কর্ম্মক্ষেত্রে আমার মূল্যবোধ
কর্ম্মজীবনে আমার দৃষ্টিভঙ্গী
আমার দীর্ঘ সরকারী কর্মজীবনে আমি কখনও নিজেকে ছোট করিনি; আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে ন্যায়পরায়ণতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে বরাবর লড়াই করে এসেছি ।
আমাদের প্রশিক্ষণ কালে বরিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছ থেকে শিখেছিলাম বিবেচনার জন্য আনীত বিষয়গুলো ন্যায়সঙ্গত, আইনানুগ এবং নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করতে । আমার চরিত্রে শুরু থেকেই এই গুণাবলীর দু একটি উপস্থিত ছিল । আমার সম্পূর্ণ চাকুরীজীবনব্যাপী আমি এই সকল নীতি অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করেছি এবং কোনরূপ বাহ্যিক প্রভাবকে আমার কোন সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হতে দিই নি । সমগ্র কর্ম্মজীবনে আমি কখনো কারো ভয়ে ভীত না হয়ে বা কারো প্রতি কোন আনুকুল্য না দেখিয়ে ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাতহীন ভাবে কাজ করেছি । আইনকানুন প্রয়োগে কঠোর হওয়ায় আমি "অনমনীয়" (rigid) এই বিশেষণও অর্জন করেছি ।
ক্ষমতার অলিন্দে যখন কেউ আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন তখনও আমি আমার ন্যায়সঙ্গত অবস্থান থেকে একচুলও নড়িনি । আমি এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি যেখানে আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের বা প্রভাবশালীদের ইচ্ছার কাছে আমি আত্মসমর্পন করিনি বা তারা যা করতে বলেছেন আইনের পরিপন্থী বলে তা করিনি, যদিও জানতাম এর ফলে আমার কর্ম্মজীবনে ক্ষতি বা অসুবিধা হতে পারে । পরবর্তীকালে এর ফলাফলও একাধিকবার আমাকে ভোগ করতে হয়েছে, যার ঈঙ্গিত আমি আমার এই স্মৃতিকথার স্থানে স্থানে দিয়েছি । তবে সে জন্য আমার বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই ।
উর্দ্বতন কর্তৃপক্ষের বা প্রভাবশালীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার বা তাদের বক্তব্য বা ক্রিয়ার সাথে সহমত না হওয়ার কতিপয় উদাহরণ
শেষতম ঘটনা দিয়ে উদাহরণগুলো শুরু করছি ।
আমি তখন অনুন্নত শ্রেণী কল্যাণ বিভাগের যুগ্মসচিব । দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী (Minister of State, সংক্ষেপে MOS), যিনি নিজেও আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত ছিলেন, আমার মাধ্যমে একটি প্রস্তাব পাঠালেন তাঁর সচিবালয়ে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত চতুর্থ শ্রেণীর একটি পদে সাধারণ শ্রেণীভুক্ত লোক নিয়োগের অনুমতির জন্য । তিনি আমাকে ফোনে অনুরোধ করলেন প্রস্তাবটি যেন অনুমোদিত হয়ে যায় তা দেখতে । আমি ওঁকে বলেছিলাম আইনগত দিক থেকে এতে অসুবিধা আছে । কিন্তু উনি ইনসিস্ট করছিলেন । বিষয়টি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর স্তরে সিদ্ধান্ত সাপেক্ষ ছিল । ঐ সংরক্ষিত পদে নিয়োগের জন্য সংরক্ষণ শ্রেণীভুক্ত প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছিল । এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়ার আইনগত বাধা ছিল । আইনের বিধান অনুযায়ী এই প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়া সম্ভব নয় এই অভিমত দিয়ে আমি নথীটি দপ্তরের সচিবের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সমীপে দাখিল করি । পরে রাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি প্রকৃত অবস্থা জানালাম । ঐ মন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিলেন । উত্তরে আমি জানালাম ওঁর ক্ষমতা অনুযায়ী আমাকে দপ্তর থেকে বদলী করতে পারেন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই ঐ প্রস্তাবের অনুকূল মত দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় । প্রস্তাব সহ পেশ হওয়া নথীটি আর আমার কাছে ফেরৎ আসেনি । অর্থাৎ প্রস্তাবটির গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছিল । আমার এই দপ্তর থেকে বদলীর জন্য কোন প্রস্তাবও আমার প্রশাসনিক বিভাগে পেশ হয়নি । আমি দপ্তরে আমার নির্দিষ্ট কর্মকাল সমাপ্ত করে অবসর গ্রহণ করি । ভ্রান্তি নিরসন কল্পে জানাই আমি সাধারণ শ্রেণীভুক্ত, সংরক্ষিত শ্রেণীর কোন জাতি বা গোষ্ঠির সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোন সম্পর্ক নেই । আমি কেবল আইনের বিধান কার্যকর করার চেষ্টা করেছি । ইহা তাৎপর্যপূর্ণ যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী নিজে যে উপজাতির জন্য পদটি সংরক্ষিত ছিল সেই উপজাতিভুক্ত হয়েও ঐ শ্রেণীর প্রার্থীর স্বার্থের পরিপন্থী ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন ।
ঐ দপ্তরে থাকাকালীন আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে । ঐ সময় আমি মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্ম্মরত একজন অতীব প্রভাবশালীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম । মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ সহায়ক (রাজনৈতিক নিয়োগী) আমাকে দপ্তরের একটি বিশেষ নথি নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে বলেন । সরকারের কার্যবিধি (Rules of Business) অনুযায়ী ওর এই অনুরোধ বেআইনী ছিল: কোন দপ্তরের কোন বিষয়ে ওর কোন এক্তিয়ার ছিল না, কোন অফিসারকে সরকারীভাবে ডেকে পাঠানো ত দূরের কথা । ওর অনুরোধের উত্তরে আমি সরাসরি ওর মুখের উপর বলি ওকে কোন নথি দেখাতে আমি বাধ্য নই । আমার দায়িত্বে থাকা কোন ফাইল বা নথি দেখতে হলে ওকে আমার মন্ত্রী বা সচিবের মাধ্যমে অধিযাচন বা রিক্যুইজিশন পাঠাতে হবে । ওর বা ওর পরিচিত কারো স্বার্থসম্পন্ন কোন একটি বিশেষ নথি নিয়ে ওর চেম্বারে ডেকে পাঠানোর ঔদ্ধত্য আমাকে ক্ষিপ্ত করে দিয়েছিল । আমি জানতাম ঐ সময় সচিবস্তরের অনেক অফিসারও ওর ডাকে সাড়া দিয়ে ফাইল বগলদাবা করে ওর কাছে ছুটতেন । উনি তখন এত ক্ষমতাশালী ছিলেন ।
অপর একটি ঘটনা ঘটে আমি যখন কোন একটি দপ্তরের অধীন একটি সংস্থায় ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসাবে কর্মরত ছিলাম । সেই সময় দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী (বর্তমানে প্রয়াত) আমায় কিছু কথা বলেন যা অসত্য ছিল । আমি প্রতিবাদ করে বলি কথাগুলো ঠিক নয় । কিন্তু মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে অনড় থেকে বলেন কথাগুলো তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত তাঁর কর্মীদের কাছ থেকে জেনেছেন । আমি তখন তাঁর মুখের উপর বলি তিনি যদি আমার উপর আস্থা রাখতে না পারেন বা আমার কথায় বিশ্বাস না করতে পারেন তবে তাঁর উচিত আমাকে অবিলম্বে সরিয়ে দেয়া । আমি সাধারণতঃ মিথ্যে কথা বলি না আর কোন পদ আঁকড়ে থাকতেও চাই না । বিষয়টির সেখানেই সমাপ্তি হয়েছিল, মন্ত্রী এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য করেন নি । আমি যথাসময়ের অনেক পরে সসম্মানে ঐ সংস্থা ও দপ্তর ছেড়ে যাই ।
দূর অতীতে কোন এক দপ্তরের সচিবের হস্তক্ষেপ, পীড়াপীড়ি ও চাকুরীতে ক্ষতি করতে পারার ক্ষমতার প্রতি তির্যক ইঙ্গিত সত্বেও আইন দ্বারা সিদ্ধ নয় এমন একটি পদে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিলাম । তারও আগে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে তীব্র মতভেদের কারণে অধিকতর আর্থিক সুবিধাযুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের ডেপুটেশন পদ ছেড়ে আসতে দ্বিধা করিনি ।
আইন-কানুনের প্রয়োগে কঠোর হওয়ার দরুণ আমি "অননমনীয়" বা “rigid” এই আখ্যাও অর্জন করেছিলাম । এমন কি জনৈক রাজ্যপাল (Governor) যাঁর কাছে আমি কাজ করেছিলাম আমার সম্পর্কে আমার সাক্ষাতেই তাঁর সচিবকে বলেছিলেন, "এই ভদ্রলোক সর্বদা আপনাকে আইন দেখাবেন" (“This man will always show you the rules”) । স্বভাবতঃই তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং এমন একটি বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছিলেন যেখানে আইনের বিধান উল্লেখ করে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম । সরকারী কাজে আইনের প্রয়োগে আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্য অনেক সময় আমাকে কুৎসিত পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হতে হয়েছে, যেমন আমি আমার রাজভবন অধ্যায়ে বলেছি । আমি যেমন সেখানে উল্লেখ করেছি, ঐ শোচনীয় পরিস্থিতি উদ্ভূত হওয়ার পূর্বেই আমি ঐ পদ ছেড়ে চলে আসতে চেয়েছিলাম । কারণ আমি দেখেছিলাম রাজভবনের প্রশাসনিক প্রধান নিজের পক্ষে অসুবিধাজনক কোন সিদ্ধান্ত নিতে অনিচ্ছুক । তাছাড়া এমন কোন বিষয় তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক যদি তা রাজ্যপালের অসন্তোষ উৎপাদন করতে পারে বলে তার মনে হয়,তবে সেটা রাজ্যপালের কাছে পেশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন; প্রত্যয়ের সঙ্গে কোন বিষয় উপস্থাপিত করতে পারেন না । অতিরিক্ত বিশেষ বেতন এবং পদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা কিছুই আমাকে ঐ ভাবে পদ ছেড়ে আসার অনুকূলে ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত করতে পারে নি । এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার যে অন্য কারণে আমার সেই ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি ।
আমার চাকুরী বিষয়ক পর্যালোচনা
আমি কখনো নিজের লাভের কথা ভেবে বা হাই প্রোফাইল পদের লোভে কাজ করিনি । বরঞ্চ পেছনে তাকালে দেখা যাবে কখনও কখনও আমার কোন কোন সহকর্মী রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে কোন পদে আমার নিয়োগের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে নিজের অনুকূলে করিয়ে নিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী আমার যোগ্যতা ও কর্ম্মদক্ষতা (১) প্রশ্নাতীত হওয়া সত্বেও আমাকে দীর্ঘদিন মেখলিগঞ্জের মত অবহেলিত ও দূরবর্তী স্থানে যেখানে অন্যরা যেতে ভয় পেত, কাটাতে হয়েছিল । এমনকি আই. এ. এসে প্রথম দুবারের প্রমোশনে আমি কোলকাতার নিকটবর্তী স্থানে পোস্টিং পাই নি যদিও আমার সহকর্ম্মীদের অনেকেই রাজনৈতিক সংযোগ কাজে লাগিয়ে তা যোগাড় করতে পেরেছিল । ফলে দুবারই আমাকে এই প্রমোশন প্রত্যাখ্যান করতে হয় । ১৯৯৫ সালে সুবিধাজনক জায়গায় পোস্টিং পেয়ে আমি যখন প্রমোশন পদে যোগ দি তখন আমাকে চার বৎসরের বরিষ্ঠতা হারাতে হয় । কর্ম্মজীবনে এরূপ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক সংযোগ গড়ে তোলার কথা কখনও ভাবিনি । নিজের নির্ধারিত মূল্যবোধক মাপকাঠির মধ্যে কাজ করতে পেরেছি এটাই আমার বড় প্রাপ্তি । তাই আমি দিনের শেষে খুশী ও সন্তুষ্ট ।
আমি কাজ করতে ভালবাসি এবং নিজের সন্তুষ্টি সহকারে তা করতে পেরেছিলাম । অভাবের মধ্যে মানুষ হলেও অর্থ বা পদ কোনটার প্রতিই আমার কোন লোভ ছিল না বা নেই। আর সে কারণেই কর্ম্মজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের শীর্ষে থেকেও নিষ্কলঙ্ক বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম এবং বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত হয়ে মানুষকে ন্যায় দিতে পেরেছিলাম।
বর্তমান বনাম অতীতের সিভিল সার্ভেণ্ট
আজকের দিনের সিভিল সার্ভেণ্টরা রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশনায় নিজেদের চালনা করেন দেখে আমার কষ্ট হয়। তারা যেন 'হিজ মাস্টার্স/হার মেজেস্টিস' কণ্ঠ হয়ে উঠেছেন, সর্বদা প্রভুর মন বুঝে কোন বিষয়ে নিজেদের মতামত দিচ্ছেন । সিভিল সার্ভিসের মূল নীতিই তারা ভুলে গেছেন, যে নীতি অনুযায়ী যে কোন বিষয়ে আইনের বিধান উল্লেখ করে তাদের নিরপেক্ষ মতামত দিয়ে রাজনৈতিক নির্বাহীর নিকট পেশ করার কথা । রাজনৈতিক প্রভুরা প্রদত্ত পরামর্শ গ্রহণ করতে বা না করতে পারেন এবং অন্যরূপ নির্দেশও দিতে পারেন, যে নির্দেশ লিখিত হলে বাধ্যতামূলক হবে । সিভিল সার্ভেণ্ট আইনের বিধান তুলে ধরতে দায়বদ্ধ । সেটা মানা না মানা রাজনৈতিক প্রভুর প্রাধিকার । আইনের বিধানের পরিপন্থী কোন মৌখিক আদেশ বা নির্দেশ থাকলে নিয়মানুযায়ী তা কার্যকর করার পূর্বে লিখিত করিয়ে নিতে হবে । এই নিয়মনীতিগুলো মেনে চললে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক অবৈধতা ও বেনিয়ম পরিহার করা যেত । সেক্ষেত্রে খুব কমসংখ্যক রাজনৈতিক নির্বাহীই তাদের ক্রিয়াকর্ম্মের পশ্চাতে লেজুড় ছেড়ে যেতে সাহসী হতেন । সিভিল সার্ভেণ্টদের মৌখিক বেআইনী নির্দেশ অমান্য করার অধিকার আছে ।
অতীতে কে কে হাজরা, রঘু ব্যানার্জি, জে সি সেনগুপ্ত, এস এম মুর্সেদের মত প্রথিতযশা সিভিল সার্ভেণ্টরা ছিলেন যাঁরা ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় বা জ্যোতি বসুর উচ্চতার মুখ্যমন্ত্রীদের মুখের উপরও আইনসঙ্গত নয় এমন নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করতে পারতেন । এটা যেমন সত্যি যে এই জাতের সিভিল সার্ভেণ্ট আজকের যুগে দুর্লভ এটাও তেমনি সত্যি যে আজকের রাজনৈতিক প্রভুরা যে সব সিভিল সার্ভেণ্ট তাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে না তাদের প্রতি অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ । প্রভুর সুরে নাচতে অরাজী সিভিল সার্ভেণ্টদের শায়েস্তা করতে বাধ্যতামূলক প্রতীক্ষা (Compulsory waiting) নামক মুলস্রোত থেকে বাইরে ঠেলে দেয়ার এক অভিনব অবমাননাকর পদ্ধতি নীতি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে গত এক দশকের উপর চালু হয়েছে । বছরের পর বছর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সিভিল সার্ভেণ্টদের তা প্রতিরোধ করার অক্ষমতায় সিভিল সার্ভিসের মেরুদণ্ড আজ ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে । স্বার্থান্বেষী সিভিল সার্ভেণ্টরা যারা এখন সংখ্যাগুরু এই সুযোগে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত । অপরদিকে যারা স্বার্থান্বেষী নন তাদের বেশীর ভাগ যে ভাবে চলা উচিত ছিল সাহসের অভাবে সেভাবে চলতে পারেন নি । মুষ্ঠিমেয় সংখ্যক স্রোতের বিপরীতে গিয়ে অন্যায় প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন এবং তার ফলে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এটা ভবিষ্যতের জন্য অশুভ । দেশের দুর্ভাগ্য, আজকের দিনের সিভিল সার্ভেণ্টরা হয় নমনীয় নয় স্বার্থান্বেষী ।
সাম্প্রতিক কালের (২০১৫-১৬) দূর্গাশক্তি নাগপাল ও অশোক খেমকার মত সিভিল সার্ভেণ্টরা যখন রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও তাদের পরামর্শদাতাদের মোকাবিলায় কঠোর প্রতিরোধের মুখেও আইন প্রয়োগ করতে বদ্ধপরিকর হন তখন আশার আলো দেখা যায় । এ থেকেই মনে হয় সিভিল সার্ভেণ্টরা ইচ্ছে করলে এখনো কাঠামোটাকে পচন থেকে রক্ষা করতে পারেন । এটা ঠিক দিনকালের পরিবর্তন হয়েছে এবং জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ধরণের যোগসূত্র তৈরী হয়েছে । তবুও সিভিল সার্ভেণ্টরা এই ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ রুখতে পারেন যদি তারা একটি শ্রেণী হিসাবে জেগে উঠেন । এই জন্য সিভিল সার্ভেণ্টদের কেবল সৎ, আইনমান্যকারী, ন্যায়পরায়ণ ও নির্ভীক হতে হবে । শ্রেণী হিসাবে তাদেরকে রাজনৈতিক প্রভুদের হাতের ক্রীড়ণক হওয়া থেকে নিজেদের বিরত করতে হবে এবং সততা, চারিত্রিক শুদ্ধতা ও আচরণবিধি মেনে নিজ কাজ সম্পাদন করতে হবে । কেবল কাঠামোতে জোর ধাক্কা ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন দ্বারাই তা করা সম্ভব । আইন মেনে ও ন্যায়সঙ্গত ভাবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনগুলোও ধনাত্মক ভূমিকা পালন করতে পারে । হয়ত এটা অভিলাষী চিন্তা, কিন্তু বিকল্পই বা কি আছে?
সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ পদের বরিষ্ঠতায় যোগ্য হলেও অশোক খেমকাকে ভারত সরকারের যুগ্ম সচিব পদের জন্য প্যানেলভুক্ত করা হয়নি । কারণ দেখানো হয়েছে তার কর্ম্মজীবনে তিনি কখনো কেন্দ্রীয় সরকারের ডেপ্যুটেশন পদে যান নি । জানি না তাঁকে ডেপুটেশন পদে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল কি না ।
স্বার্থান্বেষী সিভিল সার্ভেণ্টের অভিযোজন: একটি দৃষ্টান্ত
নিজের কিংবা এক বা একাধিক বশংবদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে একজন স্বার্থান্বেষী সিভিল সার্ভেণ্ট জনস্বার্থমূলক কোন বিষয় কি ভাবে পরীক্ষা করেন তার কয়েক বৎসর পূর্বের একটি নজির এখানে উত্থাপন করতে আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি । বিষয়টি ছিল কোন এক বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল রুজু করা নিয়ে । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুগ্মসচিব পদ মর্যাদার জনৈক অফিসার তার কাছে পেশ করা নথিপত্র যথাযথ পরীক্ষা না করে ও জেলা অফিসারের পত্রে উল্লিখিত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনা না করে দপ্তরের নোটে লিখলেন জেলা অফিসার এখনও আপীল করার সুযোগ আছে কি না তা বিবেচনা না করে আইনী অফিসারের মত অভিমত দিয়েছেন । তিনি এই কথাগুলো লিখেছিলেন যখন এটা সর্ব্বজনজ্ঞাত যে কোন কোর্টের আদেশ পালিত হয়ে যাওয়ার পর (এক্ষেত্রে কয়েক মাস পর) সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা যায় না এবং যখন সংশ্লিষ্ট জেলা অফিসার তার চিঠিতে এ বিষয়ে দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিলেন । যুগ্ম সচিব মহোদয়ের নোট থেকে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে তার মতে সরকারী অফিসারদের কোন বিষয়ে আইনগত অবস্থান নেয়া উচিত নয়, বরং যারা বিষয়টিতে আগ্রহী তাদের সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করা উচিত ।
তিনি মিথ্যা ভাষণও করেছিলেন । জেলা অফিসারের সঙ্গে কোন কথা না বলেই লিখেছিলেন এ বিষয়ে তিনি জেলা অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছেন । দপ্তরের নির্দেশ থাকা সত্বেও যথাসময়ে আপীল না করে তড়িঘড়ি কোর্টের আদেশ পালন করা হয়েছিল । এই বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং যে ভাবে তা করা হয়েছিল তাতে দুর্নীতির সম্ভাবনা প্রকট ছিল । জেলা আধিকারিকের চিঠিতে এর সুস্পষ্ট ঈঙ্গিতও ছিল । কিন্তু সেই বিষয়টি এঁড়িয়ে যাওয়া হল । এবং একটি অকার্যকর প্রস্তাব (৩) নিয়ে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল । কেন?
মহামান্য যুগ্ম সচিবের নোট পড়ে এটাই প্রতিপন্ন হচ্ছিল যে বিষয়টির দায় তিনি জেলা আধিকারিকের উপর চাপাতেই অধিকতর আগ্রহী এবং এ বিষয়ে মিথ্যা ভাষণেও তিনি পিছপা নন যদিও সম্পূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছিল জেলা আধিকারিকের অজ্ঞাতে । সেই উদ্দেশ্যে নিয়েই জেলা আধিকারিকের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল । জেলা আধিকারিক ঘটনা পরম্পরা বিবৃত করে, কিভাবে বিষয়টি তাকে অন্ধকারে রেখে সমাধা হয়েছে সেটা সুস্পষ্ট করে ও বিষয়টিতে দুর্নীতির সম্ভাবনার ঈঙ্গিত দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবী করেছিলেন । কিন্তু দুর্নীতির বিষয়টি কোন গুরুত্বই পেল না । ১৯৯৭-৯৮ সালের ঐ ঘটনার আজ পর্যন্ত কোন তদন্তও হয়েছে বলে জানা নেই ।
এই জাতের সিভিল সার্ভেণ্ট অনেক বছর আগেও ছিল, এখন শুধু এদের সংখ্যা বেড়েছে । বলা বাহুল্য, চলিত প্রথা অনুযায়ী এখানে উল্লিখিত অফিসার অবসর পূর্ববর্তী ও অবসর পরবর্তী উভয় পর্যায়েই যথাযথভাবে রাজনৈতিক প্রভুদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন । এরা সেই জাতের অফিসার যারা তাদের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে খুশী করতে ও নিজেদের দক্ষ প্রমাণ করতে আইনকানুকে উপেক্ষা করতে দ্বিধা বোধ করে না ।