সূচীপত্র
আমার বিদ্যালয় শিক্ষা শুরু:
আমরা যোরহাট শহরে স্থিত হওয়ার পর আমার নিয়মিত স্কুল শিক্ষা আরম্ভ হয় । এই শহর যোরহাট আমার জীবনে ও চরিত্র গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । এখানেই বয়ঃসন্ধি কালে আমার মধ্যে রোমাণ্টিক ভালবাসার অনুভূতি জাগ্রত হয় ।
যতদূর মনে আছে, ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে আমি এখানে লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাই স্কুলের প্রাইমারী বিভাগের (যা এ্যাংলো বেঙ্গলী প্রাইমারী স্কুল নামে পরিচিত ছিল) দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই । ঐ সময় আমরা স্কুলের ঠিক পেছনে চিত্রে প্রদর্শিত গলির [1](২০১৪ সালের অবস্থান) শেষ প্রান্তে একটি ছোট ভাড়া বাড়ীতে[2] থাকতাম । স্কুলের খুব কাছে হওয়াতে আমি একাই হেঁটে স্কুলে চলে যেতে পারতাম ।
বিদ্যালয়ের পিছনে যে গলিতে যোরহাটে আমাদের প্রথম বাসস্থান ছিল তার ২০১৪ সালের চিত্র ।
জীবনে প্রথম বৃ্ত্তিলাভ
পড়াশোনাকে আমি আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করেছিলাম । প্রত্যেক পরীক্ষায় আমি ক্লাসে প্রথম হতাম । ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জীবনের প্রথম স্কলারশিপ লাভ করি । ঐ পরীক্ষায় আমাদের স্কুল থেকে আর কেউ এই সম্মানের অধিকারী হয় নি । এই বৃত্তির মান ছিল মাসিক দশ টাকা এবং তা আমার বাকী স্কুলজীবনের শেষ পর্যন্ত চালু ছিল । স্বীকৃতি, অনুপ্রেরণা বা সম্মানের কথা বাদ দিলেও তখনকার দিনের অর্থমূল্যের হিসাবে টাকার পরিমাণটা নেহাৎ নগণ্য ছিল না । তখন চালের দাম ছিল সেরপ্রতি ছয় থেকে আট আনা । ষোল আনায় এক টাকা হত আর এক সের প্রায় ০.৯৩ কেজির সমান ছিল । আমাদের দুর্দিনে এই অর্থ পরিবারের কাজে লেগেছিল ।
১৯৫০-ভূমিকম্প: প্রভাব ও আমার অভিজ্ঞতা
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা । চিত্র ৬
আমরা যোরহাটে স্থিত হওয়ার অনতিকাল পর আসামের ১৯৫০ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় । এই ভূমিকম্প আমার মনে যে ভীতিপ্রদ অনুভূতির সঞ্চার করেছিল তার ফলে ঐ ঘটনা সুস্পষ্টভাবে আমার মনে গেঁথে রয়েছে । সে দিন ছিল স্বাধীনতা দিবস, সময় সন্ধ্যা । আমি (বাঁ পাশে আমার ১৯৫৩ সালের জানুয়ারী মাসের ছবি) বাবার পাশে শুয়ে গল্প শুনছিলাম । হঠাৎ আমরা অনুভব করলাম সবকিছু যেন দুলছে, শুনতে পেলাম সবাই ‘ভূমিকম্প, ভূমিকম্প’ বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । আমরা ও ছুটে বাইরে ফাঁকা জায়গায় চলে এলাম, পড়শীরাও সেখানে জড়ো হয়েছিল । আমাদের পায়ের নীচের মাটি জোরে জোরে দুলছিল । আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম; এর আগে ভূমিকম্প সম্পর্কে আমার কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়নি । চারদিক থেকে শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনি এবং সেই সঙ্গে "ভগবান, রক্ষা কর" এই প্রার্থনা শোনা যাচ্ছিল । কতক্ষণ এই অবস্থা চলেছিল জানি না, তবে কয়েক সেকেন্ড হলেও মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল । যাহোক, সৌভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণের মধ্যেই দুলুনি থেমে গেল । আমাদের মনে বিপন্মুক্তির অনুভূতি এল, যদিও ভয় কাটল না । কাছাকাছি কোথাও ক্ষতি বা ধ্বংসের খবর ছিল না । সে রাতে আমরা মনে ভয় নিয়ে ঘুমোলাম । হয় সে রাতে আর কোন কম্পন হয়নি, নয় আমরা তা অনুভব করতে পারিনি । পরদিন সকালে বড়রা শহরে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে বেরোলেন । ওঁরা ফিরলে আমরা জানতে পারলাম শহরের কোথাও কোথাও রাস্তা ও রেললাইনের কিছু অংশ ধ্বসে গিয়েছে, সৌভাগ্য বশতঃ কোথাও প্রাণহানি ঘটেনি । ঘর-বাড়ীরও তেমন কোন ক্ষতি হয়নি । একমাত্র বালিবাট নামক এলাকার বৃহৎ মস্জিদটি ধ্বসে পড়েছিল । সেই সময় শহরের বাড়ীগুলো ছিল একতলা বা খুব বেশী হলে দোতলা । সম্ভবতঃ সেই কারণেই বাড়ীগুলো পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল । পরবর্তীকালে আসামের এই ভূমিকম্প ও তার ব্যাপক ধ্বংসলীলার বিবরণ আমি নানা জায়গায় পড়েছি । উইকিপেডিয়া[3] থেকে জেনেছি ব্রহ্মপুত্রের উপনদীর গতিপথ পরিবর্তন ও ডাইক[4] (Dyke) গঠন করে উপনদীর জলস্রোত রোধ করা ছাড়াও এই ভূমিকম্প আসাম ও তিব্বতে কমবেশী ৩৩০০ প্রাণহানি ঘটিয়েছিল । সুবনিশিরি সহ কয়েকটি উপনদীর ডাইকগুলো পরে ভেঙ্গে গিয়ে প্রবল বন্যার সৃষ্টি করেছিল । ডিব্রুগড় ও সদিয়ার অনেকাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল । আমরা ঐ সময় জানতাম কেবল ডিব্রুগড় গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । রিক্টর স্কেলে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৬ ও তীব্রতা (intensity) ছিল চরম (extreme)। এই ভূমিকম্পের ধ্বংস-লীলার সম্যক ধারণা দিতে ইণ্টারনেট থেকে সংগৃহীত কয়েকটি ছবি পাশে সংযোজন করলাম ।
সেই সময় অতি অল্প সংখ্যক লোকই বাড়ীতে খবরের কাগজ রাখতেন । টেলিভিসন তখনও আসেনি । কারো কারো রেডিও সেট ছিল, যা আমাদের পক্ষে রাখা সম্ভব ছিল না[5] । তখনকার দিনে আমাদের মত শিশুদের বাইরের জগতের ঘটনাবলী সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার মত কোন ব্যবস্থা ছিল না । ফলতঃ এই ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এবং আমরা যে রাজ্যে বসবাস করতাম সেই রাজ্যেরই বিভিন্ন অংশে এর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে কোন ধারণাই আমাদের ছিল না । সে দিক দিয়ে আজকের শিশুরা অনেক ভাগ্যবান । বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও ইনটারনেটের সাহায্যে এরা আজ কত সহজে পৃথিবীর যে কোন স্থানের দৈনন্দিন ঘটনা অনুসরণ করতে পারে । এমন কি, বিশেষ বিশেষ ঘটনা সরাসরিও দেখতে পারে । অনস্বীকার্য, টেলিভিসনের অনেক কুপ্রভাব রয়েছে, তবে এর অনেক ভাল দিকও আছে যার মধ্যে একটি হল - আজকের যুগের শিশুরা টেলিভিসনের মাধ্যমে বাইরের জগৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে পারছে । এটা ওদের উত্তরজীবনে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে ।
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা । চিত্র ১
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা । চিত্র ২
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা । চিত্র ৩
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা । চিত্র ৪
১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা । চিত্র ৫
উপলভ্য মাধ্যম
সেকালে আমাদের বিনোদনের ব্যবস্থা বলতে ছিল স্কুলের খেলাধূলো, বাৎসরিক উৎসব, সিনেমা এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা । খেলাধূলোয় আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না । আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু প্রদীপ (বর্তমানে আমেরিকায় সেট্লড্) ভাল ক্রিকেট খেলত এবং স্কুল ক্রিকেটে অংশ নিত । উৎপলও (বিদ্যালয় শিক্ষক হিসাবে অবসর নিয়ে যোরহাটে প্রতিষ্ঠিত ছিল, বর্তমানে প্রয়াত) ক্রিকেট খেলত । আমার অপর কিছু বন্ধুবান্ধব যথা, মৃণাল, আশু (আমাদের ক্লাশের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী), গোকুল (দীর্ঘদিন প্রয়াত) ইত্যাদির মত খেলাধূলোয় আমার ভূমিকা ছিল দর্শকের । গোকুল ভাল গান করত । গান শোনার জন্য আমরা ওর চারদিকে ভীড় করতাম । ওর একটি প্রিয় গান যা আমাদেরও মুগ্ধ করত তা ছিল,
"শাজাহান নাই আজ, মমতাজ নাই আজ
তাজমহল, তাজমহল ।..........."
আমাদের বিদ্যালয় জীবনে আমরা কদাচিৎ সিনেমা দেখতে যেতাম । স্কুলজীবনে আমি একটিমাত্র ছবি দেখেছিলাম, যার নাম ছিল "পরিবর্তন" । এরপর আমি সিনেমা হলে যাই মেট্রিক পরীক্ষার পর । যোরহাটের শঙ্কর সিনেমা হলে "অগ্নিপরীক্ষা" নামক ছবিটি মামাতো ভাই রজত ওরফে মানিকের সাথে দেখেছিলাম; মানিক ঐ সময় তদানীন্তন পূর্ব্ব-পাকিস্থান তথা অধুনা বাংলাদেশ থেকে আমাদের কাছে বেড়াতে এসেছিল । মানিক (প্রয়াত, ২০ এপ্রিল ২০০৮) ছিল সিনেমা-আসক্ত । ওর সঙ্গে আমি বেশ কয়েকটি সিনেমা দেখেছিলাম । ঐগুলোর মধ্যে ছিল নয়া দৌড়, লালু ভুলু, ইন্সানিয়াৎ ইত্যাদি । যোরহাটে ঐ সময় তিনটি সিনেমা হল ছিল শঙ্কর, ইলি ও অরুণা । আমরা তিনটি হলেই সিনেমা দেখেছিলাম ।
যা ছিল আমার প্রিয়
তবে আমি স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যেতেই বেশী ভালবাসতাম । এই অনুষ্ঠান প্রতিবৎসর বা কখনও কখনও একাধিক বৎসরের জন্য একসাথে অনুষ্ঠিত হত । পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাত থেকে আমি নিয়মিত পুরস্কার গ্রহণ করতাম । এটা আমার কাছে খুব আনন্দের ছিল । পুরস্কার হিসাবে পেতাম ভাল ভাল বই, যেগুলো পড়ে আমি খুব আনন্দ পেতাম; সেই বইগুলোর কয়েকটি এখনও আমার সংগ্রহে রয়েছে । কয়েকটি পরবর্তীকালে কর্মস্থলে বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে ।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছাড়াও সময় সময় স্কুলের পক্ষ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ম্যাজিক শো, বিচিত্রানুষ্ঠান, থিয়েটার ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হত । এগুলো আমরা খুব উপভোগ করতাম। স্কুলের সব অনুষ্ঠানই লক্ষ্মী ইউনিয়ন বেঙ্গলী ক্লাবের প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত হত; আমাদের স্কুলের আলাদা কোন প্রেক্ষাগৃহ ছিল না ।
আমার দাদার শিক্ষাদীক্ষা
শিক্ষার কথায় ফিরে এসে আমার নিজের বিষয়ে বলার আগে আমার দাদার সম্পর্কে দু একটা কথা বলে রাখি। আমি (পাশের ছবিটি পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের আমার একটি পুরনো কিছুটা বিবর্ণ ছবি) যখন লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাই স্কুলে পড়তাম আমার দাদা কৃষ্ণকান্ত দাস তখন যোরহাটের জগন্নাথ বরুয়া কলেজে পড়ত; ঐ কলেজ থেকে সে যথাসময়ে কলা বিভাগে স্নাতক হয়, পরে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম. এ. করে । এখানে উল্লেখ্য স্নাতকোত্তর পড়ার খরচের অনেকটাই দাদাকে নিজেকে ব্যবস্থা করতে হয়েছিল; বাসস্থান থেকে দূরে গৌহাটি শহরে পড়ার পুরো খরচ যোগান বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না ।
উল্লেখ্য, দাদা নিজের তাগিদেই স্নাতকোত্তর পাঠের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও নিজেই আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা করেছিল । ওকে এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার বা সাহায্য করার কেউ পরিবারে ছিল না ।
স্কুলে আমার কৃতিত্ব ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা
আমার সম্পর্কে আমি আগেই বলেছি ক্লাশের প্রতি পরীক্ষায় আমি প্রথম হতাম; এই ভাবে দশম শ্রেণীতে পৌঁছুলাম । সেটা ছিল ১৯৫৯ সাল, এবার গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের বছরের মেট্রিক পরীক্ষার জন্য আমাদের তৈরী হওয়ার সময় । আমরা ছিলাম গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিক পরীক্ষার শেষ ব্যাচ; পরের বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিক পরীক্ষার পরিবর্তে রাজ্য সেকেণ্ডারী বোর্ডের অধীনে স্কুল ফাইনেল পরীক্ষা চালু হওয়ার কথা ছিল[6] । আমার শিক্ষকদের সকলের আশা ছিল এই পরীক্ষায় আমি খুব ভাল ফল করব । আমি অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠা সহকারে পরীক্ষার জন্য তৈরী হতে লাগলাম । আমার যেটুকু সাহায্যের প্রয়োজন হত তা আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়ে যেতাম । যথাসময়ে মেট্রিক পরীক্ষার যোগ্যতানির্ধারক নির্বাচনী পরীক্ষা বা সিলেক্সন টেস্ট হল । অতঃপর মেট্রিক পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার পালা ।
একটি স্মর্তব্য ঘটনা
এখানে আমি একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করছি যা থেকে আমাদের সেদিনের শিক্ষকরা ছাত্রদের কৃতিত্ব ও স্কুলের সুনামের বিষয়ে কতটা সংবেদনশীল ছিলেন তা প্রকাশ পাবে । স্কুলের সকল মেট্রিক পরিক্ষার্থী ছাত্রকে (ছাত্রীদের জন্য সম্ভবতঃ আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল) একটি ক্লাসরুমে বসিয়ে পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন আমাদের সংস্কৃত শিক্ষক সুধাংশু মোহন ভট্টাচার্য । পূরণ করতে গিয়ে আমার ফর্মে হঠাৎ ছিটকে কালি পড়ে গেল, আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম । কি করব বুঝতে না পেরে শিক্ষক মহাশয়ের শরণাপন্ন হলাম; তিনি ছুটলেন প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের কাছে । অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের প্রধান শিক্ষক শশব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন; তাঁর সারা মুখে আনন্দের দ্যুতি খেলছিল । তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বল্লেন, "এটি একটি শুভ সংকেত, তুমি ঐ ফর্মটিই পূরণ করে জমা দাও ।" আমি তাই করলাম । সেই প্রধান শিক্ষক, আমাদের সম্মানিত কিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় দীর্ঘদিন গত হয়েছেন, কিন্তু সেদিনের ঘটনা মনে পড়লে আজও আমার চোখের সামনে তাঁর সেদিনের সেই আনন্দে উদ্ভাসিত মুখমণ্ডল ভেসে ওঠে । আমাদের অন্যান্য শিক্ষকরা পরে যখন এই ঘটনার কথা জানলেন তাঁরা অত্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠলেন । তাঁদের প্রত্যাশার পারদ উর্দ্ধমুখী হল; তাঁরা আশান্বিত হলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় নিশ্চয়ই অসাধারণ কিছু করব । অনেকে হয়ত এটাকে মিথ বা মিথ্যা ধারণাজাত বিশ্বাস বলে অভিহিত করবেন । কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ছাত্রদের জন্য তৎকালীন শিক্ষকদের সদিচ্ছা, ভালবাসা ও উদ্বেগ যে অনুরণিত হচ্ছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই । বিদ্যালয়ের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতাও এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে ।
মেট্রিক পরীক্ষার ফল: প্রথম স্থান অধিকার ও ছাত্রবৃত্তি লাভ
আমি আমার শিক্ষকদের হতাশ করিনি । আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম । প্রথম হওয়ায় এবং অঙ্কে সর্ব্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় আমি দুটি মেডেল পেয়েছিলাম । মেডেল দুটির প্রথম পিঠের প্রতিচ্ছবি নিম্নে প্রদত্ত হল । অঙ্ক এবং অতিরিক্ত অঙ্ক ছাড়াও আমি সংস্কৃতে লেটার নম্বর পেয়েছিলাম । সামগ্রিক বিচারে আমি স্টার মার্ক পাই । আমার মোট প্রাপ্ত নম্বরের শতকরা হার ছিল ৮০.৩৩% । আজকের দিনের ভাল ছাত্রদের ৯৮%, ৯৯% নম্বর প্রাপ্তির পাশে এটা অবশ্য তেমন কিছু আহামরি নয় বলে মনে হতে পারে । তবে তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের সময় বহুধা বিকল্প উত্তর সম্বলিত প্রশ্নের (MCQ) প্রচলন ছিল না । বিশ্লেষণমূলক ও দীর্ঘ উত্তর প্রদেয় প্রশ্নের আধিক্য থাকায় নম্বর সংগ্রহ কঠিনতর ছিল ।
এই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ইন্টারমিডিয়েট কোর্সের জন্য আমি মাসিক ৫০ টাকা হারে জাতীয় মেধা বৃত্তি (ন্যাশনেল মেরিট স্কলারশিপ) পেয়েছিলাম ।
মেট্রিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে প্রাপ্ত মেডেল
পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার মেডেল
অঙ্কে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির মেডেল
কৃতিত্ব বিচারে নম্বরের ভূমিকা সম্পর্কে আমার অভিমত
যদিও আমার এই স্মৃতিচারণে বিভিন্ন পরীক্ষায় আমার প্রাপ্ত নম্বরের উল্লেখ করেছি, আমি মনে করি কৃতিত্বের মাপকাঠি হিসাবে পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর একমাত্র বিচার্য হতে পারে না । এ বিষয়ে প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত জের টেনে নিয়ে যাওয়ার মত কে কতটা জ্ঞান ও মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষতা অর্জন করতে পেরেছে । কিন্তু আমাদের পদ্ধতিটাই (system) এমন যে নম্বরই এখানে প্রাধান্য পায় । সকলেই তাই তাদের সন্তান-সন্ততি বা প্রতিপাল্য কে কি শিখেছে বা শিখছে তা না দেখে নম্বরের পশ্চাদ্ধাবন করেন । এর দ্বারা আমরা ছেলেমেয়েদের প্রকৃত শিক্ষিত করার পরিবর্তে মার্ক হাণ্টিং রোবট তৈরীতে ইন্ধন যোগাচ্ছি না ত!
আমার পরীক্ষা-প্রস্তুতি ও অধীত বিষয়ের গভীরতা
স্কুলে পঠনকালে কিংবা পরে, বস্তুতপক্ষে আমার সম্পূর্ণ ছাত্রজীবনে কখনও কোন গৃহশিক্ষক ছিলেন না । আমি কখনও আলাদা করে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ার প্রয়োজন বোধ করিনি । গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করার সামর্থ্যও আমাদের ছিল না । বাড়ীতেও আমাকে পড়াশোনায় সাহায্য করার মত জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন কেউ ছিলেন না । আবার পড়াশোনা বা পরীক্ষার ফলাফলের ব্যপারেও কোন তরফে আমার উপর কোন চাপ ছিল না । সবদিক দিয়েই আমি ছিলাম মুক্তবিহঙ্গ । কিন্তু এই মুক্তির মধ্যেও আমি বন্দী ছিলাম আমার নিজের কারাগারে । আমার অন্তরাত্মা সর্বদা আমাকে উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছুতে অনুপ্রাণিত করত । আমাদের দাবিদ্র্য সব সময় আমাকে ঐ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তাড়া দিত । আমি আমার সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দীর্ঘ সময় ধরে পড়া করতাম, প্রায় সর্বদাই রাত জাগতাম । আমার শিক্ষাকে কখনো সর্টকাট পথে নিয়ে যাইনি, কখনো বাজারে চালু নোটবই পড়িনি । আমি পাঠ্যবই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়েছি এবং তারপর প্রশ্নমালা সুশৃঙ্খলভাবে সমাধান করার চেষ্টা করেছি । আমি প্রশ্ন সমাধানে জোর দিয়েছি এবং প্রচুর প্রশ্নমালা সমাধান করেছি । এই ভাবে ব্যাপক পড়াশোনার মধ্য দিয়ে আমি যা শিখেছি তার অধিকাংশই আজ চার পাঁচ দশক পরেও আমার স্মৃতিতে সঞ্জীবিত রয়েছে যদিও এই সময়কালে শিক্ষাজগত থেকে অনেক দূরে আমি প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেছি ।
আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় আমার স্থান সুনিশ্চিত করতে আমার যখন যা সাহায্যের প্রয়োজন হত তা আমি প্রথমে আমার স্কুলের ও পরে কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়ে এসেছি । আমার শিক্ষকেরা আমাকে যে ধরণের শিক্ষা দিয়েছেন তার জন্য আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ ।
আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন নিঃস্বার্থ দায়িত্ব পালনের জীবন্ত নিদর্শন । তাঁরা জীবনযাত্রায় ছিলেন সহজ সরল । বিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দরিদ্র । কারো কারো যথোপযুক্ত পরিধেয়ও ছিল না; কেউ কেউ ছেঁড়া-জুড়ে-দেয়া পোষাক পরেও আসতেন । গৃহশিক্ষকের চাহিদাও ছিল যৎসামান্য; গৃহশিক্ষকতা থেকে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগও তাই ছিল সীমিত । তখনকার দিনে শিক্ষকদের জন্য অবসর পরবর্তী পেনসন ব্যবস্থাও ছিল না । এতদ্সত্বেও আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে উদ্যম ও দায়িত্ববোধের অভাব ছিল না । তাঁরা সর্ব্বদা আমাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলেন । ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় বৌদ্ধিক ক্ষমতার অভাবও তাঁদের ছিল না । শিক্ষকতা তাঁদের কাছে কেবলমাত্র একটি বৃত্তি ছিল না, এটি তাঁদের একটি ব্রতও ছিল । আজকের দিনের অধিকাংশ পেশাদার শিক্ষকের মত ওঁরা অর্থের পেছনে ছুটতেন না ।
আমাদের প্রধান শিক্ষক কিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় (ধ্রুব ব্যানার্জি নামে সমধিক পরিচিত) তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কঠোর অনুশাসনের জন্য সুবিদিত ছিলেন । ছাত্ররা তাঁকে সমভাবে ভয় ও শ্রদ্ধা করত । তাঁর মুহূর্তের দর্শন ক্লাসরুমের বাইরে গল্পরত ছাত্রদের ক্লাসে ফেরৎ পাঠাবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল । উনি একজন মহান শিক্ষকও ছিলেন । উঁচু ক্লাসে তিনি আমাদের ইংরেজী পড়াতেন । সহজবোধ্য ব্যাখ্যা ও দক্ষ উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি বিষয়টিকে আকর্ষণীয় করে তুলতেন ।
আমাদের স্কুলের উন্নয়নে ও স্কুলকে সামনের সারিতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ওঁর অনবদ্য অবদান রয়েছে । ওঁর সময়েই আমাদের স্কুল গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথমবার তৃতীয় ও সপ্তম (১৯৫৮) ও দ্বিতীয়বার প্রথম (১৯৬০) স্থান অর্জন করে ।
তিনি একজন কঠোর শৃঙ্খলাবাদীও ছিলেন । ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা কখনো সহ্য করতেন না । এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যেখানে আমাদের এক সহপাঠি (বর্তমানে প্রয়াত} আমাদেরই এক সহপাঠিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে ওঁর হাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল ।
আমাদের সেই শিক্ষকরা কেউই আজ আর নেই । আজকের আমাকে তৈরী করার পশ্চাতে ওঁদের অবদানের কথা স্মরণ করে আমি চিরদিন ওঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব । ওঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ছাত্রদের সঙ্গে ওঁদের একটি গ্রুপ ফটো[7] নিম্নে সংযোজন করলাম ।
প্রধান শিক্ষক কিরণ্মময় বন্দ্যোপাধ্যায়
২০২০ সালে সামাজিক মাধ্যমের একটি পোস্ট থেকে আমি জেনেছি আমাদের শিক্ষক সত্যবিনোদ পাল (উপরের চিত্রে চেয়ারে সপ্তম স্থানে উপবিষ্ট ) একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন । তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও একজন ছিলেন ।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেণ্টারের বাড়বাড়ন্ত
আমাদের কালের বৈপরীত্যে আজকাল গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ ছাত্রজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে । সর্বত্র বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মাকড়সার জালের মত কোচিং সেণ্টার গজিয়ে উঠেছে । পাশাপাশি চলছে গৃহশিক্ষকতার রমরমা কারবার । অল্পবয়সী ছাত্রছাত্রীরা স্কুলফেরৎ বাড়ী এসে কোনক্রমে দু-চার গ্রাস গলাধঃকরণ করেই যখন গৃহশিক্ষকের কিংবা কোচিং সেণ্টারের উদ্দেশে ধাবমান হয় তখন তা দেখে আমি বেদনা বোধ করি । মেধাবী ছাত্ররাও প্রায়শঃ এর ব্যতিক্রম নয় । দিনের শেষে এরা শ্রান্তক্লান্ত হয়ে ফেরে, মন থাকে বিপর্যস্ত । মনকে সতেজ করার মত খেলাধূলো বা অন্যরূপ শিশু বা বালকসুলভ ক্রিয়াকর্মের অবকাশ থাকে না । বলতে গেলে নম্বর উৎপাদক পাঠের যূপকাঠে ওদের শৈশব বলি হয়ে যায় ।
প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেণ্টারের বিস্তারের কারণ
এই অস্বাস্থ্যকর রীতি মূলতঃ সরকারী ও সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে পঠনপাঠনের অপ্রতুলতা হেতু বিস্তার লাভ করেছে । ব্যতিক্রম বাদ দিলে আজকের দিনের শিক্ষকদের অধিকাংশ সাধারণতঃ অর্থলোভী, রাজনৈতিক শ্রেণীভুক্ত এবং নিজ কর্ম্মে অননুরক্ত । এঁরা স্কুলে পঠনপাঠনে ততটা আগ্রহী নন যতটা গৃহশিক্ষকতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে । পাঠ্যবস্তু স্কুলে যথাযথ ভাবে পড়ানো হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হত না । আমার ভাবতে অবাক লাগে এই ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ করে যারা মহানগরীতে বাস করে, শুধু গৃহশিক্ষকের কাছে বা কোচিং সেন্টারে যাতায়াত করতেই কত অমূল্য সময় নষ্ট করে । এটা স্পষ্ট যে দিনের শেষে ওরা শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে ফিরবে, ওদের মধ্যে কদাচিৎ বাড়ীতে পড়াশোনা করার শক্তি অবশিষ্ট থাকবে । আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ছাত্র যদি পরিশ্রমী, পড়াশোনায় অনুরক্ত ও ক্লাসে মনোযোগী হয় এবং শিক্ষক যদি পারদর্শী ও নিজকর্মে অনুরক্ত হন তবে গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেণ্টারের প্রয়োজন হয় না ।
গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা মূলতঃ কোন না কোন স্কুলের শিক্ষক । স্কুলের পাঠ্যসূচী অনুযায়ীই তাঁদের পড়াতে হয় । তাহলে ছাত্রদের সেই বিষয়গুলোতে বাইরে গিয়ে পাঠ নেয়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে সংশ্লিষ্ট স্কুলে যথার্থ পারদর্শী শিক্ষকের অভাব অথবা পারদর্শী শিক্ষকদের যথোপযুক্ত শিক্ষাদানে অনীহা । অর্থাৎ শিক্ষক নির্বাচনে গলদ অথবা নিযুক্ত শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের বাইরে অন্যত্র শিক্ষাদানে আগ্রহী । রাজনীতি, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের ত্রিমুখী আক্রমণে মেধাভিত্তিক নির্বাচন এখন কার্যতঃ দুর্লভ । সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশে বেআইনী ভাবে নিযুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিলীকরণ, কোটি কোটি টাকার বেআইনী অর্থ ও সম্পদ উদ্ধার ও সর্বোপরি গত জুলাই মাসে (২০২২ সাল) শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগের দুর্নীতিতে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও অন্যান্যদের গ্রেফতার এই ভাবনারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ । এই ভাবে ভিন্নপথে নিযুক্ত শিক্ষকরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিপুল সংখ্যায় রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন । ছাত্র পড়ানোর চাইতে নিজেদের নিরাপদ রাখাটা স্বভাবতঃই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ।
অবশ্যই আজকের দিনেও শিক্ষাদানে নিবেদিত প্রাণ ও যথার্থ পারদর্শী শিক্ষক আছেন, তবে তাঁদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য ।
পিতা-মাতার ভূমিকা
অধিকাংশ বাবা-মায়েরাও প্রাইভেট টিউশন ব্যবস্থা বিস্তারে উৎসাহ প্রদান করে চলেছেন । সহজ অর্থের প্রাবল্যে ও পরীক্ষায় সন্তানের উচ্চতর নম্বর সংগ্রহের অভিলাষে এরা সময় উপস্থিত হলে ভাল শিক্ষক বা ভাল কোচিং সেণ্টারের সন্ধানে পাগলের মত ছুটোছুটি শুরু করে দেন ।
প্রাইভেট টিউশনের ক্ষতিকর প্রভাব
প্রকৃতপক্ষে গৃহশিক্ষকতা উপকারের চাইতে অপকার করে বেশী । গৃহশিক্ষকতায় মূল দৃষ্টি পরীক্ষা উত্তরণের জন্য বাছাই করা পাঠক্রমে নিবদ্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের সার্বিক জ্ঞানার্জনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । জনৈক শিক্ষাবিদের মতে "tuition centres have become mark or grade generating factories where the student resorts to ‘reading, cramming and scoring’” গৃহশিক্ষকতার ক্ষেত্রেও সম্ভবতঃ অনুরূপ মূল্যায়ন প্রযোজ্য ।
প্রাইভেট টিউশন সম্পর্কে অন্যান্যদের প্রতিমুখে আমার অভিমত
আমার পর্যবেক্ষণের ভিত্তি বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকালে আমার উপলব্ধ অভিজ্ঞতা হলেও প্রাইভেট টিউশন সম্পর্কিত সমকালীন চর্চা, লেখালেখি ও আলোচনার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ । প্রাইভেট টিউশন আইন করে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারেও বিস্তৃত পরিসরে বিতর্ক হয়েছে; এমনকি আর টি ই (RTE) আইনে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাইভেট টিউশন বন্ধও করে দেয়া হয়েছে । (ঐ আইনের ধারা ২৮ দ্রষ্টব্য)।
প্রাইভেট টিউশনের বিপদ মোকাবিলার পথ
আমার মতে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং যথার্থ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যথেষ্ট সংখ্যক একনিষ্ঠ ও পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রাইভেট টিউশন নামক এই ব্যাধিকে ধীরে ধীরে নির্মূল করা যেতে পারে। অনস্বীকার্য বর্তমান কালে কাজটি খুবই কঠিন । তবে এ ছাড়া উপায়ই বা কি ?
প্রবন্ধ: দি আইডিয়া অব এ টিচার
যারা পড়তে আগ্রহী তাদের জন্য ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশিত অভিজিৎ পাঠক মহোদয়ের একটি মনোগ্রাহী প্রবন্ধের বৈদ্যুতিন সংস্করণ এখানে সংযোজন করলাম ।
আমাদের বিদ্যালয় লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাই স্কুল
আমার স্কুল ও আমি
আমাদের বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সহশিক্ষা ছিল; সপ্তম শ্রেণীতে পৌঁছুলেই মেয়েদেরকে আলাদা করে উঁচু ক্লাশের মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট প্রাতঃকালীন বিভাগে নিয়ে যাওয়া হত । অন্যান্য স্কুলের মত আমাদের স্কুলেও বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপট থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসত । আমি এসেছিলাম দূর্ব্বল আর্থসামাজিক পশ্চাৎপট থেকে যা আমি পরে ব্যাখ্যা করব । সেই কারণে আমি কিছুটা ভীতু ও লাজুক ছিলাম; সহজে কারো সাথে বিশেষ করে মেয়েদের সাথে মিশতে পারতাম না । আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের কথা আগেই বলেছি, তারা সকলেই ছিল ছেলে । ছেলেদের মেয়ে বন্ধু থাকাটা সেকালে ছিল বিরল ঘটনা ।
বিদ্যালয়জীবনে মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক
আমার ক্লাসের সব মেয়েদের এবং নীচু ক্লাসের কয়েক জনকেও আমি নামে ও চেহারায় চিনতাম, কিন্তু বন্ধু বলে বিশেষ কেউ ছিল না । আমি কদাচিৎ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতাম । মেয়েদের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ থাকা সত্বেও ছোটবেলায় মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে আমি সহজ বোধ করতাম না । পারতপক্ষে আমি ওদের এড়িয়েই চলতাম । পরবর্তীকালে আমার সেদিনের সহপাঠিনীদের মধ্যে যাদের সাথে দেখা বা কথা হয়েছে ওরা প্রত্যেকেই অনুযোগ করেছে ছোটবেলা আমি ওদের সাথে কথাই বলতে চাইতাম না ।
এতদ্সত্বেও আমি অতি অল্প বয়সে আমারই ক্লাসের কোন একজন মেয়েকে গভীরভাবে ভালবেসে ছিলাম, যদিও আমার ভীরুতা ও কুণ্ঠার কারণে আমি তাকে তা বলতে পারিনি । বিদ্যালয়কাল থেকে যার সঙ্গে দেখা বা পরবর্তী কয়েক দশক পর্যন্ত বাক্যালাপও হয়নি আমার সেই ভালবাসার জনের নাম ও প্রতিচ্ছবি দীর্ঘকাল আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গভীরভাবে অঙ্কিত ছিল । আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুসহ কেউ তা জানতে পারেনি । এ বিষয়ে বিস্তারিত "আমার জীবনে নারী" নামক অধ্যায়ে পাওয়া যাবে ।
লক্ষ্মী ইউনিয়ন বেঙ্গলী ক্লাব
হরিসভা
লক্ষ্মী ইউনিয়ন বেঙ্গলী হাইস্কুল
অবস্থান ও ক্রিয়াকর্ম
আমাদের স্কুলের (বর্তমানের ছবি উপরে ডানদিকের শেষ প্রান্তে) নিকটস্ত লক্ষ্মী ইউনিয়ন ক্লাব (বর্তমান কালের ছবি উপরে বাম দিকে) নামে বাঙ্গালীদের একটি ক্লাব ছিল । যোরহাটের বাঙ্গালীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রস্থল ছিল এই ক্লাব । এই ক্লাবের একটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল যেখানে সময় সময় আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানও আয়োজিত হত ।
ক্লাবহাউস ও স্কুলের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল হরিসভা মন্দির যেখানে বাঙ্গালীদের পূজো-আর্চা হত । আমরা স্কুলের সরস্বতী পূজোও ওখানেই করতাম । ১৯৫৮-৫৯ সালে আমাদের তত্ত্বাবধানে হরিসভা মন্দিরে অনুষ্ঠিত স্কুলের সরস্বতী পূজোর একটি প্রতিচ্ছবি ডান পাশে দেখা যাচ্ছে।
ক্লাব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আভ্যন্তরীণ ক্রিড়া প্রতিযোগীতা, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করত এবং সেই সঙ্গে সমাজসেবা মূলক বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যাপৃত থাকত । হরিসভা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করত, স্কুল ছিল বিদ্যাশিক্ষার কেন্দ্র । তিনটি বিভিন্নধর্ম্মী প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকে তরুণ বাঙ্গালী মনে সর্বাত্মক বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল ।
১৯৫৮-৫৯ সালের বিদ্যালয়ের সরস্বতী পূজার চিত্র ।
গঠন ও বিন্যাসের পরিবর্তন
২০০৭ সালে এই এলাকা সফর কালেই আমি লক্ষ্য করেছিলাম সময়ের সাথে এই স্থানের ভবনগুলোর গঠন ও বিন্যাস পরিবর্তিত হয়েছে । ভবনগুলোর মধ্যস্থিত পূর্বেকার উন্মুক্ত স্থানের চিহ্ণমাত্র আর ছিল না । স্কুল ভবনের চতুর্দিকে দেয়াল, ভবনের মধ্যভাগে একটি তল ও দক্ষিণ দিকে একটি দ্বিতল পার্শ্বভাগ যোগ হয়েছিল । তবে স্থানে স্থানে রং উঠে গিয়ে ভবনটির বহির্ভাগ মলিন দেখাচ্ছিল । স্কুল ভবনের দক্ষিণে একটি পার্শ্বভাগ যোগ হওয়ায় হরিসভা ও স্কুলভবনের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত প্রাঙ্গনটি লোপ পায় । হরিসভার সম্মুখস্থ প্রাঙ্গনটিও হরিসভার নিজস্ব সম্প্রসারণ হেতু বিলুপ্ত হয় । ফলতঃ পুরো এলাকাটি অতিমাত্রায় ঘিঞ্ঝি ও শ্বাসরোধকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
পরবর্তী কালে ২০১৮ সালে যোরহাট ভ্রমণকালে দেখেছি বিদ্যালয় ভবনের বহিরাঙ্গে নতুন রঙের প্রলেপ পড়েছে, প্রবেশপথে একটি তোরণও যুক্ত হয়েছে । তবে তোরণটি বিদ্যালয়ের প্রথিতযশা প্রধান শিক্ষক স্বর্গীয় কিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয়ের নামে নামাঙ্কিত হলে যোগ্য ব্যক্তির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও বিদ্যালয়ের পক্ষে গৌরববাহী হত বলে মনে হয় ।
ক্লাবের শতবার্ষিকীর সমাপ্তি অনুষ্ঠান ও স্কুলের প্রাক্তনীদের সম্বর্ধনা
লক্ষী ইউনিয়ন হাইস্কুলের প্রাক্তনীদের দেওয়া মানপত্র
আমার ২০১৪ সালের মার্চ মাসে যোরহাট সফর কালে ঐ ক্লাব শতবার্ষিকী পালন করছিল । ঐ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি দিবসে (যা আমার অবস্থান কালের মধ্যে পড়েছিল) ক্লাব কর্তৃপক্ষ আমাকে ১৯৬০ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়ে "যোরহাটকে গৌরবান্নিত" (ওদের কথা, আমার নয়) করার জন্য সম্বর্দ্ধনা জ্ঞাপন করেন । ক্লাব কর্তৃপক্ষ ৭৫ বৎসরের অধিক বর্ষীয় সদস্যদের সম্বর্দ্ধনা দিচ্ছিলেন । যোরহাটে আমার অবস্থিতির কথা জানতে পেরে ওঁরা বিশেষ ভাবে আমাকে ঐ সম্বর্দ্ধনায় অন্তর্ভূক্ত করেন । যদিও আমি কখনও ঐ ক্লাবের সঙ্গে কোন ভাবেই যুক্ত ছিলাম না এবং আমার বয়সও তখন ৭৫এ পৌঁছয় নি । ঐ অনুষ্ঠান চলাকালীন বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির তদানীন্তন (২০১৪ সাল) সভাপতি দীপক ভট্টাচার্য মহাশয় আমাকে বিদ্যালয়কক্ষে স্কুলের পরিচালন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অনুরোধ জানালে দিন কয়েক পূর্বে ঘটে যাওয়া কোন এক অবাঞ্ছিত ঘটনার [10] পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার অক্ষমতা জ্ঞাপন করি । যোরহাটে বসবাসকারী লক্ষী ইউনিয়ন হাই স্কুলের প্রাক্তনীরা পরদিন সন্ধ্যায় ঐ স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ডে স্কুলের সর্বশেষ পরীক্ষায় এতাবৎ কাল একমাত্র প্রথম স্থানাধিকারী হিসাবে আমাকে সম্বর্দ্ধনা জ্ঞাপন করেন । এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির সভাপতি যিনি নিজেও বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র । ওঁদের প্রদত্ত সম্বর্ধনালিপির একটি প্রতিচ্ছবি বাম পাশে সংযোজন করলাম । মানপত্রের সঙ্গে উপহার হিসাবে একটি ঢাকাওয়ালা হোরাই[11], একটি অসমীয়া গামছা ও একটি পাঞ্জাবীর পরিমাণ তসর সিল্কের কাপড় ছিল । জীবনের পথ পরিক্রমার এই শেষ পর্যায়ে এসে প্রথম যৌবনের কৃতিত্বের বিষয়টি নিয়ে নাড়া চাড়া হ’ক, আমি চাই নি । কিন্তু বিশেষ অন্তরঙ্গ ও স্নেহভাজন দু-একজনের অনুরোধে উভয়ক্ষেত্রেই ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আমাকে রাজী হতে হয়েছিল ।
পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে আমি ও আমার বন্ধু আশু ওরফে আশুতোষ পাল যখন আসাম ভ্রমণকালে যোরহাট গিয়েছিলাম সেই সময় লক্ষ্মী ইউনিয়ন স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । একদল শিক্ষার্থীর সাথে আমাদের অধিবেশন হয় । শিক্ষক-শিক্ষিকারাও উপস্থিত ছিলেন । তারিখটা ছিল ২০১৬ সালের ১৭ই ফ্রেব্রুয়ারী । আমার বক্তব্যে আমাদের সময়ের শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ ও ছাত্রদের সম্পর্কে উদ্বেগ, আগ্রহ ও সংবেদনশীলতা এবং সাধারণ ভাবে ছাত্রদের পড়াশুনার প্রতি গভীর অনুরাগের কথাই প্রাধান্য পেয়েছিল । আমি ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি যত্নবান হতে ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম । পড়াশুনা ও পরীক্ষা-প্রস্তুতি সম্পর্কে ছাত্রদের তরফে কিছু প্রশ্ন ছিল । নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে ওদের আমি একটি কথাই বলেছিলাম, বিদ্যা অর্জনের কোন সহজ পথ নেই আর কঠোর পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই (there is no short-cut to learning and no alternative to hard labour) । অনুষ্ঠানটি বিদ্যালয়ের অধিবেশন কক্ষে হয়েছিল, যা আমাদের সময় ছিল না ।
প্রাক্তনীদের দেওয়া উপহার, "হোরাই"
লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাই স্কুলের অধিবেশন কক্ষে ছাত্র ও শিক্ষদের সাথে ইণ্টারেক্টিব অধিবেশনের দৃশ্য
লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাই স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মিদের মধ্যে আমি
বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রবেশকালে আমার অনুভূতি
অধিবেশন গৃহে (বিদ্যালয় থেকে দূরে বিদ্যালয়ের বর্দ্ধিত প্রাঙ্গনে স্থাপিত) যাওয়ার পূর্বে আমরা মূল বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলাম । শেষবার যখন এখানে পদার্পণ করেছিলাম তারপর পাঁচ দশকের অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে । বাল্যে এবং প্রথম যৌবনে যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ছিলাম আজ এত বছর পর তার মৃত্তিকার স্পর্শ হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় অনুভূতির সঞ্চার করল । হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত পুরনো দিনের সুখস্মৃতি এক লহমায় জেগে ওঠল, আমি নস্টালজিক হয়ে পড়লাম । আমার মন সেই দিনগুলোতে চলে গেল যখন আমি এই প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে তোষিতার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যাকুল হয়েছিলাম । এই স্মৃতি আমার মনে একযোগে বেদনা ও আনন্দ উভয়েরই সঞ্চার করল । যে পারিপার্শ্বিকে ভালবাসার উদ্গম হয়েছিল তার চিত্র পরিস্ফুট হয়ে হৃদয়কে উদ্বেলিত করল । আবার সেই ভালবাসা উন্মিলিত হওয়ার পূর্বেই নিমীলিত হয়ে যাওয়ার বেদনামিদুর স্মৃতি হৃদয়ে বিষণ্ণতার সৃষ্টি করল ।
অসমীয়া নামঘর
অসমীয়া লোকেদের জন্য স্কুলভবনের পার্শ্ববর্তী জমিতে হরিসভার বিপরীতে একটি নামঘর ছিল । সেখানে মাদল বাদন সহ উচ্চৈস্বরে ঈশ্বরের নাম সংকীর্তন হত । কখনো কখনো তা আমাদের পড়ায় বিঘ্ন ঘটাত । ২০০৭ সালের সফরকালেও আমি নামঘরে ঐ বিশালকায় মাদল গুলো দেখেছি । আমার ঐ সময়ে তোলা শ্রীমন্ত শঙ্কর মন্দির নামের এই নামঘরটির একটি ছবি ডান পাশে দেখা যাচ্ছে ।
আমাদের দুর্দশার শুরু
আমার স্কুলশিক্ষার এই সময়ে (১৯৫৬-৫৭ সাল) ও তৎপরবর্তী কালে আমার স্নাতক শিক্ষাকাল পর্যন্ত আমরা এক কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম । মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় বাবা প্রেসের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন; বাবার আত্মমর্যাদা বোধ ছিল অতীব প্রখর ।
নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা ও স্থান পরিবর্তন
বাহাদূর সিং এর বাড়ীতে প্রেসটি চিহ্নিত স্থানে প্রতিষ্টিত ছিল: বর্তমানের চিত্র
আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বাবা মানসিক শক্তি হারালেন না । এরপর নিজে একটি প্রেস স্থাপন করার প্রচেষ্টায় রত হলেন । কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ ওঁর হাতে ছিল না । নিরলস প্রচেষ্টায় ও জনাকয়েক শুভানুধ্যায়ীর সাহায্যে (যাঁদের মধ্যে তদানীন্তন শিবসাগর জেলার জেলাশাসক বি. এল. সেন মহোদয়ও ছিলেন) বাবা আসাম সরকারের উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পূণর্বাসন দপ্তর থেকে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ঋণ হিসাবে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন । ঐ ঋণের টাকায় "দাস এণ্ড সন্স প্রিন্টিং ওয়ার্কস" নামে একটি ছোট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন । প্রেসটি প্রাথমিক ভাবে যোরহাটের গড়-আলি রোড ও জে. পি. আর. রোডের সংযোগস্থলে জে সি বরুয়া নামে জনৈক অসমীয়া ভদ্রলোকের ভাড়া ঘরে স্থাপিত হয় । অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটিকে জে পি আর রোডের ভিতর দিকে কম ভাড়ার একটি এক কামরার ঘরে স্থানান্তর করা হয় । ঐ ঘরের মালিক ছিলেন বাহাদূর সিং নামে জনৈক পাঞ্জাবী ব্যবসায়ী; ভাড়া ছিল মাসিক দশ টাকা । সেই স্থানের বর্তমান কালের একটি ক্যাপশনযুক্ত চিত্র বাম পাশের প্যানেলে প্রদর্শিত হল । তিন মাসের বকেয়া ভাড়া নিয়ে গৃহমালিকের দুর্ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসটি পরে রাস্তার বিপরীত দিকে রাকেশ দাস নামে জনৈক বাসন ব্যবসায়ীর ভাড়া বাড়ীতে স্থানান্তরিত হয় । ঐ প্রতিকূল অবস্থায় উক্ত রাকেশ দাস মহাশয় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন । ওঁর স্ত্রীও একজন অমায়িক ও সহৃদয়া মহিলা ছিলেন । দুর্ভাগ্যবশতঃ ওঁদের কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না । পরবর্তী কালে ঐ বাড়ীতে আমাদের বসবাসের[12] জন্য ভিতরের দিকে প্রেসের লাগোয়া আরও দুটি ঘর ভাড়া নেয়া হয় । বাড়ীটিতে আরও কয়েকজন ভাড়াটে থাকতেন, কিন্তু পরিবেশ ছিল শান্ত । এখান থেকেই আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম; সে কথা স্থানান্তরে আলোচিত হবে । যাহোক্, প্রেসটি পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবসার দিক থেকে শ্রেয়তর গড়-আলি ও জে. পি. আর রোডের সংযোগস্থলের প্রাথমিক অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । আমাদের বাসস্থান অপরিবর্তিত রইল এবং সম্মুখের প্রেসের ছেড়ে যাওয়া ঘরটিও বাসস্থানের সঙ্গে যুক্ত হল।
প্রারম্ভিক ও অন্তিম পর্যায়ে প্রেসটি চিহ্নিত স্থানে প্রতিষ্টিত ছিল: বর্তমানের চিত্র
শ্রীরাকেশ দাস ও স্ত্রী তরুবালা দাস
অপ্রত্যাশিত অশালীন দৃশ্য
আগেই বলেছি পুনর্স্থানান্তরিত প্রেসের এই বাড়ীটির মালিক ছিলেন জে. সি. বরুয়া মহোদয় । রাস্তার লাগোয়া এই বাড়ীটির সামনের দিকে ছিল দুটি ঘর ও পেছন দিকে একটি ঘর; ভাড়া ছিল সম্ভবতঃ চল্লিশ টাকা । পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে ডান পাশের ক্যাপশনযুক্ত বর্তমানকালীন চিত্রে (ডান পাশের প্যানেলের প্রথম ছবি) প্রেসবাড়ীটি যে স্থানে ছিল তার অবস্থান নির্দেশ করা হয়েছে । প্রেসের ঘরের সংলগ্ন অনুরূপ দুটি ঘরে আমাদের একজন শিক্ষক অমলেন্দু পুরকায়স্থ মহাশয়ের একটি বই এর দোকান ছিল । এর লাগোয়া ঘরে ছিল একটি দর্জির দোকান । শেষ প্রান্তে দু কামরার একই প্রকার একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন একজন পাহাড়ী আদিবাসী[13] মহিলা । তিনি শীতকালে কমলালেবুর ব্যবসা করতেন । মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোক ওঁর ওখানে এসে থাকতেন । তিনি ঐ মহিলার ব্যবসায়ের অংশীদার বলে পরিচয় দিতেন । একদিন বাবা আমাকে ঐ মহিলার কাছ থেকে আমাদের একটি হাতুড়ী ফেরৎ আনতে পাঠালেন । তখন ছিল পড়ন্ত বেলা, মহিলার ঘরের দরজা ছিল ভেজানো । দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে গিয়ে আমি থমকে দাঁড়ালাম, বিছানায় ঐ বাঙালী ভদ্রলোক ও মহিলা আপত্তিকর অবস্থায় শায়িত । ওঁরা আমার উপস্থিতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না, বোধহয় ভাবলেন আমি নেহাতই বালক । আমি বালক ছিলাম ঠিকই, কিন্তু বিষয়টির তাৎপর্য বোঝার মত বয়স আমার হয়েছিল । যাহোক, মহিলা হাতুড়িটি কোথায় রয়েছে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, আমি হাতুড়িটি নিয়ে ফিরে এলাম । ঘটনাটির কথা কাউকে না বলাটাই সমীচীন মনে করেছিলাম ।
প্রেস-বাড়ীর মালিক জে.সি. বরুয়া
আমাদের প্রেসের পশ্চিমে গড়-আলি রোডের উপর প্রেসবাড়ীর মালিক জে. সি. বরুয়া মহোদয়ের নিজের একটি খুচরো যন্ত্রাংশের দোকান ছিল । শীতকালে গলায় মাফ্লার, মাথায় টুপি পরা বরুয়া মহাশয়ের চেহারা এখনও আমার চোখে ভাসে, দেখা হলেই “এই লোৰা, কেনেকুৱা আছা” (এই ছেলে, কেমন আছ ?) বলে কুশল জিজ্ঞেস করতেন । তিনি প্রায়ই বাবাকে বলতেন, "আপুনি দেখিব, আপুনাৰ এই লোৰাটো খুব বড় হব" (আপনি দেখবেন, আপনার এই ছেলেটি খুব বড় হবে)। তিনি খুব কাছ থেকে আমাকে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে প্রেসে কাজ করে বাবাকে সাহায্য করতে দেখেছিলেন ।
প্রেসের কার্য নির্বাহে আমার অভিষেক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়
প্রেসের জন্য নিয়মিত কর্ম্মী রাখার ক্ষমতা বাবার ছিল না; সাময়িক ও কর্ম্মভিত্তিক পারিশ্রমিকে নিয়োজিত কর্ম্মীদের দিয়ে এবং নিজে সারাক্ষণ কাজে লেগে থেকে প্রেস চালনা করতেন । আমি বরাবর সংবেদনশীল ও কর্তব্যপরায়ণ । আমি বাবার জন্য কষ্ট বোধ করতাম; তাঁর পরিশ্রম কিছুটা লাঘব করার জন্য আামি নিজে থেকে প্রেসের কাজকর্ম্ম যথা কম্পোজ করা, ফর্মা তৈরী করা, প্রুফ দেখা, মেশিন চালনা শিখতে লাগলাম । আমি তখন সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি । মনোযোগী শিক্ষার্থী হওয়ায় অল্প সময়েই বিষয়গুলো আমার অধিগত হল । বিভিন্ন ছাপার কাজের মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতিও আমি শিখলাম । এই ভাবে প্রেস চালনায় কার্যকরী শিক্ষালাভের পর অবসর সময়ে, বিশেষ করে স্কুল ছুটির পর এবং রবিবারে ও অন্যান্য ছুটির দিনে বাবাকে প্রেসের কাজে সাহায্য করতে লাগলাম । কখনও কখনও বাবার অসুস্থতা বা অন্য কারণে অনুপস্থিতির সময় আমি প্রেসের দায়িত্বে থাকতাম । পরীক্ষার মরসুমে ও নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রেসে কাজের চাপ খুব বেড়ে যেত । প্রশ্নপত্র[14] ও ভোটার তালিকা ছাপার কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হত । উভয় প্রকার কাজেই সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকার দরুণ আমাকে ঐ সময় প্রেসে অধিকতর সময় ব্যয় করতে হত । তবে কখনই তা স্কুলে অনুপস্থিত থাকার বা পড়াশুনায় ফাঁকি দেয়ার কারণ হয়ে ওঠেনি । প্রেসের কাজে ব্যয়িত অতিরিক্ত সময় আমার গভীর রাতে পড়ার নির্ঘণ্টকে প্রসারিত করে পুষিয়ে নিতাম । আমার ভাগ্নী সুলেখা ঐ সময় কিছুদিন আমাদের কাছে ছিল । ও আমার চেয়ে খুব বেশী ছোট ছিল না এবং আমার খুব প্রিয় ছিল । সেও কম্পোজ করতে শিখে নিয়েছিল এবং আমাদের কাজে সাহায্য করত । আমার দাদাও কখনও নিজে থেকে কখনও বা মায়ের পীড়াপীড়িতে প্রেসের মেশিন চালাতে ও অন্যান্য কাজে সাহায্য করত । আমাদের একমাত্র ছাপার মেশিনটি ছিল একটি ট্রেডিল বা পায়ে চালানো মেসিন; ঐটি চালাতে যথেষ্ট পরিমাণ শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হত । অনেক সময় সাময়িক ভিত্তিতে মেসিন চালাবার লোক পাওয়া যেত না; তখন বাবা নিজেই মেসিন চালাতেন । বাবার বয়স তখন ষাট-বাষট্টি । বাবাকে মেসিন চালাতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হত । আমি চালাতে চাইতাম, কিন্তু বয়স অল্প বলে বাবা সচরাচর রাজি হতেন না । কয়েক বছর পর সম্ভবতঃ আমার কলেজ জীবনের প্রথম দিকে বাবা আরো এক হাজার টাকা সরকারী ঋণ হিসাবে সংগ্রহ করে মেসিনটি চালাতে একটি ইলেক্ট্রিক মটর লাগিয়েছিলেন । প্রেসটি তখনও জে. সি. বরুয়া মহাশয়ের ভাড়া বাড়ীতেই ছিল । এই প্রসঙ্গে বলে রাখি বাবা হাজারো অসুবিধার মধ্যেও কখনো কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত ঋণ নেন নি । এই গুণটি আমাদের মধ্যেও বর্তেছিল । আমার এক বন্ধু অবশ্য আমার বাড়ী তৈরীর সময় আমার অবস্থা দেখে জোর করে আমার হাতে দশ হাজার টাকার একটি চেক ধরিয়ে দিয়েছিল । আমি প্রথম উপলব্ধ সুযোগে তা পরিশোধ করে দিয়েছিলাম । এ ছাড়া আমি বা দাদা কখনো কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত ঋণ নি-ই নি ।
এই অনুচ্ছেদের শেষে একটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করার দাবী রাখে । তা হল প্রেসে ছাপতে আসা বিষয়বস্তু সমূহের মুদ্রাক্ষর একত্রীকরণ ক্রিয়া (Composing work) আমার ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল ।
বাবার পায়ে এক মারাত্মক চর্মরোগ ও তার চিকিৎসা
সেই সময় একবার বাবার পায়ে ভয়ঙ্কর ধরণের এক চর্মরোগ হয়েছিল । প্রথমে এটি চামড়ার উপরে ফোঁড়ার আকারে দেখা দিত, তারপর ফেটে গিয়ে মাংসপেশীর গভীরে প্রবেশ করত । গোড়ালির উপর থেকে হাটুর নীচ পর্যন্ত এরূপ অনেকগুলো ক্ষত দেখা দিয়েছিল । যোরহাটের স্বনামধন্য চিকিৎসক অবসর প্রাপ্ত সিভিল সার্জেন ডঃ রবীন্দ্রনাথ দেব ওরফে ডঃ রবি দেব বাবার চিকিৎসা করছিলেন । আমিই বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম । একদিন অন্তর ডাক্তারবাবু ক্ষতস্থান পরীক্ষা করতেন ও পরিস্কার করে ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতেন । কিন্তু কোন উন্নতি হচ্ছিল না, ক্ষতগুলো দিন দিন গভীরে প্রবেশ করছিল । আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলাম । এমন সময় একদিন আমাদের প্রেসে একজন সাধারণদর্শন গ্রাম্য অসমীয়া ব্যক্তি এলেন । তিনি বাবার পায়ের ক্ষত দেখে ঐ সম্বন্ধে বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন । যাওয়ার আগে বলে গেলেন পরে যেদিন আসবেন এক প্রকার গাছের পাতা ও এক প্রকারের তেল নিয়ে আসবেন যা ব্যবহারে বাবার রোগের উপশম ঘটবে । দিনকয়েক পর তিনি ঐ তেল ও পাতা নিয়ে এলেন এবং বাবাকে ব্যবহার প্রণালী বুঝিয়ে দিলেন । একজন গ্রাম্য সাদাসিদে মানুষের স্বল্পপরিচিত এক ব্যক্তির জন্য কতটা সহমর্মিতা থাকতে পারে এটা তার এক জ্বলন্ত নিদর্শন । এঁরাই মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিচয়বাহক । বাবা বিনা দ্বিধায় ঐ তেল ও পাতা ব্যবহার করতে লাগলেন । ফল হল বিস্ময়কর । এক পক্ষ্মকালের মধ্যে ক্ষত নিরাময় হতে শুরু করল । ছয় মাসের এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় যে রোগের বিন্দুমাত্র উন্নতি দেখা যায় নি, একজন গ্রাম্য মানুষের দেশীয় চিকিৎসায় মাত্র মাস দুয়েকের মধ্যে তা সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেল । ঐ গ্রাম্য ব্যক্তির চিকিৎসা এরূপ বিস্ময়কর ভাবে কার্যকরী[15] হল । ঐ ব্যক্তি আমাদের কাছে ঈশ্বর প্রেরিত বলে প্রতীয়মান হলেন । যতদূর মনে পড়ে তিনি এর জন্য আমাদের কাছ থেকে কোন মূল্যও নেন নি । বাবা ওঁকে একখানা ছাতা উপহার দিয়েছিলেন । আমাদের দেশের অজানা অখ্যাত গ্রামে-গঞ্জে এমন অনেক মেধা রয়েছে যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদান রাখতে পারে । কিন্তু উপযুক্ত সুযোগের অভাবে এই মেধা সকলের অজান্তে অকালেই ঝরে যায় । ইহা আমাদের দূর্ভাগ্য ।
পড়াশোনায় একাগ্রতা
যাহোক, আমাদের এই দুর্দিনে আমি কখনও আমার পড়াশুনায় বিঘ্ন ঘটতে দিই নি । আমাদের সংস্কৃত শিক্ষক প্রায়শঃ উদ্ধৃতি দিতেন, “छात्राणां अध्ययनम् तपः ।” আমি এই নীতিবাক্যে বিশ্বাস করতাম এবং বাবা ও পরিবারকে সাহায্য করার সাথে সাথে নিজের জীবনে এই নীতি অনুসরণ করার সর্বাঙ্গীন প্রয়াস নিতাম । আমার দৈনন্দিন পাঠ সম্পূর্ণ করতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতাম । কখনও কখনও ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসত । তখন চোখে জল ছিটিয়ে ঘুম তাড়াতাম । এতৎ সত্ত্বেও কখনও কখনও হয়ত টেবিলের উপর বা চেয়ারের পেছনে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম । মা আমার উপর নজর রাখতেন । ঐ ভাবে টেবিল বা চেয়ারের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে দেখলে তিনি আমায় বিছানায় যেতে বাধ্য করতেন । সেক্ষেত্রে আমি ভোর রাতে উঠে আমার পাঠ শেষ করতাম । তখন আমার ঘুমোবার সময় ছিল খুবই সীমিত; দৈনিক চার-পাঁচ ঘণ্টা, কখনো বা তারও কম । হয়ত বা এই জন্যই পরবর্তী জীবনে নিদ্রাহীনতা আমার সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় ।
পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতা
রাকেশ দাসের যে ঘরে আমি লেখাপড়া করতাম
বিদ্যালয় জীবনে দারিদ্র্য ও আনুষঙ্গিক কারণে চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে । সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা আগেই বলেছি । এখানে পারিপার্শ্বিক ও তৎসংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ করছি ।
আমাদের গৃহে বিজলী বাতি ছিল না, আমি কেরোসিন বাতির আলোয় পড়াশুনা করতাম । কেরোসিন অঢেল পাওয়া যেত এবং বরাবরের মত এটি ছিল গরীবের জ্বালানী । কেরোসিনের দহনজাত কার্বণে লণ্ঠনের চিমনিতে ঝুল জমে আলোর দ্যুতি কমিয়ে দিত । মা প্রতিদিন লণ্ঠনের চিমনী পরিস্কার করে ফিতে সমান করে রাখতেন । গ্রীষ্মকালের গরমে আমি হাত পাখা ব্যবহার করতাম । ঐ সময় এক হাতে পাখা, অপর হাতে বই ও কলম এই নিয়ে মশক কুলের দৌরাত্মের মধ্যে চলত আমার বিদ্যাসাধনা । রাকেশ দাস মহাশয়ের ভাড়াবাড়ীর যে ঘরে আমি পড়াশুনা করতাম তার বর্তমানের একটি প্রতিচ্ছবি পার্শ্বে সন্নিবিষ্ট হল; ঘরটিতে দৃষ্ট দ্রব্যসামগ্রী তখন ছিল না এবং ঘরটি আরো একটু দীর্ঘ ছিল । চিত্রে প্রদর্শিত তৎকালীন এই কক্ষটিতে আমার শোয়ার একটি তক্তাপোষ ও পড়ার একটি ছোট টেবিল ছিল । কক্ষটির চিত্রে প্রদর্শিত অংশের নীচের দিকের মেঝেতে (যা চিত্রে দৃষ্ট নয়) আমার মা, বড়দিদি ও তার কন্যা সুলেখা (যারা কিছুদিনের জন্য আমাদের কাছে থাকতে এসেছিল) শয়ন করতেন ।
আমার মেট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতির শেষ দিকে আমাকে আরও একটি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় । আমি ঐ সময় উপর্যুপুরি ৩/৪ বার জ্বরে আক্রান্ত হই, সেই সঙ্গে ছিল বমি । এতে আমি শারীরিক ভাবে দূর্বল হলেও উদ্যম হারাই নি ।
এই সকল প্রতিবন্ধকতা আমার পাঠে বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি বা আমার অন্তর্নিহিত চালিকাশক্তিকেও দূর্বল করতে পারেনি । প্রকারান্তরে এগুলো আমাকে আমার লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়চিত্ত করেছিল । আমার পরবর্তী জীবনের ঘটনাবলী থেকে দেখা যাবে আমি সাধারণ ভাবে শৃঙ্খলাপরায়ণ, কর্ত্তব্যনিষ্ঠ, দৃঢ়সংকল্প[16] ও অকুতোভয় ছিলাম যদিও বয়োপ্রাপ্তির পূর্বে দু একটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে আমার অস্থিরচিত্ততা ও সাহসের অভাব দেখা যেতে পারে । আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমার শৈশবের সংগ্রাম ও পরবর্তীকালে মিশনারী কলেজ হোষ্টেলের নিয়ন্ত্রিত জীবন আমার চরিত্রে এই বৈশিষ্ঠ্যগুলির সন্নিবেশ ঘটাতে সক্রিয় ভাবে সাহায্য করেছে । আমার কাজে, তা সে যে কাজই হোক, আমি সর্বদাই আন্তরিক।
আমাদের হাল
আমার বিদ্যালয় জীবনে আমরা এক শোচনীয় আর্থিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম । পিতৃদেব চাকুরী ছেড়ে দেওয়ায় নিয়মিত অর্থাগমের পথ বন্ধ হয়ে গেল । প্রেসের আয় নিয়মিত ও জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না । ঐ সময় আমার দাদার বাইরে বেরোবার জন্য একপ্রস্তের বেশী পোষাক পর্যন্ত ছিল না; প্রয়োজনে ঐ পোষাক রাত্রিবেলা কেচে নিয়ে পরদিন ব্যবহার করতে হত । তোষকের নিচে রেখে আমাদের জামা কাপড় পাট পাট (creased) করা হত । দাদা নিজের খরচ চালাতে ও যতটা সম্ভব পরিবারকে সাহায্য করতে গৃহশিক্ষকতা করত, তবে তাও সুলভ ছিল না । মা ঘর-গৃহস্থালীর সব কাজ নিজেই করতেন । রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর গৃহস্থালী পরিপাটি রাখা ইত্যাদি ছাড়াও প্রায়শই তাঁকে বাসস্থানের চৌহদ্দির ভিতরের কল থেকে জল বয়ে আনতে হত । তাঁকে সাহায্য করতে কাজের লোক নিয়োগ করার ক্ষমতা আমাদের ছিল না ।
দারিদ্র্যের মোকাবিলায় আমার ভূমিকা
ঐ সময় আমি ছাত্রবৃত্তির যে অর্থ পেতাম তা মূলতঃ পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় হত । এমতাবস্থায় পাঠক্রম-বহির্ভূত ক্রিয়াকলাপে অংশ গ্রহণ করার সময়, মানসিকতা বা উপায় কোনটাই আমার ছিল না । আমি কদাচিৎ খেলাধূলো করতে বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে যেতাম । এমন নয় যে যেতে চাইলে বাবা মা বাধা দিতেন, তাঁরা বরং যাওয়ার জন্য উৎসাহিতই করতেন । কিন্তু আমার অন্তরাত্মা আমাকে বাধা দিত; যে অবসর সময়টুকুতে প্রেসে কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করার সুযোগ ছিল তা খেলাধূলোয় বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা-গল্পে ব্যয় করতে আমার মন সায় দিত না ।
কষ্টের দিনেও তোষিতা আমার মনে জাগ্রত: আমার মানসিক গঠনে প্রভাব
এই পৃষ্ঠায় প্লেয়ারটি যদি না খোলে, উর্দ্ধমুখী তীর চিহ্নে ক্লিক করুন । নতুন একটি পৃষ্ঠা খুলবে ও গানটি বাজবে ।
আমাদের এই কঠিন সময়েও আমি কিন্তু তোষিতাকে ভুলতে পারিনি । মাঝে মাঝেই তোষিতার চেহারা আমার মনে ভেসে উঠত । তোষিতা অনেক দিন আগেই আমাদের স্কুল ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কোথায় জানতাম না । সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় ওর বাড়ীতে গিয়ে ওর খোঁজ করাও সম্ভব ছিল না । দৈবাৎ যদি দেখা হয়ে যায় এই আশায় কখনও কখনও জনপ্রিয় স্থানগুলি ঘুরে বেড়াতাম, কিন্তু সে আশাও পূর্ণ হয়নি । আমি প্রায়ঃশই ওর চিন্তায় নিমগ্ন থাকতাম, কিন্ত এই চিন্তা যেন জীবনে সাফল্য লাভের পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে যত্নবান ছিলাম । আমার ভালবাসাকে হৃদয়ের নিভৃতে বন্দি রেখে আমার মনোযোগ আরও অধিক পরিমাণে পড়াশোনায় কেন্দ্রীভূত করলাম । এই প্রক্রিয়ায় আমি এমন একটি মানসিক গঠন তৈরী করলাম যার দ্বারা আমি আমার ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্খাকে মনের একটি অংশে আবদ্ধ রেখে নিজেকে কর্তব্যে ও দায়িত্বে নিয়োজিত করতে পারতাম; কেউ সে বিষয়ে কোন আঁচই পেত না । তাই তোষিতা সম্পর্কে আমার গভীর অনুভূতি সত্বেও আমার কৃতিত্ব অর্জনে বা আমার কর্তব্য সম্পাদনে তা কোন বাধার সৃষ্টি করেনি । এমন কি আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুবান্ধব সহ কেউই এ বিষয়ে বিন্দুবিসর্গও আঁচ করতে পারেনি ।
মনকে এই সময় নিয়ন্ত্রণে রাখলেও পরবর্তীকালে আমার মনের এই সময়কার অবস্থাকে কবিগুরুর 'দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি' এই গানের কলির অনুরণন বলেই মনে হয়েছিল । তাই এই গানটি আমার অতি প্রিয় । আমার তখনকার অনুভূতিকে রূপ দিতে গানের কথা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গীত গানটি এখানে সংযোজন করলাম ।
[এখানে উল্লিখিত "তোষিতা" নামটি আমি বাল্যে যে মেয়েটিকে মনে মনে ভালবেসেছিলাম তার কল্পিত নাম । এ বিষয়ে বিস্তারিত এই ওয়েবসাইটের "আমার জীবনে নারী" এই অধ্যায়ে পাওয়া যাবে ।]
দিবস রজনী
দিবস রজনী, আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।
তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি॥
চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই, সদা মনে হয় যদি দেখা পাই--
'কে আসিছে' বলে চমকিয়ে চাই কাননে ডাকিলে পাখি॥
জাগরণে তারে না দেখিতে পাই, থাকি স্বপনের আশে--
ঘুমের আড়ালে যদি ধরা দেয়, বাঁধিব স্বপনপাশে।
এত ভালোবাসি, এত যারে চাই, মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই--
যেন এ বাসনা ব্যাকুল আবেগে, তাহারে আনিবে ডাকি॥
পরিবার ও পিতা-মাতার প্রতি নিষ্ঠা
পরিবারের প্রয়োজন ও সম্মান সর্বদা আমার ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্খার উর্দ্ধে স্থান পেয়েছে । তাই আমার ভালবাসার পাত্রীর কাছে পৌঁছুতে আমি নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করতে পারিনি ।
পরবর্তীকালে বৃদ্ধ পিতামাতার দায়িত্ব এঁড়িয়ে নিজের ক্যারিয়ারের সন্ধানে বহির্বিশ্বে পদক্ষেপ করাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি । ঐ সময় জব-ভাউচার নিয়ে বিদেশ যাত্রা সহজতর ছিল । আমার পরিচিত অনেকেই ঐ ভাবে বিদেশ গিয়ে স্থিত হয়েছিল । শিক্ষাজীবনের কৃতিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে স্কলারশিপ যোগাড় করাও হয়ত অসম্ভব ছিল না । সংসার প্রতিপালনের জন্য আমার ভ্রাতৃদেবেরও তখন নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা ছিল । আমার গৃহকাতরতাও ইতিমধ্যে তিরোহিত হয়েছিল । আমার কয়েকজন সহপাঠি তথা বন্ধুও ঐ সময়ে বিদেশ যাত্রার তোড়জোড় করছিল । পরবর্তী জীবনে ওরা বিদেশে বসতি স্থাপনেও সমর্থ হয়েছে । কিন্তু বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য উদ্বেগ ও দুর্ভাবনা আমাকে দেশত্যাগ করা থেকে বিরত করেছে । এর ফলে হয়ত আমি আমার ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়েছি, হয়ত ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে স্বদেশে কোন কোন ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অসহনীয় বেদনা ভোগ করেছি । কিন্তু দিনের শেষে আমি সন্তুষ্ট যে আমি বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতার কাজে লাগতে পেরেছিলাম । তথাপি ওঁদের দেহত্যাগর সময় দুজনের কারো কাছেই থাকতে পারি নি বলে বেদনা বোধ করি ।
একজন সহায়ক নিয়োগ
আমার বিদ্যালয় জীবনের শেষ ভাগে যখন আমাদের আর্থিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হল তখন প্রেসের খুচরো কাজের জন্য একটি নেপালী ছেলেকে নিযুক্ত করা হল । ছেলেটি আমাদের সাথেই থাকত ও ঘর-গৃহস্থালীর কাজে মাকেও সাহায্য করত । এই ছেলেটি একটি সরল ও আমোদদায়ক চরিত্র ছিল । কিছুক্ষণ কাজ করার পরই ও বিশ্রাম করতে বসে পড়ত । ঐ সময় কেউ ওকে কোন কাজ করতে বল্লে ও ওর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গীতে বলে উঠত, “आभी आराम करेगा” । আমরা তা খুব উপভোগ করতাম । পরবর্তীকালেও পারিবারিক জমায়েতে এই বিষয় উল্লেখ করে আমরা আনন্দ উপভোগ করেছি ।
দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা
দারিদ্র্যকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং এর দংশন অনুভব করেছি । আমি শৈশবে ও প্রখম যৌবনে যে অবস্থায় ছিলাম নিজের প্রচেষ্টায় আজ সেখান থেকে অনেক উপরে উঠে এসেছি । এটা বলার অপেক্ষা রাখে না এই স্থানে পৌঁছুতে জীবনের টানা পোড়নের মধ্য দিয়ে আমাকে অনেকটা পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে আর এই চলার পথে সময় বিশেষে অন্যের সাহায্যও আমার প্রয়োজন হয়েছে । এখানে যে কথাটা বলা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করি তা হল আমি আমার অতীতকে ভুলিনি; আমি বিশ্বাস করি অতীত মানুষকে দূরদৃষ্টি দেয় । অতীতকে আমি ভবিষ্যতের পথনির্দেশক রূপে দেখি । অতীতের ভুল থেকে আমরা ভবিষ্যতের শিক্ষা পাই । প্রখ্যাত দার্শনিক, কবি, প্রাবান্ধিক ও ঔপন্যাসিক জর্জ সানটায়ানা ১৯০৫ সালে তার রীজনস ইন কমনসেন্স নামক পুস্তকে বলেছেন, "যারা অতীতকে মনে রাখতে পারে না, তারা ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে বাধ্য” (Those who cannot remember the past are condemned to repeat it".) ।
আমি চোখের সামনে দেখেছি আমার ভগ্নীদ্বয় ও মাতুলবর্গের কেউ কেউ যাঁরা নিজ বাসভূমিতে প্রাচূর্যের মধ্যে দিন কাটাতেন তাঁরা দেশত্যাগ করে ভারতবর্ষে আসার পর কি চরম দারিদ্রের সম্মুখীন হয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পর্যাপ্ত খাদ্য ও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অকালে মারাও গিয়েছিলেন । আজ যখন আমি নিজের গাড়ী চালিয়ে এখানে ওখানে যাতায়াত করি তখন আমাদের অতীতের কষ্টের দিনগুলোর অনেক কথাই মনে পড়ে । মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা যখন আমার বাবাকে প্রেস স্থাপনের পাঁচ হাজার টাকার সরকারী ঋণের জন্য দিনের পর দিন অফিস কাছারীতে ধরণা দিতে হয়েছে । এই প্রেক্ষাপটে নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে অর্থ ব্যয়ে আমার মন বিদ্রোহ করে । গাড়ীটিও আমি অবসরের প্রায় এক দশক পর সমস্ত পারিবারিক দায় থেকে মুক্ত হয়ে মহানগরীর জীবনে বৃদ্ধ বয়সের আবশ্যকতা ও সঙ্কট কালের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে কিনেছিলাম । অদ্যাবধি (২০২২ সালের পরিপ্রেক্ষিতে) এটি অসুখে বিসুখে ও রাতবিরেতে অত্যাবশ্যক প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্য ভাবে সাহায্য করেছে ।
গরীবদের জন্য আমার কষ্ট হয়, বিশেষ কিছু করে উঠতে পারি না । যখন কোন দুঃস্থ লোককে দেখি ফেলে দেওয়া খাবারের অংশ আবর্জনার স্তুপ থেকে সাগ্রহে সংগ্রহ করছে, যখন স্মরণ করি আমার নিকটাত্মীয়দের দু-একজন প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে অকালে মারা গিয়েছেন তথন আমি গভীরভাবে ব্যথিত হই । এই পরিপ্রেক্ষিতে যখন দেখি আমারই গৃহে ঘন ঘন খাদ্য দ্রব্যের অপচয় হচ্ছে তখন আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি; প্রায়শঃ ইহা আমাদের গৃহবিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । আমার সর্বাঙ্গীন প্রচেষ্টা সত্বেও এই অপচয় রোধ করা সম্ভব হয়নি । এই যন্ত্রণা সর্বদাই আমাকে দগ্ধ করে । নজরে এলে কখনো কখনো উদ্বৃত্ত গ্রহণীয় খাদ্য আশে পাশের দু-একজনের মধ্যে বিলিয়ে অপচয় রোধের চেষ্টা করি ।
আশা করি, আমি এতক্ষণে আমার শৈশবের উপান্তে আমাদের পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থার চিত্র ও তৎসহ আমার মানসিক গঠন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা দিতে পেরেছি ।
হিন্দু বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুত্রপাত ও ফলাফল
আমি আবার প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলাম; তবে তা প্রয়োজনীয়ও ছিল । প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলি, আমাদের মেট্রিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল । “বঙ্গাল খেদা” নামে এক বাঙ্গালী বিরোধী আন্দোলন সমগ্র উপত্যকাকে গ্রাস করেছিল । আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির আসামে অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে গণ্য করার প্রস্তাব গ্রহণ করাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনের উৎপত্তি । স্বভাবতই আসামে বসবাসকারী অ-অসমীয়ারা এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি । তা থেকেই বিরোধের সূচনা ও আন্দোলনের সূত্রপাত । ইতিপূর্বে ১৯৬০ সালের জুন মাসে গৌহাটির কটন কলেজের বাঙ্গালী ছাত্ররা অসমীয়াকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের একমাত্র মাধ্যম করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয় । আসামের অ-অসমীয়া এলাকার মানুষেরা অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করল । এই আন্দোলন শক্তি ধারণ করলে অসমীয়া আন্দোলনকারীরা সর্বশ্রেণীর অসমীয়া জনগণের সমর্থনে হিংস্র হয়ে উঠল । এক বৃহদাংশ অসমীয়ার মধ্যে বাঙ্গালী বিরোধী মানসিকতা তীব্রভাবে প্রতিভাত হল । ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী বাঙ্গালী হিন্দুদের অনেককে হত্যা করা হল, অনেকের বিষয় সম্পত্তি ধ্বংস হল বা লুণ্ঠিত হল । খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ অবাধে চলতে লাগল । যথেচ্ছ হিংসা ও হুমকি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীরা আসামের বিধান সভায় অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বিল আনতে সক্ষম হয় । এটা ছিল উত্তর-পূ্র্বাঞ্চলকে বাঙ্গালীশূূন্য করার একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ । লক্ষণীয় ভাবে বাঙ্গালী মুসলমানদের স্পর্শ করা হয়নি । অনেক শহরে কার্ফু জারী হল ও দাঙ্গা দমনে কোথাও কোথাও সশস্ত্র বাহিনীকে নিযুক্ত করা হল । আমার মনে পড়ে আমরা ঐ সময় যোরহাটে রাকেশ দাস মহাশয়ের যে বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম তার সম্মুখের রাস্তা জে. পি. আর রোড দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি দলকে মার্চ করে যেতে দেখেছিলাম । যে সকল বাঙ্গালীর উপায় ছিল তাঁরা আসাম থেকে পালিয়ে যেতে লাগলেন । উইকিপেডিয়া অনুযায়ী আন্দোলন চলাকালীন পঞ্চাশ হাজার বাঙ্গালী হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে এবং নব্বই হাজার বরাক উপত্যকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন ।
বিশদ বিবরণের জন্য কে. সি. চক্রবর্তী মহাশয়ের ১৯৬০ সালের ৩০শে জুলাই ইকনমিক্স উইকলিতে প্রকাশিত "১৯৬০ সালের বঙ্গাল খেদা আন্দোলনের উৎপত্তি ও ফলাফল" নিয়ে লিখিত ইংরাজী প্রবন্ধ নিম্নে দ্রষ্টব্য ।
যোরহাট ত্যাগের বাধ্যকরণ পরিস্থিতি
আমার মেট্রিকের ফলের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অনেক শুভানুধ্যায়ী বাবাকে পরামর্শ দিলেন, আমাকে বিক্ষুব্ধ এলাকার বাইরে নিয়ে যেতে । বাবা স্থির করলেন, সাময়িক ভাবে প্রেস বন্ধ রেখে শহর ত্যাগ করবেন । মধুর স্মৃতিময় এই শহর ছেড়ে যেতে হবে জেনে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল । কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্য কোন উপায় ছিল না ।
অনতিবিলম্বে একদিন আমি বাবা, মা ও দাদার সঙ্গে শিলচরের উদ্দেশে ট্রেনে চড়লাম । বরাক উপত্যকায় অবস্থিত শিলচর আসামে হলেও বাঙ্গালীপ্রধান এলাকা । লামডিং জংশন পর্যন্ত আমরা কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙ্গালী ভদ্রলোকের, যাঁদের মধ্যে আমার ভগ্নীপতি এবং বাড়ীওয়ালা রাকেশ দাস মহাশয়ের দূরসম্পর্কের ভাইপো তথা লক্ষী ইউনিয়ন হাই স্কুলের প্রাইমারী বিভাগের শিক্ষক রবীন্দ্র নাথ দাস মহাশয়ও ছিলেন, নিরাপত্তায় গিয়েছিলাম । লামডিং থেকে অপর একটি ট্রেনে উত্তর কাছাড়ের পার্বত্য এলাকার মধ্য দিয়ে আমরা শিলচর গিয়েছিলাম । রেলপথের এই অংশ যা উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলপথে "হিল সেক্সন্" নামে পরিচিত রেলের পরিমাপে তা ছিল মিটার গজ । একটি বিপদসঙ্কুল ভূখণ্ডের উপর দিয়ে এই রেলপথ স্থাপন করতে দু’ দশকের (১৮৮২ - ১৯০৩) অধিক সময় লেগেছিল ।
এই রেলপথের আধুনিকীকরণ
সময়ের সাথে সাথে এই পথের আনুপূর্বিক পরিবর্তন হয়েছে । লাইনটি মিটার গজ থেকে ব্রডগজে রূপান্তরিত হয়েছে, অনেক জায়গায় গতিপথের পূণর্বিন্যাস হয়েছে ও করিমগঞ্জের পর গতিপথ আগরতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে । সম্পূর্ণ পথটির বৈদ্যুতিকরণ হয়েছে । শিলচর থেকে গুয়াহাটি পৌঁছুতে এখন সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা আগে যেখানে লাগত প্রায় ২৪ ঘণ্টা । এছাড়া শিলচর-করিমগঞ্জ-আগরতলা গমনাগমন সহজতর ও সময়-সংক্ষেপ হয়েছে । ভারতের অন্যান্য স্থানের সাথে এই অঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে ।
জোরহাট-শিলচর যাত্রা: যাত্রাপথের নৈসর্গিক দৃশ্য
এই যাত্রাপথ এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন । আজও (শেষ ভ্রমণ ডিসেম্বর, ২০২৩ সাল) আমি এই পথে যাতায়াত অন্তর দিয়ে উপভোগ করি । যাঁরা এই পথে কখনও ভ্রমণ করেন নি তাঁদের জন্য এই পথের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ না করে পারছি না । তবে এই বিবরণী পূর্ববর্তী মিটারগজ রেলপথের সাপেক্ষে । এখানে প্রদত্ত ছবিগুলো অবশ্য ২০০৭ সালে তোলা; পথটি তখনও মিটার গজ ছিল ।
আমার কথিত সময়ে (১৯৬০ সাল) এই পথে ট্রেন ৩৭টি সুড়ঙ্গ (ডান দিকের চিত্রে একটি ট্রেনকে এরূপ একটি সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে দেখা যাচ্ছে) এবং অন্যুন ৫৮৬টি সেতু অতিক্রম করে । এই সুড়ঙ্গগুলোর কয়েকটি খুবই দীর্ঘ এবং অভ্যন্তরে নিকষ কালো অন্ধকার । অবশ্য সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে স্থানে স্থানে কম আলোর বিজলী বাতি লাগানো রয়েছে । মাহুর নামক স্থানের নিকটে ১১নং সুড়ঙ্গটি ছিল দীর্ঘতম, দৈর্ঘ্যে ১১৯২ ফুট । ডিজেল বা ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনের তখনও আবির্ভাব হয়নি; কয়লার ইঞ্জিনই ট্রেনকে টেনে নিয়ে যেত ।
ট্রেন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলে কামরার দরজা-জানালা বন্ধ রাখা হত । পোড়া কয়লার গ্যাসে কামরার ভিতর শ্বাসরোধকারী পরিবেশের সৃষ্টি হত ।
সেতুগুলো ছিল মূলতঃ গিরিখাতের উপর দিয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ট্রেন যাতায়াতের সংযোগ পথ । এই সেতুগুলোর নীচে গভীর গিরিখাত দেখতে পাওয়া যায় । এই গিরিপথের স্থানে স্থানে ট্রেন গভীর নিম্নে প্রবহমান জাটিংগা নদীর[17] গতিপথ বরাবর একেবেঁকে চলে । নদীটি যেন লুকোচুরি খেলে চলে; কখনও দৃশ্যমান, আবার কখনও বা অদৃষ্ট । নদীর জল স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ; নদীখাতের পাথরগুলো অনেক উপরে চলন্ত ট্রেন থেকে পরিস্কার দেখা যায় । ট্রেন থেকে তোলা জাটিংগা নদীর একটি অংশ ডান পাশের ছবিতে দেখা যাচ্ছে । এই রেলপথের স্থানে স্থানে বিভিন্ন আয়তন, আকার ও বর্ণের অপরূপ সুন্দর অনেক পাহাড়ী ফুল দেখা যায়; এই ফুলগুলো কখনও কখনও ট্রেন থেকে হাতে ছোঁয়া দূরত্বে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ট্রেন যখন পাহাড়ের খাড়াই এর পাশ দিয়ে বা কোন পাহাড়ের বিভাজিত অংশের মধ্য দিয়ে ছুটে চলে । শীতকালে পাহাড়ের মধ্য থেকে সূর্য উঠে এসে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে । হারাঙ্গাজাও নামক স্টেশন থেকে জাটিংগা[18] স্টেশন পর্যন্ত অংশে ট্রেন হয় খাড়া চড়াই (steep incline) বেয়ে উপরে উঠে নতুবা খাড়া ঢাল (deep decline) বেয়ে নীচে নামে । তাই ট্রেনের বগিগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে টেনে তোলার জন্য বা ধরে রাখার জন্য যাত্রাপথের এই অংশে দুটি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় । অনেক ঢিলেমির পর অধুনা (২০০৮ সাল) এই লাইনটিকে মিটারগজ থেকে ব্রডগজে রূপান্তিত করা হয়েছে । যাত্রাপথ পূণর্বিন্যাসের ফলে পুরনো পথের দৃশ্যের অনেকটাই হয়ত আর দেখতে পাওয়া যাবে না ।
উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের তৈরী এই পথের অধুনালুপ্ত অংশে চলন্ত ট্রেণের ভিডিও দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুন https://youtu.be/9x139xCZQic বা ঐ ঠিকানায় যান ।
বর্তমানকালীন এই পথের ভিডিও https://youtu.be/u19fiDVEArM এই ঠিকানায় দেখা যাবে ।
সহসা পাহাড় শেষ হয়ে যায়, ট্রেন সমতলে নেমে আসে । এর পর ট্রেন চা-বাগিচার বা দু পাশের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটে চলে বদরপুর নামক জংশন স্টেশনে এসে পৌঁছয় । সেখান থেকে সমতল পথে বরাক নদীর অববাহিকায় শিলচর । লামডিং থেকে শিলচর ২১৩ কি. মি. এর এই দূরত্ব অতিক্রম করতে ট্রেনের সময় লেগেছিল প্রায় ১২ ঘণ্টা । যাত্রাশেষে মরিয়াণী-লামডিং-বদরপুর হয়ে আমরা শিলচর পৌঁছুলাম রওয়ানা হওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ।
তখনকার দিনে ট্রেনে ভ্রমণ যথেষ্ট কষ্টকর ছিল । নীচু শ্রেণীতে আজকের মত তখন শয়নকামরা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না । আমরা তৄতীয় শ্রেণীতে ভ্রমণ করেছিলাম; সারা পথ আমাদের ভীড়ে ঠাসা কামরাতে বসে যেতে হয়েছিল । হাফলং নামক স্টেশনে খাবার সংগ্রহ করতে আমাদের প্রায় যুদ্ধ করে বাইরে আসতে হয়েছিল ।
[এখানে সংযোজিত ছবিগুলো ২০০৭ সালের আসাম ভ্রমণের সময় তোলা ।]
গুহায় প্রবেশকালীন একটি ট্রেণের দৃশ্য: উঃ পূঃ রেলের লামডিং-বদরপুর সেক্সন
বদরপুর-লামডিং শাখায় একটি তীক্ষ্ণ বাঁকের মুখে ট্রেণ
লামডিং-বদরপুর শাখায় ট্রেণ থেকে তোলা জাটিংগা নদীর চিত্র
পাহাড়ের ঢালের মাঝে শীতের সকালের ঘনীভূত কুয়াশা লামডিং-বদরপুর রেলপথে
পার্বত্য অঞ্চলের পর চা-বাগিছার পাশ দিয়ে ট্রেণের যাত্রাপথ
শিলচরের মাতুলালয় যেখানে আমরা উঠেছিলাম
আমার ছোটমামা পূর্ব-পাকিস্থান ছেড়ে এসে শিলচরে বরাক নদীর তীরে কাঠের আসবাবপত্রের ব্যবসা শুরু করেছিলেন । শিলচরে আমরা প্রথমে সাময়িক ভাবে ওঁর কাছেই উঠলাম । তিনি শিলচর শহরের নাজিরপট্টি নামক এলাকায় জনৈক গোবিন্দবাবুর বাড়ীতে আড়াই খানা ঘরে ভাড়া থাকতেন । স্ত্রী ও ছোট ছোট চার ছেলেমেয়ে ছাড়াও ছোটমামার সাথে তাঁর পরিবারের অংশ হিসাবে থাকতেন মামার বৈমাত্রেয় ভাই আমাদের ঋষিমামা ও আমার বাবার দূর সম্পর্কের এক মামা অশ্বিনীবাবু যাঁকে আমরা দাদামশায় বলে ডাকতাম । অশ্বিনী দাদামশায় পেন্সনার ছিলেন । সেই সময় মায়ের বড়মামাও সেখানে অবস্থান করছিলেন । আর্থিক অনটন ও তীব্র স্থানাভাব সত্বেও মামা আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
বাড়ীর মালিক গোবিন্দবাবুর একটা ছাতার দোকান ছিল বাড়ীর সম্মুখভাগে । বাঁ পাশে ছাতার দোকানটির ছবি, ২০২৩ সালের শিলচর ভ্রমণকালে তোলা । দোকানটি যথাস্থানে বিদ্যমান, যদিও মালিক দীর্ঘদিন গত । গোবিন্দবাবু এই দোকানটির পিছন দিকে সপরিবারে বাস করতেন । ছাতার দোকান ও গোবিন্দবাবুর বাসগৃহের মধ্যভাগে ছিল মামাদের বাসগৃহ । গোবিন্দবাবুর এক ছেলে চয়ন ও এক মেয়ে শীলার কথা আমার মনে আছে ।
বাবার চাকুরী যোগাড় ও বাসস্থান পরিবর্তন
পরে বাবা স্থানীয় একটি প্রিন্টিং প্রেসে চাকুরি নিলে আমরা গুরুচরণ কলেজসংলগ্ন টিকরবস্তী নামক স্থানেএকটি আলাদা বাড়ী ভাড়া নিয়ে সেখানে চলে যাই । যতদূর মনে পড়ে পরবর্তীকালে দাদা গুরুচরণ কলেজে লেকচারার পদে যোগ দেয়ার পরও এই বাড়ীতেই অধিষ্ঠিত হয়েছিল । এখানেই পিতৃদেব দেহত্যাগ করেন । বিয়ের পর ঝর্ণা বৌদি (দাদার প্রথমপক্ষের স্ত্রী) এই বাড়ীতেই উঠেছিলেন এবং এখানে থাকাকালীনই সন্তান প্রসবকালে মৃত্যু বরণ করেন ।
যোরহাটের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে প্রত্যাবর্তনের সহায়ক না হওয়া পর্যন্ত বাবা এখানে উল্লিখিত প্রেসে চাকুরীরত ছিলেন ।
আমার কলেজ পরিক্রমা
আসামের ভাষাদাঙ্গা তথা বঙ্গালখেদা আন্দোলনের ফলে যোরহাট ত্যাগ করে শিলচরে আশ্রয় নেয়ার পর আমার কলেজে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় এল । এই পর্যায়ে স্থিত হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন কারণে আমি স্থান থেকে স্থানান্তরে একাধিক কলেজ পরিবর্তন করেছি । আমার সেই কলেজ পরিক্রমার বিষয়টিই এই অংশে লিপিবদ্ধ করেছি ।
প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলিকাতা
কলেজে প্রবেশ
শিলচরে সুনীল এন্দো[19] নামে ছোটমামার পরিচিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয় । তিনি আমাকে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন ও প্রয়োজনে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । সেই অনুযায়ী একদিন (সম্ভবতঃ মাসটা ছিল আগষ্ট, সাল ১৯৬০) সকালের বিমানে দাদা ও মিঃ এন্দোর সঙ্গে আমি কোলকাতা পাড়ি দিলাম । সেই আমার প্রথম বিমান ভ্রমণ ও প্রথম কোলকাতা দর্শন । কোলকাতা পৌঁছে আমরা জানতে পারলাম প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়ার শেষ তারিখ পেরিয়ে গেছে । কিন্তু মিঃ এন্দো সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না । তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য নির্মল কুমার সিদ্ধান্ত মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ধার্য করালেন । সেই অনুযায়ী নির্দ্দিষ্ট সময়ে উপাচার্যের ১নং লাউডান ষ্ট্রীটের[20] বাড়ীতে আমরা ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম । ওঁর হস্তক্ষেপে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রি-ইউনিভার্সিটি[21] বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলাম । কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার থাকার সমস্যা সমাধানে হোষ্টেলে আবাসের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলেন । সুপরিচিত অঙ্কশাস্ত্রবিদ সনৎ বসু মহাশয় ঐ সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন । হিন্দু হোষ্টেলের অধীক্ষক ছিলেন স্বনামধন্য বাংলার অধ্যাপক হরপ্রসাদ মিত্র ।
কলেজ ত্যাগ
কিন্তু ঘটনা প্রবাহ বিপরীতমুখী হল । আমি হোমসিক বা গৃহকাতর হয়ে পড়লাম । আমি বাবা-মার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলাম, কখনও ওঁদের ছেড়ে বাইরে থাকিনি । আমি দাদাকে বল্লাম বাড়ী থেকে এত দূরে আত্মীয় বন্ধুহীন এই শহরে থেকে পড়াশোনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । আসামের এক ছোট শহর থেকে আসা এই দারিদ্র্য-পীড়িত টীন-এজারের মনে মহানগরী ভীতির সঞ্চার করেছিল । তাছাড়া মনের গভীরে যোরহাটের অস্বাভাবিক অবস্থা ও তজ্জনিত কারণে পরিবারের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা আমাকে উদ্বিগ্ন করেছিল । পরিবারের তৎকালীন আর্থিক অবস্থায় এই দূরদেশে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব ছিল সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল । পরিবারের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে আমার পূর্ণ পরিচিতি থাকায় এই দ্বিধা সহজেই মনকে আবিষ্ট করেছিল । দাদা অনেক করে বোঝাল, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা বল্ল, কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী হলাম না । অগত্যা সে আমাকে শিলচর ফিরিয়ে নিয়ে গেল ।
এত কাণ্ড করে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়াটাই আমার বিফলে গেল । এখানেই আমার প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষালাভের উদ্যোগের ইতি ।
একজন অসাধারণ দরদী মনের মানুষের সংস্পর্শলাভ
শিলচরে সুনীল এন্দো নামের ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার স্বল্পক্ষণের পরিচয় । কিন্তু তিনি আমার জন্য যা করেছিলেন তার তুলনা হয় না । এই স্বল্প পরিচয়েও কেবলমাত্র আমার কৃতিত্বের বিবেচনায় আমাকে উন্নততর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সুযোগ করে দিতে তিনি স্বপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন । নিজব্যয়ে আমাদের সঙ্গী হয়ে কোলকাতা এসেছিলেন । প্রেসিডেন্সিতে ভর্তির শেষ তারিখ পেরিয়ে গেছে জেনেও পিছিয়ে যান নি । স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিলেন । সর্বাবস্থায় চেয়েছিলেন আমি যেন ঐ প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাই । অথচ আমি ওঁর কেউ নই । এমন হৃদয় ক' জনের হয় ? আমি অনুতপ্ত ওঁর এই সর্বাঙ্গীন প্রচেষ্টার মূল্য দিতে পারি নি । আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমাকে তা দিতে দেয় নি । আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ বলে ওকে ছোট করব না, বলব আমি ওঁর কাছে অসীম ঋণী, যে ঋণ কখনো শোধ করা যায় না । আমার পরম সৌভাগ্য এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম । ওঁর কাছে আমার একটা গুরুতর অপরাধ হয়েছে । কোলকাতা থেকে ফিরে কলেজে ভর্তির টালমাটালে ওঁর সাথে আমার আর দেখা করা হয়নি । এই ঔচিত্যবোধটা বোধহয় আমার মধ্যে তখনও জাগেনি । আমাকে কেউ এটা স্মরণ করিয়েও দেয় নি । পরে বুঝেছি দারিদ্র্যের পীড়নে মানুষের সুক্ষ্মবোধগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় । আজ যখন সেই ঔচিত্যবোধটা পূর্ণমাত্রায় জাগ্রত তখন সেদিনের সেই বিচ্যুতির জন্য মন অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত ।
আজ উনি কোথায় জানি না । তবে যেখানেই থাকুন, আমার এই অনভিপ্রেত বিচ্যুতির জন্য তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন এই প্রার্থনা করব ।
প্রেসিডেন্সি ত্যাগের সিদ্ধান্তের বিশ্লেষণ
আমার প্রেসিডেন্সি ত্যাগের এই সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল? এ নিয়ে আমি পরবর্তী কালে অনেক ভেবেছি ও বিভিন্ন দৃষ্টকোণ থেকে এর পর্যালোচনা করেছি । আমার মনে হয়েছে সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও সঠিক ছিল । প্রথমতঃ একদিকে যেমন প্রেসিডেন্সির আবহাওয়ায় পড়াশোনা করে উচ্চতর শিখরে পৌঁছুবার সম্ভাবনা প্রবল ছিল অপর দিকে অভিভাবকহীন অবস্থায় মোহময়ী মহানগরীর বর্ণময় জীবনের মোহে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও কম ছিল না, বিশেষতঃ যখন ঐ বয়সে আমার আত্মবিশ্বাস যথেষ্ট দৃঢ়তা লাভ করেনি । দ্বিতীয়তঃ পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিত হয়েছে কোনভাবেই আমার পড়ার আংশিক খরচও ঐ সময় পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না । সমস্ত আনুষঙ্গিকতা সম্পূর্ণ করে আমার স্কলারশিপের টাকা পেতে কম করে মাস দুই-তিন সময় লাগত । সেই সময় খরচ চালাবার টাকার কোন সংস্থান ছিল না । সেই সময় পরিবারের আয়ের কোন উৎসই[1] ছিল না । থাকা-খাওয়া ও তৈজসপত্র সহ আমার পড়ার সম্পূর্ণ খরচ বহন করা ত দূরের কথা জীবিকা নির্বাহই দুষ্কর ছিল । পরবর্তী পর্যায়েও এই স্কলারশিপের টাকা কয়েক মাস অন্তর অন্তর থোকে থোকে আসত । অন্তর্বতীকালে বাবার আয় থেকে আমার দূরদেশে শিক্ষাখাতে অর্থের সংস্থান করা সম্ভব ছিল না । তাছাড়া কোন স্কলারশিপের টাকাই নিজের বাসস্থানের বাইরে পড়াশোনার খরচ যোগাবার পক্ষে যথেষ্ট নয় । সেই যুগে হলেও একমাত্র ঐ টাকায় (মাসিক পঞ্চাশ টাকা) কলেজের বেতন, হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার খরচ, বইপত্রাদির মূল্য ও আনুষঙ্গিক খরচাপাতি বহন করা সম্ভব ছিল না; অতিরিক্ত অর্থ নিজেদের পরিপূরণ করতে হত । বাবা পরে যখন শিলচরে একটা স্বল্প মাইনের চাকুরী যোগাড় করেন তখনও মাইনের এই টাকায় বাড়ীভাড়া সহ পরিবারের সব খরচ মিটিয়ে কোলকাতায় আমার শিক্ষা সম্পর্কিত ব্যয়ের কোন অংশই বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না । তাই কোন এক সময় আমাকে প্রেসিডেন্সি ছেড়ে আসতেই হত । আর মাঝপথে ছেড়ে আসতে হলে তার ফল হত ভয়াবহ । আমার জীবনে উঠে দাঁড়াবার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যেত । তাই কারণ যাই হোক, প্রসিডেন্সিতে পাঠ জীবনে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অধিকতর সম্ভাবনাময় হলেও, প্রসিডেন্সি ছেড়ে এসে আমি আমার এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করেছি ও অনেক ভবিষ্যৎ জটিলতা পরিহার করতে পেরেছি বলেই আমি মনে করি ।
[1] আমি যখন প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হতে যাই সেই সময় যোরহাটে আমাদের প্রেস ভাষা-দাঙ্গার দরুণ তালাবন্ধ ছিল । কবে সেই তালা খুলবে তারও কোন স্থিরতা ছিল না । আমার দাদার কোন আয়ের উৎস ছিল না । যোরহাট ত্যাগের পর আমার বাবারও কোনরূপ আয় ছিল না ।
করিমগঞ্জ কলেজ, আসাম
কলেজে প্রবেশ
কোলকাতা থেকে বাড়ী (শিলচর) ফেরার পর আমার খুব তাড়াতাড়ি কোন স্থানীয় কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন ছিল । সময় তড়িৎ গতিতে বয়ে যাচ্ছিল । দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা করতে না পারলে আমার একটি শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল । এমতাবস্থায় আমার প্রথম কাজ হল একটি ভাল কলেজ খুঁজে বার করা । খোঁজখবর নিয়ে জানলাম নিকটবর্তী করিমগঞ্জ শহরের কলেজটি মোটামুটি ভাল কলেজ । আমি তাড়াতাড়ি ঐ কলেজের ইন্টারমিডিয়েট বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে গেলাম । কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার জন্য কলেজ হোষ্টেলে থাকার ব্যবস্থাও করে দিলেন । আমার মেট্রিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভর্তি সংক্রান্ত সমস্ত ফি মকুব করে দিলেন ও আমাকে ফ্রীস্টুডেন্টশিপ মঞ্জুর করলেন । ক্লাশ শুরু হতে দেরী ছিল । ভর্তি হওয়ার পর আমি বাবার সঙ্গে শিলচর ফিরে এলাম; বাবা আমাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন । আমি ভর্তি হলাম ঠিকই, কিন্তু খুশী হতে পারলাম না; বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম । জায়গাটা আমার পছন্দ ছিল না ।
একটি যোগ: কলেজ পরিবর্তনের নতুন সম্ভাবনা
আমি যখন এরূপ নিরানন্দ মনের অবস্থায় করিমগঞ্জ কলেজে ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম সেই সময় একদিন স্কুলের বন্ধু প্রদীপের (পুরো নাম প্রদীপ কিশোর রায়, ডাকনাম দীপু) কাছ থেকে ডাকে একটি চিঠি পেলাম । স্বাভাবিক ভাবে মেট্রিক পরবর্তী পর্যায়ে আমার কলেজ পরিক্রমা করিমগঞ্জেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা । কিন্তু দীপুর চিঠি পরিস্থিতি বদলে দিল । এখানেই বোধহয় ডেস্টিনি নামক অতিপ্রাকৃত শক্তির আবির্ভাব । আমরা এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যোরহাট ছেড়ে এসেছিলাম । আসার আগে বন্ধুবান্ধব কারো সাথেই দেখা হয়নি, কাউকে ঠিকানা দেয়া ত দূরের কথা । আমি নিজে শিলচর গিয়ে ছোটমামার কাছে উঠব এইটুকুই জানতাম, সেই বাড়ীর ঠিকানাও আমার জানা ছিল না । আমরা তখন প্রায় ভাসমান অবস্থায় ছিলাম । এরূপ অবস্থায় কি ভাবে দীপুর লেখা পোস্টকার্ড আমাদের কাছে পৌঁচেছিল তা আজও আমার কাছে বিস্ময় ।
আমার শিক্ষাজীবনে দীপুর চিঠির তাৎপর্য
দীপুর এই চিঠিটিই ছিল সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের সঙ্গে আমার একমাত্র যোগসূত্র । এই চিঠিটি আমার কাছে না পৌঁছুলে আসামের প্রথম শ্রেণীর ঐ কলেজে আমার পড়ার প্রশ্নই আসত না; আমার কলেজ পরিক্রমা ইতিমধ্যে করিমগঞ্জে এসে স্থিত হয়ে গিয়েছিল । আমার জীবন প্রবাহ তখন কোন খাতে বইত আর আমি আজ যেখানে পৌঁচেছি সেখানে আদৌ পৌঁছুতে পারতাম কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে । আমার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই চিঠিটি তাই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ।
দীপুর চিঠি: বার্তা ও প্রভাব
দীপু লিখেছিল, ও শিলংএ সেন্ট এন্থোনিজ কলেজে ভর্তি হয়েছে; আমি ওখানে গেলে দুজনে একসাথে থেকে পড়াশোনা করতে পারব । দীপু আরো জানিয়েছিল, সেন্ট এন্থোনিজ কলেজ কর্তৃপক্ষ বলেছেন আমি ঐ কলেজে ভর্তি হলে বিনা বেতনে কলেজে শিক্ষা ও বিনা খরচে হোষ্টেলে আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবেন । চিঠি পড়ে আমি খুবই উল্লসিত হলাম । সেকালে সেন্ট এন্থোনিজ কলেজ ছিল আসামের প্রথম সারির কলেজগুলোর মধ্যে একটি । তাছাড়া শিলং এর নিজস্ব আকর্ষণ ছিল । আসামের তদানীন্তন রাজধানী হওয়ার সুবাদে করিমগঞ্জের তুলনায় শিলং ছিল অনেক বেশী উন্নত এবং ওখানকার সংযোগ ব্যবস্থা ছিল উৎকৃষ্টতর । ওখানে সুযোগ সুবিধাও ছিল অনেক বেশী । শিলং এর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করার মোহ ত ছিলই । আমি আগে কখনও পার্বত্য শহর দেখিনি, সেদিক থেকেও এক দুর্বার আকর্ষণ ছিল । সর্ব্বোপরি আমার স্কুলের সহপাঠি দীপু ওখানে ছিল; মাতাপিতার ছত্রছায়া ছেড়ে নিজের শহরের বাইরে অবস্থান কালে পুরনো সহপাঠির সান্নিধ্য অবশ্যই কাম্য ছিল । কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে শিলং এ পড়াশোনাটা আমাদের পক্ষে আর্থিক দিক থেকেও সহায়ক ছিল । শিলং আসামের রাজধানী হলেও বিশ্বজনীন (Cosmopolitan) হওয়ার ফলে ও বাঙ্গালীদের সংখ্যাধিক্য হেতু অসমীয়া-বাঙ্গালী বিরোধের পটভূমিতে স্থানটি ছিল নিরাপদ ।
করিমগঞ্জ কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনে মা-বাবার বা দাদার কোন আপত্তি ছিল না । কিন্তু যেহেতু আমি ইতিমধ্যে করিমগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম, আসামের অন্য কলেজে যেতে হলে ট্র্যান্সফার সার্টিফিকেট নেয়া আমার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল । করিমগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের কাছে ট্র্যান্সফার সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করলাম । তিনি প্রথমে আমাকে ঐ কলেজে থেকে যাওয়ার জন্য অনেক বোঝালেন । আমি রাজী না হওয়ায় তিনি আমাকে ভর্তির সময় যে সকল ফি মকুব করা হয়েছিল তা জমা দিতে বল্লেন । সেই ফি ও তৎসহ নির্দ্দিষ্ট ট্র্যান্সফার ফি জমা দিয়ে আমি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলাম । করিমগঞ্জ কলেজের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবসান হল ।
সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজ, শিলং
শিলং এর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা
এরপর এক সকালে (সম্ভবতঃ আগষ্ট/সেপ্টেম্বর মাসের কোন একদিন) আমি দাদার সঙ্গে শিলং এর পথে গৌহাটি, (বর্তমানে গুয়াহাটি) রওয়ানা হলাম । যাত্রাপথের প্রথমার্ধে আবার উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলপথের পাহাড় লাইনে ট্রেনভ্রমণ । এই পথের নৈসর্গিক শোভা আমি আগেই যোরহাট থেকে শিলচর আসার পথে বর্ণনা করেছি । পথের দ্বিতীয়ার্ধ রাতের অন্ধকারে পেরিয়ে আসি । যাত্রার প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে আমরা গৌহাটি পৌঁছুলাম।
গৌহাটিতে আমি ছিলাম নতুন, শহরের কিছুই চিনতাম না । গৌহাটির নিকটস্থ ঝালুকবাড়ীতে অবস্থিত গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দাদা স্নাতকোত্তর পাঠক্রম সম্পূর্ণ করেছিল; সে গৌহাটি শহর ভালভাবেই চিনত । গৌহাটিতে আমরা একটা হোটেলে উঠলাম ।
গৌহাটি ও কামাখ্যা দর্শন
আমি সারাদিন ঘুরে ঘুরে শহর দেখলাম । নদী ও পাহাড় পরিবেষ্টিত শহরটির সৌন্দর্য ছিল মনোমুগ্ধকর । বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ শহরের গা ঘেঁসে রাজকীয় ভাবে বয়ে চলেছে; নদীর মধ্যভাগে কতিপয় পাহাড় উদ্গত হয়ে এক অপরূপ শোভা সৃষ্টি করেছে । দূরে গারো ও খাসি-জয়ন্তী পাহাড়ের রূপরেখা দেখা যায় । অদূরে নীলাচল পাহাড় যার শীর্ষে বিখ্যাত কামাখ্যা মন্দির অবস্থিত ।
পরবর্তীকালে একাধিকবার কামাখ্যা মন্দির দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। প্রথমবার মা ও স্ত্রীর সাথে, পরের দুবার স্ত্রীর সাথে, যার মধ্যে শেষবার ২০০৭ সালে যখন আমি সস্ত্রীক আসাম ভ্রমণে গিয়েছিলাম । পাহাড়ের চূঢ়ায় মন্দিরটি মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত । পাহাড় থেকে নীচের গৌহাটি শহরকে রাতের অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু আলোর মালা বলে মনে হয় । প্রতিদিন নির্দ্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে মন্দিরে পূণ্যার্থীদের লম্বা সারিবদ্ধ লাইন দেখা যায় । দেবীদর্শনের জন্য মন্দিরে ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশ মূল্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশ পথ রয়েছে । মাটির গভীরে দেবীর গর্ভগৃহ, ভিতরে ঘন অন্ধকার । সেখানে উঁচু বেদীর উপর দেবী প্রতিষ্ঠিতা । উচ্চ আলোর বিজলী বাতি লাগিয়ে আলোকিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে । উচ্চ শক্তির স্ট্যান্ড ফ্যান দিয়ে ভিতরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করা হয়েছে । এতৎ সত্ত্বেও গর্ভগৃহে প্রাপ্তব্য স্থানের তুলনায় একযোগে সমবেত দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেশী হওয়ায় দেবীস্থানে শ্বাসরোধকারী অবস্থার সৃষ্টি হয় । দেবীস্থানের আরও গভীরে একটি অগভীর জলাধারে পরিবেষ্টিত একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে । গর্ভগৃহ থেকে লিঙ্গে পৌঁছুতে স্বল্প উচ্চতার দরোয়াজা দিয়ে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে সংকীর্ণ সিঁড়িপথ ধরে এগোতে হয় । জলাধারের পার্শ্বে ২ বা ৩ টি ইটের সমদৈর্ঘ্যের সরু সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পুরোহিতের সাহায্যে লিঙ্গে পূজো দেয়া যায় । (২০০৭ সালে আমার শেষবারের জন্য এই মন্দির দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে এই চিত্র অঙ্কিত ।)
সেই সময় গৌহাটি শহরের জনসংখ্যা আজকের মত বিস্ফোরক পর্যায়ে পৌঁছয় নি । শহরটি মোটামুটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ছিল । শহরের মধ্যে যাতায়াতের মূল পরিবহন ছিল সাইকেল রিক্সা যদিও গুটিকয়েক সিটি বাস চলত ।
গৌহাটি-শিলং যাত্রাপথ: প্রথম ও পরবর্তী অভিজ্ঞতা
বর্তমান (সাল ২০১৪) গৌহাটি-শিলং রাজপথের একাংশ
গৌহাটিতে ব্রহ্মপুত্রের একটি দৃশ্য
শিলং শহরটি খাসি-জয়ন্তী পাহাড়ে অবস্থিত । গৌহাটি থেকে দূরত্ব ৯৯.৫ কি. মি. । শিলং এর সঙ্গে রেল যোগাযোগ তখনও ছিল না, এখনও নেই । গৌহাটি পৌঁছুবার পরের দিন সকাল ৬টায় আমরা আসাম স্টেট ট্র্যান্সপোর্টের বাসে গৌহাটি থেকে শিলং রওয়ানা হলাম । গৌহাটি থেকে শিলং যাওয়ার রাস্তাটি জি-এস রোড (গৌহাটি-শিলং রোড) নামে পরিচিত । তখন জি-এস রোড আজকের মত চওড়া ছিল না । রাস্তাটি ছিল একমুখী; গৌহাটি ও শিলং এই দু দিক থেকে আসা গাড়ীগুলোকে মংপু নামক মধ্যবর্তী স্থানে পারাপার করানো হত । এই রাস্তায় গাড়ী চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে ৩ ঘণ্টা অন্তর যথা ৬টা, ৯টা, ১২টা ও ৪টায় গৌহাটি ও শিলং এই দু প্রান্ত থেকে যাত্রা শুরুর সময় নির্দ্দিষ্ট করা ছিল । ৪টার পর কিংবা নির্দ্দিষ্ট সময় ব্যতিরেকে কোন প্রান্ত থেকেই কোন গাড়ী সাধারণতঃ রওয়ানা হতে পারত না।
আমি আগে কখনও পার্ব্বত্য শহরে যাই নি, স্বভাবতই আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম । আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে বাস যখন একে বেকে পাহাড়ের চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে চলতে লাগল আমি তখন বিভোর হয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগলাম । এক পাশে গভীর গিরিখাত, অন্য পাশে সু-উচ্চ খাড়া পাহাড় মনে ভয় মিশ্রিত উত্তেজনার সঞ্চার করছিল । মাঝে মাঝে সংকীর্ণ জলধারা পাহাড় বেয়ে নেমে আসছিল । এই পথে পরবর্তী ভ্রমণে দেখেছি এই জলধারা যেখানে রাস্তার পাশে নেমে এসেছে সেই স্থানে পাহাড়ী উপজাতিভুক্ত লোকেরা এর জলে স্নান ও কাপড়চোপড় কাচার কাজ সম্পন্ন করছে । যেতে যেতে দেখছিলাম কিছু আদিবাসী নরনারী পিঠে ঝুলানো ত্রিকোণাকৃতি বেতের ঝুড়িতে শাকসব্জী নিয়ে পাহাড় বেয়ে নামছে । আদিবাসী পাহাড়ী মেয়েরা শিশুদের পিঠে বেঁধে নিয়ে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত; এই ব্যবস্থায় এক টুকরো কাপড় পিঠে বেঁধে শিশুকে তার মধ্যে বসিয়ে দেয়া হয়, কাপড়ের দুই প্রান্ত বগলের মাঝখান দিয়ে এনে সামনের দিকে গিঁট বেঁধে দেয়া হয় । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছিল প্রায় দেড়-দশক পূর্বে দেখা জন্মস্থান শ্রীহট্টের মাছিমপুর নামক এলাকা থেকে আসা মনিপুরী ফেরিওয়ালীদের, যারা ঠিক একই ভাবে শিশুদের পিঠে বেঁধে পণ্যাদি ফেরি করে বেড়াত । বাসটি যখন আরও উপরে ওঠে এল আমি হিমেল হাওয়ার স্পর্শ পেলাম, আমাকে গরম জামা পরতে হল । মংপুতে আমরা প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করলাম, তারপর আবার যাত্রা শুরু হল । এরপর আমি আর দীর্ঘক্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারিনি, বিবমিষায় (nausea) কাতর হয়ে পড়েছিলাম । বাকী পথ আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কাটালাম, শিলং পৌঁছুবার পরই আমি স্বাভাবিক হয়েছিলাম । আমরা সকাল দশটায় শিলং পৌঁছুলাম । একটা হোটেলে উঠে খাওয়া দাওয়া সেরেই কলেজে ছুটলাম ।
ইণ্টারমিডিয়েটের বিজ্ঞান (I. Sc) শাখায় ভর্তি
সেন্ট এন্থোনিজ কলেজের[22] অধ্যক্ষ রেভারেণ্ড ফাদার জোসেফ আরোকিয়াস্বামী দু হাত বাড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন । আমি ইংরাজী, বাংলা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক এবং অতিরিক্ত অঙ্ক (ঐচ্ছিক) এই বিষয়গুলো নিয়ে ইন্টারমিডিয়েটের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলাম । আমার থাকার জন্য সন্নিহিত কলেজ হোষ্টেলে একটি একক ঘর নির্দ্দিষ্ট করে দেয়া হল । এ সবের জন্য আমাকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হল না । আমার কলেজে পড়া ও হোষ্টেলে থাকা-খাওয়া সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নির্ধারিত হল । আমি কলেজ ও হোষ্টেলে স্থিত হয়ে যাওয়ায় দাদা পরদিন ফিরে গেল ।
কলেজের পরিবেশ, অবস্থান ও বিন্যাস
সেন্ট এন্থোনিজ কলেজ শিলং এর লাইমুখরা নামক এলাকায় অবস্থিত ছিল । শিলং এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই এই অঞ্চলে অবস্থিত ছিল । সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই অঞ্চল ছিল অনেকটা কোলকাতার কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলের সমতুল্য । আমাদের কলেজের সম্মুখস্থ রাস্তার সংযোগস্থলকে বলা হত ডনবস্কো স্কোয়ার; সেণ্ট জন বস্কো তথা ডনবস্কোর[23] নামানুসারে এই নামকরণ হয়েছিল । মেয়েদের সেন্ট মেরীজ কলেজ, ছেলেদের সেন্ট এডমন্ডস স্কুল ও কলেজ নিকটেই অবস্থিত ছিল । ডনবস্কো স্কুলের পাশে ও আমাদের কলেজের প্রসারিত অংশের বিপরীতে ছিল অপূর্ব সুন্দর রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রেল “Mary Help of Christian Church” ।
আমাদের কলেজের নিজস্ব বাড়ীটি ছিল খুব সুন্দর, বৃটিশ আর্কিটেক্ট্চারেল পদ্ধতিতে তৈরী । এটি খুব বেশীদিন আগে তৈরী হয়নি । কিন্তু কলেজের সংলগ্ন ছাত্রাবাসটি ছিল একটি পুরনো দ্বিতল কাঠের বাড়ী । এর একতলার এক অংশে একটি বড় হলঘর ছিল, দোতলায় ততোধিক বড় আরেকটি হলঘর ছিল । হলঘর দুটিকে মানুষ-উঁচু কাঠের ফ্রেমে ক্যানভাসের পার্টিশন লাগিয়ে এক একটি ছোট ছোট একক ঘরে ভাগ করা হয়েছিল । এক একজন আবাসিককে এরূপ একটি ছোট ঘর, একটি ছোট টেবিল ও একটি একক খাট দেয়া হয়েছিল । প্রতিটি ঘরে একটি করে বিজলী বাতি লাগানো ছিল । ছাত্রাবাসটিতে অনধিক পঞ্চাশ জন আবাসিক থাকত । সকলের জন্য একত্রে চারটি স্নানঘর ও চারটি শৌচাগার ছিল । আমার ও দীপুর ঘর দুটি ছিল পাশাপাশি । এরই পাশে ছিল তেজপুর থেকে আগত আমাদের আরেক বন্ধু চিত্তেন্দ্র সোম ওরফে চেতুর ঘর । চেতুর একটি মুদ্রাদোষ ছিল হাতে চাবির রিঙ ঘোরানো । এই বাড়ীটির একতলার অপর (কলেজ সন্নিহিত) অংশে ছিল অধ্যক্ষ্যের চেম্বার, কলেজ অফিস, লাইব্রেরী ইত্যাদি । এই অংশেও ছাত্রাবাসের জন্য একাধিক শয্যাবিশিষ্ট দু-একটি ঘর ছিল । ছাত্রাবাসের বাইরের দিকে রাস্তা সংলগ্ন অংশের একটি কক্ষে ছিল ছাত্রাবাস অধীক্ষকের চেম্বার তথা বাসস্থান । এটি পেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি বাড়ীতে ছিল সায়েন্স ল্যাবোরেটরি ।
আমাদের কলেজ-কাম-হোষ্টেল বিল্ডিং এর পেছনে একটি খেলার মাঠ ছিল । ঐ মাঠের বিপরীত দিকের পাহাড়ে অবস্থিত ছিল সেন্ট এডমন্ডস সিনিয়র কেম্ব্রিজ স্কুল ও সেন্ট এডমন্ডস কলেজ ।আমাদের কলেজ ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চভুক্ত ও সেণ্ট এডমণ্ডস কলেজ ছিল প্রোটেস্টাণ্ট । আমাদের কলেজের ছাত্রদের বলা হত এন্থোনিয়ান আর সেণ্ট এডমণ্ডসের ছাত্রদের বলা হত এডমণ্ডিয়ান । সেন্ট এডমন্ডস ও আমাদের কলেজের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগীতা চলত ।
আমি কলেজ পরিত্যাগ করার পর ২০০৭ সালে যখন প্রথমবার কলেজ দর্শনে যাই তখন দেখি কলেজটি স্থানান্তরিত হয়েছে । আমার স্ত্রীও তখন আমার সঙ্গে ছিলেন । নীচের অনুচ্ছেদে পরিবর্তনগুলির বিবরণ রয়েছে ।
ডানদিকের প্যানেলে বর্তমান অবস্থানে সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের শিরোনাম সহ দুটি আলোকচিত্র রয়েছে । এই আলোকচিত্র দুটি আমার ২০০৭ ও ২০১৪ সালে আসাম ভ্রমণের সময় তোলা । এই প্রসঙ্গে জানাই আমাদের সময়ের কলেজ বা হোস্টেলের কোন ছবি দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার কাছে নেই । তা সত্বেও বর্তমান সেণ্ট এন্থোনিজ হায়ার সেকেণ্ডারী স্কুলের অঙ্গীভূত ১৯৬০ সালের আমাদের সময়ের অপরিবর্তিত অবস্থানে কলেজের একটি অংশের ছবি এখানে সংযোজন করেছি । এটি আমার ২০১৬ সালের শিলং ভ্রমণের সময় তোলা হয়েছে । ২০১৬ সালে তোলা বর্তমান পরিবর্তিত অবস্থানে বিদ্যমান কলেজ হোস্টেলটিরও একটি ছবি এখানে রয়েছে ।
পরিবর্তিত অবস্থানে সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের প্রবেশ পথে যীশুখৃষ্টের মূর্তি
পরিবর্তিত অবস্থানে সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের
বিশালাকার মূল বিল্ডিং
সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের বর্তমান হোস্টেল
আমাদের সময়ের কলেজ বিল্ডিংএর অংশ যা বর্তমানের সেণ্ট এন্থোনিজ এইচ. এস. স্কুলের অংশ
সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষের নামে ছাত্রদের পুস্তক বিপনী
অধ্যক্ষ
আমাদের কলেজ জাত-পাত মুক্ত সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল যা রেভারেণ্ড ফাদার জোসেফ আরোকিয়াস্বামী (Arokiaswamy)[24] নামীয় কেরালাবাসী মিশনারি অধ্যক্ষ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন । ফাদার জোসেফ (ছবি ডানে) ছিলেন ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন ও গুরুগম্ভীর প্রকৃতির । তবে বিশেষ প্রয়োজনে তাঁর সমীপবর্তি হওয়া যেত ।
ছাত্রদের ভাষা ও জাতিসত্তা
কলেজে বিভিন্ন ভাষাতাষী ও জাতিগত বিভিন্নতার ছাত্রছাত্রী ছিল । বাঙালী ছাড়াও এদের মধ্যে ছিল অসমীয়া, খাসিয়া, গারো, লুসাই, নাগা, মণিপুরী, এ্যাংলো-ইনডিয়ান ও অন্যান্য । আমাদের ক্লাসে অতি অল্প সংখ্যক ছাত্রী ছিল, সেকালে মেয়েরা বিজ্ঞান পড়তে খুব একটা উৎসাহী ছিল না । এই ছাত্রীদের মধ্যে একজন সুদর্শনা এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছাত্রীও ছিল ।
কলেজের প্রতীক ও আদর্শ
আমাদের কলেজের প্রতীক বহুদা অর্থ বহন করে । প্রথমতঃ প্রতীকে আধিপত্য বিস্তারক অক্ষর 'A' কলেজের পৃষ্ঠপোষক পেডুয়ার সেণ্ট এন্থোনিকে নির্দেশ করে । উড়ন্ত ঈগল নির্দেশ করে প্রতিটি এন্থোনিয়ানের জীবনের প্রতিক্ষেত্রে উৎকর্ষতা লাভের প্রচেষ্টা হবে তার হলমার্ক । প্রতীকটির নিম্নে উন্মুক্ত পুস্তকটির অর্থ শিক্ষা ও শিক্ষার প্রতি ভালবাসাই এই প্রতিষ্ঠানের পূর্বাধিকার । এই সবের পশ্চাতে রয়েছে একটি ক্রুশ চিহ্ন যা সকলের মুক্তির জন্য ক্রুশের উপর যীশুখৃষ্টের আত্মদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । যীশুখৃষ্টের প্রতি এই ভালবাসাই কলেজকে উৎকৃষ্টতা ও সেবার শীর্ষে আরোহণ করার উদ্দীপনা দেয় । এ সব কিছুই একটি চক্রাকার ব্যাণ্ডের দ্বারা বেষ্টিত যার মধ্যে খোদিত রয়েছে কলেজের নাম ও মূলমন্ত্র, "Ever More, Better Ever". মূলমন্ত্রটি লেটিন শব্দ Excelsior এর অনুবাদ । এটি আবার সামনে নিয়ে এল জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ও কার্যধারায় উৎকর্ষতার জন্য সংগ্রাম প্রতিটি এন্থোনিয়ানের এবং তাদের কলেজের বৈশিষ্ঠ্য ।
বিজ্ঞান শাখার শিক্ষকমণ্ডলী
আমাদের কলেজের বিজ্ঞান শাখার শিক্ষকমণ্ডলীর অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষাদানে দক্ষ । রসায়ন (কেমিস্ট্রি) বিভাগের প্রধান প্রোঃ এস্. এন. পাল ছিলেন স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় শিক্ষক । তিনি আমাদের অজৈব রসায়ন পড়াতেন । তাঁর পড়াবার পদ্ধতি ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ । তিনি জটিল বিষয়গুলোকে সহজতম ভাবে ব্যাখ্যা করতেন যেন আমরা সহজেই তা আয়ত্ব করতে পারি । এই প্রসঙ্গে আমি একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি । অজৈব রসায়নে পেরিয়োডিক টেবিল নামক ধাতুর পরমাণু অঙ্ক নির্দেশক সারণিটি মনে রাখা অত্যন্ত কষ্টকর । কিন্তু প্রোঃ পাল এটি মনে রাখার এমন একটি সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে চাকুরী জীবনের শেষ পর্যায়ের পূর্বে এটি ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি । জৈব রসায়ন পড়াতেন প্রোঃ রায়চৌধুরী । অঙ্কে আমরা পেয়েছিলাম এইচ্. এল্. রায় (পুরো নাম হীরালাল রায়) নামে আরেকজন প্রতিভাবান শিক্ষক । মিঃ রায় ডেমনস্ট্রেটর হিসাবে নিযুক্ত হয়ে থাকলেও অঙ্কে তাঁর প্রতিভা ছিল অসামান্য । শিক্ষক হিসাবে বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করে তিনি সহজেই ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতেন । আমরা তাঁর কাছ থেকে সহজ পন্থায় অঙ্কের সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি শিখেছিলাম । প্রোঃ পালের ক্লাসের জন্য যেমন অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করতাম মিঃ রায়ের ক্লাসের জন্যও তেমনি আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করতাম । তবে মিঃ রায় সুরাসক্ত ছিলেন এবং মাঝে মাঝেই ক্লাশে অনুপস্থিত থাকতেন । প্রোঃ দাস (প্রথম নাম মনে নেই) অঙ্ক বিভাগের প্রধান ছিলেন । ওঁর ক্লাসে আমরা বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতাম না । পদার্থবিদ্যায় কিছুদিন এ. রাজু নামে একজন দক্ষিণ ভারতীয় অল্পবয়সী অধ্যাপক আমাদের পড়িয়েছিলেন । তিনি সুন্দরভাবে পড়াতেন এবং আলোচিত বিষয়ে আগ্রহ সঞ্চার করাতে পারতেন । দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের কলেজে তিনি বেশীদিন ছিলেন না । প্রোঃ বিনয় চক্রবর্তী ছিলেন পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান । তিনি ভাল পড়াতেন । আমরা প্রোঃ জি. জি. সোয়েল, যিনি পরে লোকসভার অধ্যক্ষ (স্পীকার) নিযুক্ত হয়েছিলেন,তাঁকে আমাদের ইংরেজীর অধ্যাপক রূপে পেয়েছিলাম । তিনি মাঝে মাঝেই ভুল করে অন্য অধ্যাপকের ক্লাসের সময় পড়াতে চলে আসতেন; ভুল ধরিয়ে দিলে দুঃখ প্রকাশ করে চলে যেতেন । তিনি হয় ভুলোমন ছিলেন নয় সুরার প্রভাবে ভুল করে ফেলতেন । প্রোঃ মার্টিন নারায়ণ মাজো (Majaw) আমাদের আরেকজন ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন এবং ভালই পড়াতেন । প্রোঃ সোয়েল ও প্রোঃ মার্টিন উভয়েই পাহাড়িয়া উপজাতি (Hill Tribe) শ্রেণীভুক্ত ছিলেন । প্রোঃ গোপাল দে আমাদের বাংলা পড়াতেন । কলেজের বিপরীত দিকে ওঁর একটি স্টেশনারী দোকান ছিল ।
এখানে আমি আমাদের কলেজের অধ্যাপক মণ্ডলীর বিশেষ কয়েক জনের কথাই উল্লেখ করেছি । অন্যদের নাম আমার স্মৃতিতে না থাকায় তাঁদের সম্পর্কে উল্লেখ করতে পারিনি, এই জন্য আমি দুঃখিত।
ছাত্রদের মূল্যায়ন ও নিষ্পাদন
আমাদের কলেজে মাসিক পরীক্ষার (monthly tests) মাধ্যমে ছাত্রদের লাগাতার মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু ছিল । শিক্ষাবর্ষের শেষে পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তরণের বার্ষিক পরীক্ষা এবং সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বসার নির্বাচনী পরীক্ষা (Selection test) অনুষ্ঠিত হত । শিলং পার্বত্য শহর হওয়ায় এখানে গ্রীষ্মকালীন অবকাশের পরিবর্তে শীতকালীন অবকাশ হত । সময় ছিল ডিসেম্বরের মধ্যভাগ থেকে ফেব্রুয়ারীর শেষ পর্যন্ত । শিক্ষাসূচীর (কোর্সের) অন্তিমবর্ষে শীতকালীন অবকাশের কিয়দংশে স্পেশাল ক্লাসের জন্য আমাদের শিলং-এ থেকে যেতে হত । কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন, শীতকালীন অবকাশে বাছাই করা ছাত্রদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হত ।
তাপস পাল নামে এই কলেজের ছাত্র আমি যে বৎসর কলেজে ভর্তি হই সেই বৎসরই বিশ্ববিদ্যালয়ের আই. এসসি (I. Sc.) পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে । তাপস ছিল আমাদেরই এক সহপাঠি তরুণ পালের দাদা; তরুণ পরে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে এম্. বি. বি. এস পাশ করে ডাক্তার হয়েছিল । তাপস এবং তরুণ ছিল আমাদের প্রফেসর এস্. এন্. পালের ভ্রাতুষ্পুত্র । উভয়েই মেট্রিক পরীক্ষা যোরহাট লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাইস্কুল থেকে পাশ করেছিল; তাপস ১৯৫৮ সালের ঐ পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তম স্থান অধিকার করেছিল । তরুণ আমার ভাল বন্ধু ছিল; কিন্তু ওর বর্তমান অবস্থান আমি জানি না । হোষ্টেলে আমাদের মধ্যে দীপক ভট্টাচার্য নামে আরেকজন মেধাবী ছাত্র ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের বৎসরের আই. এসসি (I. Sc.) পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছিল । সে ও পরের বৎসর অর্থাৎ ১৯৬১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আই. এসসি (I. Sc.) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হয়েছিল । আমার উপর কলেজ কর্তৃপক্ষের অনেক আশা ছিল এবং তাঁরা আমার পড়াশোনায় যাতে কোন ব্যঘাত না ঘটে সে বিষয়ে বিশেষ যত্নবান ছিলেন । তাঁরা আশা করতেন আমি পরের পরীক্ষায় (১৯৬২) প্রথম হয়ে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আই. এসসি (I. Sc.) পরীক্ষায় পর পর তিন বৎসর প্রথম স্থান অধিকার করার হেট্রিকবৃত্ত সম্পূর্ণ করে কলেজকে দুর্লভ সম্মানের অধিকারী করব ।
আমার কলেজ জীবনের বন্ধু-বান্ধব ও তাদের প্রভাব
আমি যখন কলেজে ভর্তি হই তখন আমার স্কুলের সহপাঠি দীপুর ঐ কলেজে কিছুদিন কেটে গেছে; ওর কিছু বন্ধুও জোটে গেছে । দীপুর ঐ বন্ধুরা শীঘ্রই আমারও বন্ধু হয়ে গেল । আমাদের কিছু নতুন বন্ধুও হল । বন্ধুদের মধ্যে ছিল চিত্তেন্দ্র সোম (ডাক নাম চেতু), সুব্রত পুরকায়স্থ, রাজর্শি ভট্টাচার্য (ডাক নাম কিসু) ও দেবাশীষ নন্দী । চেতু ভিন্ন অন্যান্যরা ছিল হোষ্টেলের বাইরের এবং অনেকে কলেজেরও বাইরের । বন্ধুদের সাহচর্যে আমি ধীরে ধীরে গৃহকাতরতা (home-sickness) কাটিয়ে উঠতে লাগলাম । হোষ্টেলে অনেক ছাত্রের সঙ্গে সহাবস্থান আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করেছিল । হোস্টেলের বিভিন্ন জাতিভুক্ত ও বিভিন্ন ধর্ম্মীয় সম্প্রদায়ের আবাসিকদের সংসর্গ আমাকে উদারমনা করেছিল; তারই ফলশ্রুতি রক্ষণশীল পরিবারভুক্ত হওয়া সত্বেও পরবর্তীকালে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রতি আমার গোঁড়ামি বা বিরূপতা ছিল না এবং নেই । শিলং এ দীপুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীরতর হয়
আমাদের সময়ের ও পরবর্তী কালের হোস্টেল সম্পর্কে দু-চার কথা
অতীত কালের হোস্টেল: আমাদের সময়ের হোস্টেলের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমি "কলেজের পরিবেশ, অবস্থান ও বিন্যাস" নামক অনুচ্ছেদে আঁকার চেষ্টা করেছি । যদিও তদানীন্তন হোস্টেলের বসবাস ব্যবস্থায় কিছু কিছু অপূর্ণতা ছিল আমরা সানন্দে ওখানে আমাদের দিনগুলি কাটিয়েছি । যে কাজে আমাদের পাঠানো হয়েছিল সেই কাজে মনোনিবেশ করতেও আমাদের কোন সমস্যা হয় নি । আমরা অনধিক পঞ্চাশ জন আবাসিক ছিলাম । যদিও আমরা বিভিন্ন জাতিগত গোষ্টি থেকে এসেছিলাম সবাইকে এক ভাবতে ও এক হিসাবে থাকতে আমাদের কোন অসুবিধা হয় নি ।
বর্তমান কালের হোস্টেল: ১৯৮৪ সালে কলেজের স্থান পরিবর্তন ও আবাসিক স্থানের বর্ধিত চাহিদার দরুণ কর্তৃপক্ষের উপর নতুন ও অধিক শয্যাবিশিষ্ট হোস্টেল নির্মাণের বাধ্যবাধকতা এসে যায় । সেই অনুযায়ী স্টিফেন হল নামে ১৭০ টি শয্যাবিশিষ্ট ছাত্রদের একটি হোস্টেল ও মাম্মা মার্গারেট হল নামে ৪০টি শয্যাবিশিষ্ট ছাত্রীদের একটি হোস্টেল তৈরী হয় । ছাত্রদের হোস্টেলে একক ও ত্রি-শয্যা বিশিষ্ট ঘরে ১৭০ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে । আমাদের সময়ের হোস্টেলের নিয়মাবলী যা আমি পরের অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছি তা এখনও বলবৎ রয়েছে বলে মনে হয় । সময়ের ব্যবধানে এখানে সেখানে কিছু পরিবর্তন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় । আবাসিকদের মধ্যে আমাদের সময়ের মত ভ্রাতৃত্ব বোধ বিদ্যমান রয়েছে কিনা তা উপলব্ধি করার অবকাশ আমার হয় নি । তবে কলেজের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায় হোস্টেলে প্রবেশের ও অবস্থান অব্যাহত রাখার একটি পূর্বশর্ত হল আবেদনকারীদের পক্ষে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ছাত্রদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে বাস করার অঙ্গীকার । লক্ষণীয়, আমাদের সময় এমন কোন অঙ্গীকারের প্রচলন ছিল না বা তার প্রয়োজনও হয়নি । হোস্টেলে আমার চার বৎসরের অবস্থান কালে ভাতৃত্ববোধ নিয়ে সহ অবস্থানের কোন ব্যত্যয় আমি দেখিনি ।
হোস্টেল অধীক্ষক ফাদার কেনি ও হোস্টেলের কঠোর নিয়মাদি
হোস্টেলের বিপরীতে নিকটস্থ ক্যাথেড্রেলের অভ্যন্তরের চিত্র
আমাদের ছাত্রাবাস রেভারেণ্ড ফাদার এন্. জে. কেনি[25] নামে একজন আইরিশ ধর্ম্মযাজকের দক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত । এখানকার নিয়মাবলী খুব কঠোর ছিল । প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্ন ভোজন, বৈকালিক চা ও নৈশভোজের সময় নির্দ্দিষ্ট ছিল । যথাসময়ে ঘণ্টি বাজিয়ে আবাসিকদের খাদ্যগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হত; মধ্যাহ্ন ভোজ ও নৈশ ভোজে দুবার ঘণ্টি বাজান হত । নৈশভোজের ক্ষেত্রে প্রথমবার রাত ৭-১৫ মিঃ এ ও দ্বিতীয়বার রাত ৮-০০মিঃ এ খাবার ঘণ্টি বাজত । কলেজের পর আবাসিকরা যে যেখানেই যাক সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে তাদের হোস্টেলে ফিরে আসতে হত । সন্ধ্যা ঠিক ৬টায় ঘণ্টি বাজিয়ে আবাসিকদের জানানো হত যে তাদের নিজ নিজ ঘরে ফেরার সময় হয়েছে । অতঃপর ফাদার কেনি পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে প্রতি ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে দিয়ে স্থিরনিশ্চয় হতেন যে আবাসিক ঘরে আছে ও পড়াশোনায় ব্যস্ত রয়েছে । সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হত আমাদের স্টাডি টাইম । এই সময় গল্পগুজব করা বা অন্য আবাসিকের ঘরে থাকা একেবারই অনুমোদন করা হত না । কারো সন্ধ্যা ৬টার পর বাইরে থাকার প্রয়োজন হলে তাকে অধীক্ষকের (Superintendent) অগ্রিম অনুমতি নিতে হত । রাত্রিবেলা নৈশভোজের সময় অতিবাহিত হলে ফাদার কেনি পুনরায় পর্যবেক্ষণে বেরোতেন । ঐ সময় কোন আবাসিক কোন কারণে ঘরে অনুপস্থিত থাকলে ঘরে ফেরার সাথে সাথে তাকে ফাদার কেনির সঙ্গে দেখা করতে হত । নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক আবাসিককে রাত সাড়ে দশটার পর ঘরের আলো নিভিয়ে দিতে হত । অনেক সময় ফাদার কেনি রাত্রিবেলা টর্চ হাতে নিয়ে চারদিক ঘুরে দেখতেন সবকিছু ঠিক আছে কি না ।
ফাদার এন. জে. কেনি
আমার জীবনে হোস্টেলের ভূমিকা: হোস্টেল জীবন ও শিক্ষকমণ্ডলী সম্পর্কে অনুভূতি
এরূপ কঠোর শৃঙ্খলা ও অনুশাসনের মধ্য দিয়ে আমি আমার নবযৌবনের চার বৎসর কাটিয়েছি । ইহা আমার চরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে ; আমাকে কর্ম্মমুখী, শৃঙ্খলাপরায়ন ও স্পষ্টবক্তা করেছে ।
এই কলেজ, এর ছাত্রাবাস ও শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে আমি অসীম ঋণী, বিশেষভাবে ঋণী ফাদার কেনির কাছে তাঁর ভালবাসা ও সযত্ন তত্ত্বাবধানের জন্য । "ফাদার ফিগার" বলতে যা বোঝায় ফাদার কেনি ছিলেন তাই; শৃঙ্খলায় কঠোর, হৃদয়ে কোমল । তিনি বন্ধুভাবাপন্ন এবং কৌতুকপ্রিয়ও ছিলেন । আমাদের হোস্টেলে ইসলাম (প্রথম নাম মনে নেই) নামে একজন অসমীয়া মুসলমান ছাত্র ছিল । ওর ইংরেজী ভোক্যাবুলারী (vocabulary) দুর্বল ছিল । একদিন ফাদার কেনি রাতের রাউণ্ডে পরিদর্শনে বেরিয়ে ওর ঘর থেকে দু হাতে তালি বাজার আওয়াজ শুনতে পান । তিনি জিজ্ঞেস করেন, "Islam, what are you doing?"। উত্তরে ইসলাম বলে "Father, I am killing buffaloes" । এই নিয়ে ফাদার কেনি সকলের সাথে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলেন ।
ফাদার কেনি, ফাদার জোসেফ বা আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর কেউই আজ আর নেই । ২০১৪ সালের মার্চ মাসে কলেজ দেখতে গিয়ে আমার দেখে ভাল লেগেছে যে কলেজের মৎস্য বিভাগের নতুন ভবনটি আমাদের সময়ের স্বনামধন্য অধ্যক্ষ ফাদার যোসেফের নামে নামাঙ্কিত হয়েছে । ২০১৬ সালে আমার সর্বশেষ (২০২২ সালের পরিপ্রেক্ষিতে) শিলং ভ্রমণের সময় আমি দেখে আনন্দিত হয়েছি যে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ফাদার যোসেফ বেশ্শিরিলোর (Fr. Joseph Bacchirello) নামে ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত পুস্তাকাদির একটি বিপনী চালু হয়েছে ।
আমাদের কলেজের দিনগুলি
২০০৭ সালে দৃষ্ট পুলিশবাজারের একটি আংশিক চিত্র
কলেজে ক্লাশ শেষের পর অবসর সময়ে আমরা কলেজ সন্নিহিত লাইমুখরা অঞ্চলেই ঘুরে বেড়াতাম । কখনও কখনও ৫-৬ জন মিলে নিকটস্থ রেস্তোঁরায় যেতাম । দূরে যেতে পারতাম না, সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হোস্টেলে ফিরতে হত । কখনও কখনও হোস্টেলের আশে পাশেই ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতাম, মাঝে মাঝে ধূসর মেঘ রাস্তার সমতলে নেমে এসে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করত । সময় সময় এবং ছুটির দিনে নির্দ্দিষ্ট সময়ের পর বাইরে থাকার আগাম অনুমতি নিয়ে আমরা দলবেধে শিলং এর কেন্দ্রীয়স্থল পুলিশ বাজার যেতাম (বা পাশে ২০১৪ সালের পুলিশবাজারের একটি অংশের দৃশ্য) ।
পুলিশ বাজারে আমরা রেস্তোঁরায় যেতাম, ওয়ার্ডস লেকে ঘুরে বেড়াতাম আর মেয়েদের সমাবেশ দেখতাম । আমাদের এক বন্ধু কিসুর কথা আগেই উল্লেখ করেছি । কিসু[26] ছিল মিষ্টভাষী ও শান্ত স্বভাবের এক আনন্দদায়ক ব্যক্তিত্ব । ওদের বাসা ছিল পুলিশ বাজার থেকে রেসকোর্স যাওয়ার রাস্তা জেল রোডে । পুলিশ বাজার গেলে আমরা প্রায়শঃ ওর বাড়ী যেতাম, ওর বাড়ীর লোকেরা আমাদের সাদরে গ্রহণ করতেন । পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের পর যতবার আমি শিলং গিয়েছি প্রতিবার জেলরোডে কিসুদের বাড়ী খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছি । কিন্তু কয়েক দশকের ব্যবধানে পরিপার্শ্বের বিবর্তনে ও আমার স্মৃতিমলিনতায় তা বার করা সম্ভব হয় নি । অবশেষে ২০১৬ সালে আসাম-মেঘালয় সফরে শিলং অবস্থানের সময় আমি জনৈক স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে কিসুদের তদানীন্তন বাড়ীর সঠিক অবস্থানের দিকনির্দেশ পাই এবং জেল রোডের ঐ বাড়ীতে যাই । ওদের পরিবারের কেউ এখন ওখানে থাকেন না । জনৈক পড়শীর সাহায্যে কিসুদের এক আত্মীয়ের সাথে দূরাভাষে কথা বলে নিশ্চিত হই কিসু দীর্ঘদিন গত হয়েছে । এই দুঃসংবাদে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি । কিসুর শারীরিক বর্ণনা শুনে স্থানীয় ভদ্রলোক বাড়ীর দিকনির্দেশ দেয়ার সময় অবশ্য এই আশঙ্খাই প্রকাশ করেছিলেন । ওদের পরিবারের অন্যান্যদের সম্পর্কে চেষ্টা করেও কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারি নি ।
সেন্ট এডমন্ডসেরই ছাত্র আমাদের আরেক বন্ধু ছিল দেবাশীষ নন্দী । ওর বান্ধবী[27] কিসুদের পাশের বাড়ীতেই থাকত । কিসুদের বাড়ীতে আমরা গেলে দেবাশীষও[28] সঙ্গে থাকত । বস্তুতঃ কিসুর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছিল দেবাশীষের মাধ্যমে । যতদূর মনে পড়ে দেবাশীষের বাবা আসাম সরকারের শিক্ষা দপ্তরের অফিসার ছিলেন । দেবাশীষরা আমাদের কলেজের কাছে নংথুমাইতে খাকত । যাদবপুর থেকে মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেবাশীষও এখন আমেরিকাবাসী । ওর দিদি কুমকুম আমাদের কলেজে আমাদের চেয়ে সিনিয়র ছাত্রী ছিল ।
দীপুর জ্যাঠতুতো বোন এবং আমাদের স্কুলের সহপাঠিনী কল্পনা, ডাকনাম গোপা, হোষ্টেলে থেকে পুলিশ বাজার এলাকায় লেডিকিনী কলেজে পড়ত । দীপু ওর সাথে দেখা করতে গেলে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেত । গোপা পরে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে এম. বি. বি. এস (MBBS) পাশ করে ডাক্তার হয়েছিল । পরে ও ডাক্তার হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মিউনিসিপ্যাল সার্ভিসে যোগ দেয় । কোলকাতায় ও নিজস্ব ফ্ল্যাটে বসবাস করত । বহুদিন পর বন্ধু মৃণালের মাধ্যমে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটেছিল বছর দশ বারো আগে (২০০৭-০৮ সালে) । ওর স্বামীর সাথেও আমার পরিচয় হয়েছিল এবং বার দুয়েক দেখাও হয়েছিল । উনি ভারত সরকারের অধীনস্থ জিওলজিকেল সার্ভেতে উচ্চপদে আসীন ছিলেন । ২০১৪-১৫ সালের কোন এক সময়ে উনি গত হন । স্বামীর মৃত্যুর পর ২০১৫ সালের জুন মাসে বাসস্থান পরিবর্তন করে গোপা পুণায় স্থিত হয়েছে । ওর একটি বিবাহিতা কন্যা ও দৌহিত্রী রয়েছে ।
২০০৭ সালে পরিলক্ষিত কলেজ ও কলেজ সংলগ্ন এলাকার পরিবর্তন
পুলিশবাজারের সর্ট-কাট সিঁড়িপথের জায়গায় স্থাপিত রাস্তা
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হল কলেজের স্থান পরিবর্তন । পাহাড়ের উপরিভাগের সমতল উপত্যকা থেকে সরে কলেজ ঐ পাহাড়েরই ঢালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । পরিবর্তিত অবস্থানে কলেজ একটি জমকালো প্রধান ভবন সহ একাধিক ছোট ছোট ভবনে বিস্তৃত রয়েছে । কলেজের আদি অবস্থানে স্থাপিত হয়েছে সেণ্ট এন্থোনিজ হায়ার সেকেণ্ডারী স্কুল । পরবর্তী কালে আমি কলেজের ওয়েবসাইট থেকে জেনেছি আমাদের কলেজের স্থানান্তরকরণ হয়েছিল ১৯৮৪ সালে।
আমাদের কলেজের বিপরীত দিক থেকে পুলিশ বাজার যাওয়ার একটি পায়েহাঁটা সোজা পথ (সর্টকাট) ছিল । এই পথে যাতায়াত করতে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হত । কিন্তু ২০০৭ সালে আমার গ্র্যাজুয়েশনের পর প্রথম বার শিলংএ কলেজ দেখতে এসে ঐ সিঁড়িগুলোর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাই নি ।
এই সিঁড়িভাঙা পথের জায়গায় একটি পুরোদস্তুর একমুখী রাস্তা তৈরী হয়েছে যার উপর দিয়ে ছোট গাড়ী ও ট্যাক্সি চলাচল করে (বাম পাশের ছবিতে দৃশ্যমান) । এই রাস্তারই শেষ প্রান্তে পাহাড়ের উপত্যকায় একটি জাঁকালো নিজস্ব নতুন ভবনে (যার আলোকচিত্র পূর্বে প্রদর্শিত হয়েছে) আমাদের কলেজটি স্থানান্তরিত হয়েছে । ছাত্রাবাসটি কলেজের মূল ভবনের উপরের পাহাড়ে একটি নতুন ভবনে চলে এসেছে; এটি কলেজের সঙ্গে সিঁড়িপথে যুক্ত হয়েছে । নতুন ছাত্রাবাসের আবাসিক ধারণক্ষমতা আমাদের সময়ের পঞ্চাশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে একশ সত্তর । এ ছাড়া চল্লিশটি শয্যা বিশিষ্ট একটি ছাত্রীনিবাস ও যুক্ত হয়েছে । কলেজের বর্তমান (সাল ২০১৪) অধ্যক্ষ ব্রাদার অ্যালবার্টের (Br. Albert Longley Dkhar sdb) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী কলেজটিতে বর্তমানে বত্রিশটি বিভাগ (Department) রয়েছে ও কলেজের ছাত্রধারণ ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার । তবে বর্তমানের অধ্যাপকদের মধ্যে পুরনো দিনের কমিটমেণ্টের কতটা রয়েছে সে বিষয়ে আমার জানার অবকাশ হয়নি।
কাঠের তৈরী আমাদের পুরনো ছাত্রাবাসটির জায়গায় একটি নতুন পাকা বাড়ী তৈরী হয়েছে । সেই বাড়ী এবং আমাদের আদি কলেজ বিল্ডিং - এই দুটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেন্ট এন্থোনিজ হাইয়ার সেকেন্ডারী স্কুল ।
কলেজে প্রথম শীতকালীন অবকাশ
আমি ১৯৬০ সালের আগষ্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের প্রথমার্দ্ধে সেন্ট এন্থোনিজ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম । আমাদের প্রথম শীতকালীন অবকাশের খুব বেশী দেরি ছিল না । অবকাশের পূর্বে আমাদের তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের ক্লাস বাকি ছিল । যোরহাটের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় আমার মা, বাবা ও দাদা যাঁরা পূর্বে আসামের ভাষাদাঙ্গার দরুণ শিলচরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, ইতিমধ্যে যোরহাটে ফিরে এসেছিলেন । অবকাশ শুরু হলে দীপু ও আমি একত্রে আমাদের হোম-টাউনের উদ্দেশে যাত্রা করলাম । আমরা বাসে ভ্রমণ করছিলাম; প্রথমে গৌহাটি এবং পরে সেখান থেকে অপর একটি বাসে যোরহাট ।
এবার আমি গৌহাটি-শিলং রাস্তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একেবারেই উপভোগ করতে পারিনি । বাস নীচে নামতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বিবমিষায় (nausea) আক্রান্ত হয়ে বাসের শেষ সারির শূন্য সীটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম । পার্বত্য পথে ভ্রমণের আমার এই অসুস্থতা আমাকে দীর্ঘদিন ভুগিয়েছে । আমার আই. এসসি (I. Sc.) পাঠের শেষ পর্যায়ে আমি যখন পাহাড়ী পথে যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম তখনই কেবল এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পেলাম । পরবর্তী কালে শিলং সহ অনেক পাহাড়ী রাস্তায় আমি একাধিকবার যাতায়াত করেছি, কিন্তু আর কখনও এরূপ অস্বস্তি বোধ করিনি ।
আনন্দময় অবকাশ যাপন
যাহোক, আমার অবকাশ খুব ভাল কাটল । কয়েক মাসের নিরবচ্ছিন্ন বিচ্ছেদের পর আমার ন্যায় গৃহকাতর (যদিও ইতিমধ্যে গৃহকাতরতা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল) টীন-এজারের পক্ষে পরিবারের সঙ্গে পুণর্মিলন অবশ্যই খুব আনন্দের হয়েছিল । স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে দেখে খুব খুশী হলেন ও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের আশীর্ব্বাদ করলেন । স্কুলের কিছু বন্ধুবান্ধব যথা মৃণাল, উৎপল, হীরেশ যোরহাটেই ছিল । কিন্তু তোষিতার সঙ্গে দেখা হল না বা ওর কোন সংবাদও পেলাম না । অবকাশের দিনগুলোর কিছুটা সময় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কাটালাম; বাকি সময় বাবাকে প্রেসের কাজকর্ম্মে সাহায্য করলাম ।
অবকাশ শেষে ফেরৎ যাত্রা: পথে দীপুর সুটকেস চুরি
আমাদের অবকাশ শেষ হয়ে এল । আমি ও দীপু ট্রেনে যোরহাট ছেড়ে গৌহাটি রওয়ানা হলাম । ( ডান পাশে আমার ও দীপুর ছবি ।) যাত্রাপথে লামডিং ও চাপারমুখ স্টেশনের মধ্যবর্তী কোনো এক স্থানে দীপুর জামাকাপড় ভর্তি সুটকেসটি চুরি হয়ে গেল । ট্রেনটি ছিল শীতকালের নৈশ ট্রেন । সুটকেসটি উপরের বাঙ্কে রেখে আমি ও দীপু নিচের বাঙ্কে ঘুমিয়ে ছিলাম । কখন যে সুটকেসটি উধাও হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি । চাপারমুখ স্টেশনে ঘুম ভাঙ্গলে দেখলাম সুটকেসটি নেই । চাপারমুখ স্টেশনে কর্তব্যরত পুলিশকে জানালে ওর অভিব্যক্তি, "এটা চুরি ছিন্তাই এর এলাকা, স্যুটকেস এতক্ষণ পগার পার হয়ে গেছে ।" শিলং পৌঁছে দীপুকে নতুন জামাকাপড়ের সেট কিনতে হয়েছিল ।
প্রসঙ্গক্রমে আমি নিজেও একবার এরূপ সুটকেস চুরির শিকার হয়েছিলাম । আমি তখন কালনায় পোস্টেড, ছোট শ্যালিকাকে নিয়ে মেখলিগঞ্জ যাচ্ছিলাম । শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে চড়ে সুটকেসটি বাঙ্কে রেখে নিজেদের জায়গা খোঁজার ফাঁকেই জামাকাপড় ভর্তি সুটকেসটি বেপাত্তা হয়ে যায়।
আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ডানে দীপু, বামে আমি
কলেজে পঠন-পাঠন পুনরারম্ভ
অবকাশের পর আমাদের ক্লাশ পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়ে গেল । বাড়ীর স্নেহময় পরিবেশ ছেড়ে এসে মন বসাতে আমার কয়েকদিন কেটে গেল । ধীরে ধীরে আমি কলেজ ও হোষ্টেল জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নিলাম । অতঃপর আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পড়াশোনায় নিয়োজিত করলাম । সময়ের সাথে সাথে পড়ার চাপে ও বন্ধুবান্ধবদের আনন্দদায়ক সাহচর্যে আমার গৃহকাতরতা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হল । সেটা ছিল ১৯৬১ সাল; পরের বৎসরের প্রথমে অনুষ্ঠেয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার পাঠক্রম সম্পূর্ণ করার তাগিদ ছিল । তাছাড়া নিয়মিত মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষাও ছিল । তাই পড়াশোনায় শিথিলতার কোন অবকাশ ছিল না।
আই. এসসি ১৯৬১র ফল প্রকাশ: সহ-আবাসিকের ১ম স্থান লাভ
ইতিমধ্যে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬১ সালের আই. এসসি (I. Sc.) পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল । আমাদের কলেজের ছাত্র এবং হোষ্টেলের আবাসিক দীপক ভট্টাচার্য, যার সম্পর্কে আগে বলেছি প্রত্যাশা মত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হল ।
আমার আই. এসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি
এবার আমার পালা । পরের বৎসরের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে কলেজকে হ্যাট্রিকের দুর্লভ সম্মান এনে দেয়ার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হল । পড়াশোনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করলাম; কলেজ আমার সমস্ত ব্যয় বহন করছিল, কলেজকে আমার সেরাটা উপহার দেয়া কর্তব্য ছিল । তাছাড়া এই সময় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তীব্র বাসনা গভীরভাবে অনুভব করতাম । আমি জানতাম দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে । আর সেই জন্য প্রয়োজন পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট । অতএব আমার শক্তি ও সময়ের পুরোটাই অধ্যয়নে নিয়োগ করলাম । পড়াশোনার গতি বজায় রাখতে আমি ও দীপু স্থির করলাম শীতকালীন অবকাশের শেষভাগে অল্প কয়েক দিনের জন্য বাড়ী যাব ।
প্রসঙ্গতঃ ঐ শীতকালীন অবকাশে আমাদের শিলং অবস্থানকালে ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম ভাগে (সম্ভবতঃ ৩রা ফেব্রুয়ারী, সাল ১৯৬২) শিলং এ পারদ ০°সে এর নীচে নেমে গিয়েছিল এবং জলের পাইপে ও বালতিতে জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল । আমার শিলং এ চার বৎসরকাল অবস্থানের মধ্যে এরূপ ঘটনা ঐ একবারই ঘটেছিল ।
টুকি-টাকি
এটা জেনে অনেকে কৌতুক বোধ করতে পারেন যে শীতের কামড় থেকে রক্ষা পেতে আমরা গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে একদিন ও শীতকালে মাসে একদিন স্নান করতাম । স্নান করাটা আমাদের কাছে অনুষ্ঠান স্বরূপ ছিল; নির্দ্দিষ্ট দিনে দলবদ্ধ ভাবে জামাকাপড় নিয়ে মজা করতে করতে পালা করে যে যার স্নানঘরে ঢুকে পড়তাম । আমরা সাধারণতঃ বিকালের দিকে স্নান করতেই অভ্যস্ত ছিলাম ।
আমাদের আই. এসসি পরীক্ষার ফল
আমাদের ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পরীক্ষা হয় ১৯৬২ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে এবং ফল প্রকাশিত হয় জুলাই মাসে । আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি এবং অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় সর্বোচ্চ নম্বর পাই; অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে লেটার নম্বরও পাই । সামগ্রিক বিচারে পেয়েছিলাম স্টার মার্ক । প্রাপ্ত নম্বরের শতকরা হার ছিল ৮৫.১% । হ্যাট্রিক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক মণ্ডলী ও কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলাম; আমার পরিশ্রম সার্থক হল । কলেজ কর্তৃপক্ষ খুশী হয়ে কলেজের পক্ষ থেকে হ্যাট্রিককারী তিনজনকেই একটি করে রৌপ্য স্মারক উপহার দিলেন । ঐ স্মারকের প্রতিচ্ছবি নিম্নে প্রদত্ত হল । স্মারকটিতে কলেজের প্রতীক চিহ্নের নীচে নিম্নরূপ অন্তর্লিখন (inscription) রয়েছে (যার শব্দগুলো কালের প্রভাবে কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে)।
স্মারক
অন্তর্লিখন
" With pride and pleasure College remembers your performance"
First in inter-Science Examination
TAPAS KUMAR PAL (1960)
DIPAK CHAKARAVORTY (1961)
AJOY KUMAR DAS (1962)
FIRST IN STUDY IS GREAT INDEED BUT STEADY IN LIFE'S NOBLE DUTIES IS GREATER STILL. THIS IS OUR WISH AND GOD GRANT YOU THAT.
স্মারকে উদ্দিষ্ট ইচ্ছা-পূরণ
স্মারকে খোদিত ইচ্ছাগুলোর কতটা আমি পূরণ করতে পেরেছি জানি না, তবে এটা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি সারাজীবন ধরে ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্খাকে দূরে সরিয়ে রেখে আমি আমার কর্ত্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করেছি ।
নগদ পুরষ্কার
স্মারক ছাড়াও কলেজ কর্তৃপক্ষ নগদ ২০০ টাকা আমাকে পুরষ্কার দিয়েছিলেন । সেই টাকায় বাবা আমাকে একটি এ্যাংলো-স্যুইস ঘড়ি (Wristwatch) কিনে দিয়েছিলেন; এটিই ছিল আমার জীবনে প্রথম হাতঘড়ি । ঘড়িটি আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী ছিল । চাকুরীর শেষ পর্বে ঘড়িটি অচল হয়ে যাওয়ায় আমাকে তা পরিবর্তন করতে হয়।
(ক) আই. আই. টি (Indian Institute of Technology)
বি. টেকের জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রদান
আই. এসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য অপেক্ষায় থাকাকালীন আমি, দীপু ও অপর কয়েকজন বন্ধু মিলে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেক্নলজির (আই. আই. টি) প্রবেশিকা (এনট্রান্স) পরীক্ষা দিয়েছিলাম । এ বিষয়ে দীপুই ছিল মূল উদ্যোক্তা । সেকালেও আই. আই. টি. র (I.I.T.) বি. টেক্. (B. Tech.) কোর্সে ভর্তির জন্য সর্ব্বভারতীয় স্তরে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হত; পরীক্ষায় সফল হলে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে পাঠ্য বিষয় নির্বাচন করা হত ।
লিখিত পরীক্ষায় যোগ্য বিবেচিত, সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ: ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য নির্বাচিত
পরীক্ষায় আমার বন্ধুবান্ধব পরীক্ষার্থীদের মধ্যে আমি একাই কৃতকার্য হলাম । কৃতকার্য হয়ে আমি সাক্ষাৎকারের ডাক পেলাম । যোরহাট থেকে বিমানে কোলকাতা ও সেখান থেকে ট্রেনে খড়্গপুর পৌঁছুলাম । এটি আমার দ্বিতীয় বিমান ভ্রমণ, একা প্রথম । যতদূর মনে পড়ে বিমান ভাড়া ছিল ষাট টাকা, বিমানটি ছিল অধুনালুপ্ত ডাকোটা; সাল ১৯৬২ । হাওড়া থেকে খড়্গপুর পর্যন্ত ট্রেনে দ্বিতীয় শ্রেণীর, যে শ্রেণীতে আমি ভ্রমণ করেছিলাম,[34] ভাড়া ছিল দশ টাকা । ট্রেন তখন কয়লার কেনাডিয়ান ইঞ্জিনে চলত, ইএম্ইউ (EMU) চালু হয় নি । যাহোক, খড়্গপুর স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে কিয়ৎদূরে হিজলীতে অবস্থিত আই. আই. টিতে উপস্থিত হলাম । যথাসময়ে ইন্টারভ্যুয়ে ডাক পড়ল । সাক্ষাৎকার শেষে আমাকে পাঠ্য বিষয় হিসাবে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নিতে বলা হল । আমি তাই করলাম ও ভর্তি হয়ে গেলাম । "রাজেন্দ্র প্রসাদ হল অব রেসিডেন্স" নামক হোষ্টেলে আমার আবাস নির্দ্দিষ্ট হল ।
রেগিং এর উপলব্ধ আশঙ্কায় হোস্টেল ও প্রতিষ্ঠান ত্যাগ
যেদিন আমি হোষ্টেলে যোগ দিলাম, সেদিনই গভীর রাতে পাশের হোষ্টেল নেহরু হল থেকে ক্রমাগত হল্লার আওয়াজ পেতে লাগলাম । খোঁজ নিয়ে জানলাম নবাগতদের রেগিং চলছে । সারারাত ভয়ে ভয়ে কাটালাম । পূর্বে আমি অনেকের কাছে খড়্গপুর আই. আই. টিতে প্রচলিত রেগিং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে শুনেছিলাম । সেই সময় আমি খুব ভীরু ছিলাম, নেহরু হলের ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়লাম । পরদিন সারাদিন আমার মনের মধ্যে এখানে থাকা-নাথাকার দ্বন্দ্ব চলতে লাগল । রেগিং এর ভয় ত ছিলই । সেই সাথে আর্থিক অনবস্থা[35] হেতু অনিশ্চয়তার ভয় থেকে থেকেই মাথা চাড়া দিচ্ছিল । অবশেষে ভীরুতার জয় হল । অন্ধকার নামলে একটি রিক্সায় মালপত্র নিয়ে আমি খড়্গপুর স্টেশনে পালিয়ে[36] এলাম । সারারাত প্ল্যাটফর্মে কাটিয়ে ভোরের ট্রেনে কোলকাতা ফিরলাম । এইভাবে আমার ভীরুতা ও আর্থিক অনবস্থা হেতু মানসিক দ্বন্দ্ব খড়্গপুর আই. আই. টিতে আমার অধ্যয়নের পথ রুদ্ধ করে দিল, ঠিক যে ভাবে অনেক বৎসর পূর্বে আমার লাজুকতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব আমার কৈশোর জীবনের ইপ্সিত ভালবাসাকে পূর্ণতা দেয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করেছিল । এই প্রসঙ্গে আমার আমেরিকান অতীন্দ্রিয়বাদী (Transcendentalist) রলফ ওয়াল্ডো এমারসন্ এর কথা মনে পড়ছে । তিনি বলেছিলেন, "যা ভয় কর, তাই কর । ভয়ের মৃত্যু অনিবার্য ।" (“Do the thing we fear and death of fear is certain.”) । আজ আমার মনে হয় সেদিন যদি কৈশোরের ভালবাসাকে রূপ দিতে পারতাম বা সাহস সঞ্চয় করে রেগিং এর মুখোমুখি হয়ে তা অতিক্রম করতে পারতাম তবে আমার জীবনধারা হয়ত অন্য খাতে বইত । তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রেগিং এর বাধা অতিক্রম করতে পারলেও আর্থিক অনটন চার বছরের এই পাঠক্রম সম্পূর্ণ করার পথে অলঙ্ঘ্য অন্তরায় হয়ে যে দেখা দিত সে বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ ছিল না । এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে আলোচনা করেছি ।
প্রসঙ্গতঃ পরবর্তীকালের ইঞ্জিনিয়ারিং ও সমতুল্য পেশাগত কলেজ সমূহের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কত মেধাবী ছাত্রের স্বপ্ন রেগিং নামক এই দুষ্ট ব্যধির কবলে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে । এমন কি রেগিং এর নির্দয় প্রয়োগে জীবনহানি পর্যন্ত ঘটেছে । রেগিং প্রতিরোধক আইনও তৈরী হয়েছে, কোথাও কোথাও তার প্রয়োগও হচ্ছে । কিন্তু দুষ্ট ক্রীড়া চলছেই।
বাসভূমিতে ফেরৎ যাত্রা
কোলকাতা থেকে আমি ট্রেনে যোরহাট ফিরলাম । সেকালে কোলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ, গৌহাটি বা পরবর্তী স্থানগুলোতে রেলভ্রমণ যথেষ্ট কষ্টকর ছিল । প্রথমতঃ নিম্ন শ্রেণীতে শয়নযান ছিল না বা বার্থ সংরক্ষণ প্রথাও ছিল না । তাছাড়া গঙ্গা[37] ও ব্রহ্মপুত্র[38] নদী, যা যাতায়াতের পথে পেরোতে হত, তাদের উপর কোন সেতু ছিল না । গৌহাটি বা পরবর্তী স্থানে যেতে হলে স্টীমারে দুবার নদী পেরোতে হত । শকরীকলি ঘাট ও আমিনগাঁও নামক স্থানে যথাক্রমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র পার হতে রেল কোম্পানী আয়োজিত বিশেষ স্টীমার পরিষেবার ব্যবস্থা ছিল । শকরীকলি ঘাটে যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে স্টীমারে গঙ্গা পেরোতেন, তারপর অপর পার মনিহারি ঘাটে অপেক্ষমান সংযোগকারী ট্রেনে উঠে গন্তব্যের দিকে এগোতেন । মনিহারি ঘাটে সুস্বাদু খাবারের অনেক দোকান ছিল, এরা ধূমায়িত ভাতের সাথে ইলিশ বা অন্য উপাদেয় মাছের ডিশ পরিবেশন করত । আরো উপরের দিকে যাঁরা গৌহাটি বা গৌহাটি-পরবর্তী স্থানে যেতেন তাঁদেরকে আমিনগাঁওতে আবার ট্রেন থেকে নেমে স্টীমারে ব্রহ্মপুত্র পেরোতে হত । তারপর অপর পারে পান্ডুতে অপেক্ষমান ট্রেনে চেপে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে এগোতে হত । শকরীকলিঘাট পর্যন্ত রেললাইন রেলের পরিভাষায় ছিল ব্রডগজ, পরবর্তী লাইনগুলো সবই ছিল মিটারগজ । জীবনে এই প্রথম আমি এই পথে একাকী ভ্রমণ করছিলাম, স্বভাবতই কিঞ্চিৎ আশঙ্কা ছিল । কিন্তু নিরাপদেই আমি বাড়ী পৌঁছেছিলাম।
(খ) যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি কলেজে ভর্তি
যোরহাট ফিরে শুনলাম আমার বন্ধু দীপু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে । আমার মনে তখনো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার বাসনা বিরাজমান ছিল । দীপুর উপস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমার ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্র প্রকৌশল (Mechanical Engineering) পড়ার ইচ্ছে হল, এটি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সবচেয়ে প্রার্থিত বিষয় ছিল । বস্তুতঃ আমার এই পদক্ষেপটি ছিল আমাদের আর্থিক অনিশ্চয়তার প্রশ্নকে দূরে রেখে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার আরেকটি প্রচেষ্টা । রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য তখন কোন জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা ছিল না । যতদূর স্মরণ করতে পারি যাদবপুরেরও নিজস্ব কোন ভর্তি পরীক্ষা ছিল না । যোগ্যতানির্ধারক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই ভর্তি করা হত । আমার আইএসসি. পরীক্ষার ব্যতিক্রমি ফলের ভিত্তিতে আমি সহজেই ভর্তি হয়ে গেলাম, হোষ্টেলে স্থান পেতেও আমার কোন অসুবিধা হল না ।
যাদবপুর ত্যাগ: ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠের অভিলাষের সমাপ্তি
যাদবপুরে রেগিং এর ভয় ছিল না আর বাল্যবন্ধু দীপুর সাহচর্য ও পেয়েছিলাম । আমি ক্লাস করতে আরম্ভ করলাম, মাসখানেক ক্লাসও করলাম । কিন্তু অর্থের অভাবে পাঠক্রম সম্পূর্ণ করতে পারার অনিশ্চয়তা জনিত দুশ্চিন্তায় ও দূরে আত্মীয়-পরিজনহীন স্থানে নিরপত্তাহীনতাজাত মানসিক দ্বন্দ্বের দরুণ আমি পাঠ্য বিষয়টিতে মনোনিবেশ করতে পারলাম না । তাই শেষ পর্যন্ত আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হলাম । আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠের সমাপ্তি ঘটল ।
স্নাতকার্থী পাঠের শেষ গন্তব্য: সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজ
আমি শিলং ফিরে গিয়ে আমার পুরনো সেন্ট এন্থোনিজ কলেজে অঙ্কে অনার্স নিয়ে বি. এসসি. কোর্সে ভর্তি হলাম, অপর বিষয় দুটি ছিল রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা । কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পূর্বের সমুদয় আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রসারিত করলেন । জাতীয় মেধাবৃত্তি প্রাপক হিসাবে আমি মাসে পঁচাশি টাকা বৃত্তিও পেতাম । আর্থিক অনিশ্চয়তা হেতু পাঠ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর হল । তথাপি ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো, যেখানে পড়ার স্বপ্ন ছাত্রছাত্রীরা দেখে থাকে, স্বেচ্ছায় ছেড়ে আসার জন্য প্রথম সপ্তাহ দুয়েক বিমর্ষ হয়ে রইলাম । এই সময় আমার সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে মনের ভিতর ক্রমাগত দ্বন্দ্ব চলত । হোষ্টেলে পুরনো বন্ধুদের অনুপস্থিতিও আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে তুলত । আমার ঘনিষ্ট বন্ধু দীপুর অনুপস্থিতি আমাকে ব্যথিত করত বিশেষ করে ছুটির দিনে হোষ্টেলে এবং অবকাশকালে বাড়ী যাতায়াতের সময় । প্রায়শঃ তোষিতার কথা আমার মনে পড়ত । ওর কথা ভাবতে আমার ভাল লাগত ও তা আমাকে নির্বান্ধবতার কষ্ট থেকে সময় সময় মুক্তি দিত, বিশেষ করে আমি যখন একা থাকতাম । ধীরে ধীরে আমি পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিলাম, নতুন বন্ধু হল; আমি পড়াশোনায় মন দিলাম ।
স্নাতক স্তরে নতুন বন্ধু-বান্ধব
স্নাতক পাঠকালে আমার যে কয়েকজন নতুন বন্ধু হল তাদের মধ্যে ছিল অঞ্জন ভট্টাচার্য (নীচের ছবিতে একেবারে ডানদিকে), সুরজিৎ চৌধুরী এবং আরো কয়েকজন যাদের সকলের নাম এখন আর আমার মনে নেই । জানি না আমার ঐ বন্ধুরা আজ কোথায় । কলেজ ত্যাগের পর ওদের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় নি । স্নাতকস্তরে অধ্যয়নকালে হোস্টেলের কয়েকজন সহ-আবাসিকের ছবি নিম্নে প্রদর্শিত হল । এদের মধ্যে বাঁ দিক থেকে প্রথম তিনজন অসমীয়া, পরের জন বাঙালী, তার পরের জন নাগা ও সবশেষে অঞ্জন । অঞ্জন ব্যতীত আর কারো নাম আজ আর আমার মনে নেই । আমাদের কলেজ ও হোস্টেলের বিশ্বজনীন চরিত্র বোঝাতে এদের জাতিগত পরিচয় উল্লেখ করলাম ।
ভুতুমামার শিলং আগমন
এই সময় আমার এক মামা, যাকে আমরা ভুতুমামা বলে ডাকতাম ও যার পরিচয় আমার এই ওয়েবসাইটে মামাদের সংক্রান্ত ওয়েবপেজে দেয়া আছে, শিলং এর এক হোটেলে ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে এলেন । হোটেলটি ছিল পুলিশ বাজারে; জি. এস. রোড ও কিটিং রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত । মামা ও মামী দুজনে হোটেলেই থাকতেন । মামী আমাকে প্রতি রবিবার ওঁদের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । সময় সময় আমি ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম এবং মাঝে মধ্যে রবিবারের দুপুরের খাওয়া খেয়ে আসতাম ।
এটা আমার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন পড়াশোনার রুটিনের বাইরে চিত্তবিনোদক হিসাবে কাজ করত ।
কুমুদ রঞ্জন দাস ওরফে ভুতু মামা
অবকাশ যাপন
দূর্গপূজা ও শীতকালীন অবকাশে বাড়ী গিয়ে পরিবারের সাথে সময় কাটাতাম, বাবাকে প্রেসের কাজে সাহায্য করতাম ও পুরণো বন্ধুবান্ধবদের সাহচর্য উপভোগ করতাম । কিন্তু যাকে দেখার জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুল ছিল সেই তোষিতার দেখা পাই নি ।
১৯৬৪ সালের স্নাতক পরীক্ষার ফল প্রকাশ: আমার কৃতিত্ব
এই ভাবে আমার স্নাতক স্তরের পাঠক্রমের দু বছর অতিবাহিত হল । ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম এবং অঙ্কে অনার্স নিয়ে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে (ফার্স্ট ক্লাস) উত্তীর্ণ হলাম । ঐ বৎসর বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কে আর কেউ প্রথম বিভাগ পায় নি । আমি আরো একবার জাতীয় মেধাবৃত্তি পেলাম; মাসিক ১১০ টাকা হিসাবে স্নাতকোত্তর পঠনপাঠনের জন্য ।
এই ভাবে আমার ছাত্রজীবনে মেট্রিক থেকে স্নাতোকত্তর স্তর পর্যন্ত আমি সর্বদা জাতীয় মেধাবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলাম ।
সেন্ট এন্থোনিজ কলেজের উপাধ্যক্ষের একটি শংসাপত্র ডানপার্শ্বে সংযোজন করলাম । এর থেকে কলেজ অবস্থান কালে আমার আচরণাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে । শংসাপত্রটি পরবর্তীকালে কর্মস্থলে বন্যার জলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ।
কলেজের প্রতি কৃতজ্ঞতা
আমার চার বৎসরের অধ্যয়নকালে কলেজে বিনা বেতনে শিক্ষালাভ এবং হোস্টেলে বিনা ব্যয়ে আহার ও আবাসের সংস্থান করে দেয়ার জন্য আমি সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজ কর্তৃপক্ষের নিকট অসীম ঋণী । এখানকার শিক্ষা প্রণালীও আমাকে অর্জিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে অপরিসীম সাহায্য করেছে ।
শিলং সম্পর্কে আমার অনুভূতি
আমার শিলং বাসের গল্পের উপসংহারে এটাই বলব আমার ৪ বছরের শিলং অবস্থানে প্রথম দুবছর অধিকতর আনন্দময় ছিল । অন্তিম পর্যায়ের ২ বছর আমি আগের বন্ধুদের অভাব গভীর ভাবে অনুভব করেছি । ঐ সময় আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর যে সব প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এসেছি ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা সানন্দে তাদের পাঠক্রম যথাযথ অনুসরণ করছে এই কল্পিত চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে সময় সময় আমায় বিষণ্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে ।
খাসিয়া সমাজ-ব্যবস্থা
খাসিয়া পাহাড়ে যেখানে শিলং অবস্থিত, বসবাসকারীদের মধ্যে খাসিয়ারাই প্রধান । অন্যান্য অনেক পাহাড়ী আদিবাসীদের মত খাসিয়াদেরও মাতৃতান্ত্রিক[29] সমাজ ব্যাবস্থা । বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর পরিবারের সাথে বসবাস করে । সন্তান-সন্ততিরা মায়ের উপাধি গ্রহণ করে ।
খাসিয়াদের কর্ম-সংস্কৃতি
অধিকাংশ বাইরের কাজই মেয়েরা করে থাকে । বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের ও পোষাক পরিচ্ছদের খুচরো দোকান এবং বাজারের মাছ ও সব্জির দোকানগুলো এরাই চালায় । স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নিম্ন স্তরের অনেকেই মোট বইতে অভ্যস্ত । শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে এদের মধ্যে চাকুজীবির সংখ্যাও বাড়তে থাকে, তবে সেখানেও সেদিনের হিসাবে সংখ্যায় মেয়েরা ছেলেদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল ।
খাসিয়া রমণীর পরিধেয়
পরিধেয়ের ক্ষেত্রে খাসিয়ারা ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল; মেয়েদের সর্ব্বাঙ্গ আবৃত থাকত । আমার জ্ঞানমত প্রাত্যহিক পরিধেয় হিসাবে তের টুকরো আলাদা আলাদা কাপড় ব্যবহার করত । পার্শ্বে সেইরূপ পরিধেয় পরিহিতা কয়েকজন খাসিয়া রমণীর চিত্র প্রদর্শিত হল । ছবিটি ইণ্টারনেট থেকে নেয়া ।
তবে পরবর্তীকালে শিলং ভ্রমণের সময় খাসিয়া রমণীদের মধ্যেও পাশ্চাত্য পোষাকের প্রাবল্য লক্ষ্য করেছি ।
শিলং এর আইন-শৃঙ্খলা
আমাদের সময় শিলং শান্তিপূর্ণ ছিল; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল চমৎকার । পরবর্তী কালে উত্তর-পূর্বের অন্যান্য স্থানের মত এখানেও উগ্রতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়ে যায় । এই সব আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল HNLC (Hynniewtrep National Liberation Council)[30] এবং ANVC (Aachik Natioal Volunteer Council)[31] নামধারী উগ্রপন্থী দল । এদের প্রভাবে শিলং কিছুদিনের জন্য একটি অশান্ত এলাকায় পরিণত হয়েছিল ।
শিলং এর গুরুত্ব
আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য শিলংকে পূবের স্যুইৎজারল্যান্ড বলা হয় । আমাদের সময় শিলং আসামের রাজধানী ছিল । ছাত্রজীবনে আমার শিলং অবস্থান কালে ওখানকার দর্শনীয় স্থানসমূহের অনেকগুলোই ঘুরে দেখেছি ।
উল্লেখযোগ্য জলপ্রপাত
শিলংএ তিনটি বিখ্যাত জলপ্রপাত এ্যালিফেণ্টা, বিডন ও বিশপ রয়েছে । শেষের দুটো আমরা দেখেছি; একটিতে বিরাট সংখ্যক সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে দেখেছি কিভাবে ফেনাভ জল তীব্র গতিতে পাথর ও পাথরকুঁচি বিছানো খাতে পড়ে ধীর গতিতে সম্মুখে এগিয়ে চলেছে । যে জলধারাটি এই প্রপাত তৈরী করেছে তা উপরের পাহাড়ে জি. এস. রোডকে শিলং প্রবেশের মুখে আড়াআড়ি ভাবে অতিক্রম করেছে ।
ওয়ার্ডস লেক
ওয়ার্ডস লেকের একটি দৃশ্য
শহরের কেন্দ্রস্থল পুলিশবাজার এলাকায় ওয়ার্ডস লেক নামক বিখ্যাত লেকটি অবস্থিত । অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে তৈরী অশ্বখুরাকৃতি এই কৃত্রিম লেকটি ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক । এর স্থানে স্থানে রঙ-বেরঙের ফুলের বাগান ও পরিসীমায় পাহাড়ের ঢালে কোমল ঘাসের গালিচা । আমরা প্রায়শঃই লেকে বেড়াতে যেতাম । লেকের জলে ভাসমান মাছের খেলা দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে যেত । লেকের পাড়ে ঘাসের গালিচায় বসে গল্প করার বা লেকের জলে বোটিং করার সুযোগও ছিল । লেকের মধ্যস্থলে অবস্থিত সেতু থেকে জলে বিচরণশীল মাছকে খাওয়ানো যেত । সম্পূর্ণ লেকটির অবারিত দর্শনের জন্যও এটিই ছিল প্রকৃষ্ট জায়গা । লেকটির পাশেই রয়েছে বিভিন্ন ধরণের অর্কিড ও উদ্ভিজ্জের শ্যামলিমাময় বোটানিক্যাল গার্ডেন ।
এই লেকের পরিকল্পনাকারী আসামের তদানীন্তন চিফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ডের নামে লেকটির নামকরণ হয়েছে । ১৮৯৪ সালে কর্ণেল হপ্কিনস (Hopkins) লেকটি তৈরী করেন । বলা হয় জনৈক খাসিয়া বন্দী তার বন্দী জীবনের দৈনন্দিন একঘেয়েমি কাটাতে এই এলাকা তৈরিতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল।
ওয়ার্ডস লেকের অপর একটি দৃশ্য
চেরাপুঞ্জি
আইএসসি পাঠকালে আমরা একবার চেরাপুঞ্জি গিয়েছিলাম যেখানে এককালে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হত । সে ছিল এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা । চেরাপুঞ্জিতে সর্ব্বক্ষণ রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা চলছে । এই রোদ ত এই বৃষ্টি[32] । সঙ্গে ছাতা বা রেনকোট না নিয়ে এখানে চলা দায় । এমন একটি দুরবর্তী প্রান্তে যৎসামান্য লোকসংখ্যা বিশিষ্ট স্থানেও রামকৃষ্ণ মিশন[33] দূর দূরান্তের দুঃস্থ লোকেদের সাহায্য ও স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে তাদের শাখা খুলেছিল। ২০০১ সালের আদমসুমারি (সেন্সাস) অনুযায়ী এই এলাকার লোকসংখ্যা ছিল ১০,০৮৬ যা আমি যখনকার কথা বলছি তখন খুব বেশী হলেও তা ৫০০০ ছাড়াত না । শাখাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে যখন এখানকার লোকসংখ্যা ৩৫০০ র কাছাকছি থাকারই সম্ভাবনা । আমরা সশ্রদ্ধ অন্তঃকরণে মানব সেবার প্রতিভূ মিশনটি দর্শন করেছিলাম । সবদিক থেকে আমাদের চেরাপুঞ্জি ভ্রমণ খুবই উপভোগ্য হয়েছিল ।
চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশন
সোহরাতে অস্বাভাবিক আবহাওয়া পরিবর্তন
অনেক দশক পেরিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বন্ধুবর আশুর (আশুতোষ পাল) সাথে যখন চেরাপুঞ্জি (স্থানীয় নাম সোহরা) পুনর্দশনে যাই তখন সেখানে বৃষ্টির চিহ্নমাত্র ছিল না । জলপ্রপাত ও জলাশয়গুলির সবই প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল । দু-একটি জলপ্রপাতে সরু ধারায় জল নেমে আসছিল । চেরাপুঞ্জির প্রধান জলপ্রপাত নোহ-কা-লিকাইর পাশে দেয়া ঐ সময়কার চিত্রটি থেকে বিষয়টি পরিস্ফুট হবে । স্থানীয়দের থেকে জানা যায় যে আগের বৎসরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চেরাপুঞ্জিতে কোন বৃষ্টিপাত হয় নি । তথাকথিত উন্নয়নার্থে (রাস্তা সম্প্রসারণ, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, খণিজ পদার্থ উত্তোলন ইত্যাদি) নির্বিচারে বৃক্ষ ও পাহাড় ছেদন জাতীয় ধ্বংসাত্মক কর্ম্মই এমন অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয় ।
নোহ-কা-লিকাই জলপ্রপাত
ডাউকি-তামাবিল দর্শন
আরেকবার তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত শ্রীহট্ট শহরের সীমানায় অবস্থিত ডাউকি দর্শনে গিয়েছিলাম । দূর থেকে জন্মভূমির সীমানা সংলগ্ন অঞ্চলের নৈসর্গিক শোভা দেখে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম । ইচ্ছে হচ্ছিল সীমানা ডিঙিয়ে ওপারে গিয়ে নিজের জন্মস্থান দেখে আসি । কিন্তু তা ত সম্ভব ছিল না । ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরে আসি । ডাউকির যাত্রাপথ খুবই মনোরম ছিল।
বহু বছর পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্মভূমি দর্শনের এই তীব্র বাসনা চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়েছিলাম । এর বিস্তৃত বিবরণ এই ওয়েবসাইটের "আমার জন্মভূমি শ্রীহট্ট: দীর্ঘ প্রতিক্ষার একটি সফর" নামক পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে ।
শিলচর-শিলং রাজপথ: একটি প্রাথমিক সফর
স্নাতক শ্রেণীতে অধ্যয়ন কালে মোটর পথে শিলং থেকে শিলচর যেতে ২১৮ কি. মি. পার্বত্য পথ অতিক্রম করেছিলাম । আমার ছিল নৈশ যাত্রা । রাস্তাটি তখন সবে চালু হয়েছে, কোথাও কোথাও তখনও কাজ হচ্ছিল । রাস্তাটি খুবই সরু ছিল, সর্বত্র পাশাপাশি দুটি গাড়ী পার হওয়ার মত পরিসর ছিল না । তার উপর বৃষ্টি হচ্ছিল । স্থানে স্থানে গভীর গিরিখাতের পাশ দিয়ে চলা যাত্রাপথটি বিরূপ আবহাওয়ার দরুণ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ছিল । আমরা জায়গায় জায়গায় যানজটে আটকে যাচ্ছিলাম । শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমি নিরাপদেই গন্তব্যে পৌঁছেছিলাম ।
আসাম ত্যাগের সঙ্কল্প
আমি স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময়কালের মধ্যে আমার ভীরুতা ও গৃহকাতরতা উভয়েই দূরীভূত হয়েছিল যদিও আমার অন্তর্মুখিতা (Introversion) আমাকে ত্যাগ করেনি । ইতিমধ্যে আমার আত্মবিশ্বাসও দৃঢ়ীভূত হয়েছিল । আমি সঙ্কল্প করলাম আমার স্নাতোকত্তর পাঠ ও বহির্বিশ্বে যোগাযোগের (এক্সপোজার) সুবিধার্থে আমি আসাম ছেড়ে অধিকতর সম্ভাবনাময় অন্য কোন স্থানে চলে যাব ।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতে ভর্তির প্রচেষ্টা
আমি কোলকাতা এলাম ও ফলিত অঙ্কে (Applied Mathematics) স্নাতোকত্তর শ্রেণীতে ভর্তির জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে (Calcutta University College of Science & Technology) আবেদন করলাম । ততদিনে ঐ কলেজে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল । আমাকে জানানো হল আমার ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে, ভর্তির অনুমোদন পাওয়ার বিষয়েও আশ্বাস পেলাম না ।
দিল্লী রামযাস কলেজের অনুমোদন
আমি ইতিপূর্বে দিল্লির রামজাস কলেজে অঙ্কে এম্. এসসি. তে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলাম । সেখানে ভর্তির সম্মতি পত্রও (offer letter for admission) আমার কাছে ছিল ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ গণিতে ভর্তি
ইতিমধ্যে আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ গণিতে (Pure Mathematics) স্নাতোকত্তর শ্রেণীতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলাম । এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিত বিষয়টি পাঠক্রমে ছিল না । আমি কোলকাতায় থাকাটাই শ্রেয়[39] মনে করলাম ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম । বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধির মধ্যে অবস্থিত একটি হোস্টেলে স্থানও পেয়ে গেলাম । ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠরত আমার বন্ধু দীপু নিকটবর্তী নিউ হোস্টেলে থাকত, যেখানে মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র হিসাবে আমিও কিছুদিন ছিলাম । আমি স্নাতোকত্তর শ্রেণীর ক্লাস করতে শুরু করলাম এবং কিছুদিন ক্লাসও করলাম ।
সায়েন্স কলেজে ভর্তির অনুমোদন লাভ
এমন সময় হঠাৎ একদিন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেখানে ফলিত গণিতে ভর্তির অনুমোদন পেলাম । অনুমোদন পত্রটি আমাদের শিলচরের[40] তৎকালীন ঠিকানা হয়ে আমার কাছে পৌঁচেছিল । এটি ছিল আমি কোলকাতায় এসে সায়েন্স কলেজে ফলিত গণিত শাখায় স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তির যে আবেদন করেছিলাম তার অনুমোদন । ফলিত গণিত সর্বদাই আমার প্রথম পছন্দের বিষয় ছিল । আমি ঐ বিষয় পড়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না । আমি আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলাম ।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইগ্রেশন
৯২নং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রোডে অবস্থিত Calcutta University College of Science & Technology তে ফলিত গণিতে স্নাতোকত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হলাম । ৪৯বি হাজরা রোডে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে আবাসিক হিসাবে স্থান পেলাম । সেটা ছিল ১৯৬৪ সাল । ক্লাস করতে অন্যদের সঙ্গে আমাকেও প্রতিদিন অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করে আচার্য প্রফুল্ল রায় রোডে কলেজে যেতে হত । আমার এখনও মনে আছে ৩৩ নং দোতলা বাসে, যা সেই সময় চেতলা থেকে পাইকপাড়া পর্যন্ত যাতায়াত করত, আমরা কলেজে যেতাম । হোস্টেল থেকে কলেজ পর্যন্ত দূরত্ব ছিল কমপক্ষে ১০ কি. মি. আর ভাড়া ছিল ১০ নয়া পয়সা[41] ।
হোস্টেলের বন্ধুবান্ধবও সহপাঠি
হোস্টেলে আমার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন ছিল আগরতলা থেকে আগত ফলিত গণিতের অমরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, বিশুদ্ধ গণিতের সৌমিত্র চৌধুরী ও, পদার্থ বিদ্যার ছাত্র দেবজ্যোতি ভৌমিক এবং মেদিনীপুর থেকে আগত বিশুদ্ধ গণিতের ছাত্র ভবতোষ মণ্ডল । আমার রুমমেট ছিল মেদিনীপুরের গ্রামের সহজ সরল ছেলে পরিসংখ্যান (স্ট্যাটিসটিকস) বিদ্যার ছাত্র নিশীথ বেরা । অনেকদিন পর আমি যখন রইটার্স বিল্ডিংসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুন্নত শ্রেণী কল্যাণ বিভাগে যুগ্ম কমিশনার হিসাবে কর্ম্মরত সেই সময় নিশীথের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল । চিত্রাভিনেতা মৃণাল মুখার্জিও স্যাটিসটিক্সের ছাত্র হিসাবে আমাদের সঙ্গে হোস্টেলে থাকত । কোলকাতার এক রাজনৈতিক নেতার কন্যার সাথে ওর তখন পূর্বরাগ চলছিল । সেই সময় মৃণাল মাঝে মাঝে যাত্রাতেও অভিনয় করত । হোস্টেলে থাকাকালীন ও বাংলা ছবি শঙ্খবেলায় প্রথম অভিনয় করে । ঐ ছবি মুক্তি পেলে মৃণাল আমাদের কয়েকজনকে উজ্জ্বলা সিনেমা হলে ছবিটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল । ২০১৯ সালের ৭ই মে মৃণাল পরলোকগত হয়েছে । হোস্টেল ছাড়ার পর মৃণালের সাথে আমার আর দেখা হয়নি ।
হোস্টেলের বাইরের সহপাঠিদের মধ্যে ছিল সচীন উপাধ্যায়, প্রণব বিদ, জয়ন্ত চৌধুরী, প্রদোষ দাশগুপ্ত, মাণিক সরকার প্রমুখ । প্রদোষ দাশগুপ্ত ব্যতীত বাকিরা এখন কোথায় জানি না ।
প্রথমবার স্নাতোকত্তর পরীক্ষা বর্জন: কারণ ও অনুশোচনা
আমি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম এই প্রত্যাশা নিয়ে যে এখানে শিক্ষাদানে বিশেষ ভাবে জ্ঞানলব্ধ প্রখ্যাত শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পাব । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিশ্ববিশ্রুত । অপেক্ষাকৃত ছোট শহরের নামী কলেজে যেরূপ ব্যতিক্রমী মেধাসম্পন্ন শিক্ষকমণ্ডলীর কাছে আমি শিক্ষালাভ করেছিলাম তার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রত্যাশা অমূলক ছিল না । কিন্তু আমি নিরাশ হলাম । এখানকার শিক্ষাদানের পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না । শিক্ষকদের কারো কারো মধ্যে নিজেদের নোট পড়ে যাওয়ার প্রবণতাই অধিক ছিল । ফলিত গণিতের মত বিষয়ে এই শিক্ষণ প্রণালী আমাদের কয়েকজনকে পাঠ্য বিষয়ের গভীর অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হল । অবশ্য আমাদের সহপাঠিদের মধ্যে যারা প্রেসিডেন্সি কলেজ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিল তারা ত্রিবর্ষীয় স্নাতক স্তরে লব্ধ উন্নত জ্ঞানের[42] জন্য বিষয়গুলো অনুধাবন করতে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল । আমরা যারা বাইরে থেকে এসেছিলাম সমস্যাটা তারাই বেশী বোধ করছিলাম । আমার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো কঠিন ছিল । আমি ক্লাশ শুরুর অনেকদিন পর ভর্তি হয়েছিলাম; প্রথম দিকে পড়ানো বিষয়ের অনেক কিছুই আমার অজানা ছিল । আমি অন্তর্মুখি ও বহিরাগত হওয়ায় এমন কাউকেও[43] বন্ধু হিসাবে পেলাম না যে আমাকে পূর্বে পঠিত বিষয়ে যথাযথ ভাবে অবহিত করতে পারে । ক্লাসের দৈনন্দিন পাঠ অনুধাবন করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল; আমি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারাতে লাগলাম । আগ্রহের অভাবে আমি এবং আরো কয়েকজন বন্ধু ক্লাস বাদ দিতে লাগলাম । ফলিত গণিতের বিষয়সূচীতে কয়েকটি নতুন বিষয়ও ছিল । যথাযথ উপস্থাপনার অভাবে তার দু-একটিতে আমার প্রয়োজনীয় আগ্রহ জন্মাল না । আমার মত একজন প্রতিভাবান ছাত্রের শ্রেণীকক্ষে প্রদত্ত অধ্যাপকের বক্তৃতা অনুধাবন করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারার অপারগতা আমার মধ্যে নৈরাশ্যের সৃষ্টি করে থাকতে পারে যার ফলে মন অন্যত্র বিকল্প সন্ধানে প্রবৃত্ত হয় । ছাত্রাবাসের সদ্যলব্ধ লাগামহীন স্বাধীনতাও এর সহায়ক হয় । এরূপ পরিস্থিতিতে মহানগরীর মোহময় পরিবেশ পড়াশোনা থেকে আমার মনকে অনেকটা বিচ্যুত করল । ফলতঃ পরীক্ষার সময় এলে দেখলাম আমি প্রস্তুত নই । স্থির করলাম, ঐ বৎসর পরীক্ষা দেব না; পরের বৎসর সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় বসব।
পাঠক্রম যথাযথ ভাবে অনুধাবনের পথে এখানে উল্লিখিত বিষয়সমূহ অন্তরায় হয়ে থাকলেও আমি মনে করি স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পঠনকালে আমি নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করতে ব্যর্থ হয়েছি । পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে নিজেকে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে এই বাধাগুলি অতিক্রম করা হয়ত অসম্ভব হত না । আমি বিশ্বাস করি "ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ" এই আপ্তবাক্যকে উল্লঙ্ঘন করে মনোযোগ অন্যত্র নিবদ্ধ না করলে আমাকে পরীক্ষা বর্জন করতে হত না, পরন্তু সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারতাম । এই বিচ্যুতির জন্য আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না । আমার এই অবনয়ন আমি কোনদিন মেনে নিতে পারব না, এর কাঁটা চিরদিন আমাকে সময়ে অসময়ে বিদ্ধ করবে ।
আমার অপ্রতিরোধ্য গতিকে আমারই মূর্খামিতে এখানে এসে থমকে যেতে হয়েছিল । নিজেকে তুলে ধরার শেষ মাইলস্টোনটি অতিক্রম করার সুযোগ আমি হেলায় হারিয়ে জনারণ্যে মিশে গেলাম । এ দুঃখ, এ কষ্ট ভুলবার নয় ।
দিল্লী যাত্রা ও বন্ধু সুব্রত
যাহোক, পরীক্ষা না দিয়ে আমি দিল্লী চলে গেলাম । সেই আমার প্রথম দিল্লী যাওয়া । সেই আমার ছাত্রজীবনে প্রথম ও শেষবারের মত পরীক্ষা বর্জন । এটা আমার জীবনের একটা কলঙ্ক । সালটা ছিল ১৯৬৬ । দিল্লীতে আমি আমার এক বন্ধু সুব্রত পুরকায়স্থের আত্মীয়ের কাছে ছিলাম । সুব্রতের সেই আত্মীয় ভারত সরকারে একজন আণ্ডার সেক্রেটারী ছিলেন, তিনি মেসবাড়ীতে থাকতেন ।
শিলং এ সেন্ট এন্থোনিজ কলেজে পড়ার সময় সুব্রত আমাদের হোস্টেলের বাইরের বন্ধুদের একজন ছিল । সুব্রত ওর দাদার কাছে থাকত । ওর দাদা ঐ সময় শিলং এ পোস্টেড একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন । সুব্রতরাও সিলেটি । আমি যখন দিল্লী যাই সুব্রত তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক শ্রেণীতে পাঠরত । পরবর্তী কালে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মজীবন শেষ করে ও কোলকাতায় স্থিত হয় । অবসরের পর ও আমার এক সহকর্ম্মীর মাধ্যমে আমাকে খুঁজে বের করেছিল এবং কয়েক যুগ পরে আমাদের দুজনের বার কয়েক দেখা ও কথা হয়েছে ।
দিল্লী থেকে প্রত্যাবর্তন পরবর্তী ঘটনা
যাহোক, এম. এসসি. (M. Sc.) পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি কোলকাতা ফিরে এলাম ও আগের হোস্টেলেই উঠলাম । আমি নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করলাম যেন পরের বার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় বসতে পারি ও সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারি । কিন্তু পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে এই পরিকল্পনা ওলট-পালট হয়ে যায়।
আমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্নাতকোত্তর স্তর অতিক্রম করেছি, যদিও ফল আমার তদবধি অর্জিত মান থেকে লক্ষ যোজন দূরে রয়ে গেছে । এ বিষয়ে বিস্তারিত আমার কর্মজীবনের বহরমপুর অধ্যায়ে পাওয়া যাবে ।
রিলোকেশন: কারণ ও পরিস্থিতি
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হলাম সেই সময়কালের মধ্যে আমার দাদা শিলচরের একটি কলেজে লেক্চারার (Lecturer) পদে যোগ দিল । আমার পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর্থিক অনিশ্চয়তা সংক্রান্ত দুর্ভাবনা দূর হল । দাদার সঙ্গে বসবাস করার জন্য মা-বাবা যোরহাট ছেড়ে শিলচর চলে গেলেন । যোরহাটের বাস উঠে যাওয়ায় তোষিতার সঙ্গে আমার যোগাযোগের সম্ভাবনাও ক্ষীণতর হয়ে গেল । বয়স ও ব্যাধির দরুণ এবং আমাদের দুই ভাই এর অনুপস্থিতিতে বাবার একার পক্ষে প্রেস চালনা করা সম্ভব ছিল না ।
অধিকন্তু, অধুনা নাগাল্যাণ্ডের অন্তর্গত তুয়েনসাং, মকক্চাং প্রভৃতি যে সব অঞ্চল থেকে আমাদের প্রেসে বৃহদাংশ কাজের অর্ডার আসত, নেফায় নাগা আন্দোলনের ফলে ঐ সব অঞ্চল থেকে অর্ডার আসা আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । এরপর আসামের বঙালখেদা আন্দোলনের জেরে বেশ কিছুকাল প্রেস বন্ধ থাকায় গ্রাহক সংখ্যা আরো কমে গেল, ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল । যতদূর মনে পড়ে, এই সময় দাদা লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক পদে নিযুক্ত হয় । এর ফলে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা হল, কিন্তু প্রেসের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কোন সুরাহা হল না । এর কিছুকাল পর দাদা শিলচরে গুরুচরণ কলেজে লেকচারার পদে যোগ দেয় ।
প্রেসের আয় জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট না হওয়ায় ও প্রেসের পুনরুজ্জীবনের কোন আশা না থাকায় বাবা শিলচরে রিলোকেট করার সিদ্ধান্ত নেন ।
আমাদের প্রেসের উপর রিলোকেশনের প্রভাব
পরিবারের রিলোকেশনের ফলে প্রেসের ভবিষতের উপর যবনিকা পড়ে গেল । অতীতে আমাদের কাউকে প্রেসে বসিয়ে রেখে বাবা সময় সময় ওর্ডার সংগ্রহ করতে ও পাওনা আদায় করতে বেরোতেন । আমার পর দাদাও যোরহাট ছেড়ে চলে আসায় সেই পথও রুদ্ধ হয়ে গেল । বাবার অনুপস্থিতিতে প্রেসের কাজকর্ম্ম চালনা করার জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে বিশ্বাসী কর্ম্মচারী রাখাও আমাদের সামর্থের মধ্যে ছিল না । সুতরাং প্রেস পুনর্চালনার বা বিক্রীর বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তা তালাবন্ধ রেখে যোরহাট ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ব্যতিরেকে বাবার গত্যন্তর ছিল না । পরে আমার ভগ্নীপতি রজনী মোহন রায় যিনি যোরহাটে বসবাস করতেন প্রেসটি কিছুদিন চালাবার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু প্রেসের ভগ্নস্বাস্থ্য তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি । অবশেষে প্রেসটি বিক্রী হয়ে যায়, তবে তা বাবার মৃত্যু ও আমার চাকুরীতে প্রবেশের অনেক পরে ।
পরিপ্রেক্ষি
আমার শিক্ষাজীবনে মেট্রিক পরবর্তী প্রতিটি পর্যায়ে কোন না কোন কারণে আমি একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্য বিষয় পরিবর্তন করেছি । ভাল বা খারাপ যাই হোক পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তগুলো সবই একান্তভাবে আমার নিজস্ব, কারো দ্বারা প্রভাবিত নয় । শিক্ষার সীমাবদ্ধতা হেতু আমার মা-বাবার পক্ষে আমাকে উপযুক্ত পথনির্দেশ দেওয়া সম্ভব ছিল না; আমার দাদাও সেই সময় ক্যারিয়ারগত সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিল না । আমার নিজেরও ক্যারিয়ার সম্পর্কে পূর্বনির্ধারিত কোন লক্ষ্য ছিল না । আমাদের আর্থিক অবস্থাও তখন খুবই দুর্বল ছিল । কেবল ছাত্রবৃত্তির উপর নির্ভর করে কতদূর এগোনো যায় সে বিষয়েও আমার কোন ধ্যান ধারণা ছিল না । অপরদিকে আমি ছিলাম অতীব কল্পনাপ্রবণ । পূর্বাপর বিবেচনা না করে ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হয়ে নিজের মেধার জোরে একাধিক শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ সুনিশ্চিত করেছি; পরবর্তী পর্যায়ে বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি হয়ে তা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছি । আমার মা-বাবা বা বয়োজ্যাষ্ঠরা আমার এই ক্রিয়াকলাপের কোনটির জন্যই কখনো আমাকে ভর্ৎসনা করেন নি । তাঁরা সর্বদা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন ও আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছেন।
ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ বিশ্লেষণ
আমার বিষয় কিংবা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে কোন ভুল ছিল না, কিন্তু বিভিন্ন কারণে কোনটিতেই আমি লেগে থাকতে পারিনি । ইতিমধ্যে আলোচিত এর একটি প্রধান কারণ ছিল আমাদের আর্থিক অনবস্থা । আমাদের তদানীন্তন আর্থিক অবস্থায় নির্বাচিত বিষয় বা প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে পাঠ্যসূচী সম্পূর্ণ করার প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থানের অনিশ্চয়তা মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উৎপাদনে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল । পাঠক্রম নির্বাচন কালে আর্থিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে আসেনি । এ বিষয়ে পরিবারের কারো কোন ধারণাই ছিল না; এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে কোন আলোচনাও হয় নি । ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর সেখানকার ব্যয়ের বহর সম্পর্কে আমার ধারণা জন্মায় । খড়্গপুরে ভর্তি হওয়ার পর সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে এবং কলেজের ফি, হোষ্টেলের থাকা খাওয়ার খরচ, পুস্তকাদির বহর ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে আমার মনে হয় আমাকে ওখানে পড়াতে গেলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হয় অর্ধাহারে নয় অনাহারে থাকতে হবে । অন্যথায় অর্ধপথে আমাকে পড়া ছেড়ে আসতে হবে । এর কোনটাই অভিপ্রেত ছিল না । কেবল ছাত্রবৃত্তির টাকায় এই ব্যয় বহন করা সম্ভব ছিল না, অনিশ্চিত পারিবারিক আয় থেকে ঘাটতি মেটানোরও উপায় ছিল না ।
পরবর্তীকালে যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম আর্থিক দূর্বলতার বাধাকে অতিক্রম করে কতদূর যাওয়া যায় তা দেখতে । মাস দেড়েকের মধ্যেই আর্থিক বাধ্যবাধকতায় আমার দোদুল্যমান অবস্থার চিত্র পরিস্ফুট হয়ে গেল । ইঞ্জিনিয়ারিং কে বিদায় জানিয়ে আমি যাদবপুর ত্যাগ করলাম ।
প্রেসিডেন্সিতে ভর্তির সময় আসামের ভাষা দাঙ্গার দরুণ যোরহাটে আমাদের প্রেস বন্ধ ছিল । দাদার কোন উপার্জন ছিল না । কি বিবেচনায় বাবা আমাকে প্রেসিডেন্সিতে পাঠাতে রাজী হয়েছিলেন জানি না, হয়ত চেয়েছিলেন আমার উন্নতির পথ প্রশস্ত হোক । কিন্তু তা ছিল আত্মহত্যার সমান । এটা ঠিক মাসখানেক-মাসদুয়েকের মধ্যে বাবা প্রেস-ম্যানেজারের একটা স্বল্প মাইনের চাকুরী জোগাড় করেছিলেন । কিন্তু সেই আয় থেকে বাড়ীভাড়া সহ পরিবারের সব খরচ মিটিয়ে আমার পড়ার খরচ যোগান দেয়া ছিল অসম্ভবের অতীত । আমি মাসে পঞ্চাশ টাকা করে বৃত্তি (National Scholarship) পেতাম । তবে ঐ যুগে হলেও এই টাকা কলেজের ও হোস্টেলের এবং তৎসহ বইপত্রাদির ব্যয় বহন করার পক্ষে অপ্রতুল ছিল[45] । তাছাড়া বৃত্তি মাসে মাসে পাওয়া যেত না, একসাথে কয়েক মাসের হিসাবে পাওয়া যেত । ঐ টাকা আসা অবধি নিজেকেই খরচ চালাতে হত । শিলচর পালিয়ে আসার কয়েক মাস পর যোরহাটের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাবা যোরহাট ফিরে গিয়ে প্রেস চালু করেন । তবে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার ফলে ও অন্যান্য কারণে প্রেসের আয় এমন স্তরে নেমে যায় যে জীবিকা নির্বাহ করাই দুষ্কর হয়ে পড়ে । এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্সিতে আমাকে সাহায্য করা পরিবারের পক্ষে অসম্ভব ছিল । প্রেসিডেন্সি ছেড়ে এসে ভবিষ্যতের অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলাম ।
আমাদের তখন প্রায় দিন আনি দিন খাই অবস্থা । বস্তুতঃ সেই সময় আমাদের ঐরূপ আর্থিক অবস্থায় বাসভূমির বাইরে আমার কোন শিক্ষাসূচীই অব্যাহত রাখা দুষ্কর ছিল । সেন্ট এন্থোনিজ কলেজ কর্তৃপক্ষের সহায়তাই এক্ষেত্রে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার পথে রসদ জুগিয়েছে ।
পরবর্তী পর্যায়ে আমার স্নাতোকত্তর পাঠকালে আমার দাদা যখন চাকুরীরত এবং আমার ছাত্রবৃত্তির অর্থের বাইরে শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যয়ের সিংহ ভাগই বহন করত তখনও এ বিষয়ে আমাকে যথেষ্ট ভাবতে হয়েছে, সময় বিশেষে শিক্ষকতা করতে হয়েছে । চরম কৃচ্ছ সাধনের মধ্যে জীবন যাপন করেও আমাকে এরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল । আমি আমার সম্পূর্ণ ছাত্রজীবনে এমন কি তারপরও একটি পয়সাও একান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে ব্যয় করিনি ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৬২ সালে পুরস্কারের অর্থে বাবা আমাকে যে হাতঘড়িটি কিনে দিয়েছিলেন পরবর্তী চল্লিশ বৎসরের অধিক সময় ঐটি-ই ব্যবহার করে এসেছি । চাকুরী জীবনরে শেষ পর্যায়ে অকেজো হয়ে যাওয়ায় তা পরিবর্তন করতে হয়েছিল । চাকুরী লাভের পর যে কোন সময় আমি ইচ্ছা করলে একটি প্রচলিত রুচির হাতঘড়ি ক্রয় করতে পারতাম ।
উল্লেখ্য ১৯৬৪ সালের ১৫ই আগষ্টের যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে[46] বিভিন্ন পরীক্ষায় আমার কৃতিত্বের বিবরণ দিতে গিয়ে বাবা নিজেই আমার মেট্রিক পরবর্তী শিক্ষার জন্য অর্থাভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন । সেই অংশের পেপার কাটিং ও তার বৈদ্যুতিন প্রতিলিপি এই পরিচ্ছেদের শেষে দেয়া আছে । (যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে পাঁচ দশকের অধিক পুরাতন এই কাটিংটির দু-একটি বাক্য আস্পষ্ট হয়ে গেছে) ।
তবে আমি নিজে পরিবারের ভিতরে বা বাইরে কাউকে এ বিষয়ে কখনও কিছু বলিনি । পাঠ্য বিষয় ভাল না লাগা বা আমার গৃহকাতরতাকেই আমার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসার প্রধান কারণ হিসাবে দেখিয়েছি । সেদিনের অবস্থায় পরিবারের আর্থিক অসামর্থতার কথা বলা পরিবারের ভেতরে পিতামাতার পক্ষে বেদনাদায়ক ও বাইরে পরিবারের মর্যাদা হানিকর বলেই আমি মনে করেছি ।
উপসংহার
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিত্যাগ করার কারণ হিসাবে আমি বরাবর আমার পাঠ্য বিষয়ে আগ্রহের অভাব বা গৃহকাতরতাকেই নির্দেশ করেছি । অনস্বীকার্য আমার তদানীন্তন ভীরুতা, অন্তর্মুখিতা, সাধারণ ভাবে মিশতে পারার অপারগতা ও দূরদেশে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিজনিত প্রতিক্রিয়াও এ বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল ।
জীবনের পথপরিক্রমার শেষ পর্যায়ে এসে আমার মনে হয় কারণ যাই হোক, আমার সে দিনের সেই সিদ্ধান্তগুলো যথাযথ ছিল, অন্য রকম হলে ফল আত্মঘাতী হতে পারত । অর্থাভাবে পাঠক্রম মাঝপথে ছেড়ে আসতে বাধ্য হলে আমার প্রতিষ্ঠা লাভের পথই রুদ্ধ হয়ে যেত । তাই অস্থিরচিত্ততার উপাদান থাকলেও সামগ্রিক ভাবে সিদ্ধান্তগুলো জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করেছিল বলেই আমি মনে করি । তবে সমগ্র পরিস্থতি বিবেচনা করে মনে হয় আমাকে পথ দেখাবার কেউ যদি সেদিন থাকত তাহলে হয়ত আমার পক্ষে পাঠক্রম নির্বাচন সহজতর হত।
জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অনস্বীকার্যতা
আমি মনে করি জীবনের লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থির করে পরবর্তীকালে যত বাধা বিঘ্নই আসুক না কেন সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকা উচিত । অন্যথায় নিজেকে গভীর অরণ্যে পথ হারানো এক পথিক বলে মনে হতে পারে । আজকাল মায়েরা অধিকাংশই সুশিক্ষিতা; ছেলেমেয়েদের উদ্বুদ্ধ করার পারদর্শিতা তাদের কাছে অবশ্যই আশা করা যায় । তবে এঁদের কারো কারো নিজেদের ইচ্ছা ছেলেমেয়েদের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকতে পারে । এটা ঠিক নয়, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে । যদি কারো পছন্দের বিষয় পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ হয় তবে বাবা-মায়ের উচিত যথোপযুক্ত কারণ দেখিয়ে সন্তানের প্রত্যয় উৎপাদন করে তাকে পরিবর্তনে সম্মত করানো । কোন ছেলে বা মেয়ের যদি কোন বিষয়ে দক্ষতা দেখা যায় তবে তাকে সে বিষয়ে উৎসাহ দেয়া উচিত ।
পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে গেছে । দারিদ্র্য এখন মেধাবী ছাত্রের পড়াশোনার পথে কোন বাধা নয় । আজকের দিনে মেধাবী ছাত্রের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করার অনেক পথ খোলা আছে । এখন প্রয়োজন শুধু উপযুক্ত দিকনির্দেশ ও বড় হওয়ার আকাঙ্খা ।
পেপার কাটিং
১৯৬৪ সালের ১৫ই আগষ্টের যুগান্তর পত্রিকায় আমার স্নাতকস্তর পর্যন্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের তথা অর্থাভাবজনিত কারণে পড়াশোনায় ব্যাঘাতের একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল । পত্রিকাটির সংশ্লিষ্ট অংশের একটি বৈদ্যুতিন অনুলিপি নিম্নে বাম পার্শ্বে প্রদর্শিত হয়েছে । ঐ অনুলিপির উপরের ডানদিকে তীর চিহ্নিত আইকনে ক্লিক বা টেপ করলে অপর একটি ট্যাবে অনুলিপিটি সহজপাঠ্য হয়ে উপস্থাপিত হবে ।
এই মূল সংবাদপত্রটির কর্তিত অংশের অনুলিপিটির পাশে ঐটির একটি প্রতিলিপি সংযোজন করা হয়েছে । সংবাদপত্রটির কর্তিত অংশ দীর্ঘ পাঁচ দশক কাল রক্ষিত থাকায় এর কিছু অংশ দুষ্পাঠ্য হয়ে পড়েছে । প্রতিলিপিটি সেই কারণে ।
পরিবেশিত সংবাদের ভুল
উল্লিখিত সংবাদে নিম্নে বর্ণিত দুটি ভুল রয়েছে ।
১ । ১৯৫৫-৫৬ সালের এমই বা বৃত্তি পরীক্ষায় অবশ্যই আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম, কিন্তু সারা আসামে প্রথম হয়েছিলাম এমন কোন লেখ্যপ্রমাণ নেই । পরীক্ষাটির বৎসর ছিল ১৯৫৬, সংবাদে বর্ণিত ১৯৪৬ নয় ।
২ । ১৯৬০ সালে আমি প্রেসিডেন্সিতে বিজ্ঞান বিভাগে প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম । কিন্তু গৃহকাতরতা ও অর্থনৈতিক কারণে পাঠ অব্যাহত রাখতে পারার অনিশ্চয়তা হেতু ছেড়ে এসেছিলাম । অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারি নি, এ সংবাদ ঠিক নয় ।
হয় বাবা বয়স ও বিদ্যমান অর্থনৈতিক উদ্বেগে অনবধানতা বশতঃ ভুল বলেছিলেন নয়ত রিপোর্টার ভদ্রলোক বাবা যা বলতে চেয়েছিলেন তার ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন ।
পাদটীকা
[1] বহু বছরের পরিবর্তনের পর এটা বর্তমানের (২০১৪ সালের)ছবি । গলিটি রয়েছে, কিন্তু যে বাড়ীটিতে আমরা থাকতাম তার কোন অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাইনি ।
[2] পরে আমরা জে. পি. আর স্টেশনের সন্নিকটে বিল্বমঙ্গল ঘোষ নামক জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে ভাড়া ছিলাম । মাঝখানে কিছুদিন জে. পি. আর রোডে বাহাদুর সিং-এর দালানের (যেখানে প্রথমদিকে কিছুদিন আমাদের প্রেস অবস্থিত ছিল) পাশের গলিতে একটি বাড়ীতে ছিলাম । বস্তুতঃ যোরহাটে অবস্থান কালে আমরা ৪-৫ বার বাসস্থান পরিবর্তন করেছি । আমরা তখন কিছুদিন বাঁশবাড়ীতেও ছিলাম । বাঁশবাড়ী নামক এলাকাটি সেই সময় তৈরী হচ্ছিল ।
[3] http://en.wikipedia.org/wiki/1950_Assam_%E2%80%93_Tibet_earthquake
[4] একটি কৃত্রিম বা প্রাকৃতিক ঢাল বা দেয়াল যা জলস্তরকে নিয়ন্ত্রন করে, আমেরিকান ইংরেজীতে একে লেভি বলে ।
[5] ষাটের দশকের শেষ দিকে আমি যখন মেখলিগঞ্জে কর্মরত ছিলাম সেই সময় বন্যাক্লিষ্ট সরকারী কর্মী হিসাবে সরকার থেকে প্রাপ্ত পরিশোধ্য অগ্রীম বেতনের টাকা থেকে একটি ট্রেন্সিস্টার সেট ক্রয় করি । সেটিই আমার জীবনের প্রথম রেডিও । বাল্যে রেডিওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল শ্রীহট্টে আমার মাতুলালয়ে ।
[6] পরবর্তী কালে এই সময়সূচীর পরিবর্তন হয় । সম্ভবতঃ ১৯৬২ সাল পর্যন্ত গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ণ্ত্রণেই এই পরীক্ষা পরিচালিত হয়ে থাকবে ।
[7] ফটোটি যোরহাটের একজন বিশিষ্ট নাগরিক ও একদা লক্ষ্মী ইউনিয়ন হাইস্কুলের প্রাথমিক বিভাগের শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ দাস মহাশয়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত ।
[8] Deleted
[9] Deleted
[10] আমার এক আত্মীয় আমার অজ্ঞাতে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা করে আমার স্কুল পরিদর্শনের ইচ্ছার কথা বলতে গিয়েছিলেন । সেই সময় ঐ প্রধান শিক্ষিকা কিছু অবান্তর ও অসৌজন্যমূলক কথা বলেন যা সরাসরি আমার বিষয়ে না হলেও সাধারণ ভাবে যথেষ্ট আপত্তিকর ছিল ।
[11] হোরাই কাঁসার তৈরী স্ট্যাণ্ডযুক্ত একপ্রকার ট্রে বিশেষ । এটি ঢাকনাযুক্ত বা ঢাকনা বিহীন হতে পারে । আমাকে দেয়া হোরাইটি ছিল ঢাকনাযুক্ত । অসমীয়া কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে হোরাইর একটি বিশেষ স্থান রয়েছে । গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের অভ্যর্থনা জানাতে এটি ব্যবহৃত হয় ।
[12] আমরা সেই সময় জে. পি. আর. রেল স্টেশনের কাছে বিল্বমঙ্গল ঘোষ নামীয় জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম ।
[13] ঐ মহিলা ছিলেন খাসিয়া উপজাতি গোষ্ঠিভুক্ত ।
[14] প্রশ্নপত্রগুলি সবই ছিল যোরহাট শহরের বাইরের স্কুলের । অত্যন্ত গোপনীয়তায় সেগুলি ছাপান হত ।
[15] পরবর্তীকালে বাবার এই রোগ আর কখনও ফিরে আসেনি ।
[16] আবেগ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা হেতু অভ্যন্তরীণ চাপের বশীভূত হয়ে মেট্রিক পরবর্তী ও প্রাক স্নাতক স্তরে পঠন কালে যখন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠানে এবং বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি তখন এই দৃঢ়তার অভাব ছিল ।
[17] জাটিংগা নদীটি উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলার জাটিংগা গ্রামের নিকটস্থ বরাইল নামক পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে চাঁদপুরের নিকট বরখোলা গ্রামের নিম্নদেশে জাটিংগামুখ নামক স্থানে বরাক নদীতে মিশেছে ।
[18] হাফলং পর্ব্বত শীর্ষের ঢালে জাটিংগা নামক গ্রামটি "পাখীর আত্মহননের স্থান" হিসাবে বিখ্যাত । এখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে পাখীরা এসে আত্মহত্যা করে বলে কথিত । বলা হয়, এটি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি । এ নিয়ে পক্ষীবিশারদদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে । জাটিঙ্গায় পক্ষীদের এই আত্মহননের ঘটনা ১৯১০ সাল থেকে চলছে, কিন্তু এটি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে আনেন পক্ষীবিদ ই. পি. গী (E P Gee) ১৯৫৭ সালে তার লেখা ওয়াইল্ড লাইফ অব ইণ্ডিয়া (Wild Life of India) নামক গ্রন্থে ।
[19] পরে জেনেছিলাম সুনীল এন্দ মহাশয় শ্রীহট্টের প্রথিতযশা ডাক্তার দীগেন্দ্র এন্দ মহাশয়ের ভাইপো । ডঃ এন্দো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনারহাতে নিহত হয়েছিলেন ।
[20] বর্তমান নাম ডঃ ইউ. এন. ব্রহ্মচারী স্ট্রিট ।
[21] কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তিন বৎসরের স্নাতক কোর্স চালু হয়েছে । সেই সঙ্গে ছিল প্রাক-স্নাতক স্তরে এক বৎসরের জন্য এই প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্স ।
[22] ফাদার জোসেফ বেচ্ছিয়ারেলো (Bacchiarello) নামক ধর্ম্মযাজক ১৯৩৪ সালে এই কলেজটির প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি ছিলেন এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ । তিনি বৃটিশ রাজত্বে বঞ্চিত স্থানীয় দেশীয়দের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের বাধ্যকারী দাবি তুলেছিলেন ।
[23] ১৮১৫ সালের ১৬ই আগষ্ট সেণ্ট জন বস্কো যিনি ডনবস্কো নামে বহুল পরিচিত, ইতালীয় আল্পস পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে বেক্কি নামক পাহাড়ী অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করেন । মাত্র দুই বৎসর বয়সে পিতা ফ্রান্সিসকে হারিয়ে মাতা মার্গারেট দ্বারা লালিত পালিত হন । দৈবাদিষ্ট হয়ে ডনবস্কো নিপীড়িত জনসাধারণের উন্নতিসাধনে নিজেকে নিয়োজিত করেন । ১৮৪১ সালে তিনি সেণ্টহুড লাভ করেন । ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ওঁর নামাঙ্কিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্তমান । বিশদ জানতে হলে এখানে ক্লিক করুণ → http://www.donboscowest.org/saints/donbosco
[24] দীর্ঘ প্রায় ২৪ বৎসর (১৯৫৮ - ১৯৮১) ফাদার জোসেফ সেন্ট এন্থোনিজ কলেজের রাশ ধরেছিলেন । এই সময়ে কলেজটি এক মহাকাব্যিক উৎকর্ষতায় পৌঁছয় এবং ফাদার জোসেফ নিজে একজন লিজেন্ডে পরিণত হন । এই সময়েই কলেজ পর পর তিন বৎসর (১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬২) গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আই এসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করে দুর্লভ হেট্রিক-সম্মান লাভ করেছিল ।
[25] ফাদার এন. জে. কেনি ১৯৪০ সাল থেকে সেণ্ট এন্থোনিজ কলেজের সাথে যুক্ত ছিলেন । তিনি সর্বদা কলেজের প্রতিভূ হিসাবে বিবেচিত হতেন । তিনি একাধারে ইংরাজীর অধ্যাপক, কলেজের উপাধ্যক্ষ ও হোস্টেলের অধীক্ষক ছিলেন । সর্বোপরি তিনি ছিলেন কলেজ প্রাঙ্গনে এক উদ্দীপনাময় উপস্থিতি । ১৯৯৫ সালে এই ছাত্রদরদী যাজক প্রয়াত হন ।
[26] আমার ২০০৭ ও ২০১৪ সালের শিলং ভ্রমণকালে অনেক চেষ্টা করেও কিসু বা ওর বাড়ীর লোকেদের হদিস বার করতে পারিনি । দীর্ঘদিনের অদর্শন ও সময়ের সাথে পারিপার্শিক অবস্থার পরিবর্তনের দরুণ বাড়ীটির সঠিক অবস্থান তখন বুঝে উঠতে পারি নি ।
[27] ছেলেমেয়ের পারস্পরিক মেলামেশা ও বন্ধুত্ব সমাজের কিছু কিছু অংশ ইতমধ্যে গ্রহণ করে নিয়েছিল, তবে ডেটিং প্রথা তখনও শুরু হয়নি ।
[28] কলেজ ছাড়ার দীর্ঘদিন পর দেবাশীষের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল এবং আমরা সারাদিন একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম । ও তখন অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমার কর্ম্মস্থলের নিকটে নাগরাকাটা নামক স্থানে কর্ম্মরত ছিল । এর পর আর ওর সাথে যোগাযোগ হয়নি । ও বর্তমানে আমেরিকায় নিউ জার্সিতে রয়েছে বলে খবর পেয়েছি ।
[29] মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর পরিবারের সাথে বাস করতে আসে, ছেলে মেয়েরা মায়ের পদবী গ্রহণ করে ।
[30] The Hynniewtrep National Liberation Council (HNLC) was a militant organization operating in Meghalaya, India. It claimed to be a representative of the Khasi-Jaintia tribal people, and its aim was to free the Meghalaya from the alleged domination of the Garos and the non-tribal outsiders (the "Dkhars"). It was proscribed in India on 16 November 2000, but the ban was later lifted.[
[31] ANVC was formed in December 1995 to curve out a homeland for Garos clled “Achik land” comprising the present district of Garo Hills in Meghalaya and a large chunk of Kamrup and Goalpara districts of Assam. It was proscribed on November 16, 2000. The outfit signed a ceasefire agreement with Govt of India on July 23, 2004
[32] দীর্ঘদিন পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চেরাপুঞ্জি দেখতে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম । কোথাও কোন বৃষ্টি নেই; প্রধান জলপ্রপাত সহ সব জলপ্রপাতগুলো হয় শুষ্ক নয় ক্ষীণধারা । স্থানীয় লোকেদের থেকে জেনেছিলাম পূর্ববর্তী সেপ্টেম্বর মাস থেকে বৃষ্টির দেখা মেলেনি । কি অবিশ্বাস্য জলবায়ু পরিবর্তন ! কারণ প্রণিধানযোগ্য ।
[33] স্বামী বিবেকানন্দের ভবিষ্যৎবাণীবাহি বার্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ সন্ন্যাসী প্রভানন্দজী (কেতকি মহারাজ) সন্নিহিত শ্রীহট্ট জেলার সমতল ভূমি থেকে খাসিয়া পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত শেলা নামক গ্রামে পৌঁছন ১৯২৪ সালে । উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ শাসনাধীন বিদেশী শক্তির কবল থেকে খাসিয়া উপজাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা । খাসিয়াদের জন্য তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা ও একনিষ্ঠতা দ্বারা প্রভানন্দজী শীঘ্রই ওদের হৃদয় জয় করে নেন । এরপর তিনি খাসিয়াদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে ও তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্রতী হন । তিনিই ১৯৩১ সালে চেরাপুঞ্জিতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ।
[34] সম্পূর্ণ বিনা ব্যয়ে আমার আইএসসি কোর্স সম্পন্ন হওয়ায় ঐ সময় প্রাপ্ত স্কলারশিপের টাকার অধিকাংশটাই বাবার কাছে সঞ্চিত ছিল । তা থেকে এই পর্যায়ের ব্যয় নির্বাহ করা হয় ।
[35] ইন্টারভ্যুয় দিতে এসে প্রতিষ্ঠানে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে এখানে অধ্যয়নের ব্যয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয়েছিল । আমাদের তদানীন্তন টলায়মান অর্থনৈতিক অবস্থায় দীর্ঘদিন এই ব্যয় বহন করে এখানে অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করা কতটা সম্ভব সেই সম্পর্কে সংশয় দেখা দিল ।
[36] ইহাকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উপলব্ধ ভয়ের আশঙ্কায় পলায়ন বলা যেতে পারে । সেই সঙ্গে এটাও ঠিক অর্থাভাবজনিত দুশ্চিন্তা থাকলেও রেগিং এর ভয় না থাকলে হয়ত এভাবে পালিয়ে আসার ইচ্ছে হত না ।
[37] ফারাক্কা ব্যারাজ যা বর্তমানে গঙ্গার দু পারের ব্রডগেজ রেলপথকে যুক্ত করেছে তা ১৯৭৫ সালে চালু হয় ।
[38] সরাইঘাট সেতু নামে ব্রহ্মপুত্রের উপর রেল-সড়ক যুগ্ম সেতুটি ১৯৬৩ সালের জুন মাসে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ।
[39] পরবর্তীকালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপকদের পাঠন পদ্ধতি দেখে মনে হয়েছে দিল্লীর কলেজে না গিয়ে আমি ভুল করেছিলাম ।
[40] দাদা শিলচরে চাকরি নিয়ে চলে আসার পরিপ্রেক্ষিতে বাবা-মা যোরহাট ত্যাগ করায় আমাদের বাড়ীর তখনকার ঠিকানা ছিল শিলচর ।
[41] ভারতবর্ষে দশমিক পদ্ধতি চালু হয় ১৯৫৭ সালে । পরবর্তীকালের এক পয়সাকে (এক টাকার এক শতাংশ, অধুনা লুপ্ত) তখন বলা হত এক নয়া পয়সা ।
[42] কলিকাতা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃবর্ষীয় ডিগ্রী কোর্সের বিষয়সূচী গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন দ্বিবর্ষীয় ডিগ্রী কোর্সের বিষয়সূচী অপেক্ষা উন্নততর ছিল।
[43] দেখলাম, এদিকের ছাত্র-ছাত্রীরা সাধারণতঃ অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক । নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে প্রতিযোগী সহপাঠিকে যথাযথ সাহায্য করতে বিমুখ ।
[44] আমার শিলং এ অবস্থান কালে এটা ঘটায় এর সঠিক সময় আমার স্মৃতিতে নেই ।
[45] কোন স্কলারশিপই সেই অর্থে পাঠরত ছাত্রের সম্পূর্ণ ব্য়য় নির্বাহের পরিমাপে নির্ধারিত হয় না ।
[46] এই খবরে দুটি ভুল রয়েছেঃ (১) ১৯৫৫-৫৬ সালে এম. ই. পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলাম; সারা আসামে প্রথম হওয়ার খবর ঠিক নয় । (২) প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছিলাম; কিন্তু গৃহকাতরতার দরুণ ও অর্থাভাবজনিত দুশ্চিন্তায় ছেড়ে এসেছিলাম । অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারি নি, এ খবর ঠিক নয় । হয় অনধবনতা বশতঃ বাবা ভুল বলেছিলেন, নয় রিপোর্টার মহোদয় বাবার বক্তব্যের ভুল মূল্যায়ন করেছিলেন ।