সমবায় সূতাকলে এম. ডি. পদে নিয়োগ ও যোগদান
আমার পরবর্তী নিয়োগ হল সমবায় ভিত্তিক দুটি ভাবী সূতাকলের পরিচালন অধিকর্তা (Managing Director) হিসাবে । সূতাকল দুটির একটি মেদিনীপুর শহরে তাম্রলিপ্ত কোঅপারেটিভ স্পিনিং মিলস লিমিটেড নামে এবং অপরটি বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় কংসাবতী কোঅপারেটিভ স্পিনিং মিলস লিমিটেড নামে স্থাপন করা স্থিরীকৃত হয়েছিল । দুটি সূতাকলেরই সদর দপ্তর কোলকাতায় হবে বলে স্থির ছিল ।
১৯৮২ সালের ৬ই আগস্ট আমি পদ দুটিতে যোগ দিলাম । সূতাকল দুটি বলতে গেলে তখন ভ্রুণ অবস্থায় ছিল ।
আমার যোগ দেয়ার প্রাক্কালীন সূতাকলের প্রশাসন
হ্যাণ্ডলুম অধিকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকের দায়িত্বে ও কয়েকজন ডেপ্যুটেড কর্মচারী নিয়ে দুটি মিলের যুগ্ম অফিস ছিল । অফিসটি কোলকাতার অন্য একটি অফিসের ছোট একটি কুঠুরিতে অবস্থিত ছিল । তাঁত ও বস্ত্র শিল্পের অধিকর্তা মিল দুটির চেয়ারম্যান ছিলেন । পরিচালন সমিতি সরকারের মনোনীত সদস্যদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল ।
অফিস প্রতিষ্ঠা
আমার প্রথম ও প্রধান কাজ হল অফিসবাড়ী খুঁজে বার করা ও কর্মী নিয়োগ । কর্মী নিয়োগের জন্য কর্মসংস্থান কেন্দ্র থেকে যোগ্য প্রার্থী তালিকা সংগ্রহ করে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন করা হল । যথাসময়ে নির্বাচিত প্রার্থীদের কর্মে নিয়োগ করলাম । যাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল কালক্রমে তারা ভাল কর্মী, আন্তরিক ও পরিশ্রমী হিসাবে নিজেদের প্রতিপন্ন করল।
ইতিমধ্যে অফিসের জন্য আমি একখানা বাড়ী ভাড়া করলাম ও হিসাবপত্র তদারকির জন্য একজন চার্টার্ড একাউণ্টেণ্টকে আংশিক সময়ের জন্য নিয়োগ করলাম । চার্টার্ড একাউণ্টেণ্ট একজন সৎ মানুষ ছিলেন । হিসাব পত্রের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাকে মাথা ঘামাতে হত না ।
অফিস চালু হওয়ার পর মিলের অবস্থানস্থলে দক্ষ তত্বাবধান ও স্থানীয় কর্ম্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি জীপ গাড়ী ক্রয় করেছিলাম ।
প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দ ও অর্থ সংস্থান
প্রাথমিক প্রাক্কলনে প্রতিটি মিলের প্রকল্পব্যয় নির্ধারিত ছিল ৮০১ লক্ষ টাকা । অর্থসংস্থান পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ব্যয়ের ৫০% মূলধনী শেয়ার হিসাবে রাজ্য সরকারের প্রদেয়, অবশিষ্টের একটি অংশ কম সুদে ঋণ হিসাবে জাতীয় সমবায় উন্নয়ন কর্পোরশনের (NCDC) প্রদেয় এবং বাদবাকী অংশ আইএফসিআই (IFCI), আইডিবিআই (IDBI) ও আইসিআইসিআই (ICICI) ব্যাঙ্কের গঠিত কনসোর্টিয়াম থেকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ হিসাবে প্রাপ্তব্য ছিল ।
পরবর্তীকালে প্রকল্পস্থানে মিলের প্রয়োজনীয় জল পাওয়া না যাওয়ায় দূর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহের জন্য রাজ্য সরকার নিজস্ব কোষাগার থেকে প্রকল্প ব্যয়ের অতিরিক্ত ২৭ লক্ষ টাকার একটি স্কীম মঞ্জুর করেছিলেন ।সূতাকল চালাবার একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান জলের উপলভ্যতা প্রকল্প রচনার সময় লক্ষ্য করা হয়নি, এটি অবশ্যই প্রকল্প রচনার সঙ্গে যুক্ত সকলের ক্ষেত্রেই গুরুতর ত্রুটি ।
জমির অধিকার গ্রহণ ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা পর্যালোচনা
অফিস স্থাপিত হওয়ার পর আমি আমার পদে যোগদানের পূর্বে নির্বাচিত মেদিনীপুর ও বড়জোড়া মিলের জমির দখল নিলাম । আমি আসার পূর্বেই মিলের গঠন-নক্সা তৈরী ও নির্মাণ কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের জন্য আর্কিটেক্টও নিযুক্ত হয়ে গিয়েছিল । জমির অধিকার প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে আর্কিটেক্টের করণীয় কি থাকতে পারে আমার বোধগম্য হল না । যাহোক, আমার বিবচনায় মনে হল এত বড় মাপের একটি নির্মাণ কার্য একক ভাবে কোন প্রাইভেট আর্কিটেক্টের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না (১) । যথার্থ ও কার্যকরী তত্ত্বাবধানের জন্য সরকারী কোন বরিষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারকে ডেপ্যুটেশনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
নির্মাণ কার্যের তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ
উপরের অনুচ্ছেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্মাণকার্য তত্ত্বাবধান ও নিরীক্ষণের জন্য দুটো সোসাইটির জন্য একটি নির্বাহী বাস্তুকারের পদ সৃষ্টি করা হল । পরে আমি রাজ্য পূর্ত বিভাগ থেকে একজন নির্বাহী বাস্তুকারকে ডেপ্যুটেশনে নিয়ে এলাম । সৌভাগ্যক্রমে উনি একজন অত্যন্ত সৎ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন । প্রতিটি মিলের মিল সাইটে দৈনন্দিন নির্মাণ কার্য তদারকির জন্য একটি করে দুটি এ্যসিস্টেণ্ট ইঞ্জিনিয়ারের পদও তৈরী করানো হল । এই দুটি পদের জন্যও পূর্ত বিভাগ থেকে দুজন সহকারী বাস্তুকারকে ডেপ্যুটেশনে নিয়ে এলাম । এদেরকে নির্বাহী বাস্তুকারের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হল ।
ঘোড়ার আগে গাড়ী সংযোজন: জমির দখল পাওয়ার আগেই মেশিনের অর্ডার
আমার যোগদানের পূর্বেই প্রতিটি মিলের জন্য পঞ্চাশ হাজার স্পিণ্ডল বা টাকু ক্ষমতা বিশিষ্ট মেশিনের অর্ডার ট্যাক্সমেকো কোম্পানিকে দেয়া হয়ে গিয়েছিল । অর্ডার নিশ্চিত করার শর্ত হিসাবে মেশিনপত্রের মোট মূল্যের কিয়দংশও অগ্রিম হিসাবে কোম্পানিকে দেয়া হয়েছিল । মেসিন স্থাপন করার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরীর কাজ শুরু হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি মেশিনের অর্ডার দেয়ার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না । বিশেষতঃ যখন মিলের জমিও হাতে আসে নি এবং সময়ের পূর্বের প্রদত্ত এই অর্ডারে মিলের প্রাপ্তব্য কোন ডিসকাউণ্ট বা মূল্যবূদ্ধির (escalation) বিরুদ্ধে কোনরূপ মূল্য সুরক্ষা (price protection) ব্যবস্থা ছিল না ।
মিলের পরিকাঠামো তৈরীর পূর্বে মেসিন সরবরাহের প্রস্তাব
পরবর্তীকালে আমি যখন প্রকল্পের দায়িত্বে সেই সময় সরবরাহকারী কোম্পানি মেসিনগুলি ডেলিভারী করে দিতে চেয়ে একটি প্রস্তাব নিয়ে এল । এই প্রস্তাব গৃহীত হলে মিলকে মেসিনের মূল্য বাবদ প্রাপ্য বাকী সম্পূর্ণ অর্থ কোম্পানিকে মিটিয়ে দিতে হত । মিলের ফ্যাক্টরির কাঠামো তৈরীর কাজ তখন সবে শুরু হয়েছে । মেসিন বসাবার অবস্থায় আসতে তখনও অনেক দেরী । কোম্পানি প্রস্তাব দিল মেসিন সরবরাহের পর যতদিন না মিল মেসিন বসাবার অবস্থায় আসছে ততদিন ওগুলো ওরা ওদের হেফাজতে রাখবে । সোসাইটির চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রস্তাবটি আমার কাছে এল । এই প্রস্তাবে মিলের পক্ষে প্রাপ্তি কিছুই ছিল না, পুরো প্রস্তাবটাই কোম্পানির প্রত্যক্ষ আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল । অর্ডারের মেসিনগুলোর মূল্যের বাকী প্রাপ্য অংশ আদায় করাই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল । আমি দৃঢ়ভাবে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কি কি ভাবে এটি মিলের স্বার্থের প্রতিকূল সে বিষয়ে ৭ দফা বিবরণ লিপিবদ্ধ করে প্রস্তাবটি চেয়ারম্যানের কাছে পেশ করলাম ।
উৎকোচ দিয়ে কার্যোদ্ধারের প্রয়াস
সম্ভবতঃ কোম্পানির প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার অভিমত কোম্পানির কর্মকর্তারা কোনভাবে জানতে পারে । ওরা এটাও বুঝতে পারে এই অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে ওদের প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই । এরপর একদিন সকালবেলা কোম্পানির দু-তিন জন আধিকারিক অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করে ওদের প্রস্তবটি নিয়ে আলোচনা করতে চায় । আমি সরাসরি ওদের বলি এ বিষয়ে আলোচনার কিছু নেই । এই বলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরের দিকে এগোই । ওরা আমার সঙ্গে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে আমি কোথাও বেড়াতে যাই কি না । ইতিবাচক উত্তর পেয়ে ভারতের যে কোন রাজ্যে সপরিবারে বেড়াতে গেলে ওরা সেটা স্পনসর করার অভিপ্রায় ঈঙ্গিতে জানায় । ওদের সেই ঈঙ্গিত অবজ্ঞাপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমি কাজে বেরিয়ে যাই । সেই প্রস্তাব আর অনুমোদন পায় নি ।
প্রকল্প রচনায় বিচ্যুতি
জমির দখল নেয়ার পর আমি যখন মিলের ফ্যাক্টরী কাঠামো নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে যাব তখন আমার নজরে আসে সূতাকল চালাবার অত্যাবশকীয় উপাদান জল অকুস্থলে উপলভ্য নয় । মিল প্রতিষ্ঠা করতে হলে জলের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত করা অপরিহার্য । আমি অবিলম্বে বিষয়টির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম । সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন পাইপ লাইন যোগে বড়জোড়া থেকে ১২ কি মি দূরে দুর্গাপুরের দামোদর নদ থেকে কংসাবতী মিলের জল ও মেদিনীপুর শহর থেকে ০.৫/১ কি মি দূরে কংসাবতী নদী থেকে তাম্রলিপ্ত মিলের জল আনা হবে । স্থির হল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ প্রকল্প রচনা ও রূপায়নের দায়িত্ব নেবে । এই প্রকল্প বাবদ ব্যয় রাজ্য সরকার বহন করবে আর তা সূতাকল প্রকল্পের অংশ হিসাবে গণ্য হবে না । স্পষ্টতঃ রূপায়নের পর এই পাইপ লাইন স্কীম সচল রাখতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে রাজ্য সরকারকে উল্লেখযোগ্য পৌনঃপুনিক অর্থ ব্যয় করতে হবে । এটি একটি হটকারী সিদ্ধান্ত-প্রসূত প্রকল্পের ক্লাসিক উদাহরণ যেখানে প্রকল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে অবাঞ্ছিত ব্য়য়ভার বছরের পর বছর বয়ে যেতে হবে । স্থান নির্বাচনের সময় কেউ স্থানটিতে প্রকল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলি রয়েছে কি না সেটা দেখা প্রয়োজন মনে করেন নি । প্রকল্প-স্থান রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্দ্ধারিত হয়েছিল কি না তা অবশ্য আমার জানা নেই ।
যতদূর আমি মনে করতে পারি পাইপ-লাইন স্কীমের প্রাথমিক ব্যয়বরাদ্দ ছিল ২৭ লক্ষ টাকা ।
এইফকোস্পিন ও এনসিডিসি
মোম্বাইতে অল ইণ্ডিয়া ফেডারেশন অফ কোঅপারেটিব স্পিনিং মিলস লিমিটেড (এইফকোস্পিন, AIFCOSPIN) নামে ভারতের সকল সমবায় সূতাকলগুলির একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আছে । এই ফেডারেশনে বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন যারা ফেডারেশনকে প্রদেয় নির্দিষ্ট কনসালটেনসি চার্জের বিনিময়ে স্পিনিং মিলকে প্রকল্প রচনা, মেসিনারী নির্বাচন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকল্প মূল্যায়ন ইত্যাদি কাজে সাহায্য করে থাকেন । আমাদের মিল দুটিও ঐ প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিল । প্রকল্প রচনায় প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের সাহায্যও নেয়া হয়েছিল । আমি দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম, প্রকল্প রচনায় যুক্ত থেকেও ঐ প্রতিষ্ঠান প্রকল্প রচনাকালে প্রকল্পস্থানে জলের অনুপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয় নি । সম্ভবতঃ বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পস্থল পরিদর্শন করেন নি যা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা বিবেচনার্থে ওদের করা উচিত ছিল ।
যাহোক, মিল সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করতে ও ফেডারেশনের বার্ষিক সাধারণ সভায় উপস্থিত হতে মিলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমি মোম্বাই গিয়েছিলাম । সেটিই ছিল আমার প্রথম মোম্বাই দর্শন ।
আমাদের মিল দুটির জন্য ঋণমঞ্জুরীর তদ্বির করতে আমি দিল্লিতে জাতীয় সমবায় উন্নয়ন কর্পোরেশনের সদর দপ্তরেও গিয়েছিলাম । প্রকল্প থেকে আমি বিদায় নেয়ার পূর্বেই ঋণের মঞ্জুরীপত্র এসেছিল ।
পরিচালন অধিকর্তা হিসাবে আমার কার্যক্রম
মিলের পরিচালন অধিকর্তা হিসাবে আমার কার্যক্রম সংক্ষেপে নিম্নরূপ ভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে ।
(১) পরিকাঠামো গঠন, যথা প্রাথমিক পর্যায়ে সহায়ক কর্মী ও আধিকারিক সহ অফিস প্রতিষ্ঠা, জমি ও জলের ব্যবস্থা ইত্যাদি ।
(২) প্রকল্প মূল্যায়ন ও প্রকল্প রূপায়নে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ অনুমোদনের জন্য আইডিবিআই, আইএফসিআই, আইসিআইসিআই ইত্যাদি সর্বভারতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদন ।
(৩) নির্মাণ ও বৈদ্যুতিক কার্য, আর্দকরণ (Humidification), বুনোন যন্ত্রপাতি (যার প্রথম অংশ আমার যোগদানের পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল) ইত্যাদি বিষয়ে চুক্তি চূঢ়ান্তকরণ ।
(৪) সামগ্রিক ভাবে সর্ব বিষয়ে তদারকি ।
(৫) নির্বাহী প্রধান হিসাবে আর্থিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ।
এটি এমন একটি বিশেষ ধরণের বহুমুখী প্রকল্প ছিল যাতে খুব কম সংখ্যক মধ্যস্তরীয় সিভিল সার্ভেণ্টের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ হয় । রূপায়ন স্তরে এই প্রকল্পের শীর্ষে থেকে আমি আমার জ্ঞানকে বহুলাংশে সম্বৃদ্ধ করতে পেরেছিলাম ।
আমি চার বৎসরের অধিক কাল এই প্রকল্পের শীর্ষে ছিলাম এবং এর প্রতিটি দিকের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত ছিলাম ।
বিদায়
১৯৮৭ সালের ২রা মার্চ আমার পরবর্তী পদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্প বাণিজ্য দপ্তরের উপসচিব পদে যোগ দিতে আমি এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাই ।
প্রকল্পের নির্মাণকার্য তখন অগ্রবর্তী স্তরে, এনসিডিসির ঋণ অনুমোদিত হয়ে গেছে ও সর্বভারতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কনসোর্টিয়াম দ্বারা প্রকল্পের মূল্যায়নও সমাপ্ত হয়েছে ।
যে সরকারী আবাসে আমার কোলকাতার চাকুরীজীবনের বৃহদাংশ কাটিয়েছি
এই অংশ এখানে জুড়েছি কেননা এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার সময়ই এই সরকারী ফ্ল্যাট আমার নামে বরাদ্দ হয়েছিল ।
এতদিন আমি বরানগরের ভাড়া বাড়ী থেকে অফিস যাতায়াত করতাম । ১৯৮২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর যখন আমি এই দুটি স্পিনিং মিলে কর্মরত সেই সময় আমার নামে সরকারী ফ্ল্যাট বরাদ্দের আদেশ পেলাম । ফ্ল্যাটটি ছিল ২৪৭/১ লোয়ার সার্কুলার রোডে মিণ্টোপার্ক সরকারী আবাসন নামে একটি নবনির্মিত আবাসনে ।
খগেন্দ্র নাথ ভৌমিক নামে একজন বরিষ্ঠ সহকর্মীর আনুকুল্যে ফ্ল্যাটটি পেয়েছিলাম । শ্রীভৌমিক তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবাসন বিভাগের উপসচিব, সরকারী আধিকারিকদের বাড়ী/ফ্ল্যাট বরাদ্দের বিষয়টির দায়িত্বে ছিলেন । শ্রীভৌমিকের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল ।
ফ্ল্যাটটি একটি উৎকৃষ্ট এলাকার বহুতল অট্টালিকায় অবস্থিত ছিল । অট্টালিকাটির সপ্তম তলে ৬৮ নং এই ফ্ল্যাটটি যথেষ্ঠ বায়বায়িত ও সুন্দর ভূচিত্র দর্শনে উন্মোচিত ছিল । এখান থেকে রেসকোর্স ও ভিক্টরিয়া মেমোরিয়াল দেখা যেত । আমরা এই ফ্ল্যাটে উঠে আসি ১৯৮৩ সালের ১৪ই জানুয়ারী । ১৯৯৭ সালের ১লা জুন সল্টলেকে আমাদের কোঅপারেটিভ ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমরা এখানেই ছিলাম ।
ফেমুর ভেঙ্গে যাওয়া জনিত জটিলতায় আমার মা এই ফ্ল্যাটেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
এই ফ্ল্যাটে অবস্থানের স্মৃতি আমার মনে যুগপৎ আনন্দ ও বিষাদের সূষ্টি করে । সেগুলিকে নিম্নলিখিত ভাবে সংখ্যার্পিত করা যায়:
(১) এখানে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে অনভিপ্রেত অবস্থার সম্মুখীন হই যা ঘটিয়েছিল রাজ্যপালের এডিসি । এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ রাজ্যপালের উপসচিব হিসাবে আমার রাজভবন কার্যকালের অধ্যায়ে পাওয়া যাবে ।
(২) এখানেই আমি আবার মূল্যবান কিছু হারিয়ছি যার স্মৃতি আমি এখনও হৃদয়ে গভীর ভাবে লালন করি ।
(৩) প্রথমবারের আইএএসে (IAS) পদোন্নতি এখানে থাকাকালীনই হয় এবং এখান থেকেই তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হই ।
(৪) তৃতীয়বারের পদোন্নতিতে এখান থেকেই আইএএসে (IAS) যোগদান করি এবং উন্নীত পদে প্রাথমিক পর্যায়ে এখান থেকেই কর্তব্য সম্পাদন করি ।
(৫) আমরা এখানে থাকাকালীনই আমার কনিষ্ঠা কন্যা গ্যাস্ট্রো এন্টেরিক অসুখে আক্রান্ত হয় । অসুখের তীব্রতায় ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় ।
(৬) আমার বড়মামা (দ্বিতীয়বার) ও তার এক কন্যা, জামাতা ও দৌহিত্রী বাংলাদেশ থেকে এখানেই আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন ।
(৭) বড়মামার কনিষ্ঠ ভ্রাতা, আমাদের কুটুমামা, ওঁর কন্যাদের নিয়ে শিলচর থেকে এখানেই আমাদের কাছে বেড়াতে এসেছিলেন ।
(৮) আমার মামাতো ভাই দীপু (বড়মামার নিউইয়র্কবাসী পুত্র) বিয়ের পর স্ত্রী ঝুমাকে নিয়ে এখানেই আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল । বিয়ের পূর্ব্বেও ও বার দুয়েক বাংলাদেশ হয়ে আমাদের কাছে এসেছিল এই বাড়ীতেই ।
(৯) এখান থেকেই আমার কনিষ্ঠা শ্যালিকা শান্তির, (যে দীর্ঘকাল আমাদের পরিবারের অংশ ছিল), বিয়ে দিয়েছিলাম ।
(১০) এখান থেকেই আমার কনিষ্ঠা কন্যা স্কুল যাতায়াত শুরু করে ।
সুতরাং এই বাড়ী আমার অবসর-পূর্ববর্তী কোলকাতা জীবনের বৃহদাংশ ঘটনার সাক্ষী ।