“A Tale of a Sylheti Refugee” নামক আমার ইংরাজী ওয়েবসাইটের এটি বাংলা সংস্করণ । তবে সময়াভাবে ইংরাজীতে লেখা আমার ভ্রমণ কাহিনীগুলোর বাংলা তর্জমা এখানে দেয়া সম্ভব হয়নি । ইংরাজীতে লেখা ভ্রমণ কাহিনীগুলোর লিঙ্ক অবশ্য এই ওয়েবসাইটের অবসর জীবন সংক্রান্ত পৃষ্ঠার শেষে দেয়া আছে । পরে সম্ভব হলে বাংলায় লেখা কাহিনীগুলো যথাস্থানে অন্তর্ভুক্ত করব / তীর নির্দেশিত অংশে টেপ বা ক্লিক করলে ইংরাজী ওয়েবসাইটে যাওয়া যাবে →https://sites.google.com/site/aparajeya1943 । ঐ নামে গুগল সার্চ করেও ঐ ওয়েবসাইটে পৌছুঁনো যাবে ।
এটি মূলতঃ আমার ও পূর্বপাকিস্থান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা আমাদের পরিবারের ও আত্মীয়স্বজনের জীবন যুদ্ধের কাহিনী, যদিও এই কাহিনী আমাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কি ভাবে আমরা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি ও চলার পথে আমি কি কি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা নিয়েই এই গল্প । তবে এটাও সত্যি আমার মধ্যে যে সম্ভাবনা (potential) ছিল পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় তার পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি ।
শালীনতার সীমা বজায় রেখে আমি আমার এই কাহিনী সততার সঙ্গে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি । আমার পারিবারিক পশ্চাদপট, আমার অনুভূতি, জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গী ও বর্তমান সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আমার অভিমত যথাযথ ভাবে এখানে উপস্থাপনা করার প্রয়াস নিয়েছি । কোথাও আমার কৃতিত্ব অতিরঞ্জিত করার বা ব্যর্থতা গোপন করার চেষ্টা করি নি ।
সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য আমার মন্তব্য বা টিপ্পনী আমার মনন ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে আমি যে সকল স্থানে অবস্থান করেছি সে সকল স্থানে দৃষ্ট বা উপলব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এখানে উপস্থাপনা করেছি । স্থানান্তরে বা স্থানবিশেষে তা ভিন্নরূপ হতে পারে । আমার মন্তব্য দ্বারা ব্যক্তিগত বা গোষ্টিগত ভাবে কাউকে আহত করা বা কারো প্রতি কুৎসা প্রকাশ করা আমার উদ্দেশ্য নয় ।
-অজয় কুমার দাস
বিঃ দ্রঃপুস্তকাকারে এই কাহিনী, "পতন থেকে উত্থান" নামের পিডিএফ (pdf) নথি হিসাবে এই পাতার শেষে সংযোজিত হয়েছে । ঐ সংযোজিত নথিটির চিত্রের মধ্যে ডানপাশে একটি ক্ষুদ্রাকার বর্গক্ষেত্র দ্বারা আবদ্ধ তির চিহ্ন দেখা যাবে । সেখানে ক্লিক বা টেপ করলে নথিটি পড়ার জন্য খুলে যাবে ।
আমার পশ্চাদপট
আমি একদা শ্রীহট্টবাসী (১) মূল-হারানো একজন বাঙালী । আমি গর্বিত যে, আমি একজন সিলেটি বাঙালী । আমরা আজ (ইং ২০২২ সাল) থেকে প্রায় ৭৫ বৎসর পূর্বে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থান তথা বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত শ্রীহট্ট শহরে অবস্থিত আমাদের পৈতৃক বাসস্থান ছেড়ে আসতে বাধ্য হই । সময়টা যতদূর মনে হয় ১৯৪৭ সালের শ্রীহট্ট রেফারেণ্ডামের অব্যবহিত পর । ভারতবর্ষ বিভাজনের খড়্গ যে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর নেমে এসেছিল তাদের মত আমিও আমার বাল্যকালের প্রারম্ভে ছিন্নমূল হয়ে যাই । এরপর কঠোর পরিশ্রমকে পাথেয় করে জীবনের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন সিভিল সার্ভেণ্ট হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হই । উল্লেখযোগ্য পশ্চাদপটবিহীন একজন স্ব-প্রতিষ্ঠ মানুষ হিসাবে আমি ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে সততা, আন্তরিকতা ও মর্যাদার সাথে দীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করেছি । সিভিল সার্ভেণ্ট হিসাবে আমার কর্তব্য সম্পাদনে আমি কখনো কোন চাপ কিংবা হুমকির কাছে নতি স্বীকার করি নি; রাজনৈতিক বা অন্যরূপ হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা প্রতিহত করে আমি সর্বদা আইনানুগ ভাবে কাজ করেছি । কর্মজীবনে আমি ভয়শূন্য চিত্তে ও পক্ষপাতহীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি । আমার চরিত্রের এই বৈশিষ্ঠ্যগুলোর জন্য আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেই পরিবেশ ও যে সব মানুষ ঐ পরিবেশের অঙ্গ ছিলেন তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ ।
অত্যুজ্জ্বল শিক্ষাজীবন ও বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্বেও যেখানে পৌঁছানো উচিত ছিল আমার পক্ষে অনতিক্রম্য প্রতিকুল অবস্থার দরুণ আমি সেখানে পৌঁছুতে পারি নি । আমার মেধা ছিল, কিন্তু অর্থ ছিল না । যে সকল উৎকৃষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি প্রবেশ সুনিশ্চিত করেছিলাম সেখানে পঠন-পাঠন চালনা করার আর্থিক ক্ষমতা আমাদের ছিল না । প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় জন্মভূমির ভিটে-মাটি ছেড়ে শরণার্থী না হতে হলে আমার কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ বিঘ্নিত হত না । কারণ, সেক্ষেত্রে বাসস্থানের বুনিয়াদ সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও চাকুরীরত পিতার আয়ের নিশ্চয়তা থাকার দরুণ ছাত্রবৃত্তির (scholarship) অর্থের বাইরে প্রয়োজনীয় অধিক অর্থের সংস্থান সহজেই হয়ে যেত । ভারতবিভাগে আমরা গৃহহীন হয়ে পড়লাম, আমাদের মাথার উপর কোন স্থায়ী ছাদ রইল না; আমাদের পৈতৃক বাসস্থান যেমন তেমন অবস্থায় ফেলে আসতে হল । পরবর্তী কালে বিনামূল্যে তা নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিগত হল । পিতৃদেব কোথাও আর কোন নিজস্ব গৃহ বা বাসভূমির ব্যবস্থা করতে পারেন নি; আমরা স্বল্প ভাড়ার বাড়ীতে যাযাবরের মত কখনো এখানে কখনো সেখানে থেকে বড় হয়েছি । সেই সময় (আমার বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় জীবনে) আমাদের কোন স্থায়ী আয়েরও সংস্থান ছিল না ।
শৈশবে ও বয়ঃসন্ধি কালের বেশীর ভাগ অংশ জুড়ে ভবিষ্যতের বুনিয়াদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টার সাথে সাথে আমাকে পরিবারের সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কঠোর যুদ্ধ যুজতে হয়েছে । জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে গিয়ে হৃদয়ে অঙ্কুরিত কৈশরের গভীর ভালবাসাকে পল্লবিত করার আকাঙ্খা আমাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে।
১৯৬০ সালের আসামের ভাষা দাঙ্গার ("বঙ্গাল খেদা") ফলে পার্টিশন-পরবর্তী যে স্থানে আমরা স্থিত হয়েছিলাম স্বল্প সময়ের জন্য হলেও সেখান থেকে উৎখাত হলাম । এর ফলে পিতৃদেব অনেক কষ্টের পর যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার ধ্বংসের পথ সূচিত হল ।
আমি দুঃখিত, আমাকে বলতে হচ্ছে, আমার ও আমাদের পরিবারের এবং আত্মীয়স্বজনদের (যারা অধিকতর কষ্ট ভোগ করেছেন) ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আশীর্বাদ হিসাবে না এসে অভিশাপ হয়ে এসেছিল ।
আমাকে কেন্দ্র করে এই কাহিনী যত এগোবে ততই বাস্তুত্যাগী মানুষের কষ্ট, লাঞ্ছনা ও জীবনের পথে অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতার চিত্র পরিস্ফুট হবে । হয়ত এই চিত্র পাঠকদের মনে উদ্বাস্তুদের জন্য কিঞ্চিৎ সমবেদনার উদ্রেক করবে ।
১৯৯১ সালে আমার পরিবার ।
আশা ছিল আদর্শ পরিবার করে গড়ে তুলতে পারব ।
চালকের সীটে আমার দৌহিত্র শ্রীমান শ্লোক ।
প্রার্থনা করি জীবনের গাড়ীও যেন সে দৃঢ়তার সঙ্গে সফলভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং একজন আদর্শ মানুষ তৈরী হয়।
কেন এই ওয়েবসাইট?
আমার জন্মভূমির কথা, আমার ছিন্নমূল দূর বা নিকট আত্মীয়দের কিয়দংশের ব্যথা-বেদনা এবং আমার বড় হওয়ার পথে ও পরবর্তী কালে আমি যে সকল বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছি সেই সম্পর্কে বলতে এই কাহিনী । কাহিনীটিকে কালের বাধা অতিক্রম করে সঞ্জীবিত রাখার উদ্দেশ্যে ও আমার দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের নিকট সহজলভ্য করতে ওয়েবসাইট রূপে উপস্থাপিত করেছি । সাইটটিকে আমার ভ্রমণ বৃতান্ত, ভ্রমণের ভিডিও, ছবির অ্যালবাম, বন্ধু বান্ধবের বিবরণ ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক বিষয়ের তথ্য ও বিবরণ দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চেষ্টা করেছি । আমার ভ্রমণ বৃতান্তে আমি যে সকল স্থান পরিদর্শন করেছি সেই সকল স্থান সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য ও পশ্চাদ্পট সংযোজন করেছি । এই সকল ভ্রমণ কাহিনীর বাংলা তর্জমা এখানে না পাওয়া গেলে মূল ইংরাজী বর্ণনার জন্য এখানে A Tale of a Sylheti Refugee - Travelogue Part A (google.com) ক্লিক/টেপ করুন ।
এই ওয়েবসাইটের উদ্দেশ্য আমার চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা আমার আত্মীয়স্বজন, উত্তরসূরী, বন্ধুবান্ধব, ও অন্যান্য যারা আগ্রহী তাদের মধ্যে সম্প্রচারিত করা । আমার পরিবারের সদস্যরা আমার জীবনের ঘটনাবলী সম্পর্কে সম্যক অবহিত । এই মুহূর্তে ওরা নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত; আমার কথা শোনার মত সময় বা আগ্রহ ওদের নেই । ভবিষ্যতে কোন একদিন আমার পরিবারের বর্তমান সদস্যের কেউ বা আমার কোন উত্তরসূরী হয়ত আমি কেমন মানুষ ছিলাম জানতে আগ্রহী হবে । সেই সম্ভাবনা সামনে রেখে এই সাইট তৈরী করেছি ।
আমার পরিশ্রম সার্থক হবে যদি ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের একজনও আমার এই জীবনী থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে । আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকের জীবন থেকেই কিছু না কিছু শেখার থাকে এবং আমি সবিনয়ে বলতে চাই আমার জীবন থেকেও হয়ত অনেক কিছূ শেখার থাকতে পারে।
জন্মভূমি ও অভিবাসন
আমি আগেই বলেছি আমাদের আদি বাসভূমি ছিল শ্রীহট্ট । শ্রীহট্ট বা সিলেট প্রথম যুগে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির একটি সম্পদশালী জেলা যেখান থেকে সময় সময় অসাধরণ প্রতিভাবান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে । ভারত বিভাগের অব্যবহিত পূর্বে অনুষ্ঠিত সিলেট রেফারেণ্ডামের ফলশ্রুতি হিসাবে শ্রীহট্ট তদানীন্তন পূর্বপাকিস্থানের অন্তর্ভূক্ত হলে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে আমরাও বাস্তুহারা হলাম। পিতৃদেবের দুরদৃষ্টির দরুণ আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার শিকার হতে হয় নি । আমাদের আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে হয় সর্বস্ব হারিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন নয়ত ক্রমাগত জীবনের আশঙ্কা নিয়ে স্বস্থানে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন । আমাদের মান ও প্রাণ রক্ষা করতে পিতৃদেব যথাসময়ে জন্মভূমি ছেড়ে এসেছিলেন। আমরা প্রায় শূন্য হাতে কেবল মাত্র পিতার প্রেস মেনেজারের চাকুরী, যা তিনি স্থান ত্যাগের পূর্বে সংগ্রহ করেছিলেন, তাই সম্বল করে শিলচর শহরে পাড়ি দি । এখানেই আমাদের দুর্দশার সমাপ্তি হল না । পূর্বে কথিত বঙ্গাল খেদা আন্দোলন নামে পরিচিত ভাষাদাঙ্গার দরূণ পার্টিশন পরবর্তী এক যুগের অধিক কাল আমরা আসামের যে স্থানে বসবাস করছিলাম সেই স্থানও ১৯৬০ সালে ছেড়ে অসতে হল । এটা ঠিক,পরবর্তী কালে সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল । কিন্তু দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অতি কষ্টে স্থাপিত প্রেস ব্যবসাকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয় নি । অর্থাগমের উৎস এই ভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঐ স্থান আমাদের ছেড়ে আসতে হয়েছিল ।
আমরা ও পার্টিশন: কিছু জ্ঞাতব্য তথ্য
আমাদের ও আমাদের যে সকল আত্মীয় পরিজন পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন সকলেরই নিত্যসঙ্গী ছিল অভাব। আমাদের পরিবার অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করেছে, সময় সময় 'দিন আনি দিন খাই' অবস্থার মধ্য দিয়েও গেছে । পিতার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অনিশ্চিত অবস্থায় সংসারের হাল ধরার ক্ষমতা এবং আমাদের নিজেদের উঠে দাঁড়াবার দৃঢ় ইচ্ছা না থাকলে আমরা অতলে তলিয়ে যেতাম । আমি মধ্য শৈশব থেকেই পিতা ও পরিবারকে সাহায্য করতে প্রেসের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম । সেই সময় আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকেও তার শ্রমের অংশ বহন করতে হয়েছে । আমার বোনেরা ও তাদের পরিবার এবং আমার মামাদের অনেকেও অধিকতর দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করেছেন । দুবেলার দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতে এদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে; কখনো কখনো সেই অন্ন জোগাড় করাও সম্ভব হয়নি । অথচ আমাদের মত এদের সকলেই স্বস্থানে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার ছিলেন, কেউ কেউ বা অর্থবানও ছিলেন । তাই আমি বলেছি আমাদের মত উদ্বাস্তুদের জীবনে স্বাধীনতা ছিল অভিশাপ, আশীর্বাদ নয় ।
কিন্তু সিলেটিরা জন্ম-যোদ্ধা । আমরা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনের পথে এগিয়েছি । আমাদের এই যুদ্ধ ছিল মরণ-বাঁচনের লড়াই । অন্য যে কোন লড়াইয়ের মত এখানেও হার-জিতের প্রশ্ন রয়েছে । এই যুদ্ধে কেউ হেরেছেন, কেউ জিতেছেন । হার-জিতের বাইরে বাস্তব ঘটনা হল আমাদের অর্থাৎ সিলেটিদের এক রাজনৈতিক দাবা খেলার শিকার হতে হল, যেখানে সিলেটি হিন্দু ও তাদের জন্মভূমিকে বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করা হল । ভারত-বিভাজনের অব্যবহিত পূর্বে এক অপ্রত্যয়ার্হ রেফারেণ্ডামের মাধ্যমে শ্রীহট্টকে আসাম থেকে বিচ্যুত করে পূর্ববঙ্গের তথা পূর্বপাকিস্তানের অঙ্গীভূত করা হল । অথচ শ্রীহট্টকে আসামে সংযুক্ত করার পর বার বার এই জেলাকে পূর্ববঙ্গে ফিরিয়ে দেয়ার জোরালো দাবী সত্ত্বেও তদানীন্তন বৃটিশ সরকার তাতে কর্ণপাত করে নি । ভারত বিভাজনে অন্যান্য রাজ্যের পাকিস্তানভুক্তির সাথে শ্রীহট্ট জেলার বৃহদাংশের পাকিস্তানে অঙ্গীভূত হওয়ার পার্থক্য এখানেই । শ্রীহট্ট যদি আসাম থেকে বিযুক্ত না হত তবে আসামের অংশ হিসাবে ভারতভুক্ত হত । এর ফল হল ভয়ঙ্কর । আমাদের মত হাজার হাজার শ্রীহট্টবাসী হিন্দু ছিন্নমূল হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হল । জন্মভূমি আঁকড়ে থাকা হিন্দুরা বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় নিপীড়ণের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্য়ায় দেশত্যাগ করতে লাগল । দশকের পর দশক ধরে উদ্বাস্তুস্রোত বয়ে চলল । এই স্রোত মূলতঃ উত্তরপূর্ব ভারতের দিকে ধাবিত হল এবং এর বূহদাংশ আসামে স্থিত হল ।
আসামে প্রবেশকারী এই অসহায় শরণার্থীদের নানা ছলে আসাম থেকে বার করে দেয়ার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চলতে লাগল । বঙাল খেদা আন্দোলন, অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের দাবী, বিদেশী ও বহিরাগত চিহ্নিতকরণ ও বহিস্করণ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এই ছিন্নমূল মানুষজনের উপর বছরের পর বছর উৎপীড়ণ চলেছে । কিন্তু নিপীড়িত এই জনমানব একত্রিত হয়ে সেই সকল আক্রমন প্রতিহত করেছেন । অবশেষে রাজীব গান্ধী চুক্তি (Rajiv Gandhi Accord, 1985) অনুযায়ী জাতীয় নাগরিক পঞ্জি আধুনীকরণ কালে এই বাস্তুহারাদের এক বৃহদাংশকে বাদ দেয়া হয় । পরবর্তী কালে এই সব বাদ পড়া মানুষদের কিছু শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকত্ব প্রদানের উদ্দেশ্যে ভারত সরকার যখন লোকসভায় ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী বিল (Indian Citizenship Act. 1957 Amendment Bill) আনেন সেই সময় সারা দেশে বিশেষ করে আসামে তীব্র হিংসাত্বক আন্দোলন গড়ে ওঠে । এই আন্দোলন বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয় যদিও তন্মধ্যে বিলটি আইনে পরিণত হয়ে যায় ।
অসমীয়া-প্রধান ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আমি বাল্যে এক দশকের বেশী সময় কাটিয়েছি; ১৯৬০ সালের বঙাল খেদা আন্দোলন স্বচক্ষে দেখেছি এবং তার শিকারও হয়েছি । আমার বরাবরই মনে হয়েছে অসমীয়ারা সাধারণ ভাবে আসামে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে । শিলং এ যে কসমোপলিটান হোস্টেলে আমি বাস করেছি সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে অসমীয়ারাও ছিল । কিন্তু কোন বাঙালী ছাত্রের সাথে কোন অসমীয়া ছাত্রের হৃদ্যতা আমার নজরে আসে নি । যদিও বাহ্যতঃ এদের পরষ্পরের মধ্যে কোন অসদ্ভাব দেখা যায় নি, কিন্তু এটা বোঝা গেছে অসমীয়া ছাত্ররা বাঙালী ছাত্রদের প্রতি প্রসন্ন মনোভাবাপন্ন ছিল না । আমার বিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু (সিলেটি নয়) আমাকে তার জীবনের একটি ঘটনা বলেছিল, যেখানে সে এক অসমীয়া বন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে একদল উন্মত্ত অসমীয়া যুবকের আক্রমণের শিকার হয়েছিল এবং অতি কষ্টে পালিয়ে বেঁচেছিল । ঘটনাটি ঘটেছিল যোরহাট শহরে । অসমীয়ারা বাঙ্গালীদের বিশেষ করে সিলেটি বাঙ্গালীদের পথের কাঁটা বলে গণ্য করত । এইরূপ এক বিরূপ ভাবাপন্ন পরিবেশে বাস্তুচ্যুত সিলেটি বাঙ্গালী হিসাবে আসামে অবস্থান তাই আমাদের কখনও সুখপ্রদ মনে হয় নি ।
যারা মাটি আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন
আমার বড় দুই দিদি ও তাদের পরিবারকে প্রাণভয়ে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে শূন্যহাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল । বাসভূমির দৃঢ় বন্ধন ছিন্ন করে এদেরকেও শেষ পর্যন্ত অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিতে হয়েছিল । এ বিষয়ে বিস্তারিত এই ওয়েবসাইটের ভ্রাতা-ভগ্নী পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে ।
আমার মামাদের অধিকাংশই ভারত ভাগের পর কোন না কোন সময় উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে (ভারতে) প্রবেশ করেছেন । কিন্তু আমার বড়মামা পরিবারের অধিকাংশ সদস্য সহ আমৃত্যু স্বস্থানে (শ্রীহট্টে) বসবাস করেছেন । তবে তাকে বিভিন্ন সময়ে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের প্রাণহানির হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে । একদা ধর্মোন্মত্ত নরঘাতকরা তার এক পুত্র ও তার পরিবারকে হত্যার চেষ্টা করে । জল-জঙ্গল পেরিয়ে অনেক কষ্টে পালিয়ে গিয়ে তারা রক্ষা পায় । ধরা পড়লে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত । বর্তমানে (২০১৭-১৮) আমার বড়মামার ছেলমেয়েদের অধিকাংশ এই ক্রমাগত হুমকির মধ্যে বাস করার হাত থেকে রেহাই পেতে সপরিবারে দেশত্যাগ করে আমেরিকাবাসী হয়েছে । বিস্তৃত বিবরণ এই সাইটের "আমার মামা ও মামাতো ভাইরা" নামক পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য । কাউকে যদি ক্রমাগত ধর্মীয় নিপীড়ণের হুমকির মধ্যে জীবন যাপন করতে হয় তবে সে জীবন কি আদৌ কোন জীবন?
সিভিল সার্ভিসে আমার পথপ্রদর্শক
আমার কর্মজীবনে আমি রাজনৈতিক ও অন্যান্য কিছু ঘটনার ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি যেখানে আমাকে সিভিল সার্ভেণ্ট হিসাবে আমার ভূমিকা পালন করতে হয়েছে । এসব ক্ষেত্রে আমি আমার বিবেকের নির্দেশে চলেছি, যে নির্দেশ শূন্য থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাকে সর্বদা ন্যায়, সততা ও নিরপেক্ষতার পথে পরিচালিত করেছে । আমি যাদের নেতৃত্বে কাজ করেছি আমার অনুসৃত কর্মপদ্ধতি তাদের অসন্তোষ উৎপাদন করতে পারে ও ফলতঃ আমার চাকুরীর ক্ষতি হতে পারে জেনেও আমি বিবেক প্রদর্শিত পথ ত্যাগ করি নি ।
ছিন্নমূল একজন সিলেটির আত্মকথা
এই ওয়েবসাইটের ঠিকানা (URL) https://sites.google.com/view/dasak2022
সিলেটি উদ্বাস্তু পরিবারের ইতিহাস
"পতন থেকে উত্থান" নামে লিখিত সিলেটি শরণার্থী হিসাবে আমাদের পারিবারিক ইতিহাস বৈদ্যুতিন পুস্তকাকারে এই পৃষ্ঠার শেষে সংযোজন করেছি । প্রচ্ছদের উপরের ডানদিকের তীর চিহ্নে ক্লিক বা টেপ করলে পুস্তকটি নতুন একটি পাতায় খুলে যাবে । ওখানেই বইটি পড়া যাবে বা প্রয়োজনে ডাউনলোডও করা যাবে ।
প্রয়োজনে যোগাযোগ করার ঠিকানা: dasak2020@outlook.com
মেনু নির্বাচন পদ্ধতি
পেজ বা পৃষ্ঠার মাথায় ওয়েবসাইট লগোর ছবির বামদিকে তিনটি আনুভূমিক (Horizontal) সমান্তরাল রেখা দেখুন । ঐ রেখার উপর ক্লিক করলে নেভিগেশন মেনু খুলে যাবে । ওখান থেকে পছন্দসই পৃষ্ঠার নামে ক্লিক বা টেপ করলে সংশ্লিষ্ট পাতা খুলে যাবে । কোন পাতার নামের বামদিকে যদি নিমন্মুখী তীর চিহ্ন ( Down arrow) থাকে তবে বুঝতে হবে ঐ পাতার মধ্যে ঐ গ্রুপের আরো উপপাতা লুকিয়ে আছে । তীর চিহ্নে ক্লিক বা টেপ করলে ঐ পাতা বা পাতাগুলোর নামের তালিকা বেরিয়ে আসবে । সেই নামের উপর ক্লিক করলে সংশ্লিষ্ঠ পাতাটি খুলে যাবে ।