১০৮-শিব মন্দির, কালনা
কার্যে যোগদান কালে রাজনৈতিক অবস্থা
১৯৭২ সালের ২৬শে ডিসেম্বর আমি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টার পদে কালনার এসডিও অফিসে যোগ দিই । ঐ সময় কালনা রাজনৈতিকভাবে অস্থির ছিল । আমার কাজে যোগ দেয়ার আগে কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল । এর অনতিপূর্বে রাষ্ট্রপতি শাসনে এক অভূতপূর্ব কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন হয় । ১৯৭২ সালের সেই কুখ্যাত নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হন । সেই সময় এক ভয়ঙ্কর নক্সাল আন্দোলন রাজ্য জুড়ে ব্যপ্তি লাভ করেছিল । এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারী স্তরে এলাকার পর এলাকা চিরুণী তল্লাশি করে নক্সাল ও বামপন্থীদের নিশ্চিন্ন করার এক উগ্র অভিযান চালানো হল । হাজার হাজার নক্সালপন্থীকে হেফাজতে নিয়ে বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা হল, শত শত যুবক নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল । মার্কসবাদী কম্যুনিষ্ট পার্টিও নিজেদের জমি রক্ষার তাগিদে জোর-জুলুম ও হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির পথ অবলম্বন করল । যে কোন মুল্যে এই সব আন্দোলন প্রতিহত করতে কংগ্রেস বদ্ধপরিকর হল । রাজনৈতিক দলগুলোর পরষ্পরবিরোধী স্বার্থের সংঘাত রাজ্যজুড়ে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ও কিছু কিছু বর্ধিষ্ণু গ্রামে আইনশৃঙ্খলার এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করল ।
বাসস্থান ও অফিস
এরূপ এক পরিস্থিতিতে কালনায় এসে আমরা ব্যক্তিগত মালিকানার একটি ভাড়া বাড়ীতে উঠলাম, যা এসডিও মহোদয় আমাদের আসার পূর্বেই স্থির করে রেখেছিলেন । এটি একটি নবনির্মিত দালানবাড়ী ছিল, বসবাসের পক্ষে যথোপযুক্ত । বিদ্যাসাগর পাড়া নামে একটি শান্ত ও ভদ্র মহল্লায় বাড়ীটি অবস্থিত ছিল, যদিও শহরের কেন্দ্রস্থল ও অফিস থেকে দূরত্বটা একটু বেশী ছিল । পরে আমরা অপর একটি অধিকতর সুরক্ষিত ও সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত বাড়ীতে উঠে যাই । সেই বাড়ীটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, দ্বিতল, চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত । প্রাচীরের সম্মুখভাগের প্রবেশপথে তালা লাগাবার সুবিধাসহ সুরক্ষা দরোয়াজা ছিল ।এটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ছিল, নিকটেই ছিল সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি । দু জায়গাতেই বাড়ীওয়ালারা ছিলেন ভাল মানুষ । ওদের সাথে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি । কালনায় এসডিওর বাংলো ব্যতীত কোন সরকারী বাসভবন ছিল না ।
এসডিও অফিস শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে একটু দূরে ছিল, আমাদের পরিবর্তিত বাসস্থান থেকে হাঁটাপথে ১৫-২০ মিনিট । আমি হেঁটে বা রিক্সাতে অফিস যেতাম । আমাদের অফিস ছিল গঙ্গার তীরে এক মনোরম পরিবেশে । কালনার কর্মচারী ও অফিসারেরা ছিলেন কর্তব্যনিষ্ট ও সহায়তাকারী । আমি ছিলাম সেকেণ্ড অফিসার অর্থাৎ প্রশাসনিক প্রাধান্য পরম্পরায় এসডিওর পর । এসডিওর অনুপস্থিতিতে আমি মহকুমা আদালত পরিচালনা করতাম ও নির্বাহী বিচারকের অন্যান্য কার্য সমাধা করতাম । আমি ব্লক অফিস পরিদর্শন সহ প্রশাসনিক স্তরে বিবিধ কাজেও নিযুক্ত ছিলাম । সময় বিশেষে মহকুমা ভূমি সংস্কার আধিকারিকের অবর্তমানে আমি ঐ অফিসেরও দায়িত্ব পালন করেছি ।
কালনার অন্যান্য অফিসারবৃন্দ
কালনায় কর্ম্মরত বিচারক অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মহকুমা বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট বিজন বিহারী চাকলানবিশ ও প্রথম শ্রেণীর বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট মানস সেনগুপ্ত । ওঁরা দুজনেই খুব ভাল মানুষ ছিলেন । চাকলানবিশ মহোদয় ছিলেন সরল ও পরোপকারী, সেনগুপ্ত মহোদয় ছিলেন খানিকটা গম্ভীর প্রকৃতির । আমরা ছিলাম অনেকটা পারিবারিক বন্ধুর মত । চাকলানবিশ মহোদয় পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইন সচিব পদে উন্নীত হয়েছিলেন আর মানস সেনগুপ্ত মহোদয় হয়েছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি । এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে আমাদের সময় মেখলিগঞ্জে কর্মরত বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অসিতবরণ লাহিড়ীও পরবর্তীকালে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে উন্নীত হয়েছিলেন ।
আমি যখন কালনায় কার্যভার গ্রহণ করি তখন এসডিও ছিলেন ১৯৬২-ব্যাচের ডব্লুবিসিএস অফিসার ভবতোষ চক্রবর্তী । আমি এসেছিলাম বদলী হয়ে যাওয়া ডব্লুবিসিএস অফিসার ১৯৬৫-ব্যাচের অমল চ্যাটার্জির জায়গায় । শ্রী চ্যাটার্জি ছিলেন সেকেণ্ড অফিসার । আমি ওর স্থলাভিষিক্ত হলাম । এ ছাড়া অশোক গনাই নামে আরেকজন ডব্লুবিসিএস অফিসার ঐ সময় ঐ অফিসে পোস্টেড ছিলেন । অশোক চাকুরীতে আমার তিন বছরের জুনিয়ার ছিলেন । পরবর্তীকালে ওর সময় এলে উনি প্রমোশন পেয়ে আইএএস এ যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পুরনো ক্যাডারে ফিরে আসেন ।
ভবতোষ চক্রবর্তীর পর এস. ডি. ও হয়ে আসেন নবীন আই এ এস অফিসার ভেনক্টরমন সুব্র্যমানিয়ান | কালনা অবস্থানের বাকী সময় আমি ওর সাথেই কাজ করেছি | ঐ সময় কালনায় মহকুমা পুলিশ অফিসার ছিলেন বিনোদ মেহতা যিনি পরে কোলকাতা পোর্ট এলাকার ডেপুটি কমিশনার থাকাকালীন দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসতাবে খুন হন |
কালনার ধর্মীয় ঐতিহ্য
গঙ্গা তথা ভাগীরথীর তীরে কালনা হল একটি মন্দির নগরী । দেবী কালী বা অম্বিকার নামে শহরটি অম্বিকা কালনা নামেও পরিচিত । কুবজিকাতন্ত্র নামে ষষ্ঠ শতকের একটি গ্রন্থে সর্বপ্রথম কালনার উল্লেখ পাওয়া যায় । আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আলেকজাণ্ডার কানিংহামের মতে খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে অম্বিকা কালনা তাম্রলিপ্ত রাজ্যের একটি সীমান্ত শহর ছিল । সপ্তম শতকে শশাঙ্কের রাজত্বকালে কালনায় একটি শক্তিশালী নৌঘাটি স্থাপিত হয়েছিল ।
শ্রীচৈতন্যের জীবৎকালে নির্মিত তাঁর নামের একমাত্র মন্দির কালনায় অবস্থিত । এটি বৈষ্ণবদের একটি সুবিখ্যাত তীর্থস্থান ছিল । পঞ্চদশ শতকের মুসলমান রাজত্বেও এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পীঠস্থান হিসাবে গণ্য হত।
অষ্টাদশ শতকে বর্ধমানের মহারাজার পূষ্ঠপোষকতায় কালনায় অনেকগুলো টেরাকোটার অবিশ্বাস্য কারুকার্য সম্পন্ন জাঁকজমক পূর্ণ মন্দির স্থাপিত হয় । এই সময় কালনা তার মহিমার শীর্ষে পৌঁছয় । অম্বিকা কালনার প্রতিটি সৌধ ইতিহাসের স্মারক । ইহা ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিভিন্নতার সাক্ষ্য বহন করছে । এখানে আমরা বৌদ্ধ, জৈন, শাক্ত, বৈষ্ণব, সারিয়া, খৃষ্টান, ইসলাম সকল ধর্মমতের জীবন্ত এক ঝলক দেখতে পাই ।
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সিদ্ধেশরী মন্দির একটি প্রধান ল্যাণ্ডমার্ক । সিদ্ধেশরী মন্দির ব্যতিরেকে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মন্দির ও স্মৃতিসৌধের মধ্যে আছে রাজবাড়ী, শ্রীগৌরাঙ্গ মন্দির ও ১০৮-শিবমন্দির । শ্রীগৌরাঙ্গ মন্দিরে শ্রীচৈতন্যের স্বহস্তে লিখিত পুঁথি সংরক্ষিত আছে । মন্দিরের প্রবেশ পথে একটি নিমগাছের তলদেশে একটি পাথরের উপর একজোড়া বিশালাকার পদচিহ্ন খোদিত রয়েছে । জনশ্রুতি, পদচিহ্ণযুগল মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের ।
১৮০৯ সালে চুয়াত্তর ও চৌত্রিশটি মন্দিরের দুটি বৃত্তাকার স্তরে ১০৮-শিবমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় । প্রথম বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলো সাদা-কালো পাথরে তৈরী, দ্বিতীয় বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলো সবই সাদা মার্বেল পাথরে তৈরী । নিপুণ গঠণশৈলীর দরুণ মন্দিরটির কেন্দ্রস্থল থেকে সব শিবলিঙ্গগুলোকেই দেখা যায় ।
কালনার অন্যান্য মন্দিরগুলোর মধ্যে রয়েছে নব কৈলাশ মন্দির, কালনা রাসমঞ্চ, প্রতাপেশ্বর মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির, লালজি মন্দির, রূপেশ্বর মন্দির, মহাপ্রভু মন্দির, নিত্যানন্দ মন্দির, তেরাভাদা বুদ্ধ মন্দির, কালনা মন্দির কম্প্লেক্স ইত্যাদি।
কালনা শহর থেকে স্বল্প দূরত্বে বুড়োশিবতলা নামক স্থানে আমরা একটি গ্রাম্য ধর্মীয় মেলায় গিয়েছিলাম । এটি ছিল একটি বার্ষিক মেলা । এই মেলায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দূর দূরান্ত থেকে লোকেরা এসে যোগ দিত । একটি কুঁড়ের ছাউনিতে থাকা একটি বিশালাকার শিবলিঙ্গকে কেন্দ্র করে মেলাটি অনুষ্ঠিত হত ।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কালনা যথেষ্ট উন্নত ছিল । এখানকার লোকেরা মিশুকে ও মার্জিত ছিল, এঁরা সঙ্গীত ও বিনোদন প্রিয়ও ছিল ।
কালনায় একটি সিনেমা হল ছিল । আমরা সপরিবারে সেখানে সিনেমা দেখতে যেতাম । ঐ হলে দেবানন্দের "হরে রাম, হরে কৃষ্ণ" সিনেমাটি দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে ।
মহিষমর্দিনী উৎসবের সময় চারদিন সারা শহর যেন উল্লাসে ফেটে পড়ত । দশহরার সময় কালনা ২নং ব্লকের অন্তর্গত একটি স্থানে(১) এক অপূর্ব বাজিপোড়ানো উৎসব হত । রাতের আকাশে রঙবেরঙের আতশবাজির এত বিভিন্ন আকারে ও বিভিন্ন রূপে উন্মোচন আমি খুব কমই দেখেছি । আমরা কালনার অফিসাররা সপরিবারে গভীর রাত পর্যন্ত এই অভিনব আতসবাজির অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম । কালনা ২ নং ব্লকের বিডিও মহোদয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় থাকতেন । পি. মুখার্জি নামে একজন বয়স্ক অফিসার বিডিও ছিলেন ।
কালনায় অফিসারদের অবসর বিনোদনের জন্য কোন ক্লাব বা সভাকক্ষ ছিল না । সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আমরা একে অপরের বাড়ীতে মিলিত হতাম ।
অন্যান্য জ্ঞাতব্য তথ্য
একটি নিখুঁত প্রতিফলন ।
কালনায় আমাদের ২য় ভাড়াবাড়ীতে ।
কালনায় জীবনধারণ-ব্যয় তুলনামূলক ভাবে অন্য অনেক শহরের চেয়ে কম ছিল । টাটকা মাছ ও শাকসব্জি প্রচুর পরিমানে পাওয়া যেত । দামেও ছিল সস্তা ।
কালনা পুরণো শহর বলে রাস্তাঘাটগুলি ছিল সরু সরু । শহরের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল মূলতঃ রিক্সা । মহকুমা শহর হিসাবে যা যা থাকা প্রয়োজন যথা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, সিনমা হল সবই কালনায় ছিল । রেল ও সড়কপথে কালনার সঙ্গে সুবিধাজনক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল । আমার পূর্ববর্তী কর্ম্মস্থল মেখলিগঞ্জের সাথে পার্থক্যটা ছিল চোখে পড়ার মত ।
অন্যান্য মন্দির নগরীর মত কালনাতেও বাঁদরের উপদ্রব ছিল । বাঁদরগুলি প্রায়ই গৃহস্থের বাড়ীতে ঢুকে ফলমূল শাকসব্জি নিয়ে পালিয়ে যেত । একবার আমার প্রথম সন্তানের সময় স্ত্রী যখন গর্ভবতী সেই সময় ও দুপুরের ঘুম ভাঙার পর দেখে একটি বিশালাকার বাঁদর ওর ড্রেসিং টেবিলের ওপর বসে প্রমাণ মাপের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে । আমার স্ত্রী ভয় পেয়ে গিয়েছিল । কিন্তু বাঁদরটি অল্পক্ষণের মধ্যেই শান্ত ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর বাড়ী ছেড়ে চলে যায় ।
কালনায় যাদের সঙ্গে কাজ করেছি
মহকুমা শাসক ভবতোষ চক্রবর্তীর (বাঁ দিক থেকে ৪র্থ) বিদায় সম্বর্ধনা । শ্রীচক্রবর্তীর ডান পাশে নতুন মহকুমা শাসক ভি সুব্রমানিয়ান, বাঁ পাশে স্ত্রী-কন্যা ।
কালনায় আমি যে দুজন মহকুমা শাসকের (SDO) সঙ্গে কাজ করেছি তাঁরা উভয়েই ছিলেন বন্ধুভাবাপন্ন । প্রথম জন আমাদের সার্ভিসের ভবতোষ চক্রবর্তী ছিলেন আমুদে, সঙ্গীতপ্রেমী ও রসজ্ঞ ব্যক্তি । তিনি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন, তখনও গুরুর কাছে তালিম নিতেন | ওঁর স্ত্রী নিবেদিতা ছিলেন মিশুকে, সুন্দরী ও রুচিশীলা । ওঁদের একটি মেয়ে মুনমুন ও একজোড়া যমজ ছেলেমেয়ে ছিল । সেই যমজ ছেলেটি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়াশোনা সেরে দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স (AIMS) থেকে প্রথমে এমবিবিএস (MBBS) ও পরে এমডি (MD) হয় | কিন্তু ও গার্হস্থ্য ধর্ম ত্যাগ করে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেয় । বর্তমানে ও মিশনের একজন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী । কালনায় আমরা (আমার ও ভবতোষ চক্রবর্তীর পরিবার) পারিবারিক বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম । শ্রীচক্রবর্তী একজন সুন্দর মানুষ ছিলেন ও আমার কাছে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মত ছিলেন । কাজের বাইরে আমরা সপরিবারে নানা জায়গায় বেড়াতে যেতাম, কখনো কখনো নদীচরে বা অন্যত্র পিকনিক করতাম । একবার একজন স্থানীয় উকিল (নাম আমি ভুলে গেছি) আমাদের সঙ্গে গঙ্গার চরে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন । উকিলবাবু কিঞ্চিৎ স্থূলদেহ ছিলেন ও একটু খুঁড়িয়ে চলতেন । যতদূর মনে পড়ে ওঁর একটা পা একটু ছোট ছিল | তিনি তাঁর বন্দুক দিয়ে বেশ কয়েকটি গাংচিল শিকার করেছিলেন । পাখিগুলি খেতে খুব সুস্বাদু ছিল ।
আমার পরবর্তী এসডিও (SDO) ছিলেন প্রথম মহকুমা শসক পদ প্রাপ্ত একজন তরুণ আইএএস (IAS) অফিসার ভেনঙ্কটরমণ স্যুব্রমানিয়ান । ওঁর চার্টার্ড অ্যাকাউণ্টেন্সির (Chartered Accountancy) পেশাদারী ডিগ্রীও ছিল । যে কোন মাপকাঠিতে সুদর্শন এই তরুণ অফিসার একজন ভাল মানুষ ছিলেন । ওঁর মধ্যে অহমিকা বোধের প্রাবল্য ছিল না । তিনি কাজকর্ম শিখতে আগ্রহী ছিলেন, উচ্চনাসা ছিলেন না । শীঘ্রই ওঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । উনি মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ীতে আসতেন; অনেক সময় আমরা একসঙ্গে আহারও করতাম । একবার ওর মা ও বোন কালনা বেড়াতে এসেছিলেন । সেই সময় একদিন স্যুব্রমানিয়ান আমার স্ত্রী ও আমাকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । আহার শেষে মহিলারা যখন গল্প করছিলেন তখন স্যুব্রমানিয়ান পরষ্পরের ভাষা না জেনে ওঁদের এই গল্পের ধারায় বিস্মিত হয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, "দেখুন, পরষ্পরের ভাষা না জেনেও ওনারা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব চালিয়ে যাচ্ছেন!" (Look! How they are carrying out their conversations without even knowing each other's language) আমরা ব্যাপারটি উপভোগ করেছিলাম । পরবর্তীকালে স্যুব্রমানিয়ান সচিব ও প্রধান সচিব হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করেছেন। কিন্তু আইন ও নীতিতে বিশ্বাসী কর্তব্যনিষ্ট এই অফিসার বাম আমলে রাজনৈতিক প্রভুদের নেক নজরে ছিলেন না । তাই পশ্চিমবঙ্গে থাকাকালীন ঘন ঘন তাঁর দপ্তর বদল হয়েছে । পরবর্তীকালে অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় সহ ভারত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে কর্মরত থেকে স্যুব্রমানিয়ান সাহেব অবশেষে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
কালনার তদানীন্তন মহকুমা পুলিশ অফিসার ভি কে মেহতার সঙ্গেও আমার সুসম্পর্ক ছিল । অনেক কাল পর মেহতা তখন কোলকাতা পোর্ট এলাকার উপ নগরপাল । সেই সময় একদিন কোলকাতার খিদিরপুর এলাকায় দুর্বৃত্ত দমন অভিযান পরিচালনা করার সময় প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের হাতে নিষ্ঠুর ভাবে তিনি নিহত হন । এই মর্মান্তিক ঘটনার সময় আমি কলকাতায় পোস্টেড ছিলাম । স্বাভাবিক কারণেই এই ঘটনার সংবাদে আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ি । পরবর্তী কালে ওঁর স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আমরা যে সরকারী আবাসনে থাকতাম সেখানে বসবাস করতে আসেন । পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঐ আবাসনে ওঁকে একটি ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন, সহানিভূতিসম্পন্ন হয়ে একটি চাকুরীও দিয়েছিলেন।
আমার প্রথম কন্যার আবির্ভাব
আমার প্রথমা কন্যা মামন ওরফে অনিন্দিতা ।
জন্ম ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৪
আমি যখন কালনায় কর্মরত সেই সময় কৃষ্ণনগরের একটি নার্সিংহোমে আমার প্রথম সন্তানের (একটি কন্যা পরে নামাকরণ হয় মামন ওরফে অনিন্দিতা) জন্ম হয় । গর্ভের পরিণত পর্যায়ে আমার স্ত্রী কৃষ্ণনগরে ওর এক পিসির প্রযত্নে ছিল; আমি কর্ম্মস্থলে কর্ম্মরত ছিলাম । আমার মা আমার সঙ্গে ছিলেন |
জীবনে প্রথমবার সন্তানের পিতা হওয়ার অনুভূতি এক বিশষ ধরণের অনুভূতি । যতদিন আমি কালনায় কর্ম্মরত ছিলাম সেই সময় এই অনুভূতি ও আনন্দ স্ত্রীর সাথে মিলে সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করেছি । পরবর্তী কর্ম্মস্থলে নিজকর্ম্মে ব্যপৃত থাকায় ওকে বেশী সময় দিতে না পারার দরুণ ওর বড় হয়ে ওঠতে দেখার আনন্দ থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত হয়েছি । আবার ঐ কর্ম্মস্থলের ভয়াবহ গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা করতে ওকে ওর মায়ের সাথে যখন সুদূর মালদহে ওর মাসীর বাড়ী পাঠিয়ে দিতাম তখন দীর্ঘদিন ও আমার চোখের আড়ালে বড় হয়ে ওঠেছে । সেটা দেখার মাধুর্য থেকেও আমি বঞ্চিত হয়েছি ।
আমার কন্যার জন্মের পর আমার দাদা দ্বিতীয়া স্ত্রী সাবিত্রীকে নিয়ে কালনা বেড়াতে এসেছিল । এর অল্প কিছুদিন পূর্বে দাদা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে । তবে সেই বিয়েতে আমি থাকতে পারি নি । কয়েকদিন কালনাতে থেকে ও সস্ত্রীক ফিরে গেল । মা দীর্ঘদিন আমার কাছেই ছিলেন । সেই সময় আমার মেয়ে ঠাকুমার সান্নিধ্য পায়, ঠাকুমাও নাতনিকে নিয়ে আনন্দে কাটিয়েছেন ।
বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজন
কালনায় আমাদের বন্ধুস্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন ডাঃ অরবিন্দ নন্দী ও তার স্ত্রী । ডাঃ নন্দী কালনা হাসপাতালে কর্ম্মরত ছিলেন । শীঘ্রই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল । ডাঃ নন্দীর স্ত্রী হাসিখুশী মহিলা ছিলেন । আমাদের উভয়েরই সপরিবারে পরষ্পরের বাড়ীতে যাতায়াত ছিল । আমাদের মধ্যে ডাঃ অমল বেরা নামে কালনা হাসপাতালের একজন তরুণ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞও ছিলেন । ডাঃ বেরা অবিবাহিত ছিলেন । আমার কন্যার জন্মের পর ডাঃ বেরাই ওর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে পরামর্শ দিতেন । আমাদের আরেকজন খুব কাছের মানুষ ছিলেন কালনা পৌরসভার (Kalna Municipality) স্বাস্থ্য পরিদর্শক (Sanitary Inspector) অমল সেনগুপ্ত । আমার কন্যার জন্মের পর ওর টীকাকরণ ব্যবস্থা শ্রীসেনগুপ্তই করেছিলেন । শ্রীসেনগুপ্ত মিশুকে ও সদালাপী মানুষ ছিলেন । কালনার স্থানীয় কিছু পরিবারের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । ঐ সব বাড়ীতেও আমাদের যাতায়াত ছিল ।
কালনা থেকে বদলী
আমার কন্যার বয়স যখন পাঁচ মাস সেই সময় আমি কালনা থেকে বদলীর সরকারী নির্দেশ পেলাম । এই নির্দেশে আমাকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম মহকুমার অন্তর্গত নয়াগ্রাম ব্লকে ভারত সরকার কর্তৃক স্পন্সর্ড 'Pilot Intensive Rural Employment Project' বা "PIREP" নামক প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে প্রকল্প আধিকারিক (Project Officer) পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল।
প্রাথমিক ভাবে আমি পাঁচ মাসের একটি শিশু সন্তানকে নিয়ে এরূপ একটি অন্তর্বতী স্থানে যেতে অনিচ্ছুক ছিলাম । আমি আমার অসুবিধার কথা জানাতে গৃহ (সাধারণ প্রশাসন) বিভাগের যুগ্ম সচিব শ্রী বরদা চরণ শর্মা মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম । শ্রীশর্মা আমায় জানালেন যে পদটিতে বিশেষ ভাতা(২) রয়েছে যা আমার পক্ষে সহায়ক হতে পারে এই বিবেচনায় আমাকে ঐ পদে নিযুক্ত করেছেন; আমার অসুবিধা থাকলে নিয়োগ বাতিল করে দেবেন । পরে আমি জেনেছিলাম প্রকল্পটির স্থিতিকাল সীমাবদ্ধ; ১৯৭৬ সালের ৩১শে মার্চ এটির মেয়াদ শেষ। এই বিবেচনায় বদলীর সরকারী নির্দেশের মান্যতা দেয়া সাব্যস্ত করলাম । নতুন পদে যোগ দিতে ৭ই জুলাই ১৯৭৪ কালনার পদের দায়িত্ব হস্তান্তর করলাম । তখন পর্যন্ত নতুন জায়গা কেমন তা জানতাম না ।
কালনার মেয়াদ স্বল্পকালীন হলেও আমরা তা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করেছি ।
পাদটীকা
১ । স্থানটির নাম এখন মনে নেই । সাতগাছিয়া বা বৈদ্যপুর হতে পারে ।