রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীহট্ট দর্শনের শতবর্ষ পূর্তিতে শহরের চান্দনী ঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্মারকস্তম্ভ
আমার জন্মভূমি দর্শন
ডিসেম্বর ২০১৯
সূচীপত্র
শ্রীহট্ট দর্শনের পটভূমি
শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রেফারেণ্ডাম (অপশন: ভারত বা পাকিস্তান) এবং পরবর্তী ভারত ভাগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি বাবা-মার হাত ধরে আমার জন্মভূমি ছেড়ে আসি । সে প্রায় বাহাত্তর বছর (২০২২ সালের সাপেক্ষে) আগের কথা । এরপর ১৯৬০ এর দশকের প্রথম দিকে যখন আমি শিলংএ কলেজে পড়তাম সেই সময় একবার তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান-ভারত তথা শ্রীহট্ট-মেঘালয় সীমান্তে অবস্থিত তামাবিল নামক স্থানে গিয়েছিলাম । সেই সময় সেখান থেকে অনতি দূরে অবস্থিত শ্রীহট্টে আমার জন্মস্থান দেখতে যাওয়ার এক তীব্র বাসনা হৃদয়ে অনুভব করেছিলাম । জন্মভূমি দর্শনের এই আকাঙ্খা অবশ্য পরে পড়াশোনা ও চাকুরীর ব্যস্ততার দরুণ অন্তরালে চলে যায় । অবসর গ্রহণের পর এই অভিলাষ আবার মাথা চাড়া দেয় ও ২০১৮ সালের পরে তা অপ্রিতরোধ্য হয়ে ওঠে । বাংলাদেশ যেতে সর্বাগ্রে পাসপোর্টের প্রয়োজন । বিদেশ ভ্রমণের প্রয়োজনীয় কোন পাসপোর্ট আমার ছিল না । এ যাবৎকাল আমার কোন পাসপোর্টের প্রয়োজন না হওয়ায় পাসপোর্ট করাইওনি ।
কিন্তু পাসপোর্টের অভাব আমার জন্মভূমি সফরের কোন অন্তরায় হতে পারে না । এক মাসের মধ্যে আমি আমার ও আমার স্ত্রীর পাসপোর্ট ও বাংলাদেশ ভ্রমণের ভিসা সংগ্রহ করলাম। কোলকাতা-গুয়াহাটি-শিলং-তামাবিল-সিলেট এই পথ ধরে ২৯ নবেম্বর, ২০১৯ যাত্রা শুরু করার পরিকল্পনা করেছিলাম । কিন্তু ২৯ এর আগের রাতে আমার দৌহিত্র হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই পরিকল্পনা রদ করতে হয় । আমার দৌহিত্র তখন আমাদের বাড়ীতেই ছিল ও কর্মোপলক্ষে ওর বাবাও শহরের বাইরে ছিল । ও খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর ওর বাবা ফিরে এলে আমরা ১লা ডিসেম্বর ২০১৯ রওয়ানা হলাম।
প্রারম্ভিক: যাত্রার প্রথম দুদিন
১লা ডিসেম্বর সকাল ৯টার বিমানে সস্ত্রীক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে গুয়াহাটি রওয়ানা হলাম । ১০:১৫ নাগাদ বরজোড়া বিমান বন্দরে আমরা অবতরণ করি । সেখান থেকে ট্যাক্সিতে গুয়াহাটি । সেদিন আমরা গুয়াহাটিতে আসাম সরকারের টুরিষ্ট লজ প্রশান্তিতে রইলাম । বুকিং আগেই করা ছিল । পরদিন ২রা ডিসেম্বর সকালবেলা একটি আলাদা ট্যাক্সি ভাড়া করে শিলং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । শিলং পৌঁছে হোটেলে উঠলাম । হোটেল আগেই বুক করা ছিল । সে রাতটা আমরা শিলং-এ কাটালাম ।
যাত্রা ও গন্তব্যে উপনীতি
সিলেট যাত্রায় তামাবিলের পথে
শিলং-তামাবিল পথের একটি ভিউ পয়েণ্টে
তামাবিল সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে মামাতো ভাইপো সুজকের সাথে
মাতুলালয়, গোপীনাথ ভবন, দাড়িয়াপাড়া, শ্রীহট্ট ।
মাতুলালয়ে প্রবেশের মুখে মামাতো ভাই শঙ্করের সাথে
৩রা ডিসেম্বর সকাল ১০টা নাগাদ আগের দিন বুক করে রাখা একটি ভাড়া গাড়ীতে আমরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত তামাবিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । বেলা ১২:৩০ মিনিটে আমরা ভারতীয় অভিবাসন অফিসে পৌঁছুলাম । বিস্মিত হয়ে দেখলাম কর্মচারীবৃন্দ অফিসে তালা দিয়ে একযোগে জলযোগ করতে বেরিয়ে গেছে । আমাদের ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হল । সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে ভারতের সীমানা ছাড়ার অনুমোদন পেতে বিকেল ১:৪৫ । এরপর আমরা ভারতের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করলাম । সেখানে গাড়ী নিয়ে উপস্থিত ছিল আমার মামাতো ভাইপো সুজক । নথিপত্র নিয়ে বাংলাদেশ অভিবাসন অফিসে গেলাম । এখানে কর্মচারীরা যে যার কর্মে লিপ্ত ছিল । আমাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে বেশী সময় লাগল না । সুজকের গাড়ীতে সিলেট রওয়ানা হলাম ।
প্রথম শৈশবে বাবা-মার হাত ধরে দেশ ছেড়ে যাওয়ার ৭২ বছর পর আবার আমি জন্মভূমির মাটিতে পা রাখলাম । এই সৌভাগ্য আমাদের পরিবারের আর কারো হয় নি । হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করলাম; পৈতৃক ভিটে ও বহুযুগ পূর্বে শেষ দেখা মাতুলালয় দর্শনের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম ।
আমার এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের সফর ৩রা ডিসেম্বর শুরু হয়ে ৯ই ডিসেম্বর শেষ হয়েছিল । আমার এই সফরের অভিজ্ঞতা দীর্ঘ সময় পর নিজের মূলে ফিরে আসা একজন মানুষ তথা একজন পর্যটক হিসাবে বিবৃত করতে চাই ।
তামাবিল সীমান্ত থেকে সিলেটের দূরত্ব ৫০-৫৫ কিমি । বিকেল ৪টা নাগাদ আমরা সিলেটে মামাবাড়ীতে পৌঁছুলাম । সেখানে আমার বড়মামার দিকের আত্মীয়স্বজনেরা সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল । ওদের উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা আমাদের অভিভূত করল ।
মামাতো ভাইদের মধ্যে বড়মামার দ্বিতীয় ও পঞ্চমপুত্র উপস্থিত ছিল । দ্বিতীয়পুত্র চন্দন সংসারত্যাগী সাধু হয়ে সে ভাবেই বাস করছে । শৈশবে ওকে হাটি হাটি পা পা অবস্থায় দেখে যাওয়ার পর এই প্রথম দেখা । সেদিনের সেই চেহারার সঙ্গে ওর আজকের চেহারার মিল খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা । সেই প্রচেষ্টা থেকে বিরত রইলাম । পঞ্চমপুত্র শঙ্করের জন্ম আমাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর । ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ভারত ভাগের পর শিলচরে, পরে কয়েকবার কোলকাতায় আমাদের বাড়ীতে দেখা হয়েছে । ওর চেহারা তাই আমার পরিচিত ।
আমরা যখন পৌঁছুই সেই সময় ঐ দুই ভাই ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনদের যারা তখন সিলেটে ছিল, তারা সবাই উপস্থিত ছিল । এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মামাতো ভাইপো সুজক যে আমাদের তামাবিল থেকে নিয়ে এসেছিল সে ছাড়া ওর স্ত্রী পলি ও পুত্র শ্রীহান এবং মামাতো ভাই শঙ্করের পুত্র সৈকত ও পুত্রবধু অহনা, কন্যা টুম্পা ও ওদের ছেলেমেয়ে । এদের সকলকেই আমি জীবনে প্রথম দেখলাম, কিন্তু কারো মধ্যে অপরিচিতির জড়তা ছিল না । এটাই বোধহয় মূলের ধর্ম; বাহ্যিক ভাবে ভিটেমাটি থেকে উৎপাটিত হলেও অন্তরে একই থেকে যায় । ওদের সারল্য, উষ্ণতা, ঐকান্তিকতা আমাকে মুগ্ধ করল । আমার ছোট ছোট নাতি নাতনিরাও ওদের মধ্যে আমাদের পেয়ে খুশীতে মেতে উঠল ।
মামাতো ভাইপো সুজক বাড়ীর যে অংশে বাস করে আমরা সেখানেই ছিলাম । এটাই বড়মামাদের আদি বাড়ী ছিল । সংসারে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আশে পাশে দালানবাড়ী যোগ হয়েছে । এই বাড়ীতেই বড়মামা ও কুটুমামা (বড়মামার ছোট ভাই) সপরিবারে বসবাস করতেন এবং এখানেই আমি আমার প্রথম শৈশবে মায়ের সঙ্গে এসেছি; অবশ্যই সময়ের সাথে সাথে বাড়ীর মধ্যেও কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে । তবু এই সেই স্থান যেখানে আমি শৈশবের প্রত্যুষে আমার মামাতো ভাই মানিকের সঙ্গে খেলা করেছি । মানিক আমার চেয়ে মাস কয়েকের (সঠিক ভাবে বলতে গেলে ৯+ মাসের) ছোট ছিল, কিন্তু এক দশকেরও বেশী সময় পূর্বে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছে । ওর স্মৃতিতে আমি বিমর্ষ হয়ে পড়লাম, মানিকের জীবৎ কালে আসতে না পারার অনুশোচনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল ।
এই বাড়ীতে প্রবেশের সাথে সাথে আমার স্মৃতিপথ অবারিত হয়ে গিয়েছিল, বহুযুগের ওপার থেকে ছোটবেলার স্মৃতি সব একে একে ভেসে আসতে লাগল । ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আমার দাদামশায় যে ঘরে থাকতেন, যেখানে তাঁর গোয়ালঘর ছিল, আমার অন্যান্য মামারা যে সব ঘরে থাকতেন সব দেখতে লাগলাম । দাদামশায়ের গরু বা গোয়ালঘর আজ আর নেই, কিন্তু দাদামশায় নিজে যে ঘরে থাকতেন তা প্রায় একই রকম আছে । আমার অন্য মামারা যে সব ঘরে থাকতেন সেখানকার নবনির্মিত (মামাদের সময়ের সাপেক্ষে} দালান কোঠাগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখলাম ।
স্ত্রী আলপনা, পুত্র সৈকত, পুত্রবধু অহনা, কন্যা টুম্পা ও নাতিনাতনীদের নিয়ে মামাতো ভাই শঙ্কর মূল বাড়ীর পাশে নতুন তিনতলা দালানবাড়ীতে বসবাস করে । এই অংশেরই লাগোয়া গৃহদেবতা গোপীনাথের মন্দির । প্রয়াত মামাতো ভাই প্রদীপ ওরফে পদের বিধবা স্ত্রী হেনা দুই পুত্র ও এক পুত্রবধুকে নিয়ে মূলবাড়ীর বর্ধিত অংশে বাস করে । বাকী ভায়েরা সপরিবারে আমেরিকায় রয়েছে । আমাদের থাকাকালীনই বাড়ীর পেছন দিকে একটি একতলা দালানবাড়ী তৈরীর কাজ শুরু হয়েছিল ।
সুজকের স্ত্রী পলি ওরফে পিয়ালী আমাদের দেখাশোনা করেছে । সে একটি অসাধারণ মেয়ে, হাসিখুশী ও আন্তরিকতায় ভরপুর । সারাক্ষণ মুখে হাসি ধরে রেখে ও অবিরাম নিজের কাজ করে যায় । অত্যন্ত পরিশ্রমী মেয়ে, আমাদের থাকাকালীন ওকে আমি একবারও গুমড়ামুখে দেখিনি । ওর আরেকটি গুণ, ও অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ । ওর বাড়ীতে আত্মীয় পরিজনের ভীড় লেগেই থাকে; ও আন্তরিকতার সঙ্গে সকলের সেবাযত্ন করে । পলি ছবি তুলতে ও তা ফেসবুকে পোস্ট করতে খুব ভালবাসে । ওর ফেসবুক পোস্ট থেকেই দেশ বিদেশ থেকে ওদের বাড়ীতে আত্মীয়সবজনের আনাগোণার খবর পাই । ও অত্যন্ত কোমলহৃদয়াও বটে, ওদের বাড়ী থেকে বিদায় নেয়ার সময় আমি ওর চোখের কোণে জল দেখেছিলাম । ছেলে শ্রীহানকেও ও ভালভাবেই মানুষ করছে । শ্রীহানও মায়ের মত উষ্ণহৃদয় ও দেখলেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে এমন শিশু । আমার অন্য ভইপো সৈকত ও ভাইঝি টুম্পার দিকের আমার নাতিনাতনীরাও ওদের মা বাবার সাথে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল । ওদের আনন্দমুখর সাহচর্য আমাদের হৃদয়মন ভরিয়ে দিয়েছিল ।
মাতুলালয়ে প্রবেশের মুখে গোপীনাথ মন্দিরে নাতি-নাতনীদের সাথে ।
মামতো ভাই সাধু চন্দনের সাথে বাড়ীর ভেতর ।
দাঁড়িয়ে (বাম থেকে ডানে): মামাতো ভাই শঙ্করের স্ত্রী আলপনা, ওদের পুত্র সৈকত, পুত্রবধু অহনা ও কন্যা টুম্পা । বসে আমি ও আমার স্ত্রী অজিতা ।
বড়মামা ও মামীমা
মামাতো ভাই সাধু চন্দনের অল্পবয়সের ছবি ।
মামাতো ভাইপো সুজক (মানিকের কনিষ্ঠ পুত্র), ওর স্ত্রী পিয়ালী ও পুত্র শ্রীহান ।
পৈতৃক ভিটের খোঁজে
রায়নগর রাজবাড়ীর প্রাচীন রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ।
রায়নগর রাজবাড়ীর বিপরীত দিকের টিলাবাড়ী পৈতৃক ভিটে খুঁজতে গিয়ে যার দেখা পেয়েছিলাম ।
দ্বিতীয় দিনে আমার প্রথম কাজ হল দাড়িয়াপাড়ার মামাবাড়ী থেকে ৭-৮ কিমি দূরে রায়নগরে আমাদের পৈতৃক বাড়ীর খোঁজ করা । সেই বাড়ী সনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় দাগ নং বা হোল্ডিং নম্বর কিছুই আমার জানা ছিল না । বাড়ীর দলিল বা সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দেখার সুযোগ আমার কখনও হয়নি । ওগুলো বরাবর বাবার কাছেই ছিল । বাবার মৃত্যুর পর দাদার কাছে থেকে থাকবে । তবে আমি কোনদিন খোঁজ করিনি । আর আমার শ্রীহট্ট আগমনের অনেক পূর্বেই দাদাও গত হয়েছিল । আমি কেবল জানতাম আমাদের বাড়ী একটা টিলার উপর ছিল ও টিলার নীচে সমতল ভূমিতে আমাদের একটা নিজস্ব পুকুর ছিল । আমি মাকে সময় সময় বলতে শুনতাম আমাদের বাড়ী রাজবাড়ীর সন্নিকটে ছিল । দীর্ঘ কয়েক দশকের বড় সড় পরিবর্তনের পর আমার জানা এই যৎসামান্য তথ্য নিয়ে পৈতৃক বাড়ী খুঁজে বার করা কতটা সম্ভব হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল । যা হোক, একটা সৎ প্রচেষ্টা হিসাবে মামাতো ভাই শঙ্করকে নিয়ে পৈতৃক বাড়ীর, যা আমি বাবা-মার সাথে সাত দশক পূর্বে ছেড়ে এসেছিলাম, সন্ধানে বেরোলাম । শঙ্কর ওর ছোটবেলায় ১৯৫০ এর দশকের কোন এক সময় ওর কাকার তথা আমার ছোটমামার সাথে ঐ বাড়ী দেখতে গিয়েছিল । আমরা রায়নগর পৌঁছুলাম ও রাজবাড়ীর বিপরীতে টিলার উপর একটি বাড়ীও দেখতে পেলাম । কিন্তু স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে জানলাম আমরা যে পুকুরসহ টিলার খোঁজ করছি তা যে জায়গায় ছিল সে জায়গা আমরা রাজবাড়ী আসার পথে ছেড়ে এসেছি । তবে সে টিলা বা পুকুর কিছুই এখন আর নেই । পুকুর ভরাট করে আর টিলা সমতল করে সেখানে ঘরবাড়ী উঠেছে । কার গরু, কে দেয় ধোঁয়া ! দেশভাগের ফলে কিছু লোকের হ'ল যাকে ইংরেজীতে বলে windfall gain । আর আমরা (?) শূন্যহাতে গৃহহারা । যাক, আমরা রাজবাড়ীর রাস্তার এ মাথা ও মাথা করলাম । প্লট নং, হোল্ডিং নং জানা না থাকায় আমাদের ছেড়ে যাওয়া ভিটে সনাক্ত করা সম্ভব হল না । অতি বাল্যে যে এলাকায় থেকেছি ও হাটাচলা করেছি আজ বার্ধক্যে সেখানে পা ফেলতে পেরেছি এই সন্তুষ্টি নিয়েই আমাকে ফিরতে হল । আমার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটির সন্নিহিত এলাকায় যেখানে তাঁরা জন্মেছিলেন, যেখানে তাঁরা বড় হয়েছিলেন, যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন অন্ততঃ সেই এলাকায় আমি আসতে পেরেছি এটাই ছিল আমার এক বড় প্রাপ্তি ।
রাজবাড়ীরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে দেখলাম। রাজবাড়ী বলতে যা বোঝায় তার কোন অস্তিত্ব আজ আর নেই । রাজবাড়ীর চৌহদ্দির মধ্যে মহিলা ও শিশুদের জন্য একটি অনাথ আশ্রম স্থাপিত হয়েছে । তবে রাজবাড়ীর প্রাঙ্গনে প্রাচীন রাধাকৃষ্ণের মন্দিরটি এখনও রয়েছে ও সেখানে নিত্য পূজো হয় ।
রায়নগরের একটি গলিপথ
রায়নগর রাজবাড়ীর চৌহদ্দির ভেতর নির্মিত শিশু ও মহিলাদের অনাথ আশ্রমের আধুনিক ভবন
শ্রীহট্টের রায়নগর রাজবাড়ীতে স্থাপিত অনাথ আশ্রমের সাইনবোর্ড ।
দূর্গাবাড়ী ও এম সি কলেজ দর্শন
শ্রীহট্টের সাদিপুরে অবস্থিত দুর্গাবাড়ী মণ্ডপ
দুর্গাবাড়ীতে দেবী দুর্গার মূর্তি:
নিত্য পূজায় রত পুরোহিত
এরপর আমরা টিলাগর-অম্বরখানা রোডে সাদিপুরের বালুচরে দুর্গাবাড়ী দেখতে গেলাম । দুর্গা মন্দিরটি একটি টিলার উপর অবস্থিত । মন্দিরে পৌঁছুতে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয় । মন্দিরটি সুসংরক্ষিত ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । দেবী দুর্গার একটি মহিমাময় মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত । আমরা যখন দর্শন করতে যাই সেই সময় একজন পুরোহিত পূজো করছিলেন ।
দুর্গাবাড়ী থেকে আমরা মুরারীচাঁদ কলেজ (এম সি কলেজ নামে বহুল পরিচিত) দেখতে গেলাম । শ্রীহট্ট বিভাগে এটিই ছিল প্রথম কলেজ । ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটি বাংলাদেশের পুরণো কলেজগুলোর মধ্যে সপ্তম । শ্রীহট্টের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জীবনে এই কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । এক শত কুড়ি একর জমির উপর বিস্তৃত এই কলেজের ছাত্রসংখ্যা চৌদ্দ হাজার । কলেজের প্রবেশ পথের বাম দিকে শেখ মুজিবর রহমানের একটি বিশাল আবক্ষ কাট-আউট রয়েছে । গাছ গাছালির মধ্যে যথেষ্ট হাঁফ ছাড়ার জায়গা নিয়ে কলেজ বিল্ডিংস ও বিভাগগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । ব্যবহার্য কিছু প্রাচীন কাঠামোও এখানে সেখানে রয়েছে । চৌহদ্দির মধ্যে একটি বৃহদায়তন জলাশয় আছে। বিভাগের নাম ও পথ নির্দেশক সবই বাংলায় লেখা ।
বাংলাদেশে গাড়ীর নাম্বার প্লেট, দোকানের সাইনবোর্ড থেকে সব কিছুই বাংলায় । বাংলা এখানকার রাষ্ট্রভাষা ।
এম সি কলেজ থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা বাড়ী এলাম ।
মুরারীচাঁদ কলেজের ফটক, শ্রীহট্ট ।
মুরারী চাঁদ কলেজের প্রবেশ পথের পার্শ্বে শেখ মুজিবর রহমানের ফটো কাট আউট ।
মুরারী চাঁদ কলেজের গ্রন্থাগার ভবন, শ্রীহট্ট ।
মুরারী চাঁদ কলেজের অভ্যন্তরে যাতায়াতের পথ ।
সান্ধ্য বিনোদন
কাজী এ্যাসপারেগাসে নাতি শ্রীহানের (মামাতো ভাইপোর পুত্র) সাথে, শ্রীহট্ট ।
সন্ধ্যায় সুজক আমাদেরকে জিন্দাবাজারে কাজী এ্যাসপারেগাস নামে একটি নতুন চালু হওয়া রেষ্টুরেণ্ট কম্প্লেক্সে নিয়ে গেল । পলি ও শ্রীহান সঙ্গে ছিল । জায়গাটি খুব সুন্দর, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত । এর কেন্দ্রস্থলে বসার ব্যবস্থা ঘিরে খাবারের স্টল । আমরা কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে বাড়ী ফিরলাম । ঘড়িতে তখন রাত দশটা ।
আমাদের অবস্থানের দ্বিতীয় দিনের সমাপ্তি হল ।
পৌত্র (সুজকের পুত্র) শ্রীহানের সাথে শ্রীহট্টের কাজী এ্যাসপারেগাসের বাইরে ।
সুজক, পলি ও শ্রীহানের সাথে কাজী এ্যাসপারেগাসের বাইরে ।
কাজী এ্যাসপারেগাস, জিন্দাবাজার, শ্রীহট্ট: ভেতরের দৃশ্য ।
রাতারগুল জলাবন দর্শন
রাতারগুল জলাবনের অভ্যন্তরের একটি দৃশ্য
রাতারগুল জলাবনের অভ্যন্তরে নৌকোয় বিচরণশীল আমরা ।
পরদিন, ৫ই ডিসেম্বর ২০১৯ আমার ভাইপো সুজক আমাদের রাতারগুল জলাবন দেখাবার ব্যবস্থা করেছিল । রাতারগুল শ্রীহট্ট শহর থেকে ২৬ কি মি দূর । আমরা বিকেল ২:৩০ মি এ সুজকের গাড়ীতে বাড়ী থেকে রওয়ানা হয়ে ৪ টার সময় বোটিং পয়েণ্টে (নৌকো চড়ার জায়গায়) পৌঁছুলাম । আসার পথে গাড়ীর অডিও যন্ত্রে একটি ভারী সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলাম । সুজক জানালো গানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের অধ্যক্ষা আমার মামাতো বোনঝি (রেবার মেয়ে) রীমা গেয়েছে । গলাটি ভারী মিষ্টি, গানটি হৃদয়গ্রাহী; আমার সূক্ষ্ম অনুভূতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল । আমার এই বোনঝিকে দেখার সুযোগ হয় নি ।
বোটিং পয়েণ্টে আমরা একটা ডিঙি নৌকোয় চড়লাম । চেঙ্গির খাল নামক একটি সংযোগকারী খালের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে এই নৌকো আমাদেরকে জলাবনের প্রান্তে পৌঁছে দিল । সেখানে নৌকো পরিবর্তন করে অপেক্ষাকৃত বড় নৌকোতে জলাবনে প্রবেশ করলাম । আমরা দেড় ঘণ্টাকাল জলাবনের ভেতর ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির চমকপ্রদ দানের এক অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করলাম । পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্যের প্রতিফলিত আলোয় জলে অর্ধনিমজ্জিত বৃক্ষরাজির সে এক অপরূপ দৃশ্য যা কথায় প্রকাশ করা যায় না ।
বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার গোঁয়াইন ঘাটে গোঁয়াইন নদীর মিষ্টি জলে এই রাতারগুল জলাবন । এটি বাংলাদেশের একমাত্র এবং বিশ্বের অল্প কয়েকটি মিষ্টি জলের জলাবনের একটি । জলাবনটি ৫০৪ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত । ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এটিকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা করেছেন । এই জলাবনকে বাংলাদেশের আমাজন ও শ্রীহট্টের সুন্দরবন বলা হয়ে থাকে । জলাবনটির নামকরণ হয়েছে "রাতা" বা "পাতি" গাছের নাম থেকে যা সিলেটি লোকেরা ব্যবহার করে থাকেন । এই চিরসবুজ অরণ্য গাঁওয়াইন নদীতে অবস্থিত ও চেঙ্গির খাল দ্বারা যুক্ত । এখানকার অধিকাংশ গাছই করক গাছ । বর্ষাকালে এই অরণ্য ২০-৩০ ফুট জলের গভীরতায় নিমজ্জিত থাকে । অন্য সময় এই গভীরতা থাকে ১০ ফুট ।
পড়ন্ত বেলায় রাতারগুল জলাবনের অভ্যন্তরের একটি দৃশ্য ।
রাতারগুল জলাবনের অভ্যন্তরে নৌকোয় বিচরণশীল ।
পড়ন্ত বেলায় রাতারগুল জলাবনের অভ্যন্তরের আরেকটি দৃশ্য ।
সিলেট ক্লাব পরিভ্রমণ
সিলেট ক্লাব
রাতারগুল থেকে ফেরার পথে আমরা সিলেট ক্লাব দেখতে যাই । ভাইপো সুজক ক্লাবের মেম্বার । ক্লাবটি একটি সুদৃশ্য নিজস্ব অট্টালিকায় প্রতিষ্ঠিত । অন্যান্য ক্লাবসদৃশ ক্রিয়াকর্ম ব্যতীত এখানে বিভিন্ন ধরণের খেলাধুলোরও ব্যবস্থা আছে । ক্লাবটি এখনও উন্নতিকরণ পর্যায়ে রয়েছে । এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে পাঁচ শত ।
টিভি, ভিডিও, কম্প্যুটার, ইণ্টারনেট, ব্যায়ামাগার, পুল টেবিল ইত্যাদির সংযোগ বা ব্যবস্থাপনা তথা সেবা দেয়ার লক্ষ্যে ক্লাবটির পরিকল্পনা করা হয়েছ । চা ও নোনতা খাবার সরবরাহেরও ব্যবস্থা আছে। শিশুবান্ধব কর্নার, খেলার মাঠ, গল্ফকোর্স ও অন্যান্য খেলাধুলোর ব্যবস্থা করারও পরিকল্পনা রয়েছে ।
সিলেট ক্লাব দর্শনের মধ্য দিয়ে আমাদের সিলেট পরিভ্রমণের তৃতীয় দিনের কর্মসূচীর সমাপ্তি ঘটল ।
শ্রীহট্টের জলবায়ু
শ্রীহট্ট সমুদ্রস্তর থেকে ২১ মিটার উপরে । এখানকার জলবায়ু সাধারণতঃ মৃদু ও উষ্ণ । গ্রীষ্মকালে ভাল বৃষ্টিপাত হয়, শীতকালে সামান্য । বার্ষিক গড় উষ্ণতা ২৩.৬º সে । উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আগত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বায়ু ভারী বর্ষণ ঘটায় । শ্রীহট্ট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী এখানকার গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৪১৬২ মি মি । সর্ব্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় জুলাই মাসে যার পরিমাণ ১২৫০ মি মি ।
সিলেট মহানগরী ও শহরতলির দ্রষ্টব্য স্থান
সিলেটের মেডিকেল কলেজ রোডে অবস্থিত আলিয়া মাদ্রাসার প্রবেশপথ
চার মাথার মোড়, সিলেটের চৌহাট্টা ব্যবসাকেন্দ্র ।
সিলেটে সুরমা নদীর উপর কিন সেতু ।
সিলেটের চাঁদনীঘাটে সুরমা নদী ।
রবীন্দ্রনাথের শ্রীহট্ট আগমনের শতবর্ষ স্মারক, চাঁদনীঘাট, শ্রীহট্ট ।
শ্রীহট্টে কবিগুরুর রচিত কবিতা মমতাহীন কালস্রোতে । কবির শ্রীহট্ট দর্শনের শতবর্ষ স্মারকের গায়ে উৎকীর্ণ
১৯১৯ সালে সিলেট দর্শনের সময় তোলা কবিগুরু ও অন্যান্যদের গ্রুপ ফটো ।
আলি আমজাদ ঘড়ি, সিলেট ।
জজকোর্ট, সিলেট ।
সিলেট এডভোকেট সমিতির ১ নং হলের চিত্র ।
ডেপুটি কমিশনারের অফিস প্রাঙ্গন, সিলেট ।
হাসান মার্কেট, বন্দর বাজার, সিলেট ।
সিলেট সিটি কর্পোরেশন বিল্ডিং, বন্দর বাজার ।
চতুর্থ দিনে (৬ই ডিসেম্বর ২০১৯) আমি শহর ও শহরতলিতে ঘুরে ঘুরে প্রাচীন ও দর্শনীয় স্থানসমূহ দর্শন করলাম । দিনটি শুক্রবার (ইসলাম ধর্ম্মাবলম্বীদের জুম্মাবার) হওয়ায় অফিস আদালত সব বন্ধ ছিল । বাংলাদেশে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ।
যা হোক, সকালবেলা দৈনন্দিন প্রাতঃভ্রমণকালে বাড়ীর নিকটস্থ পুরনো মেডিকেল কলেজ রোড ধরে চৌহাট্টা নামক চৌমাথা (চার রাস্তার মিলনস্থল) তথা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার এলাকায় পৌঁছুলাম । বাংলাদেশ সময়ে তখন সকাল ৭:৩০ মি; দু-একটি রেস্টুরেণ্ট ছাড়া দোকান পাট সব বন্ধ । আলপাইন রেস্টুরেণ্ট নামে একটি চায়ের দোকানে আমি এক কাপ চা খেলাম । দাম সম্বন্ধে একটু ধারণা দিতে বলি একটি প্রমাণ মাপের কাপের দুই-তৃতীয়াংশ চায়ের দাম পড়েছিল বাংলাদেশী মুদ্রায় দশ টাকা । পথে আসতে আসতে মেডিকেল কলেজ রোডের মোড়ে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা দৃষ্টি গোচর হল । আলিয়া মাদ্রাসার প্রাঙ্গনটি বিস্তৃত । এর পাশে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ নামের একটি বিশাল মাঠ রয়েছে । আমাদের সিলেটে অবস্থান কালের মধ্যে ৫ই ডিসেম্বর ঐ মাঠে সিলেট জেলা ও নগর আওয়ামী লিগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল । মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে । এর ছাত্রসংখ্যা ৬৫০ । চৌহাট্টা এলাকায় আমার ভ্রমণকালে আমি বেশ কয়েকটি কুশলী স্থাপত্যের নির্দেশক অট্টালিকা দেখেছি এবং দাড়িয়াপাডা রোডে ও সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ফুল ও উদ্ভিদের নার্সারি দেখতে পেয়েছি ।
সকাল দশটা নাগাদ আমার ভাইপো সুজক শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখাতে আমাকে নিয়ে বেরোল । আমরা রিক্সা করে প্রথমেই চাঁদনি ঘাটে গেলাম । যে স্থানগুলো আমি দেখেছিলাম পশ্চাদপটসহ তার বিস্তৃত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করলাম ।
(১) কিন সেতু: সুরমা নদীর উপর অবস্থিত এই সেতু শ্রীহট্ট মহানগরীর একটি বিশিষ্ট ল্যাণ্ডমার্ক । ইহাকে শ্রীহট্ট মহানগরীর প্রবেশ পথ বলা হয়ে থাকে । সেতুটি তৈরী হয় ১৯৩৬ সালে এবং এর নামকরণ হয় আসামের তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর স্যার মাইকেল কিনের নামানুসারে । মাইকেল কিন ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত আসামের গভর্নর ছিলেন ।
(২) সুরমা নদী: শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সুরমা শ্রীহট্টের প্রধান নদী । মণিপুর পর্বতমালার মাও সাংসং নামক স্থানের নিকট উৎপন্ন এই নদীটি বরাক নামে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের নিকট দু ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর ভাগ সুরমা ও দক্ষিণ ভাগ কুশিয়ারা নামে বয়ে গেছে । এই স্থানে নদীটি সিলেট অবতলে প্রবেশ করেছে যার ফলে সুরমা অববাহিকার সৃষ্টি হয়েছে । ভারতীয় এলাকায় এই নদীটি বরাক নামেই পরিচিত । উত্তরে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা উপনদীসমূহের জলে সুরমা স্ফীত হয় । দক্ষিণবাহী সোমেশ্বরী নদীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরের অংশে এটি বাউলি নদী নামেও পরিচিত । কুশিয়ারা নদীর দক্ষিণের উপনদীগুলো হয় সিলেট পাহাড় নয় ত্রিপুরা পাহাড় থেকে উৎপন্ন । ত্রিপুরা পাহাড় থেকে আগত কুশিয়ারার প্রধান উপনদী মনু । সুরমা নদীর একটি প্রধান শাখানদী কুশিয়ারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর কুশিয়ারা কালনি নদী নামেও পরিচিত হয় । বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব বাজার নামক স্থানের উপরদিকে সুরমা ও কুশিয়ারা পুনর্যুক্ত হয়ে মেঘনা নাম গ্রহণ করে । অবশেষে তা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয় । সুরমা নদীর গড় গভীরতা ২৮২ ফুট (৮৬ মি) সর্বাধিক গভীরতা ৫৫০ ফুট (১৭০ মি) । সুরমা নদী বাংলাদেশের বহু সংখ্যক হাওরের (Wetland ecosystem) মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।
(৩) শতবর্ষ স্মারক: পাথরে খোদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ণাবয়ব রেখাচিত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৯ সালে শ্রীহট্ট আগমনের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এই স্মারকটি সিলেট সিটি কর্পোরেশন শ্রীহট্টের চাঁদনিঘাটে (যেখানে রবীন্দ্রনাথ শহরে প্রবেশ করেছিলেন ) কিন সেতুর তলদেশের সুরক্ষিত স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছেন । কবির রেখাচিত্রের নিম্নে শ্রীহট্ট দর্শন উপলক্ষে কবির রচিত কবিতা "মমতাহীন কালস্রোতে" খোদিত রয়েছে । এই স্থান পরিদর্শনে যে কোন বাঙ্গালী হৃদয়ে সিলেটিদের সংস্কৃতির স্পন্দন ও তাদের সাথে একাত্মতা অনুভব করবেন ।
শতবর্ষ উদযাপন: সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভের ৬ বৎসর পর ১৯১৯ সালের ৫ই নবেম্বর রবীন্দ্রনাথ শ্রীহট্ট দর্শনে আসেন । তাঁর এই আগমনের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপনে ২০১৯ সালে শ্রীহট্টের নাগরিকবৃন্দ বিভিন্ন মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন । রবীন্দ্র শতবর্ষ স্মরণ উৎসব পালনের জন্য প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আব্দুল মাল আব্দুল মোহিতকে সভাপতি করে এবং সিলেট মহানগরীর মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি আনুষ্ঠানিক সমিতি গঠন করা হয় । মূল অনুষ্ঠানগুলো ২০১৯ সালের ৭ ও ৮ নবেম্বর অনুষ্ঠিত হয় । শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ ব্রাহ্ম মন্দিরে ও কবি নজরুল প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ।
মূল দর্শন সম্পর্কীয়: রবীন্দ্রনাথের শ্রীহট্ট দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও জীবনীকার বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন। এটি কবিগুরুর জীবনের ও শ্রীহট্টের ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে । এ বিষয়ে কিছু জ্ঞাতব্য তথ্য নিম্নে প্রদত্ত হল ।
১৯৪১ সালে কবিগুরুর মৃত্যুর পর কবিপ্রণাম নামে একটি স্মারক গ্রন্থ শ্রীহট্টে প্রকাশিত হয় । নলিনী কুমার ভদ্র, অমিয়াংশু এন্দো, মৃণাল কান্তি দাস ও সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ পুস্তকটি সম্পাদনা করেন । কবিপ্রণামে লিপিবদ্ধ শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক সুধীরেন্দ্রনারায়ণের প্রবন্ধে কবিগুরুর শ্রীহট্ট সফরের বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে । এতদ্ব্যতীত কবিগুরুর জীবনীকার প্রশান্ত কুমার পাল তাঁর গ্রন্থ রবিজীবনীতেও এই ভ্রমণ সম্বন্ধে লিখেছেন ।
সিলেট ভ্রমণের পশ্চাদপট: ১৯১৯ সালের অক্টোবর মাসে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের মাস কয়েক পর রবীন্দ্রনাথ শ্রীহট্টের সন্নিকটবর্তী শিলং এ অবকাশ যাপন করতে আসেন । শ্রীহট্টের ব্রাহ্মসমাজের তদানীন্তন সচিব গোবিন্দনারায়ণ সিংহ ঐ সময় কবিগুরুকে শ্রীহট্ট ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান । কিন্তু কবিগুরু যাত্রাপথ দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর হবে এই কারণ দেখিয়ে সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন । এরপর মহিলা সমিতি, অঞ্জুমান-ই-ইসলাম ও অন্যান্য সংগঠনের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত শ্রীহট্ট আগমনে রাজী হন ।
যাত্রাপথ: আসাম-বাংলা রেলপথ পরিকল্পিত হওয়ার পরবর্তী কালের কথা, কবি শ্রীহট্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সঙ্গে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী । শ্রীহট্ট আসার পথে কবি গৌহাটিতে একদিন অবস্থান করেন । লামডিং, বদরপুর, করিমগঞ্জ ও কুলাওড়া (বর্তমান বাংলাদেশ) হয়ে এসে কবি মাইজগাঁও, বরমচল, ফেঁচুগঞ্জ (বর্তমান সিলেট) ইত্যাদি স্থানে দাঁড়ান ।
অভ্যর্থনা: প্রাক্তন সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান রায় বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, সৈয়দ আব্দুল মাজিজ (কাপ্তান মিয়া), রায়বাহাদূর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত, নলিনীবালা চৌধুরী, গোবিন্দনারায়ণ সিংহ এবং অন্যান্যরা কবিকে শ্রীহট্টে অভ্যর্থনা জানান । সুরমা নদীর চাঁদনিঘাটে যেখানে রবীন্দ্রনাথ শ্রীহট্টে প্রবেশ করেন সেখানে তাঁর দর্শন লাভের জন্য হাজার হাজার লোক সমবেত হয়েছিল । রেভারেণ্ড থমাসের বাংলোর সন্নিকটে মিসেস রবার্টের বাড়ীতে কবি অধিষ্ঠান করেন ।
শ্রীহট্টে কবির কার্যক্রম: কবির উপস্থিতিতে ব্রাহ্ম মন্দিরে ব্রাহ্ম সমাজের আয়োজিত একটি বিশেষ সান্ধ্য প্রার্থনা হয় । সেখানে কবি বীণা বাজ হে মম অন্তরে এই গানটি গান এবং উপনিষদ থেকে আবৃত্তি করেন । ওঁর সম্মানে নাগরিক সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং সেই সম্বর্ধনা সভায় অভ্য়র্থনা সমিতির সভাপতি খান বাহাদুর আব্দুল মাজিজ স্বাগত ভাষণ দেন । সেখানে কবি বাঙ্গালীর সাধনা এই শীর্ষকে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন ।
এ ছাড়াও শীহট্টে অবস্থানকালে কবিগুরু মুরারীচাঁদ কলেজ ও মহিলা সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন । তিনি মুরারীচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ কবিবর রায়বাহাদুর নগেন্দ্র চৌধুরী, অপূর্ব চন্দ্র দত্ত ও সিংহ পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন । মাছিমপুরে কবি মণিপুরী নৃত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন । পরে তিনি শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যের প্রবর্তন করেছিলেন । শ্রীহট্ট সফরে কবি এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে তিনি শ্রীহট্টের নামকরণ করেন শ্রীভূমি এবং মমতাহীন কালস্রোতে নাম দিয়ে একটি কবিতা লিখেন । দুর্ভাগ্যবশতঃ এই কবিতাটি কবির সাহিত্যকর্মে স্থান পায় নি; ঐতিহাসিকরা মনে করেন কবি অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে এই কবিতাটি লিখেছিলেন ।
৮ই নবেম্বর কবি আগরতলার উদ্দেশ্য শ্রীহট্ট ত্যাগ করে যান ।
(৪) আলি আমজাদ ঘড়ি: সুরমা নদীর চাঁদনিঘাটের বিপরীত দিকে অবস্থিত এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম ক্লক টাওয়ার । স্থানীয়ভাবে এটাকে ঘড়িঘর বলা হয় । সুরমা নদীর উপর কিন সেতুর সন্নিকটে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্র । ঘড়িটি অনেকবার মেরামত করা হয়েছে । তবে বর্তমানে এটি সচল রয়েছে । প্রতি ঘণ্টায় ঘড়িটি সজোরে বেজে ওঠে । টাওয়ারের দুদিকে দুটি ঘড়ি রয়েছে, একটি উত্তরে ও অন্যটি দক্ষিণে । ঘড়িটির নক্সা তৈরী করেছিলেন নবাব মৌলভী আলি আহমেদ খান । এটা চালু হয় ১৮৭৪ সালে । ঘড়িটি প্রস্থে ১৬.৭ ফুট ও উচ্চতায় ২৪.৩ ফুট ।
এই জেলার বস্তুসমগ্র নিয়ে একটি সুন্দর কথন চালু আছে । তা হল
চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি, আলি আমজাদের ঘড়ি ।
জিতু মিয়ার বাড়ী, বঙ্কু বাবুর দাড়ি ॥
(৫) জজকোর্ট: ২০১৩ সালে শ্রীহট্ট জেলা দায়রা আদালত বিল্ডিংএ মহানগর দায়রা আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় । কোর্ট প্রাঙ্গনে এডভোকেট বিল্ডিং এর পাশে কোর্টের জাঁকালো বহুতল অট্টালিকা তৈরী হয়েছে । এই অট্টালিকা দুটো খুব বেশী পুরনো বলে মনে হল না । আমার ঘনিষ্ঠতম মামাতো ভাই মানিক (বর্তমানে প্রয়াত) এখানে আইনজীবী ছিল । ও যেখানে বসত সেটা দেখার আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল । সেই ইচ্ছা ছিল ওর প্রতি আমার আবেগের অন্তর্প্রকাশ । আমার ভাইপো আমাকে সিলেট ডিস্ট্রিক্ট এডভোকেট সমিতির ১ নং হলে যেখানে মানিকের চেম্বার ছিল সেখানে নিয়ে গেল । কোর্ট বন্ধ থাকায় ভেতরটা দেখা হল না । হলের শীর্ষে খোদিত তথ্য থেকে জানলাম এই হলটি ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । দালানঘরটিও প্রাচীন বলেই মনে হল । প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, ১৮৭৪ সালেই শ্রীহট্ট বাংলা দেওয়ানীর অঙ্গ হিসাবে আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ।
(৬) ডি সি অফিস: ছুটির দিন হওয়ায় অফিস বন্ধ ছিল । অফিস প্রাঙ্গনে দুটি জিনিষ নজর কাড়ল । এক, 'গৌরব সিলেট' এই আখ্যায় মহানগরীর বিশিষ্ট বিষয়বস্তু তুলে ধরে প্রাঙ্গনের এক অংশ জুড়ে ক্ষুদ্রাকার মহানগরীর মডেল, নগরীর প্রতি ভালবাসার প্রতীক । আর দুই, সমস্ত সরকারী বিজ্ঞপ্তি, নির্দেশপত্র, সাইনবোর্ড, গাড়ীর নম্বর ইত্যাদি সব কিছু বাংলায় লেখা । বাংলা ভাষার প্রতি এদের মমত্ববোধ সত্যি-ই হৃদয় ব্যকুল করে । ভাবি, অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে আমরা কেন এর বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি না ।
(৭) হাসান মার্কেট: সিলেটের বন্দর বাজার এলাকায় ১৯৫৯ সালে এই বাজারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্দর বাজারের নাম আমি শিশু অবস্থায় সিলেট থাকাকালীন প্রায়ই শুনতাম । বস্তুতঃ বন্দর বাজার সিলেটের একটি ব্যবসায় কেন্দ্র ।
(৮) সিলেট সিটি কর্পোরেশন: কর্পোরেশন এলাকা ২৭.৩৬ বর্গ কি মি বিস্তৃত । এর সীমানা উত্তরে সিলেট সদর উপজিলা, দক্ষিণে দক্ষিণ সুরমা উপজিলা, পূর্বে সিলেট সদর উপজিলা এবং পশ্চিমে দক্ষিণ সুরমা উপজিলা ও সিলেট সদর উপজিলা । এই কর্পোরেশন শহরের ২৭০৬০৬ জন নাগরিককে পরিষেবা দেয় (২০১১ সালের বাংলাদেশ জনগণনা ও সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্র বা ফিল্ড রিপোর্ট) । সিটি কর্পোরেশন অফিসটি হাসান মার্কেটের সন্নিহিত ।
সিলেট পৌরসভা তৈরী হয়েছিল ১৮৬৭ সালে, ২০০১ সালের ৯ই এপ্রিল এটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয় । এর নিয়ন্ত্রণে ২৭টি ওয়ার্ড, ২৯৩৮১ টি হোল্ডিং এবং ২৯৯৯৮ কি মি নগরপথ রয়েছে ।
(৯) শ্রীচৈতন্য মন্দির: সন্ধ্যেবেলা আমরা ঢাকা দক্ষিণে শ্রীচৈতন্যের পৈতৃক বাড়ী দেখতে গেলাম । সঙ্গে সুজক ছাড়া ছিলেন আমার স্ত্রী, সুজকের স্ত্রী পলি ও পুত্র শ্রীহান । আমরা যখন পৌঁছুলাম তখন প্রায় অন্ধকার; আমরা মন্দির এলাকার বাইরে যেতে পারলাম না । আমাদের দর্শন নতুন মন্দির এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল । অন্ধকারের জন্য নিকটবর্তী টিলার উপর অবস্থিত শ্রীচৈতন্যের পূর্বপুরুষের আদি বাসস্থান দেখা হল না, নতুন মন্দির এলাকার বাইরে বিদ্যুৎ যায়নি ।
প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বিখ্যাত চৈতন্য মন্দির শ্রীহট্টের ৪৫ কি মি দক্ষিণ-পূর্বে এই ঢাকা দক্ষিণে অবস্থিত । চৈতন্য মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষের বাসস্থান হিসাবে এই স্থান পূজিত । ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় এখানে একটি বাৎসরিক মেলা হয় । দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার পূণ্যার্থী তখন এখানে সমবেত হন ।
(১০) রামকৃষ্ণ মিশন, শ্রীহট্ট: ঢাকা দক্ষিণ থেকে ফেরার পথে আমরা অল্পক্ষণের জন্য রামকৃষ্ণ মিশনে প্রবেশ করেছিলাম। গুরুগম্ভীর বাতাবরণে তখন সান্ধ্য প্রার্থনা চলছিল ।
ইন্দ্রদয়াল ভট্টাচার্য নামে শ্রীরামকৃষ্ণের এক ভক্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯২৬ সালে এই মিশনটির প্রতিষ্ঠা হয় । ইন্দ্রদয়াল ছিলেন স্থানীয় স্কুলের একজন উদ্দীপনাময় শিক্ষক । তিনি ছিলেন সিলেটের স্বনামধন্য তান্ত্রিক সাধু মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যের চতুর্থ সন্তান ।
এই দর্শনের সাথেই আমার চতুর্থ দিনের সিলেট পরিভ্রমণের কর্মসূচীর পরিসমাপ্তি হল ।
চতুর্থদিনে দৃষ্ট কিছু কিছু স্থানের চিত্র বামের ও নিম্নের প্যানেলে প্রদর্শিত হল ।
শ্রীচৈতন্য মন্দিরের প্রবেশপথ, ঢাকা দক্ষিণ, সিলেট ।
শ্রীচৈতন্য মন্দির, ঢাকা দক্ষিণ, সিলেট ।
কৃষ্ণ-চৈতন্য মহাপ্রভুর মূর্তি, শ্রীচৈতন্য মন্দির, ঢাকা দক্ষিণ, সিলেট ।
শ্রীহট্টের রামকৃষ্ণ মিশনের প্রবেশ দ্বার ।
নিম্বার্ক আশ্রম ও শাহ জালালের দরগা দর্শন
নিম্বার্ক মন্দির, দারিয়াপাড়া, সিলেট ।
শাহ জালারের দরগায় ভক্তদের জন্য রান্নাবান্নার বিশালাকার ডেকচির সম্মুখে দাঁড়িয়ে ।
আমাদের শ্রীহট্টে অবস্থানের পঞ্চম দিনে (৭ই ডিসেম্বর ২০১৯) আমি প্রাতঃভ্রমণকালে দাড়িয়াপাড়া রোডে অবস্থিত নিম্বার্ক আশ্রম পরিদর্শন করি । আশ্রম-মন্দিরে পূজিত দেবদেবী রাধা ও কৃষ্ণ ।
নিম্বার্ক সম্প্রদায় চারটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি । মধ্যযুগের শেষভাগে নিম্বার্ক সম্প্রদায় সনাতন কৃষ্ণ-কেন্দ্রিক ঐতিহ্যের প্রথম বাহক । নিম্বার্ক নামের একজন তেলেগু ব্রাহ্মণ তথা যোগী ও দার্শনিক এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন । নিম্বার্ক মতে মুক্তির পাঁচটি সাধনা হল, (১) কর্ম (২) বিদ্যা (৩) উপাসনা বা ধ্যান (৪) প্রপত্তি (প্রভু/ভক্তির কাছে সমর্পন) ও (৫) গুরুপোসত্তি (ভক্তি ও রাধাকৃষ্ণরূপী ভগবানের কাছে আত্মসমর্পন) । (উইকিপিডিয়া)
শ্রীহট্টের নিম্বার্ক আশ্রমটি ১৯৩১ সালে স্থাপিত হয়েছিল ।
নিম্বার্ক আশ্রম দর্শনের পর বেলা সাড়ে দশটায় ভাইপো সুজককে নিয়ে হজরৎ শাহ জালালের দরগা দেখতে গেলাম । সাত দশকেরও পূর্বে মায়ের সাথে দেখতে আসা এই দরগার এক ঝাপসা স্মৃতি আমার মনে খচিত ছিল । কিন্তু আমার চোখের সামনে যে দরগা দেখলাম আমার স্মৃতিতে থাকা দরগার সাথে তার কোন মিলই খুঁজে পেলাম না ।
চতুর্দশ দশকের সুফি সাধু হজরৎ শাহ জালালের এই চিত্তাকর্ষক মাজারটি বাংলাদেশের বৃহত্তম ও মহত্বতম তীর্থক্ষেত্র । একটি মসজিদ ও মূল মাজার সম্বলিত দরগা কম্প্লেক্সে পূর্বদিকের ফটকদ্বার দিয়ে আমরা দরগা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলাম । প্রথা অনুযায়ী দরগায় ঢোকার মুখে জুতো খুলে রাখলাম । দরগামধ্যে শাহ জালালের কবরটি দামী বুটিদার রেশমী কাপড়ে আবৃত, জানতে পারলাম, সন্ধ্যেবেলা কবরের চারদিক মোমবাতি জ্বালানো হয় । চার পাশের অন্ধকারের মধ্যে মাজারের চতুর্দিকের মোমবাতির আলো স্বভাবতই এক ঐন্দ্রজালিক বাতাবরণের সৃষ্টি করে ।
জালালি কবুতর নামে এক ঝাঁক কবুতর দরগার আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল ও মাঝে মাঝে বিভিন্ন দালানের কার্নিশে বসছিল । এই কবুতরগুলোকে পবিত্র বলে মানা হয় ও এদেরকে কেউ হত্যা করে না । উপলভ্য নথিপত্র থেকে জানা যায় সিলেট আসার পথে জালাল দিল্লিতে সাধু নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অতিথি হিসাবে অবস্থান করেছিলেন । সেই সময় নিজামুদ্দিন জালালকে একজোড়া দুর্লভ কবুতর উপহার দেন যা পরে জালালি কবুতর নামে পরিচিত হয় । বলা হয়ে থাকে ঐ কবুতরজোড়ার প্রজননের মধ্য দিয়ে ওদেরই বর্তমানের বংশধর এই জালালি কবুতরগুলোর আবির্ভাব ।
দরগা কম্প্লেক্সের উত্তর প্রান্তে পবিত্র ক্যাটফিসে (মাগুর, শিঙি মাছ) পূর্ণ একটি পুকুর আছে যার মাছগুলোকে ভক্তরা খাইয়ে থাকেন । কিংবদন্তী অনুযায়ী এই ক্যাটফিসগুলো হিন্দুরাজা গৌড় গোবিন্দের কালো যাদুকারদের রূপান্তরিত অবস্থা । ১৩০৩ সালে শাহ জালাল গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে শ্রীহট্ট অধিকার করেছিলেন ।
দরগার পশ্চাদ্দিকে টিলার ঢালে অবস্থিত সারি সারি কবরে পূর্ণ গোরস্থানটিও ঘুরে দেখলাম । মৃত্যুতে সাধু শাহ জালালের কবরের কাছে সমাহিত হওয়াকে বিশেষ সম্মান বলে গণ্য করা হয় ।
শাহ জালালের মাজারের প্রবেশদ্বারের সম্মুখে ।
সিলেট জেলা ও নগর আওয়ামী লিগের ৫ই ডিসেম্বরের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের প্রস্তুত স্থান, সিলেট।
সিলেট সার্কিট হাউস ।
শাহ জালাল ও শ্রীহট্টে ইসলাম ধর্ম্মের প্রসার
শাহ জালালের দরগার প্রবেশপথ, দরগা মহল্লা, সিলেট ।
শাহ জালাল ১২৭১ সালে জন্মেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে । বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক নথিপত্রে ওঁর জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে । ওঁর মাতা সৈদা হাসিনা ফতিমা ও পিতা মামুদ ইবন মোহম্মদ ইবন ইব্রাহিম মক্কার কুরাইশ গোষ্ঠীর বংশধর ছিলেন । জালালের পিতা একজন ধর্ম্মযাজক ছিলেন । তিনি অতীন্দ্রিয়বাদী সুফি রুমির সমসাময়িক ছিলেন ।পুত্রের জন্মের পাঁচ বছর পর তিনি দেহত্যাগ করেন । জালাল মক্কায় তাঁর মামা সৈয়দ আহমেদ কবীর সুহরাবর্দীর কাছে শিক্ষালাভ করেন ও মানুষ হন । পড়াশুনায় তিনি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন; তিনি হাফিজ (কোরাণ যার মুখস্থ) হন এবং ফিক (ইস্লামী আইনশাস্ত্র) অধিগত করেন । তিনি মখদুম (সুন্নাহের শিক্ষক) হন । নিঃসঙ্গ পরিবেশে প্রার্থনা করার কারণে ও তপস্বীরূপে নির্জন জীবন যাপনের জন্য তাঁর নামের পেছনে আল মুজাররাদ যুক্ত হয় । দাবী করা হয় যে ৩০ বছরের অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং ধ্যানের দ্বারা তিনি আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলেন ।
জালালের মামা সৈয়দ আহমেদ কবীর জালালের হাতে এক আঁজলা মাটি দিয়ে তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশে যেতে বলেন । তিনি জালালকে নির্দেশ দেন যে ভারতের যে স্থানের মাটি তাঁকে দেয়া নমুনার সাথে বর্ণে ও গন্ধে হুবহু মিলে যাবে তিনি যেন সেই স্থানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম্মের প্রসার ঘটান । জালাল মক্কা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করেন; পথে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি ও অতীন্দ্রিয়বাদী সুফির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় । ইয়েমেনের শেখ আলি রাজপুত্রের দায়িত্বভার ছেড়ে জালালের অভিযানে যোগ দেন । আরব উপদ্বীপ থেকে আর যে সব শিষ্য ওঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন জালালের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ফারান, হাফিজ মোহম্মদ জাকারিয়া আরব, মক্কার দায়ুদ কুরাইশী, সুলেইমান কার্ণি এবং কামাল পাহলোয়ান ইয়েমানি । শেখ চাসমী পীর নামে একজন মৃত্তিকাবিজ্ঞানীর (পেডোলজিস্ট) সাথেও জালালের দেখা হয় যিনি জালাল যে সব স্থানে যাবেন সেই সব স্থানের মাটির সঙ্গে জালালের সাথে আনা মাটির নমুনার সমতা পরীক্ষা করবেন । জালাল বাগদাদ হয়ে আসেন । সেখানে তিনি শেষ আব্বাসিদ খালিফা আল মোস্তাসিমের হত্যার সময় উপস্থিত ছিলেন । বাগদাদে তিনি শাহ মুস্তাফা, সৈয়দ ইসমাইল ও সৈয়দ ইউসুফের মত অনুগামীদের লাভ করেন । বাগদাদের মোঙ্গল আক্রমণে বিতাড়িত হয়ে জালাল ও তাঁর অনুগামীদের দল পূর্বদিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন । ইরানে এই দলে যোগ দেন শাহ কালা ও শাহ ইরানী ।
জালাল পাঞ্জাবের উচে পৌঁছন । সেখানে তিনি ও তাঁর অনুগামীরা সুরাবর্দিয়া সুফি মতবাদে দীক্ষিত হন । সমরখন্দের ওমর সমরখন্দি, মুলতানের আরিফ মুলতান, বেলুচিস্থানের শেখ গরীভ শাহ গাব্রু আফগানি এবং গজনীর মাখদুম জাফর গজনায়ীর মত শিষ্যেরা উচের আরো উপরে উত্তরের স্থানগুলো থেকে এসে তাঁর দলে যোগ দেন । এরপর শাহ জালাল গুজরাট পৌঁছন । সেখানে শাহ মালুম ও নরমৌল যোগ দেন । এখানে জালাল শাহ হালিম আদ-দিন নরমৌলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ।
অতঃপর শাহ জালাল দিল্লী পৌঁছন ও সেখানে সুফি সাধু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার অতিথি হন ।
১৩০৩ সালে লখনৌটির সুলতান সামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ পার্শ্ববর্তী রাজ্য গৌড়ের সাথে সিলেটে, যা তখন হিন্দুরাজা গৌড়গোবিন্দের শাসনাধীন ছিল, যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন । এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল গাজী বুরহানুদ্দীন নামে এক সিলেটে বসবাসকারী মুসলমানের নবজাতক পুত্রের জন্ম উদযাপন উপলক্ষ্যে গো-বলিদানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে । এই ঘটনাকে পবিত্রতা নষ্টকারী বিবেচনায় ক্রুদ্ধ গোবিন্দ নবজাতককে হত্যা করালেন ও বাহারুদ্দিনের ডান হাত কাটিয়ে নিলেন ।
এই সংবাদ যখন সুলতান ফিরোজ শাহের কাণে পৌঁছুলো তখন তিনি প্রথমে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সিকান্দর খান গাজী ও পরে তার সেনাধ্যক্ষ সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে সৈন্যদল পাঠান । বাঙ্গালী সৈন্যের বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করার অনভিজ্ঞতা ও গৌর গোবিন্দের যুদ্ধ কৌশলের শ্রেষ্ঠতায় পর পর তিনটি আক্রমণ ব্যর্থ হয় ।
এবার শাহ জালাল ও তাঁর সঙ্গীদের সহায়তায় যারা সংখ্যায় প্রায় ৩৬০ জন ছিলেন চতুর্থ আক্রমণ সংঘটিত হল । গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রাথমিক আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর ফিরোজ শাহ হয়ত শাহ জালালের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন । অন্যথায় শাহজালাল হয়ত সিলেটেই ছিলেন ও সুলতানের অনুরোধের আগেই স্বাধীনভাবে হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন । মিলিত মুসলমান শক্তি অবশেষে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে সিলেটকে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয় । গৌড় গোবিন্দ পশ্চাদাপসরণ করতে বাধ্য হন। ঐতিহ্য অনুসারে শাহ চেসমী পীর এই সময় সিলেটের মাটির সঙ্গে শাহ জালালের সঙ্গে আনা মাটির নমুনা পরীক্ষা করে দেখেন তারা অভিন্ন । যাই হয়ে থাকুক, যুদ্ধের পর জালাল ও তাঁর অনুগামীরা সিলেটে বসতি স্থাপন করেন । ১৩০৩ সালের একটি ফারসী শিলালিপি শাহ জালালের দরগায় পাওয়া গেছে যাতে ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে জালালের সাহায্য নিয়ে সিকন্দর আরসা শ্রীহট্ট জয় করেছিলেন বলে উৎকীর্ণ আছে । এই শিলালিপিটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে (National Museum) সংরক্ষিত আছে ।
জীবনের শেষ পর্যায়ে জালাল ইসলাম ধর্ম্মের প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন । প্রখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা তখন সাতগাঁয়ে । তিনি এক মাসের এক দীর্ঘ যাত্রায় সিলেটের উত্তর-পূর্ব দিয়ে কামরূপের পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে জালালের সঙ্গে দেখা করতে আসেন । হাবুং হয়ে সিলেটের পথে জালালের বেশ কয়েকজন শিষ্য ইবন বতুতাকে স্বাগত জানান । এই শিষ্যরা ইবন বতুতাকে যাত্রাপথে সাহায্য করতে ইবন বতুতার আগমনের কিছুদিন আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন । ১৩৪৫ সালে জালালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইবন বতুতা লক্ষ করেন জালাল দীর্ঘদেহী, শীর্ণকায় ও গৌরবর্ণ । তিনি মসজিদের পাশে একটি গুহায় বাস করেন ও মূল্যবান বস্তু বলতে তার কেবল একটি ছাগল রয়েছে প্রয়োজনীয় দুধ, মাখন, দৈ ইত্যাদির জন্য । ইবন বতুতা লক্ষ্য করেছিলেন জালালের সঙ্গীরা বিদেশী এবং দৈহিক শক্তি ও সাহসিকতার জন্য সুবিদিত। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন অনেকে পথ-নির্দেশ পেতে জালালের কাছে আসতেন । শাহ জালালের সঙ্গে ইবন বতুতার সাক্ষাতের বিবরণ ইবন বতুতার আরবী সফরনামা রিলহাতে লিপিবদ্ধ আছে ।
শাহ জালালের মৃত্যুর তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে । তবে ইবন বতুতা বলেছেন জালাল ২০ ধূল কোয়াদা ৭৪৬ এ এইচ (১৩৪৬ সালের ১৫ই মার্চ) দেহত্যাগ করেছিলেন । তাঁর কোন বংশধর ছিল না । সিলেটের দরগা মহল্লা নামে বর্তমানে পরিচিত এলাকায় তাঁর নিজের নমের দরগায় তাঁকে সমাহিত করা হয় । তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠতম সতীর্থ হাজি সারেকোয়াম ইউসূফ ও বংশ পরম্পরায় তাঁর পরিবারের লোকদের দরগার খাদিম (অভিভাবক) নিযুক্ত করে যান ।
(সূত্র: উইকিপিডিয়া)
সিলেটের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে গেট-টুগেদার
আমার মামতো বোন গায়েত্রী ওরফে সীমু ওর স্বামী রজতকে সঙ্গে নিয়ে মৌলভী বাজার থেকে সেদিন সকালবেলা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল । রজতের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ । ওকে একজন নির্ভেজাল সরল ও সহৃদয় মানুষ বলেই আমার মনে হল।
সন্ধ্যায় সিলেটের মীনাবাজারে অবস্থিত রয়েল সেফ রেষ্টুরেণ্টে এক বিশুদ্ধ সান্ধ্যভোজের মধ্য দিয়ে আমার সিলেটে অবস্থানকারী আত্মীয়স্বজনের সাথে মিলিত হলাম । সকলের সান্নিধ্যে এক উৎফুল্ল সন্ধ্যা কাটল । রাত দশটায় আমরা বাড়ী ফিরে গেলাম । আমাদের শ্রীহট্ট অবস্থানের ষষ্ঠ দিনের সমাপ্তি হল ।
নিম্নের প্যানেলে ঐ সুন্দর সন্ধ্যাটিকে ধরে রাখা কয়েকটি মুহূর্তের ছবির মাধ্যমে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করলাম ।
সিলেটের মীনাবাজারের রয়েল সেফ হোটেল গেট-টুগ্যাদার সান্ধ্য ভোজের আত্মীয় স্বজনদের একাংশ ।
সিলেটের মীনাবাজারের রয়েল সেফ হোটেল গেট-টুগ্যাদার সান্ধ্য ভোজের আত্মীয় স্বজনদের একাংশ ।
সিলেটের আত্মীয়-স্বজনদের একাংশের সাথে ।
শ্রীহট্ট ভ্রমণের উপান্ত্য দিন: স্টেডিয়াম ও চা বাগিচা দর্শন ।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একাংশ |
সিলেট মহানগরীর সন্নিকটবর্তী ন্যাশনেল টি কোম্পানীর ফ্যাক্টরী দর্শন |
আমাদের শ্রীহট্টে অবস্থানের আজ ষষ্ঠদিন (৮ই ডিসেম্বর, ২০১৯) । আগেই বলেছি, আমার মামাতো ভাইপো সুজক সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ম্যানেজার । ও স্টেডিয়াম কম্প্লেক্সটি আমাদের ঘুরিয়ে দেখাল । আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামে কি কি সুযোগ সুবিধা উপলভ্য হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে সম্যক অবগত হলাম । স্টেডিয়ামটি একটি অপরূপ সুন্দর দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত ।
এখান থেকে আমরা ন্যাশনেল টি কোম্পানী নামের একটি চা প্রক্রিয়াকরণ ফ্যাক্টরী দেখতে গেলাম । এই কোম্পানিটি ১৮৭৫ সালে স্থাপিত । এদের একটি নিজস্ব চা বাগান আছে, নাম লাক্ষাতোরা ।
চা কারখানা দেখার পর আমরা মালিনীছড়া নামের একটি চা বাগিচা দেখতে গেলাম । বাগিচাটি তরঙ্গায়িত; উর্দ্ধতল ও অবতল সবুজ চা গাছে আবৃত । সবুজের শ্যামলিমায় সে এক অপরূপ দৃশ্য। ১৫০০ একর জমির উপর ১৮৪৯ সালে স্থাপিত এটি ছিল এই উপমহাদেশের সর্ব্বপ্রথম ও সর্ব্ববৃহৎ চা বাগিচা । লর্ড হার্ডন নামে একজন ইংরেজ উদ্যোগী এই বাগানটি স্থাপন করেন । ১৯৮০র দশকে আমার মামদের মধ্যে জ্যাষ্ঠতম রমাকান্ত দাস এই বাগানে পরামর্শদাতা হিসাবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন ।
আমাদের শ্রীহট্ট অবস্থানকালে একটি স্থানীয় সংবাদপত্র "সিলেট মিররে" প্রকাশিত সংবাদে জানতে পারি বাংলাদেশ চা উৎপাদনে আত্মনির্ভর হতে চলেছে এবং সর্বকালীন রেকর্ড করে আনুমানিক ৯১ কোটি কিলোগ্রাম চা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে । বাংলাদেশে ১৬১ টি চা বাগান আছে । তার মধ্যে সিলেট বিভাগের দুটি জেলাতেই চা বাগিচা গুলো মূলতঃ কেন্দ্রীভূত; সিলেটে ১৯টি ও মৌলভী বাজারে ৯১টি চা বাগিচা রয়েছে ।
বাগিচা দর্শনের পর আমরা বাড়ী ফিরে এলাম এবং শ্রীহট্টে আমাদের বিশিষ্ট স্থান পরিক্রমা শেষ হল ।
এবার বাড়ী ফেরার প্রস্তুতি ।
মালিনীছড়া চা বাগানে কিছুক্ষণ |
সিলেট থেকে শিলং
ডাউকি-শিলং রোডে মাওলিনং গ্রামে ব্যালেন্সিং পাথরের সম্মুখে |
মাওলিনং গ্রামের একটি গির্জা |
মাওলিনং গ্রামের কেন্দ্রীয় স্থল |
৯ই ডিসেম্বর সোমবার বাংলাদেশ সময় সকাল ১০ টায় আমি সস্ত্রীক সিলেট থেকে কোলকাতার পথে শিলং রওয়ানা হলাম । আত্মীয়স্বজনেরা সবাই আমাদের বিদায় জানাতে সমবেত হয়েছিল । বিদায় সর্বদাই দুঃখজনক । পলি সহ আমার কয়েকজন আত্মীয়ের চোখের কোণ জলে চিক চিক করছে দেখলাম। একদিকে আমার নিকটজনের সাহচর্য ও সহৃদয় আতিথেয়তা ও অপরদিকে আমার মূল, এই দুই ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় আমার নিজের মনও ভারাক্রান্ত ছিল । কিন্তু কেউ যখন বেড়াতে আসে তখন নির্দিষ্ট সময় পর ত তাকে যেতেই হয়, তা যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন । অতএব আমাদেরও ফেরৎ যাত্রা শুরু হল । মামাতো ভাইপো সুজক ও ভগ্নিপতি রজত সীমান্ত পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিতে এল । আমরা সুজকের গাড়ীতেই সীমান্তে এলাম ।
টামাবিলের বাংলাদেশ সীমান্তে ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর আমরা ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব গেইট (Indo-Bangladesh Friendship Gate} অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করলাম ও ইমিগ্রেশনের যাবতীয় ভারতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করে শিলং রওয়ানা হতে প্রস্তুত হলাম । বাংলাদেশ থেকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে ডাউকি থেকে আমাদের শিলং নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি একটা ভাড়া গাড়ীর বন্দোবস্ত করেছিলাম । আমাদের আগমনের সময় গাড়ীটি ডাউকিতে উপস্থিত ছিল । ঐ গাড়ীটিতে করে আমরা বেলা ১:৩০ মিনিটে শিলং রওয়ানা হলাম । পথে ড্রাইভারের সাথে আলোচনাক্রমে জানলাম যে পরদিন ১০ই ডিসেম্বর উত্তরপূর্ব ছাত্র সংগঠন (নেসো) ভারতীয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯ এর বিরোধীতায় সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্ধ ডেকেছে । ড্রাইভার জানাল বন্ধ কার্যকরী হলে আমাদের প্রয়োজনে ওর পক্ষে গাড়ী বার করা সম্ভব হবে না । এই সংবাদ নিয়ে আমরা শিলং এর পথে এগোলাম ।
শিলং এর পথে আমরা দুটো পর্যটক কেন্দ্র পরিদর্শন করলাম । প্রথমটি পূর্ব খাসিয়া পাহাড়ে মাওলিনং নামক গ্রামে একটি ভারসাম্যকারী পাথর, নাম মাইরংকিউ শারারিতা ব্যালেন্সিং স্টোন । এটি আসলে একটি বিশালাকার পাথর যা একটি বিশেষ কোণে একটি অতি ক্ষুদ্র পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে । এত ক্ষুদ্র একটি পাথরের উপর এই দৈত্যাকার পাথরটি এক অদ্ভুদ কোণে কি ভাবে ভারসাম্য বজায় রেখেছে তা ভেবে বিস্ময়ের উদ্রেক হয় । তারের বেষ্টনীর মধ্যে এই দৈত্যাকার পাথরটি যুগ যুগ ধরে একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, সাইক্লোন, ঝড় কিছুই এর গঠনের ক্ষতি বা অবস্থানের পরিবর্তন করতে পারে নি । বাঁশবনের মধ্যে এই স্থানটি সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে । স্থানীয়দের মতে এই অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে সন্তুষ্ট করতে হাজার বৎসর পূর্বে এখানে নরবলি হত । পর্যটকদের সহগামী গাইডদের মতে এখানে খাসিয়া উপজাতিদের একটি প্রাচীন মন্দির ছিল যা মাওলিনং ও রেওয়াই গ্রামে খৃষ্ট ধর্ম্মের আগমনের পর এখন আর ব্যবহৃত হয় না । এই পাথরের দর্শনমূল্য মাথাপিছু দশ টাকা ।
ব্যালেন্সিং স্টোন দেখার পর আমরা সর্ব্বাপেক্ষা পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং দেখতে গেলাম | ২০০৩ সালে মাওলিনংকে এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম ঘোষণা করা হয় | ২০১৫ সালে এই গ্রামের লোক সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০ | অধিবাসীরা সবাই খাসিয়া, ৯০% খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী | গ্রামে তিনটি গির্জা আছে | ২০১৪ সালের গণনা অনুযায়ী মোট পরিবারের সংখ্যা ৯৫ | শিক্ষার শতকরা হার ৯০% | কৃষিকার্যই স্থানীয় লোকেদের প্রধান বৃত্তি; সুপুরী প্রধান ফসল | গ্রীষ্মকালে আনারস এবং লিচুও হয় | গ্রামটি চতুর্দিকেই অপরূপ শোভামণ্ডিত | গ্রামে গাড়ীর প্রবেশ মূল্য গাড়ী প্রতি পঞ্চাশ টাকা | হয়ত এটা গাড়ীর ধোঁয়ায় গ্রামের পরিবেশের ক্ষতির জরিমানা ।
আমি ঘুরে ঘুরে গ্রামের ও লোকেদের কিছু ছবি তুললাম |
শিলং পৌঁছোনো: পরের দিনের সর্বাত্মক বন্ধের অভিজ্ঞতা
মাওলিনং অতিক্রম করে চলার পথে আমরা বিকাল ৫:৩০ মিনিটে শিলং এর শহরতলী পৌঁছুলাম । কিন্তু ট্রাফিকের জটে আমাদের প্রায় দেড় ঘণ্টা আটকে থাকতে হল । অবশেষে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সন্ধ্যে সাতটায় শিলং ও ৭:১৫ মিনিটে হোটেলে পৌঁছুলাম । পরের দিন ১২ ঘণ্টার সর্বাত্মক বন্ধে সারাদিন হোটেলবন্দী হয়ে ছিলাম । বন্ধে দোকান-পাট, হাটবাজার এমনকি ওষুধের দোকান, ফুড স্টল, রেস্তোরাঁ সব বন্ধ ছিল । বড় হোটেলের প্রধান ফটক ছিল বন্ধ, পাশের ছোট দরওয়াজা দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছিল । সরকারী বা বেসরকারী গাড়ী, গণ পরিবহন কিছুই রাস্তায় দেখা যায় নি । সন্ধ্যে ৬টায় বন্ধ শেষ হওয়ার পরও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি । পুলিশ বাজারের মত কেন্দ্রীয়স্থলে কেবল দু-একজন চা-বিক্রতা ও ফল-বিক্রেতাকে পসরা নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে দেখা গেছে, ফুটপাথের দু-একটি দোকান ছাড়া দোকানপাট সব বন্ধই ছিল ।
ফেরৎ যাত্রার শেষ পর্যায়: গুয়াহাটি হয়ে কোলকাতা
কেব প্রতিবাদের মিছিলের জেরে গুয়াহাটি-শিলং রোডে স্থবির যানবাহন ।
গুয়াহাটি বিমান বন্দরের প্রস্থান এলাকায় বিভিন্ন সময়ের বিমানের যাত্রীদের প্রতিক্ষারত অবস্থানের একটি দৃশ্য ।
গুয়াহাটি থেকে কোলকাতার ১২ তারিখের বিমান ধরতে বন্ধের পরদিন (১১ই ডিসেম্বর) আমাদের গুয়াহাটি যাওয়ার কথা । ডাউকি থেকে যে ড্রাইভার আমাদের শিলং নিয়ে এসেছিল তারই আমাদেরকে গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল । বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সেই কর্ম্মসূচী নিশ্চিত করতে ১০ তারিখ সন্ধ্যাবেলা ঐ ড্রাইভারকে ফোন করি । ফোনে ও আমাকে জানায় যে সন্ধ্যেয় ও আমাদেরকে শিলং নিয়ে এসেছিল, সেই রাতেই ভ্যাণ্ডালরা ওর গাড়ীসহ ৩১ খানা গাড়ীতে ভাঙ্চুর চালায়; ওর গাড়ীর উইণ্ডশিল্ড ও কাঁচের জানালা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে । গাড়ীটি রাস্তায় চলাচলের অবস্থায় নেই । তবে ও আমাদের জন্য অন্য একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করে দেবে । পাহাড়ের ড্রাইভারদের এই সততা, বিশ্বস্ততা ও মক্কেলদের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্যিই প্রশংসনীয় । সেই ড্রাইভার যথার্থই পরদিন (১১ ডিসেম্বর) আমাদের জন্য অন্য একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল । সেই গাড়ীতে সকাল ১০টায় রওয়ানা হয়ে আমরা বিকেল দুটোয় গুয়াহাটি হোটেলে পৌঁছুলাম । পথে ভারতীয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের দরুণ স্থানে স্থানে আটকে পড়ায় পৌঁছুতে দেরী হল ।
১১ ডিসেম্বর বিকেল থেকে গুয়াহাটির পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ: কেব বা সিটিজেনসিপ আমেন্ডমেণ্ট বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনকে ঘিরে গুয়াহাটির পরিস্থিতি বিস্ফোরক পর্যায়ে পৌঁছয় । গৌহাটি হোটেলে পৌঁছুবার অব্যবহিত পরে আমরা টিভির সংবাদে জানতে পারি আসামের রাজধানী দিসপুরে যে স্থান হয়ে আমরা মাত্র কিছুক্ষণ আগে এসেছি সেখানে বৃহদাকার গোলমাল শুরু হয়েছে । দিন গড়িয়ে যত শেষ বিকেলে এগোল পরিস্থিতি তত খারাপ হতে লাগল; সংবাদে ঘোষণা করা হল যে সন্ধ্যে সাতটা থেকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হবে । সন্ধ্যার খবরে জানা গেল গৌহাটি সহ কয়েকটি শহরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্ফু বলবৎ করা হয়েছে । আমি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম; পরের দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার বিমানে কোলকাতা ফেরার কথা । গুয়াহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হোটেল থেকে ২৩।২৪ কি মি দূরে । চলমান পরিস্থিতিতে কি ভাবে এই দূরত্ব অতিক্রম করে বিমান বন্দরে পৌঁছুব ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না । হোটেল প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনরূপ সাহায্য করতে অপারগ ছিল । দুশ্চিন্তায় আমি আমার পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের এক শীর্ষস্তরের কর্তাব্যক্তিকে সাহয্যের জন্য ফোন করলাম, উত্তরে এক অনাগ্রহী প্রতিক্রিয়া পেয়ে ক্ষুব্ধ হলাম । আমি একা থাকলে মোটেই উদ্বিগ্ন হতাম না । কিন্তু সঙ্গে ক্যান্সার আরোগ্যোত্তর রোগিনী আমার স্ত্রী ছিলেন । তাঁকে নিয়ে গুয়াহাটিতে আটকে থাকার ঝুঁকি নেয়া সম্ভব ছিল না । আমি অনুধাবন করলাম এই গর্ত থেকে বেরোবার উপায় আমাকেই বার করতে হবে । সন্ধ্যেবেলা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে আমি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের পাশের ছোট দরওয়াজা দিয়ে রাস্তায় বেরোলাম । হোটেলটি জি-এস রোডের উপর অবস্থিত । আমরা জি এস রোড ধরে কয়েক পা মাত্র এগোতে পারলাম । শহরের ব্যস্ততম রাস্তা জি এস রোড এখন জনমানবশূন্য, দোকানপাট সব বন্ধ, চারদিক অন্ধকার, শুধু রাস্তার মাঝ বরাবর লাইন ধরে কোন এক দাহ্য পদার্থ জ্বলছে । এই ছিল শহরেয় ব্যস্ততম এলাকার চিত্র, সময় বোধহয় তখন সন্ধ্যা ৮টা ।
পরদিন গৌহাটি থেকে বেরোবার কৌশল ভেবে বার করলাম । সে কৌশল ছিল, প্রাতঃকালে যতটা সম্ভব অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে একটি গাড়ী যোগাড়ের চেষ্টা করা আর সেই গাড়ীতে হোটেল ছেড়ে বিমান বন্দর পৌঁছুনো । প্রাতঃকালে পরিস্থিতি অনেকটা নিরুত্তেজ থাকার সম্ভাবনায় ও কিছু অতিরিক্ত আয়ের প্রচেষ্টায় কোন কোন ড্রাইভার হয়ত নিয়ে যেতে রাজী হবে এই আশা নিয়ে পরিকল্পনাটি করলাম । বিমান বন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড আমি চিনতাম ।
সেই অনুযায়ী পরদিন সকাল ৬টায় হোটেল থেকে ঐ রকম একজন ড্রাইভারের খোঁজে বেরোলাম । খানিক দূরেই অভিষ্ট সিদ্ধ হল । একজন ড্রাইভার প্রচলিত ভাড়ার চতুর্গুণ মূল্যে বিমান বন্দরে পৌঁছে দিতে রাজী হল । আমরা তৎক্ষণাৎ হোটেল থেকে বেরিয়ে বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । হোটেল থেকে আগের রাতেই চেক-আউট করে নিয়েছিলাম । সৌভাগ্যক্রমে পথে কোন বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি । আমরা সকাল ৭:৩০ মিনিটে বিমান বন্দরে পৌঁছুলাম । বিমানবন্দর চত্তরে আমরা প্রচুর সংখ্যক লোককে প্রতীক্ষারত দেখলাম; এরা সবাই ছিলেন দিনের বিভিন্ন সময়ের বিমানের যাত্রী । আমাদের বিমান ছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় । ১২ ঘণ্টা অপেক্ষার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমরা বিমান বন্দরের ভেতরে প্রবেশ করলাম ।
কিন্তু কোলকাতায় আমার মেয়েরা এই ১২ ঘণ্টার অপেক্ষা মেনে নিতে পারল না । তারা উদ্বিগ্ন হয়ে ঐ সময়ের পূর্বে অন্যান্য উপলভ্য বিমানের খোঁজ করতে লাগল । আমার ছোটমেয়ে শেষ পর্যন্ত গো এয়ার এয়ারলাইন্সের সকাল ১১টার বিমানে আমাদের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করল । গুয়াহাটিতে যেহেতু ইণ্টারনেট বা এস এম এস পরিষেবা চালু ছিল না আমার মেয়ে কোলকাতায় টিকিট কেটে টিকিট কনফার্মেশন মেসেজ বিমান পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে আমাদের কাছে পাঠায় । ঐ বিমানে এসে আমরা বিকেল দুটোয় বাড়ী পৌঁছুই । ফেরৎ যাত্রা তাই আমাদের কাছে ঝঞ্ঝাট ও আর্থিক ক্ষতি সম্পন্ন এক কঠোর পরীক্ষা প্রতিপন্ন হল । সব বাধাবিঘ্ন সত্বেও ৭২ বছর পর জন্মভূমি দর্শন এক অবিস্মরণীয় পরিপূর্ণতা ও আজীবন অভিজ্ঞতা হয়ে রইল ।
এই সফরে বার বার একটা কথাই মনে হয়েছে আজ যদি আমরা সবাই সকল আত্মীয়স্বজন নিজেদের জন্মভূমিতে একত্রে বসবাস করতে পারতাম তবে তা কতই না সুখের ও আনন্দের হত ।
আমার শ্রীহট্ট দর্শনের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র নীচের ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেছি ।