আত্মবিশ্লেষণ
আমার ধনাত্মক দিক
আমি প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন একজন কর্মোদ্যোগী মানুষ । অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমি না-থাকার (have-nots) দল থেকে উঠে এসে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি ।
কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমি অগ্র পশ্চাৎ ভাল ভাবে বিবেচনা করে দেখি, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেলে তাতে অবিচল থাকার চেষ্টা করি । কিন্তু জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম যার ফলে পরবর্তীকালে আমাকে প্রতি পদে অনুশোচনার শিকার হতে হয়েছে ।
ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমি মিতব্যয়ী; আমি “অর্থ সঞ্চয় অর্থ উপার্জনের সমতুল্য” (Money saved is money earned) এই মতবাদে বিশ্বাসী । কিন্তু অর্থের প্রতি আমার কোন লিপ্সা নেই (স্মর্তব্য আমি অর্থাভাবের মধ্যে মানুষ এবং শিক্ষাজীবনে অর্থাভাবজনিত কারণে একের পর এক প্রখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি ) । আমি মনে করি প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ ক্ষতিকারক । এরূপ অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই মনুষ্যত্বের বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে । অনেক কাল আগে একটি হিন্দি প্রবচন পড়েছিলাম, “रूपाया पैसा हातका मैल हाय, आते जाते रहते हाय” (Money is nothing but dust on the hand; it keeps on coming and going) । অর্থকে আমি সেই অর্থেই দেখি । অর্থের প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত হলেই অনর্থ ঘটায় ।
আমি লোভ ও আধুনিক জীবনধারার মূল্যবোধহীন আসক্তিকে ঘৃণা করি ।
আমার জীবনের মূলমন্ত্র হল, "সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি" (Honesty is the best policy) । কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কেবল সৎ হওয়াই যথেষ্ট নয়, সততার সঙ্গে কর্ম্মশীলতাও দরকার।
আমি ভাল কর্ম্মী, এবং আমি যাই করি তা ত্রুটিহীন করতে চাই (I strive for perfection in whatever I do) ।
যে কোন ধরণের অপচয়কে আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি । অপচয় হতে দেখলে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি । কিন্তু দুঃখের সঙ্গে আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে আমার স্ত্রীর উদাসীনতার জন্য আমার নিজের বাড়ীতেই অপচয় বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছি ।
নতুন বিষয় শিখতে আমি বরাবর আগ্রহী । বাড়ীতে থাকাকালে আমার বেশীর ভাগ সময় কম্প্যুটার নিয়ে ব্যস্ত থাকার এটি একটি প্রধান কারণ ।
আমি একজন সম্পূর্ণরূপে শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তি, বিশৃঙ্খলা আমি সহ্য করতে পারি না । আমি আমার সমস্ত চিঠিপত্র ও তথ্যাদি যথাযথ শ্রেণীবিন্যাস করে বিভিন্ন ফাইলে সংরক্ষণ করি, সে আলমারিতেই হউক আর বৈদ্যুতিন ডিস্কেই হউক । আমি জায়গার জিনিষ জায়গায় থাকুক এটাই চাই যেন প্রয়োজনে সহজেই তা পাওয়া যায় । আমার এ ব্যাপারে পীড়াপীড়ি মাঝে মাঝে পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়ে ওঠে । আমি চাই অকেজো পুরণো নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিক, কিন্তু আমার স্ত্রী চায় নতুনের সাথে পুরণোও থাকুক । ফলে স্থানাভাব দেখা দেয় ।
আমি কোন বিষয়ে অযৌক্তিক ও অন্যায্য তর্ক সহ্য করতে পারি না, উত্তেজিত হয়ে পড়ি । আমার নীতিতে আঘাত করে এমন বিষয়ে সমঝোতা করা আমার পক্ষে কঠিন । (১)
আমি অত্যন্ত অনুভূতি প্রবণ যা কারো কারো কাছে দুর্বলতা বলে মনে হতে পারে ।
আমি জীবন যাপনে সাদাসিদে, কিন্তু কাজে এককেন্দ্রিক মন তা সে যখন, যেখানে, যেমন কাজই হোক না কেন । আমি যে অতি সামান্য অবস্থা থেকে উঠে এসেছি তা আমি কখনও ভুলি না, আমৃত্যু তা আমার মনে থাকবে ।
আমি অন্তর থেকে সুন্দরের পূজারী ।
আমি কর্মস্থলের বিষয় বাসভবনে বয়ে আনার ঘোরতর বিরোধী । আমার কর্মস্থলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে । কিন্তু তার বিন্দু-বিসর্গও আমার পরিবারের সদস্য বা কর্মস্থলের বাইরের বন্ধুবান্ধবরা কেউ জানতে পারেনি । জীবন-কাহিনী লিখতে গিয়ে তার কিছু কিছু এখানে প্রকাশ করেছি ।
আমি তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী । তাই আমি কোন রোজনামচা বা নোট ব্যতিরেকেই আমার জীবনকাহিনীতে বর্ণিত ঘটনাগুলো নিকট ও দূর অতীতের স্মৃতি থেকে আহরণ করতে পেরেছি ।
আমি আজকের দিনের কাদাছোড়া ও হিংসাশ্রয়ী রাজনীতিকে ঘৃণা করি, কিন্তু অতীতের স্বচ্ছ রাজনীতিকে শ্রদ্ধা করি ।
আমি সাধারণভাবে পার্থিব আসক্তির বৈপরীত্যে কিছু উচ্চ আদর্শে নিবেদিত । আমার আদর্শ বা নীতি আঘাতকারী কোন পরিস্থিতির সূচনা হলে আমি নির্মম ভাবে তার মোকাবিলা করি; আমার ব্যক্তিগত সুখ-স্বাছন্দ্য বা আশা আকাঙ্খা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তার কোন ব্যত্য়য় ঘটাতে পারে না ।
আমার ঋণাত্মক দিক
প্রকৃতিগত ভাবে আমি অন্তর্মুখী (Introvert), সহজে বন্ধুত্ব পাতাতে পারি না । যৌক্তিক লেখায় আমি পারদর্শী, কিন্তু আলাপচারিতায় কিছুটা জড় । সেখানে আমি অন্তর্মুখী । একদল অপিরিচিত মুখের মধ্যে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না । পরিবার ও বন্ধুদের বাইরে আমি বলি কম, শুনি বেশী । আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা অন্য কারো বাড়ীতে থাকতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না ।
নিজের কষ্টের কারণ হলেও আমার সম্মুখে বা আমার অবগতির মধ্যে ঘটা কোন বিষয়ে আমি সহজেই জড়িয়ে পড়ি । এই কারণে পরিবারের মধ্যেও কেউ আমাকে পছন্দ করে না এবং প্রায়শঃ আমাকে অবাঞ্ছিত প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় ।
আমার পছন্দ অপছন্দ বোধ তীব্র ।
সুন্দরের প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ কখনও কখনও প্রগাঢ় হয়ে আমার দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পরিস্থিতির দাস হয়ে পড়ি ।
ইংরেজীতে যাকে লিবিডো (libido) বলা হয় আমার মনে হয় আমার মধ্যে তার মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা বেশী ।
আমি কদাচিৎ নিজেকে প্রকাশ করি । আমি খানিকটা খুঁতখুঁতে ও উন্নাসিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অবশ্যই অনমনীয় ।
আমার ও আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবনদর্শনের ভিন্নতা হেতু সময় সময় সংঘাত দেখা দেয় এবং পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয় ।
আমার আমার শখ বা Hobby
আমি পড়তে, গাড়ী চালাতে, কম্প্যুটার নিয়ে কাজ করতে, ছবি বিশেষ করে নৈসর্গিক দৃশ্যের ছবি তুলতে ভালবাসি । কম্প্যুটার চালনা আয়ত্ব করার পর আমার পঠনপাঠন মূলতঃ বৈদ্যুতিন বিষয় সামগ্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে । মুদ্রিত বই ছাড়াও আমার ইলেকট্রনিক লাইব্রেরীতে ৫০০টি ই-বুক সংরক্ষিত আছে যার অধিকাংশই ইংরেজী ভাষায় । এই বইগুলোর প্রায় সবকটিই আমার পড়া হয়ে গেছে । ২০১৭ সালের মধ্যভাগে আমি একটি ইলেক্ট্রনিক বুক রিডার "Kindle Paperwhite" ক্রয় করি । এর মাধ্যমে সামান্য মাসিক ব্যয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ইংরেজী বই পড়ার সুযোগ পাওয়া যায় । এটি আমার জন্য খুবই সুবিধাজনক হয়েছে বিশেষ করে আমি যখন সফরে থাকি । এর দ্বারা ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি প্রায় ৩৮৪টি বই পড়া শেষ করেছি । আমার পড়ার সময় সাধারণতঃ রাত ৮টা/সাড়ে আটটা থেকে রাত ১১টা/সাড়ে এগারটা
লিগ্যাল থ্রিলার সহ রহস্যময় ও ডিটেক্টিভ গল্প আমাকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে । আমি মনে করি এই ধরণের গল্প মস্তিষ্ককে অবারিত করে বিষয়বস্তুকে যথাযথ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার শিক্ষা প্রদান করে ।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্ম্মবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গী
আমরা অধিকাংশ সিলেটি হিন্দুদের মত আদিতে বৈষ্ণব । এ বিষয়ে গোঁড়ামি আমি বাল্যকালে মায়ের মধ্যে লক্ষ্য করেছি । আমার মামাবাড়ীর গৃহদেবতা গোপীনাথ তথা শ্রীকৃষ্ণ । তবে উদ্বাস্তু হয়ে দেশত্যাগের পর ও পরবর্তি পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ধর্ম্ম নিয়ে কোন মতবাদের অনুসারী হওয়ার মত অবকাশ আমাদের ছিল না । অন্ন চিন্তায় যাদের সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকতে হয় তাদের মধ্যে খুব কম লোকেরই অন্য চিন্তার অবকাশ থাকে । তবে মায়ের ধর্মীয় আচার আচরণের অভাব দেখিনি ।
আমি ভগবান বা সর্ব্বশক্তিমানে বিশ্বাস করি, কিন্তু ধর্মীয় আচার-আচরণে নয় (Do not believe in rituals) । আমার মতে মানুষের কর্মই বিচার্য, কে কতক্ষণ ঠাকুরঘরে কাটাল তা নয় । আমি মনে করি সদর্থক কর্ম্ম ও বাহুল্যবর্জিত আরাধনাই আমাদের পাথেয় হওয়া সমীচীন । আমার কোন কুসংস্কার নেই এবং তা সমর্থনও করি না ।
আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন । আমি জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাসী নই । আমি নিজে ভিন্ন জাতিতে বিয়ে করেছি ।
আমার কাছে আমাদের সনাতন মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি পশ্চিমী প্রথা ও সংস্কৃতির চেয়ে অধিক মূল্যবান ।
আমার ব্যর্থতা
আগেই বলেছি, আমি প্রকৃতিগত ভাবে খুঁতখুঁতে । সে কারণেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কিছু ভুল বিকল্প পছন্দ করে পরবর্তী জীবনে অসীম কষ্টের শিকার হয়েছি । সেক্ষেত্রে নির্বাচন করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকল প্রত্যক্ষ ও বাহ্যিক উপাদানগুলো বিবেচনা করেছিলাম । কিন্তু পরবর্তী কালে প্রতিভাত হল যে অপ্রত্যক্ষ বা আভ্যন্তরীণ ও দূরবর্তী উাপাদানগুলো এবং তাদের তাৎপর্য অনুধাবন করতে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম । সাধারণতঃ আমি কোন বিষয় দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি । কিন্তু এখানে আমি তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম; অন্য এক বিহ্বলকারী উপাদান আমার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে রাখায় (বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়) এবং সংশ্লিষ্ট ডাটা বা তথ্য উপলভ্য না হওয়ায় । আমার দু-একজন শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শও বাস্তব অবস্থার পশ্চাদপটে বিবেচনা করিনি (অত্যধিক আত্মবিশ্বাস!) । নিজের জীবনে কোন কোন ক্ষেত্রে আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছি ।
আমি অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করেছি, কিন্তু দৃশ্যতঃ নিজের বাড়ীর বিচরণ ক্ষেত্রেই সাফল্যের অভাব রয়েছে ।
ছোটবেলা থেকে আমি গম্ভীর, মৃদুভাষী ও শান্ত প্রকৃতির ছিলাম । পরিবারের বাইরে আমি এখনও তাই । কিন্তু পরিবারের অঙ্গনে কখনো কখনো এগুলোর কিছু অভাব দেখা যায় । বিবাহোত্তর জীবনে কোন এক সময় থেকে এই পরিবর্তনের সূচনা হয় । এর অনেক কারণ থাকতে পারে (প্রতিকূল পারিবারিক বাতাবরণ ব্যত্যয় নয়) । কারণ যাই হোক, এই পরিবর্তনে আমি বিরক্ত বোধ করি; পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করছি ।
স্ত্রী ও পরিবার সম্পর্কে ধারণা: কল্পনা ও বাস্তব
তারুণ্যের প্রথমে আমি একজন বুদ্ধিমতি, সুন্দরী, প্রেমময়ী, বিচারবুদ্ধিসম্পন্না ও সহানুভূতিশীলা রমণীকে স্ত্রী রূপে কল্পনা করতাম । পরে আমার উপলব্ধি হল আমি সোনার পাথরবাটি চাইছি, একই অঙ্গে এত গুণের সমাহার সম্ভব নয় । যদিও আমি সুন্দরের পূজারী, এটা স্বীকৃত সত্য প্রায়শঃ সৌন্দর্য অন্য গুণাবলীর সহগামী হয় না । লিও টলস্টয় যেমন বলেছেন, "এটা বিস্ময়কর যে সৌন্দর্যই উৎকর্ষতা এই বিভ্রম কত সম্পূর্ণ!" "(It is amazing how complete is the delusion that beauty is goodness!)" । আমার ব্যক্তিগত জীবনে যে রমণীকে আমি স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছি তিনি সুন্দরী এবং কয়েকটি ব্যতিক্রমী গুণের অধিকারিণী (মেখলিগঞ্জ অধ্যায়ে "আমার স্ত্রী অজিতা" নামক অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য) । কিন্তু জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্টতই ভিন্ন, সে বিষয়ে আমরা প্রায় বিপরীত মেরুবাসী; আমাদের আদর্শও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী । তবে আমাদের পারিবারিক বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে মূলতঃ সন্তান মানুষ করার পদ্ধতি । ভ্রান্ত পদ্ধতির ফল সুখকর হয় নি । মায়ের স্নেহান্ধতা ও মাত্রারিক্ত প্রশ্রয়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়া মেয়েদের উত্তরজীবনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে । আমার আদর্শ পরিবার গঠনের বাসনা স্বপ্নে বিলীন হয়েছে ।
তবে পারিবারিক জীবনে মূলতঃ আমি একজন অত্যন্ত ভুলবোঝা মানুষ, মনোজগতে আমি সম্পূর্ণ একা । আমার নিবাস গৃহ হওয়া থেকে অনেকটাই দূরে রয়ে গেছে ।
সংসার পরিচালনায় আমার ভূমিকা
স্বাভাবিক নিয়মে পারিবারিক জীবনে সংসার পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব স্ত্রীর । স্বামীর মূল দায়িত্ব অর্থ উপার্জনের ও সময় বিশেষে বা প্রয়োজনে সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে স্ত্রীকে পরামর্শ দানের । এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রমে সংসার পরিচালনার মূল দায়িত্ব আমাকে স্বহস্তে গ্রহণ করতে হয়েছিল । আমার স্ত্রী পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যয় নির্বাহে অপারগ হওয়ায় চাকুরী নির্ভর সীমিত আয়ে সংসারের ব্য়য় নির্বাহের বিষয়টি ওর উপর ন্যস্ত করা সম্ভব ছিল না । দু-একবার অন্যরূপ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে লাগাম নিজের হাতেই নিতে হয়েছে ।
অতীতের দারিদ্রতা ও জীবনের অনিশ্চয়তা স্মরণে রেখে এবং পরিবারের স্বাস্থ্য, মেয়েদের শিক্ষা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় তথা বিবাহাদির ভবিষ্যৎ সংস্থান, পরিবারের জন্য নিজস্ব গৃহ সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে সীমাবদ্ধ আয় থেকে প্রতিটি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাকে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে । পরিহার্য ব্যয় যতটা সম্ভব পরিহার করে চলেছি । জীবনে একবার ব্যতীত সপরিবারে বা একক ভাবে আনন্দ উপভোগে রেস্তোঁরা পরিদর্শন করিনি । বিবাহিত জীবনে খুবই সীমিত সংখ্যক সিনেমা থিয়েটার দেখেছি । নিজের কোন ব্যক্তিগত ব্যয় ছিল না, চাকুরীর মধ্যজীবনে সিগারেট ছাড়ার পর কোন নেশা করিনি । কলেজ জীবনে প্রাপ্ত পুরষ্কারের টাকা থেকে কেনা জীবনের প্রথম হাতঘড়ি দিয়ে চল্লিশ বছরের অধিক সময় কাটিয়েছি । সামর্থ্য থাকলেও পাল্টাবার কথা ভাবিনি । দৈনন্দিন জীবনে নিজের জন্য যতটা সম্ভব কম জামাকাপড় ব্যবহার করেছি । অনেক সময় নিজের স্বল্প ব্য়য়সম্পন্ন ইচ্ছাকেও অবদমিত করেছি । মনের গভীরে এই বিবেচনা কাজ করেছে যে ঐ পরিহার্য ব্যয়ে সঞ্চিত অর্থ পরিবারের উপকারে আসতে পারে । হয়ত বাল্যের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত শিক্ষাই আমাকে তা করতে প্ররোচিত করেছে । সর্বদা এটাই চেয়েছি যে আমি যে অবস্থা থেকে উঠে এসেছি আমার পরিবারের কাউকে যেন কখনও সে অবস্থায় পড়তে না হয় । কৃচ্ছতাসাধনে সর্বদা নিজেকেই নিয়োজিত করেছি । কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই তার প্রভাব পরিবারের উপরও পড়েছে । সকলের সব চাহিদা সব সময় মেটানো যায় নি । পরিবারের নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে আমাকে দৃঢ়হাতে ব্য়য় সঙ্কোচন করতে হয়েছে । কিন্তু আমার স্ত্রী-কন্যারা কেউ আমার এই দায়বদ্ধতা তথা আর্থিক সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পারেনি । ওরা আমার জীবনের কথা জানে না । তাই ওদের পক্ষে আমাকে মূল্যায়ন করাও সম্ভব নয় । আর জানলেও যুগধর্মের শিকার ওদের পক্ষে এই মূল্যায়ন কতটা সম্ভব সে প্রশ্ন থেকেই যায় ।
রোমাণ্টিসিজম
রোমাণ্টিক ও ভাবপ্রবণ হওয়ায় আমি এক্ষেত্রে দূর্বল । মধ্য-শৈশবে আমার এক সহপাঠিনীর প্রতি গভীর ভালবাসার উদ্রেক হয়েছিল যার বিস্তৃত বিবরণ আমার শিক্ষাজীবনের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করেছি । সেটা ছিল একতরফা ভালবাসা । মেয়েটি তা জানতে পারেনি বা তার সাড়া দেয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়নি । পরবর্তী জীবনে অন্য এক নারী আমায় আকৃষ্ট করেছিল; তার ভালবাসার মুগ্ধতা এবং এক ধরণের স্বর্গীয় আনন্দ অন্তরে অনুভব করেছিলাম । জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আরো দু-একজন নারী আমার প্রতি তাদের আগ্রহ প্রদর্শন করেছিল, কিন্তু সাড়া দেয়ার আগ্রহ বোধ করিনি । এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় । অনাদিকাল থেকে বহুলাংশ নারী-পুরুষের জীবনেই এরূপ ঘটেছে । তবে আমার কাছে ভালবাসা যতটা না শারীরিক তার চাইতে অনেক বেশী এক প্রগাঢ় অনুভূতি । আমার জীবনে এই দুর্লভ তীব্র অনুভূতি দুবার এসেছিল, প্রথমবার শৈশবে আর দ্বিতীয়বার প্রাপ্তবয়সে । প্রথমবার একতরফা, দ্বিতীয়বার যুগ্ম সাধনে । আমি নির্বিদ্বধায় বলতে পারি দুবারই আমি উচ্ছ্বসিত আনন্দ ও প্রকৃত ভলবাসার স্বর্গীয় রূপ উপলব্ধি করেছিলাম । যদিও প্রথমবার ছিল আমার একক মনের অনুভূতি, অন্য পক্ষের কোন সক্রিয় ভূমিকা ছিল না ।
আমি যথার্থ অর্থেই রোম্যানটিক ও আবেগপ্রবণ । এই অশীতিতম বয়স্কালেও তা সমভাবে আমার মধ্যে বিদ্যমান । হেট্রোসেক্সুয়াল ভালবাসার কথা বাদ দিলেও রোমাণ্টিক পরিবেশে আমি পরিপূর্ণতা অনুভব করি । অন্ধকার ঘরে একাকী শুয়ে আমি যখন ডিভিডিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি তখন আমার সারা দেহমনে রোমাঞ্চের পরশ লাগে; আমার সূক্ষ্ম অনুভূতি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে, আমি এক অপার আনন্দ অনুভব করি । সিনেমার পর্দায় দুঃখের দৃশ্য এই বয়সেও আমার চোখে জল নিয়ে আসে ।
আমার জীবনের ভুল ও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব
জীবনে আমি কয়েকটি পর্বতপ্রমাণ ভুল (Himalayan blunder) করেছি । সংখ্যায়ন করে সেগুলোকে নিম্নরূপে বিন্যাস করা যায় ।
(১) শিক্ষাজীবনের শেষ পর্বে "ছাত্রাণাং অধ্য়য়নং তপঃ" এই আপ্তবাক্য বিস্মৃত হয়ে মহানগরীর ভিন্নতর স্থূল আনন্দের মোহে মনোযোগ নিয়োজন । ফল: প্রথাগত শিক্ষার শেষ পরীক্ষায় সম্পাদন আমার তদবধি লব্ধ মান থেকে লক্ষ যোজন দূরে থেমে রইল ।
(২) চাকুরীজীবনের প্রারম্ভে বদলী হওয়া স্থানের প্রাণহীনতা ও নির্জনতা সম্বন্ধে অবহিত হওয়া সত্বেও এবং ঐ বদলী প্রত্যাহার করার সুযোগ পেয়েও আত্মম্ভরিতায় সেই সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে বদলীর নির্দেশ পালন । উল্লেখ্য, সহকর্মীরা সেই স্থান সর্বতোভাবে পরিহার করতে সচেষ্ট হন, নির্দেশ পালনের সময় সেই তথ্যও গোচরে ছিল ।
এর ফল হয়েছে সুদূরপ্রসারী । এই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য আমি অনেক কিছু হারিয়েছি; আমার প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছে ও চারিত্রিক অবনয়ন হয়েছে ।
(৩) "যা জ্বল জ্বল করে তাই সোনা নয়" (All that glitters is not gold) - এই প্রবচন বিস্মৃত হওয়ায় আমাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে । আমি মনে করি আমার এই বিচ্যুতির দরুণ আমার পরবর্তী প্রজন্মও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ।
উপসংহার
উপসংহারে আমি এটাই বলতে চাই, সংসার জীবনে প্রবেশের পূর্বের ব্যতিক্রমি কৃতিত্ব তথা প্রাপ্তি যেমন আমাকে উদ্ধত বা অহংকারী করতে পারেনি, তেমনি পরবর্তীকালের অপ্রাপ্তিও আমাকে হতাশার অন্ধকারে ডোবাতে পারে নি । সর্বদাই আমি মানসিক স্থৈর্য ও সমতা বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেছি এবং সম্ভবতঃ সফলও হয়েছি । এটা হয়ত আমার হৃতমান অবস্থা থেকে জীবন শুরু করার অবদান । আমি জীবনে দেখেছি অনেক কিছু, শিখেছি তারও বেশী । আমি কদাচ নিরাশ হই, সর্বদাই লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা করে যাই । অবশ্যই আত্মমর্যাদা বজায় রেখে । এটাই আমার চরিত্র ।
মূল্যবোধে একাল ও সেকাল
আমাদের উঠতি বয়সে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী ও নৈতিকতা বোধ
আমি এমন একটা সময়ে বড় হয়েছিলাম যখন আমাদের সমাজ মোটামুটি দুর্নীতিমুক্ত ছিল । এটা ঠিক যে দারিদ্র্য আরো ব্যাপক ছিল । কিন্তু মানুষের মধ্যে যেন তেন প্রকারে অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহের লিপ্সা ছিল না । আজকের দিনের লোককে অর্থের মালিকানার মূল্যে বিচার করার রীতির বিপরীতে সমাজ তখন দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের ঘৃণা করত । লোকেরা সাধারণতঃ অসৎ উপায়ে ধনবান হওয়ার চাইতে নিজের সামর্থ্যের মধ্যে জীবন ধারণ করাটাই শ্রেয়তর মনে করত । নৈতিক মান ছিল উন্নত । রক্ষণশীল সমাজের সনাতন মূল্যবোধ বিরাজমান ছিল । সমাজ অপরাধীদের প্রতি সহনশীল ছিল না ।
প্রজন্মের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশ কলুষিত
আমাদের সময় ছাত্ররা মোটামুটি ভাবে নিজেদের পড়াশোনার প্রতি আন্তরিক ছিল, শিক্ষকদের ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল । পরীক্ষায় টুকাটুকি ছিল না বল্লেই হয় । নকল করতে গিয়ে ধরা পড়লে সহপাঠিদের বিদ্রুপের পাত্র হতে হত । পরীক্ষাহলে ধরা পড়ে পরীরক্ষককে (invigilator) হুমকি দেয়ার বা আঘাত করার কথা কেউ ভাবতেও পারত না । বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোটদের ভাল মন্দ সম্পর্কে উপদেশ দিতে পারতেন আর ছোটরা কোনরূপ অসম্মান না দেখিয়ে যথাযথ মর্যাদায় তা শুনত ।
আমি যে স্কুল বা কলেজে পড়েছি সেখানে ছাত্র ইউনিয়ন বলে কিছু ছিল না বা ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশও ঘটে নি । আমাদের শিক্ষকরাই আমাদের প্রয়োজন ও ভাল মন্দ দেখতেন । এগুলো সবই এখন অতীতের বিষয় । স্কুলে অবশ্য এখনও ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে উঠেনি, কিন্তু স্কুলের ছাত্রদের প্রায়শঃ রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা যায় ।
আজকের কলেজ রাজনীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে । কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলের ছাত্রদের মধ্যে মারামারি এমনকি হত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে । ছাত্রদের মধ্যে বন্ধুত্ববোধ আজ আর নেই । শিক্ষার পীঠস্থানে পরিবেশ আজ কলুষিত । শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এখন সামান্যতম ভক্তিশ্রদ্ধাও নেই । তারা অবৈধ দাবী আদায়ের জন্য প্রায়শই শিক্ষকদের কষ্টকর অবস্থায় দীর্ঘসময় আবদ্ধ করে রাখে । কেউ কেউ শিক্ষককে নির্দয় ভাবে প্রহার করতেও দ্বিধাবোধ করে না । আমরা এইসব ঘটনার কথা মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি । উপযুক্ত শিক্ষা আর শৃঙ্খলা ছাড়া আজকের ছাত্র কি করে কালকের সুস্থ নাগরিক হয়ে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করবে আর দেশকে গৌরবের শীর্ষে নিয়ে যাবে? জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উচ্ছৃঙ্খলতা, অপরাধ, বিদ্বেষ ইত্যাদিতে এদের হাতেখড়ি হয়ে যাচ্ছে । আমাদের তথাকথিত রাজনীতিকরা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিচ্ছেন ! আমার মতে স্নাতক স্তরের পূর্ববর্তী পর্যায়ে ছাত্রদের মূলস্রোত রাজনীতিতে জড়ানো উচিত নয় । ছাত্র রাজনীতিতে সৌহার্দ্য, স্বচ্ছতা ও মূল্যবোধ সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন ।
উদারীকরণ পরবর্তী দৃশ্যপট
অর্থনৈতিক উদারনীতি প্রবর্তিত হওয়ায় ও বিশ্বায়নের ফলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে । পশ্চিমী সভ্যতার কুপ্রভাবে আমাদের সনাতন মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে, পশ্চিমী সভ্যতার বৈশিষ্ট্যও আমরা গ্রহণ করতে পারিনি । সবাই এখন দ্রুত অর্থের (quick money) পিছনে ছুটে চলেছে । দুর্নীতি আর এখন অস্পৃশ্য নয়, সমাজ এখন নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও সহনশীল (permissive) । অবাধ মেলামেশা, অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের একত্রবাস, সৎ বা অসৎ যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন এ সবই হচ্ছে আজকের দিনের রীতি । শিক্ষকতা সাধারণ ভাবে এখন গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে পকেট পূরণ করার পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে । পিতামাতা বা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের রীতি এখন অতীত । অনেক ক্ষেত্রে সহায়সম্বলহীন পিতামাতাকে রাস্তায় বের করে দেয়া হচ্ছে । সম্পত্তির লোভে তাঁদেরকে মারধরের এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটছে । স্বাভাবিক ক্ষেত্রে বাড়ীতে থাকলেও তাঁরা অনেক সময় বাড়তি উপদ্রব বলে বিবেচিত হন । পারিবারিক জীবনের ভিত বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে পড়ছে । বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলেছে । ছেলেমেয়েরা নিজেদের মেয়েবন্ধু বা ছেলেবন্ধুকে বিয়ে করে সংসার জীবনে প্রবেশ করার কিছুদিনের মধ্যেই মোহমুক্ত হয়ে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায় । ইহা পশ্চিমী সভ্যতার কুপ্রভাব । সমাজের অবনয়ন হয়েছে, সমাজ ব্যবস্থা রাজনীতিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে । ধর্ষণ, হত্যা, পারিবারিক হিংস্রতা এখন নিত্যদিনের ঘটনা । যখনই কোথাও কোন উঁচু স্তরের অপরাধ সংঘটিত হয় তখনই সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ গজিয়ে ওঠে, যার ফলে পক্ষপাতশূন্য অনুসন্ধান অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । অপরাধীরা এর ফলে অপরাধ সংঘটিত করতে উৎসাহিত হয় ।
আমাদের সময়ের অল্পেতে তুষ্ট থাকার মানসিকতার পরিবর্তে এখন মানুষের মনে অন্তহীন চাহিদা । কন্সয়ূমারিজ্মের (Consumerism) যুগে যাদের এই চাহিদা মেটাবার সামর্থ্য নেই তাদের অনেকে আইন ভেঙ্গে ভিন্নপথে তা আদায় করতে সচেষ্ট হচ্ছে । দুর্নীতি, চুরি, ছিনতাই, হত্যা ইত্যাদি তাই দিন দিন বেড়েই চলেছে ।
মদ্যপান ও অন্যান্য আসক্তি: প্রসার ও কুফল
মদ্যপানের নেশা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে নবীন প্রজন্মকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে । আমাদের সময় শিলং এর মত ঠান্ডা জায়গাতেও কলেজের পাহাড়ী উপজাতিভুক্ত ছাত্র ভিন্ন অন্য ছাত্রদের মধ্যে কদাচিৎ কেউ মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল । আজকের দিনে সমতলের কলেজ পড়ুয়া তরুণ তরুণীদেরও অনেককেই বার রেস্তোঁরায় মদ্যপানরত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় । বিভিন্ন পেশায় নিযুক্তদের মধ্যে এই নেশায় আসক্ত নয় এমন নারীপুরুষের সংখ্যা ক্ষীয়মান ।
পুরনো দিনে গৃহবধুরা সর্বশক্তি দিয়ে মদ্যপ স্বামীদের মদ ছাড়াবার চেষ্টা করতেন । এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে আমার কোন এক কর্মস্থলে আমার এক সহকর্মী ও বন্ধু অন্যান্য বন্ধুদের সাহচর্যে দিন দুয়েক দু-এক পেগ মদ্য পান করেছিল । নববিবাহিতা স্ত্রীর তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে অচিরেই তাকে সেই পথ ত্যাগ করতে হয় । আজকের দিনে বিশেষ করে তথাকথিত শহুরে অভিজাতদের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রই দেখা যায়; স্বামীর তালে তাল মিলিয়ে স্ত্রীরাও মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে যায় (২) । প্রারম্ভে ইহা মজা হিসাবে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে আসক্তিতে পরিণত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক অশান্তি ও হিংস্রতার কারণ হয়ে ওঠে । এমন উদাহরণ বিরল নয় যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারেও মদ্যপ স্বামী কারণে অকারণে স্ত্রীকে প্রহার করতে দ্বিধা বোধ করে না । বাচ্চাদের উপর এর দুষ্ট প্রভাবের কথা না ভেবে স্বামী-স্ত্রী যুগলে নিয়মিত মদ্যপানের আসরে বসেন, আজকের দিনে এমন উদাহরণেরও অভাব নেই । এরূপ নির্বোধ ও অপরিণামদর্শী দম্পতি শিশুর সম্মুখেও মদ্যপানে রত হতে দ্বিধাবোধ করে না । এমনকি শিশুকে নিবৃত্ত করতে “এটা বড়দের পানীয়, ছোটদের খেতে নেই” বলে শিশুর কোমল মনে ভবিষ্যতের জন্য এর বিষাক্ত বীজ বপন করে রাখে । আমার এক বন্ধু তার নিজের দেখা একটি ঘটনার কথা আমাকে বলেছিল যেখানে এক শিশুর পিতা হাতে মদের গ্লাস নিয়ে তার শিশু সন্তানের সঙ্গে খেলা করছিল আর মা নির্বাক দর্শক হয়ে বসেছিল । এরূপ পিতামাতা ভবিষ্যতের সুস্থ নাগরিক গঠনের পথে বড় অন্তরায় । এরা অতিমাত্রায় আত্মসুখী, সকলের পক্ষে ক্ষতিকারক জেনেও ক্ষণিক আনন্দের মোহে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নেশায় মশগুল হয় । এদের কে নিবৃত্ত করবে? এটা তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার তথা বর্তমান সমাজের সহনশীলতার ফসল ।
মদ্যপানের সর্বব্যাপী এই অশুভ বিস্তারে আমাদের মত পুরণো প্রজন্মের লোকেরা (যারা স্বভাবতঃ দূরদর্শী) অসহায় বোধ করছেন । তাদের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে, তারা সর্বদা তাদের পথভ্রষ্ট নিকটজনের ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় টান টান হয়ে থাকেন ।
এই প্রসঙ্গে ২০১৬ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে কোলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের দূরবর্তী এলাকার দুটো ভয়াবহ ঘটনার উল্লেখ করছি । দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই টীনএজার (কিশোর-কিশোরী) জড়িত । প্রথমটিতে কোলকাতার একটি কিশোর তার বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে (যেখানে অবাধ মদ্যপানের ব্যবস্থা ছিল) মদ্যপ অবস্থায় বচসায় জড়িয়ে পড়ে পরিণামে গুরুতর আহত হয় ও আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু বরণ করে । অপর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের এক আধাশহর এলাকার নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী স্কুলে জলের আবরণে মদ এনে ধরা পড়ে ও স্কুল থেকে বহিস্কৃত (rusticated) হয় ।
পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে মদ, গাঁজা, ড্রাগস ইত্যাদি সর্বনাশা নেশার বহুল প্রসার ঘটেছে । এরূপ একটি সর্বভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠকালীন আমার বিশেষ পরিচিত একটি মেধাবী ছাত্রের কি শোচনীয় অবস্থা হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখেছি । মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত যুবকটি এখনও সম্পূর্ণ ভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে নি । কিছুদিন পূর্বে (২০১৬ সালের আশপাশ) কোলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে কৃত সর্বভারতীয় জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (All India Institute of Public Health and hygiene) এক সার্ভে রিপোর্টে দেখা যায় প্রথম থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ৫৭% বিভিন্ন নেশায় গভীর ভাবে আসক্ত ।
এখানে উদাহরণ স্বরূপ উল্লিখিত ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের হঠাৎ পাওয়া লাগামছাড়া উদারতার ফসল । এগুলো আমাদের সমাজ তথা দেশের জন্য গভীর উদ্বেগবাহী এক বার্তা বয়ে আনে ।
আমি মদ (৩) ও মাদকদ্রব্যকে তীব্রভাবে ঘৃণা করি । এমন নয় যে আমি বন্ধুদের সঙ্গে বসে এক আধ বার মদ্যপান করিনি । কিন্তু ইহা স্বাদে, গন্ধে অথবা অন্য কোন আকর্ষণে আমাকে আসক্ত করতে পারেনি । অফিস অনুষ্ঠানে ও অন্যত্র আমি অনেক বার এগিয়ে দেয়া মদ প্রত্যাখ্যান করেছি । একদা আমি যখন কোন এক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে কর্ম্মরত ছিলাম তখন এক দূতাবাস থেকে আমাকে এক বোতল রেডহর্স হুইস্কি উপহার পাঠানো হয়েছিল । বোতলটি বছর দুয়েক আমার আলমারিতে তালাবন্ধ ছিল, তারপর আমার এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলাম এবং ওর সাথে এক ঢোঁক গিলে স্বাদ আস্বাদন করেছিলাম । অনেকে বলেন উত্তেজনার জন্য তারা মদ্যপান করেন । কিন্তু সেই উত্তেজনার মধ্যেই যে ভবিষ্যতের বিনাশের বীজ অঙ্কুরিত হয়, এটা তাদের বোধগম্য হয় না । সবদিক দিয়ে মদ মানুষকে নিঃস্ব করে দেয় ।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যে মদ্যপান ও মদের বিক্রী সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছেন । তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে নিঃসন্দেহে এটা একটা প্রশংসার্হ পদক্ষেপ । কিন্তু যতক্ষণ না এটা দেশব্যাপী লাগু হচ্ছে ততক্ষণ ইপ্সিত লক্ষে পৌঁছুনো সম্ভব হবে না । কিন্তু রাজস্ব ক্ষতির বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য রাজ্যের এতে রাজী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ।
ধূমপান: বর্তমান দৃশ্যপট
এটা উৎসাহব্যঞ্জক যে আমাদের সময়ের এক জনপ্রিয় নেশা আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণ হারিয়েছে যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে একদল তরুণী ইতিমধ্যে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে । সেকালে কোলকাতায় প্রতিটি পানবিড়ির দোকানের পাশে একপ্রান্ত জ্বলতে থাকা দড়ি ঝুলিয়ে রাখা হত । এগুলো বিড়ি সিগারেটে অগ্নিসংযোগের কাজে ব্যবহার করা হত । আজকাল এই ধরণের দড়ি কদাচিৎ দেখা যায় । ধূমপায়ী তরুণদেরও এখন বহুলাংশে কম দেখতে পাওয়া যায় । ইহা ধূমপানের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাসের এক সুস্পস্ট নিদর্শন।
আমার অনেক ধূমপায়ী বন্ধু একাধিকবার ধূমপানের অভ্যাস ছাড়তে না ছাড়তে আবার তা গ্রহণ করেছে । কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর আমি ধূমপানে রপ্ত হয়েছিলাম এবং পরবর্তী বছর দশ বারো তা বহাল রেখেছিলাম । এক ধাক্কায় আমি এই নেশা চিরতরে পরিত্যাগ করি, যখন আমার চার বৎসর বয়সী শিশুকন্যা আমার ধূমপানে আপত্তি করে আমাকে এটি ছাড়তে বলে । এরপর বন্ধুদের অনেক পীড়াপীড়িতেও আমি কোনদিন সিগারেটে টান দিই নি । আজকের প্রজন্মে এই মানসিক দৃঢ়তা সচরাচর দেখা যায় না । আমার বিবেচনায় লোভ ও আসক্তি আমাদেরকে গ্রাস করেছে ।
ধূমপান যা বিগত দিনে নিম্নশ্রেণীর অশিক্ষিতা মহিলাদের মধ্যেই দেখা যেত আজ তা শিক্ষিতা শহুরে নারীদের আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আমি সম্বৃদ্ধ পরিবারের কয়েকজন শিক্ষিতা তরুণীকে প্রকাশ্য দিবালোকে পথিমধ্যে নির্বিকারভাবে ধূমপান করতে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম ।
বিশ্বায়ন ও তার প্রভাব
গ্লোবেলাইজেশন বা বিশ্বায়নও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যথাযথ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে । বাবা মা দুজনেই কর্মরত বা অন্যভাবে ব্যস্ত থাকায় আজকাল অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে গৃহভৃত্য, ডে কেয়ার সেণ্টার বা পরিবারের বয়োজ্যাষ্ঠদের প্রযত্নে ছেড়ে দেয়া হয় । এই শিশুরা দিনের বেশীর ভাগ সময় বাবামায়ের বিশেষ করে মায়ের যত্ন ও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয় । এই অভাব সময় সময় দামী খেলনাপাতি উপহার দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করা হয় । ক্রীড়াকৌতুকে মা বা বাবার সঙ্গ না পেয়ে এই শিশুরা একগুঁয়ে, উদ্ধত ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে । সহজেই অনেক উপহার পাওয়ায় চেষ্টা করে কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা নষ্ট হয়ে যেতে পারে । ইহা ভবিষ্যতে তার পড়াশোনায়ও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে ও জীবনে সাফল্য লাভের অন্তরায় হতে পারে ।
প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হতে থাকা আজকের বালক-বালিকারা সাধারণতঃ জীবনকে সহজ ভাবে নেয় । নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এদের অধিকাংশই উপলব্ধি করতে পারে না । চোখের সামনের বর্ণময় জীবন ওদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয় । ওরা এক মিথ্যা ধারণার বশবর্তী হয়ে ভাবে যে এই বর্ণময় অধ্যায় ওদের জীবনে কখনও শেষ হবে না । বিপরীতে আমার মত যারা দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ হয়েছে তাদের অনেকেরই মনে সব সময় চলমান অবস্থার ছবি জাগরুক থাকত এবং ঐ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় চিন্তায় ইন্ধন যোগাত । ইহা আমাদের কঠোর পরিশ্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছুতে অনুপ্রেরণা দিত।
প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হওয়াটা কোন অপরাধ নয়, কিন্তু পিতামাতাকে সাবধান হতে হবে যেন সন্তান অতিরিক্ত প্রশ্রয় না পায় এবং বাস্তব পৃথিবী ও তার নিহিতার্থ সম্পর্কে সজাগ থাকে । শিশুকে যথাযথ ভাবে চালনা করতে মায়ের প্রয়োজন বিচক্ষণতা ও ধৈর্য । মনে রাখতে হবে শিশু একটি সংবেদনশীল যন্ত্রের মত যা কেবল সযত্ন পরিচালনায়ই উৎকৃষ্টতার পরিচয় দেবে ।
দারিদ্র্য মানুষের জীবনে অভিশাপ বিশেষ । আমার মতে তা মানবিক বিকাশকে দু ভাবে প্রভাবিত করে । কোমলতর দিক বিচারে এটি মানুষকে দুর্বল করতে পারে ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে অন্তরায় হতে পারে (শিষ্ট লোক) । কঠিন দিক বিবেচনায় এটি বৈধ ভাবে অপ্রাপ্তব্য বস্তু সামগ্রী জোর করে কেড়ে নেয়ার অপরাধমূলক মানসিকতাসম্পন্ন একজন নির্দয় মানুষ তৈরী করতে পারে (দুষ্ট লোক) ।
বৈদ্যুতিন যন্ত্র ও তার প্রভাব: পরিশিষ্ট
মোবাইল ফোনের রূপ ধরে শিশুদের ক্ষতিকারক এক মহা বিপদ হাজির হয়েছে । দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম্মের জন্য নিজেদের মুক্ত রাখতে অনেক পিতামাতা তাদের অল্পবয়স্ক সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেন । ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা উল্লসিত হয়ে বৈদ্যুতিন ক্রীড়া, বন্ধুবান্ধবের সাথে গল্প, চ্যাট বা নিজেদের পছন্দের ইণ্টারনেট প্রোগ্রামে নিবিষ্ট হয়ে যায় এবং তার দ্বারা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিকিরণের শিকার হয় । "মামজংশন ডট কম" নামের একটি বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে শিশুদের উপর মোবাইল ফোনের অন্যান্য কুফলের মধ্যে (আচরণগত ও মেজাজ পরিবর্তন সহ) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরূপ বলেছেন, "মানুষের পক্ষে সেল ফোনের বিকিরণ সম্ভবতঃ ক্যান্সারজনক । ৬০ শতাংশের বেশী বিকিরণ শিশুরা শোষণ করে । ওদের মস্তিষ্কের পাতলা চামড়া, টিস্যু, হাড় ওদেরকে বয়স্কদের দ্বিগুন বিকিরণ শোষণ করতে সাহায্য করে । ওদের উন্নয়শীল স্নায়ুতন্ত্র ওদেরকে এই কারসিনোজেনিকের পক্ষে আরো ভেদ্য করে দেয় ।" মাতাপিতা ও শিশুর ভালমন্দ দেখার দায়িত্বে থাকা সকলের এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকা উচিত এবং শিশু যাতে এর শিকার না হয় সে বিষয়ে রক্ষণাত্মক ব্যবস্থা নিতে তৎপর হওয়া উচিত । দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি নিজের পরিবারের লোকদেরই এ বিষয়ে প্রত্যয় উৎপাদন করতে পারিনি ।
আবার বৈদ্যুতিন যন্ত্রের সহজ অধিগম্যতা হেতু শিশুদের মধ্যে গল্পের বই, যা ওদের কল্পনাশক্তি বিকাশের ও মূল্যবোধ বৃদ্ধির সহায়ক হত, পড়ার প্রবণতা ক্ষীয়মান হয়ে পড়েছে । যখন সব কিছুই চোখের সামনে ঘটে তখন কিছুই আর কল্পনা করার থাকে না । অধিকন্তু আমরা সহজেই অডিও-ভিস্যুয়েল উপস্থাপনায় আকৃষ্ট হই । ইণ্টারনেটের সহজ অধিগম্যতা শিশুদের গঠনমূলক পর্যায়ে আরেক বিপদ ডেকে আনছে; তারা হিংসাশ্রয়ী ও নীতিবিগর্হিত বিষয়বস্তুতে উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে ।
মদ্যপানের বাস্তবতা: আরেকটি পরিশিষ্ট
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শৃঙ্খল ভঙ্গ করতে লকডাউন লাগু হওয়ার পর (২০২০-২১ সাল) প্রথম দেড়মাস অতিমারি নিয়ন্ত্রণ আইন ১৮৯৭ মোতাবেক অন্যান্যদের মধ্যে মদের দোকান সহ সমস্ত দোকান ও সংস্থা বন্ধ ছিল । পরে যখন মদের দোকান সহ কিছু কিছু দোকান খোলার অনুমতি হল তখন ভারতবর্ষের শহর ও অন্যত্র মদের দোকানের সামনে ক্রেতাদের কিলোমিটারব্যাপী লম্বা লাইন দেখা যেতে লাগল । মদের দোকান খোলার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ক্রেতারা লাইন দিতে শুরু করল ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল তাদের তৃষ্ণা নিবারণের বহু আকাঙ্খিত এক বোতল মদের জন্য । একে অপরকে ডিঙিয়ে বোতল অগ্রে অধিকার করার প্রচেষ্টায় স্থানে স্থানে ধাক্কাধাক্কি ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে গেল । শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অনেক জায়গায় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হল । এটা ঘটল কর ও শুল্ক বাবদ ৭০% মূল্যবৃদ্ধির পরও । দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক বোতল মদের ওপর ওদের জীবন-মরণ নির্ভর করছে, ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে ওদের কোন হেলদোলই ছিল না । ভারতীয় সমাজ পাশ্চাত্য অনুকরণ করতে গিয়ে বেলাগাম হয়ে নিজেকে আজ কোথায় নামিয়ে এনেছে এটা তারই পরিচায়ক ।
করোনা ভাইরাসের জন্য লকডাউনের সময় মদের দোকান খোলার পরবর্তী পরিস্থিতি বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে নেয়া ছবির সাহায্যে নিম্নে উপস্থাপিত করা হল ।
লকডাউনে অনেকদিন বন্ধ থাকার পর মদের দোকান খুললে দোকানের সামনে ক্রেতাদের লাইন ।
লকডাউনে অনেকদিন বন্ধ থাকার পর মদের দোকান খুললে আরেকটি দোকানের সামনে ক্রেতাদের লাইন ।
সুরাভাণ্ড নিয়ে পলায়নরত । পশ্চাতে বঞ্চিত সুরাপেয়িদের অনুসরণ । লকডাউনে বন্ধ মদের দোকান খোলার পরের দৃশ্য ।
সুরাপেয়ীদের ভিড়ে ট্রাফিক জ্যাম ।
সুরা উৎসাহীর আসদাচরণে পুলিশি শাসন । লকডাউনে বন্ধ মদের দোকান খোলার পরের দৃশ্য ।
লকডাউনে অনেকদিন বন্ধ থাকার পর মদের দোকান খুললে আরেকটি দোকানের সামনে ক্রেতাদের সুশৃঙ্খল লাইন ।
<<< হোম পেজে যেতে বাঁ দিকের বোতামে টেপ বা ক্লিক করুন ।
(২) এটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা ।
(৩) কর্ম্মজীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত এর কলুষিত প্রভাব থেকে গৃহাঙ্গনকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলাম ।