রাইটার্স বিল্ডিংস, কোলকাতা
পদে যোগদান ও অবসর গ্রহণ
১৯৯৮ সালের ১৬ই জুন আমি অনুন্নত শ্রেণী কল্যাণ দপ্তরে যুগ্ম সংরক্ষণ কমিশনার ও যুগ্ম সচিব পদে যোগ দিই ।
প্রায় পাঁচ বৎসর পর ২০০৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী এখান থেকেই আমি অবসর গ্রহণ করি ।
আমার বরাদ্দ কার্যাবলী
আমি তপশিলী জাতি, তপশিলী উপজাতি ও অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায়ের চাকুরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতির প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার ও এই সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও কমিশনের রাজ্যস্তরের প্রশাসনিক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম ।
পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষণ নীতি প্রয়োগ করার পদ্ধতি
অন্যান্য অনেক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মত পশ্চিমবঙ্গে সংরক্ষণ পদভিত্তিক নয়, পদশূন্যতা (vacancy) ভিত্তিক । পদশূন্যতা ভিত্তিক সংরক্ষণ প্রয়োগ করতে একই ধরণের পদের জন্য ১০০ বিন্দু বিশিষ্ট পর্যায় তালিকা (100-point roster) তৈরী করা হয় । সংরক্ষণের ঘোষিত শতাংশের হিসাবে এই তালিকার নির্দিষ্ট বিন্দুগুলো সনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট সংরক্ষিত শ্রেণীর জন্য বরাদ্দ করা হয় । প্রতিটি সরকারী অফিসে বা প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি শ্রেণীর পদের জন্য এই ধরণের আলাদা আলাদা তালিকা রাখা আবশ্যিক । কোন পদ শূন্য হলে সেই পদের প্রকৃতি (অর্থাৎ তা সংরক্ষিত কি না, সংরক্ষিত হলে কোন শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত ইত্যাদি) এই তালিকার সাজুয্যে স্থির করা হয় ।
জনকল্যানমূলক সেবা সচল রাখতে সংরক্ষণ বিমুক্তি
সংরক্ষিত ভেকেন্সিতে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে এবং জনস্বার্থে ঐ পদে অবিলম্বে নিয়োগ অত্যাবশ্যকীয় বিবেচিত হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ বিমুক্তির জন্য যুগ্ম কমিশনারের নিকট প্রস্তাব পেশ করতে পারেন। এই ধরণের প্রস্তাব বিবেচনা কালে আমি দেখেছি বিশেষ করে প্রযুক্তিগত এবং স্কুল ও কলেজ শিক্ষক পদে উপযুক্ত প্রার্থীর অভাব প্রকট । শিক্ষাক্ষেত্রে ও নির্মাণকার্যে অচলাবস্থা এড়াতে সংরক্ষিত পদের অগ্রনায়ন নীতি (carryforward principle) অনভিপ্রেত হলেও প্রয়োগ করতে হয়েছিল ।
অগ্রনায়ন নীতি ও তার ফলাফল
অগ্রনায়ন নীতিতে (১) সংশ্লিষ্ট সংরক্ষিত ভেকেন্সিকে সংরক্ষণমুক্ত করে দেয়া হয় যেন অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটাতে ঐ পদ উপলভ্য সাধারণ প্রার্থীর দ্বারা পূরণ করা যায় । ঐ পূরণ হওয়া ভেকেন্সির সংরক্ষণ তখন পরবর্তী উপলভ্য অসংরক্ষিত ভেকেন্সিতে প্রযুক্ত হয় ও সেই ভেকেন্সিটি তখন সংরক্ষিত হয়ে যায় । এই পদ্ধতিতে আমরা শীঘ্রই এমন একটি পরিস্থিতিতে পৌঁছুলাম যেখানে কিছু কিছু উচ্চতর পদের ক্ষেত্রে পর্যায় তালিকার কোন একটি নির্দিষ্ট বিন্দু পর্যন্ত সব শূন্যতা সংরক্ষিত হয়ে গেল । ফলতঃ কোন একটা সময়কালে যদি পর্যাপ্ত সংখ্যক সংরক্ষিত শ্রেণীর প্রার্থী উপলভ্য হয় তবে সেই সময়কালে উপলভ্য কোন যোগ্য সাধারণ প্রার্থীকে ঐ পদে নিয়োগ করা সম্ভব হবে না । কিন্তু এই পরিস্থিতি অনিবার্য । এরূপ একটি পরিস্থিতির দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব অভিপ্রেত নয় । কিন্তু জনসেবা সচল রাখতে এর গত্যন্তরও নেই ।
সংরক্ষণ বিমুক্তিকরণ ও অগ্রনায়ন নীতি থেকে শিক্ষা
এই পরিস্থিতি থেকে যে শিক্ষা লাভ হয় তা হল সংরক্ষণের অনুপাত বাড়ানোর দাবী নিয়ে রব তোলার পরিবর্তে সংরক্ষিত শ্রেণীর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া উচিত । উপলভ্য সংরক্ষিত কোটা যদি তা যাদের জন্য (উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে) তাদের দ্বারা পূরণ করার ব্যবস্থা করা যায় তবে তা ঐ সকল শ্রেণীর প্রতি একটি যথার্থ সেবা বলে গণ্য হতে পারে । যখন সংরক্ষিত শ্রেণীর লোকেদের জন্য শত শত সংরক্ষিত শূন্যতা অব্যবহৃত থাকছে তখন কাগজে কলমে কোটা বাড়িয়ে কি উদ্দেশ্য সাধিত হবে? কিন্তু আজকের রাজনীতিবিদদের হিসেব অন্য, তারা ভোটব্যাঙ্কের ব্যালান্সের দিকে তাকিয়ে হিসেব করেন! যূপকাঠে বলি হয় জনস্বার্থ!
আমি আমার কার্যকালে সীমাবদ্ধ সুযোগের মধ্যে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০-বিন্দু পর্যায় তালিকা কঠোরভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি । আমার অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল যাদের যোগ্যতা রয়েছে অন্ততঃ তারা যেন তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয় ।
আইন, বিধি ও নিয়ামকের সঙ্কলন প্রস্তুতিকরণ ও প্রকাশ
অনুন্নত শ্রেণী কল্যাণ বিভাগে কর্ম্মরত থাকাকালীন ২০০২ সালে আমি একক ভাবে ও সময় বিশেষে ব্যক্তিগত সহায়কের(2) সাহায্য নিয়ে অফিস কম্প্যুটারে কম্পেণ্ডিয়াম অন রিসার্ভেশন (Compendium on Reservation) নামে একটি বই তৈরী করি (বইটির প্রচ্ছদপটের ছবি বাম পার্শ্বের প্যানেলে প্রদর্শিত) । এটি এ৪ (A4) মাপের কাগজে ৪৫৫ পৃষ্ঠার একটি নথি । এতে তপশিলী জাতি, তপশিলী উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর সংরক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয় সংক্রান্ত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত আইন, বিধি, নিয়ামক ও নির্দেশনামা একত্রিত করা হয়েছে । বইটি সরকারীভাবে ছাপিয়ে অনেকগুলো কপি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিলি করিয়েছিলাম । এই নথি তৈরী করতে আমাকে অধিকাংশ দিনই অফিসের সময়ের পরে কাজ করতে হয়েছে । এটি তৈরী করার ভাবনা তখনই মনে এল যখন দেখলাম কোন বিষয় পরীক্ষাকালে আইনকানুন দেখতে হলে ইতস্তত খুঁজে বেড়াতে হয় ও অনেক সময় প্রয়োজনীয় লেখ্যটি পাওয়া যায় না । তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল যাদের জন্য এই আইন-কানুনগুলো তৈরি হয়েছে আইন-কানুনের এরূপ একটি একত্রিত নথি তাদের সহায়ক হবে ।
আমার সময়কালে আমার তৈরী এই দপ্তরের প্রকাশিত কম্পেণ্ডিয়াম অন রিসার্ভেশন গ্রন্থটির সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিন সংস্করণ (৩) এই পরিচ্ছদের শেষাংশে একটি ফ্রেমে সংযোজন করা হয়েছে । ফ্রেমের ডানদিকের উপরে তীর চিহ্নিত অংশে টেপ বা ক্লিক করলে আলাদা ট্যাবে বড় আকারে এটি প্রদর্শিত হবে । ফ্রেমের মধ্যেও স্ক্রোল করে যে কোন নির্দিষ্ট অংশ পড়া যাবে । এই লেখ্যটি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে । স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় ইতিমধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন পরিমার্জন হয়ে থাকবে । কেউ যদি এই গ্রন্থের কোন অংশ ব্যবহার করতে চান তাকে এই পরামর্শই দেয়া উচিত হবে তিনি যেন ব্যবহারের পূর্বে ঐ অংশের বর্তমান অবস্থান জেনে নেন ।
আমার কর্ম্মসম্পাদন ও আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ
আমার এটাই ছিল কর্ম্মজীবনের শেষ পর্যায় । এই দপ্তরে কার্যকালেও আমি অন্যান্য স্থানে যেমন করেছি সেই একই ভাবে এখানেও আইনকানুন অক্ষরে অক্ষরে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছি । এটা অনস্বীকার্য যে এ বিষয়ে দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও সচিবের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি ।
দপ্তরে আমি তিনজন সচিব ও দুজন পূর্ণ মন্ত্রীর কাছে কাজ করেছি । প্রথমে ছিলেন দীনেশ ডাকুয়া মন্ত্রী ও কৃষ্ণা ঝালা সচিব । পরে উপেন কিস্কু ছিলেন মন্ত্রী এবং ক্রমানুসারে সুখবিলাস বর্মা ও রামসেবক বন্দ্যোপাধ্যায় সচিব ।
অবসর গ্রহণ ও প্রাক-অবসর ঘটনা
৩৫ বৎসর ২ মাস ও ২৫ দিন সরকারী কার্যে যুক্ত থেকে ২০০৩ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী অপরাহ্ণে আমি অবসর গ্রহণ করি, রাইটার্স ব্লিডিংস ও সিভিল সার্ভিসকে বিদায় জানাই ।
এখানে আমি একটি কৌতুহল-উদ্দীপক বিষয় উল্লেখ করতে চাই । অবসরের প্রাক্কালে আমার সচিব আমার ঐকান্তিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে দপ্তরে কিছুদিনের জন্য আমার পুনর্নিয়োগের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন । প্রত্যাশিত ভাবেই সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় । এটা ঘটবে আমি জানতাম এবং সচিব আমার আপত্তি সত্বেও যখন প্রস্তাবটি পেশ করেন তখনই আমি তাঁকে তা বলেছিলাম । ততদিন আমি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের ও তাদের মানসিকতার ধারা সম্পূর্ণরূপে চিনে নিয়েছি । আমার দিক থেকে আমি বলতে পারি আমি কখনোই সরকারী ক্ষেত্রে পুনর্নিয়োগে আগ্রহান্বিত ছিলাম না । সচিব আমার পুনর্নিয়োগের অনুমোদন লাভে সফল হলেও অতি অবশ্যই আমি তা প্রত্যাখ্যান করতাম । সরকারে পুনর্নিয়োগের বিষয়টি আমি সমর্থনও করি না । এই প্রথা পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থবিরোধী । এটা ক্যারট এণ্ড স্টিক (Carrot and Stick) পলিশিরও সমার্থক ।
আমার সার্ভিস পর্যালোচনা
সময় বিশেষে বৃত্তিগত বিপত্তি সত্বেও আমি সিভিল সার্ভিসের চাকুরীজীবন উপভোগ করেছি । মানুষের জন্য যেটুকু করতে পেরেছি তাতে আমি খুশী । আইএএসে সরাসরি প্রবেশ করা সম্ভব হলে হয়ত সিভিল সার্ভেণ্ট হিসাবে মানুষকে অধিকতর সেবা দিতে পারতাম ।
এই প্রসঙ্গে কর্ণাটক বিধানসভা ভবনের শীর্ষে খোদিত "Govt work is God's work" বাক্যটি আমার মনে পড়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি সরকারী কাজের এর চেয়ে ভাল সংজ্ঞা আর হয় না । কারণ মানুষের সেবাই ভগবানের সেবা আর সরকারী কার্য সেই সেবার সুযোগ করে দেয় ।
আমি কখনও কখনও অনুভব করি সিভিল সার্ভিসে আটকে না গেলে আমি সমাজকে আরো বেশী কিছু দিতে পারতাম । আমার সার্ভিসের কিছু বন্ধুরাও তাই বলে । একজন বন্ধু প্রায়শঃই ঠাট্টাচ্ছলে বলে আমার মেধাকে এই সীমাবদ্ধ কর্ম্মক্ষেত্রে নষ্ট করার জন্য পরপারে গিয়ে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে । অবশ্য এসব ভাবনা চিন্তার আজ আর কোন বাস্তব তাৎপর্য নেই ।
আমার কর্ম্মজীবন মূলতঃ উন্নয়নমূলক ও নিয়ন্ত্রক প্রশাসনে প্রায় সমভাবে বিভক্ত ছিল । আমি অবশ্য উন্নয়নমূলক কাজ, যা জনগণের কাছাকাছি থেকে করা যায় ও সুফল সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছুনো যায়, তাই পছন্দ করতাম । প্রশাসনের এই অংশে নতুন পরিকাঠামো তৈরীর সঙ্গে যুক্ত থাকার পরিতৃপ্তিও পাওয়া যায় ।
অবসর-পরবর্তী নিয়োগ
অবসরের পর আমি পেনসনের বাইরে মাসিক চল্লিশ হাজার টাকা বেতনে কলিকাতা স্টক এক্সচেঞ্জে (সরকারী প্রতিষ্ঠান নয়) এক বৎসরের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলাম । সঙ্গে প্রান্তিক সুবিধা হিসাবে ছিল যাতায়াতের জন্য গাড়ী এবং ফ্রি ল্যাণ্ডলাইন ও মোবাইল ফোন । ২০০৪ সালের ২৮শে অক্টোবর আমি এই পদে যোগ দিয়েছিলাম এবং কার্যকাল সম্প্রসারিত না হলে ২০০৫ সালের ২৭শে অক্টোবর পর্যন্ত তা কার্যকরী থাকত । কিন্তু নয় মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর আমি পদত্যাগ করে চলে আসি । চেয়ারম্যানের কর্ম্মপদ্ধতি আমার পছন্দ হচ্ছিল না । চেয়ারম্যানও একজন অবসরপ্রাপ্ত বরিষ্ঠ আইএএস অফিসার ছিলেন ।
সেই থেকে আমি অবসর পরবর্তী নিয়োগ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি ।