আমার বিয়ে, ১৯৭২
স্ত্রীর সঙ্গে জলপাইগুড়িতে বিয়ের দিনকয়েক পর ।
মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই আমার অভিভাবকদের নিকট বিবাহযোগ্যা কন্যাদের অভিভাকদের তরফ থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে । আমার বয়স তখন ১৭-১৮ বছর । আমার একমাত্র লক্ষ্য তখন উচ্চ শিক্ষা লাভ । বিয়ের প্রশ্নই আমার চিন্তাধারার মধ্যে নেই । স্বভাবতই সমস্ত প্রস্তাবগুলিই আমি প্রত্যাখ্যান করি । এরপর আমি যখন কোলকাতায় স্নাতকোত্তর পাঠরত সেই সময় কোলকাতায় লরেটোতে পাঠরতা একটি মেয়ের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব আমার দাদার কাছে এসেছিল । সে প্রস্তাবও আমি প্রত্যাখ্যান করি । এর কয়েক বৎসর পর, দাদার প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বর ও বরযাত্রীদের এগিয়ে দিতে আমি তখন গৌহাটিতে । সেখানে আমার ভগ্নিপতির গৌহাটির এক দুর-সম্পর্কের আত্মীয়া আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । আমি জানতে পারলাম ঐ ভোজে আমন্ত্রণকারিনীর কন্যাকে বিয়ের উদ্দেশ্যে আমার সম্মুখে উপস্থিত করার পরিকল্পনা রয়েছে । আমি বিয়েতে রাজী হলে আমাকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা বা একটি মোটর বাইক উপহার দেয়ার প্রস্তাবও কন্যাপক্ষের রয়েছে । বিবাহে যৌতুক প্রথার আমি ঘোরতর বিরোধী । এটি আমার নীতি বিরুদ্ধ । বিয়ের বিষয়েও তখনো পর্যন্ত আমার কোন আগ্রহ ছিল না। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আমি মধ্যাহ্ন ভোজে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকি । এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসে, যখন আমি কর্মরত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রথম শ্রেণীর আধিকারিক হিসাবে সংসার প্রতিপালনের যথেষ্ট ক্ষমতাও অর্জন করেছি । সুতরাং ইহা স্পষ্ট চাকুরীজীবি হওয়ার পরও সেই অবধি বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না । তা সত্বেও এই ঘটনার বছর আড়াইর মধ্যে (দীর্ঘদিনের) চাকুরীস্থলের নির্জনতায় নির্বান্ধব জীবনের একঘেয়েমি আমাকে বিয়ের ব্যাপারে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল ।
আমার মেখলিগঞ্জের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে ১৯৭২ সালের ৬ই মার্চ আমি বিয়ে করি । ততদিনে স্বপ্নীল জগতের অধরা প্রেমও অপসূত (আমার অধরা প্রেম নামক অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। স্ত্রী অজিতা এখানকার স্থানীয় মেয়ে । এটি প্রেমগঠিত বিয়ে নয়, তবে অসবর্ণ বিয়ে । পূর্বেই বলেছি কর্মস্থল মেখলিগঞ্জে আমার অবস্থানের দ্বিতীয়ার্দ্ধের পূর্বে বিবাহ বিষয়টি আমার বিবেচনার বাইরে ছিল । এক বিরূপ আবহাওয়ায় শুভার্থীজনের পরামর্শ উপেক্ষা করে এই বিয়েতে এগিয়েছিলাম ।
বিয়ের পশ্চাদপট
আমার বিয়ের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তের পশ্চাতে কার্যকরী ঘটনা ও তথ্যের বিশ্লেষণ প্রয়োজন ।
বন্যা, নির্বাচন ইত্যাদি জরুরি অবস্থা ছাড়া মেখলিগঞ্জের প্রশাসনিক কাজকর্ম্ম কাউকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না । আমার দৈনন্দিন কর্ম্ম শেষে অঢেল অবসর যথাযথ ভাবে ব্যবহারের পথ না পেয়ে আমার মনের উপর চেপে বসত । জায়গাটির নির্জনতা ও নিস্প্রভতা এবং আমার একাকীত্ব আমার শরীর ও মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল । আমার সহকর্ম্মী তথা বন্ধু বলাই বদলী হয়ে চলে যাওয়ার পর এই নির্জনতা ও একাকিত্বের পীড়ন তীব্রতর হয়ে উঠল । আমার শীঘ্র বদলী হওয়ারও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না । একাকিত্ব কাটিয়ে ওঠার জন্য সঙ্গীর আবশ্যকতা আমি গভীরভাবে অনুভব করতে লাগলাম । এমতাবস্থায় পূর্বে কথিত স্বনির্বাচিত কন্যা অজিতাকে বিয়ে করলাম । অজিতা (ডাকনাম স্বপ্না) ছিল মেখলিগঞ্জ নিবাসী অনুপেন্দ্রনাথ সিনহা ও সুষমা দেবীর চতুর্থ কন্যা, পঞ্চম সন্তান ।
অজিতা এবং ওদের পরিবার ভিন্ন জাতিগোষ্টিভুক্ত ছিল । এটি একটি অসবর্ণ (Intercaste) ও আন্তঃআঞ্চলিক (Interregional) বিয়ে ছিল, যদিও তা প্রণয়ঘটিত ছিল না । পূর্বরাগ (Courtship) ত দূরের কথা, বিয়ের আগে আমাদের কথাবার্তাই হয়নি । পুরুষানুক্রমে মেখলিগঞ্জের বাসিন্দা এবং বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী রীতিনীতিতে সাবলীল হলেও মেয়েটির পরিবার মূলতঃ ছিল রক্ষণশীল ।
সহকর্মীবন্ধু বলাই এবং ওর স্ত্রী প্রাথমিক ভাবে মেয়েটির প্রতি আমার আগ্রহ জাগায়; প্রাক বিবাহকালে ও বলাইর স্ত্রীর বান্ধবী ছিল । ঐ মেয়েটির সম্পর্কে আমার বন্ধু ও বন্ধুস্ত্রী উভয়েরই উঁচু ধারণা ছিল । পরবর্তীকালে বলাইর বাসভবন সহ দু-এক জায়গায় আমি ওকে দেখেছি । ওর শারীরিক সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করেছিল । আমার মনে হয়েছিল সে ও বোধহয় আমাকে পছন্দ করে । ওর শিক্ষাদীক্ষা ও পারিবারিক সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু না জেনেও [অনুভূতি ও কল্পনার উপেক্ষাকারী (overriding) প্রভাবে] আমি ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম । বলতে গেলে আমি অন্ধকারে ঝাপ দিলাম । যা হোক, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তা কার্যকরী করার প্রশ্ন এল । কিন্তু এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করার কেউ ছিল না, বলাই আগেই বদলী হয়ে চলে গিয়েছিল ।
মেয়েটির সঙ্গে বা ওর পরিবারের কারো সঙ্গে আমার কোন পরিচিতি ছিল না । ওঁদের জাতিগত মতাদর্শও আমার অগোচর ছিল । আমি একটি মর্যাদা সম্পন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলাম । আমার পক্ষে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়া সম্ভব ছিল না; এর জন্য মাধ্যম হিসাবে কাউকে প্রয়োজন ছিল । অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর মেয়েটির পরিবারের সাথে পরিচিত আমার এক বয়স্ক ডাক্তার বন্ধুর সাহায্য নেয়ার মনস্থ করলাম ।
ঐ বন্ধু সরকারী ডাক্তার হলেও দীর্ঘদিন মেখলিগঞ্জের বাসিন্দা ছিলেন ও মেয়েটির পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত ছিলেন । আমার প্রস্তাব শুনে ঐ ডাক্তার বন্ধু এই বিয়েতে আপত্তি জানালেন, বার বার আমাকে এই বিয়ে থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলেন । কিন্তু বহু চেষ্টা করেও ওঁর আপত্তির যথার্থ কারণ জানতে পারলাম না । উনি মেয়েটি আমার উপযুক্ত হবে না, এর বাইরে কিছু বললেন না । আমোদ-প্রমোদহীন এরূপ একটি স্থানে বন্ধুবান্ধবহীন জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল । তাছাড়া সহকর্মী বন্ধু বলাই ও ওর স্ত্রী মেয়েটি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ব্যক্ত করেছিল । যৌবনের মানসিকতায় ভাবলাম, যেমনই হোক পারষ্পরিক ভালবাসা উজ্জীবিত হলে ওকে যথাযথ ভাবে তৈরী করে নিতে পারব এবং দুজনে মিলে একটি সুন্দর সংসার গড়ে তুলতে পারব । দুর্ভাগ্যবশতঃ বাস্তবে তা হয়নি । হয়ত আবেগহীন ভাবে ডাক্তারের আপত্তির বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত ছিল । কিন্তু তা সম্ভব হয় নি । ডাক্তার বন্ধুর আপত্তি সত্বেও আমার সিদ্ধান্ত বদল করতে পারি নি । তবে ঐ বন্ধুটির প্রত্যয় উৎপাদন করে ওর মারফৎ প্রস্তাবটি পাঠাতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল । প্রস্তাবটি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই গৃহীত হয়েছিল ।
তবে আজ একথা স্বীকার করতে বাধা নেই যে পারষ্পরিক অবস্থান না জেনে এই বিষয়ে অগ্রসর হয়ে আমি নিতান্ত মূর্খের কাজ করেছিলাম; দুজনের কারোর জন্যই এর ফল সুখকর হয় নি । জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী । আমার পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তার বন্ধু ওর সম্পর্কে যে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন তা বিবেচনা না করার মুর্খামি সময় সময় কার্যকারণে স্মরণ করতে বাধ্য হই ।
মেয়েটির জ্ঞাতিগোষ্ঠির মধ্যে এই বিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল । পরিবার পরিজনদের মধ্যে বিভাজনের ফলে এই বিয়ে সামাজিক বিয়ে হতে পারেনি । এ বিষয়ে কন্যার দাদা আমার অনুমতি নিতে এলে আমি বলেছিলাম, লক্ষ্যটাই মূল, পদ্ধতিটা বাহূল্য । জলপাইগুড়ি কালীবাড়িতে মালা বদল করে আমাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্ব সম্পন্ন হয় । পরদিন জলপাইগুড়ির বিবাহ নিবন্ধকের নিকট ভারতীয় হিন্দু বিবাহ নিবদ্ধক আইন, ১৯৫৫ (Indian Hindu Marrriage Registration Act, 1955) অনুযায়ী বিয়ে নথিভুক্ত হয় ।
কন্যার ভ্রাতা ও মাতা সহ নিকটাত্মীয়দের কয়েকজন যদিও বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন ওদের অনেক আত্মীয়স্বজনই বিয়েতে অংশ নেন নি । পাত্রীর এক দিদি ও জামাইবাবু বিয়ের শহরের বাসিন্দা হয়েও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না, যদিও পাত্রী কলেজে পড়ার সময় ওদের ঐ বাড়ীতে থেকেই বেশ কিছুদিন পড়াশোনা করেছিল । তবে পাত্রীর পক্ষ থেকে মাতা, ভ্রাতা, জ্যেষ্ঠা ও কনিষ্ঠা ভগ্নি, একটি শিশু ভগ্নিপুত্র ও এক মামতো ভাই উপস্থিত ছিলেন ।
আমি জাতি ও গোষ্ঠির বাইরে বিয়ে করা সত্বেও আমার পরিবার ও আত্ময়ীস্বজন আমার স্ত্রীকে সাদরে গ্রহণ করেছিল । আমার দাদা ও পুর্ব-পাকিস্তান নিবাসী মামাতো ভাই মানিক ওরফে রজত, যে ঐ সময় ভারত ভ্রমনে শিলচর এসেছিল, এই বিয়েতে উপস্থিত ছিল । আমার মেখলিগঞ্জের সহকর্মী সাবরেজিস্ট্রার দীপক মুখার্জিও আমার তরফে এই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন ।
আমার স্ত্রী অজিতা
স্বপ্নার কুমারী অবস্থার ছবি
আমার স্ত্রীর কতগুলি মহৎ গুণ আছে যা আমি আমার কর্ম্মজীবনের ‘রাজভবন’ ও ‘পাইরেপ’ [8] অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি । সাধারণ ভাবে ওর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় ও সরলমনা এবং কোমলহৃদয়া । ও কখনও আমার মায়ের প্রতি বা আমার অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের প্রতি কর্ত্তব্যে অবহেলা করেনি । জীবনের অন্তিম পর্যায়ে মৃত্যুর পূর্বে মা অল্প কিছুদিন অচেতন অবস্থায় ছিলেন । ঐ সময় ওঁর শরীরে শয্যাক্ষতও (Bed sores) দেখা দিয়েছিল । সেই সময় আমার স্ত্রী নিজেই ওঁর সেবা শুশ্রুষা করেছে । যত্ন ও অন্তরের ভালবাসা দিয়ে সে ওঁর সেবাযত্ন করেছিল । ওঁকে রাইল্স টিউব দিয়ে খাওয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করানো, পোষাক পরিবর্তন করা ইত্যাদি সবই ওই করত । এমনকি নির্বিদ্বিধায় ওঁর মলমূত্র পর্যন্ত পরিষ্কার করেছে । হৃদয়ে অকৃত্রিম অনুকম্পা না থাকলে এই কাজগুলি কেউ করতে পারে না বিশেষতঃ যখন এই জাতীয় সেবা অর্থের বিনিময়ে লভ্য । এই জন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ ।
পূর্বেই বলেছি, মার মৃত্যুকালে আমি অন্যত্র ছিলাম । আমার ফেরা পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমার কর্মস্থলের সহকর্মীদের ও আবাসনের সহবাসিন্দাদের সহযোগিতায় মার মৃতদেহ শবাগারে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে যাবতীয় মৃত্যু পরবর্তী ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন করেছিল । সেদিক থেকে ও ছিল ব্যতিক্রমি । আমার আত্মীয় স্বজনেরাও ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।
আমার স্ত্রীর আরেকটি গুণ সহনশীলতা । পাঁচ মাসের একটি শিশুসন্তানকে নিয়ে বিয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে নগরজীবনের আমোদ-আহ্লাদ বিবর্জিত নয়াগ্রামের মত একটি নির্জীব স্থানে বিনা প্রতিবাদে দুবৎসরের অধিক কাল বাস করেছে । এই প্রায় বনবাসে কাল কাটাবার জন্য ওকে কখনো আমি অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুনিনি ।
তবে কয়েকটি দুর্লভ গুণের অধিকারীণি হলেও ওর চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব, মেয়েদের প্রতি স্নেহান্ধতা, ও রক্ষণাত্মক মানসিকতা (shielding mindset) কাঙ্খিত পরিবার গঠনে গুরুতর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । অন্ধ ভালবাসা ও মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় যে উঠতি বয়সের সন্তানের উপর বিষবৎ ক্রিয়া করে এই সত্য আমার স্ত্রী উপলব্ধি করতে পারেন নি । উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশের অভাবে সন্তানের চরিত্র গঠনে এ সব ত্রুটির অনভিপ্রেত ফলাফল সম্পর্কে অনবহিত হওয়ার দরুণ এরূপ ঘটেছে বলেই আমার মনে হয় । ওর এই ত্রুটি এবং মেয়েদের ব্যাপারে স্পর্শকাতরতা তথা আত্মজনের হিতোপদেশ শোনার অনীহার দরুণ আমার আদর্শ পরিবার গঠনের আশা নির্মূল হয়ে যায় ।
সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন ভাবে ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রে মায়ের ক্রমাগত সমর্থন পাওয়ার ফলে মেয়েদের মধ্যে মূল্যবোধ ও অপরাপর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রার্থিত বিকাশ ঘটেনি । ওদের পরবর্তি জীবনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় । এর ঈঙ্গিত আমার এই স্মৃতিচারণের কোথাও কোথাও হয়ত পাওয়া যাবে ।
এই প্রসঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন আমার সংশোধনের প্রচেষ্টা বার বার প্রতিহত হয়েছে ।
তবে এ সব কোন কিছুর জন্যই আমি আমার স্ত্রীকে দোষারূপ করি না । আমি মনে করি সব কিছুর জন্যই দায়ী আমার অবিমৃষ্যকারিতা ও কল্পনাপ্রবণ মানসিক গঠন । আমার স্ত্রীর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ওর যথাযথ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে ঘটেছে যার জন্য ওকে দায়ী করা যায় না । কিন্তু যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা আমার পক্ষে অপরিহার্য ছিল যথা সময়ে তা বিবেচনা না করার দোষে আমি দুষ্ট ।
মিণ্টো পার্ক সরকারী আবাসনে বসবাস কালে স্বপ্নার ছবি, সাল ১৯৯১
এবার আসি স্বাস্থ্যের কথায় । ২০১১ সালের মধ্যভাগে আমার স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়ে । ডাক্তারী ভাষায় এটি ছিল Non Hudson Lymphoma of grade II in the retroperitoneum. এটি ছিল একপ্রকার আরোগ্যযোগ্য ক্যান্সার । প্রাক চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর মূল চিকিৎসা শুরু হল ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। রোগ নিরাময়ের পর্ব শেষ হল ২০১২ সালের শেষভাগে । এরপর মাসিক, ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক চেক-আপ চলল। এক্ষণে ও সুস্থ । তবে ক্যান্সার কিছু কিছু বিষয়ে ওর মানসিক স্বস্থ্যের ক্ষতিসাধন করেছে । ধৈর্যহানি, উত্তেজনা, স্মৃতিদৌর্বল্য ইত্যাদি তার অঙ্গ ।
ওর ক্যান্সার চিকিৎসার ঐ মাসগুলিতে ওকে সুস্থ করে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেছিলাম । ঐ দিনগুলি ছিল আমার দুঃস্বপ্নের দিন; অমানুষিক শারীরিক কষ্টের ও দুঃসহ মানসিক উদ্বেগের দিন । কিন্তু পাহাড়ের মত স্থির থেকে আমি বিপদ অতিক্রম করলাম । ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম যে আমি দেরীতে হলেও IAS এ যোগ দিয়েছিলাম যার ফলে ক্যান্সার চিকিৎসার এই বিপুল ব্যয়ের সিংহ ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য প্রকল্প পুনর্বণ্টন করেছিল ।
অতি সম্প্রতি (১লা জানুয়ারী ২০২২) আমার স্ত্রীর ভ্যাস্কুলার ডিমেনশিয়া (Vascular Dementia) রোগ ধরা পড়েছে । ডিমেনশিয়া একটি অগ্রগতিশীল ব্যধি । এটি আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলবে তার কোন স্থিরতা নেই । চিকিৎসা চলছে, রোগটিকে বর্তমান পর্যায়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছি । কিন্তু রোগিনীর যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়ায় তা কতদূর সম্ভব হবে তা বুঝে উঠতে পারছি না । ইতিমধ্যেই স্মৃতিদৌর্বল্য বৃদ্ধির ও চলাফেরায় অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে । সে গৃহস্থালীর সমূহ কাজকর্ম্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে । ঘরের মধ্যে দু-চার পা হাঁটা ব্যতীত হাঁটাচলা প্রায় বন্ধ । কথাবার্তায় প্রাসঙ্গিকতার অভাব বেড়েছে । এক কথায় অবস্থার অবনতি হচ্ছে । রোগিনী স্বভাবগত ভাবে আমার কথা শুনে না, জোর করলে উত্তেজিত হয়ে অনভিপ্রেত ব্যবহার করে । তবু চেষ্টা জারী রেখেছি ।
আমার স্ত্রীর পরিবার
স্ত্রী সুষমা সহ অনুপেন্দ্রনাথ সিংহ
আমার শ্বশুরমশাই অনুপেন্দ্রনাথ সিং, শাশুড়ি সুষমা সিং । ওদের ছ'টি কন্যা বাবলি, বাণী, রত্না, স্বপ্না, বুলবুল ও শান্তি বা বন্দনা এবং একটি মাত্র পুত্র সুদর্শন ওরফে টুটু । আমার স্ত্রী ওদের মধ্যে পঞ্চম । পুত্র কন্যাদের মধ্যে কেবল দুজনের (যার মধ্যে একজন আমার স্ত্রী} পড়াশোনা উচ্চমাধ্যমিক স্তর বা তার উর্দ্বে বিস্তৃত । আমার শ্বশুরের সাথে কথাবার্তা বিশেষ হয় নি । তবে ওঁকে একজন সজ্জন ও ভালমানুষ বলেই মনে হয়েছে । শাশুড়ী সারাজীবন এক বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের হেঁসেলের দায়িত্বে ছিলেন বলেই জেনেছি ।
আমার শ্বশুরের মেখলিগঞ্জে অবস্থানকারী জ্ঞাতিগোষ্টিদের প্রায় সকলেরই ছিল জমিনির্ভর জীবনযাত্রা । শুনেছি এককালে আমার শ্বশুরকুলের বিস্তর জমি ছিল এবং ওরা প্রায় জমিদার পর্যায়ভুক্ত ছিলেন । পশ্চিমবঙ্গ জমি অধিগ্রহণ আইন (West Bengal Estate Acquisition Act, 1953) চালু হওয়ার পর ওদের অধিকাংশ জমি সরকারে ন্যস্ত হয়ে যায় । জমিনির্ভর এই সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার বিষয়টির গুরুত্ব ছিল গৌণ । তবে পরবর্তীকালে এই সকল পরিবারের শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত কেউ কেউ নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মের মুষ্টিমেয় কয়েক জনের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন । কিন্তু সবক্ষেত্রে সফল হতে পারেন নি । তবে এঁদের পৌত্র-প্রপৌত্র ও দৌহিত্র-দৌহিত্রীরা সকলেই প্রায় উচ্চশিক্ষিত ও অর্থকরী কর্মে লিপ্ত । একজন ত বাণিজ্যিক পাইলটও হয়েছে । এদের কেউ স্নাতক, কেউ বা স্নতকোত্তর ।
বিবাহাদির ব্যপারে ওরা বরাবর নিজেদের সমাজবৃত্তে আবদ্ধ ছিলেন । সেই সমাজবৃত্তের বাইরে বিয়েকে নিয়ে আসার ব্যাপারে যদিও আমি পথিকৃত, পরবর্তী কালে এরূপ ঘটনা আরো ঘটেছে এবং ওদের সমাজও এখন তা মেনে নিয়েছে।
আদতে এঁরা পশ্চিমবঙ্গের বাইরের অধিবাসী । বহু যুগ পুর্বে এই রাজ্যেে এসে এঁরা স্বজাতীয় লোকেদের সঙ্গে একত্রে বসবাসের উদ্দেশ্যে মেখলিগঞ্জ শহরের অন্তিম প্রান্তে সিংপাড়া নামে একটি মহল্লা তৈরী করেন । সম্ভবতঃ এঁরা কোচবিহারের মহারাজার কর্মচারী ছিলেন এবং ঐ সুবাদে মেখলিগঞ্জে জমিজমা পেয়েছিলেন । দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গে বাস করার ফলে এঁরা বাংলাভাষী ও বহুলাংশে বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক । তবে নিজেদের সমাজবৃত্তে বিবাহাদি অনুষ্ঠানে সাধারণতঃ নিজেদের চিরাচরিত প্রথাই অনুসরণ করেন । এঁরা স্থানীয় রাজবংশী ভাষা ব্যবহারেও দক্ষ ।
পুরণো আমলের দু-চার জন ছাড়া সিংপাড়ায় জমিনির্ভর পরিবার বর্তমানে আর বিশেষ নেই । পরিবারগুলোর মধ্যেকার গাঁথুনিও এখন দূর্বল । পুরণো কালের মানুষেরা গত । নতুন প্রজন্ম বর্তমান চাকুরী ভিত্তিক জীবন-যাত্রায় অধিকতর আগ্রহী ।