত পর্যন্ত ত্রাণ বিলিতে সাহায্য করলাম । এরপর কোন রকমে আমরা বিডিও অফিসে বাকী রাতটুকু কাটালাম ।
বিডিও অফিসের একতলা বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল । দুতলায় প্রচুর সংখ্যক লোক আশ্রয় নিয়েছিল । বিডিও নিজেও দুতলার একটি ঘরে বাস করছিলেন । এত সংখ্যক লোক একটিমাত্র টয়লেট ব্যবহার করায় চতুর্দিক অসহনীয় দুর্গন্ধে ভরে গিয়েছিল । বিডিও চিত্তরঞ্জন দাসকে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছিল; আমাদের মনে হয়েছিল ওকে অবিলম্বে ওখান থেকে না সরালে অসুস্থ হয়ে পড়বেন ।
পরদিন সকালে আমরা বিডিওকে নিয়ে বন্যায় আটকে পড়া একটি ট্রাকে করে তমলুক ফিরে এলাম । কাকটিয়া ছেড়ে আসার আগে বিডিও ওর অনুপস্থিতিতে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্য যথাযথ ভাবে চলার ব্যবস্থা করে এলেন । তমলুকে নিজের বাসস্থানে উপযুক্ত নিদ্রা ও বিশ্রামে ক্লান্তিমুক্ত হয়ে বিডিও কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে বন্যাত্রাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন । চিত্ত স্বাভাবিক অবস্থায় তমলুক থেকে অফিস করতেন ।
বন্যাত্রাণে সাহায্য করতে আমি আরও কয়েকদিন তমলুকে ছিলাম । জল নেমে গিয়ে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে আমি নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসি ।
বন্যাত্রাণে পঞ্চায়েৎ কার্যনির্বাহীদের ভূমিকা
নতুন পঞ্চায়েৎ কার্যনির্বাহীরা এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অনতিপূর্বে ক্ষমতায় এসেছিলেন । কিন্তু তাঁরা বন্যাত্রাণ ও উদ্ধারকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে প্রশংসনীয় উদ্যমে কাজ করেছিলেন ।
সরকারী কর্মীদের পুনর্শ্রেণীবিন্যাস: এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত
আমি যখন চাকুরীতে যোগদান করি সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পদগুলি মোটামুটি দুটি শ্রেণীতে [১] বিভক্ত ছিল, গেজেটেড ও নন্গেজেটেড । পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসাবে আমি প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার ছিলাম । গেজেটেড অফিসারদের নিয়োগ, পোস্টিং, বদলী, ছুটি সংক্রান্ত বিষয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গেজেটে প্রকাশিত হত । গেজেটেড অফিসারদের কিছু স্বতন্ত্র ক্ষমতা ছিল যথা নথিপত্র প্রত্যায়ন, পাসপোর্ট, জাতিনির্ধারণ, আবাসিকতা ইত্যাদি বিষয়ে শংসাপত্র প্রদান । গেজেটেড অফিসারদের দৈনিক হাজিরার খাতাও সই করতে হত না । গেজেটেড অফিসারেরা ছিলেন সেল্ফ-ড্রয়িং অর্থাৎ তারা নিজেদের মাইনে নিজেরাই ট্রেজারী থেকে তুলে নিতে পারতেন । তবে তার জন্য পশ্চিমবঙ্গ মহাগাণনিকের (Accountant General, West Bengal) পে-স্লিপ নামক অনুমোদনপত্রের প্রয়োজন হত । এই অনুমোদন পত্র সংশ্লিষ্ট অফিসারের কর্মরত থাকার অবস্থানের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য কার্যকর থাকত ।
১৯৭৮ সালে, আমি তখন ডিপিএপিতে কর্মরত, বামফ্রণ্ট সরকার সরকারী পদগুলিকে পুনর্বিন্যাস [১] করে এ, বি, সি এবং ডি এই চারটি শ্রেণীতে বিভাজন করেন । গেজেটেড ও নন্গেজেটেড শ্রেণী [২] লুপ্ত । তদানীন্তন গেজেটেড শ্রেণী এক্ষণে গ্রুপ "এ" ও গ্রুপ "বি" পর্যায়ভুক্ত হয় । সেল্ফ-ড্রয়িং ক্ষমতা প্রত্যাহৃত হয় যদিও নথি প্রত্যায়ন ও শংসাপত্র প্রদানের ক্ষমতা অব্যাহত থাকে । গেজেটেড অফিসারদের মাইনে ও ভাতা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য অফিসারদের সাথে সাধারণ বিলে তোলার ব্যবস্থা হল । পে-স্লিপ প্রথা বিলোপ পেল । পরবর্তী পর্যায়ে তদানীন্তন গেজেটেড অফিসারদের ক্ষেত্রেও হাজিরা খাতা সই করা বাধ্যতামূলক করা হল ।
প্রোজেক্ট ত্যাগ
ঝাড়গ্রামের মহকুমা শাসক পদে নিযুক্ত হয়ে আমি ১৯৭৯ সালের ২৭শে এপ্রিল এজেন্সী ছাড়লাম । ত্রিনাথ কৃষ্ণ সিন্হা নামে একজন ডব্লুবিসিএস অফিসার এজেন্সীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন ।
<<< হোম পেজে যেতে বাঁ দিকের বোতামে টেপ বা ক্লিক করুন ।