কোলকাতা রাজভবন
সূচীপত্রের যে কোন বিষয়ের উপর ক্লিক করে সেই বিষয় সংক্রান্ত অংশে যাওয়া যাবে ।
সূচীপত্র
কার্যভার গ্রহণ: প্রথম দিন
১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারী অপরাহ্ণে আমি রাজভবনে যৌথভাবে রাজ্যপালের উপসচিব (DS to Governor), অতিথি-আপ্যায়ন অধিকর্তা (Director of Hospitality) ও রাজ্যপালের গৃহস্থালীর হিসাবাধ্যক্ষ (Comptroller of Governor's Household) পদগুলির দায়িত্বভার গ্রহণ করি । আমার কার্যভার গ্রহণের সময় রাজভবনে রাজ্যপাল টি. ভি. রাজেশ্বরের আহূত নববর্ষ পার্টি চলছিল । অতিথিদের মধ্যে অন্যান্যরা ব্যতীত চিত্র, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলেন । আমি যখন পৌঁছুলাম তখন পার্টি শেষের পর্যায়ে, অতিথিরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন । তখনও উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল । এদের মধ্যে ছিলেন সিনেমা জগতের বসন্ত চৌধুরী, অপর্ণা সেন, দেবশ্রী রায় এবং ক্রীড়া জগতের পি কে ব্যানার্জি । পি কে ব্যানার্জির সঙ্গে মুখোমুখি কথা হয়েছিল । বসন্ত চৌধুরী পরে ফোন করে কথা বলেছিলেন, ওঁর কোন একটি জ্ঞাতব্য বিষয় ছিল ।
প্রজাতন্ত্র দিবসে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের একটি চিত্র, রাজভবনে কোলকাতা ।
প্রশাসনিক গঠন
সচিবকে শীর্ষে রেখে রাজ্যপালের দপ্তর দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল । একটি ছিল রাজ্যপালের সচিবালয় যা সাংবিধানিক বিষয়গুলির দেখাশোনা করত ও রাজ্যপালের দৈনন্দিন সাক্ষাৎকার সূচী তৈরী করত । অপর ভাগে ছিল ডিএসজি (DSG) অফিস, যা পূর্বে মিলিটারি সচিবের অফিস নামে পরিচিত ছিল, যার দায়িত্ব ছিল রাজ্যপালের গৃহস্থালী ও প্রটোকল সংক্রান্ত বিষয়গুলির দেখাশোনা করা । পরবর্তীকালে এই অংশের নাম হয়েছিল রাজ্যপালের গৃহস্থালী সচিবালয় (Governor's Household Secretariat) । তবে তার আগেই আমি রাজভবন ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম । ডিএসজি (DSG)(১) কার্যালয়ে সেক্সন অফিসার, অফিস সুপারিণ্টেডেণ্ট, পরিবহন সুপারিণ্টেডেণ্ট (Transport Superintendent), লাইব্রেরিয়ান, গৃহস্থালী সহকারী (Household Assistant), হিসাব রক্ষক (Accountant), ক্যাশিয়ার ইত্যাদি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ছাড়াও একগুচ্ছ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিল । আমার মেয়াদ কালে একটি গৃহস্থালী পরিচালিকার (Housekeeper) পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং একজন মহিলাকে ঐ পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল । এ ছাড়া রাজ্যপালের দুজন এডিসি (ADC), একজন সশস্ত্র বাহিনীর ও অপর জন নৌসেনার, এই কার্যালয়ের অন্তর্গত ছিলেন ।
পরবর্তী কালে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে দুজন অফিসার রাজ্যপালের এডিসি পদের জন্য দিতে অস্বীকার করেন । তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় একটি পদ রাজ্য সরকারের আইপিএস অফিসার দ্বারা পূরণ করা হবে । তবে এই সিদ্ধান্ত আমি রাজভবন ত্যাগ করার পর কার্যকরী হয়েছিল ।
১৯৯১ সালে কোলকাতা রাজভবনে প্রজাতন্ত্র দিবসের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিবৃন্দের একাংশ
প্রোঃ সৈয়দ নুরুল হাসানের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল রূপে শপথ গ্রহণের পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে এগিয়ে দেয়ার পথে ।
রাজভবনের আভ্যন্তরীণ গঠণ
চুরাশি হাজার বর্গফুট গৃহতল (floor area) বিশিষ্ট রাজভবন একটি ত্রিতল অট্টালিকা । এক তলাতে একটি হলঘর সহ এক বিশাল কেন্দ্রীয় এলাকা রয়েছে যাকে কেন্দ্র করে চারটি বক্রাকার করিডোর চারটি পরষ্পর বিচ্ছিন্ন উইংসে গেছে যাদের প্রত্যেকটি এক একটি বড় হলঘর সহ এক একটি আলাদা বাড়ী । রাজভবনে অন্যুন ষাটটি কক্ষ রয়েছে ।
উত্তর তথা মূল ফটক থেকে রাজভবনকে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় । ফটক থেকে অনেকটা দূরে এক বিস্তৃত সোপান শ্রেণী সরাসরি রাজভবনের দ্বিতলে উঠে গিয়েছে । এই সোপানশ্রেণী দিয়েই মনোনীত রাজ্যপাল প্রথমবার রাজভবনে প্রবেশ করেন । এখানেই তাঁকে রাজভবনের তরফে অভ্যর্থনা জানানো হয় ।
এই সোপান শ্রেণীর নীচে কিছুটা দূরে রয়েছে ড্রেগনের উপর স্থাপিত সুসজ্জিত একটি চীনা কামান । এর দুপাশে রয়েছে ক্ষুদ্রাকার দুটি কামান । কামানটি ১৮৪২ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধের পর চীন দেশের নানকিং থেকে আনা হয়েছিল । এটি এডিনবরার প্রথম আর্ল এডওয়ার্ড ল' উপহার দিয়েছিলেন । এর সংলগ্ন মার্বেলের ফলকে উৎকীর্ণ আছে, "The peace dictated to the Emperor of China under the walls of Nanking by the military force of England and of India".
রাজভবনের আবাসিক অংশের বিভাজন
রাজভবনের একটি অংশ রাজ্যপাল এবং ওঁর পরিবারের জন্য নির্দ্দিষ্ট । অপর অংশে দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট অতিথিদের সাময়িক অবস্থানের জন্য একাধিক সুসজ্জিত কক্ষ আছে । ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য ‘প্রিন্স ওফ ওয়েলশ’ নামে একটি নির্দিষ্ট স্যুট রয়েছে । অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের বা সমমর্যাদার অতিথিদেরও এই স্যুটে রাখা হয় । এ ছাড়া অন্যান্য অতিথিদের জন্য ডাফরিন, ওয়েলশলি ও এণ্ডারসন নামে তিনটি সুসজ্জিত কক্ষ আছে । আমার অবস্থানকালে প্রিন্স ওফ ওয়েলশ স্যুটে রাষ্ট্রপতি রামস্বামী ভেঙ্কটরমন, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ও ওঁর স্ত্রী সীতাদেবী (এঁরা রাত্রি যাপন করেন নি), মাননীয় নেলসন মেণ্ডেলা, প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর থেকেছেন । কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসহ অন্য যাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে গণ্য করা হত তাঁদের রাজভবনের অন্যান্য অতিথি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা হত । রাজ্যপালের অতিথিরাও এই সকল কক্ষে অবস্থান করতেন । টি ভি রাজেশ্বর রাজ্যপাল থাকাকালীন স্যুটগুলির নাম পরিবর্তন করে ভারতের মহান নদনদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি নাম রেখেছিলেন । পরবর্তীকালে প্রোঃ নুরুল হাসান ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে পুরনো নামগুলো ফিরিয়ে আনেন ।
রাজভরনের বৈঠকখানা সমূহ ও অন্যান্য কক্ষাদি
রাজভবনে মোট তিনটি বৈঠকখানা (Drawing Rooms) আছে । বৈঠকখানাগুলোর নামাকরণ হয়েছে বিভিন্ন রঙের নামে যথা ইয়েলো (হলুদ}, ব্লু (নীল) ও ব্রাউন (বাদামী) । ইয়েলো ড্রয়িং রুম হল এগুলোর মধ্যে বৃহত্তম । নামে ড্রয়িং রুম হলেও মূলতঃ এটি একটি বিশাল হলঘর । এর দেয়াল অপূরূপ চিত্রকলায় সজ্জিত । স্বাধীনতা দিবসের রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা এখানেই হয় । সংলগ্ন থ্রোনরুমে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলে অনুষ্ঠান শেষে অভ্যাগতদের এখানেই চা-পানে আপ্যায়িত করা হয় । ব্লু ড্রয়িংরুমে সাধারণতঃ রাজ্যপাল অতিথিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন । তবে রাজভবনের ছোটখাটো অনুষ্ঠানও সময় বিশেষে এখানে হয়ে থাকে । আমার কার্যকালে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যসচিব তরুণ দত্ত মহাশয়ের অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে স্বনামধন্য সেতার বাদক ও পঞ্চাশের দশকের আইএএস (IAS)অফিসার বিমল চন্দ্র মুখার্জি মহাশয়ের সেতার বাদন অনুষ্ঠান এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল । ব্লু ড্রয়িং রুমের সংলগ্ন ব্রাউন ড্রয়িং রুমটি ছোটখাটো মিটিং বা কনফারেন্সের জন্য ব্যবহৃত হয় । তৃতীয় তলে বিভিন্ন পুরাকীর্তির তথা রাজভবনের পুরাকালের নিদর্শন দ্বারা সজ্জিত মিউজিয়ামটি অবস্থিত । একটি কক্ষে রাজ্যপাল নুরুল হাসানের ব্যক্তিগত পুস্তকাদি সংরক্ষিত ছিল ।
রাজভবনের হল ও ভোজনকক্ষ
রাজভবনের হল ও ভোজন কক্ষ গুলো বিভিন্ন নামে অভিহিত যথা থ্রোন রুম, কাউন্সিল চেম্বার, মার্বেল হল ও বেঙ্কুয়েট হল । থ্রোন রুমে রিচার্ড ওয়েলসলির সিংহাসন রয়েছে । পাশে আছে টিপু সুলতানের সিংহাসন । এখানে মাহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু ও ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের তৈলচিত্র রয়েছে । মহাত্মাগান্ধীর দেহাবশেষের ভস্ম বহনকারী একটি পাত্রও রাখা আছে । এই কক্ষের লাগোয়া ইয়েলো ড্রয়িং রুম । থ্রোনরুমে রাজ্যপালের ও সাধারণভাবে মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে । তবে আমার কার্যকালে একবার রাজভবনের লনে সামিয়ানা টাঙিয়ে মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল । রাজভবনের তৃতীয় তলে কাউন্সিল চেম্বার । ব্রিটিশ আমলে গভর্নর জেনারেল এখানে প্রথমদিকে কার্যনির্বাহী পরিষদের ও পরে বিধানিক পরিষদের বৈঠক করতেন । বর্তমানে কখনো কখনো এই কক্ষ রাজ্যপালের কোন বিশেষ মিটিংএর কাজে ব্যবহার হয় । তবে আমার কার্যকালে এখানে তেমন কোন মিটিং হয়নি । মার্বেল হলটি একতলায় । এখানে অনেক সরকারী ও অনুমতি সাপেক্ষে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে ।
কাউন্সিল চেম্বারের সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র ভোজন কক্ষ ও বিলিয়ার্ড রুম রয়েছে । বিলিয়ার্ড রুমে একটি পুরাকালের বিলিয়ার্ড টেবিল ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী রয়েছে । বেন্কোয়েট হলের দুপাশে ডরিক[1] স্থাপত্যে নির্মিত স্তম্ভের সারি আর মধ্যভাগ বরাবর ফুটন্ত পুষ্পের চেহরার ঝুলন্ত সিণ্ডেলিয়ার গুচ্ছ হলটির শোভা বর্দ্ধন করছে । মাঝ বরাবর মেহগনি কাঠের তৈরী লম্বা ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ভোজসভার আয়োজন করা হয় । বৃটিশ আমল থেকে মহারাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এখানে আপ্যায়ন করা হয়েছে । আমার কার্যকালে নেলসন মেণ্ডেলা. ইয়াসের আরাফত. লণ্ডনের তৎকালীন মেয়র সহ অনেক বিশিষ্ট জনকে এই বেনকোয়েট হলে নৈশভোজে আপ্যায়ন করা হয়েছে ।
[1] ডরিক রীতি হল প্রাচীন গ্রীক ও পরবর্তী রোমান স্থাপত্যের তিনটি রীতির একটি । বাকি দুটি রীতির নাম আইকনিক ও করিণথিয়ান ।
রাজবনের অন্যান্য সম্পদ
জরুরী ও গোপনীয় বিষয় ছাপার জন্য রাজভবনের একটি নিজস্ব ছাপাখানা রয়েছে । রাজভবনের একটি নিজস্ব লাইব্রেরী আছে যা দেখাশোনা করতেন ডিএসজি অফিসের একজন কর্ম্মচারী । মিউজিয়ামের কথা আগে বলেছি । আমার কার্যকালে পূরাকীর্তি ও রাজভবনের প্রাচীনকালের উপলভ্য দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে উন্নতি করণের প্রচেষ্টা চলছিল ।
রাজভবনের অফিস সমূহের অবস্থান
রাজভবনের দ্বিতলে রাজ্যপালের অফিস চেম্বার, রাজ্যপালের সচিবালয়, রাজ্যপালের সচিব, সহসচিব ও একান্ত সচিবের অফিস ঘর রয়েছে । একতলায় মার্বেল হল সংলগ্ন অংশে রয়েছে ডিএসজির অফিস ও চেম্বার, রাজভবন টেলিফোন কেন্দ্র ইত্যাদি । মূল (উত্তর) ফটক সংলগ্ন একটি আলাদা বাড়ীতে রয়েছে পুলিশ অফিস । রাজভবনের বাইরে সচিব ও উপসচিবের (ডিএসজি) ডুপ্লেক্স বাংলোর মধ্যবর্তী স্থলে রাজভবন গাড়ীর গ্যারেজ । এই এলাকার বিপরীত দিকে নির্বাহী বাস্তুকারের অফিস ।
পরিবহন: উপলভ্যতা ও পরিচালন
রাজভবনে রাজ্যপালের লিম্যুজিন ও সরকারী আথিত্যকর্তীর (Official Hostess) একটি কণ্টেসা সহ বেশ কয়েকটি গাড়ী ছিল । আমার মেয়াদকালে একটি অব্যবহার্য গাড়ীর পরিবর্তে একটি মারুতী সুজুকি সাফারী গাড়ী ক্রয় করা হয় । সেক্সন অফিসার পদমর্যাদার পরিবহন অধিক্ষক (Transport Superintendent) গাড়িগুলির প্রত্যক্ষ দায়িত্বে ছিলেন । রাজ্যপালের ও আথিত্যকর্তীর গাড়ী ব্যতিরেকে অন্য গাড়ীগুলি রাজভবনের বরিষ্ঠ আধিকারিক ও এডিসিরা প্রত্যেক স্তরের জন্য নির্দ্ধারিত মাসিক দূরত্ব পর্যন্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিনা ব্যয়ে ব্যবহার করতে পারতেন। নির্দ্ধারিত দূরত্বের বাইরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হলে নির্দিষ্ট ছাড় (discounted charge) দেয়া দরে ব্যয় বহন করতে হত ।
ভারতের রাষ্ট্রপতি রামস্বামী ভেন্কটরমন কোলকাতা রাজভবন থেকে অনুষ্ঠানের উদ্দেশে যাত্রাকালে বিদায় জানানো ।
রাজভবন রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন নির্মাণ
রাজভবন রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন নির্মাণের জন্য একজন নির্বাহী বাস্তুকার ও আলাদা আলাদা অফিসে দুজন সহকারী বাস্তকার (সিভিল ও বিদ্যুৎ) ছিলেন । এই ইঞ্জিনিয়াররা নিজ নিজ দপ্তরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ছিলেন ।
উদ্যানপালন
রাজভবনের বাগান পরিচর্যা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন একজন উদ্যান অধিক্ষক । তিনি বন দপ্তরের অধীনস্থ ছিলেন ।
রাজভবন ছাপাখানা
জরুরী ও গোপনীয় বিষয় ছাপার জন্য রাজভবনের একটি নিজস্ব ছাপাখানা রয়েছে ।
রাজ্যপালের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা
রাজ্যপালের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রাজভবনে একজন সর্বসময়ের আবাসিক চিকিৎসক নিযুক্ত ছিলেন ।
রাজ্যপাল প্রোঃ হাসান সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না, দৈনন্দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াও মাঝে মাঝেই তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন হত । আবাসিক চিকিৎসকই প্রত্যহিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদির দায়িত্বে ছিলেন । প্রয়োজনে বরিষ্ট সরকারী চিকিৎসাবিদ ও বিশেষজ্ঞরাও শুশ্রুষা করতেন । এছাড়া বছরে অন্ততঃ একবার প্রোঃ হাসান চিকিৎসার জন্য আমেরিকা যেতেন । আমেরিকায় ওঁর মেয়েও বসবাস করতেন । দু-একবার দেশের ভিতর সরকারী সফরে থাকাকালীন উনি বিমানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, বিমান বন্দর থেকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল ।
সুবিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী (বর্তমানে মৃত) রাজ্যপালের সাম্মানিক চিকিৎসক ছিলেন । তিনি সপ্তাহের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে রাজভবনে বসে রাজভবন কর্মচারীদেরও বিনা ব্যয়ে চিকিৎসা করতেন । আমি ও আমার জ্যেষ্টা কন্যা চর্মঘটিত রোগে ওঁর চিকিৎসায় সুফল পেয়েছিলাম ।
কর্মচারী ও আধিকারিকদের বসবাস ব্যবস্থা
সকল আধিকারিক, এডিসি ও গৃহস্থালীর কর্মচারীদের জন্য রাজভবনে সুনির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল । সচিব ও উপসচিবের জন্য ডুপ্লেক্স ধরণের বাসভবন ছিল । উপসচিবের নির্দিষ্ট বাংলোর দেয়ালে ও ছাদে বৃহদাকার ফাটল দেখা দিয়েছিল যার জন্য ব্যপক মেরামতির প্রয়োজন ছিল । আমার পূর্বসূরীর আমলে ছাদ থেকে চাঙ্ড় ভেঙ্গে পড়েছিল বলেও রিপোর্ট ছিল । দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি চলছিল, কিন্তু সন্তোষজনক মেরামতি হয় নি । আমি এই বাংলোর দখল না নিয়ে নিকটবর্তী যে সরকারী আবাসনে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম । রাজভবনের নিকটস্থ হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে কিংবা প্রয়োজনে আমাকে পেতে কোন অসুবিধা হত না । তবে এর জন্য আমাকে রাজ্যপালের অনুমতি নিতে হয়েছিল ।
রাজভবনের টেলিফোন নেটওয়ার্ক
রাজভবনে বসবাসকারী আধিকারিক ও কর্মচারীদের অফিস ও আবাস, রাজভবনের প্রতিটি গেস্টরুম ও সার্ভিস পয়েণ্ট টেলিফোনে যুক্ত ছিল । এক বিরাট সংখ্যক এক্সটেনশন লাইনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল । রাজভবনের নিজস্ব টেলফোন অপারেটাররাই হস্তচালিত পিবিএক্স (Manual PBX) বোর্ডের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা সচল রেখেছিলেন । আমার কার্যকালে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয়ে হস্তচালিত বোর্ডকে বৈদ্যুতিন বোর্ড (Electronic Board) দ্বারা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয় । এই পরিবর্তনে নেটওয়ার্কের কার্যকরী দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং অপারেটারদের কাজের চাপও হ্রাস পায়।
রাজভবনের টেলিফোন ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ তদারকি করার জন্য কলিকাতা টেলিফোনস এর একজন সুপারভাইসর রাজভবনে নিযুক্ত ছিলেন ।
রাজ্যপালের উপসচিব হিসাবে কর্তব্য ও দায়িত্ব
রাজ্যপালের উপসচিব হিসাবে আমি রাজ্যপালের গৃহস্থালী ও প্রোটোকল সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বে ছিলাম । সচিবের সামগ্রিক তত্তবধানে রাজ্যপালের সচিবালয়ের আধিকারিক ও কর্মচারী ব্যতিরেকে রাজভবনের মানবসম্পদ ও সামগ্রীসমূহ মূলতঃ আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল । রাজ্যপাল ও রাজভবনে অবস্থান কালে তাঁর অতিথিদের ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত ছিল । রাজভবনের গেস্টরুমে ভিভিআইপি ও রাজ্যপালের অতিথিদের আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা সহ কক্ষ বরাদ্দ করাও আমার দায়িত্বে ছিল । বহিরাগত কিংবা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মানে রাজ্যপাল ভোজসভা বা টিপার্টি আহ্বান করলে তার ব্যবস্থাপনা তদারকির সামগ্রিক দায়িত্ব আমার ছিল । রাজ্যপালের আহূত সকল মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজে রাজ্যপালের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রোটোকল অনুযায়ী আমন্ত্রিতদের আসনবিন্যাস আমাকে চূঢ়ান্ত করতে হত । রাজ্যপালের পরামর্শ অনুযায়ী ভোজসভায় আমন্ত্রিতদের তালিকা ও খাদ্যতালিকা (মেনু) আমি প্রস্তুত করতাম । আন্তর্জাতিক ও জাতীয়স্তরের নিমন্ত্রিতদের কাছে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছুনো আমাকে নিশ্চিত করতে হত ।
দেশের ভিতরে বা বাইরে ট্রেণ, প্লেন বা হেলিকপ্টরে রাজ্যপাল ও তার সফরসঙ্গীদের সফরের ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল । সরকারী সফরে সচিবের অনুপস্থিতিতে আমাকে রাজ্যপালের সহগামী হতে হত । আমার কার্যকালে একবারই আমি রাজ্যপালের সফর-সঙ্গী হয়েছিলাম। সেটা ছিল মালদহ উত্তর দিনাজপুর সফর ।
দার্জিলিংএ বছরে দুবার রাজ্যপালের শিবির আয়োজন করা ও সেই উদ্দ্যেশ্যে লোকলস্কর ও দ্রব্যসামগ্রীর গমনাগমন করানো আমার আরেকটি দায়িত্ব ছিল । দার্জিলিং রাজভবন, গেস্ট হাউস ও কর্মচারী আবাসনের আসবাব পত্রের রক্ষণাবেক্ষণের দিকটাও আমাকে দেখতে হত ।
ডিএসজি অফিসের প্রশাসনিক প্রধান হওয়ার সুবাদে এই অফিসের প্রশাসনিক কার্যাবলীর ভার আমার উপর ন্যস্ত ছিল ।অফিস প্রধান হিসাবে আমাকে কিছু বিধিবদ্ধ কর্তব্য সম্পাদন করতে হত ।
অতিথি-আপ্যায়ন অধিকর্তা হিসাবে কর্তব্য ও দায়িত্ব
অতিথি-আপ্যায়ন অধিকর্তা হিসাবে রাজভবনে নিবাসিত রাষ্ট্রীয় অতিথিদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার ছিল । তাছাড়া মন্ত্রীদের ও রাজ্যপালের শপথ গ্রহণ, স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসের অভ্যর্থনা ইত্যাদি সরকারি অনুষ্ঠানের আয়োজন ও তদারকি করা আমার কর্তব্যের অন্তর্গত ছিল । স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসের নিমন্ত্রণপত্র সাধারণতঃ রাজ্যপাল এবং রাজ্যপালের স্ত্রীর নামে পাঠানো হত । রাজ্যপাল অকৃতদার বা বিপত্নীক হলে নিমন্ত্রণপত্র কেবল রাজ্যপালের নামেই পাঠানো হত । রাজ্যপাল ও তাঁর স্ত্রী অথবা সরকারী আতিথ্যকর্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে অতিথিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্যাক্যালাপ করতেন । মুখ্যমন্ত্রীও অবশ্যই এই অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিত থাকতেন । এই উপলক্ষে অংশ গ্রহণকারী বরিষ্ঠ সিভিল ও মিলিটারি আধিকারিকদের এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের পরষ্পরের সঙ্গে পরিচিতি ও আলাপচারিতার সুযোগ হত । অতিথিদের চা, কফি, মিষ্টি, নোন্তা ইত্যাদি খাদ্য ও পানীয় দ্বারা আপ্যায়ন করা হত । স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমন্ত্রণ জানানো বাধ্যতামূলক ছিল । অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে ও শেষে সামরিক ব্যাণ্ডে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হত । অনুষ্ঠানগুলি আয়োজন করা হত রাজ্যপালের গৃহস্থালী অফিস থেকে, সামগ্রিক দায়িত্বে থাকতেন রাজ্যপালের উপসচিব । পরিবহনের প্রবেশ ও নির্গমন এবং রাজভবনের ভিতর ঐগুলোর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করত কোলকাতা পুলিশ । রাজভবনে পার্কিং ব্যবস্থাও থাকত পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ।
হিসাবাধ্যক্ষ হিসাবে কর্তব্য ও দায়িত্ব
হিসাবাধ্যক্ষ হিসাবে রাজ্যপালের গৃহস্থালীর সমুহ ব্যয়ের যথাযথ হিসাব রাখার দায়িত্ব ছিল আমার । রাজ্যপাল (বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা) আইন, ১৯৮২ ও তদন্তর্গত বিধেয়ক অনুযায়ী কৃত ব্যয়ের নিরীক্ষার (অডিট) সাথেও আমাকে যুক্ত থাকতে হত । এই খাতে ব্যয় সরাসরি সরকারের কনসলিডেটেড ফাণ্ড থেকে হয়, এর জন্য আইনসভার অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না । রাজ্যপালের ব্যয়ের নিরীক্ষা (Audit) একজন উপ মহাগাণনিক Deputy Accountant General) স্তরের আধিকারিকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় ।
গৃহস্থালীতে আমার আনীত পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া
রাজ্যপালের গৃহস্থালী পরিচালনা দক্ষতর করতে আমি কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছিলাম যার অনভিপ্রেত ও অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল ।
রাজ্যপালের গৃহস্থালীর ভারপ্রাপ্ত উপসচিব হিসাবে গৃহস্থালীর পরিচালন ব্যবস্থাকে সুষ্টুতর করতে আমি কিছু পরিবর্তন এনেছিলাম এবং আর্থিক নিয়মাবলী যথার্থ ভাবে বলবৎ করতে ও দক্ষতা বাড়াতে কিছু পদ্ধতিগত আবশ্যকতার প্রবর্তন করেছিলাম । এগুলো করতে গিয়ে সরকারী নিয়মাবলীর পরিপন্থী কিছু প্রাচীন প্রথার পরিমার্জন বা বিলুপ্তি ঘটাতে হয়েছিল । এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিস্তারিত বিবরণে যাওয়ার প্রয়োজন নেই । কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায় আমার নেয়া এই পদক্ষেপগুলো রাজভবনের কিছু মানুষকে অখুশী করেছিল এবং আমার পরিমাপন যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে তবে পরবর্তীকালে রাজভবনের কয়েকটি নিন্দনীয় তথা অপরাধমূলক ঘটনার মূল কারণ হয়েছিল । এই সকল কার্য ও ঘটনা আমি পরবর্তী অনুচ্ছেদ গুলোতে সবিস্তারে বর্ণনা করেছি ।
রাজ্যপালের প্রতিষ্ঠান সাধারণের চোখে যে উচ্চাসনে আসীন তা বিবেচনা করে ঘটনাকালে আমি বিষয়টিকে প্রচারের আলোয় আনতে চাই নি এবং সেই কারণে কয়েকজন সাংবাদিকের বারংবার অনুরোধ সত্বেও এই ঘটনা সম্পর্কে কোন সাক্ষাৎকার বা প্রতিক্রিয়া দিই নি । আমি ভেবেছিলাম প্রশাসনিক স্তরে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে, বিষয়টিকে জনসমক্ষে এনে রাজভবনের মত একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা উচিত হবে না । কিন্তু আমি সত্য গোপনের অপরাধে অপরাধী হব যদি রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই সকল আধিকারিকদের দ্বারা ঘটানো এই অপরাধমূলক ঘটনাগুলো আমার জীবনকাহিনীতে উল্লেখ না করি । তবে সেখানে পৌঁছুনোর আগে জানিয়ে রাখি প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত থাকা সত্বেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি । এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমাকে ছুটিতে যেতে হয়েছিল । ছুটি শেষে আমি অন্য দপ্তরে কাজে যোগ দিয়েছিলাম । রাজভবনের বাইরে অন্যত্র আমার নিয়োগের প্রস্তাব অবশ্য রাজভবনের এই ঘটনাগুলোর আগে থেকেই রাজ্য সরকারের বিবেচনাধীন ছিল ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমার ক্ষেত্রে ঘটা ঘটনা দুটির বেশ কিছুদিন আগে ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৯২ থেকে আমার ৫৭ দিনের জন্য ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু আমার অনুপস্থিতিতে রাজভবনের কাজকর্মের অসুবিধা হবে এই যুক্তিতে সচিবের অনুরোধে ও রাজ্যপালের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে ছুটি স্থগিত রাখতে রাজী হই । অনুমোদনলিপি সহ আমার ছুটির মূল দরখাস্তের প্রতিলিপি নিম্নলিখিত লিঙ্কে এপেন্ডিক্স পাতার শেষে রাজভবন বিষয়ক অংশে দেয়া হয়েছে । A Tale of a Sylheti Refugee - X. Appendix (google.com)
তদানীন্তন সচিবের নেতৃত্বাধীন রাজভবনের কাজের পরিবেশে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না । এই সচিব রাজ্যপাল অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ ছিলেন । রাজভবন প্রশাসনে এর গুরুতর প্রভাব পড়ছিল । তাই আমি লম্বা ছুটি নিতে চেয়েছিলাম যেন ছুটি শেষে আমাকে আর এই পদে ফিরে আসতে না হয় । কিন্তু রাজ্যপালের ইচ্ছায় আমাকে ছুটি স্থগিত রাখতে হয়েছিল, বিশেষতঃ ছুটি যখন অধিকার হিসাবে স্বীকৃত নয় ।
যে সকল রাজ্যপালের অধীনে আমি কাজ করেছি
রাজভবনে একাধিক রাজ্যপালের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল । প্রথমজন ছিলেন টি ভি রাজেশ্বর, যিনি আমায় রাজভবনে নিয়ে এসেছিলেন । আমার আসার পর তিনি অবশ্য অতি অল্প দিনই ছিলেন । মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় উনি চলে যান । মিঃ রাজেশ্বর রাজভবনের অতিথি কক্ষগুলোর বৃটিশ আমলের নাম প্রিন্স অব ওয়েলস, এণ্ডারসন, ওয়েলসলি ইত্যাদি বদলে ভারতের মহান নদনদী গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদির নামে নামাঙ্কিত করেছিলেন । পরে ওঁর উত্তরসূরী প্রোঃ এস. নুরুল হাসান ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে কক্ষগুলির পুরণো নামগুলি ফিরিয়ে এনেছিলেন । মিঃ রাজেশ্বর একজন যোগ্য প্রশাসক ছিলেন । ডান দিকের প্যানেলে রাজভবন কর্মীদের আয়োজিত মিঃ টি ভি রাজেশ্বরের বিদায়ী টি-পার্টিতে ওঁর সাথে আমার আলাপচারিতার চিত্র।
মিঃ রাজেশ্বর ১৯৮৯ সালের ২০শে মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন । ২০১৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী তিনি দেহত্যাগ করেন ।
তিনি অরুণাচল প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর, সিকিমের রাজ্যপাল এবং অবশেষে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হিসাবেও কাজ করেছেন ।
তিনি আদিতে ভারতীয় পুলিশ সেবার (আইপিএস) সদস্য ছিলেন । ১৯৮৩ সালে অরুণাচল প্রদেশের লেঃ গভর্ণর হওয়ার পূর্বে ভারতের গুপ্তবার্তা সংস্থার প্রধান (Chief of Intelligence Bureau) ছিলেন । ২০১২ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ উপাধি লাভ করেন ।
পরবর্তী রাজ্যপাল হলেন প্রোঃ সৈয়দ নুরুল হাসান যিনি ওড়িষ্যার রাজ্যপাল হিসাবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নিলেন । ডানদিকের শিরোনামযুক্ত ফটো প্যানেলে প্রোঃ হাসানকে কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নিকট পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে শপথ নিতে দেখা যাচ্ছে। প্রোঃ হাসানের সঙ্গে এসেছিলেন ওঁর বোন রিজুয়ানুল হাসান যাঁকে সকলে "বাজি" অর্থাৎ "বোন বা দিদি" বলে ডাকত । প্রোঃ হাসান বিপত্নীক ছিলেন । তাই সরকারী নির্দেশে বাজি হয়েছিলেন সরকারী আতিথ্যকর্ত্রী (Official Hostess)। প্রোঃ হাসানের এক ছেলে ও এক মেয়েকে আমি দেখেছি । ছেলে খুব সম্ভবতঃ বাঙ্গালোরে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের প্রফেসার ছিলেন । কন্যা আমেরিকায় ব্যবসা করতেন । ওঁর দুটো শিশুকন্যা ছিল, ভারী মিস্টি । ওঁরা সকলেই অবশ্য দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন । প্রোঃ হাসান একজন প্রথিতযশা ঐতিহাসিক ও একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন । বিভিন্ন বিষয়ে ওঁর পাণ্ডিত্যও সর্বজনবিদিত ছিল । ওঁর সঙ্গে দুই ট্রাকভর্তি বইপত্র এসেছিল যার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজভবনে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়েছিল ।
প্রোঃ হাসান রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিমাসে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের মহানির্দেশকের সঙ্গে মিটিং করতেন । জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী । তবুও এই নিয়ে রাজভবন ও রাইটার্স বিল্ডিং এর মধ্যে কোন মতবিরোধ হয়েছিল বলে জানা নেই । এ ছাড়া পূর্বে উল্লিখিত সংখ্যালঘু বিষয়ক কোন সমস্যা দেখা দিলে প্রোঃ হাসান ফোনে বা ডেকে পাঠিয়ে মুখ্যসচিবের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ নিতেন । তখনকার দিনে অবশ্য টুইট চালাচালির ব্যবস্থাপনা ছিল না ।
বিভিন্ন ধরণের অসুখ থাকায় প্রোঃ হাসানের গ্রহণযোগ্য খাদ্য সম্পর্কে নানা বিধিনিষেধ ছিল । কিন্তু তিনি লোকজনকে আদর আপ্যায়ন করতে ভালবাসতেন । প্রায়শঃ তিনি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের(২) মধ্যাহ্নভোজে বা নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানাতেন । খাদ্য তালিকা (মেনু) নিজেই ডিক্টেট করতেন । ইয়াকুব নামে ওঁর একজন ব্যক্তিগত পাচক ছিল । ইয়াকুব চমৎকার বিরিয়ানী, স্মোকড ইলিশ, টাইগার চিংড়ি ভাজা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ থালি রান্না করতে পারত ।
১৯৯৩ সালের ১২ই জুলাই রাজ্যপাল পদে কর্মরত অবস্থায় তিনি কোলকাতার এস. এস. কে. এম (SSKM) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । আমি তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নগর উন্নয়ন দপ্তরে উপসচিব হিসাবে কর্মরত ।
প্রোঃ হাসান প্রথম দফায় ১২ই আগস্ট ১৯৮৬ থেকে ২০শে মার্চ ১৯৮৯ এবং পরবর্তী দফায় ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯০ থেকে ১২ই জুলাই ১৯৯৩ (মৃত্যু) পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন।
প্রোঃ সৈয়দ নুরুল হাসান (২৬শে ডিসেম্বর ১৯২১ - ১২ই জুলাই ১৯৯৩) একজন ঐতিহাসিক ও ভারত সরকারের বরিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা,সমাজ কল্যাণও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন (১৯৭১ - ১৯৭৭) । রাজ্যপাল পদে নিয়োগের পূর্বে তিনি তৎকালীন রাশিয়ায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন (১৯৮৩ - ১৯৮৬) । তিনি একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন ।
নুরুল হাসান এডুকেশন ফাউন্ডেশনটি ওঁর নামে । কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রোফেসরশিপ চেয়ার "দি নুরুল হাসান চেয়ার" টিও ওঁরই নামে ।
চিকিৎসার জন্য প্রোঃ নুরুল হাসান দেশের বাইরে থাকলে সন্নিহিত রাজ্যের রাজ্যপাল এই রাজ্যের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকতেন । এইরূপ পরিস্থিতিতে একবার দায়িত্বে ছিলেন বিহারের রাজ্যপাল এ আর কিদোয়াই; আরেকবার ত্রিপুরার রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডি । ডান দিকের প্যানেলে মিঃ রেড্ডির পশ্চিমবঙ্গের গভর্ণর-ডেজিগনেট হিসাবে রাজভবনে অভ্যর্থনার একটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । সেটা ছিল ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাস ।
রাজ্যপালের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকার পূর্ণ মেয়াদ মিঃ রেড্ডি কোলকাতা রাজভবনে ছিলেন । ফিরে যাওয়ার সময় মিঃ ও মিসেস রেড্ডিকে পৌঁছে দিতে আমি আগরতলা গিয়েছিলাম । ওখানে রাজ্যপালের অতিথি হিসাবে আমি দিন কয়েক রাজভবনে ছিলাম । মিসেস রেড্ডি স্বহস্তে দু-একটি পদ রান্না করতেন । উনি অত্যন্ত অতিথিপরায়ণা ছিলেন । আমি যে ক'দিন আগরতলায় ছিলাম মিসেস রেড্ডি খাওয়ার সময় রাজ্যপাল ও আমাকে ডেকে একসাথে বসিয়ে নিজে খাওয়ার পরিবেশন করেছেন । মিসেস রেড্ডি একজন মাতৃস্বভাবা রমণী ছিলেন ।
মিসেস রেড্ডি পেশায় একজন ডাক্তার ছিলেন, আগরতলায় থাকার সময় বিনা পয়সায় দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা করতেন । তিনি ময়ুরের আকারের বাঁশের তৈরী একটি টেবিল ল্যাম্প আমাকে উপহার দিয়েছিলেন । ল্যাম্পটির একটি আলোকচিত্র ডান দিকের প্যানেলে প্রদর্শিত হয়েছে । দীর্ঘদিনের আবহাওয়ার প্রভাবে এর ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে গেছে । ত্রিপুরার কারিগররা বাঁশের সুক্ষ্ম কাজের জন্য খ্যাত । বাঁশের তৈরী ময়ুরটি ওদের পারদর্শিতার নিদর্শন ।
আমার বিবেচনায় শ্রী ও শ্রীমতি রেড্ডি উভয়েই খুব ভাল মানুষ ছিলেন, আন্তরিক, উষ্ণ, ও ধার্মিক । যতদূর দেখেছি, ওঁরা রক্ষণশীল ছিলেন বলে মনে হয়েছে । ওঁদের একমাত্র পুত্র একজন প্রখ্যাত ডাক্তার ।
প্রোঃ নুরুল হাসানের মৃত্যুর পর শ্রীরেড্ডি ১৪ই আগস্ট ১৯৯৩ থেকে ২৭শে এপ্রিল ১৯৯৮ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যপাল ছিলেন । ২০০২ সালের ৪ঠা মার্চ তিনি দেহত্যাগ করেন ।
কে ভি রঘুনাথ রেড্ডি (৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯২৪ - ৪ঠা মার্চ ২০০২) একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন । তিনি তদানীন্তন অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে তিনবার রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন, ১৯৬২-৬৮, ১৯৬৮-৭৪, ১৯৭৪-৮০ ।
রাজ্যপাল টি ভি রাজেশ্বরের বিদায়ী চা-চক্রে রাজ্যপালের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমি
রাজভবনে রাজ্যপাল টি ভি রাজেশ্বরের বিদায় সম্বর্ধনা । রাজভবনের কর্মচারী ও আধিকারিকদের পক্ষ থেকে রাজ্যপালকে ফুলের তোড়া উপহার ।
রাজ্যপালের দায়িত্ব নিতে আসা প্রোঃ নুরুল হাসানকে রাজভবনে অভ্যর্থনা ।
রাজভবনের থ্রোন রুমে প্রোঃ সৈয়দ নরুল হাসানের রাজ্যপাল হিসাবে শপথ নেয়ার দৃশ্য । শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ।
এই টেবিল ল্যাম্পটি মিসেস রেড্ডি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন ।
গভর্ণর-ডেজিগনেট মিঃ কে ভি রঘুনাথ রেড্ডিকে রাজভবনে স্বাগত জানানো হচ্ছে ।
রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে সস্ত্রীক কে ভি রঘুনাথ রেড্ডির রাজভবনে প্রবেশের দৃশ্য ।
শপথ গ্রহণের পর সচিব, উপসচিব ও সহসচিবের সঙ্গে রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডির প্রথম বৈঠক ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ
রাজভবনের কার্যকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক ব্যক্তিত্বকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল । এঁদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রপতি রামস্বামী ভেঙ্কটরমন, প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং এবং ওঁর স্ত্রী সীতাদেবী, প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর, মহামান্য নেলসন মেণ্ডেলা, মহামান্য ইয়াসের আরাফত, কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রপতি মিঃ হুন সেন, লণ্ডনের মেয়র ও অন্যান্য । ১৯৯০-৯১ সালে ইয়াসের আরাফতের সচিবরূপে সূহা দায়ুদ তাওইলকেও দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল । ইনি-ই সেই তাওইল যিনি ইয়াসের আরাফতকে বিয়ে করেছিলেন । তিনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন ।
নিচের প্রথম ছবিটি মহামান্য নেলসন মেণ্ডেলার অটোগ্রাফের। মেণ্ডেলা ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে কোলকাতা পরিদর্শনে এসে যখন রাজভবনে অবস্থান করছিলেন সেই সময়ে এটি নেয়া ।
এই অটোগ্রাফটির নিচে ও পাশে পরিদর্শনকারী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে ক্যামেরায় ধরা কতকগুলি স্মরণীয় মুহূর্ত ।
মহামান্য নেলসন মেণ্ডেলাকে রাজভবনে স্বাগত জানাবার মুহূর্ত । ছবিতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যসচিব টি সি দত্তও রয়েছেন ।
ভারতের রাষ্ট্রপতির সফর
আমার রাজভবনের কার্যকালে রাষ্ট্রপতি রামস্বামী ভেঙ্কটরমন একাধিকবার কোলকাতা সফরে এসেছেন । রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের আধিকারিকবৃন্দ ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এক বিস্তৃত পরিপার্শ্ব থাকত । একবার রাজ্যপালের শিবিরকালে রাষ্ট্রপতি দার্জিলিং ভ্রমণে এসেছিলেন । রাজ্যপাল দার্জিলিং শিবিরে থাকলেও রাজভবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী বাস্তুকার সাধারণতঃ দার্জিলিং যান না । দার্জিলিং রাজভবনের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সহকারী বাস্তুকারই রাজভবনের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেন । কিন্তু সেবার রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী শ্রীমতি ভেঙ্কটরমন রাজভবনে যে অতিথি কক্ষে তিনি ছিলেন তার টয়লেটে রাজ্যপালের স্যুটের (suite) টয়লেট-ফ্লাশের অনুরূপ ফ্লাশ বসিয়ে দিতে বলেন । কোলকাতা থেকে নির্বাহী বাস্তুকারকে ডেকে পাঠানো হয় । বাস্তুকার মহাশয় মহা ফাঁঁপরে পড়েন । ঐ রকম ফ্লাশ স্থানীয় ভাবে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না । অনেক কষ্টে তিনি যোগাড় করেছিলেন, কোথা থেকে কি ভাবে জানি না । তবে এর দ্বারা তিনি সকলের মান মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন ।
মহামান্য নেলসন মেণ্ডেলার হস্তাক্ষর ।
রাষ্ট্রপতি রামস্বামী ভেঙ্কটরমনকে রাজভবনে তাঁর নির্দিষ্ট স্যুটে নিয়ে যাওয়ার পথে ।
প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রপতি ইয়াসের আরাফত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জর্জ ফারনাণ্ডেজের সঙ্গে রাজ্যপালের ভোজসভায় যোগ দিতে রাজভবনে প্রবেশ করছেন ।
প্রধানমন্ত্রী শ্রী চন্দ্রশেখরকে রাজভবনে অভ্যর্থনাকালে ।
রাজভবনে অনুষ্ঠেয় যমুনালাল বাজাজ পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর ও রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডিকে নিয়ে যাওয়ার পথে ।
লণ্ডনের মেয়রের সম্মানে রাজ্যপালের প্রদত্ত ভোজসভার একটি চিত্র ।
রাজ্যপালের সহকারী সচিব অনন্ত বেরা রাজ্যপালের বোন মাননীয়া রিজুয়ানুল হাসানকে রাজভবনে স্বাগত জানাচ্ছেন ।
দার্জিলিং এর রাজভবন ও রাজ্যপালের শিবির
দার্জিলিংএও একটি রাজভবন আছে যেখানে রাজ্যপাল গ্রীষ্মের কিয়দংশ ও শীতের প্রাক্কালে কিয়ৎকাল অবস্থান করেন । ঐ রাজভবন এলাকায় সচিব ও উপসচিবের নির্দিষ্ট সরকারী বাসভবন, অতিথি নিবাস ও কর্মচারীদের বাসস্থান রয়েছে । রাজ্যপালের দার্জিলিং শিবিরে অবস্থান কালে কোলকাতা রাজভবনের অধিকাংশ অফিসার ও কর্মচারীকে দার্জিলিং থাকতে হত । রাজভবনের গাড়ীসহ এই বিপুল সংখ্যক লোকলস্কর দার্জিলিং নিয়ে যাওয়ার ও ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব উপসচিবের উপর ন্যস্ত ছিল। সংশ্লিষ্ট উপসচিব হিসাবে গৃহস্থালীর কাজকর্মের তত্ত্বাবধানে ও সমন্বয়ের জন্য আমাকেও ব্যক্তিগতভাবে ঐ সময় দার্জিলিং উপস্থিত থাকতে হত ।
রাজ্যপালের দার্জিলিং ক্যাম্পে থাকাকালীন ভারতীয় ডাক বিভাগ প্রতিদিন একটি মেল ব্যাগ কোলকাতা রাজভবন থেকে দার্জিলিং রাজভবন ও বিপরীতক্রমে দার্জিলিং রাজভবন থেকে কোলকাতা রাজভবনে আনা-নেয়া করত ।
দার্জিলিং রাজভবন
দার্জিলিং রাজভবনের প্রবেশপথ ।
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর হত্যা: মধ্যরাতে খবর এল দার্জিলিং রাজভবনে
১৯৯১ সালের গ্রীষ্মের শিবিরে রাজ্যপাল যখন দার্জিলিং ছিলেন সেই সময় শ্রীপেরামবুদারে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হন । ঐ সালের ২১শে মে রাজ্যপালের গ্রীষ্মকালীন শিবিরে আমি তখন দার্জিলিংএ । মধ্যরাতে কোলকাতা রাজভবনের কর্মচারীর মাধ্যমে সেই ভয়ঙ্কর সংবাদ পেলাম, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন । বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু সরকারী খবর মানতেই হবে । রাজ্যপালের ঘুম ভাঙিয়ে এই দুঃসংবাদটি তাঁকে দেয়া হল । পরদিন সকালের বিমানে রাজ্যপাল বাগডোগরা হয়ে দিল্লী চলে গেলেন । প্রধানমন্ত্রীর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি ফিরেছিলেন ।
১৯৯১ সালে টয়ট্রেণে প্রমোদভ্রমনের দৃশ্য
১৯৯১ সালের গ্রীষ্মকালীন দার্জিলিং শিবিরের টুকিটাকি
১৯৯১ সালের দার্জিলিং শিবিরে আমি আমার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম । সেবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলিকপ্টার রাজ্যপালকে পরের দিন বাগডোগরা থেকে দার্জিলিং নিয়ে যাওয়ার পরীক্ষামূলক উড়ানে(৩) গিয়েছিল । ঐ হেলিকপ্টারে আমি সপরিবারে দার্জিলিং গিয়েছিলাম । আমরা কোলকাতার নিকটস্থ ব্যারাকপুর এয়ারস্ট্রিপ থেকে যাত্রা শুরু করে মালদা ও বাগডোগরায় বিরতি নিয়ে দার্জিলিং এর মেলে অবতরণ করি ।
ঐ শিবিরকালে আমরা একবার মিরিক ভ্রমণেও গিয়েছিলাম । গ্রীষ্মকালীন শিবির সমাপ্তির পূর্বে রাজ্যপালের ইচ্ছায় রাজভবন কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে একটি সম্পূর্ণ টয় ট্রেণে দার্জিলিং থেকে বতাসিয়া লুপ(৪) পর্যন্ত একটি প্রমোদ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । রাজ্যপাল প্রোঃ সৈয়দ নুরুল হাসান নিজেও সঙ্গে ছিলেন ।
নিম্নে ক্যামেরায় ধরে রাখা ঐ শিবিরকালের কয়েকটি স্মরণীয় মুহূর্তের দূশ্য ।
দার্জিলিং এর পথে মালদা হ্যালিপেডে ।
দার্জিলিংএ উপসচিবের বাসভবনে ।
মিরিক হ্রদে নৌকাবিহার, মিরিক, দার্জিলিং ।
মায়ের মৃত্যু: ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯০
রাজভবনে কর্মরত থাকাকালীন ১৯৯০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর আমি আমার মাকে হারাই । সেই সময় মা কোলকাতায় আমার কাছে ছিলেন । কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য উনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন আমি ওঁর পাশে থাকতে পারি নি । আমি সেই সময় দার্জিলিং গিয়েছিলাম রাজ্যপালের আসন্ন প্রাক-শীতকালীন শিবিরের ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে । ফেরার পথে রেলের আভ্যন্তরীণ সংবাদ আদান-প্রদান ব্যবস্থার মাধ্যমে আমি ট্রেণে ওঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম । কোলকাতা ফিরে পরদিন ওঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করি । অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্থা করার পূর্ব পর্যন্ত মৃতদেহ পিস হেভেন নামক শবাগারে সংরক্ষিত ছিল । অন্ত্যেষ্টি কোলকাতার নিমতলা ঘাট মহাশ্মশানে ইলেক্ট্রিক চুল্লিতে সম্পন্ন হয়েছিল ।
নিজের ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির স্যুইচে পৌঁছুতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার দরুণ ঊর্বাস্থি (ফিমার) ভেঙ্গে মা কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন । এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ণ ওয়ার্ডে দিন পনেরো হাড় ভাঙ্গার চিকিৎসা হয়েছিল । ইতিমধ্যে একবার ব্রেইন স্ট্রোকের মত হয় । এরপর ডাক্তাররা জানালেন এই অবস্থায় হাড়ের চিকিৎসা সম্ভব নয় এবং সুস্থতার কোন সম্ভাবনা নেই । তখন মাকে বাড়ী নিয়ে এসেছিলাম । বাড়ীতে মা আমার স্ত্রীর প্রযত্নে এবং আমাদের আবাসনের সহ বাসিন্দা আমার এক বন্ধু ডাক্তারের তত্বাবধানে ছিলেন ।
মা সরোজনলিনী দাস ।
জন্ম: জানা নেই, মৃত্যু: ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ ।
জীবনের অন্তিম পর্যায়ে মৃত্যুর পূর্বে মা কিছুদিন অচেতন অবস্থায় ছিলেন । ঐ সময় ওঁর শরীরে শয্যাক্ষতও (Bed sores) দেখা দিয়েছিল । সেই সময় আমার স্ত্রী নিজেই ওঁর সেবা শুশ্রুষা করেছে । যত্ন ও অন্তরের ভালবাসা দিয়ে সে ওঁর সেবাযত্ন করেছিল । ওঁকে রাইল্স টিউব দিয়ে খাওয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করানো, পোষাক পরিবর্তন করা ইত্যাদি সবই ওই করত । এমনকি নির্বিদ্বিধায় ওঁর মলমূত্র পর্যন্ত পরিষ্কারকরেছে । হৃদয়ে অকৃত্রিম অনুকম্পা না থাকলে এই কাজগুলি কেউ করতে পারে না বিশেষতঃ যখন এই জাতীয় সেবা (হোক না সে আন্তরিকতাশূন্য) অর্থের বিনিময়ে লভ্য । আমার স্ত্রী অমায়িক ও কোমলহৃদয়া যদিও চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব রয়েছে এবং মেয়েদের সম্বন্ধে স্নেহান্ধ ।
পূর্বেই বলেছি, মার মৃত্যুকালে আমি অন্যত্র ছিলাম । আমার ফেরা পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমার কর্মস্থলের সহকর্মীদের ও আবাসনের সহবাসিন্দাদের সহযোগিতায় মার মৃতদেহ শবাগারে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে যাবতীয় মৃত্যু পরবর্তী ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন করেছিল ।
রাজ্যপালের শোকপ্রকাশ
মায়ের মৃত্যুকালে রাজ্যপাল দিল্লি ছিলেন । সেখান থেকে তিনি শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন । রাজ্যপালের বোন রিজুয়ানুল হাসান আমার ফ্ল্যাটে মায়ের শ্রাদ্ধে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ।
দুই জায়গায় মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান
মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের স্থান নিয়ে পরিবারের মধ্যে মতানৈক্য হয়েছিল । দাদা জ্যেষ্ঠপুত্র বলে ওর বাসভূমি শিলচরে শ্রাদ্ধ করতে চেয়েছিল । দাদার শ্রাদ্ধ করা নিয়ে আমার কোন আপত্তির প্রশ্নই ছিল না, কিন্ত আমার আপত্তি ছিল স্থান নির্বাচন নিয়ে । দাদা শিলচরে শ্রাদ্ধ করতে চেয়ে আমায় ওখানে যোগ দিতে বলে । কিন্তু মা আমার এখানে কোলকাতায় মারা গিয়েছিলেন এবং এখানেই ওঁকে দাহ করা হয়েছিল । আমার স্ত্রীর আত্মীয় স্বজন, আমার বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের অনেকে শ্মশান যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন । সামাজিক রীতি অনুযায়ী শ্মশানবন্ধু নামে পরিচিত এই শ্মশানযাত্রার সঙ্গীদের শ্রাদ্ধবাসরে আলাদা ভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয় । তাছাড়া মা আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকায় আমার বন্ধুবান্ধব ও তাদের পরিবারের অনেকের সাথে মায়ের পরিচিতি গড়ে উঠেছিল । কোনভাবেই এই বিষয়গুলি উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । দাদা নানাভাবে আমাকে শিলচরে শ্রাদ্ধের জন্য রাজী করাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু উল্লিখিত বাধ্যবাদকতায় আমি রাজী হতে পারি নি । আমি দাদাকে আমার এখানে কোলকাতায় শ্রাদ্ধ করতে বললাম, দাদা রাজী হল না । ফলে দুই জায়গাতেই শ্রাদ্ধ হল, কোলকাতায় আমার ফ্ল্যাটে আর শিলচরে দাদার বাড়ীতে ।
রাজভবনে বিদ্যুৎবিভ্রাট ও পরবর্তী বিষয়াদি
১৯৯১ সালে একবার ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি. এন. সেশন প্রাক-নির্বাচন সফরে এ রাজ্যে এসে রাজভবনে অবস্থান করছিলেন । অভিনেত্রী-পরিচালক অপর্ণা সেনের নেতৃত্বে একদল তারকা শ্রীসেশনের সঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা করতে রাজভবনের ইয়েলো ড্রয়িং রুমে(৫) অপেক্ষা করছিলেন । শ্রীসেশন রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন । এমন সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়, সারা রাজভবন অন্ধকারে ডুবে যায় । আমার দু বছরকাল রাজভবনে অবস্থানকালে এমন ঘটনা আমি দেখিনি বা পূর্বে ঘটেছে বলেও শুনিনি, এইটি একমাত্র উদাহরণ । তিনটি আলাদা আলাদা গ্রীডে রাজভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় । কোন একটি গ্রীড অকেজো হলে বাকী দুটি গ্রীডের যে কোন একটি অকেজো গ্রীডটির স্থান নেয় । তিনটি গ্রীডই একসাথে অকেজো হয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজভবনের ইতিহাসে এই প্রথম । প্রায় আধ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না । গরমে অপর্ণা সেন অসুস্থ বোধ করছিলেন । ওঁকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়েছিল ।
পরে শ্রীসেশনকে ওর নির্দিষ্ট কক্ষে নিয়ে যাওয়ার সময় উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন রাজভবনে জেনেরেটার কি নেই । আমি ওঁকে জেনারেটারের প্রয়োজন না হওয়ার কারণ বিশদে বিশ্লেষণ করেছিলাম । অবশ্য এই ঘটনার পরই সিদ্ধান্ত হয় দুটি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ক্যাপটিভ জেনারেটর বসানো হবে । আমার কার্যকালেই জেনারেটর দুটি বসানো হয়েছিল । তবে আমার অবস্থানকালের মধ্যে ওগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন হয় নি । পরবর্তীকালেও এগুলোর ব্যবহার প্রয়োজনীয় হয়েছিল বলে মনে হয় না।
রাজ্যপালের এডিসি ও তাদের নিয়ে সমস্যা
রাজভবনে রাজ্যপালের এডিসিদের ক্রিয়াকলাপ গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছিল । এর জন্য মূলতঃ দায়ী ছিল তদানীন্তন সচিবের নিজেকে প্রয়োগ করার ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপারগতা । রাজ্যপালের সান্নিধ্যে থাকায় ও ছায়াসঙ্গীস্বরূপ হওয়ায় তদানীন্তন এডিসিদের ধারণা হয়েছিল যে ওরা কারো নিয়ন্ত্রণে নন, নিয়ম ও পদ্ধতিকে উপেক্ষা করে ওরা যা খুশী করতে পারেন । আমি যখন সরকারী নিয়মাবলী প্রয়োগ করতে শুরু করলাম ও পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন নিয়ে এলাম তখন তার আঁচ এদের গায়ে লাগল । এরা বিভিন্ন সমস্যা, যা সময় বিশেষে প্রায় সঙ্কটে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলেন । নৌ বাহিনীর একজন অফিসার এডিসি হয়ে এলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয় । এই অফিসারের আচরণ ছিল রূঢ় ও অশোভন, যা রাজভবনের কর্মচারী মহলে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল ।এডিসিরা এবার নিজেদের অনুকূলে লিখিতভাবে বিভিন্ন দাবী দাওয়া পেশ করলেন, যা ছিল রাজভবনের ইতিহাসে অভূতপূর্ব । দাবী-দাওয়ার মধ্যে ছিল নিজেদের জন্য আলাদা টাইপিস্ট (যা আইনতঃ কোন আধিকারিক পাওয়ার হকদার নন) চাওয়া থেকে শুরু করে ওদের বাসস্থানের আসবাবপত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গৃহস্থালী অফিসের কর্মচারী দ্বারা নিয়মিত পরিদর্শন । এরূপ বিশেষ ব্যবস্থার কোন বিধান না থাকায় দাবীগুলো অবশ্য গৃহীত হয়নি । তবে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য হিসাবে ও প্রশাসনিক কর্তব্যরহিত আনুষ্ঠানিক পদে নিযুক্ত এই আধিকারিকদের এইরূপ দাবীপত্র পেশ কতটা আইনানুগ ছিল সে প্রশ্ন থেকেই গেছে ।
কালক্রমে একজন এডিসি সরকারী নগদ অর্থ রাজ্যপালের কাজে ব্যয় করার পর তার প্রমাণক দাখিল করতে অস্বীকার করলেন । রাজ্যপাল শহরের বাইরে গেলে জরুরী কাজে ব্যবহারের জন্য সঙ্গী এডিসির হাতে নগদ অর্থ দেয়া হয় । সরকারী নিয়ম অনুযায়ী অগ্রিম থেকে ব্য়য়িত অর্থ পরবর্তী কালে ব্য়য়ের প্রমাণক সহ হিসাবের অঙ্গীভূত করতে হয় । কথিত ক্ষেত্রে রাজ্যপাল দিল্লী যাওয়ার সময় প্রথা অনুযায়ী সঙ্গী এডিসির (নেভি) হাতে নগদ অর্থ দেয়া হয়েছিল । দিল্লীতে থাকাকলীন রাজ্যপালের প্রয়োজনে উক্ত অর্থ থেকে কিছু অর্থ ব্যয়িত হয় । পরে ঐ অর্থের হিসাব তৈরীর সময় একটি ক্ষেত্রে উক্ত এডিসি প্রমাণক দাখিল করতে অস্বীকার করেন । এই একই এডিসি একবার এক দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যপালের সফরসঙ্গী হওয়ার বিষয়ে এক গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছিলেন ।
অপর এডিসি দাবী করলেন উপসচিবের কার্যালয়ের কর্মচারীরা সরাসরি এডিসিদের কাছ থেকে ওদের সম্পর্কিত বিষয়ে আদেশ গ্রহণ করুন । এডিসিরা প্রশাসনিক কর্তব্যরহিত আনুষ্ঠানিক পদে নিযুক্ত; প্রশাসনিক নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতাবিহীন । আনুক্রমিক বিন্যাস পদ্ধতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এই প্রস্তাব প্রশাসনিক নিয়ম-নীতিকে বিসর্জন দেয়ার সমতুল্য ছিল । এর অন্যান্য গভীর তাৎপর্যও ছিল । এই সকল ঘটনা সময় সময় সচিবকে, যিনি রাজ্যপালের সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা ত বটেই এডিসিদেরও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ছিলেন, জানানো হয়েছিল । সচিব এডিসিদের এটা উপলব্ধি করাতে ব্যর্থ হন যে ওদেরকে সরকারী আইন কানুন মেনে চলতে হবে এবং যা ইচ্ছে করা যাবে না । কোনরূপ প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এডিসিরা আরো সাহসী হয়ে উঠলেন এবং সমস্ত শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে অপরাধীসুলভ আচরণ করতে লাগলেন ।
আর্মি এডিসির অপরাধীসুলভ আচরণ: ৩রা জানুয়ারী ১৯৯২
১৯৯২ সালের ৩রা জানুয়ারী আর্মি এডিসি অফিসের সময় আমার সেক্সন অফিসার নির্মল চ্যাটার্জিকে অফিস ঘরের মধ্যে মারমুখী হয়ে ভীতিপ্রদর্শন করেন । নির্মল চ্যাটার্জি আইনানুগ ভাবেই ঐ এডিসির কাছ থেকে সরাসরি আদেশ নিতে অস্বীকার করেছিলেন । এই নিন্দনীয় ঘটনায় সঙ্কট তৈরী হয়েছিল । কর্মচারীরা ধর্মঘট ডাকতে চাইছিল । কিন্তু ঐ এডিসির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক বা অন্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি । সচিব মহোদয়ের নিকট তোষণের নীতিই (Policy of appeasement) অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল । আমি চাইছিলাম বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হোক, কিন্তু সচিব রাজী হলেন না । ঘটনাটি ৫ই জানুয়ারীর টেলিগ্রাফ কাগজেও ছাপা হয়েছিল ।
বরিষ্ঠ আর্মি অফিসারদের সঙ্গে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা
আমার চাকুরী জীবনের প্রথমদিকে আমি দু-একজন মেজর পদমর্যাদার আর্মি অফিসারের সঙ্গে কাজ করেছি । তাঁরা ছিলেন শালীন, হাস্যময় ও মধুরস্বভাব সম্পন্ন । আমার কখনও মনে হয়নি ওঁদের চেয়ে পদমর্যাদায় এক স্তর নিম্নের প্রতিরক্ষা কর্মীদের কারো ব্যবহার রাজভবনে এডিসি পদে নিযুক্ত আর্মি বা নেভি অফিসারের মত হতে পারে । রাজভবনে আর্মি এডিসি ছিলেন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার আর নেভি এডিসি ছিলেন ল্যাফটানেণ্ট পদমর্যাদার । রাজভবনে এই এডিসিরা যে প্রশ্রয় পেতেন বা যে উদারতার সঙ্গে ওদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হত সম্ভবতঃ তাই ওদেরকে উদ্ধত ও আত্মম্ভরী করেছিল ।
ফিল্ডে ওরা যে কঠিন অবস্থায় বাস করেন ও দেশের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন তার প্রতি পূর্ণ কৃতজ্ঞতা জানিয়েও আমাকে বলতে হচ্ছে যে সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে ওদের, অন্ততঃ তখনকার দুজনের, প্রশিক্ষণের অভাব ছিল ।
এদের পূর্ববর্তী দুজন এডিসিকে আমি কিছুদিনের জন্য পেয়েছিলাম । সেই দুজন অনেক বেশী পরিপক্ব ছিলেন ।
দ্বিতীয় অপরাধ, অধিকতর গুরুতর: এবার অপরাধী নেভি এডিসি, ২২ শে জানুয়ারী, ১৯৯২
৩রা জানুয়ারীর অফিসঘরে কর্মরত আধিকারিককে মারমুখী হয়ে ভয় দেখানোর ঘটনার পরেও উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দোষী এডিসির বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই এডিসিরা আরো উগ্র ও দুর্বিনীত হতে উৎসাহিত হল। অবশেষে নেভি এডিসি ভারসাম্য হারিয়ে ও রাজ্যপালের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে পর পর ২২ ও ২৩ জানুয়ারী রাতে মদ্যপ অবস্থায় আমার বাড়ীতে চড়াও হয় ব্যক্তিগতস্তরে ওর তথাকথিত ক্ষোভ নিস্পত্তি করতে ।
২২ জানুয়ারী রাত ১১টা নাগাদ ঐ এডিসি সম্পূর্ণ মদ্যপ অবস্থায় আমার ফ্ল্যাটের (মিণ্টো পার্ক হাউসিং এস্টেট, ২৪৭/১ লোয়ার সার্কুলার রোড) দরজার ঘণ্টি অবিরাম বাজাতে থাকেন । আমি দরওয়াজা খুলে বাইরে এলে উনি চীৎকার করে দেশী-বিদেশী ভাষা মিলিয়ে আমায় গালিগালাজ করতে শুরু করেন ও একই সঙ্গে ফ্ল্যাটের খোলা দরজার উপর জোরে জোরে লাথির পর লাথি মারতে থাকেন । উনি একটি মিথ্যা অভিযোগ খাড়া করেন যে আমার নির্দেশে ওর গর্ভবতী স্ত্রীকে রাজভবনের গাড়ী ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি । এই অভিযোগ শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম; এমন কোন ঘটনা ঘটেছে বলেই আমার জানা ছিল না, আমার নির্দেশ দেয়া ত দূরের কথা । আমি ওকে সেই কথাই বোঝাবার চেষ্টা করি । উনি এই সমস্ত কিছু বোঝার মত অবস্থায়ই ছিলেন না । উনি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন । সুজনরা ত বলেইছেন, "দুর্জনের ছলের অভাব হয় না ।" যাহোক, গোলমালের আওয়াজ পেয়ে আমাদের আবাসনের কয়েকজন বরিষ্ঠ আইপিএস অফিসার সহ অনেকে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন । তা দেখে সম্ভবতঃ এডিসি মহাশয়ের বোধোদয় হয় । উনি তখন চলে যান । যাওয়ার সময় শাসিয়ে যান, "আমার কি হবে তা নিয়ে আমি ভাবি না, তবে আপনাকে আমি দেখে নেব ।" আমাদের আবাসনে তথা আমার ফ্লাটে অসৎ উদ্দেশ্যে অনধিকার প্রবেশ বা প্রবেশের চেষ্টা করে এবং হট্টগোল সৃষ্টি করে ঐ এডিসি শুধু আমার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করেন নি, ইচ্ছাকৃত ভাবে আবাসনের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও শান্তি ও নিদ্রার ব্যঘাত ঘটিয়েছেন । আমাকে ভীতি প্রদর্শনও করেছেন । এই সব খাতেই তিনি ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারামতে অপরাধী হিসাবে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য ।
নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এডিসির সাজানো ঘটনা যদি সত্যিও হত, সেক্ষেত্রেও এভাবে উর্ধতন বা অধস্তন কোন অফিসার বা কর্মচারীর বাড়িতে চড়াও হয়ে শাসানো তার অধিকারের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকত না । যদি ওর কোন সত্যিকারের অভিযোগ থেকেও থাকত সেক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে ঘটনাকালে আমার সাথে বা সচিবের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টির তাৎক্ষিণক নিস্পত্তি করাটাই হত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া । সংশ্লিষ্ট সকলেই দূরাভাষে যুক্ত ছিলাম । তাছাড়া তার অভিযোগটি যদি সত্যি হত এবং প্রথম বিকল্পটি ওর কাছে গ্রহনীয় না হত তবে অভিযোগের প্রতিকার পাওয়ার ন্যায়সঙ্গত উপায় হত আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট বিষয়টি নিয়ে যাওয়া । পরিবর্তে তিনি যা করলেন তা হয়ে দাঁড়াল অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ, প্রাণহানির আশঙ্কা ঘটানো, ভীতিপ্রদর্শন এবং সমষ্টিগত মানুষের শান্তি বিঘ্নিতকরণ । এর সবগুলিই ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ । কিন্তু আমার এজাহার (এফআইআর, FIR) এর উপর কোন কার্যকরী ব্যবস্থাই নেয়া হল না । আইন নীরব দর্শক হয়ে রইল, অপরাধী নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াল । ঐ সময় একটি খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য ছিল কোন এফআইআর (FIR) হয়নি । যদিও তিনি সরকারী ও ব্যক্তিগত দুভাবেই সম্পূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন, কিন্তু একটি বিভাগীয় তদন্তের ও ব্যবস্থা করেন নি ।
উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাই নিলেন না
যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে ২২শে জানুয়ারীর ঘটনার পূর্ণ বিবরণ আমি সচিব মহোদয়ের নিকট ঘটনার পরদিনই পাঠিয়েছিলাম । এডিসির আগের রাতের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে আমার পরিবারের সুরক্ষার জন্য আমার ফ্ল্যাটে নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করার ব্যবস্থা করার অনুরোধও জানিয়েছিলাম । এই চিঠির প্রতিলিপি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবকেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছিল । আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিঠি দুটি উদ্দিষ্ট অফিসারদ্বয়ের চেম্বারে কর্মরত আপ্ত সহায়কের হাতে দিয়ে এসেছিলাম । কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, কোন নিরাপত্তারক্ষী নিযুক্ত হয়নি ।
নেভি এডিসি কর্তৃক অপরাধের পুনরাবৃত্তি: ২৩শে জানুয়ারী ১৯৯২
পরদিন (২৩শে জানুয়ারী) সন্ধ্যাবেলা থেকে আমরা নেভি এডিসির সহযোগীদের (যারা কোলকাতার নৌভবন থেকে বলছে বলে জানাচ্ছিল), অশালীন ভাষায় শাসানোমূলক ফোন বার্তা পেতে শুরু করি । এইরূপ একটি ফোন রাজভবনের টেলিফোন অপারেটারের কাছেও আসে এবং সে তা আমায় জানায় । আমার পরিবারের সদস্যরা এই সকল বার্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ল । কিছুক্ষণ পর ঐ অপারেটর আমায় জানাল যে এডিসি ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছে । আমি রাজ্যপালের সচিবকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই । এরপর আমি স্বরাষ্ট্র সচিবকে ফোন করে পুরো বিষয়টি জানিয়ে তাৎক্ষণিক সাহায্য চাই । তাঁকে আরো বলি যে রাজ্যপালের সচিবের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে পারছি না । তিনি আমায় জানান যে রাজ্যপালের সচিব ওঁর কাছেই আছেন, তিনি তাকে সব জানাবেন এবং নিজেও ব্যবস্থা নেবেন ।
রাজ্যপালের সচিব এডিসির আগের রাতের কার্যকলাপ যথা আমার বাসস্থানে অনধিকার প্রবেশ ও আমাকে ভীতিপ্রদর্শনের বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন । আগের রাতের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এডিসির যে আবার আমার ফ্ল্যাটে এসে ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করা সম্ভব তা সচিব মহোদয় বুঝতে পারেন নি এটা ভাবার কোন কারণ নেই । তা সত্বেও তিনি এডিসিকে এই ঘৃণ্য ও অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত করার কোন চেষ্টাই করলেন না । বরং উগ্রস্বভাব এই এডিসির কার্যকলাপের ফলে যদি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তবে তাতে যেন জড়িয়ে পড়তে না হয় সেই উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্র সচিবের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বেহদিসী করে রাখলেন । আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল প্রথম দিনের ঘটনার পরের দিন ২৩শে জানুয়ারী সারাদিনের মধ্যেও আমার প্রত্যক্ষ উপরস্থ কর্তৃপক্ষ হিসাবে তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না ! এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে যা ঘটছিল তার উপর সচিব মহোদয়ের আশীর্বাদ ছিল । এটা শুধু নিষ্ক্রিয়তা বা দায়িত্ব এড়াবার ক্লাসিক উদাহরণ নয় এটা ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার একজন বরিষ্ঠ সদস্যের অপরাধমূলক ক্রিয়ার গোপন সমর্থনের এক কদর্য উদাহরণও বটে ।
সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়াতে আমরা আমাদের ফ্ল্যাটের বিপরীতে অবস্থিত কৃষিবিভাগের মুখ্য বাস্তুকার শ্রী নিবিড় বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় আঘাতের পর আঘাতের আওয়াজ পেতে লাগলাম । শ্রীবন্দোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটের দরজার আই হোল দিয়ে দেখা গেল আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে ঐ এডিসি দরজার গায়ে লাথির পর লাথি মারছে । ওর সাথে শঙ্কর নামের রাজভবনের একজন ড্রাইভার ছিল, সে ওর নির্দেশে নিজের নাম করে আমায় দরজা খুলতে আহ্বান করছিল । দরজা খুলতে না পেরে ও শঙ্করকে দরজা ভেঙ্গে ফেলতে নির্দেশ দিল । আমরা শুনতে পেলাম শঙ্কর তা করতে অস্বীকার করল । বিনা কারণে অপরের বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে ফেলতেও ওর এতটুকু দ্বিধা বা ভয় ছিল না । ঐ মুহূর্তে ওকে দাগী গুণ্ডা বদমাসের বেশি কিছু ভাবা যাচ্ছিল না, নৌবাহিনীর অফিসার ত দূরের কথা । কিছুক্ষণের মধ্যে মিলিটারি পুলিশ পৌঁছুল, সম্ভবতঃ স্বরাষ্ট্র সচিবের ব্যবস্থাপনায় । মিলিটারি পুলিশ এডিসিকে নিয়ে গেল । এরপর স্থানীয় থানা থেকে একজন অফিসারের নেতৃত্বে তিনজন পুলিশকর্মী এল । আমরা যে ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছিলাম তার বাসিন্দাদের সম্মুখে ঘটনা সম্পর্কে আমার বয়ান লিপিবদ্ধ করে তারা চলে গেল ।
নেভি এডিসির অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপের সম্ভাব্য পশ্চাদপট
আগেই বলেছি, আর্থিক নিয়মানুযায়ী সরকারী তহবিল থেকে কোন অর্থ ব্যয় করলে সেই ব্য়য়ের অনুকুলে যথার্থ প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয় । রাজ্যপালের সরকারী সফরে রাজ্যপালের জরুরী প্রয়োজনে ব্যয় করতে সহগামী এডিসিকে কিছু নগদ অর্থ অগ্রিম হিসাবে দেয়া হয় । নিয়মানুযায়ী সফর শেষে ব্যয়িত অর্থের যথার্থ প্রমাণক সহ খতিয়ান দাখিল করার কথা যার সাহায্যে অগ্রিম হিসাবে প্রদত্ত অর্থের সামঞ্জস্য সাধন করা হয় । এরূপ একটা সফরে সহগামী নেভি এডিসিকে কিছু অর্থ অগ্রিম দেয়া হয়েছিল । সফর শেষে ঐ এডিসি খরচের খতিয়ান জমা দিলে দেখা যায় একটি সামগ্রীর ক্ষেত্রে খরচের কোন ভাউচার বা প্রমাণক নেই । এডিসির কাছ থেকে ভাউচার আদায়ের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ভাউচার(৬) প্রদানে এডিসিকে বাধ্য করতে আমি বিষয়টি সচিবের কছে পেশ করি । এই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখিত নোটের বৈদ্যুতিন ফাইল আমার ইংরেজী ওয়েবসাইটের এপেন্ডিক্স পাতায় পাওয়া যাবে ।
অন্য একটি ক্ষেত্রে ঐ একই এডিসি একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যপালের দিল্লী সফরের প্রাক্কালে এক সংকটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন । আমি ঐ বিষয়ে রাজ্যপালের সচিবকে এডিসির অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ হাইলাইট করে ওর বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানিয়ে কড়া ভাষায় একটি গোপনীয় ডেমি অফিসিয়াল চিঠি লিখেছিলাম । আমার ধারণা ঐ চিঠিটি ওকে দেখানো হয়েছিল অথবা কোন না কোন ভাবে উনি সেটা দেখতে পেয়েছিলেন ।
সম্ভবতঃ ওর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থাগুলো এবং রাজভবনের গাড়ী ব্যবহারের পদ্ধতিকরণ ওকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল এবং ওর সীমিত বুদ্ধিমত্তায় শারীরিক শক্তি ব্যাবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত স্তরে তার নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন ।
সর্বস্তরে জানানো সত্বেও দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হল না
২৫শে জানুয়ারী আমি একটি ডিও চিঠিতে রাজ্যপালের সচিবকে সরকারী ভাবে ২৩শে জানুয়ারীর দ্বিতীয় ঘটনা বিশদে জানিয়ে অনুরোধ করি এই বিষয়ে আমার পূর্ববর্তী চিঠি ও বর্তমান চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যেন যথাবিহিত ব্যবস্থা নেন । এই চিঠির অনুলিপি আগের মতই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে পাঠিয়েছিলাম । যদি আমার স্মৃতিভ্রম না হয়ে থাকে তবে দ্বিতীয় ঘটনার পর বিষয়টি ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা সচিবের নজরেও এনেছিলাম । দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রতিরক্ষা সচিবকে লেখা সেই চিঠির অনুলিপি বা পাঠাবার প্রমাণ কোন অসতর্ক মুহূর্তে হারিয়ে ফেলেছি ।
২৯শে জানুয়ারী আমি সংশ্লিষ্ট আলিপুর থানার ওসিকে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে একটি চিঠি পাঠাই । সেই চিঠিতে আমি ওসিকে ২৩শে জানুয়ারী রাত্রে পুলিশ অফিসার দ্বারা অকুস্থলে লিপিবদ্ধ আমার বিবৃতির ভিত্তিতে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করি ও বিবৃতির একটি সারাংশ সেই সঙ্গে সংযুক্ত করে দি । ঐ সারাংশকে আমি এজাহারের (FIR) অঙ্গীভূত করতে অনুরোধ করি । কিন্তু আমার ঐ সংবাদবাহী পত্রকে এজাহার হিসাবে গণ্য করা হল না ও কোন কেসও শুরু করা হল না । আমার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়নি । রাজভবনের সঙ্গে জড়িত বিষয় বলে বোধহয় সকলে উপরমহলের নির্দেশের দিকে তাকিয়ে রইল । সেই নির্দেশ হয় এল না নয়ত অগ্রাহ্য করার নির্দেশ এল । চিঠির একটি অনুলিপি এখানে দেখা যাবে । A Tale of a Sylheti Refugee - X. Appendix (google.com)
আমি অবশ্য জানি না ভারতীয় নৌবাহিনী এই দোষী নেভি অফিসারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল কি না । সম্ভবতঃ মিলিটারি পুলিশ, যারা ২৩শে জানুয়ারী রাত্রে ওকে ঘটনাস্থল থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, নৌবাহিনীতে ঐ অফিসারের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করে থাকবে ।
তবে এটা সহজেই অনুমেয় ঐ এডিসি তার নিজস্ব ইউনিটে কর্ম্মরত থাকাকালীন এরূপ ঘটনা ঘটালে ওকে গুরুতর শাস্তির সম্মুখীন হতে হত, হয়ত বা চাকুরী থেকে বরখাস্ত হওয়ার মত কঠিন শাস্তিও হতে পারত ।
রাজ্যপাল সমীপে বিষয়টি পেশ
ও রাজ্যপালের প্রতিক্রিয়া
রাজ্যপাল প্রোঃ নুরুল হাসান ঘটনার সময় শহরের বাইরে ছিলেন । উনি ফিরে আসার পর আমি ওঁর সাথে দেখা করি ও সম্পূর্ণ ঘটনা বিবৃত করে দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানাই । উনি সবই শুনলেন কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না । রাজ্যপালের সম্পূর্ণ নিরবতায় আমি হতবাক হয়ে গেলাম, না দোষী এডিসির অপরাধের একবিন্দু নিন্দা, না ভুক্তভোগী আমার প্রতি সান্ত্বনার একটি শব্দ । তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বা বিষয়টি সম্পর্কে ব্যবস্থা নেবেন এমনটা বোঝাবার মত একটি শব্দও ব্যবহার করলেন না, তার মুখাবয়বেও এমন কোন ভাব প্রতিফলিত হল না । কেন এমন ঘটল সে সম্পর্কেও কিছু জানতে চাইলেন না । মনে হল উনি বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে চাইছেন । আমি আশা করেছিলাম রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ও একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসাবে তাঁর মধ্যে ন্যায়বিচারের নৈতিক উৎকর্ষ থাকবে । আমি আশাহত হলাম । বেরিয়ে আসার আগে আমি ওকে বলে এলাম, আমি ছুটিতে আছি; আপনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন এ রকম পরিবেশে কাজ করা সম্ভব নয়। রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় আমি ছুটিতে ছিলাম ।
এডিসি সংক্রান্ত বিষয়ে চিঠিপত্রের অনুলিপি
এডিসির কার্যকলাপ সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত চিঠিপত্রের অনুলিপি একটি বৈদ্যুতিন ফাইলে আমার মূল ওয়েবসাইট, "লাইফ এস আই সো ইট (Life As I Saw It)" এর এপেণ্ডিক্স পাতায় "Correspondence on Aides-de-Camp's illegal activities" এই শিরোনামে পাওয়া যাবে । সেখানে যেতে গেলে নিচের লিঙ্কটি ক্লিক বা টেপ করতে হবে ।
গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া পরিহার
রাজভবনের প্রতিষ্ঠানিক সম্মান ও বিষয়টির সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে ঘটনাকালে আমি বিষয়টিকে প্রচারের আলোয় আনতে চাই নি । সেই কারণেই কয়েকজন সাংবাদিকের বারংবার অনুরোধ সত্বেও এই ঘটনা সম্পর্কে মুখ খুলিনি। কিন্তু সংবাদটি পরে স্টেটসম্যান, বর্তমান ও জনসত্ত ইত্যািদি কাগজ নিজ নিজ ভাষ্যে বিভিন্ন তারিখে প্রকাশ করেছিল । কয়েকটি কাগজের ঐ সংবাদ সংক্রান্ত অংশের কাটিং পূর্বে উল্লিখিত এপেণ্ডিক্স পাতায় দেখা যাবে ।
পূর্বেই বলেছি ১৯৯২ সালের ২৩শে জানুয়ারী রাত্রে ঘটনার সময় স্থানীয় থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে আমার বয়ান লিপিবদ্ধ করেছিল, সেখানেই ওরা ওদের দায়িত্ব শেষ করেছিল । আমি যখন বুঝলাম রাজ্যসরকারের সর্বস্তরে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে তখন আমার খেদ হল যে সুযোগ পাওয়া সত্বেও প্রাথমিক পর্যায়ে গণমাধ্যমের সাহায্যে বিষয়টি প্রচারের আলোয় না এনে আমি ভুল করেছি । গুরুতর অপরাধ করা সত্বেও সেই অপরাধী অফিসারকে বিচারের সম্মুখীন করাতে ব্যর্থ হলাম এই মনোকষ্ট আমাকে এখনও পীড়া দেয় ।
এই অপরাধমূলক কর্মে সরকারী পরিকাঠামোর অসদ্ব্যবহার
সরকারী সম্পত্তি (রাজভবনের গাড়ী) ব্যবহার করে সরকারী কর্ম্মচারীকে (রাজভবনের ড্রাইভার) সহযোগী করে সরকারী সম্পত্তিতে (রাজ্যসরকারের হাউসিং এস্টেট) অনধিকার প্রবেশ করে সরকারী ফ্ল্যাটের ও ফ্ল্যাটে বসবাসকারী রাজ্যসরকারের একজন বরিষ্ঠ আধিকারিকের ক্ষতিসাধন করার (দরজায় লাথির পর লাথি মেরে) অপরাধমূলক ক্রিয়ার অপরাধী এই এডিসির বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার কোন ব্যবস্থাই নিল না । এমনকি একটি নিরপেক্ষ তদন্তেরও ব্যবস্থা করলেন না, যদিও আমি তা চেয়েছিলান । এটা কি কোন সুস্থ প্রশাসন? দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি এরূপ এক স্থবির প্রশাসনের অঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম ।
উপসংহার: কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা সম্বন্ধে আমার অভিমত
উপসংহারে আমার বিচারে আমি এটাই বলতে পারি যে তৎকালে রাজ্যসরকারের ও রাজভবনের শীর্ষস্তরে যে সব প্রশাসনিক কর্তা অধিষ্ঠিত ছিলেন তাদের সেই চারত্রিক দৃঢ়তা ছিল না যার দ্বারা নৌবাহিনীর একজন ল্যাফটেনেন্টের (lieutenant) মত জুনিয়র পদমর্যাদার আধিকারিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন, হোক না তা রাজনৈতিক বা অন্য কোনরূপ বাধ্যবাধকতায়। অপরাধী অফিসারের বিরুদ্ধে যে তারা শুধু ব্যবস্থা নিলেন না তাই নয়, ঘটনা পরম্পরায় মনে হয় আলিপুর থানার ওসিকেও ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত রাখলেন । পুলিশ অফিসার ঘটনাকালে ঘটনাস্থলে আমার বয়ান লিপিবদ্ধ করার পর সেই বয়ানকে FIR বা এজাহার হিসাবে গণ্য করার অনুরোধ সংশ্লিষ্ট ওসিকে জানানো সত্বেও স্বরাষ্ট্র সচিব গণমাধ্যমে বললেন এফআইআর (FIR) হয়নি । অপরাধী এডিসি বিনা অনুমতিতে আমাদের আবাসনে প্রবেশ করেছিল আমার ক্ষতি করার অপরাধমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে, আমার ফ্ল্যাটের দর্জায় একের পর এক লাথি মেরেছে, সহকারী রাজভবনের ড্রাইভারকে দর্জা ভেঙ্গে ফেলতে বলেছে এবং আগের দিন রাত্রে আমাকে শাসিয়ে গেছে এই পরিপ্রেক্ষিতে এই অপরাধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৪১ ধারা প্রযোজ্য । ঐ ধারা মতে এই অপরাধ কগনাইজেবল অর্থাৎ পুলিশ কোর্টের বিনা অনুমতিতে (ওয়ারেণ্ট ছাড়া) অপরাধীকে আটক করে কেস শুরু করতে পারার ক্ষমতা প্রাপ্ত । কিন্তু করেনি । আমি বিশেষ ভাবে এও চেয়েছিলাম বিষয়টি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক (৭) । তাও হয়নি । কেন? কার স্বার্থে? কাদের বাঁচাতে? তবে কি কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোবার ভয়? সঠিক উত্তর আমার জানা নেই । হয়ত বা কিছু বরিষ্ঠ আধিকারিককে বাঁচাতে ।
ঐ সময় রাজ্য প্রশাসনের ও রাজভবনের শীর্ষস্তরে ভারতীয় প্রশাসনিক সেবা ভুক্ত নিম্নে উল্লিখিত আধিকারিকরা দায়িত্বে ছিলেন ।
১ । নারায়ণ কৃষ্ণমূর্তি, মুখ্যসচিব (বর্তমানে মৃত)
২। মনীশ গুপ্ত, স্বরাষ্ট্র সচিব (বর্তমানে তৃণমূল দলভুক্ত রাজ্যসভার সদস্য)
৩ । রাজীব শ্রীবাস্তব, রাজ্যপালের সচিব (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)
কেন আমি আইনি প্রতিকার চাইলাম না
আমি এই অন্য়ায়ের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারতাম, কিন্তু আদালতে যাওয়ার মত লোকবল বা অর্থবল কিছুই আমার ছিল না । তাছাড়া, ক্ষমতার অলিন্দে যারা বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছিল তারা নিশ্চয়ই তা সদয় ভাবে নিত না । তারা অবশ্যই আমার চলার পথে বাধাবিঘ্নের সৃষ্টি করত । দুটি শিশু সন্তান সহ আমার পরিবার সম্পূর্ণরূপে আমার উপর নির্ভরশীল ছিল, আমার পক্ষে এই ঝুঁকি নেয়া সম্ভব ছিল না ।
পাদটীকা
(১) ডিএসজি বলতে বুঝায় "ডেপুটি সেক্রেটারী টু গভর্ণর" অর্থাৎ রাজ্যপালের উপসচিব ।
(২) প্রোঃ হাসানের স্থানীয় ও সর্বভারতীয় স্তরে রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে পরিচিতের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ ছিল ।
(৩) খারাপ আবহাওয়ার জন্য রাজ্যপাল অবশ্য পরদিন হেলিকপ্টারে দার্জিলিং যেতে পারেন নি । সড়ক পথেই তাঁকে যেতে হয়েছিল ।
(৪) বাতাসিয়া লুপ দার্জিলিং শহর থেকে কয়েক কিমি দূরে একটি সর্পিল রেলপথ যা দার্জিলিং হিমালয় রেলপথের আরোহণের নতির পরিমান কমাবার উদ্দেশ্যে তৈরী । রেলপথটি এখানে ক্রমে ক্রমে নিজের উপর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে একটি গুহার মধ্য দিয়ে গিয়েপাহাড়ের চূঢ়ায় পৌঁচেছে ।
(৫) রাজভবনের হল ও বসার ঘরগুলোকে বিভিন্ন রঙের নামে নামকরণ করা হয়েছে । ইয়েলো বা হলুদ কক্ষ রাজভবনের বৃহত্তম হল । এটি থ্রোন রুম যেখানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তার সঙ্গে সংযুক্ত । শপথ অনুষ্ঠানের পর এই ইয়েলো কক্ষে অথিতিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয় । স্বাধীনতা দিবসের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানও এখানেই হয়ে থাকে ।
(৬) এক্ষেত্রে রাজ্যপালের টীমের সহগামী গৃহস্থালীর একজন নিম্নবর্গীয় কর্মী যথাযথ ভাউচার সহ রাজ্যপালের ঐ ট্রিপে ব্যবহৃত একটি সামগ্রির মূল্য দাবী করলে ঐ অর্থ ওকে মিটিয়ে দেয়া হয় । পরে এডিসি তার খরচের খতিয়ানে সমর্থনকারী প্রমাণ ব্যতিরেকে ঐ একই সামগ্রীর একই মূল্য দাবী করেন । এডিসিকে ঐ সামগ্রীর খাতে ব্যয়ের প্রমাণ দাখিল করতে বললে তিনি তা করতে অস্বীকার করেন । বিষয়টি রাজ্যপালের সচিবের নজরে আনা হয় । সংশ্লিষ্ট ফাইলটি একাধিকবার আমার ও সচিবের মধ্যে ঘোরাঘুরি করার পর অবশেষে সচিব এডিসিকে ব্যয়ের শংসাপত্র দিতে বলা হোক এই নির্দেশ দিয়ে ফাইলটি ফেরৎ দেন । এডিসি প্রত্যুত্তরে জানান শংসাপত্রের পরিবর্তে তিনি অর্থ ফেরৎ দেবেন । কিন্তু তারপরও নানা প্রশ্ন তুলে তিনি টালবাহনা করতে থাকেন । আমি রাজভবন ছেড়ে আসা পর্যন্ত বিয়টির মীমাংসা হয়নি ।
(৭) আমি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট নেভি এডিসির আমাদের আবাসনে অনধিকার প্রবেশ, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আমার ফ্ল্যাটে জোর করে প্রবেশের চেষ্ট, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপের নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছিলাম ।