সেন্সাস অধিকারে যোগদান
১৯৮০ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর আমি কোলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ সেন্সাস অধিকর্তার অফিসে উপ-অধিকর্তা পদে যোগ দিলাম । পরে আমাকে উত্তরবঙ্গ আঞ্চলিক উপঅধিকর্তা পদে নিয়োগ করে শিলিগুড়িতে বদলী করা হয় । জেলার ভারপ্রাপ্ত সেন্সাস আধিকারিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে আমি সেন্সাস পরিচালন ব্যবস্থা তত্বাবধান করি । সেন্সাস আমাকে কর্তব্য সম্পাদনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চলের মনমোহিনী দৃশ্যাবলী উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছিল ।
আমাদের শিলিগুড়ির বাসভবন
শিলিগুড়িতে আমরা বাবুপাড়া নামক মহল্লায় হাবু সরকার নামক ব্যক্তির বাড়ীতে ভাড়া ছিলাম । বাড়ীটি খুব সুন্দর ছিল, ষড়ভুজাকার বৈঠকখানার সব দিকগুলোতে অর্ধেক দেয়ালের উপর কাঁচের জানালা বসানো ছিল । বাজার সংলগ্ন হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ ও জরুরী ওষুধপত্র সহজলভ্য ছিল, অপর দিকে বাইরের হৈ হট্টগোল না পৌঁছনোয় এলাকা ছিল শান্ত । নিকটে একটি সিনেমা হলও ছিল । রেল স্টেশনও খুব একটা দূরে ছিল না । ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত শিলিগুড়িতে আমাদের অবস্থানের পুরো সময়টাই আমরা এই বাড়ীতে কাটিয়েছি । আত্মতৃপ্তিময় অনেকগুলি মুহূর্ত আমি এখানে অতিবাহিত করেছি । সেই স্মৃতি আমি এখনও রোমন্থন করি । মেখলিগঞ্জ নিকটবর্তী হওয়ায় শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজনেরা যাতায়াতের পথে প্রায়ঃশই এখানে দর্শন দিতেন । এই বাড়ীটির বন্দোবস্ত করে দেয়ার জন্য অবশ্যই আমার স্ত্রীর বড়দিদির পুত্ররা ধন্যবাদার্হ ।
দার্জিলিং ও তার পাহাড়ী মহকুমাগুলোতে আমার প্রথম পদার্পন
আমার সেন্সাস উপঅধিকর্তার কার্যকালেই আমি জীবনে প্রথম দার্জিলিং দর্শন করি । যদিও আমি নিকটবর্তী মেখলিগঞ্জ মহকুমায় চার বৎসরের অধিক কাল কর্মরত ছিলাম ঐ সময় দার্জিলিং দর্শনের সুযোগ আমার হয়নি । বর্তমান এ্যাসাইনমেণ্টে সেন্সাসের কাজ করতে গিয়ে আমি দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়ং সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থান সফর করেছি । মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে এই সব ট্রিপ অত্যন্ত আনন্দদায়ক ছিল ।
আমার জ্যেষ্ঠ কন্যার ঐশ্বরিক পরিত্রাণ
এইভাবে ভ্রমণকালে একদিন একটি রক্তহিমকারী ঘটনা ঘটেছিল । সেদিন আমি সপরিবারে পাঙ্খাবাড়ী রোড ধরে শিলিগুড়ি ফিরছিলাম । কার্শিয়ং পেরিয়ে একটা জায়গায় আমরা একটু থেমেছিলাম । সবাই গাড়ী থেকে নেমেও ছিলাম । আমরা যেখানে নেমেছিলাম তার বিপরীত দিকে গভীর খাদ ছিল । আমার বড় কন্যার বয়স তখন ৬ বৎসর । হঠাৎ গভীর আতঙ্কে দেখি ও খাদের প্রান্তে চলে গেছে । এক-দু পা এগোলেই একেবারে খাদের গভীরে । আমি ওর থেকে কয়েক ফুট দূরে ছিলাম। এক লাফে ঝাপিয়ে পড়ে ওকে ধরলাম । করুণাময়ের অসীম কৃপায় ওকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম ।
পাঙ্খাবাড়ী রোডের একটি দৃশ্য
জয়ন্তী, পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান
আলিপুরদুয়ারে সেন্সাস মিটিং সেরে একবার নিকটবর্তী জয়ন্তী দর্শনে গিয়েছিলাম । বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকায় জয়ন্তী গ্রামটি গভীর অরণ্যে অবস্থিত । গ্রামটির অবস্থান জয়ন্তী নদীর পাশ বরাবর । আশে পাশের সুদৃশ্য ভূচিত্র ও স্থানে স্থানে বন্য ঝর্ণার সমাহার জায়গাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে । জয়ন্তীর অপর পারে ভূটানের সুদৃশ্য পর্বতমালা । বনবিভাগের যে বাংলোয় আমরা বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তার পাশ দিয়েই জয়ন্তী নদী বয়ে চলেছে ।
কন্যার শিক্ষায় বিরূপ প্রভাব
দুঃখজনক ভাবে আমার এই বদলী আমার জ্যেষ্ঠা কন্যার শিক্ষাক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল । শিলিগুড়িতে ওকে কোন ভাল স্কুলে ভর্তি করানো যায় নি, পাড়ার স্কুলেই পড়তে হচ্ছিল । আমি বুঝতে পারছিলাম ও ধীরে ধীরে পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছে । ঐ অবস্থায় আমার আর কিছু করার ছিল না । পড়াশোনার প্রতি ওর একনিষ্ঠতা আর ফিরে আসে নি ।
কোলকাতায় বদলী: বাসস্থান সমস্যা
সেন্সাসের তৃণমূল স্তরের কাজ শেষ হয়ে গেলে আমাকে কোলকাতা বদলী করা হল । আমি সেন্সাসের তথ্য সারণিকরণের (data compilation) জন্য প্রতিষ্ঠিত সল্টলেক ১নং সেন্সাস ট্যাবুলেশন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলাম । অফিসটি ছিল সল্টলেকের পূর্তভবনে ।
আমি যখন শিলিগুড়ি থেকে বদলী হলাম তখন কোলকাতায় সরকারী বাড়ীর তীব্র অভাব । আমার সরকারী বাড়ী পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না । আমার বন্ধু বলাই, আমার চাকুরীজীবনের প্রথম দিকে যার কথা বলেছি, বরানগরের নিকটে আলমবাজার নামক স্থানে একটি ব্যক্তিগত মালিকানার বাড়ী আমার জন্য ভাড়ায় ঠিক করল । এটি একটি দু কামরার বাড়ী ছিল; একটি কামরা বড়, অপরটি ছোট, পাশে ঢাকা দেয়া বারান্দায় রান্নার ঘর । রান্নাঘরটি এত ছোট ছিল যে আমার স্ত্রীকে কামরা দুটির ছোটটিতে বসে তথাকথিত রান্নাঘরে উনুন রেখে রান্না করতে হত । ভাড়া ছিল মাসিক ৩০০ টাকা ।
পরবর্তীকালে আমরা এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড় ও সুবিধাজনক ভাড়া বাড়ীতে ওঠে যাই, অবস্থানের দিক থেকেও সেটি অনেক সুবিধাজনক ছিল । এই বাড়ীটি ছিল আমার সহকর্মী তথা বন্ধু অশোক চ্যাটার্জির পৈতৃক বাড়ীর একটি অংশ । এটি বরানগরের রতনবাবু রোডে অবস্থিত ছিল । আমরা ওখানে ভালই ছিলাম । অশোক, অশোকের স্ত্রী, ওদের ছেলে মেয়ে, অশোকের মা ও ভাই এর পরিবারের প্রায় অংশ হয়ে গিয়েছিলাম ।
অশোকের মা জ্যোতির্ময়ী দেবী ছিলেন স্বাভাবিক মাধুর্যপূর্ণ মহিলা, দৃঢ়, শিক্ষিতা ও স্বাধীনচেতা । উনি আমাদের সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন ।
আলমবাজার ও রতনবাবু রোডের দুটো বাড়ীরই মধুর স্মৃতি হৃদয়ে সঞ্চিত রয়েছে ।
জ্যেষ্ঠা কন্যার পঠন-পাঠন ও আনুষঙ্গিক বিষয়
কোলকাতায় বদলী হয়ে আসার পর বড় মেয়েকে বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করলাম । ভোরবেলা আমি ওকে বাসে করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসতাম । ফিরে এসে তাড়াহুড়ো করে অফিসের জন্য প্রস্তুত হতে হত । আমি নিকটস্থ দক্ষিণেশ্বর স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেণে উল্টাডাঙ্গা যেতাম । সেখান থেকে বাসে করে সল্টলেকের পূর্তভবনে আমার অফিসে পৌঁছুতাম ।
আমার মেয়ের স্কুল সকাল দশটায় ছুটি হত । মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে আমার স্ত্রীকে ঐ সময় মেয়ের স্কুলে যেতে হত । আমার স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে আমার কনিষ্ঠা শ্যালিকা শান্তি ওরফে বন্দনা, যে ঐ সময় আমাদের সঙ্গে থাকত, আমার ছোট মেয়ের দেখাশোনা করত । শান্তি আমারও প্রয়োজনাদির দিকে লক্ষ্য রাখত এবং ওর দিদিকে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করত । আমাদের দু-দুটো মেয়ে যখন বড় হচ্ছিল এবং সময়াভাবে আমি সংসারের দিকে বিশেষ নজর দিতে পারতাম না সেই সময় ও দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সাহায্য করেছে । দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ও আমাদের পরিবারেরই একজন ছিল । ও অত্যন্ত মমতাময়ী, আমার মেয়েদের নিজের মেয়ের মতই দেখত ।
ডানদিকের প্যানেলে শান্তি যে সময় আমাদের সঙ্গে ছিল সেই সময়ের ওর ছবি ।
পরবর্তীকালে কোলকাতায় আমার বাসভবন থেকে আমি ওর বিয়ে দিয়েছিলাম ।
আমার কনিষ্ঠা শ্যালিকা শান্তি ওরফে বন্দনা
আমার বন্ধু অশোক
অশোক যার পৈতৃক বাড়ীর একাংশ ভাড়া নিয়ে আমরা আলমবাজারের বাড়ী থেকে উঠে এসেছিলাম তার একটি পুত্র ও একটি কন্যা ছিল । তার দুই সন্তানই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত; পুত্র কুনাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, কন্যা রাকা চক্ষু শল্যবিদ । অশোক আমার খুব ভাল বন্ধু । ও একজন উদার হৃদয় মানুষ । ও আমাকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে । আমি যখন মেদিনীপুরে কয়েক মাসের জন্য কর্ম্মরত ছিলাম তখন ও ওর নির্দিষ্ট সরকারী বাসভবন আমাদের বসবাসের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল । সেজন্য ও আমাকে কোন ভাড়াও দিতে দেয় নি । অন্য অনেক সহকর্মীকেও ও একই ভাবে সাহায্য করেছে । ও তখন অবিবাহিত ছিল ও অন্যত্র বাস করত । এ ছাড়া বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী বাদ দিয়েও ওর কাছে যে যখনই সাহায্যের জন্য যায় ও নির্বিদ্বিধায় সাহায্য করতে চেষ্টা করে, অনেক সময় নিজের পরিধির বাইরে গিয়েও । সেদিক থেকে আজকের যুগে এরকম একজন মানুষ দুর্লভ । অশোক এখন সপরিবারে আমাদের সাথে একই কোঅপারেটিভ বাড়ীতে বাস করে । বস্তুত আমাকে এ বাড়ীতে নিয়ে আসার পিছনে বলাইর সাথে সাথে ওরও ভূমিকা ছিল । আমার শ্যালিকা শান্তির বিয়েতেও অশোক ও বলাই আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে ।
উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
সল্টলেক ১নং সেন্সাস ট্যাবুলেশন অফিসের দায়িত্বে থাকাকলীন সেন্সাস অধিকর্তার (যার অধস্তন হিসাবে আমি পূর্বেও কাজ করছিলাম} কিছু সিদ্ধান্ত ও ক্রিয়া প্রশাসনিক ঔচিত্যের দিক থেকে আমার পক্ষে অবমাননাকর মনে হল । আমি প্রশ্ন তুললাম । আমার মনে হল অধিকর্তা চোখে না দেখে কাণে দেখতে শুরু করেছেন (कर्णेन पश्यति!) । সর্বদা চাটুকার অধস্তন আধিকারিক দ্বারা পরিবৃত থেকে তিনি অন্যদের সম্পর্কে নিজের মূল্যায়নে চাটুকারদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন ।
সমস্ত প্রশাসনিক ঔচিত্যবোধ বিসর্জন দিয়ে তিনি আমার সম্পূর্ণ অজান্তে আমার অনুজ (Junior) আধিকারিককে আমার অফিসের কার্যের অগ্রগতি পরিদর্শন করতে পাঠিয়েছিলেন । প্রশাসনিক নীতি অনুযায়ী কোন অনুজ বা সমবরিষ্ঠতার (of same or equivalent seniority) আধিকারিক কোন অগ্রজ বা অন্য সমবরিষ্ঠতার আধিকারিকের কার্য পরিদর্শন বা পর্যালোচনা করতে পারেন না । আমি অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করে ওর কার্যাবলী কি ভাবে আমার মর্যাদায় আঘাত করছে জানিয়ে লম্বা ছুটিতে চলে গেলাম ।
ছুটি শেষে সেন্সাস অধিকারে (Directorate of Census) যোগ দিয়ে সে দিনই (৩১-০৩-১৯৮২) দায়িত্বভার ত্যাগ করে ক্ষুদ্র শিল্প অধিকারে উপ-অধিকর্তা (এমপ্লয়মেণ্ট) পদে যোগ দিলাম ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, যিনি সেন্সাস অধিকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি পূর্ববর্তী জেলাশাসক পদে আসীন থাকাকালে দু বছরের অধিক সময় আমি ওঁর অধীনে খুব কাছে থেকে কাজ করেছি । তিনিই দু বছরের অধিক কাল কাছে থেকে আমায় কাজ করতে দেখে নিজেই সেন্সাস পদের জন্য আমাকে নির্বাচন করেছিলেন । আমার কাজকর্ম্মের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন থাকলে উনি অবশ্যই সে সম্বন্ধে আমাকে বলতে পারতেন আর তাই হত রীতিসম্মত ।
আমার মনে হয় যে অফিসাররা অধিকর্তাকে সাহচর্য দিতেন তাদের মধ্যে অন্ততঃ কেউ কেউ আমার সম্পর্কে অধিকর্তার মনে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন । এই স্তাবকরা প্রায়শঃ নিজেদের মধ্যে সময় বিশেষে অধিকর্তার উপস্থিতিতে অসংযত শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করতেন । ওরা চাইতেন বাকীরাও ওদের দলে যোগ দিন । আমি বরাবর সরকারী কাজকর্মের ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে খোস গল্প করার চেয়ে স্বস্থানে কর্তব্য সম্পাদনে ব্যপৃত থাকার পক্ষপাতী । আমাকে দলে টানতে না পেরে স্তাবকদের একাংশ হয়ত আমার বিরুদ্ধে কুৎসামূলক ফিসফিস প্রচার (whispering campaign) শুরু করে থাকবেন বা অধিকর্তার কাণ ভাঙিয়ে থাকবেন ।