নয়াগ্রামের ভসরাঘাটে সুবর্ণরেখায় সূর্যাস্তের ছবি ।
নতুন পদে যোগ ও কর্মকালের মেয়াদ
১৫ই জুলাই ১৯৭৪ সালে আমি পাইলট ইনটেন্সিভ রুরেল এমপ্লওয়মেণ্ট প্রজেক্ট (Pilot Intensive Rural Employment Project) সংক্ষেপে পাইরেপ (PIREP) নামের এই প্রকল্পে "প্রকল্প আধিকারিক" বা "প্রজেক্ট অফিসার" পদে যোগদান করি । ১৯৭৬ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমি ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলাম ।
প্রকল্প সম্বন্ধীয়
পাইরেপ ছিল কেন্দ্রীয় সেক্টারের একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প । প্রতি রাজ্যের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের জন্য একটি করে এই প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ব্লক নয়াগ্রাম, যেখানে আদিবাসীসংখ্যা এলাকার মোট জনসংখ্যার ৪০.০১% (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী), এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল ।
পাইরেপ ছিল একটি বহুমুখী প্রকল্প । প্রধানতঃ রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুষ্করিণী সংস্কার, পশুপালন, ভূমিসংরক্ষণ, অরণ্যায়ন, মৎস্য উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গ্রামীন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল । রাস্তাঘাট ও পুষ্করিণী সংস্কারের পরিকল্পনা সরাসরি প্রকল্প আধিকারিকের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হত । অপরাপর ক্ষেত্রে পরিকল্পনাসমূহ জেলাভিত্তিক বিভাগীয় আধিকারিকরা তাদের মনোনীত অধস্তনদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতেন । ভূমি সংরক্ষণ ও ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের তদারকির জন্য প্রজেক্ট স্তরে বিভাগীয় আধিকারিক নিযুক্ত ছিলেন । বনজ সম্পদ সৃষ্টির কাজে একজন সহকারী ডিভিসনেল ফরেস্ট অফিসার (ADFO) দায়িত্বে ছিলেন । কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই পাইরেপ প্রকল্পের কাজে শ্রমিক নিয়োগ প্রজেক্ট অফিসারের মাধ্যমেই করতে হত । সেদিক দিয়ে প্রজেক্ট অফিস সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে অনেকটা কর্মসংস্থান কেন্দ্রের মত কাজ করত ।
গ্রাম্য পরিবেশে খরিকামাথানী নামক একটি ছোট জায়গায় প্রকল্পটির সদর দপ্তর ছিল । ২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী খরিকামাথানীর লোকসংখ্যা ছিল ২০০২ । ইণ্টারসেন্সাল কালের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪-৭৬ সালে আমি যখন এখানে ছিলাম সেই সময় এই সংখ্যা আনুমানিক ১৫০০ র কাছাকাছি ছিল । বালিগেড়িয়া নামক স্থানে প্রজেক্ট সদর থেকে ১.৫ - ২ কি মি দূরে ছিল ব্লক সদর । প্রজেক্ট সদরের বিপরীত দিকে অনুরূপ দূরত্বে নয়াগ্রামে ছিল থানা । খরিকামাথানীতে সপ্তাহে একদিন হাট বসত, দূর দূরান্ত থেকে গ্রামবাসীরা তাদের বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী নিয়ে হাটে পসরা সাজিয়ে বসত ।
বাসস্থান সমস্যা
খরিকামাথানীতে বসবাসের উপযোগী বাসস্থান পাওয়া দুষ্কর ছিল । কার্যালয়ে আমার পূর্বসূরী তথা চাকুরীতে আমার ব্যাচমেট ব্যারাকসদৃশ একটি দালানবাড়ীতে দুকামরার একটি অংশে সপরিবারে বাস করত । ঐ দালানবাড়ীতে পাশাপাশি ঘরে আরো দু-একজন সরকারী আধিকারিক বসবাস করত এবং দু-একটি সরকারী অফিসও ছিল । অন্য কোনরূপ বিকল্প না থাকায় আমি পূর্বসূরীর পরিত্যক্ত বাসভবনটিই বসবাসের জন্য গ্রহণ করলাম । এই বাসভবনের পশ্চাদ্দিক একটি সীমানা বেষ্টনী দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল । নয়াগ্রাম থানা এলাকায় কোন বিদ্যুৎ বা পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল না । কুয়োই ছিল পানীয় জলের একমাত্র উৎস । আমাদের বাসস্থানের বেষ্টনীর মধ্যে আমাদের একক ব্যবহারের জন্য হস্তচালিত পাম্পসহ একটি পাতকুয়ো ছিল । আমরা ঐ পাতকুয়োর জলই ফুটিয়ে ব্যবহার করতাম । পাথুরে মাটির অঞ্চল হওয়ায় এখানে জল উন্নতমানের ছিল । নয়াগ্রামের গ্রীষ্ম ছিল চরম উষ্ণ ও শুষ্ক । ঐ সময়ের সূর্য ছিল ভয়ঙ্কর, সূর্যতাপে মাটি দগ্ধ হয়ে যেত । গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা করতে ঐ সময় আমি স্ত্রী-কন্যাকে মালদহের বুলবুলচণ্ডীতে আমার স্ত্রীর জ্যেষ্ঠা ভগিনীর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতাম ।
প্রকল্প কার্যালয় সম্বন্ধীয়
হতেটানা পাখার একটি প্রদর্শনমূলক চিত্র
আমার কার্যালয় (প্রজেক্ট অফিস) আমার বাসভবনের সন্নিকটেই ছিল । এটি ছিল টিনের ছাদযুক্ত দু-কামরার একটি পাকা বাড়ী । অফিসটি ছিল ছোট । এখানে একজন ক্যাশিয়ার, একজন অ্যাকাণ্টেণ্ট, চারজন সাব-এ্যাসিস্টেণ্ট ইঞ্জিনিয়ার, ২-৩ জন গ্রুপ ডি কর্মচারী কাজ করতেন । বিদ্যুৎ না থাকায় গ্রীষ্মকালে হাতে টানা পাখা (১) ব্যবহার করা হত । এই পাখা টানার কাজের জন্য পাঙ্খাপুলার নামে কয়েকজন মরসুমী কর্মচারী গ্রীষ্মকালে নিয়োগ করা হত । হাতে টানা পাখা একটি লম্বা আয়তাকার মাদুরসদৃশ বস্তু যার নিম্নপ্রান্তে শোভাবর্ধক কাপড়ের খণ্ড কখনো কখনো সংযোজন করা হয় । এটির উর্দ্ধপ্রান্ত একটি দীর্ঘ কাষ্ঠখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে কাষ্ঠখণ্ডটিকে তিন-চারটি দড়ির সাহয্যে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় । কাষ্ঠখণ্ডের মধ্যভাগে আরেকটি দীর্ঘ দড়ি বেঁধে ঐ দড়ির খোলা প্রান্ত ঘরের ভেতরের দেয়ালের গায়ে আটকানো একটি পুলির উপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরের বাইরের দেয়ালে আটকানো অনুরূপ আরেকটি পুলির উপর দিয়ে পার করে পাঙ্খাপুলারের হাতে পৌঁছনো হয় । পাঙ্খাপুলার ঘরের বাইরে বসে ঐ দড়ি টেনে ঘরের ভেতরের পাখা চালনা করে শীতল হাওয়া সঞ্চালন করে । গ্রীষ্মকালে পাঙ্খাপুলার পাখা টানতে টানতে ঘুমে ঢুলছে, হাত থেকে দড়ি খসে পড়েছে এই হাস্যকর দৃশ্যটি প্রায়ঃশই দেখা যেত ।
প্রকল্প এলাকার বাইরের সাথে যোগাযোগ
পাইরেপ প্রকল্প অফিস থেকে ঝাড়গ্রাম মহকুমা সদর ৮০ কিমি দূরে ছিল । নগদ অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এবং অন্যান্য কাজে আমাদের প্রায়ই ঝাড়গ্রাম যেতে হত । ঝাড়গ্রাম যেতে প্রকল্প অফিস থেকে পঁচিশ-ত্রিশ কিমি দূরে সুবর্ণরেখা নদী পেরোতে হত । আমরা গাড়ীসহ হাতে দাড় টানা ভাসমান লোহার প্ল্যাটফর্মে (Raft) করে নদী পেরোতাম । সুবর্ণরেখা নদীর উপর কুটিঘাটে তখন কোন সেতু ছিল না । বর্ষাকালে যখন সুবর্ণরেখা নদীতে বন্যা হত তখন রাফ্ট বা লোহার প্ল্যাটফরম না চলায় এই পথে গাড়ী নিয়ে যাতায়াত করা যেত না । সেই সময় সন্নিহিত রাজ্য ওড়িশ্যার বারিপাদা শহর হয়ে প্রায় ২৩০ কিমি ঘুরে আমাদেরকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছুতে হত (২)। একবার আমি ঝাড়গ্রামে কাজ সেরে ফেরার পথে সুবর্ণরেখা নদীতে হঠাৎ বন্যা (হড়কা বান) আসায় কুটিঘাটে নদী পেরোতে পারলাম না । ঘটনাচক্রে ঐ সময় আমার স্ত্রী, শিশুকন্যা ও ছোট শ্যালিকাও সঙ্গে ছিল । কুটিঘাট থেকে আমরা হাতিবাড়ী ফরেস্ট বাংলো চলে গেলাম । পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশ্যার সামান্য অংশ এবং ওড়িশ্যা ও ঝাড়গ্রামের বনাঞ্চলের কিছুটা অংশ পেরিয়ে ঘুরপথে আমরা হাতিবাড়ী পৌঁছেছিলাম । এই পথে কোলকাতা-মোম্বাই হাইওয়ের উপর পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশ্যা সীমান্তের নিকট অবস্থিত সুবর্ণরেখা সেতুর মাধ্যমে আমরা ঐ নদী পেরিয়েছিলাম | সে রাত হাতিবাড়ী ডাকবাংলোয় কাটিয়ে পরদিন গোপীবল্লভপুর ১নং ব্লকের সদর ছাতিনাশোল হয়ে আমরা খরিকামাথানী ফিরেছিলাম ।
একদা ঝাড়গ্রামের পথে খরিকামাথানী-কুটিঘাট রোডে গাড়ী চালিয়ে যাওয়ার সময় একটি ছাগশিশুকে চাপা দিয়ে দিয়েছিলাম । সময়টা ছিল প্রাতঃকাল, ছাগশিশুটি হঠাৎ রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে ছুটে বেরিয়ে গাড়ীর সম্মুখে পড়ে যায় । ওকে বাঁচাবার কোন উপায় ছিল না । প্রাণহানির এই একটি দুর্ঘটনাই আমার স্টিয়ারিং-ধরা হাতে ঘটেছিল ।
প্রকল্প রূপায়ন
সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক নিতে প্রজেক্ট অফিসে শ্রমিকদের ভীড়
প্রোজেক্টের কার্য পরিদর্শন
অনুৎপাদক সময়ে (During lean period) প্রকল্পে একসাথে দশ হাজারেরও বেশী শ্রমিক নিযুক্ত থাকত । অধিকাংশ শ্রমিক ছিল আদিবাসী, বৃহদাংশ সাঁওতাল, কিছু লোধা ও বাকী মাহাতো সম্প্রদায়ভুক্ত । সাধারণভাবে ওরা ছিল সরল, সৎ ও পরিশ্রমী । মহিলারাও কাজে যোগ দিত ও পুরুষদের সমহারে শ্রম দিত । মেট নামে এক দলপতির অধীনে এদেরকে ২০ জনের দলে ভাগ করে নিয়োগ করা হত । মেট লেখাপড়া জানত । দলের লোকেদের উপস্থিতি ও কাজের পরিমাপের হিসাব মেটকে রাখতে হত । কয়েকটি দলের তত্ত্বাবধানের জন্য দলপতিদের উপর একজন করে পরিদর্শক বা সুপারভাইজার নিযুক্ত ছিল । প্রজেক্ট অফিসারের সরাসরি অধীনস্থ স্কীম বা প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে নিজ নিজ এলাকার প্রকল্প রচনার ও নিষ্পাদনকালে পরিদর্শনের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট সাব এ্যাসিস্টেণ্ট ইঞ্জিনিয়ারের ।
তত্বাবধায়ক কর্মচারীদের সজাগ রাখতে ও কাজকর্ম সঠিকভাবে এগোচ্ছে কি না দেখতে আমি প্রায়শঃ বিভিন্ন ওয়ার্কসাইট (কর্মস্থল) অতর্কিতে পরিদর্শন করতাম । আমি কোনদিন কোথায় যাব শেষ মুহূর্তের আগে আমার গাড়ীর ড্রাইভার অবধি জানতে পারত না । আমার প্রথম দিকের কয়েকটি অতর্কিত পরিদর্শনে শ্রমিকদের কিছু জাল উপস্থিতির ঘটনা আমার নজরে এল । এই জাল উপস্থিতি রেকর্ড করার উদ্দেশ্য ছিল ঐ সকল ভৌতিক শ্রমিকের নামে পারিশ্রমিকের অর্থ আদায় করে আত্মসাৎ করা । মেট ও সুপারভাইজারের সক্রিয় সহযোগীতা ছাড়া এটা ঘটা সম্ভব ছিল না । উপস্থিতি নথিভুক্ত করার জন্য যে নিদর্শ (৩) আমি তৈরী করেছিলাম তাতে মেট, সুপারভাইজার ও পরিদর্শনকারী আধিকারিকদের জন্য উপস্থিতি প্রত্য়য়ন করে স্বাক্ষর করার ব্যবস্থা ছিল । তা থেকে আমি সহজেই জাল উপস্থিতি নথিভুক্তকারী মেট ও সুপারভাইজারকে চিহ্নিত করতে পারলাম । ভৌতিক নামগুলি খারিজ করে উপস্থিতি নিদর্শে আমি আমার স্বাক্ষরিত বক্তব্য লিপিবদ্ধ করলাম । পরে দোষী মেট ও সুপারভাইজারের নাম আমি কর্মী তালিকা থেকে খারিজ করে দিলাম যেন ভবিষ্যতে এরা পাইরেপের কোন প্রকল্পে নিযুক্ত না হতে পারে । প্রাথমিক পর্যায়ে আমি এতেই থেমেছিলাম । কিন্তু যখন দেখলাম প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না তখন দোষীদের কর্মী তালিকা থেকে বহিষ্কারের সাথে সাথে ওদের বিরুদ্ধে থানায় এজাহার (FIR) করতে শুরু করলাম । সাব এ্যাসিস্ট্যান ইঞ্জিনিয়ারদের ও সতর্ক করা হল । এবার কাঙ্খিত ফল পাওয়া গেল । পরবর্তী অতর্কিত পরিদর্শনে এরূপ ঘটনা কদাচিৎ পেয়েছি । পরবর্তীকালে যখন অন্যত্র নিযুক্ত ছিলাম তখন জেনে খুশী হয়েছি যে যাদের বিরুদ্ধে এফআইআর (FIR) করা হয়েছিল তাদের অনেকের সাজা হয়েছে ।
প্রকল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফল
প্রোজেক্টের তাৎক্ষণিক ফল হল স্থানীয় জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার উন্নতি । এখানকার এক বিপুল সংখ্যক আদিবাসী মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করত; অভাবের সময় এরা বুনো আলু, বন্য গাছের শিকড় বাকড় খেয়ে বেঁচে থাকত । প্রোজেক্টের কাজে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদেরকে জীবনধারণের ন্যুনতম প্রয়োজন মেটাবার পথ করে দিল । প্রোজেক্টে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংখ্যার কোন উর্দ্দ্বসীমা ছিল না । সুতরাং প্রতিটি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের অধিক সংখ্যায় তালিকাভুক্ত করে অধিকতর আয়ের ব্যবস্থা করার সুযোগ ছিল । গ্রামীন সড়ক নির্মান ও উন্নতিকরণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হওয়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভের ও গ্রামীন উৎপাদন বিপননের সুযোগ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায় । স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর ধনাত্মক প্রভাব পড়ে ।
পরোক্ষভাবে পশুপালন, মৎস্যচাষ ও অরণ্যায়ন কিছুটা হলেও ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় । ভূমিসংরক্ষণ. ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্প ও পুষ্করিণী সংস্কার ব্যবস্থা ভূপৃষ্টসস্থ জল অধিক মাত্রায় সংরক্ষণ করে কৃষিকার্যে সহায়তা করেছে । অধিকন্তু এগুলো ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চয়েও সহায়ক হয়েছে ।
জনসাধারণের হাতে টাকা-পয়সা থাকায় চুরি, ডাকাতি ইত্যদি অপরাধ প্রবণতাও লক্ষণীয়ভবে হ্রাস পেয়েছিল ।
পাইরেপ প্রকল্পের শ্রমপ্রধান স্কীমে সমান মাত্রার কর্মে নিযুক্ত স্ত্রী-পুরুষ ।
পাইরেপের প্রকল্প পরিদর্শনে প্রোজেক্ট অফিসার ।
রাজনৈতিক বাতাবরণ
কংগ্রেস দলের শ্রীদাশরথী সোরেন ছিলেন স্থানীয় বিধানসভা সদস্য । তিনি ছিলেন সরল ও অমায়িক; প্রোজেক্টের ব্যাপারে কখনও হস্তক্ষেপ করতেন না । তিনি তার বাড়ীর সন্নিহিত অঞ্চলের জন্য এটা ওটা স্কীমের দাবি নিয়ে মাঝে মধ্যে আমার অফিসে আসতেন । প্রকল্প পরিচালন ব্যবস্থা নিয়ে কখনো কোন অভিযোগ করেন নি । আমার পূর্বসূরীর সময় থেকে তাঁর একটা দাবী ছিল তাঁর বাসস্থান সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত একটা রাস্তা নির্মাণ করে দেয়ার । কিন্তু নির্মাণব্যয় প্রাপ্তব্য লাভের সঙ্গে সমানুপাতিক (cost-benefit equivalence) না হওয়ায় স্কীমটি করা যায় নি । তা ছাড়া প্রস্তাবিত রাস্তার মধ্যভাগে একটি চওড়া খাল ছিল যার উপর সেতু নির্মাণের খরচ শ্রম ও উপাদানের অনুমোদিত অনুপাত ৬০:৪০ র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব ছিল না ।
একবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তদানীন্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী অজিত পাঁজা (বর্তমানে মৃত) পরিদর্শনে গিয়েছিলেন । কিছু স্থানীয় কংগ্রেস কর্মী প্রোজেক্ট পরিচালনা বা শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে (সঠিক বিষয়টি আমার এখন মনে নেই, তবে সেই সময়কালে আমি দুর্নীতিকারী মেট, সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে এফআইআর করা শুরু করে দিয়েছি) মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন । সে যাই হোক, মন্ত্রী মহোদয় আমার কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য জেনে নিয়ে ঐ সকল কংগ্রেস কর্মীকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন । সুষ্ঠু ভাবে প্রকল্প পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক আবহাওয়া অনুকুল ছিল ।
সর্বভারতীয় পর্যালোচনা সম্মেলন ও প্রশিক্ষণ
১৯৭৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী নয়াদিল্লিতে পাইরেপের অগ্রগতির পর্যালোচনায় একটি সর্বভারতীয় সম্মেলন হয় । ঐ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম ।
পাইরেপে থাকাকালীন আমি হায়দ্রাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (NICD) (পরিবর্তিত নাম জাতীয় গ্রামীন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান (NIRD) কৃষি শ্রমিক সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যোগ দিয়েছিলাম । ঐ সময় আমি গোলকুণ্ডা ফোর্ট ও হাসান সাগর দেখতে গিয়েছিলাম । দুর্গের নিরাপত্তা ও বিপদসঙ্কেত জ্ঞাপক ব্যবস্থা সেকালের মানুষের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে । দুর্গের প্রবেশপথের পাশের পোস্টে কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষীর দেয়া সংবাদ ফাঁকা স্তম্ভের মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে দুর্গের কয়েক শত ফুট উপরে প্রহরারত নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে পৌঁছে যেত । বিপরীতক্রমে একই ভাবে সংবাদ উপর থেকে নীচে পৌঁছে যেত । পরীক্ষা করলে দেখা যায় এখনও নীচের করতালির আওয়াজ দুর্গের উপরিভাগ থেকে সুস্পষ্টভাবে শুনা যায় ।
ঐ সময় আমি হায়দ্রাবাদের সালার জং জাদুঘরটিও (মিউজিয়াম) পরিদর্শন করেছিলাম । এই জাদুঘরটি (Museum) পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম জাদুঘর, বিশ্বে একক ব্যক্তির সংগৃহীত পুরাকীর্তির বৃহত্তম ভাণ্ডার। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শনের অমূল্য সংগ্রহের জন্য মিউজিয়ামটি ভারতবিখ্যাত । মিউজিয়াম ভবনে সেই সময় দুটি তলে ৩৮টি গ্যালারী ছিল । দ্রষ্টব্য বস্তুসমূহ বিষয়শ্রেণী অনুযায়ী বিভিন্ন গ্যালারিতে সজ্জিত ছিল । সংগৃহীত দ্রব্যসমূহের মধ্যে ছিল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের মালিকানার ঔরঙ্গজেবের তরবারি (ড্যাগার), টিপু সুলতানের উষ্ণীষ ও চেয়ার, মিশর দেশের আসবাবপত্র ও বিভন্ন ধরণের চিত্রশিল্প । ভাস্কর্যের মধ্যে ইতালীয় ভাস্কর জিবি বেলজনির ১৮৭৬ সালে তৈরী পৃথিবীখ্যাত অবগুণ্ঠিতা রেবেকার মূর্তি সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ছিল । রেবেকার অপূর্ব সুন্দর মুখমণ্ডল মার্বেল পাথরের সূক্ষ্ম জালের মধ্য দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে দৃশ্যমান । তুলনাবিহীন এই ভাস্কর্যের দর্শন লাভ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল । এমন একটি সঞ্জিবীত আকৃতি মার্বেল পাথরে কি করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব তা ভেবে হৃদয়ে বিস্ময়ের সঞ্চার হয়। ঘড়িঘরে বিস্ময়কর সব ঘড়ির সন্নিবেশ দর্শককে অভিভূত করে । পুরণো আমলের স্মারকস্তম্ভের আকারের সূর্যঘড়ি থেকে বিংশ শতাব্দীর বিশালাকার আধুনিক ঘড়ি সবই মজুত রয়েছে । অন্যান্য ঘড়ির মধ্যে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘড়ি যাদের সৌন্দর্য ও জটিলতা দেখতে বা বুঝতে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয় তেমন ঘড়ি থেকে শুরু করে ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, স্যুইৎজারলেণ্ড ও ব্রিটেন থেকে আমদানি করা জমকালো গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়ি । দৃষ্টিনান্দিক একটি সুরেলা ঘড়ি ছিল যা সালার জাং ইংল্যাণ্ডের কুক ও কেলভিন থেকে কিনে এনেছিলেন । এই ঘড়িটিতে প্রতি ঘণ্টায় একজন সময় রক্ষক ঘড়ির উপরের ডেক থেকে বেরিয়ে এসে যত ঘণ্টা সময় তত বার ঘণ্টা বাজিয়ে ফিরে যেত । চিত্রকলার জন্য আলাদা গ্যালারি ছিল যেখানে যামিনী রায়ের প্রখ্যাত চিত্র সহ স্বনামধন্য অন্যান্য চিত্রকরদের চিত্রাদি উপস্থাপিত হত ।
জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্বলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমার পাইরেপে থাকাকালীন ঘটেছিল । এটি ছিল ১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন ভারতবর্ষে আভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা ঘোষণা (৪) । এই ঘোষণার সময় ১৯৭১ সালে জারী করা বহিঃশত্রুর আক্রমণজনিত জরুরী অবস্থা কার্যকরী ছিল । আভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা ঘোষণার কারণগুলির মধ্যে ছিল পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি সরকারী নির্দেশ না মানার আহবান, সরকারী কর্মে বাধাদান ও সরকারী গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধের উদ্দ্যেশ্যে হিংসাশ্রয়ী রাজনৈতিক আন্দোলন । এমন কি ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতির প্রাণনাশের চেষ্টাও হয় । জরুরী অবস্থা যদিও জনহিতায় জনজীবনে কিছুটা শৃঙ্খলা এনেছিল, জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যধিক বাড়াবাড়ি ও নিপীড়ণ হয় । জনসাধারণ এই ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করেন । অবশেষে ১৯৭৭ সালের ২১শে মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরী অবস্থা তুলে নিয়ে নির্বাচন ঘোষণা করেন ।
প্রকল্পের সমাপ্তি
১৯৭৬ সালের ৩১শে মার্চ প্রকল্পটির সমাপ্তি হয় । ঐ দিনই অপরাহ্নে মেদিনীপুর জেলাশাসকের অফিসের একজন আধিকারিক প্রকল্পের নথিপত্র ও সম্পত্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন । পরদিন (১লা এপ্রিল, ১৯৭৬) পূর্বাহ্নে আমি নয়াগ্রাম ত্যাগ করি ।
যদিও স্থানটিতে নগরজীবনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ছিল না এবং যদিও গ্রীষ্মকালে আমার পরিবারকে অন্যত্র পাঠাবার অতিরিক্ত অসুবিধা আমাকে ভোগ করতে হত, তথাপি এই প্রকল্পে কাজ করে আমি আনন্দ পেয়েছি । প্রকল্পটি আমাকে আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করার ও তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানবার সুযোগ দিয়েছিল ।
নয়াগ্রাম সম্বন্ধীয়
নয়াগ্রাম অবিভক্ত মেদিনীপুরের (বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের) একটি পশচাৎপদ উন্নয়ন ব্লক । রুচিসম্মত জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদানগুলি এখানে লভ্য নয় । এই অসম্পূর্ণতাগুলির মধ্যে জাজ্বল্যমান হল স্বাস্থ্যপরিষেবার পরিকাঠামো । নয়াগ্রমে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ব্যতীত কোন ফার্মেসী, ডাক্তারখানা বা হাসপাতাল ছিল না। আমার শিশুকন্যা অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য ওকে ৮০ কিমি দূরে ঝাড়গ্রামে নিয়ে যেতে হত। সৌভাগ্যবসতঃ নয়াগ্রামে থাকাকালীন আমাদের কারো কোন কঠিন অসুখ হয় নি । আমার অবশ্য একবার জলবসন্ত (chicken pox) হয়েছিল ।
জায়গাটিতে বিদ্যুৎ, পানীয় জল সরবরাহ, আমোদ-প্রমোদ ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন বলে কিছু ছিল না ।
পাঁচ মাসের একটি শিশুসন্তানকে নিয়ে বিয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে নগরজীবনের আমোদ-আহ্লাদ বিবর্জিত এরূপ একটি স্থানে বিনা প্রতিবাদে দুবৎসরের অধিক কাল বাস করে আমার স্ত্রী নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবী রাখে । এই প্রায় বনবাসে কাল কাটাবার জন্য ওকে কখনো আমি অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুনিনি ।
এই পরিচ্ছেদের উপসংহারে একটি কথাই বলব এখানে বিশেষ ভাতা অর্জন করতে হয়েছিল সভ্যজীবনের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আয়াসের বিনিময়ে ।