শরণার্থীর ঢল
১ঌ৪৭ সালের ভারত ভাগের মাসুলঃ অভাগা বাস্তুহারা শরণার্থীদের আশ্রয়ের সন্ধানে দলে দলে অজানার উদ্দেশে যাত্রা
আমার জন্মস্থান ও হারানো জন্মভূমি
আমি যখন জন্মগ্রহণ করি, সেই সময় শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলা ছিল আসামের অঙ্গীভূত । আমরা বংশানুক্রমিক ভাবে শ্রীহট্ট তথা সিলেটের বাসিন্দা ছিলাম । সুরমা নদীর তীরে এই সেই সিলেট (প্রাচীন নাম জালালাবাদ) প্রথম যুগে যা ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির একটি সম্পদশালী জেলা, যেখান থেকে সময় সময় অসাধরণ প্রতিভাবান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে । এই শ্রীহট্ট জেলাতেই জন্মেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই পুরোধা নেতা বিপিন চন্দ্র পাল যাঁর নাম অন্য দুই দেশবরেণ্য নেতা লালা লাজপৎ রায় ও বাল গঙ্গধর তিলকের নামের সাথে লাল-বাল-পাল এই শব্দবন্ধের মধ্য দিয়ে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় । তদানীন্তন শ্রীহট্টেরই অন্তর্গত করিমগঞ্জ মহকুমায় ১৯০৪ সালে খান্দেকার পরিবারে জন্মেছিলেন প্রথিতযশা বাঙ্গলী সাহিত্যিক, বহুভাষাবিদ ও রসিকতায় অগ্রণী সৈয়দ মুজতবা আলী । এই সেই সিলেট যেখানে ১৯১৯ সালের নবেম্বর মাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদার্পণ করেছিলেন ও সিলেটকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন "মমতাবিহীন কালস্রোতে" । এই সিলেটেই রয়েছে একাধারে চতুর্দশ শতকের সূফী শাহ জালাল ও শাহ ফারহানের মাজার আর অপর ধারে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পাঁচশত বছরের পুরনো শ্রীচৈতন্য মন্দির ও শ্রীচৈতন্যের পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান । এই শ্রীহট্টেই এসেছিলেন মরক্কোবাসী মধ্যযুগীয় বিখ্যাত মুসলমান পণ্ডিত ও পরিব্রাজক ইবন বতুতা । তার আরবী সফরনামা রিলহা থেকে সুফী শাহজালাল ও তৎকালীন শ্রীহট্ট সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় ।
চা-বাগিচা, উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় পাহাড়, বৃষ্টিবিধৌত অরণ্যরাজি ও নদী উপত্যকায় পরিপূর্ণ শ্রীহট্ট ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সির একটি সম্বৃদ্ধশালী জেলা । শ্রীহট্টে চা ছাড়াও ফলমূল, শাকসব্জি ও তণ্ডুলজাতীয় খাদ্য প্রচুর পরিমাণে জন্মাত । ফলমূলের মধ্যে কমলা, আনারস, কলা, ভুট্টা ইত্যাদি ছিল প্রধান । শ্রীহট্টের ছাতক নামক স্থানে কমলালেবুর খেলা হত । বিভাজন পূর্ববর্তী শ্রীহট্টে বাবাকে ছাতক থেকে কমলালেবু জিতে আনতে দেখেছি । শ্রীহট্টের কমলালেবু ছিল উৎকৃষ্ট মানের ও সুমিষ্ট । ১৯০৬ সালে শ্রীহট্ট থেকে ১৩৫২১৩ মণ কমলালেবু রপ্তানী হয়েছিল বলে জানা যায় । শ্রীহট্টে অমৃতসাগর, ডিঙ্গামাণিক, সফরি, মর্তমান ইত্যাদি নামীয় উৎকৃষ্ট মানের কলা পাওয়া যেত । এখানে জুম চাষও হত । জুম চাষের মাধ্যমে ভুট্টা, চিনার, শশা, কার্পাস, লাউ, কুমড়ো, কচুরমুখি ইত্যাদি উৎপন্ন হত । জুমে উৎপন্ন শেষোক্ত সব্জি তিনটি খুবই সুস্বাদু ছিল । অর্থকরি ফসলের মধ্যে চা ছিল সর্বপ্রধান । এ ছাড়া পান, সুপুরি ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত । শ্রীহট্ট বনজ সম্পদেও সমৃদ্ধ ছিল । এখানকার কাঠও ছিল অতি উত্তম । মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালেও শ্রীহট্ট থেকে কাঠ বিদেশে রপ্তানী হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায় । নদী ও জলাভূমির আধিক্য ও উৎকৃষ্ট মানের কাঠের প্রাচুর্য থাকায় সমরতরী তৈরিতেও শ্রীহট্ট অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল । মোগল রাজত্বের সময় শ্রীহট্টকে রাজস্বের পরিবর্তে লৌড়াধিপতিকে সমরতরী যোগাতে হত ।[1] শ্রীহট্ট চা উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ও রয়েছে । বর্তমান বাংলাদেশের ১৬১টি চা বাগিচার মধ্যে ১১০ টি-ই শ্রীহট্ট ডিভিসনে অবস্থিত । তদানীন্ত শ্রীহট্টের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্বর্তী অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় জলপথের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । অনেক জায়গাতেই নৌকোয় যাতায়াত করতে হত।
১৮৭৫ সালে আসামকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বয়ম্ভর করতে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার এই সম্বৃদ্ধশালী জেলাকে বাংলা থেকে বিযুক্ত করে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে ।
এই সম্বৃদ্ধশালী জেলার সদর শহর শ্রীহট্ট (বর্তমানে মহানগরী) । শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৭-৮ কিমি দূরে রায়নগর নামক মহল্লায় আমাদের পৈতৃক বাড়ী ছিল । রায়নগরের একজন রাজা ছিলেন (কিরূপ রাজা জানা নেই)। সেই রাজবাড়ীর কাছে আমাদের বাড়ী ছিল বলে মায়ের কাছে শুনেছি । এই রাজবাড়ী আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্মভূমি ও পৈতৃক বাড়ী দেখার অদম্য আগ্রহে আমি একবার ও সম্ভবতঃ একমাত্র বার সিলেট দর্শনে গিয়েছিলাম । সেই সময় বাড়ীর দলিল দস্তাবেজ আমার কাছে না থাকায় বাড়ীর সঠিক অবস্থান খুঁজে পাই নি । তবে স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জেনেছিলাম অনেক দিন আগেই আমাদের পুকুরটি ভরাট করে ও টিলা সমতল করে নতুন ঘরবাড়ী তৈরী হয়ে গেছে । আমরা চলে আসার সময় বাড়ীটির কোন ব্যবস্থা করে আসা যায় নি । যেমন ছিল সেই অবস্থায় ফেলে আসা হয়েছিল । দেশভাগের পর নতুন দেশের নতুন নাগরিকরা বিনা মূল্যে প্রাপ্ত সম্পত্তি মহানন্দে ভোগ করেছে এবং পরবর্তীকালে নিজেদের নামে নথিভুক্ত করিয়ে নিয়েছে । আর আমরা যারা বংশ পরম্পরায় ঐ সম্পত্তির সত্ত্বাধিকারী? সর্ব্বহারা উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসে স্থান থেকে স্থানান্তরে স্বল্প ভাড়ার ছাদ যোগাড় করে যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছি । দ্বিখণ্ডিত ভারতের গৌরবময় স্বাধীনতায় এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বলিদান !
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সিলেট হিন্দু রাজাদের অধীন ছিল । ১৩০৩ সালে লখনৌটির সুলতান সামসউদ্দিন ফিরোজ শাহ পার্শ্ববর্তী রাজ্য গৌড়ের সাথে সিলেটে, যা তখন হিন্দুরাজা গৌড়গোবিন্দের শাসনাধীন ছিল, যুদ্ধে লিপ্ত হন । এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল গাজী বুরহানুদ্দীন নামে এক সিলেটে বসবাসকারী মুসলমানের নবজাতক পুত্রের জন্ম উদযাপন উপলক্ষ্যে গো-বলিদানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে । গোবিন্দ এই ঘটনাকে পবিত্রতা নষ্টকারী বলে গণ্য করে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন । তাঁর আদেশে নবজাতককে হত্যা ও বাহারুদ্দিনের ডান হাত ছেদন করা হয় ।
এই সংবাদ যখন সুলতান ফিরোজ শাহের কাণে পৌঁছুলো তখন তিনি প্রথমে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সিকান্দর খান গাজী ও পরে তার সেনাধ্যক্ষ সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে সৈন্যদল পাঠান । বাঙ্গালী সৈন্যের বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করার অনভিজ্ঞতা ও গৌর গোবিন্দের যুদ্ধ কৌশলের শ্রেষ্ঠতায় পর পর তিনটি আক্রমণ ব্যর্থ হয় ।
এবার শাহ জালাল[2] ও তাঁর সঙ্গীদের সহায়তায় যারা সংখ্যায় প্রায় ৩৬০ জন ছিলেন চতুর্থ আক্রমণ সংঘটিত হল । গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রাথমিক আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর ফিরোজ শাহ হয়ত শাহ জালালের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন । অন্যথায় শাহজালাল হয়ত সিলেটেই ছিলেন ও সুলতানের অনুরোধের আগেই স্বাধীনভাবে হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন । মিলিত মুসলমান শক্তি অবশেষে গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে সিলেটকে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয় । ১৩০৩ সালের একটি ফারসী শিলালিপি শাহ জালালের দরগায় পাওয়া গেছে যাতে ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে জালালের সাহায্য নিয়ে সিকন্দর আরসা শ্রীহট্ট জয় করেছিলেন বলে উৎকীর্ণ আছে । এই শিলালিপিটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে (National Museum) সংরক্ষিত আছে ।
শেখ ফারুকের সিলেট জয়ের পর জালাল ও তাঁর অনুগামীরা সিলেটে বসতি স্থাপন করেন[3] ও ইসলাম ধর্ম্ম প্রচারে রত হন । সিলেটে ইসলাম ধর্ম্মের গোড়াপত্তন হয় । জালাল ইসলাম ধর্ম্মের প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন ।
যাহোক. যা বলছিলাম । বৃটিশ শাসনকালে শ্রীহট্ট জেলা আদিতে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত । শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভূমি আইন সর্ব বিষয়েই এই জেলা ছিল বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত । আসাম রাজ্যটিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্থিতিশীল ও স্বনির্ভর করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্টকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে । অসমীয়া ভাষাভাষী রাজ্য আসাম বা বাংলাভাষী জেলা শ্রীহট্ট, যা পরম্পরাগতভাবে পূর্ববঙ্গের অংশ রূপে পরিগণিত ছিল, কেউই এই সংযুক্তিকে স্বাগত জানায় নি; ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত দিক থেকে এই দুই এলাকার লোকেরা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ।
১৮৭৪ সালে আসামে সংযুক্তির পর থেকেই সিলেটি হিন্দুরা সংস্কৃতিগত ভাবে স্বগোত্রীয় তথা উন্নততর বাংলায় ফিরে যাওয়ার দাবী জানাতে থাকে । অপরদিকে সিলেটি মুসলমানেরা আসামে থেকে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল; তাদের নেতাদের ধারণা ছিল সংখ্যাধিক্যের জোরে তারা তাদের সমধর্মী সংখ্যালঘু অসমীয়া ভাইদের অধিকতর প্রভাব ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করতে পারবে । এ বিষয়ে এরা অনেকটা সফলও হয়েছিল । ১৯৮৩ সালে নেলী হত্যাকাণ্ডের[4] আগে পর্যন্ত এরা কোন বিরোধী আন্দোলনের শিকার (target/victim) হয়নি ।
আসামে যখন সিলেটি বিদ্বেষ বিস্তার লাভ করল, সেই সময় সিলেটি মুসলমানরা নিজেদের অবস্থান দৃঢ়তর করতে অসমীয়াকে মাতৃভাষা বলে মেনে নিল এবং ১৯৫১ সালের জনগণনায় সেই ভাবে নিজেদেরকে নথীভুক্ত করাল । এর ফলে দেখা গেল ১৯৩১ থেকে ১৯৫১ এই ২০ বছরে আসামে অসমীয়াভাষী লোকসংখ্যা ১৫১% বৃদ্ধি পেয়েছে যা শুধু অস্বাভাবিক নয়, অসম্ভব । ১৯৫১ সালের স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের প্রথম জনগণনায় এই চিত্রই প্রকাশিত হয়েছিল ।
এদিকে ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্টের অন্তর্ভূক্তির পর থেকেই আসামের আদি বাসিন্দারাও শ্রীহট্টের বিযুক্তি চেয়ে আসছিল । তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত সিলেটি হিন্দুদের কেবল যে কর্মক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দী রূপে বিবেচনা করত তা নয়, তারা এদেরকে নিজেদের (বিশেষ করে আর্থিকভাবে দুর্বলতর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসমীয়াদের) সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করত । তদুপরি আসামের এই আদি বাসিন্দারা ১৮২৬ সাল থেকেই বৃটিশদের সাহায্যে আসামকে জাতিগত ও ভাষাগত দিক থেকে একটি সমজাতিক রাজ্যে পরিণত করার প্রচেষ্টায় ছিল । জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের বার বার বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছিল যে আসামের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে সিলেটকে আসাম থেকে বিযুক্ত করা একান্ত প্রয়োজনীয় । অসমীয়া জনসাধারণকে অবহিত করতে অসমীয়া বুদ্ধিজিবীদের ঐ বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও লেখা প্রচার করা হচ্ছিল । ১৯৩৭ সালে নির্বাচনী প্রচারে জহরলাল নেহরু যখন আসামে এসেছিলেন সেই সময় শ্রীহট্টের আসাম থেকে আলাদা করার দাবী সহ অন্যান্য দাবীদাওয়া নিয়ে তার কাছে মেমোরেণ্ডাম দেয়া হয় ।
ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয়ের জার্নেল থেকে জানা যায় আসামের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ কেবিনেট মিশনকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে আসাম শ্রীহট্টকে পূর্ববাংলার হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত । পরে যখন শ্রীহট্টে রেফারেণ্ডামের সিদ্ধান্ত হয় তখন গোপীনাথ বরদলৈ ঘোষণা করেন যে আসাম কেবিনেট শ্রীহট্টকে আসামে রাখতে আগ্রহী নয় । এটা পরিষ্কার যে এই ঘোষণা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আসামের নেতৃবৃন্দকে শ্রীহট্টের জন্য প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্য করা হয়েছিল । সিলেটি কংগ্রেস নেতাদের জেলার অন্ততঃ কিছু অংশ উদ্ধার করার প্রচেষ্টায় বাউণ্ডারী কমিশনের কাছে জোরালো সওয়াল করতে নিরুৎসাহ করা হয়েছিল ।
আসাম থেকে বিযুক্তির পক্ষে ক্রমাগত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগের সময় শ্রীহট্টকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় । কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯১২ সালে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন সত্বেও শ্রীহট্টকে পুনরায় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের অঙ্গীভূত করা হয় ।
পরিহাসের বিষয় হল, ১৯৪৭ সালে যখন শ্রীহট্টের পূর্বপাকিস্তানে তথা পূর্ববাংলায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ উপস্থিত হল তখন হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন কারণে নিজ নিজ পূর্ববর্তী অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করল । সিলেটী হিন্দুরা আসামে থেকে যাওয়ার দাবী জানাল আর সিলেটী মুসলমানেরা আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইল । অতএব ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন সৃষ্ট মাউণ্টবেটেন পরিকল্পনা যার মধ্যে শ্রীহট্টে রেফারেণ্ডামের অভিপ্রায় অঙ্গীভূত ছিল তা কার্যকর হল ।
বিভাজন পরবর্তী শ্রীহট্ট ও শ্রীহট্টবাসীদের বিষয়ে অনিন্দিতা দাশগুপ্ত মহাশয়া তাঁর ব্লগে বিষদভাবে পর্যালোচনা করেছেন । সে বিষয়ে জানতে হলে নিম্নে প্রদত্ত লিঙ্কে ক্লিক বা টেপ করুন ।
https://bangalnama.files.wordpress.com/2009/07/remembering-sylhet-a-dasgupta.pdf
আমাদের জন্মভূমি শ্রীহট্টের হারিয়ে যাওয়া ও তার মধ্য থেকে স্বভূমিহীন (deterritorialised) সিলেটি পরিচিতি উঠে আসার ইতিহাসের কিয়দংশ এই জীবন-কাহিনীর পরিশিষ্টে পাওয়া যাবে ।
আমার জন্ম ও জন্ম-তারিখ
সেটা ছিল ১৯৪৩ সালের ৪-৫ ফেব্রুয়ারীর অমাবস্যার রাত । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে । ব্ল্যাকআউট ও অমবস্যার যুগ্ম প্রভাবে চারদিক ঘন অন্ধকার । বড়মামা বিয়ে করতে রওয়ানা হচ্ছেন । এমন সময় মায়ের প্রসব বেদনা দেখা দেয়, মাকে সিলেট সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় । কিছুক্ষণের মধ্যে আমার জন্ম এক ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার রাতে । সেটা ছিল ২২শে মাঘ বৃহস্পতিবার । কথাগুলো মায়ের কাছে শোনা । মা জন্মের দিন ও তারিখ বলতে পারলেও বাংলা বা ইংরাজী সাল বলতে পারতেন না; জন্মের সঠিক সময়ও তার পক্ষে বলা সম্ভব হয় নি । সাল জানতে আমাকে অনেক গবেষণা করতে হয়েছে; সময় জানা সম্ভব হয় নি । তাই জন্ম তারিখ ৪-৫ ফেব্রুয়ারী বলে ধরা যেতে পারে । তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকুরীতে প্রবেশের পর আমার প্রদত্ত প্রক্ষাপণের (Declaration) ভিত্তিতে আমার সরকারী জন্ম-তারিখ নির্দিষ্ট হয় ৫ই ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার, ১৯৪৩ । জন্মের সময় না জানতে পারায় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রে মায়ের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমার জন্মদিন ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ১৯৪৩ (যা বাংলা ক্যালেণ্ডার মতে মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাংলা তারিখটা ২১শে মাঘ, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ)[5] আমার জন্মদিন হিসাবে গণ্য হয় ।
-------------------
[ঐতিহাসিক ভাবে ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৩ দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এই দিনই অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের (Internal Combustion Engine) নক্সা তৈরীর পথিকৃৎদের একজন রেনসন এলি ওল্ডস তাঁর সর্বশেষ পেটেণ্টটি পেয়েছিলেন । "ওল্ডস রাণএ্যাবাউট" এর মত গাড়ী প্রস্তুতকারী এক কোম্পানীর মাধ্যমে গাড়ীর উৎপাদন পরিলেখ (Line of production) সৃষ্টিকারী হিসাবে ওল্ডস সুপরিচিত ।]
আমার মাতা-পিতা ও বংশ-পরিচয়
আমার পিতা সারদা চরণ দাস ও মাতা সরোজনলিনী দেবী । তাঁদের চার পুত্র ও চার কন্যা ছিল; আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ । আমার দুই ভাই ও দুই বোনের শৈশবেই মৃত্যু হয় । বোধশক্তি জাগার পর আমি দাদা কৃষ্ণকান্ত দাস ও দুই বিবাহিতা দিদি বকুল রাণী রায় ও চামেলী রায়কেই দেখেছিলাম । চামেলী ছিল আমাদের জীবিত ভইবোনদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ । বিশদের জন্য ভ্রাতা-ভগ্নী পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য ।
আমার মা ছিলেন নিরক্ষর [6,], বাবা নন-মেট্রিক ।,বাবা প্রথম জীবনে কন্ট্রাকটারি করতেন, পরে ছাপাখানার ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেছেন ।
আমাদের পৈতৃক বাড়ী ছিল শ্রীহট্ট শহরের রায়নগর নামক স্থানে । আমার যতদূর মনে আছে বিস্তৃত চৌহদ্দি বিশিষ্ট আমাদের দালান বাড়ীটি ছিল একটা টিলার উপর, বাড়ীর দেয়ালের বাইরের অংশে প্লাাস্টার ছিল না, সম্ভবতঃ ছাদ ছিল টিনের । টিলার নীচে সমতল জায়গায় আমাদের একটা বড় নিজস্ব পুকুর ছিল, বাড়ীর পেছন দিকে ছিল বিভিন্ন ফলের ও অন্যান্য গাছগাছালির বাগিচা । বাড়ীর চৌহদ্দির ভিতর অপর একটি অংশে একটি চালাঘরে থাকতেন আমাদের জ্যাঠামশায়।
[২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে শ্রীহট্টে জন্মভূমি দর্শনে গিয়ে বাড়ীটির অবস্থান আমি খুঁজে পাই নি । রায়নগরের স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে জানতে পারি অনেক কাল আগেই পুকুরটিকে ভরাট করে ও টিলাটিকে সমতল করে ঘরবাড়ী তৈরী হয়ে গেছে । বাড়ীটির হোল্ডিং নং বা সীমানা জানা না থাকায় বাড়ীটির সঠিক অবস্থানে পৌঁছুতে পারি নি । এ বিষয়ে দলিল-দস্তাবেজ বাবার কাছে ছিল যা সম্ভবতঃ দাদার হাত হয়ে হারিয়ে গিয়ে থাকবে । আমি ওগুলো কোনদিন দেখিনি । তবে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছুতে না পারলেও সংলগ্ন এলাকায় পৌছুতে পারলাম । যেখানে অতি বাল্যে হাঁটা-চলা করেছি অতি বৃদ্ধ বয়সে সেখানে পদার্পণ করতে পেরেছি এই সন্তুষ্টি নিয়ে রায়নগর থেকে ফিরলাম ।]
আমার পিতামহ ছিলেন দীননাথ দাস ও প্রপিতামহ ব্রজনাথ দাস । এঁদের দুজনের কাউকেই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি; প্রকৃতপক্ষে এঁদের সম্পর্কে কিছুই আমার জানা নেই । আমার পিতামহীকেও আমি দেখতে পাই নি; এমন কি, তাঁর নামও আমি জানি না । আমার বাবার দুই ভাই ছিলেন, বড় বরদা চরণ দাস ও ছোট বসন্ত দাস । ভারতী দাস নামে তাঁদের একজন বোনও ছিলেন । আমি কেবলমাত্র বাবার বড় ভাই তথা আমার জেঠামশায়কেই দেখেছিলাম । তিনি ছিলেন বিপত্নীক, তাঁর একটি অংশীদারি দোকান ছিল । সম্ভবতঃ তিনি মদ্যপায়ী ছিলেন, যদিও আমার বাবা কখনও মদ স্পর্শ করেননি । এই জেঠামশায়ও একদিন তাঁর কাজ থেকে ফিরে আমাদের পৈতৃক বাড়ীতেই আকস্মিক ভাবে দেহত্যাগ করেন । বাবা তখন শহরের বাইরে ছিলেন; মায়ের নির্দেশে আমার দাদাই দাহক্রিয়াদি সম্পন্ন করে । বাবার ছোট ভাই বা ওঁদের বোন সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই । এঁদের নাম সম্প্রতি (২০১৪-১৫) আমি আমার দিদির কাছ থেকে জেনেছি, দিদিরও এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ছিল না ।
আমাদের মাতুলালয় ছিল শ্রীহট্ট শহরের দাড়িয়াপাড়া নামক মহল্লায় । আমার মাতামহ ছিলেন রমেশ চন্দ্র দাস । তাঁকে আমি দেখেছি । তাঁর অনেকগুলো গরু ছিল; সম্ভবতঃ তিনি দুধ বিক্রী করতেন । । নিজেই গরুগুলোর যত্ন নিতেন । গরুকে না খাইয়ে নিজে কখনও অন্ন গ্রহণ করতেন না । তাঁর ছিল দুই বিয়ে । প্রথম পক্ষের সন্তানদের মধ্যে ছিলেন আমার মা, বড়মামা রমাকান্ত দাস ও ছোটমামা রাধিকা কান্ত দাস । দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানদের নাম ছিল ঋষি, সুনীল, রণু ও গঙ্গা । এঁদের সকলের মধ্যে আমার মা ছিলেন জ্যেষ্ঠ । অতি অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে তিনি মাতৃস্নেহে নিজের ছোট দুই ভাইকে মানুষ করেছিলেন । বৈমাত্রেয় ভাই বোনদের মধ্যে সদ্ভাব ও পারষ্পরিক ভালবাসা ছিল । আমার মাকে ভাইবোনেরা সবাই অত্যন্ত ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন । পিতৃকুলে তেমন কেউ না থাকায় আমরা মামাবাড়ীর সাথেই বেশী যুক্ত ছিলাম । আমাদের মাতৃকুলে অনেক মামা ছিলেন ও সেই সুবাদে অনেক মামাতো ভাই-বোনও ছিল বা আছে । মামাদের মধ্যে অনেককেই আমি দেখেছি, অনেকের কথাই সুস্পষ্ট মনে আছে । মামাতো ভাই-বোনদের অনেকের সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ আছে । এদের অধিকাংশই এতাবৎকাল বাংলাদেশের বাসিন্দা ছিল । অতি সম্প্রতি এদের অনেকেই আমেরিকায় বসবাসের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে । বিস্তারিত বিবরণের জন্য আমার "মামারা ও মামতো ভাই-বোনেরা" পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য ।
শিলচর শহরে অভিপ্রয়াণ
দেশভাগের অনতিকাল পরে সম্ভবতঃ ১৯৪৭ সালের শেষে (শ্রীহট্টের অন্তর্ভূক্তি সংক্রান্ত রেফারেণ্ডামের [7] পর) বাবা ছাপাখানার ম্যানেজারের কাজ নিয়ে শিলচর শহরে অভিপ্রয়াণ (migration) করলে আমরা পৈতৄক বাসস্থান চিরতরে ত্যাগ করলাম । বাবার শিলচরের প্রেসের মালিক ছিলেন বিগত দিনের কংগ্রেস সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ মোহন দেবের পিতা সতীন্দ্র মোহন দেব [8] । আমরা তখন পরিবারে চারজন ছিলাম; বাবা, মা, দাদা ও আমি । দাদা অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে শ্রীহট্টে মামবাড়ীতে থেকে গিয়েছিল । পরে এদেশে আমাদের সাথে যোগ দেয়।
দেশত্যাগের ফলে আমরা উদ্বাস্তু হলাম ও আমাদের পারিবারিক সচ্ছলতা হারালাম । আমাদের জমি-বাড়ীর সম্পত্তি, যেখানে যেমন ছিল, ফেলে চলে এলাম । পরবর্তীকালে পাকিস্থান সরকার এগুলোকে শত্রু সম্পত্তি গণ্য করে অধিগ্রহণ করে । শ্রীহট্টে বসবাসকারী আমার মামাতো ভাইদের কাছ থেকে পরে জেনেছি ওই জমি-বাড়ী মুসলমানেরা দখল করে ওখানে নতুন ঘর-বাড়ী বানিয়েছে ।
[পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন জন্মভূমি দর্শনের তীব্র বাসনা হৃদয়ে লালন করেছি । অবশেষে আমার সেই বাসনা পূর্ণ হয়েছে । ইতিপূর্বেই বলেছি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি (সস্ত্রীক) শ্রীহট্ট ভ্রমণ করে এসেছি । এই আনন্দময় ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ "আমার জন্মভূমি শ্রীহট্ট: দীর্ঘ প্রতিক্ষার একটি সফর" নামক পৃষ্টায় দেখা যাবে ।]
শিলচরে আমরা রেল স্টেশনের কাছে তারাপুর নামক স্থানে স্টেশনের বিপরীতে একটি গলির ভিতর ছোট একটি ভাড়া বাড়ীতে থাকতাম । আমার মা নিজেই গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ করতেন । আমার বয়স তখন ছিল বছর চার-পাঁচ । আমি পাড়ার স্কুলে (যা সম্ভবতঃ পৌরসভা পরিচালিত ছিল) ক্লাস বি (বর্তমানের কে জি ২ এর সমতুল্য) তে ভর্তি হই । স্কুলটি ছিল আমরা যে বাড়ীতে থাকতাম তার ঠিক উল্টোদিকে । শিলচরের সেই সময়ের অবস্থা সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু মনে নেই । তবে সেই সময়কার দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর কথা মনে আছে যখন সীমান্তের ওপার থেকে হাজার হাজার হিন্দু নিধনের ও হিন্দুদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের ভয়ঙ্কর সব সংবাদ প্রতিদিন সীমান্তের এপারে এসে পৌঁছুতো । ওই সময় একদিন আড়ালে থেকে আমি মা-বাবার যে কথোপকথন শুনেছিলাম তাতে আমি ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম । ওঁরা বলছিলেন ভৈরব নদীর [9] সেতুর উপর রেলগাড়ী ভর্তি হিন্দুকে মুসলমানেরা হত্যা করেছে । জীবন ও সম্মানের ভয়ে পালিয়ে আসা লোকজনদের মধ্যে যারা এ পারে পৌঁছুতে পারতেন তারা বয়ে আনতেন হত্যা, ধর্ষণ, লুঠতরাজ ও অন্যান্য জঘন্য অত্যাচারের ভয়াল বিবরণ । আমাদের দুই দিদি ও মামারা সপরিবারে পূর্ব-পাকিস্থানে থেকে গিয়েছিলেন; প্রতিনিয়ত ভয়াবহ ঘটনার সংবাদ ওদের জন্য আমাদের উদ্বেগ ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছিল । তবে শেষ পর্যন্ত এঁদের কারোরই শারীরিক কোন ক্ষতি হয়নি ।
শিলচর পরিত্যাগ: যোরহাট গমন
আমরা বেশীদিন শিলচরে ছিলাম না । দেশভাগের অস্থিরতা দূর হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই, সম্ভবতঃ ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে, বাবা উজানি আসামের যোরহাট শহরে প্রেস ম্যানেজারের চাকুরী নিয়ে শিলচর ত্যাগ করেন । প্রেসটি ছিল দাস এণ্ড কোং নামক ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর কর্তৃপক্ষের পরিচালনাধীন। প্রসঙ্গতঃ দাস এণ্ড কোং ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রথম ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর । আমার শৈশব এবং যৌবনের প্রথমাংশ যোরহাটেই কেটেছে । সেই সময়ের স্মৃতি আমি এখনও সযত্নে হৃদয়ে লালন করি ।
যোরহাটে বাবা নিজস্ব কোন জমি বা বাড়ী ক্রয় করতে পারেননি; আমরা বরাবর ভাড়া বাড়ীতে থেকেছি । বস্তুতঃ শ্রীহট্টে নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে আসার পর আমাদের নিজস্ব কোন ঘর-বাড়ী ছিল না । ১৯৭০ সালের শেষ ভাগে প্রথম আমার দাদা শিলচরে নিজের একটি বাড়ী তৈরী করে । এর অনেক পর ১৯৯৫ সালের শেষার্ধে আমি কোলকাতা সন্নিহিত সল্টলেকে সমবায় ভিত্তিক মালিকানায় একটি ফ্ল্যাট সংগ্রহ করি । যাক, সেগুলো অন্য কথা । আমার ফ্ল্যাট সংগ্রহের বিবরণ আমার ওয়েবসাইটের সংশ্লিষ্ট পাতায় দেয়া আছে ।
টিকা
[1] সূত্র: অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্বনিধি রচিত, "শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত" ।[2] শাহ জালাল ১২৭১ সালে জন্মেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে । বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক নথিপত্রে ওঁর জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে । ওঁর মাতা সৈদা হাসিনা ফতিমা ও পিতা মামুদ ইবন মোহম্মদ ইবন ইব্রাহিম মক্কার কুরাইশ গোষ্ঠীর বংশধর ছিলেন । জালালের পিতা একজন ধর্ম্মযাজক ছিলেন । তিনি অতীন্দ্রিয়বাদী সুফি রুমির সমসাময়িক ছিলেন । পুত্রের জন্মের পাঁচ বছর পর তিনি দেহত্যাগ করেন । জালাল মক্কায় তাঁর মামা সৈয়দ আহমেদ কবীর সুহরাবর্দীর কাছে শিক্ষালাভ করেন ও মানুষ হন । পড়াশুনায় তিনি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন; তিনি হাফিজ (কোরাণ যার মুখস্থ) হন এবং ফিক (ইস্লামী আইনশাস্ত্র) অধিগত করেন । তিনি মখদুম (সুন্নাহের শিক্ষক) হন । নিঃসঙ্গ পরিবেশে প্রার্থনা করার কারণে ও তপস্বীরূপে নির্জন জীবন যাপনের জন্য তাঁর নামের পেছনে আল মুজাররাদ যুক্ত হয় । দাবী করা হয় যে ৩০ বছরের অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং ধ্যানের দ্বারা তিনি আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা লাভ করেছিলেন। । (সূত্র: উইকিপিডিয়া)[3] জালালের মামা সৈয়দ আহমেদ কবীর জালালের হাতে এক আঁজলা মাটি দিয়ে তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশে যেতে বলেন । তিনি জালালকে নির্দেশ দেন যে ভারতের যে স্থানের মাটি তাঁকে দেয়া নমুনার সাথে বর্ণে ও গন্ধে হুবহু মিলে যাবে তিনি যেন সেই স্থানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম্মের প্রসার ঘটান । জালাল শ্রীহট্টে পৌঁছুন । মক্কা থেকে আসার পথে শেখ চাসমী পীর নামে যে মৃত্তিকাবিজ্ঞানী (পেডোলজিস্ট) জালালের সাথে যোগ দিয়েছিলেন শেখ ফারুকের সিলেট জয়ের পর তিনি জালালের সাথে আনা মাটির নমুনার সঙ্গে সিলেটের মাটি পরীক্ষা করে দেখেন তারা অভিন্ন । জালাল ও তাঁর অনুগামীরা সিলেটে বসতি স্থাপন করেন ও ইসলাম ধর্ম্ম প্রচারে রত হন । (সূত্র: উইকিপিডিয়া)[4] নেলী হল আসামের নওঁগা জেলার একটি অংশ । ১৯৮৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী এই এলাকার ১৪টি গ্রামের ১৬০০ থেকে ২০০০ জন বাঙ্গালী মুসলমানকে হত্যা করা হয় । বিদেশী সনাক্তকরণ ও বিতাড়নের জন্য আসাম আন্দোলন চলাকালীন ও কেন্দ্রীয় সরকারের চল্লিশ লক্ষ বাঙ্গালী মুসলমানকে ভোটাধিকার দেয়ার পরিপ্রক্ষিতে আসামের ১৯৮৩ সালের বিতর্কিত বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের (অধিকাংশই গ্রাম্য চাষী) দ্বারা সংঘটিত হিংসাত্মক ঘটনায় এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানা যায় । (সূত্র উইকিপিডিয়া)[5] মায়ের বক্তব্যে দিন ও তারিখের এই পরষ্পর বিরোধীতায় মনে হয় আমার জন্ম হয়েছিল ৪ঠা ফেব্রুয়ারী মধ্যরাতের পর যা বস্তুতঃ ৫ই ফেব্রূয়ারী ১৯৪৩ সাল ।[6] ওঁদের সময় মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রচলন ছিল না বল্লেই হয় । খুব অল্প সংখ্যক মহিলাই ঐ সময় মিড্ল স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরেছিলেন । একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে ভারতে মহিলাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ছিল ছয় শতাংশ ।[7] আমার ক্ষীণভাবে মনে পড়ে দেশত্যাগের কিছুদিন আগে শ্রীহট্টের রেফারেণ্ডাম জাতীয় কিছু একটা শুনেছিলাম । পরে বড় হয়ে জেনেছি কেবলমাত্র শ্রীহট্টের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে অনুষ্ঠিত এই রেফারেণ্ডামের ভিত্তিতে শ্রীহট্ট তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত হয় । বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় এই রেফারেণ্ডাম হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ৬ই ও ৭ই জুলাই । মূলতঃ শ্রীহট্ট ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি এবং আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত । যদিও এই রেফারেণ্ডামের ফলে আসাম পাকিস্তানের কাছে একটি সম্বৃদ্ধশালী জেলাকে হারাল অসমীয়া জনসাধারণ সাধারণভাবে ইহাকে স্বাগত জানাল; ইহা তাদের নিজেদের জন্য একটি সমজাতিক রাজ্য গঠনের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা বাস্তবায়িত করার পথ প্রশস্ত করল । বিশদ বিবরণের জন্য http://www.legalservicesindia.com/law/article/924/18/Sylhet-Referendum-1947 দেখা যেতে পারে । [8] ইনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং পরবর্তী কালে রাজ্যের একজন মন্ত্রীও হয়েছিলেন ।[9] ভৈরবনদী বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের একটি নদী । এটি গঙ্গানদীর একটি শাখানদী । খুলনা শহরকে দ্বিধা বিভক্ত করে নদীটি ঐ শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে । মেহেরপুর জেলার টেঙ্গামারি সীমানা থেকে উৎপন্ন হয়ে এটি যশোর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ।