সূচীপত্রের যে কোন বিষয়ের উপর ক্লিক করে সেই বিষয় সংক্রান্ত অংশে যাওয়া যাবে ।
সূচীপত্র
অফিসের দায়িত্বগ্রহণ, পশ্চাদপট ও কাজের পরিবেশ
১৯৯৫ সালের ১৬ই অক্টোবর আমি হাওড়ায় অতিরিক্ত জেলাশাসক, সমাহর্তা ও জেলা ভূমি ও ভূমিসংস্কার আধিকারিক (ডিএলএলআরও) পদে [আইএএস ক্যাডারভুক্ত পদ] দায়িত্বভার গ্রহণ করি । আমার মূল দায়িত্ব ছিল জেলার ভূমি ও ভূমিসংস্কার প্রশাসন । এ বিষয়ে আমি স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম যদিও অতিরিক্ত জেলাশাসক হিসাবে আমি জেলাশাসকের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ছিলাম । ভূমি সংস্কার সেট-আপে আমি ছিলাম নতুন । ভূবাসন ও জরিপ(১) বিষয়ে আমার প্রশিক্ষণও ছিল না । ১৯৮০ সালে আমি জেলা প্রশাসন ছেড়ে যাওয়ার পর ভূবাসন ও ভূমিসংস্কার শাখা দুটি একত্রীভুক্ত হয়েছিল । ফলতঃ ভূমি ও ভূমিসংস্কার বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না । কিন্তু "জ্যাক অফ অল ট্রেডস" হিসাবেই সার্ভিসে আমাদের জন্ম । সেই সুনাম বজায় রেখেই দুবছরের অধিক সময় সফলতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি । সাথে সাথে বিষয়টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের দ্বারা শিখেছিও অনেক কিছু ।
ভূমি ও ভূমিসংস্কার (জমি অধিগ্রহণ ব্যতীত) সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় ভূমি সংস্কার অফিসে সম্পন্ন হত । বিভিন্ন স্তরের ভূমিসংস্কার আধিকারিকরা এই সকল বিষয়ে নিয়মিত জনগণের সংস্পর্শে আসতেন । দুর্নীতির প্রশস্ত সুযোগ ছিল । এই অফিসারদের অনেকের চাকুরীতে সুনাম ছিল না । এদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বভাবতঃই আমাকে সদাসতর্ক থাকতে হত । এতৎ সত্বেও এমন একটি ঘটনা আমার দৃষ্টির বাইরে ঘটে যায় যা দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয় ।
আমার অজ্ঞাতে একটি দুর্নীতির ঘটনা
আমার সতর্ক দৃষ্টি সত্বেও কয়েকজন অফিসারের একটি চক্র যার মধ্যে জেলা ভূমিসংস্কার অফিসের একজন অফিসারও যুক্ত ছিলেন এমনভাবে একটি বিষয় নিষ্পন্ন করেন যা বিভাগীয় নির্দেশের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। ঘটনাটিতে দুর্নীতির উপাদান ছিল। বিষয়টি আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে ও আংশিক ভাবে আমার আইএএস প্রশিক্ষণকালের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে করা হয়েছিল এবং অনিবর্তনীয় ভাবে (Fait accompli ) নিষ্পন্ন হয়ে যওয়ার পর আমার নজরে আনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে রাজ্য সচিবালয়ের দু একজন অফিসার সহ কয়েকজন অফিসার ঘটনার পূর্ণ গুরুত্ব বুঝে বা না বুঝে ঐ অফিসার চক্রকে বাঁচাতে সক্রিয় হল । তারা জেলা আধিকারিকের উপর দায়বদ্ধতা চাপাবার চেষ্টা করল । কিন্তু সেই প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হল । জেলা আধিকারিক হিসাবে সমগ্র পটভূমি অবারিত করে বিষয়টির সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত নয় এমন কোন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবী করলাম । ১৯৯৭-৯৮ সালের এই ঘটনার আজ (২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের সাপেক্ষ) পর্যন্ত তদন্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই ।
বিষয়টি ছিল একটি খাস হয়ে যাওয়া জমির সরকারী সিদ্ধান্ত হাইকোর্টের আদেশে বাতিল হলে কোর্টের আদেশ মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার মাস কয়েক পর সেই আদেশের বিরুদ্ধে যথাসময়ে আপীল করার গাফিলতি নিয়ে ।
প্রশাসনিক গঠন
জেলা ভূমিসংস্কার অফিসে দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার জন্য ডব্লুবিসিএস (এক্সিকিউটিভ) ক্যাডারের একজন ডেপুটি ডিএলএলআরও ও কয়েকজন রেভিনিউ অফিসার ছিলেন । জেলা অফিসের এই রেভিনিউ অফিসারদের মধ্যে দুএকজন খুবই কর্মদক্ষ ও সৎ ছিলেন । প্রশাসনিক মহকুমার সমব্যাপ্ত দুটি ভূমিসংস্কার মহকুমা ছিল যার প্রত্যেকটির দায়িত্বে ছিলেন একজন করে মুহকুমা ভূমিসংস্কার আধিকারিক (এসডিএলএলআরও) । প্রত্যেক এসডিএলআরও অধীনে কয়েকজন করে ব্লক ভূমিসংস্কার আধিকারিক (বিএলএলআরও) ছিলেন যারা সংশ্লিষ্ট ব্লক ভূমিসংস্কার অফিসের দায়িত্বে থাকতেন । ভূমি উন্নয়ন ব্লকগুলিও উন্নয়ন ব্লকের সমসীম ছিল । প্রত্যেক বিএলএলআরওর অধীনে কয়েকজন রেভিনিউ অফিসার (আর ও) ছিলেন ।
পরিদর্শন, নজরদারি ও সমন্বয়সাধন
ভূমিসংস্কার প্রশাসনকে সুসংহত করতে আমি আগাম খবর না দিয়ে রেভিনিউ অফিসার স্তর পর্যন্ত ভূমি সংস্কার অফিস পরিদর্শন করতে শুরু করলাম । প্রথমদিকে আমার এই ধরণের আকস্মিক পরিদর্শনকালে আমি তৃণমূল স্তরের আরও (RO) (২) এবং কিছু কিছু বিএলআরওকেও অফিসের কাজের সময়ে উপযুক্ত কারণ ছাড়া অফিসে অনুপস্থিত পেলাম । সেই সব ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হল । এই রকম কয়েকটি আকস্মিক পরিদর্শনের পর খবর ছড়িয়ে পড়ল ও অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটল । প্রতিবেদন পেলাম ও নিজেও পরবর্তী আকস্মিক পরিদর্শনকালে দেখলাম পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে । দীর্ঘস্থায়ী না হলেও আপাতদৃষ্টিতে এই পরিদর্শন ফলপ্রসু হয়েছে । নির্দিষ্ট সূচী অনুযায়ী এবার আমি অফিসগুলোর আনুষ্ঠানিক পরিদর্শন আরম্ভ করলাম । এই অবেক্ষণ জমির রেকর্ড যথাযথ আধুনিকীকরণ, পদ্ধতিগত ত্রুটি বিমোচন ও কেস নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করণের সহায়ক হয়েছিল । এটা আমাকে ভূমি ও ভূমিসংস্কার অফিসের স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্ম ও তৃণমূলস্তরের কার্যকলাপ বুঝতেও সাহায্য করেছিল ।
প্রতি মাসে আমি জেলা অফিসে এসডিএলএলআরও এবং বিএলএলআরওদের সঙ্গে মিটিং করতে আরম্ভ করলাম । এই মিটিংএ এসডিএলএলআরও (৩) এবং বিএলএলআরওদের কাজের দফাওয়ারি লক্ষ্য স্থির করে দেয়া হত । পরবর্তী মিটিংএ এই লক্ষ্যের পশ্চাৎপটে সম্পাদন বিশ্লেষণ করা হত । যে সকল ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছুবার ব্যর্থতা দেখা যেত সেখানে সংশ্লিষ্ট আধিকারিককে ব্যর্থতার কারণ দর্শাতে বলা হত । কারণ বিশ্লেষণ করে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত । মহকুমা ও ব্লক অফিস থেকে পাঠানো জেলা অফিসে অপেক্ষমান বিষয়গুলির নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার বিষয়েও ঐ মিটিং এ আলোচনা হত । জেলা অফিসে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের বিবেচনাধীন বিষয়গুলোর নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণ মিটিংএ জানাতে হত । অসম্পন্ন বিষয়ে কোন ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা থাকলে তা দূর করতে যিনি পাঠিয়েছেন তাকে জেলা অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক যথাযথ পরামর্শ দিতেন । ভূমিসংস্কার বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচীর অগ্রগতির তদারকি করা ছাড়াও এই মিটিংগুলো মতামত ও তথ্য আদানপ্রদানের পথ প্রশস্ত করেছিল ।
ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয় সাধনের জন্য আমি মহকুমা শাসক ও ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম । খতিয়ান প্রস্তুতের প্রয়োজনে স্থাপিত জমি জরীপের ক্যাম্প অফিসও আমি মাঝে মাঝে পরিদর্শন করতাম । অধস্তন অফিসগুলির এবং তাদের তৃণমূল স্তরের ক্রিয়াকর্ম সম্বন্ধে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখতে ও অফিসারদের সতর্ক রাখতে আমি ব্যাপকভাবে কার্যকরী এলাকা সফর করতাম । যে কোন সমস্যা প্রয়োজনবোধে আমার নজরে আনতে আমি সর্বদা অফিসারদের উৎসাহিত করতাম ।
এইভাবে আমার নিয়ন্ত্রণাধীন (ভূমি ও ভূমিসংস্কারের) বিভিন্ন স্তরের অফিসের ক্রিয়াকলাপের উপর নজর রেখে ও প্রয়োজনবোধে হস্তক্ষেপ করে আমি কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম বলে মনে করি । আমার নেয়া পদক্ষেপগুলি আমাকে হাওড়ার ভূমিসংস্কার সেটআপকে মোটামোটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করেছিল । আমি বলছি না যে আমি সব অসম্পূর্ণতা দূর করে হাওড়ার ভূমিসংস্কারের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ নিখুঁত করে দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি যুক্তিসঙ্গতভাবে দাবী করতেই পারি যে আমি দৃশ্যমান উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলাম ।
রাজনৈতিক চাপ প্রতিরোধ
জমি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের মত জমির চরিত্র পরিবর্তনের ক্ষমতাও জেলা ভূমি ও ভূমিসংস্কার আধিকারিকের উপর ন্যস্ত ছিল । এইরূপ পরিবর্তন অনুমোদন করার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ আসত । এই সব চাপ আমি আমার নিজের মত করে প্রতিরোধ করতাম এবং নিয়ম অনুযায়ী ও বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতাম । এই প্রসঙ্গে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ল যেখানে আমাকে একজন মন্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করতে হয়েছিল । একবার একজন মন্ত্রী (বর্তমানে প্রয়াত) যার দপ্তরের একটি সংস্থায় আমি একদা কর্মরত ছিলাম একটি জমির চরিত্র পরিবর্তনের অনুমোদনের জন্য আমায় ফোন করেন । যতদূর মনে পড়ে আবেদনটি আমি আগেই নাকচ করে দিয়েছিলাম । আমি মন্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম কি কারণে এক্ষেত্রে অনুমোদন দেয়া সম্ভব নয় । কিন্তু মন্ত্রী যখন কিছুতেই বুঝতে রাজী হলেন না বরং আমার প্রত্যয় উৎপাদন করার চেষ্টা করতে লাগলেন তখন আমি ওকে অনুরোধ করলাম আবেদনকারীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে । আবেদনকারী আমার কাছে এলে ওকে বল্লাম তথ্য ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় ওর এই আবেদন মঞ্জুর করা সম্ভব নয় । উনি যেখানেই বা যে কারো কাছেই যান না কেন এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা নেই । আমি হওড়ায় থাকাকালীন বিষয়টি পুনর্বার আর আমার কাছে আসে নি ।
অপরাপর কাজ
অতিরিক্ত জেলাশাসক ও সমাহর্তা হিসাবে আমাকে জমি সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া আরো কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে হত । তাছাড়া ডিএলএলআরও হিসাবে জমি সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে আমি ছিলাম আপীল প্রাধিকারী । এই সকল বিষয়ে শুনানির ও নিষ্পত্তির জন্য আমাকে আলাদা সময় রাখতে হত ।
জেলাশাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক
কাজের ক্ষেত্রে জেলাশাসকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল পারষ্পরিক সমঝোতার । হাওড়ায় থাকাকালীন আমি সক্রিয়ভাবে বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচন পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করেছিলাম ও কিছু কিছু বিষয়ে জেলাশাসকদের সাহায্য করেছিলাম । আমার হাওড়ার কর্ম্মকালে জেলাশাসক ছিলেন প্রথমে রবি কান্ত ও পরে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব) । উভয়েই আমাকে জানতেন ও আমার কর্ম্মধারার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন । ওদের দিক থেকে আমার কখনো কোন অসুবিধা হয়নি । ওরা কখনও আমার কাজে হস্তক্ষেপ করেন নি। বলতে গেলে ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই ছিল ।
আইএএসে অধিষ্ঠিতকরণ প্রশিক্ষণ
নিকটস্থ আকর্ষক স্থান দর্শন
১৯৯৭ সালে হওড়ায় অবস্থানকালে আমি মুসৌরিতে অবস্থিত লাল বাহাদূর শাস্ত্রী রাষ্ট্রীয় প্রশিক্ষণ একাডেমিতে (সংক্ষেপে LBSNAA) আইএএস অফিসারদের প্রতিষ্ঠাকরণ প্রশিক্ষণে (Induction Training Course for IAS Officers) অংশ নিতে যাই । কোর্সটি ১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ই অক্টোবর পর্যন্ত চলেছিল । আমি ১৪ই সেপ্টেম্বর সকালে মুসৌরি পৌঁছুই । সেখানে থাকার জন্য একাডেমির হোস্টেল ইন্দিরা ভবনে আমার আরেক সহকর্মী সুশান্ত সেনের সঙ্গে আমাকে দু শয্যার একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হয় ।
পরদিন অর্থাৎ ১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয় ও প্রথম পর্যায়ে ২৫শে সেপ্টম্বর পর্যন্ত চলে । একাডেমির শিক্ষকমণ্ডলী ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রের স্বনামখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বরিষ্ঠ আমলারাও অতিথি বক্তা হিসাবে বক্তৃতা দিতে আসতেন । আসামের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহান্ত একাডেমি পরিদর্শনে এসেছিলেন ও কিছুক্ষণ প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কাটিয়েছিলেন ।
প্রশিক্ষণ আরম্ভ হওয়ার পর প্রথম শনিবার একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য নিকটবর্তী কেম্প্টি জলপ্রপাত ও পরবর্তী রবিবার হরিদ্বার ও ঋষিকেশ দর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন ।
কেম্প্টি জলপ্রপাতটি মুসৌরি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে । পাহাড়ের বুক চিরে দুগ্ধ ফেননিভ জলরাশি তীব্র গতিতে নেমে আসছে, সে এক অপূর্ব দৃশ্য । এই জলরাশির গন্তব্য দেখতে আমরা সর্পিল পথে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নীচে নামলাম । মনে হয় কম করে ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট নীচে নেমেছিলাম । বয়স তখন অনেকটাই কম ছিল, পঞ্চশের আশে পাশে । আর পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠা নামার আকর্ষণ আমার বরাবরের । এর অনেক পরও যখন বয়স সত্তরের উর্দ্ধে তখনও সম উচ্চতার পাহাড়ে ওঠানামা করেছি । যাক, নীচে নেমে দেখলাম প্রপাতের জল যেখানে পড়ছে সেখান থেকে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে আর যাত্রাপথে ছোট ছোট জলাশয় তৈরী করেছে ।
হরিদ্বারে আমরা রোপওয়ে ক্যাবে পাহাড়ের চূঢ়ায় অবস্থিত মনসা মন্দিরে গিয়েছিলাম । সেখানে মন্দিরে পূজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে ফেরার সময় আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি বাঁদর আমার হাতে ঝুলতে থাকা প্রসাদের ঠোঙা নিয়ে পালিয়েছিল । হরিদ্বারে আমরা একাডেমির ব্যাবস্থাপনায় ট্যুরিস্ট লজে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলাম । মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা ঋষিকেশ ভ্রমণে যাই । সেখানে রামঝোলা, লক্ষ্মণঝোলা দেখে একাডেমিতে ফিরে যাই । ফিরতে আমাদের রাত হয়ে গিয়েছিল ।
মুশৌরিতে প্রশিক্ষণে থাকার সময় আমি রোপওয়ে ক্যাবে মুসৌরি পাহাড়ের চূঢ়ায় উঠেছিলাম । চূঢ়া থেকে মুসৌরি শহর ও চতুর্দিকের পাহাড়ের এক অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় ।
ডানপার্শ্বের ও নিম্নের প্যানালে একাডেমির প্রশাসনিক ভবন, হোস্টেল কক্ষ যেখানে আমি অবস্থান করেছিলাম এবং নিকটস্থ পর্যটক আকর্ষক স্থান কেম্পটি জলপ্রপাত, হরিদ্বার ও হৃষিকেশের কয়েকটি শিরোনামযুক্ত চিত্র সন্নিবিষ্ট করেছি ।
লাল বাহাদূর শাস্ত্রী রাষ্ট্রীয় প্রশাসন একাডেমি, মুসৌরি ।
একাদেমির ইন্দিরা ভবনের এই কক্ষে প্রশিক্ষণকালে আমি ছিলাম ।
মনসা মন্দিরের পথে রোপওয়ে ক্যাব থেকে হরিদ্বারের দৃশ্য ।
লাল বাহাদূর শাস্ত্রী রাষ্ট্রীয় একাডেমির অন্তর্গত ইন্দিরা ভবনের একটি চিত্র ।
হৃষিকেশে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গার একটি দৃশ্য ।
হৃষিকেশে রামঝোলার একটি দৃশ্য ।
মুসৌরির নিকটস্থ কেম্প্টি জলপ্রপাত ।
মুসৌরী পিক থেকে মুসৌরী শহরের একটি দৃশ্য ।
দেরাদুন-মুসৌরী রাজপথের একটি দৃশ্য ।
দূন উপত্যকাকে নীচের দিকে দেখা যাচ্ছে ।
ভারত দর্শন কার্যক্রম: পর্যায় - ১
২৬শে সেপ্টেম্বর থেকে ভারত দর্শন কার্যক্রমের জন্য আমাদের ক্লাসরুম ট্রেনিং এর বিরতি ছিল; ভারত দর্শন কার্যক্রম আমাদের প্রশিক্ষণের একটি মুখ্য অঙ্গ ছিল । এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের দেশের ইতিহাস, অধিবাসী, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন রাজ্যের উন্নয়নের ধারার সঙ্গে পরিচিতি ঘটানই সম্ভবতঃ উদ্দেশ্য ছিল । ভ্রমণের সুবিধার্থে প্রশিক্ষণার্থীদের কয়েকটি দলে ভাগ করে দলের ইচ্ছা অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত কয়েকটি অঞ্চলের মধ্য থেকে উপলভ্য অঞ্চল বরাদ্দ করা হত । দল ও অঞ্চল স্থির হয়ে গেলে ভ্রমণের সমস্ত ব্যবস্থা একাডেমির পক্ষ থেকে করা হত । যাতায়াত, বাসস্থান, আহার ইত্যাদি কোন বিষয়েই প্রশিক্ষণার্থীদের নিজেদের ভাবতে হত না বা সরাসরি কোন অর্থও ব্যয় করতে হত না । আমরা দক্ষিণ ভারত নির্বাচন করেছিলাম । আমাদের দলে আমরা পশ্চিমবঙ্গের তিনজন ছাড়াও রাজস্থানের দুজন, গুজরাটের দুই বা তিনজন, এবং আরো দুএকটি রাজ্যের প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন যাদের সকলের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না ।
ভারত দর্শন কর্মসূচীর প্রথম পর্যায়ে আমরা ২৬শে সেপ্টেম্বর সকালে একাডেমির বাসে মুসৌরী থেকে রওয়ানা হয়ে সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে দিল্লী পৌঁছুই । পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কেবিনেট সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ও ওঁর সঙ্গে পরিচিত হই । আমাদের চা-বিস্কুট সহযোগে আপ্যায়ন করা হয় । পরদিন প্রাতে ভারত দর্শনে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে সেদিন আমরা দিল্লীতে নিজ নিজ রাজ্যভবনে, (পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বঙ্গভবন), রাত্রি যাপন করি ।
পরদিন সকাল ৯টায় আমি ও আমাদের দলের অন্যান্যরা বিমানে বাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । সকাল ১১টায় আমরা বাঙ্গালোর পৌঁছুলাম । বাঙ্গালোরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল কুমারক্রুপা নামক সরকারী অতিথি নিবাসে । সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা তিরুপতি তিরুমালাইর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । তিরুমালাই পৌঁছুতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা ওখানেই রাত্রি যাপন করলাম । পরদিন ভোরে দেবদর্শন করলাম । আইএএস প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে আমাদের একান্ত দর্শনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল । পরে আমরা অপরাহ্ণে বাঙ্গালোর ফিরে আসি । ফেরার পথে পথিপার্শ্বস্থ একটি ধাবাজাতীয় রেষ্টুরেণ্টে সুস্বাদু খাদ্য সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সেরেছিলাম ।
তিরুমালাই সফর আমাদের একাডেমির আয়োজিত সফরসূচীর বাইরে ছিল । আমাদের একজন সহপ্রশিক্ষণার্থীর (তামিলনাড়ুর) তিরুমলাই তিরুপাতি মন্দির প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল । তিনিই আমাদের তিরুমালাই থাকার ও মন্দির দর্শনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । আমাদের তিরুমালাই থেকে সেদিনই ফেরৎ আসার কথা ছিল । কিন্তু ওখানে পৌঁছে এবং ওখানকার অবস্থা দেখে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত হয় । সেদিনই ফিরে আসার কথা থাকায় রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত নিয়ে যাই নি । সঙ্গে তোয়ালে জাতীয় কিছুও ছিল না । ফলে তিরুমালাইতে রাত্রি যাপন ও স্নানের ক্ষেত্রে আমাকে বিশেষ অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছিল । তিরুমালাইতে সেই সময় অসংখ্য ভক্তের সমাবেশ হয়েছিল । এদের অধিকাংশ খোলা আকাশের নীচে মন্দিরের আশে পাশে মুক্ত অঙ্গনে শুয়ে বসে ছিল ।
২৮ শে ও ২৯শে সেপ্টেম্বর আমরা বাঙ্গালোরে রইলাম । ২৮ তারিখ আমরা বাঙ্গালোরে বিভাগীয় মহিলা কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কর্ণাটকের প্রশাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত হলাম । পরে আমরা বিধানসভা ভবনে রাজ্য সচিবালয়ও পরিদর্শন করলাম ও কয়েকজন ডেস্ক অফিসারের কাছ থেকে ওদের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে জানলাম । সন্ধ্যাবেলা শহরে কানাড়া সঙ্গীতের একটি মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান দেখেছিলাম।
২৯শে সেপ্টেম্বর আমরা বাঙ্গালোর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে তামিলনাড়ুর হসুর নামক শিল্পশহরে টাইটানের ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে যাই । সেখানে আমাদেরকে ফ্যাক্টরির বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখানো হয় । আমরা ঘড়ির কম্পোনেণ্ট, সোনার অলঙ্কার এবং অন্যান্য পণ্য তৈরী ও একত্রীকরণ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করি । উৎপন্ন পদার্থের অংশ-সংযোজন বিভাগে এক নির্মল বাতাবরণে কেবল নারী শ্রমিকরাই কাজ করছিল । বিভাগটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল ও নিস্তব্ধ নীরবতায় কাজ হচ্ছিল । ফ্যক্টরী প্রাঙ্গন ও কর্মস্থল লক্ষণীয় ভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছিল । পরিদর্শন শেষে কোম্পানীর তরফে আমাদেরকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করা হল । সন্ধ্যাবেলা আমরা কোম্পানীর বাঙ্গালোর শহরের শোরুম পরিদর্শন করি ।
বাঙ্গালোরের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া খুবই আরামপ্রদ ছিল ।
৩০ তারিখে আমরা মহীশূর চলে যাই এবং শহরের আশে পাশের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ ও শ্রীরঙ্গপত্তনম দর্শন করি ।
পরদিন (১লা অক্টোবর) সকালবেলা আমরা উটকামণ্ডের পথে বন্দীপুর সংরক্ষিত বনভূমি দর্শনে রওয়ানা হলাম । বেলা ১১৩০ টায় আমরা বন্দীপুর পৌঁছুলাম ও বনদপ্তরের বরাদ্দিকৃত কুটিরের দখল নিলাম । সেখানে আমার বরাদ্দ কুটিরের জানালা (৪) খুলতে গেলে এক ঝাঁক বোলতা আমায় ঘিরে ধরে হুল ফুটিয়ে দেয় । জানালাটা দীর্ঘদিন খোলা হয়নি । আমি খুলতে গেলে ওদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বিঘ্ন ঘটে, ওরা হতচকিত হয়ে আমার হাতে হুল ফুটিয়ে দেয় । এটা ঘটেছিল পৌঁছুনর পর আমরা যখন কুটিরে স্থিত হচ্ছিলাম । পরে আমাদেরকে অন্য একটি কুঠিরে স্থানান্তরিত করা হয় । বন্দীপুর অরণ্যের প্রবেশ মুখে অতিথিদের জন্য বিস্তৃত এলাকা জুড়ে অনেকগুলো কুঠির ছিল । প্রতিটি কুঠিরে দুটি করে শয্যা ছিল । আমাকে ও আমার সহপ্রশিক্ষণার্থী ও সহকর্মী সুশান্ত সেনকে একটি কুঠির বরাদ্দ করা হয়েছিল ।
সেদিন অপরাহ্ণে মধ্যাহ্নভোজ ও বিশ্রামের পর আমরা বন্যপ্রাণী দর্শনার্থে বন্দীপুর বনভূমির গভীরে সাফারীতে যাই । এই বাস-সাফারী কর্ণাটক সরকারের বনদপ্তর আয়োজন করেছিলেন । বন্দীপুরের গভীরে আমরা হরিণ, বন্য কুকুর, বন্য মোষ ও কিছু পথভ্রষ্ট ছোট ছোট প্রাণী দেখেছিলাম কিন্তু বাঘ, হাতি বা বাইসন জাতীয় কোন বড় প্রাণী দেখতে পাইনি । সে রাতে আমরা বন্দীপুরে আমাদের নির্দিষ্ট কুঠিরে রাত্রি যাপন করেছিলাম । রাত গড়াতে কুটির সংলগ্ন বিস্তৃত এলাকায় হরিণের পাল রাত কাটাতে আসে । অন্ধকারে জোড়ায় জোড়ায় চোখ ইতস্তত জ্বলজ্বল করতে দেখা যায় ।
বন্দীপুর সেই সময় কুখ্যাত চন্দনদস্যু বীরাপ্পানের আস্তানা ছিল । আমাদের অবস্থানের কয়েকদিন পরই বীরাপ্পান এখান থেকে কর্ণাটক সরকারের কয়েকজন অফিসারকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল । আমি ঘটনাটি সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছিলাম ।
সে যা হোক, পরদিন, ২রা অক্টোবর, সকালে আমরা উটির (উটকামণ্ড) উদ্দেশ্যে যাত্রা করি । পথে তামিলনাড়ুর অন্তর্গত মধুমালাই বনভূমি নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সাফারী ট্যুরে দর্শন করি । বন্দীপুর ও মধুমালাই সংযুক্ত সংরক্ষিত বনাঞ্চল । বন্দীপুর কর্ণাটকে, মধুমালাই তামিলনাড়ুতে । মধুমালাইতে আমরা ময়ূর ও অন্যান্য ছোট প্রাণী ছাড়া হরিণের দল এবং একদল বন্য হাতি দেখতে পেয়েছিলাম । দূর থেকে একটি বাইসনের আকারও দেখা যাচ্ছিল । মধুমালাইর প্রাকৃতিক দৃশ্য বন্দীপুরের চেয়ে মনোহর । বনভূমির অভ্যন্তরে আমরা একটি ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে চারদিকের অপরূপ দৃশ্যাবলী উপভোগ করলাম । সামনে পাহাড় থেকে ছোট ছোট জলের ধারা স্থানে স্থানে নেমে আসার পথে এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল ।
মধুমালাই দর্শন শেষে আমরা উটির পথে যাত্রা পুনরারম্ভ করলাম । মধ্যাহ্নে উটি পৌঁছে আমরা সরকারী অতিথি নিবাসে উঠলাম । সেদিন বিকালে ও পরদিন বেলা ১টা ৩০মি পর্যন্ত আমরা উটি ও আশেপাশের পর্যটনস্থানগুলো পরিদর্শন করলাম । উটির অতিথি নিবাসের দুটি অংশ ছিল । এক অংশে ছিল নতুন আধুনিক অট্টালিকা । অপর অংশ, আমরা যেখানে ছিলাম, সেটি ছিল একটি বিশাল পুরনো ভবন, পুরাকালের রাজা মহারাজাদের বাড়ীর মত । পুরনো অংশের ঘরগুলো ছিল বিশালাকার, ছাদ অস্বাভাবিক উঁচু; রাতে একা থাকলে যে কোন লোকের মনে ভয়ের উদ্রেক হতে পারত । আমরা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম যে নিবাসের দুটো অংশ সুড়ঙ্গপথে যুক্ত ।
৩রা অক্টোবর অপরাহ্ণে আমরা পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মধ্য দিয়ে সড়কপথে কোয়াম্বাটুর রওয়ানা হলাম । যাত্রাপথের অপরূপ নৈসর্গিক শোভা প্রাণভরে উপভোগ করে সন্ধ্যাবেলা আমরা কোয়াম্বাটুর পৌঁছুলাম । স্থানীয় একটি রেস্টু্রেণ্টে উপাদেয় খাদ্য সহযোগে আহার সমাধা করে আমরা সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপন করি ।
কর্ণাটক ও তামিলনাডুর লোকদের আমোদে ও অতিথিপরায়ণ বলেই আমার মনে হয়েছে । আমাদের রাজ্যের সঙ্গে দুঃখজনক বৈপরিত্যে এই অঞ্চলে স্থান থেকে স্থানান্তর যাওয়ার রাস্তাগুলো সুসংরক্ষিত; যানবাহন এখানে নিরপদে ঘণ্টায় ১০০।১২০ কিলোমিটার গতিতে যাতায়াত করতে পারে । অবশ্য এটা আজ (২০২২ সাল) থেকে ২৫ বৎসর আগের কথা । এখন এই রাজ্যেও (পশ্চিমবঙ্গ) রাস্তাঘাটের অনেক উন্নতি হয়েছে ।
পরদিন সকালে আমরা বিমানে দিল্লীর পথে মোম্বাই যাত্রা করলাম । মোম্বাই থেকে আমাদের দিল্লীর বিমান ছিল সন্ধ্যায় । আমরা আমাদের মালপত্র বিমান বন্দরের ক্লোকরুমে রেখে মোম্বাইর দুএকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখলাম । ক্লোকরুমটি মূল বিমান বন্দর এলাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটি আলাদা ভবনে অবস্থিত ছিল । একমাত্র এই একবারই আমি বিমানক্ষেত্রের ক্লোকরুম ব্যবহার করেছিলাম ।
মোম্বাইতে আমরা দেখেছিলাম গেটওয়ে ওফ ইণ্ডিয়া, নরিম্যান পয়েণ্ট, কমলা নেহরু উদ্যান এবং মহালক্ষ্মী মন্দির । এটি ছিল আমার দ্বিতীয় মোম্বাই ভ্রমণ । প্রথমবার এসেছিলাম অনেক বৎসর পূর্বে যখন আমি স্পিনিং মিলসের পরিচালন অধিকর্তা ।
সন্ধ্যা সাড়ে ছটার বিমানে আমরা দিল্লী রওয়ানা হলাম । রাত ৯টায় দিল্লী পৌঁছে আমরা, পশ্চিমবঙ্গের প্রশিক্ষণার্থী তিনজন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি ভবনে রাত্রিবাস করি। বাকীরা যে যার রাজ্যের ভবনে রইলেন । পরদিন সকাল সাড়ে ছটায় শতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেণে আমরা মুসৌরীর উদ্দেশ্যে দেরাদুন রওয়ানা হলাম, সেখান থেকে সড়কপথে সন্ধ্যায় মুসৌরী । আমাদের ভারত দর্শন পর্যায় ১ শেষ হল ।
নীচের ও ডান প্যানেলের শিরোনামযুক্ত ছবিগুলোতে আমরা এই পর্যায়ের ভারত দর্শনে যে যে স্থানে গিয়েছিলাম তার এক ঝলক দেখা যাবে ।
দিল্লী-বাঙ্গালোর বিমান থেকে বাঙ্গালোর শহরের দৃশ্য ।
ভারতদর্শন প্রথম পর্যায়ে আমরা যে কুমারক্রুপা অতিথি নিবাসে ছিলাম তার দৃশ্য ।
তিরুপতি-তিরুমালাই রাস্তার পার্শ্বস্থ ডিয়ার পার্ক ।
তিরুমালাই উপত্যকা থেকে নিম্নের দৃশ্য ।
তিরুমালাই সংলগ্ন উদ্যানের দৃশ্য ।
কেন্দ্রীয় সচিবালয়, বাঙ্গালোর
মহীশূর রাজপ্রাসাদের মধ্যবর্তী অংশের দৃশ্য ।
তিনজন প্রশিক্ষণার্থীর সঙ্গে শ্রীরঙ্গপত্তনমে টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন রিসোর্টের প্রবেশপথে ।
চামুণ্ডী মন্দির, মহীশূর ।
মধুমালাই বনভূমিতে পাহাড়ের বুক বেয়ে নেমে আসা জলপ্রবাহের দৃশ্য ।
বন্দীপুর বনভূমির রাস্তার উপর বন্য কুকুর।
মধুমালাই বনভূমিতে বন্য হাতির পাল ।
উটির নিকটে মধুমালাই-উটি রোডের পাশে একটি হ্রদের দৃশ্য ।
উটিতে আমরা যে সরকারী ভবনে ছিলাম তার সম্মুখের অংশে তিনজন প্রশিক্ষণার্থী
ভারত দর্শনে দক্ষিণ ভারত পরিভ্রমণের অন্তিম পর্যায়ে আরব সাগরের তীরে আমরা তিন প্রশিক্ষণার্থী ।
প্রশিক্ষণ পুনরারম্ভ
দক্ষিণ ভারত থেকে ফেরার পর আমাদের ক্লাসরুম প্রশিক্ষণ শুরু হল ৬ই অক্টোবর ও চলল ১০ই অক্টোবর পর্যন্ত ।
ভারতদর্শন কার্যক্রম: পর্যায় ২
এরপর আমরা একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ভারতদর্শন কার্যক্রমে বেরোলাম । দল বিভাজন এবার অন্যরূপ হল যদিও আমরা পশ্চিমবঙ্গের তিনজন একই দলে রইলাম । এবারের সফরে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাপনা আমাদের নিজেদেরই করতে হয়েছিল । সফরের ব্যয় প্রশিক্ষণ বাবদ রাজ্যসরকারের প্রদত্ত অর্থ থেকে ইনস্টিটিউট বহন করেছিল । ১০ই অক্টোবর বিকালে ক্লাসের পর আমরা চণ্ডীগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । কয়েকটি গাড়ীতে করে আমরা পাহাড়ী পথ ধরে যাচ্ছিলাম । আমাদের যাত্রাপথে উত্তরাঞ্চল সীমানা পেরিয়ে আমরা সীমানার নিকটস্থ পান্থসাহেব গুরুদ্বার দর্শন করি । এই গুরুদ্বারটি শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংজীর স্মরণে নির্মিত হয়েছিল । পৃথিবীব্যপী শিখ ধর্ম্মাবলম্বীদের মধ্যে এই গুরুদ্বারের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম । গুরুদ্বারে ভক্তদের দানে তৈরী একটি খাঁটি সোনার পাল্কি রক্ষিত আছে ।
আমরা যে পথ ধরে যাচ্ছিলাম তার অনেকটাই ছিল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে । রাতের অন্ধকারে সেই পাহাড়ী পথের দৃশ্য অবশ্য আমরা দেখতে পাই নি । আমাদের চণ্ডীগড় পৌঁছুতে প্রায় মধ্যরাত্রি হয়ে গেল । আগেই বলেছি, প্রথম পর্যায়ের সফরের ন্যায় এই সফরের বন্দোবস্ত পূর্বাহ্নে করা ছিল না । আমাদের থাকার জায়গা নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হয়েছিল । অনেক কষ্টে আমরা চণ্ডীগড়ে একটি হোটেলে জায়গা পেলাম । আমরা পশ্চিমবঙ্গের তিনজন একটি দুশয্যার কামরায় অতিরিক্ত শয্যা যোগ করে রাত্রিবাস করলাম । যে খাবার দেয়া হয়েছিল তা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে রাতে আমাদের আর খাওয়া হয় নি ।
চণ্ডীগড় উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে পাঞ্জাব ও পূর্বে হরিয়ানা দ্বারা সীমাবদ্ধ ।
এই শহর দেশের সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়সম্পন্ন শহরদের একটি । জাতীয় সরকারের গবেষণা অনুযায়ী এটি দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরদেরও একটি । মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ীও এই শহরটি দেশের সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের শীর্ষে । ২০১৫ সালের এলজি ইলেকট্রণিক্সের নিরীক্ষণে শহরটি দেশের সবচেয়ে সুখী শহর বলে পরিগণিত হয়েছিল । ট্রাইসিটি বলে অভিহিত চণ্ডীগড়, মহালী ও পাঁচকুলা বিস্তৃত মহানগরী এলাকার লোকসংখ্যা একত্রে ১৬১১৭৭০ ।
চণ্ডীগড় শহরটি নিজের সৌন্দর্যেই একটি দ্রষ্টব্য স্থান । এটি একটি সুপরিকল্পিত শহর, আন্তঃ এবং অন্তর সেক্টর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত । রাস্তাগুলো প্রশস্ত ও পথিপার্শ্ব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । মাঝে মাঝে বিভিন্ন রাস্তার সংযোগস্থলে আলঙ্কারিক পুষ্প, গুল্ম ও উদ্ভিজ্য দিয়ে সাজানো বৃত্তাকার বড় বড় ট্রাফিক আইল্যাণ্ড রয়েছে । শহরটির মাস্টার প্ল্যান সুইস-ফ্রেঞ্চ আর্কিটেকট লে করব্যুইজার তৈরী করেছিলেন । করব্যুইজারের তৈরী এই পরিকল্পনাটি পোলিশ স্থপতি মেসিজ নাওইকি ও আমেরিকান পরিকল্পক অলবার্ট মায়ারের তৈরী পূর্ববর্তী পরিকল্পনার রূপান্তর ঘটিয়েছিল ।
পরদিন সকালে আমরা চণ্ডীগড়ে নেকচান্দ রক গার্ডেন ও ম্যাগনাস লেক পরিক্রমণ করে অপরাহ্ণে সিমলা রওয়ানা হলাম । আমরা অধিক রাত্রে সিমলা পৌঁছে রাজ্য প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে রাত্রিযাপন করলাম ।
পরদিন সকালে আমরা সিমলা থেকে কিছু দূরে কুর্ফি নামক স্থানে প্রাকৃতিক পরিবেশে চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়েছিলাম । সময়ের আভাবে পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে পারি নি । এই প্রথম আমি ঈগল ও নেকড়েকে চিড়িয়াখানায় বন্দীদশায় দেখলাম ।
পরে মেল ও সিমলার আরো দু একটি স্থান ঘুরে দেখলাম । আমার দেখা শহরগুলির মধ্যে সিমলার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম । সেটি হল শহরে ঢোকার মুখে একটি সুড়ঙ্গপথ ।
সিমলার সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাও বিজড়িত । এখানেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টোর ১৯৭২ সালের ২রা জুলাইর সেই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তিটি একটি শান্তিচুক্তিরও বেশী কিছু ছিল যা সেনা প্রত্যাহার ও যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ে ১৯৭২ সালের যুদ্ধের ফলাফলকে বিপরীতমুখী করতে সচেষ্ট হয়েছিল । এটি ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের একটি সামগ্রিক প্রতিচিত্র ছিল ।
সিমলা ভারতের রাষ্ট্রপতির গ্রীষ্মকালীন নিবাসও বটে ।
১৯৯৭ সালের ১২ই অক্টোবর অপরাহ্ণে আমরা সিমলা ছেড়ে মুসৌরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । ঐ দিনই রাতে আমরা মুসৌরী পৌঁছুলাম । পরদিন থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণের শেষ পর্ব সমাপ্ত করতে ।
ডান দিকের প্যানালে আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের ভারত দর্শনের কিছু স্মরণীয় মুহূর্তের শিরোনামযুক্ত ছবি রয়েছে ।
বাম দিকের ছবির উপর ক্লিক করলে দুই পর্যায়ের সম্পূর্ণ ভারতদর্শন কালে আমরা যে সকল স্থান ভ্রমণ করেছি তার পূর্ণাঙ্গ ভিডিও দেখা যাবে ।
মেল থেকে দেখা সিমলা শহরের একাংশ ।
চণ্ডীগড়ের একটি ট্রাফিক আয়ল্যাণ্ড ।
চণ্ডীগড়ের নেকচান্দ রক গার্ডেন ।
চণ্ডীগড়ের ম্যাগনাস হৃদের একটি দৃশ্য ।
চণ্ডীগড়-সিমলা রোড ধরে সিমলার পথে ।
সিমলার প্রবেশপথে সুড়ঙ্গ ।
পাহাড়ে যখন সূর্য অস্ত যায় । সূর্যাস্তে সিমলা ।
কম্প্যুটারে আমার অভিষেক
আইএএস (IAS) অধিষ্ঠিতকরণ প্রশিক্ষণে আমাদেরকে কম্প্যুটার চালনা করার শিক্ষাও দেয়া হয় । এই নতুন বিষয়টি আয়ত্ব করতে আমি অত্যন্ত আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি । আমার মধ্যে হোস্টেলের কম্প্যুটার কক্ষে নিয়মিত অনুশীলন করার অভ্যাস তৈরী হয়ে যায় । বিষয়টি নতুন হওয়ায় প্রথম দিকে কম্প্যুটার চালনা করতে অসুবিধা হত । আমার দৃঢ় সঙ্কল্প ও শেখার আগ্রহে আমি সেই বাধাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠলাম এবং কাজ চালাবার মত জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হলাম । প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে এসে নিজের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় আমার অর্জিত জ্ঞানকে উন্নততর করলাম এবং কম্প্যুটার চালনা ও ইণ্টারনেট ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত হলাম । কম্প্যুটারকে আমার জীবনের অঙ্গ করে নিলাম এবং একে নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলাম । আজ আমার উন্নততর জ্ঞানের ফলে আমি নিজেকে একজন অগ্রগামী কম্প্যুটার ব্যবহারকারী বলে দাবী করতে পারি । সাফল্যের এই পর্যায়ে পৌঁছুতে আমি বাড়ীতেও একটি কম্প্যুটার স্থাপন করেছিলাম যেন অবসরে কাজ করতে পারি । ট্রেণিং থেকে ফিরে এসে আমার তদানীন্তন অফিসেও কাজের সুবিধার্থে কম্প্যুটার স্থাপন করেছিলাম । আমার পরবর্তী অফিসেও কম্প্যুটার ব্যবস্থা চালু করিয়েছিলাম । অবসর গ্রহণের পর আমার কম্প্যুটার ব্যবহারের জ্ঞান নানা বিষয়ে আমাকে অপরিসীম সাহায্য করছে । আমার মুসৌরীর প্রশিক্ষণ আমাকে কম্প্যুটার ব্যবহার শেখার সুযোগ করে দিয়েছিল এবং তার ফলেই আমি আজ এ বিষয়ে দক্ষ হতে পেরেছি । কম্প্যুটার বিষয়ে মুসৌরীর এই প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণ ব্যতীত এ বিষয়ে আমার আর কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না বা নেই ।
প্রশিক্ষণ সমাপ্ত: স্বস্থানে ফেরার পালা
১৬ই অক্টোবর মধ্যাহ্ন পর্যন্ত আমাদের ক্লাসরুম প্রশিক্ষণ চলল ।
প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পূর্বে প্রশাসনিক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু বই একাডেমির প্রদর্শিত সংগ্রহ (displayed collection) থেকে পছন্দ করে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য দেয়া হল । সেখান থেকে পছন্দ করে কয়েকটা বই আমি এনেছিলাম ।
কোর্স শেষে প্রশিক্ষণার্থী ও শিক্ষকমণ্ডলীর একটি গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছিল । তার বৈদ্যুতিন নকল নিম্নে প্রদর্শিত হয়েছে ।
১৯৯৭ সালের ১৭ই অক্টোবর প্রশিক্ষণ শেষে আমরা যে যার রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম । আমাদের প্রশিক্ষণ খুবই কার্যকরী ও আনন্দময় হয়েছিল । প্রশিক্ষণের একটি বিশেষ দিক, বিভিন্ন রাজ্যের অফিসারদের সঙ্গে পরষ্পরের পরিচিতি যা পরবর্তীকালে বিশেষভাবে সহায়ক হয় ।
হওড়া থেকে বদলী
মুসৌরী থেকে ফেরার পর ১৯৯৮ সালের ১৪ই জুন পর্যন্ত আমি হাওড়ায় কর্ম্মরত ছিলাম ।
পশ্চিমবঙ্গ অনুন্নত শ্রেণী কল্যাণ দপ্তরে সংরক্ষণ বিষয়ক যুগ্ম কমিশনার ও পদাধিকারবলে যুগ্ম সচিব নিযুক্ত হয়ে ১৫ই জুন আমি হাওড়া ছেড়ে যাই ।