শ্রীহট্ট মহানগরী
পরিশিষ্ট
শ্রীহট্ট গণভোট: পশ্চাদপট, সততা, নিরপেক্ষতা ও ফলাফল
কখন ও কেন শ্রীহট্ট আসামের অংশ হল
আসাম রাজ্যটিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্থিতিশীল ও স্বনির্ভর করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্টকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে । অসমীয়া ভাষাভাষী রাজ্য আসাম বা বাংলাভাষী জেলা শ্রীহট্ট, যা পরম্পরাগতভাবে পূর্ববঙ্গের অংশ রূপে পরিগণিত ছিল, কেউই এই সংযুক্তিকে স্বাগত জানায় নি; ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত দিক থেকে এই দুই এলাকার লোকেরা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ।
শ্রীহট্ট: ভৌগলিক
চা-উৎপাদনকারী প্রাণবন্ত জেলা শ্রীহট্ট পূর্বে ত্রিপুরা ও দক্ষিণে দক্ষিণ আসামের জেলাগুলি দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল । অসমীয়াভাষীদের মূলভূমি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে এই জেলা উত্তর কাছাড় ও জয়ন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চল দ্বারা পৃথকিকৃত ছিল । আসামে অন্তর্ভূক্তির ফলে শ্রীহট্ট আসাম রাজ্যর একটি জেলা হিসাবে কাছাড় জেলার পার্শ্ববর্তী জেলায় পরিণত হল । সিলেটি নামে পরিচিত বাংলা উপভাষীদের দ্বারা মূলতঃ অধ্যুষিত এই দুটি পরষ্পর সন্নিহিত জেলা কাছাড় ও শ্রীহট্ট অতঃপর তদানিন্তন বরাক উপত্যকা ও আগত সুরমা উপত্যকাকে নিয়ে আসামের সূচ্চ পর্বতশ্রেণীর পশ্চাদভাগে নূতন একটি সুরমা উপত্যকার সৃষ্টি করল ।
শ্রীহট্ট জেলার পরিমাপ ছিল ৫৪৪০ বর্গমাইল । ১৮৭৪ সাল থেকে শ্রীহট্ট পাঁচটি মহকুমায় বিভক্ত ছিল; শ্রীহট্ট, মৌলবীবাজার. হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও করিমগঞ্জ । প্রতিটি মহকুমার অধীনে এক বা একাধিক থানা ছিল । প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাসে দৃকপাত করলে দেখা যাবে প্রাক-ঔপনিবেশিক ও মধ্যযুগে শ্রীহট্ট বরাবর বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল । শ্রীহট্ট এইভাবে যুগ যুগ ধরে জাতিগত, ভাষাগত, ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক দিক দিয়ে বাংলার সঙ্গে যুক্ত ছিল ।
শ্রীহট্টের আসাম অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে হিন্দু ও মুসলমানদের পরষ্পরবিরোধী অভিমত
১৮৭৪ সালে আসামে সংযুক্তির পর থেকেই সিলেটি হিন্দুরা সংস্কৃতিগত ভাবে স্বগোত্রীয় তথা উন্নততর বাংলায় ফিরে যাওয়ার দাবী জানাতে থাকে । অপরদিকে সিলেটি মুসলমানেরা আসামে থেকে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল; তাদের নেতাদের ধারণা ছিল সংখ্যাধিক্যের জোরে তারা তাদের সমধর্মী সংখ্যালঘু অসমীয়া ভাইদের অধিকতর প্রভাব ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করতে পারবে । এ বিষয়ে এরা অনেকটা সফলও হয়েছিল । ১৯৮৩ সালে নেলী হত্যাকাণ্ডের আগে পর্যন্ত এরা কোন বিরোধী আন্দোলনের শিকার (target/victim) হয়নি ।
আসামে যখন সিলেটি বিদ্বেষ বিস্তার লাভ করল, সেই সময় সিলেটি মুসলমানরা নিজেদের অবস্থান দৃঢ়তর করতে অসমীয়াকে মাতৃভাষা বলে মেনে নিল এবং ১৯৫১ সালের জনগণনায় সেই ভাবে নিজেদেরকে নথীভুক্ত করাল । এর ফলে দেখা গেল ১৯৩১ থেকে ১৯৫১ এই ২০ বছরে আসামে অসমীয়াভাষী লোকসংখ্যা ১৫১% বৃদ্ধি পেয়েছে যা শুধু অস্বাভাবিক নয়, অসম্ভব । ১৯৫১ সালের স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের প্রথম জনগণনায় এই চিত্রই প্রকাশিত হয়েছিল ।
শ্রীহট্টের আসামে অন্তর্ভুক্তি দেশীয় অসমীয়ারা কিভাবে দেখতেন
এদিকে ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্টের অন্তর্ভূক্তির পর থেকেই আসামের আদি বাসিন্দারাও শ্রীহট্টের বিযুক্তি চেয়ে আসছিল । তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত সিলেটি হিন্দুদের কেবল যে কর্মক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দী রূপে বিবেচনা করত তা নয়, তারা এদেরকে নিজেদের (বিশেষ করে আর্থিকভাবে দুর্বলতর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসমীয়াদের) সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করত । তদুপরি আসামের এই আদি বাসিন্দারা ১৮২৬ সাল থেকেই বৃটিশদের সাহায্যে আসামকে জাতিগত ও ভাষাগত দিক থেকে একটি সমজাতিক রাজ্যে পরিণত করার প্রচেষ্টায় ছিল । জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের বার বার বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছিল যে আসামের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে সিলেটকে আসাম থেকে বিযুক্ত করা একান্ত প্রয়োজনীয় । অসমীয়া জনসাধারণকে অবহিত করতে অসমীয়া বুদ্ধিজিবীদের ঐ বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও লেখা প্রচার করা হচ্ছিল । ১৯৩৭ সালে নির্বাচনী প্রচারে জহরলাল নেহরু যখন আসামে এসেছিলেন সেই সময় শ্রীহট্টের আসাম থেকে আলাদা করার দাবী সহ অন্যান্য দাবীদাওয়া নিয়ে তার কাছে মেমোরেণ্ডাম দেয়া হয় ।
ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয়ের জার্নেল থেকে জানা যায় আসামের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ কেবিনেট মিশনকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে আসাম শ্রীহট্টকে পূর্ববাংলার হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত । পরে যখন শ্রীহট্টে রেফারেণ্ডামের সিদ্ধান্ত হয় তখন গোপীনাথ বরদলৈ ঘোষণা করেন যে আসাম কেবিনেট শ্রীহট্টকে আসামে রাখতে আগ্রহী নয় । এটা পরিষ্কার যে এই ঘোষণা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আসামের নেতৃবৃন্দকে শ্রীহট্টের জন্য প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্য করা হয়েছিল । সিলেটি কংগ্রেস নেতাদের জেলার অন্ততঃ কিছু অংশ উদ্ধার করার প্রচেষ্টায় বাউণ্ডারী কমিশনের কাছে জোরালো সওয়াল করতে নিরুৎসাহ করা হয়েছিল ।
আসাম থেকে শ্রীহট্টের স্বল্প সময়ের বিযুক্তি
আসাম থেকে বিযুক্তির পক্ষে ক্রমাগত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিততে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগের সময় শ্রীহট্টকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় । কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯১২ সালে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন সত্বেও শ্রীহট্টকে পুনরায় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের অঙ্গীভূত করা হয় ।
শ্রীহট্টের রেফারেণ্ডাম, জুলাই ১৯৪৭
পরিহাসের বিষয় হল, ১৯৪৭ সালে যখন শ্রীহট্টের পূর্বপাকিস্তানে তথা পূর্ববাংলায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ উপস্থিত হল তখন হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন কারণে নিজ নিজ পূর্ববর্তী অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করল । সিলেটী হিন্দুরা আসামে থেকে যাওয়ার দাবী জানাল আর সিলেটী মুসলমানেরা আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইল । অতএব ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন সৃষ্ট মাউণ্টবেটেন পরিকল্পনা যার মধ্যে শ্রীহট্টে রেফারেণ্ডামের অভিপ্রায় অঙ্গীভূত ছিল তা কার্যকর হল ।
রেফারেণ্ডামের ফলাফল সম্পর্কে সন্দেহ
বিভিন্ন কারণে এই রেফারেণ্ডাম সম্পর্কে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে:
১ । জনসাধারণের নিরক্ষর বৃহত্তর অংশকে গণভোটের পদ্ধতিগত নিয়মাবলী ও অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে অবহিত করার সুযোগ না দিয়ে অত্যধিক ত্বরায় ভোটক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় ।
২ । এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠেয় গণভোট পরিচালন পদ্ধতি সম্পর্কে পরিচালন কর্মীদের কারো কোন ধারণা থাকার কথা নয় । ভোটকর্মী ও সুরক্ষা বাহিনীকে এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া অপরিহার্য ছিল । কিন্তু মাত্র তিন দিন (বিজ্ঞপ্তি জারীর দিনকে ধরে) সময়ের মধ্যে তা সম্পূর্ণ করে ভোটকর্মী ও সুরক্ষা বাহিনীকে যথাসময়ে ভোটকেন্দ্রে পাঠানো অসম্ভব ছিল । এর ফলে অধিকমাত্রায় ভোট বাতিল হয় (২২.৫%) । ভোটকর্মী ও সুরক্ষা বাহিনীর নিরপেক্ষতার প্রশ্ন না তুলে ও বলা যায়, এদের ভোট প্রক্রিয়া সম্মন্ধে অজ্ঞতার সুযোগে কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন, ভোটপ্রদানে বাধাদান ইত্যাদি বেআইনী কার্যকলাপের সম্ভাবনা প্রবল ছিল । এই সম্বন্ধে উত্থিত অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যায় না ।
৩ । মুসলিমলীগ ক্যাডারদের ভীতি প্রদর্শনের দরুণ বাগিচাকর্মী ভোটার যাদের মধ্যে বৃহদাংশই ছিল হিন্দুসম্প্রদায়ভুক্ত ভোট দিতে পারেনি । (দ্রঃ, প্রোঃ জে. বি. ভট্যাচার্য ও বিনায়ক দত্ত) । ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে মুসলিমলীগ ক্যাডারদের আনা হয় বলেও অভিযোগ ছিল । অন্য একটি সূত্রে জানা যায় বাগিচা কর্মীরা স্থানীয় বাসিন্দা নয় এই অজুহাতে তাদের ভোটাধিকার নিষিদ্ধ করা হয় যদিও তাদের অধিকাংশই পুরুষাণুক্রমে বাগিচাকর্মী হিসাবে বাগিচাগুলোতে বসবাস করছিল ।
রেফারেণ্ডামের পরিপ্রেক্ষিতে আমার বাবাকে বলতে শুনেছিলাম যে বহিরাগতরা ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছিল । তবে তিনি মুসলিম লীগ বা অন্য কোন সংগঠনের নাম করেন নি । জন্মভূমি ছেড়ে আসার প্রস্তুতিকালে বাবা এই কথা বলেছিলেন ।
৪ । বন্যার মধ্যে ভোটপর্ব চলার ফলে অনেক ভোটার ভোটদানে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি । ।
এই সকল বিষয় বিবেচনা করে এটা বিশ্বাস করা শক্ত যে গণভোট খোলামনে হয়েছিল আর তা ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ ।
রেফারেণ্ডামের ফলাফল
১৯৪৭ সালের ৬ই ও ৭ই জুলাই রেফারেণ্ডাম অনুষ্ঠিত হয় । রেফারেণ্ডামে ২৩৯৬১৯ টি ভোট পড়ে পূর্বপাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে, ১৮৪০৪১ টি ভোট পড়ে আসাম তথা ভারতে থাকার পক্ষে । উইকিপিডিয়া অনুযায়ী রেফারেণ্ডামে মোট ২৩৯টি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়েছিল সর্বমোট ৫৪৬৮১৫টি । এই সংখ্যাগুলির সত্যতা ধরে নিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে মোট ১২৩১৫৫ টি ভোট ব্ল্যাঙ্ক বা অবৈধ বলে বাতিল হয়েছে যা মোট প্রদত্ত ভোটের ২২.৫% । শ্রীহট্টের পূর্বপাকিস্তানে যাওয়ার পক্ষে ভোট পড়ল মোট প্রদত্ত ভোটের ৪৩.৮% আর আসামে থাকার পক্ষে ভোট পড়ল মোট ভোটের ৩৩.৬৫% ।
রেফারেণ্ডামের ফলে শ্রীহট্ট পূর্ব-পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হল । সীমানা নির্ধারণকালে বাউণ্ডারী কমিশনের সভাপতি রেডক্লিফ সাহেবের অভিমত গ্রহণ করে শ্রীহট্টের মাত্র সাড়ে তিন খানা থানা রাতাবাড়ী, বদরপুর, পাথারকান্দি ও করিমগঞ্জ কে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হল । হিন্দুপ্রধান মৌলবীবাজার পূর্ব-পাকিস্তানে গেল যদিও সেখানকার ভোটারদের বৃহদাংশ আসামে থাকার অনুকুলে ভোট দিয়েছিলেন । এর কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না । উল্লেখ্য বর্তমান বাংলাদেশের তথা তদানীন্ত পূর্ববাংলার মোট চা-বাগানের প্রায় ৫৭% মৌলবীবাজার মহকুমায় অবস্থিত ।
স্বাধীনতা-উত্তর অভিবাসন ও তার ফলাফল
পার্টিশন পরবর্তী পর্যায়ে এক বিরাট সংখ্যক সিলেটি হিন্দু ধর্মীয় নিপীড়ন হেতু পাকিস্থানে সমর্পিত শ্রীহট্ট জেলার অংশ থেকে দফায় দফায় ভারতবর্ষে অভিপ্রয়াণ করতে থাকে । অভিপ্রয়াণকারীদের অধিকাংশই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ আসামে বসতি স্থাপন করে । ১৮৭৪ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যখন শ্রীহট্ট আসামের অঙ্গীভূত ছিল সেই সময় এই দেশান্তরীরা এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলেছিল । উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে স্থানীয় অসমীয়াদের উল্লেখযোগ্য বাধা সত্বেও এই বাস্তুচ্যুত লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে সময় সময় উদ্ভূত স্থানীয়দের সংঘবদ্ধ শক্তিশালী চেলেঞ্জ মোকাবিলা করে ছোট ছোট সংখ্যালঘু এলাকা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ক্রমে ক্রমে আরো মাইগ্রেণ্টরা এসে যখন এখানে সেখানে বসতি স্থাপন করে তখন ধীরে ধীরে বাস্তুভূমিহীন এক সিলেটি সত্তার উৎপত্তি হয় । ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ সিলেটি বসতি আসামের বিভিন্ন অংশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সিলেটি ও সিলেটি সত্তা আজ বিরাজমান । অসমীয়াদের নিজেদের জন্য জাতিগত ও ভাষাগত ভাবে সমগোত্রীয় এক আসাম গড়ার যে স্বপ্ন শ্রীহট্টের বিযুক্তির দ্বারা পূরণ হবে বলে আশা করা হয়েছিল বাস্তবে তা অলীকই রয়ে গেল । শ্রীহট্টের বিযুক্তির ফলে আসামের এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে অনেকগুলো মিনি-সিলেট গড়ে উঠল । এরা সিলেটি সত্তা ও বাস্তুচ্যুত সিলেটি পরিচয় বাঁচিয়ে রেখেছে ।
আসামকে ভাষাগত ও জাতিগত ভাবে সমসত্ত করার দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হয়ে অসমীয়া নেতৃত্ব তিন দশক পরে পার্টিশনের আচ্ছাদনে অভিবাসীদের বিদেশী নাম দিয়ে বিতাড়ণের এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন । ফলশ্রুতি, হিংসাত্মক আন্দোলনে আসামের প্রজ্জ্বলন । সে অগ্নি নির্বাপনে রাজীব গান্ধী চুক্তির উদ্ভাবন । চুক্তি অনুযায়ী করণীয় নির্বাচক তালিকা ১লা জানুয়ারী ১৯৬৬ সালের সাপেক্ষে সংশোধন এবং ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের পর আগত সমস্ত উদ্বাস্তু ও মাইগ্রেণ্টদের চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়ণ ।
বাংলাদেশ ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিতকরণের জন্য সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে ২০১৩ সালে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী সংশোধনের কাজ শুরু হয় । ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন ও রাজীব গান্ধী চুক্তি বিধেয়ক অনুযায়ী নাগরিক পঞ্জী আধুনিকীকরণ হয় । সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে এই কার্য সমাধা হয় । ২০১৯ সালের ৩১শে আগস্ট প্রকাশিত চূঢ়ান্ত নাগরিক পঞ্জী থেকে ১৯ লক্ষের বেশী মানুষ যার অধিকাংশই হিন্দু (বাঙ্গালী ও অন্যান্য ভাষাভাষী হিন্দু ), মুসলমান ও অন্যান্য ধর্ম্মাবলম্বীরা বাদ পড়ে । বাদ পড়া মানুষদের এক বৃহদাংশই ছিল সিলেটি হিন্দু ।
ইতিমধ্যে ভারত সরকার ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের পূর্বে ধর্মীয় নিপীড়ণে পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্থান থেকে আগত হিন্দু, শিখ, বুদ্ধ, জৈন, পার্শী, খৃষ্টান ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ করে দিয়েছেন । এই সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতের দেখানো পথে সারা ভারতজুড়ে এক বিক্ষোভ আন্দোলন বিস্তার লাভ করেছিল যা ২০১৯ এর কোভিড অতিমারীর আগ্রাসনে স্থিমিত হয়ে যায় ।
এই সকল আন্দোলন ও প্রক্রিয়া কি আসামের সমজাতিক সমভাষী রাজ্য গঠন ও একাধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টাকে সফল করতে পারবে? সময়ই বলবে ।
অসমীয়াদের সিলেট ও সিলেটিদের প্রতি মনোভাব: একটি নিবন্ধ
ঐতিহাসিক সুজিত চৌধুরীর নিচের বামপার্শ্বে সংযুক্ত নিবন্ধটি থেকে জানা যাবে আসামের নেতৃত্ব ও জনসাধারণ স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতাউত্তর কালে সিলেট ও সিলেটিদের প্রতি কি মনোভাব পোষণ করত এবং এখনো কি ভাবে তারা পার্টিশন প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সিলেটিদের আসাম তথা ভারত থেকে বিতাড়ণের চেষ্টা করে যাচ্ছে ।
আসামের (কাছাড়) ভাষা আন্দোলনের উপর সুজিত চৌধুরীর ইণ্টারভিয়্যুের ভিডিও ইউ-টিউব সংযোগ নিচে ডানদিকে দিয়েছি । কেননা এই ভিডিওর বক্তব্যে শ্রীহট্ট সংক্রান্ত বিষয়ও উত্থাপিত হয়েছে ।