উপক্রমণিকা
অবসরজীবন সর্বদাই বেদনাদায়ক ও আলস্যভরা সময়ের বাহক । গতানুগতিকতার বেড়া ডিঙিয়ে বই পড়া ও অতিরিক্ত সময় কম্প্যুটার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমার অবসর জীবন ভালভাবেই শুরু হয়েছিল । প্রায় দেড় বছর এ ভাবেই কাটল । এরপর এক বছরের নিয়োগে আমি নয় মাস কোলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জে চাকুরী করলাম । মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে কোন পরিস্থিতিতে এই চাকরী ছেড়েছিলাম তা আমি আগেই বলেছি । এবার আমি ২০০৬ সালে চলে আসি যা মোটামুটি ভালভাবেই কাটল । ঐ সময় আমার জ্যেষ্ট জামাতা চাকুরী সূত্রে প্রথমে পুণা ও পরে মোম্বাই স্থানান্তরিত হল । ঐ সময় আমার মেয়েকে সেট্ল করতে আমি পুণে ও মোম্বাই গিয়েছিলাম ।
সেই উপলক্ষে একবার বাসে বোম্বাই থেকে পুণা যাওয়ার সময় একটি ছোট দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম । পুণেতে বাস আমার নির্দিষ্ট স্টপে আসার প্রাক্কালে আমি নামার জন্য প্রস্তুতি নিতে সীট থেকে উঠে সামনের দিকে এগোচ্ছি সেই মুহূর্তে ড্রাইভার সজোরে ব্রেক চাপে ।আমি হুমড়ি খেয়ে ড্রাইভারের কেবিনের তারের জালের পার্টিশনের উপর পড়ে আহত হই, আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে । সৌভাগ্যবশতঃ কোন বড় ক্ষতি হয় নি । পরে পুণাতে ডাক্তার দেখিয়ে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিয়েছিলাম ।
নবেম্বর ২০০৭ সালে আমার ছোটমেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলাম । বছরের বেশীর ভাগ সময় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করতে কেটে গেল ।
মেয়ের বিয়ের কিছুদিন পর ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে আমি ও আমার স্ত্রী আসাম ও মেঘালয়ে এক স্বল্প দৈর্ঘ্যের সফর সম্পন্ন করি । এটি ছিল আমার আদি রাজ্য আসামে দীর্ঘ ২৫ বৎসর পর প্রত্যাবর্তন ।
২০০৭ সালের প্রথমার্দ্ধে আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড দীপু যার সম্বন্ধে বিস্তারিত আমার বন্ধুবান্ধবের পাতায় দিয়েছি স্ত্রী রিভাকে নিয়ে আমেরিকা থেকে এসেছিল । দীর্ঘ কয়েক দশক পর ওর সঙ্গে দেখা হল । পরে এক সন্ধ্যাবেলা আমার ফ্ল্যাটে দীপু এবং ওর স্ত্রীর সাথে নৈশভোজে মিলিত হই; সন্ধ্যেটা আনন্দে কেটেছিল ।
২০১০ সালে দৌহিত্র শ্লোকের জন্মের পর ওকে নিয়ে আনন্দময় মুহূর্তগুলো কেটেছে । ধীরে ধীরে চোখের সামনে ওকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছি । আমি মনে করি গৃহে একটি শিশুর অবস্থান ও চোখের সামনে ওকে বড় হয়ে উঠতে দেখা এক স্বর্গীয় আশীর্ব্বাদ ।
পরবর্তী বছরগুলিতে আসাম ও মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থান, অজন্তা, ইলোরা সহ মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদ জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, রাঁচি ইত্যাদি সফর করেছি । অনেকগুলো সফরেই বন্ধু আশু সহগামী হয়েছিল ।
২০১৬ সালে নিকনের একটি ডিএলআরএস (DSLR) ক্যামেরা ক্রয় করার পর আমার ছবি তোলার দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় প্রকৃতির কোলে অনেক মনোরম মুহূর্ত কাটিয়েছি ।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্মভূমি বাংলাদেশের শ্রীহট্ট মহানগরী ঘুরে এসেছি । এরপর থেকে পৃথিবীব্যপী কোভিড অতিমারীর কারণে বহির্গমন বন্ধ ।
২০১৭ সালে কিন্ডল পেপার হোয়াইট (Kindle Paperwhite) নামক একটি বৈদ্যুতিন বই পড়ার যন্ত্র ক্রয় করে আমার পড়ার পরিধি বিস্তৃত করেছি ।
ইতিমধ্যে অনেক নিকট আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের মৃত্যুশোকও সহ্য করতে হয়েছে ।
ঘণিষ্টতম মামতো ভায়ের মৃত্যু
ট্র্যাজেডি প্রথম আঘাত হানল ২০০৮ সালে যখন ২০শে এপ্রিল কোলকাতার হাসপাতালে আমার মামাতো ভাই মানিক ওরফে রজত প্রাণ হারাল । ও আমার খুব কাছের এবং বন্ধুর মত ছিল । ও পূর্বনির্বাচিত কোলকাতার একটি হাসপাতালে বাইপাস সার্জারি করাতে এসে আমার কাছে উঠেছিল । এর পূর্বে নিজস্ব স্থান শ্রীহট্টে ওর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল । ধমনী রুদ্ধ পাওয়ায় ডাক্তাররা ওকে শল্যচিকিৎসার (surgical intervention) পরামর্শ দিয়েছিলেন । এখানে (কোলকাতায়) আর এন টেগোর ইণ্টারনেশনেল ইনস্টিটিউট অব কারডিয়াক সায়েন্সেসে ওর অপারেশন হয় । স্বনামখ্যাত শল্যচিকিৎসক ডাঃ কুনাল সরকার অপারেশন করেছিলেন । কিন্তু অপারেশন পরবর্তী জটিলতা সহ্য করতে পারে নি । অপারেশনের দিন কয়েকের মধ্যে হাসপাতালেই দেহান্তরিত হয় । অপারেশনের পর আই. সি. ইউ তে থাকাকালীন আমি দেখতে গিয়েছিলাম । ও তখন সজ্ঞানে ছিল না, ডাক্তাররা আমার উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার বার কয়েক চেষ্টার পর একবার ও অনেক কষ্টে চোখ খুলে জিব নেড়ে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পারল না । অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে বিদায় জানানো ও তারপর এই জিব নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা এই দুই চিত্র আমার হৃদয়ের গভীরে চিরতরে অঙ্কিত হয়ে রইল । ওর মৃত্যুর আঘাত কাটিয়ে উঠতে আমার অনেক সময় লেগেছিল ।
বিদেশ থেকে আগত বাল্যবন্ধুদের সাহচর্য
২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিদেশ থেকে আগত বন্ধুবান্ধবদের সাহচর্যে অনেকটা সময় ভালভাবে কেটেছে ।
২০০৯ সালে দুই বাল্যবন্ধু পর পর বিদেশ থেকে আসে । প্রথমে নিউইয়র্ক থেকে আসে রাণা, পরে সাউথ ওয়েলস থেকে আশু । দুজনের সাথেই বেশ কয়েক দশক পর দেখা, রাণার সাথে স্কুল ছাড়ার পর প্রথম । স্বভাবতঃই আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল, কে কেমন হয়েছে দেখার । রাণার এদেশে কর্ম্মব্যস্ততার দরুণ এবং সঙ্গে আসা ছেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অতি অল্পক্ষণের জন্যই ওর সাথে দেখা হয়েছিল । লক্ষ্য করলাম, রাণা ও আশু দুজনেই দেহে অনেকটা পরিমাণ মেদ আহরণ করেছে ।
রাণার পর আশু আসে সাউথ ওয়েলস থেকে । ও বেশ কিছুদিন ছিল । ওর সঙ্গে ওর বোনের সল্টলেকের বাড়ীতে অনেক সন্ধ্যে কাটিয়েছি । এরপর আশু পুনরায় আসে ২০১১, ২০১২,২০১৩, ২০১৬, ২০১৭,২০১৮ ও ২০১৯ ও কোভিড-পরবর্তী ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে । প্রতিবারই ওর বোনের বাড়ীতে সন্ধ্যেবেলা ওর সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি । তাছাড়া আশু ও আমি অনেকগুলো যুগ্ম সফর করেছি । আমরা এই সফরগুলোতে দুজনই পরষ্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করেছি । তিন বছর পর ২০২২ সালের নবেম্বর মাসের প্রথমে আশুর সাথে এতাবৎ সর্বশেষ যুগ্ম সফরে পুরী, চিল্কা ঘুরে এসেছি । দীর্ঘদিন পর এই সফর বিশেষ আনন্দ দিয়েছিল । অনেক দিন পরের এই সফর স্বল্পদৈর্ঘ্যের হলেও যথেষ্ট আনন্দময় হয়েছিল । এই সফরকালে দুটো স্মরণীয় ঘটনা যুগপৎ ঘটেছিল । প্রথমতঃ আমার পোষাক-পরিচ্ছদপূর্ণ স্যুটেকেসের স্বয়ংক্রিয় তালা সঠিক কোড নম্বর সত্বেও খুলছিল না । সমস্যার সমাধানে হোটেলের একজন কর্ম্মচারীর সহায়তায় ন্যুনতম ক্ষতিতে তালাটিকে নিষ্ক্রিয় করে স্যুটেকেসটি খোলা হয় । দ্বিতীয়তঃ আমি যে জুতো পরে গিয়েছিলাম পুরী পৌঁছুবার পরদিন হোটেল থেকে বেরোতে গিয়ে দেখলাম তার তলি কোথাও খুলে পড়ে গেছে । জুতোজুড়া কোভিডের সময় কেনা হয়েছিল । কেনার পর থেকে দুবছরের অধিক অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল বলেই এরূপ ঘটেছে বলে জানলাম । যাক, ঐ তলিবিহীন জুতো পরেই প্রায় তিন কি মি পথ হেঁটে পুরীর বাটা কোম্পানী থেকে নতুন জুতো কিনে সমস্যার সমাধান করতে হয় । ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে আশু ও রাণা দুজনেই কোলকাতা ছিল । সেই সময় রাণা, আশু, মৃণাল ও আমি চারজন বাল্যবন্ধু দীর্ঘদিন পর একত্র হয়েছিলাম ।
২০০৭ সালের পর দীপু দুবার, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে, কোলকাতা এসেছিল । ২০১৪ সালে দীপু, ওর ছোটবোন খুকু ও জ্যেঠতুতু বোন তথা আমাদের সহপাঠিনী গোপার সাথে আমার বাড়ীতে আমরা এক বাহুল্যবর্জিত নৈশভোজে একত্র হয়েছিলাম ও আনন্দময় সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম । ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দীপু ওর সদ্যবিবাহিতা কন্যা ও জামাতাকে নিয়ে এসেছিল । ঐ সময় দীপু আত্মীয়পরিজন ও বন্ধুবান্ধবদের জন্য কোলকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলে মেয়ের বিবাহোত্তর একটি রিসেপশন পার্টির আয়োজন করেছিল । আমন্ত্রিত হিসাবে আমি সপরিবারে যোগ দিয়েছিলাম । ওখানে কয়েকজন পূর্বপরিচিতের সাথে দেখা হল । কথাবার্তায় আনন্দমুখরিত সেই সন্ধ্যা ভালই কেটে গেল । দীপুর মেয়ে বৃটাকে প্রথম দেখলাম । ওর এবং ওর বর জর্জ এণ্টনির সাথে আলাপ-পরিচয় হল ।
পরিবারে মৃত্যুর হানা
২০১০ সালে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হারালাম । ঐ বৎসরের ৬ই ফেব্রুয়ারী দাদা কৃষ্ণকান্ত দাস হৃদরোগে আক্রান্ত (Massive heart attack) হয়ে শিলচরে নিজের বাড়ীতে দেহত্যাগ করে । ওর শেষকৃত্যে যোগ দিতে আমাকে শিলচর যেতে হয় । দশদিন আমি শিলচর ছিলাম ।
পরের বছর ২৩শে জানুয়ারী আমার ভগ্নীপতি রজনী মোহন রায় আসামের মরিয়ানীতে ওঁদের নিজস্ব বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । উনি দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন ।
২০১৪ সালে আবার আমার দুই নিকট আত্মীয়ার মৃত্যু হয় । প্রথমে আমার বৌদি সাবিত্রী দাস শিলচরে ওঁর নিজের বাড়ীতে ৩০শে এপ্রিল ভোরবেলা ঘুমের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ঐ সময় ওর কাছে কোন আত্মীয়স্বজন ছিল না । আমেরিকা প্রবাসী পুত্র এসে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার আগে পর্যন্ত মৃতদেহ মর্গে সংরক্ষণ করা ছিল ।
এরপর ঐ একই বৎসরের ২৭শে অক্টোবর আমার এক কাছের মামীমা উষারাণী দাস (যার সম্পর্কে আমি মামা ও মামাতো ভাইবোনের পাতায় উল্লেখ করেছি} শিলচরের তারাপুরে তাঁর নিজস্ব ফ্ল্যাটে দেহরক্ষা করেন । ওর কোন সন্তানাদি না থাকায় ওর দেবরপুত্র যে ওর দেখাশোনা করত সে-ই শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ।
এরপর আমার দিদি (ফুলদি) বকুল রাণী রায় ২০১৮ সালের ৬ই জুন মরিয়াণীতে ছেলের বাসভবনে হৃদরোগে (massive heart attack) আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয় । সেও বার্ধক্যজনিত ও অন্যান্য নানা রোগে দীর্ঘদিন ভুগছিল ।
দৌহিত্রের আগমন
২০০৯ সালের শেষভাগে আমার ছোটমেয়ে গর্ভাবস্থায় আমাদের সাথে থাকতে আসে । ২০১০ সালের ১৫ই এপ্রিল আমাদের এখানে থাকাকালীন ভাগিরথী নেওটিয়া শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে ও একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় । এরপর আমাদের দৌহিত্র আমাদের আনন্দের আধার হয়ে ওঠে । ওকে নিয়েই আমাদের সময় কাটতে লাগল ।
গাড়ী ক্রয়
আমার অনেকদিনের একটি আকাঙ্খা ছিল নিজে গাড়ী কিনে নিজে চালিয়ে ঘুরে বেড়াব । কর্ম্মজীবনে আমার সরকারী গাড়ীতে অসরকারী ভাবে প্রায় ২০০০০ কি মি চালাবার অভিজ্ঞতা ছিল যদিও আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না । এবার আমি লাইসেন্স নেয়া সাব্যস্ত করলাম । আমি গাড়ী চালনা অভ্যাস করতে একটি মটর ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হলাম এবং লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করলাম । ইতিমধ্যে মারুতী কোম্পানিতে নির্বাচিত মডেলের গাড়ীর অর্ডার দিলাম । ২০১১ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী গাড়ী ডেলিভারী পেলাম । ২০১৬ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলাম যা প্রথমে ২০২১ সাল ও পরে ২০২৬ সাল পর্যন্ত নবীকরণ হয়েছে । আমি গাড়ী চালাতে শুরু করলাম । প্রাথমিক ভাবে দুএকটি ছোটোখাটো ভুলত্রুটির পর আমি এখন কোলকাতার রাস্তায় গাড়ী চালাতে স্বচ্ছন্দ । ইতিমধ্যে আমি নিজে গাড়ী চালিয়ে ঝাড়গ্রাম, কামারপুকুর জয়রামবাটি ও বিষ্ণুপুর ঘুরে এসেছি । সঙ্গে কেউ ছিল না । আমার আকাঙ্খা বাস্তবায়িত হল, যদিও দেরীতে ।
পরিবারে স্বাস্থ্যসঙ্কট
২০১১ সালের শেষ ভাগ থেকে আমাদের পরিবারে স্বাস্থ্যসঙ্কট দেখা দেয় । এযাবৎ আমি ও আমার স্ত্রী মোটামুটি সুস্বাস্থ্য বজায় রেখে চলেছিলাম । স্ত্রীর থাইরয়েড এবং আমার থাইরয়েড, উচ্চ রক্তচাপ ও সোরিয়াসিস নামক চর্ম্মরোগ ব্যতীত আমাদের কোন গুরুতর অসুখ ছিল না । এবার সেই অসুখগুলো দেখা দিতে লাগল ।
(ক) স্ত্রী সম্পর্কীয়
২০১১ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে শ্রোণী অঞ্চলে ব্যথা ও তৎসহ জ্বরে ভুগতে আরম্ভ করে । ২০১১ সালের নবেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ডাক্তারের চিকিৎসা কালে থেকে থেকে জ্বর ও ব্যথায় অক্রান্ত হয় । এরপর এক বন্ধুস্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে তলপেটের ইউ এস জি (USG) করালে রেট্রোপেরিটোনিয়াল লিম্ফ নোডের দীর্ঘস্থায়ী অস্বাভাবিক পরিবর্ধনের ঈঙ্গিত পাওয়া যায় । আরো পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানা যায় ও গ্রেড ২ বি সেল ননহজকিন (Non-Hodgkin) লিম্ফোমা রোগে আক্রান্ত । এই রোগটি আসলে এক ধরণের আরোগ্যযোগ্য ক্যান্সার । ওর চিকিৎসায় তখন কেমোথেরাপির ৬টি চক্র সম্পূর্ণ করা হয় ও ২৫ ডোজ রেডিওথেরাপি রে দেয়া হয় । ও বর্তমানে সম্পূর্ণ সুস্থ ও সুস্থতার একাদশ বর্ষে রয়েছে । ২০১২ সালে পেট (Positron Emission Tomography) স্কেনে দেখা গেছে ওর লিম্ফনোড স্বাভাবিক আকারে রয়েছে । পরবর্তী ডায়াগনস্টিক টেস্ট ও ক্লিনিকাল পরীক্ষায় নোডের আকারের কোন পরিবর্তন লক্ষিত হয় নি ।
সংকট কিন্তু পিছু ছাড়েনি । এ বছরের (২০২২ সাল) ১লা জানুয়ারী ওর ভ্যাস্কুলার ডিমেনসিয়া ধরা পড়ে । এটি একটি প্রগতিশীল রোগ, দুরারোগ্য । জানি না এটি কোথায় নিয়ে যাবে । তবে এখন পর্যন্ত ওষুধপত্র দিয়ে স্থিতাবস্থা রাখা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় । চিকিৎসা চলছে ।
(খ) আমার নিজের সম্পর্কীয়
(১) ভাইরাস জ্বর: (Viral Fever)
আমার স্ত্রীর কেমোথেরাপি চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর আমাকে দুবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হল । আমার জীবনে আমি আগে কখনও হাসপাতালে ভর্তি হই নি । প্রথমবার আমার স্ত্রীর রেডিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু হওয়ার দুদিন আগে ২০১২ সালের ১৭ই আগস্ট আমি হাসপাতালে ভর্তি হই । ঐ সময় কোলকাতায় ডেঙ্গুজ্বর মহামারীর আকারে ছড়াচ্ছিল । হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, শয্যা পাওয়া দুষ্কর ছিল । যাহোক ১২ঘণ্টা অপেক্ষার পর স্থানীয় আমরি হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে আমার জন্য একটা শয্যার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল । আমি তিনদিন ঐ হাসপাতালে ছিলাম, ১৯শে আগস্ট ছাড়া পাই । ইহা নিশ্চিত করা হয়েছিল যে আমার ডেঙ্গু নয় ভাইরাল জ্বর হয়েছে; সেই জ্বরের চিকিৎসা করে সুস্থ করে হাসসপাতাল থেকে ছাড়া হয়েছিল ।
(২) ভার্টিজিনাস গিডিনেস (Vertiginous Giddiness)
২০১২ সালের ২৩শে ডিসেম্বর আমি দ্বিতীয়বার হাসপাতালে ভর্তি হই তীব্র মাথাঘোরা ও সেই সঙ্গে বমনেচ্ছাজনিত সমস্যা নিয়ে । আমার শরীরের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় । আমি পাঁচদিন সল্টলেকের কলোম্বিয়া এশিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। নিয়ন্ত্রিত চলাফেরার পরামর্শ দিয়ে আমাকে ২৭ শে আগস্ট হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় । অডিওমেট্রিক পরীক্ষায় দেখা যায় বাম কাণের শ্রবণশক্তি গুরুতররূপে বিঘ্নিত । ডিসচার্জের পূর্বে হাসপাতালে আমাকে দেহের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য ও শ্রবণশক্তির উন্নতিকল্পে কিছু ব্য়য়াম শিখিয়ে দেয়া হয় ও সেগুলো বাড়ীতে অভ্যেস করার পরামর্শ দেয়া হয় । পরের একমাসে দেহের ভারসাম্যের যথেষ্ট উন্নতি হয় ও স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম হই । পরবর্তী অডিওম্যাট্রিক টেস্টে দেখা যায় শ্রবণশক্তিরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে । ইএনটি বিশেষজ্ঞ যিনি চিকিৎসা করছিলেন জানালেন যে শ্রবণশক্তির আর উন্নতি হবে না । আমাকে হিয়ারিং এইড অ্যাটাচমেণ্ট নিতে হবে । আমি অনেক পরে ২০১৫ সালের জুন মাসে এম্প্লিফোন কোম্পানী থেকে বাম কাণের জন্য একটা দামী মেশিন ক্রয় করি । কিন্তু দশহাজার টাকায় একবার সার্ভিস করিয়েও ২০১৮ সালে সেটা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায় । যদিও আমার শ্রবণশক্তির অভাব রয়েছে তবুও আমি বর্তমানে কোন মেশিন ব্যবহার করছি না । এই মেশিনগুলো অত্যন্ত দামী কিন্তু তদুনযায়ী এদের জীবনকাল বা কার্যকারিতা সমানুপাতিক নয় । শ্রবণশক্তি গুরুতর ভাবে হ্রাস পাওয়ায় গত ২২শে নবেম্বর ৮৫০০০ টাকা মূল্যে উভয় কর্ণের জন্যই উন্নত প্রযুক্তির হিয়ারিং এইড যন্ত্র ক্রয় করতে হয়েছে । এতাবৎ যন্ত্রদুটি ভালভাবেই কাজ করছে ।
(৩) ইউটিআই (ই কোলি, ইএসএলবি) UTI (E-Coli, ESLB)
২০১৯ সালে আমাকে আরেকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, এবার মূত্রনালীর সংক্রমণে । সংক্রমণ এত গুরুতর হয়েছিল যে তলপেটে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব নির্গত হচ্ছিল । ধীরে ধীরে প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতাও লোপ পায় । এই দফায় ১৭ই এপ্রিল থেকে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয় । সুস্থ করতে ৩x৮ টি ইন্ট্রাভেনাস এণ্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দিতে হয় । হাসপাতালের মোট ব্যয় আশি হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায় । হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত অনুসরিত চিকিৎসা (Follow-up treatment) চলে । তৎপর কোভিড ১৯ অতিমারীর আবির্ভাবে লকডাউন ইত্যাদি কারণে চিকিৎসাকারী ডাক্তারের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে অনুসরিত চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে হয় ।
(৪) সোরিয়াসিস (Psoriasis)
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিক থেকে আমি দ্বিতীয়বার সোরিয়াসিসের জন্য বহিরাঙ্গন ( Outdoor) চিকিৎসা করাচ্ছি । কোলকাতার একজন প্রখ্যাত চর্ম্মরোগ বিশেষজ্ঞ আমার চিকৎসা করছেন । সোরিয়াসিস একটি ক্রণিক অটোইমিউন ব্যধি যা দ্রুত শরীরে ত্বকের কোষ তৈরী করে । এই গড়ে ওঠা কোষ চামড়ার উপর আঁশ বা শল্ক তৈরী করে । সাধারণ ভাবে আঁশের চারপাশে প্রদাহ ও লালভাব থাকে । সোরিয়াসের প্রভাবে তীব্র চুলকানির সৃষ্টি হয়, চুলকানিতে আঁশ উঠে আসে ও কখনো কখনো রক্তপাত হয় । আদর্শ সোরিয়াসিসের আঁশ সাদাটে রুপার রঙের, পুরু লাল রঙের চাপড়ে তৈরী হয় । কখনো কখনো এই চাপড় ফেটে গিয় রক্তপাত ঘটায় ।আঁশ সাধারণতঃ গ্রন্থিতে জন্মায় যেমন, কনুই, হাটু ইত্যাদি । এরা অবশ্য হাত, পা, গলা, মুখ, মাথার ত্বক সহ শরীরের যে কোন অংশে প্রকাশিত হতে পারে । আমার ক্ষেত্রে তা জংঘার বাইরের অংশে, পিছনে শিরদাঁড়ার শেষপ্রান্তে, পায়ে ও কিছুটা মাথার ত্বকে ছিল । এখন পিছনে ও মাথার ত্বকে রয়েছে, নতুন যোগ হয়েছে বাম হাতের আঙুল । আমার শরীরে সোরিয়াসিসের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চামড়ার টুকরো নিয়ে ডাক্তার বায়োপ্সি করিয়েছিলেন।
সোরিয়াসিস স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত গতি এক চামড়া তৈরী প্রক্রিয়ার ফসল । সাধারণতঃ ত্বকের কোষ ত্বকের গভীরে তৈরী হয় ও ধীরে ধীরে উপরে ওঠে আসে এবং শেষ পর্যন্ত খসে পড়ে । স্বাভাবিক ভাবে এই কোষের জীবনচক্র এক মাসের হয় ।
একটি গবেষণা অনুযায়ী আমেরিকায় সোরিয়াসিস রোগীর সংখ্যা ৭৪ লক্ষ । ভারতবর্ষে সোরিয়াসিসের প্রাক্কলিত ব্যপকতা ০.৪৪% থেকে ২.৮% যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে ০.০৯% থেকে ১১.৪৩% । প্রাক্কলিত পরম মানে পৃথিবীব্যাপী ১২৫০ লক্ষ লোক এই ব্যধিতে আক্রান্ত । এই রোগ সাধারণতঃ অন্যান্য বেশ কয়েকটি রোগের অবস্থার সঙ্গে জড়িত যেমন টাইপ ২ বহুমূত্র রোগ, প্রদাহজনক পেটের রোগ, হৃদরোগ, সোরিয়াটিক বাত, উদ্বিগ্নতা ও অবসাদ । আমার ক্ষেত্রে অন্য কারণগুলি অনুপস্থিত থাকায় নানা বিষয়ে সীমাহীন উদ্বিগ্নতা ও অনিদ্রা এই রোগের কারণ বলে মনে হয় ।
আমার শরীরে সোরিয়াসিস প্রথম দেখা দেয় ২০০৪ সালের কোন এক সময়ে । প্রাথমিক অবস্থায় আমি এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করাই । স্থানীয় চর্ম্মরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা কার্যকরী হলো না, আমি জানতে পারলাম হোমিওপ্যাথিতে এই রোগের ভাল চিকিৎসা রয়েছে । ২০০৬ সালে পুণায় আমার মেয়ের বাড়ীতে থাকার সময় আমি ডাঃ বাত্রার পুণা ক্লিনিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই রোগের চিকিৎসার জন্য নাম নথিভুক্ত করালাম; হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু হল । ডাঃ মুকেশ বাত্রা একজন প্রথিতযশা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক; সারা ভারতজুড়ে ক্লিনিক রয়েছে । মেয়ের বাড়ী থেকে চলে আসার সময় আমার রেজিষ্ট্রেশন ডাঃ বাত্রার কোলকাতার উল্টাডাঙ্গা ক্লিনিকে স্থানান্তরিত করিয়ে নিলাম, চিকিৎসা অব্যাহত রইল । এখানে তিন বৎসর চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে গেলাম ।
২০১৯ সালে এই রোগ আবার দেখা দিল । আমি ডাঃ বাত্রার ক্লিনিকে আবার এই রোগের চিকিৎসার জন্য নিবন্ধীভুক্ত হলাম । এখানে তিন মাস চিকিৎসা চলল । কিন্তু এবার অবস্থা শোধরাবার পরিবর্তে আরও খারাপ হয়ে গেল এবং আশু প্রতিবিধান পাওয়া গেল না । আমাকে তখন বাধ্য হয়ে এলোপ্যাথিতে প্রত্যাবর্তন করতে হল । সেই থেকে অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে যদিও নতুন কিছু অংশ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ।
কিন্তু ২০১৯ সলে কোভিড অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের পর চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা বন্ধ করে টেলিমেডিসিন ব্যবস্থা চালু করেন । এর ফলে রোগের কিছুটা অবনতি ঘটেছে । হাতের আঙুলের উপর ও দু আঙুলের ফাঁকে নতুন করে দেখা দেয়া প্যাচগুলোকে যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না । তদুপরি ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর কিছুদিনের জন্য সোরিয়াসিসের ওষুধ খাওয়া বন্ধ রেখেছিলাম । তবে চিকিৎসা এখনও চলছে । কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে । কোভিডের প্রকোপ কমার পর দু-তিনবার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষাও হয়েছে । এরপর রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় ও শরীরের আরো কয়েকটি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে । চিকিৎসক ডাক্তারের মতে আমার রক্তে প্ল্যাটেলেট ও শ্বেত কণিকা স্বাভিকের চেয়ে অনেক কম মাত্রায় থাকায় সোরিয়াসিসের মূল ওষুধ দেয়া যাচ্ছে না । কমিয়ে রাখার চেষ্টায় অন্যান্য ওষুধ দেয়া হচ্ছে । ইতিমধ্যে (২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট) প্লীহা ও যকৃতে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়ায় খাওয়ার ওষুধ বন্ধ রয়েছে । কেবল ময়শ্চারাইজিং ক্রিম ও লোশন ব্যবহার করা হচ্ছে ।
(৫) কোভিড ১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত
১৭ই এপ্রিল ২০২১ আমি ও আমার ছোট মেয়ে কোভিড টেস্টে ভাইরাস আক্রান্ত বলে নির্ণীত হলাম । আমার ভাইরাস লোড ছিল ২৭, আমার মেয়ের ১৬ । এর অর্থ আমি সংক্রমণের অগ্রবর্তী অবস্থানে রয়েছি । আমার কোন উপসর্গ ছিল না, বুঝতেই পারছিলাম না কখন সংক্রমিত হয়েছি । ভাইরাস লোড সংকেত দিচ্ছিল টেস্টের বেশ কয়েকদিন আগেই সংক্রমণ হয়েছে । পেছনে তাকিয়ে আমার মনে পড়ল ৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল আমার প্রচণ্ড পেশীর ব্যথা ও সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক দুর্বলতা ছিল । আমি দিনদুয়েক ক্রোসিন ৬৫০ খাওয়ার পর ব্যথা সেরে গিয়েছিল । তখন আমার এটাও মনে পড়ল পেশীর ব্যথা সেরে যাওয়ার পর কয়েকদিন আমি দুর্বলতর গন্ধ পেতাম না যদিও ঘ্রাণশক্তি শীঘ্রই ফিরে এসেছিল । পরে কয়েকদিন খাবারের স্বাদও চলে গিয়েছিল । আমার বাড়ীতে এমনিতে সুস্বাদু খাবার খুব একটা তৈরী হয় না, তাই ভেবেছিলাম এটা বোধহয় রাঁধুনীর কৃতিত্ব । এই সমস্ত তথ্য ও তৎসহ RT-PCR টেস্টে নির্দেশিত ভাইরাস লোড বিবেচনা করে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে সময়ে আমার পেশীর ব্যথা ও দুর্বলতার উপসর্গ দেখা দিয়েছিল সেই সময়ের আশে পাশেই আমি সংক্রমিত হয়েছিলাম । আমি কোথা থেকে বা কার থেকে সংক্রমিত হয়েছিলাম ভেবে পাচ্ছিলাম না । আমি সকালবেলা নিকটস্থ বনবিতান জীববৈচিত্র্য পার্কে এক দুঘণ্টার প্রাতঃভ্রমণ ব্যতিরেকে মূলতঃ গৃহে অন্তরীণ থাকতাম । কদাচিৎ আমি হাটে বাজারে যেতাম । বাইরে বেরোলে জনশূন্য স্থান ছাড়া সর্বদা মাস্ক পরে থাকতাম ও ফিরে ৩০ থেকে ৪০ সেকেণ্ড সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধূতাম, জনসমাবেশ থেকে দূরে থাকতাম । আমার যুক্তিবোধ্য অনুমান এটি বায়োডাইভার্সিটি পার্কের অবাঙ্গালী প্রাতঃভ্রমণকারীদের (যারা দলবেধে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে বলতে হাটত ও মাস্ক ব্যবহার করত না) কারো থেকে সংক্রমিত হয়েছিল । অবশ্য আরেকটি সম্ভাবনাও ছিল । ১৭ই মার্চ আমার একটি কেসের ব্যাপারে আমার উকিলের সাথে কথা বলতে সল্টলেক বিচারবিভাগীয় কোর্টে গিয়েছিলাম ও কিছুক্ষণ ঘিঞ্জি বার লাইব্রেরীতে বসেছিলাম । কিন্তু আমার মুখে তখন এন ৯৫ মাস্ক ছিল ।
যাক সেকথা, ১৮ এপ্রিল কভিড টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার পর ১৯শে এপ্রিল আমরা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে একজন চিকৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি । আমিও আমার মেয়ে ডাক্তারের বিধান অনুযায়ী ওষুধ খেতে ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উপর নজর রাখতে শুরু করি । ইতিমধ্যে অবশ্য আমার সব উপসর্গগুলোই চলে গিয়েছিল এবং আমার কোন অস্বস্তি বা অস্বাচ্ছন্দ্য ছিল না । ডাক্তারের পরামর্শ মত আমরা নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী বাড়ীতে নিভৃতবাস করলাম । কভিড প্রোটোকল অনুযায়ী নিভৃত বাসের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে আমরা বেরোলাম । নিম্নে আমার টেস্টের রিপোর্ট ও ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন ।
কুকুরের কামড়
২০২১ সালের ৮ই জুলাই প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে আমি যখন বী বী পার্কের দিকে যাচ্ছিলাম তখন পেছন থেকে চুপিসাড়ে এসে একটা কুকুর আমার ডান পায়ের ডিমের নীচের অংশে কামড়ে দেয় । কামড়ের মূল আঘাত আমার ট্রাউজার্সের পায়ের উপর দিয়ে যায় ও ট্রাউজার্সের এক ক্ষুদ্র অংশ ছিন্ন হয় । ট্রাউজার্সের পা আমাকে গভীর ক্ষত হওয়া থেকে রক্ষা করে । আমার খুব সামান্য একটা ক্ষত হয়েছিল, দু-এক ফোঁটা রক্ত বেরিয়েছিল । সঙ্গে সঙ্গে টেট ভেক নিও ও এন্টি রেবিজ ভেকসিনের কোর্স শুরু করে দি । ২০২১ সালের ৫ই আগস্ট ভেকসিনের কোর্স শেষ হয় ।
আমার বর্তমান কার্যক্রম
আমি বর্তমানে বেশীর ভাগ সময় কাটাই কম্প্যুটারে অনলাইন বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে, প্রদেয় বিল ইত্যাদি অনলাইনে মিটিয়ে, বৈদ্যুতিন পুস্তকাদি পাঠ করে ও সৃজনশীল কর্ম্মে । মাঝে মাঝে গৃহস্থালীর কাজকর্ম্মও করে থাকি । দৌহিত্র শ্লোক কাছে থাকলে ওর সঙ্গেও কিছু মনোরম সময় কাটাই । ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে শ্লোক ওর বাবার কেনা নতুন বাড়ীতে চলে গিয়েছিল । তবে কোভিড অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের পর ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ও বাবা মার সাথে মোটামুটি আমার কাছেই আছে ।
প্রায়শঃ আমার বর্তমানের বাস্তবতা আমাকে অতীতে টেনে নিয়ে যায়। আমি বরাবর একজন পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ, পরিবারের প্রয়োজনকে সর্বদা অন্য সব কিছুর উপর স্থান দিয়েছি । কিন্ত আধুনিক সমাজে বিশেষ করে বার্ধক্যে পরিবার বা পরিজনের স্বার্থে কিছু বলা বা করাকে তরুণ প্রজন্ম সহজ ভাবে নিতে পারে না, তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করে ও গৃহে অশান্তির সৃষ্টি করে । আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের ভুলত্রুটি দেখলে কিংবা যথাযথ পথে চলার জন্য নানারকম উপদেশ দিতেন । তাদের সেই অভিজ্ঞতালব্ধ উপদেশ শুনে আমরা উপকৃত হতাম । কিন্তু আজকের ছেলেমেয়েদের (যেমন আমার মেয়েদের মধ্যে দেখেছি) উপদেশ পালন করা ত দূরের কথা, তা শুনার মত ধৈর্যটুকুও তাদের নেই । কথা শুরুর আগেই উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করে, জ্ঞান শুনতে চায় না ইত্যাদি বলে, বয়ঃজ্যেষ্টদের বলাই বন্ধ করিয়ে দেয় । আমাদের আগের দিনের মুনি ঋষিরা বলতেন, "পঞ্চাশোর্দ্ধম বনং ব্রজেৎ" অর্থাৎ বয়স পঞ্চাশের পর বনে চলে যাওয়া উচিত । কিন্তু আজকের আধুনিক দুনিয়ায় তা সম্ভব নয় । তখনকার দিনে এটি অর্থবহ ছিল, মানুষ তখন অরণ্যের নির্মল পরিবেশে শান্তিতে বাস করতে পারত । আজ সেই মানুষও নেই, সেই অরণ্যও নেই । জীবনের বেশীর ভাগ সময় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ নগরজীবনে অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে আজ সর্বত্যাগী হয়ে অরণ্যে বাস করা সম্ভব নয় আর বসবাসার্থে অরণ্যও এখন লভ্য নয় । সুতরাং কেউ একক ভাবে বাস করতে না চাইলে বার্ধক্যেও তাকে আত্মীয় পরিজনের মধ্যেই থাকতে হবে । সেক্ষেত্রে সুস্থ ভাবে বাঁচার ছক তাকে নিজেকেই বানাতে হবে । আমার বিবেচনায় সেক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হবে যিনি যেটা ভালবাসেন তার মধ্যেই নিজেকে ব্যাপৃত রাখা । আর সময় সময় অতীত জীবনের পৃষ্ঠা উল্টে মধুর স্মৃতি রোমন্থন করা । আমি অন্ততঃ তাই করি ।
আমার দৌহিত্র শ্লোক
আমার দৌহিত্র শ্লোক বুদ্ধিমান ও মেধাবী । আগে খুবই হাসিখুশী ছিল, এখন (২০২২ সাল) একটু গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে গেছে । যখন প্রথম কথা বলতে শেখে সেই সময় ওর আধো আধো বুলি শোনা মহা আনন্দের ছিল । ওর খুবই ছোটবেলায় ওর জন্য জীবজন্তু, মাছ, শাকসব্জীর ছবি দেয়া বই এনে দিতাম, সেই থেকে ওর পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জন্মায় । ও টডলার অবস্থায় যা যা শিখেছিল ওই সব জীবজন্তু, শাকসব্জী ইত্যাদির নাম পরবর্তীকালেও ওর স্মরণে ছিল । ও নানা বিষয়ে শিখতে উৎসুক । বর্তমানে ও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে । পরীক্ষার ফলাফল প্রশংসার দাবী রাখে । ওর সাধারণ জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর । আমার বিশ্বাস উপযুক্ত পথনির্দেশ পেলে জীবনে ও উন্নতির শিখরে পৌঁছুতে পারবে । কিন্তু উপযুক্ত পথনির্দেশ দেবে কে? স্বাভাবিক অভিভাবকদের তরফে পড়াশোনার ব্যপারে অত্যধিক চাপ ওর মেধা ও অধ্যবসায়ের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে । এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় । এ নিয়ে পীড়াপীড়ি করতে গেলে গৃহের পরিবেশ কলুষিত হয় । দুঃখজনক ভাবে ইতিমধ্যে ওর আত্মবিশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে । কিন্তু যাদের তা লক্ষ্য করার কথা তারা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে অপারগ । শিশুকে গড়ে তুলতে যে সংবেদনশীলতা, বিচারবুদ্ধি ও গভীর চিন্তাশীলতা প্রয়োজন শ্লোককে যারা গাইড করছেন তাদের মধ্যে তা কি মাত্রায় রয়েছে তা সংশয়পূর্ণ । শ্লোক বুদ্ধিমান, পড়াশোনায় একনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল । ওর উপর সামগ্রিক দৃষ্টি রেখে পড়াশোনার ব্যপারে ওকে স্বাধীনভাবে এগোতে দিলেই বোধহয় ভাল হত । তবে তা যখন হয়নি তখন এটা দেখা দরকার গাইডেন্সের জেরে ওর স্বাভাবিক বিকাশ যেন ব্যহত না হয় । বাচ্চাটা আস্তে আস্তে যেন কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে । যতক্ষণ বাড়ীতে থাকে চুপচাপ থাকে, পড়া আর তৈরী করা পড়া অন্যকে দিয়ে ধরাণো এই তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান । স্কুলের বাইরে না বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলা ধুলো, না করো সাথে গল্পগুজব । ওর মানসিক বিকাশ হবে কি ভাবে ? ওকে দেখে মনে হয় ওকে পরীক্ষায় টপ মার্কস অর্জনের আফিম খাইয়ে দেয়া হয়েছে । ওর জন্য বড় কষ্ট হয় । দুঃখ হয় সব বুঝেও, পড়াশোনার বিষয়টি নিজের অধিগত থাকা সত্বেও শিশুটির কোন কাজেই লাগার ক্ষমতা নেই ।
আমি চাই ওর মধ্যে মানুষের সদগুণগুলোর বিকাশ ঘটুক । ও একজন যথার্থ মানুষ হোক । কিন্তু কথিত পরিস্থিতিতে আমার অনেক আশার মত এ আশাও দুরাশায় পর্যবসিত হবে কি না কে জানে ।
শ্লোকের অসংখ্য খেলনাপাতি রয়েছে, কিন্তু কোনটির প্রতি ওর আসক্তি নেই; অতি সহজে কোন কিছু পেয়ে গেলে যা হয় । ওর সঙ্গীতে আকর্ষণ ছিল, ড্রাম বাজাতে ভালবাসত । কিন্তু বর্তমানে সেই আগ্রহ নেই । কয়েক বছর আগে থেকে ও টেনিসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে । টেনিসে ও দক্ষ হয়ে উঠছে, লেগে থাকলে ভাল খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে । অনবরত বৃষ্টি ও অসুস্থতার জন্য খেলা বেশ কিছুদিন বন্ধ আছে । এর পূর্বে কোভিড মহামারীর জন্য প্রায় দু বছর স্কুলের সাথে সাথে খেলাও বন্ধ ছিল । কোভিড এই প্রজন্মের শিশুদের অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়ে গেছে ।
ওর সবচেয় বড় গুণ হচ্ছে ও যাই করুক সম্পূর্ণ একাগ্রতা নিয়ে করে ।
জন্মভূমি সফর
আগেই বলেছি, দূর অতীতে ১৯৪০ এর দশকের শেষভাগে আমার জন্মভূমি শ্রীহট্ট বা সিলেট যেখানে আমার অতি শৈশবের প্রথম কয়েক বছর কাটিয়েছিলাম ছেড়ে আসি । দেশভাগের পরপরই আমরা ভারতভুক্ত এলাকায় মাইগ্রেট করে এসেছিলাম । আমার অবচেতন মনে সর্বদা জন্মভূমি দর্শনের বাসনা সুপ্ত ছিল । সময় ও সুযোগের অভাবে সক্রিয় কার্যকালে তা সম্ভব হয়নি । অবশেষে অবসরের দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এক স্বল্পদৈর্ঘ্যের সফরের মধ্য দিয়ে সেই বাসনা চরিতার্থ হল । নতুন ও পুরাতন আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে মূলে ফিরে কয়েকটা দিন খুবই আনন্দের মধ্যে কেটেছিল ।
অবসরকালীন বিনোদন সফর
অবসরকালে আমি কখনো একা কখনো বন্ধুবর আশুর সাথে ভারতের কয়েকটি স্থানে বিশেষ করে আসাম ও সন্নিহিত অঞ্চলে সফর করেছি । এই সফরগুলো আমরা খুবই উপভোগ করেছি । এগুলো অবসর জীবনের এক বড় প্রাপ্তি । এই সব ভ্রমণের ইংরাজী বিবরণ লিঙ্কে ক্লিক বা টেপ করলে নির্দ্দিষ্ট পাতায় নিয়ে যাবে । ।
ভ্রমণ কাহিনীর লিঙ্ক