আমার জীবনে নারী
ভূমিকা
আমি মনে করি একজন মানুষের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে তার চরিত্রের সকল দিক জানা প্রয়োজন । তার আবেগ ও অনুভূতির যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে তার জীবনে নারীর ভূমিকা পর্যালোচনা করা অত্যাবশ্যক । আমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার বিবাহ অধ্যায়ে বিস্তারিত বলেছি । এখানে অন্যান্য নারীদের কথাই বলব । আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক নারীর আগমন ঘটেছিল । একথা গোপন করার বা বলতে লজ্জিত হওয়ার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না । নারী-পুরুষের ভালবাসা বিধির চিরন্তন নিয়মেই ঘটে থাকে । কখন কার প্রতি কে আকৃষ্ট হবে তার কোন বাধাধরা ছক নেই । সময় ও সুযোগের প্রভাবেই তা ঘটে থাকে । বয়স, সম্পর্ক কোন কিছুই এর স্বাভাবিক গতিকে রোধ করতে পারে না । তাই অনাদিকাল থেকে বহুলাংশ নারী-পুরুষের জীবনেই একাধিক পুরুষ বা নারীর আগমন ঘটেছে । কখনো প্রকাশিত ভাবে, কখনো বা অপ্রকাশিত ভাবে । ভালবাসার সঙ্গে কামনার একটি অবিচ্ছদ্য সংযোগ রয়েছে ঠিকই, তবে কামনাই যদি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় তবে তা আর ভালবাসা থাকে না । অনাবিল ভালবাসা স্বর্গীয় আনন্দের বাহক । আমার জীবনে আমি তা একাধিকবার উপলব্ধি করেছি ।
আমার নারীদের কাউকে আমি হয়ত একতরফা ভাবে মন থেকে ভালবেসেছিলাম, কেউ কেউ হয়ত আমাকে ভালবেসেছিলেন বা আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন কিন্তু আমি সাড়া দিতে পারি নি । আবার কারো ক্ষেত্রে এই ভালবাসা হয়ত ছিল উভয়তঃ । আমার জীবনকে অবারিত করতে এই অংশের উদ্ঘাটন প্রয়োজনীয় । এই বিষয়টি ব্যতিরেকে আমার জীবন কাহিনীর বিশেষ করে আমার আবেগ ও অনুভূতির চিত্রায়ন অসম্পূর্ণ থাকবে । তাই আমার জীবন কাহিনীতে এর অবতারণা । আমি মনে করি না এতে লজ্জার বা লুকোবার কিছু আছে ।
আমার বাল্যের অধরা প্রেম
আমার প্রথম ভালবাসা যা ছিল অধরা, যা ছিল এক তরফা, তাই দিয়ে শুরু করছি । তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় আমার অনুভূতির প্রতিফলন ঘটাতে আমি বিষয়টি পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিবৃত করছি । আমার জীবন কাহিনীর ইতিমধ্যে কথিত অংশের কোথাও কোথাও তোষিতা নাম ধারিণী আমার এই ভালবাসার পাত্রীর উল্লেখ থেকে থাকবে ।
আমার বিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি বলেছি যে সেই সময় বিদ্যালয়ের মেয়েদের সাথে মেশা ত দূরের কথা, ওদের সঙ্গে আমি কথাই বলতাম না । আমি এতটাই লাজুক ও অন্তর্মুখী ছিলাম।
এতদ্সত্বেও আমি অতি অল্প বয়সে আমারই ক্লাসের কোন একজন মেয়েকে গভীরভাবে ভালবেসে ছিলাম, যদিও আমার ভীরুতা ও কুণ্ঠার কারণে আমি তাকে তা বলতে পারিনি । বিদ্যালয়কাল থেকে যার সঙ্গে দেখা বা পরবর্তী কয়েক দশক পর্যন্ত বাক্যালাপও হয়নি আমার সেই ভালবাসার জনের নাম ও প্রতিচ্ছবি দীর্ঘকাল আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গভীরভাবে অঙ্কিত ছিল । আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুসহ কেউ তা জানতে পারেনি । আমার জীবনের অনুরাগজনিত সেই অংশ যা দশকের পর দশক প্রকাশের সুযোগ না পেয়ে হৃদয়ের গভীরে লুক্কায়িত ছিল আজ তাকে প্রকাশ করার সময় এসেছে । কাল চলে যায়, অনুভূতি বিলীন হয়ে যায় কিন্তু স্মৃতি থেকে যায় । সেই স্মৃতি আমরা হৃদয়ের গভীরে বয়ে বেড়াই । কখনো তা প্রকাশ পায়, কখনো বা অপ্রকাশিতই থেকে যায় ।
আমার প্রথম ভালবাসা, আমার সেই অনুভূতি
আমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন আমাদের মধ্যে একটি অবাঙালী মেয়ে এল । ধরে নেয়া যাক তার নাম তোষিতা উপাধ্যায় । তোষিতা একটি সম্বৃদ্ধ ও সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবার থেকে এসেছিল । সে চমৎকার বাংলা বলত । সে ছিল সুন্দরী, রং ছিল চাপা, স্বর ছিল মধুর । তার চুল ছিল বব্-কাট, সে নাচও শিখত ।
তোষিতা আমাদের স্কুলে মাত্র বছর খানেক ছিল । কিন্তু নিজের অজান্তে সে আমার মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল । বরাবরই আমি সুন্দরের পূজারী । যেদিন ওকে প্রথম দেখলাম সেদিন সেই মুহূর্তেই ওকে আমার ভাল লেগে গেল; ওর প্রতি আমার মনে এক বিশেষ মুগ্ধতা তৈরী হল । সততার সাথে বলতে গেলে বলতে হয় আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম । প্রকৃতপক্ষে বয়ঃসন্ধি কালে ও-ই আমার মনে ভালবাসার অনুভূতি জাগরুক করেছিল, বস্তুতঃ ওকে দেখার আগে পর্যন্ত আমার মধ্যে রোমান্টিক ভালবাসার জন্ম হয়নি । এই অনভূতি জাগ্রত হওয়ার পর থেকে ওর সাক্ষাতে আমি হৃদয়ে এক অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করতাম যা পরবর্তীকালে কখনো কোন মেয়ে বা নারীর সান্নিধ্যে অনুভব করিনি । ক্লাসে আমার চোখ সর্ব্বদা ওকে খুঁজে বেড়াত, আমার সান্নিধ্যে ওর উপস্থিতি আমাকে আনন্দে ভরিয়ে দিত । ক্লাসে ওর অনুপস্থিতি আমাকে হতাশ করত; সেদিনটি আমার কাছে অর্থহীন হয়ে যেত; কোন বিষয়েই আমি মনোসংযোগ করতে পারতাম না । ওর প্রতি আমার ভালবাসা ও অনুভূতি এত তীব্র ছিল । এই অনুভূতি যৌন লালসা বা তা পরিতৃপ্তি-প্রচেষ্টার অনুভূতিকে অতিক্রম করে একান্ত ভাবেই বন্ধুত্ব ও একাত্মতা বোধক ছিল । কবিগুরুর, "আমি তোমার সঙ্গে বেধেছি আমার প্রাণ" এই গানের কলিতে যেন এই অনুভূতিই, এই আকুলতাই গুঞ্জরি ওঠে । আমার এই ভালবাসাও ছিল একতরফা নির্বাক ভালবাসা, আমার প্রতি তোষিতার মনোভাব বা অনুভূতি সম্বন্ধে জানার অবকাশ আমার কখনও হয়নি । সেই অর্থে ওর সঙ্গে কখনও আমার কথোপকথনও হয়নি । তবে বহুকাল পরে টুকরো টুকরো ঘটনার ভিত্তিতে ওর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে ও বোধহয় আত্মম্ভরী ছিল, হয়ত আমার প্রতি ওর কোন দুর্বলতাও ছিল না ।
আমি তোমার সঙ্গে
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে
তুমি জানো না, আমি তোমারে পেয়েছি
অজানা সাধনে
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ
তুমি জানো না
ঢেকে রেখেছি তোমার নাম
রঙ্গীন ছায়ার আচ্ছাদনে
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে
তোমার অরূপ মূর্তিখানি
ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি
অরূপ মূর্তিখানি
বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে
বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী
গানের তানের সে উন্মাদনে
তুমি জানো না, আমি তোমারে পেয়েছি
অজানা সাধনে
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধন
বাক্যালাপের একমাত্র ঘটনা
আমার বিদ্যালয় জীবনে একবারই ওর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল । একদিন ও স্কুলে পড়ে গিয়েছিল । তখন ওকে রিক্সায় করে বাড়ী পৌঁছে দেয়ার ভার আমার উপর পড়েছিল । আমাদের সহ-প্রধান শিক্ষক রতন মোহন গাঙ্গুলী মহাশয় আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন । আমি খুব উল্লসিত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম রিক্সায় যেতে যেতে ওকে আমার ভালবাসার কথা জানাব । পথে যেতে যেতে আমি ওকে কোথায় আঘাত লেগেছে জিজ্ঞাসা করলে ও আমাকে আঘাতের জায়গাটি দেখাল । স্কুলজীবনে ওর সঙ্গে এই আমার প্রথম ও শেষ কথোপকথন, অবশ্য এটাকে যদি কথপোকথন বলা যায় । আমার কুণ্ঠা ও তোষিতার নিরবতায় (হয়ত আঘাত জনিত ব্যথায়) বাকী পথ আমরা মৌন হয়েই রইলাম । ওদের বাড়ী পৌঁছুলে ওর মা আমায় ভেতরে ডাকলেন ও বসিয়ে এক গ্লাস জল দিলেন; স্মর্তব্য, তখনও নরম পানীয়ের আবির্ভাব হয়নি । তোষিতা সরাসরি নিজের ঘরে চলে গেল । পরবর্তীকালে তোষিতাকে আমার হৃদয়ের কথা শোনাবার আর কোন সুযোগ হয়নি ।
কঠোর সামাজিক অনুশাসন জনিত বাধা
আমাদের সেদিনের রক্ষণশীল সমাজে[1], বিশেষ করে আমাদের মত ছোট শহরে, লোকের ভ্রূকুটি উৎপাদন না করে ছেলে ও মেয়ে একত্রে মেলামেশা করতে পারত না । আমার পক্ষে তা আরও কঠিন ছিল । আমি মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলাম । কোন মেয়ের সঙ্গে আমার প্রকাশ্যে মেলামেশা, বিশেষ করে আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপটে, শহরে সমালোচনার ঝড় তুলতে পারত, যা আমাদের উভয়ের সুনামের পক্ষে ক্ষতিকারক হত । আমাদের পরিবারের উপরও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারত । তাই স্কুলের বাইরে কোথাও তোষিতার সঙ্গে দেখা করার প্রয়াস নিই নি ।
আজকের মত তখন সেলফোন ও ইন্টারনেট ছিল না । তোষিতার সঙ্গে একান্তে কথা বলার জন্য সময়ের অনেক আগে আমি স্কুলে চলে যেতাম এই আশায় যে তোষিতা যদি কখনো অন্যদের আগে স্কুলে পৌঁছৈ যায়, তবে একান্তে কথা বলার সুযোগ পাব । কিন্তু সেই সুযোগ কখনও আসে নি । তাই যদিও আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে ওর সঙ্গে গভীর ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম আমি কখনো তা ওর গোচরে আনতে পারিনি । ফলে আমার প্রতি ওর উপলব্ধিও আমার অজানা রয়ে গেছে । আমার মধ্যে যে ভালবাসার জন্ম হয়েছিল ভালবাসার জনের কাছে পৌঁছে দিতে না পারায় তা অধরাই রয়ে গেল ।
আমি ছিলাম অন্তর্মুখী বা ইন্ট্রোভার্ট; তোষিতা সম্পর্কে আমার মনোভাব আমি বন্ধুদেরও, যারা ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপনে হয়ত সাহায্য করতে পারত, জানাতে পারিনি ।
[1] তোষিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে আমাদের এক সহপাঠিকে (বর্তমানে প্রয়াত} প্রধান শিক্ষকের বেত্রাঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছিল । তবে এর ফলে তোষিতার প্রতি আমার অনুভূতির কোন হেরফের হয়নি ।
তোষিতার বিদ্যালয় পরিত্যাগ
সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি তোষিতা স্কুল ছেড়ে চলে গেছে; ভেবেছিলাম সপ্তম শ্রেণীতে প্রমোশন পেয়ে অন্য মেয়েদের মত ও বোধহয় মেয়েদের প্রাতঃকালীন বিভাগেই গেছে । একদিন মেয়েদের স্কুল ছুটির সময় ওর সঙ্গে দেখা করব বলেও ঠিক করেছিলাম । এমন সময় ওর স্কুল ছেড়ে যাওয়ার সংবাদটি পেলাম, কিন্তু কোথায় গেছে তার কোন সূত্র পেলাম না । সেই সময়ের কঠোর সামাজিক অনুশাসনের দরুণ ওর বাড়ী গিয়ে খোঁজ করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি; ভাষা, সংস্কৃতি ও বর্ণগত দিক থেকে আমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য ছিল । আর্থিক দিক থেকে দুর্লঙ্ঘ্য বিভেদ ত ছিলই ।
মেট্রিকের ফলে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া
মেট্রিক পরীক্ষায় ব্যতিক্রমী ফল জানার পর সকলের আগে যার কথা আমার মনে পড়েছিল সে ছিল তোষিতা । কিন্তু ঐ সময় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাব্যাপী গুরুতর ভাষা দাঙ্গার দরুন প্রথমে কার্ফু জারি থাকায় গৃহবন্দী ছিলাম । পরে সাময়িক ভাবে আমাদেরকে যোরহাট ছেড়ে চলে যেতে হয় । তাই সেই সময় আমি তোষিতার খোঁজ নেয়ার সুযোগ পাই নি । হয়ত তখন ওর সঙ্গে হৃদ্যতা স্থাপনের উপযুক্ত সময় ছিল । কিন্তু সময় আমার সহায় ছিল না । পরবর্তীকালে অনেক চেষ্টা করেও ওর খোঁজ পাই নি ।
দীর্ঘদিন পর তোষিতার সাথে যোগাযোগ
বেশ কয়েক দশক পর তোষিতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল । আমার এক বন্ধু ওর সেল ফোন নম্বর যোগাড় করে দিয়েছিল । তোষিতা তখন ব্রহ্মকুমারী [1] নামক এক আন্তর্জাতিক আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যা, আধ্যাত্মিক উত্তরণের চর্চায় রতা । ওর কাছ থেকে জানলাম ওর জীবনে যখন চরম অস্থিরতা ও অশান্তি এবং ও শান্তির আশায় চারদিকে ছুটাছুটি করছে, সেই সময় একদিন শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা মাতৃসমা এক রমণীর সাথে দেখা হয় । ঐ রমণীই পথ দেখিয়ে ওকে ব্রহ্মকুমারীর আশ্রয় নিতে বলেন । সেই প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়া কর্ম্মের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওর মনে হয় এটাই ওর উপযুক্ত স্থান । যার সন্ধানে সে ছুটে বেড়াচ্ছে তা সে এখানেই পাবে । সেটা দীর্ঘদিন পূর্বের কথা, সেই থেকে ও এই পথ ধরেই এগোচ্ছে । কথায় কথায় জানলাম মেট্রিক পরবর্তী পর্যায়ে আমি যখন ওর খোঁজ করছিলাম তোষিতা সেই সময় শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশুনা করছিল । ওখান থেকেই ও সঙ্গীতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে । আমাদের এই কথোপকথনের সময় ও যোরহাটেই থাকত; আমাকে ওর বাড়ীর দিক নির্দেশও দিয়েছিল । কথা হয়েছিল আমি একদিন ওর সাথে দেখা করতে এবং ওর গান শুনতে যাব । কয়েক বছর পর আমি ওর দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী যোরহাটে ওর বাড়ী খুঁজে বার করেছিলাম । কিন্তু ততদিনে ও সেই বাড়ী বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে । ওর পড়শীর কাছ থেকে ওর নতুন বাড়ীর একটি মোটামুটি দিক নির্দেশ পেয়েছিলাম । কিন্তু সেই বাড়ী আমি আর খুঁজে বার করতে পারি নি । এরপর ওর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি ।
আমাদের ঐ কথোপকথনের সময় আমি ওর পরিবারের গঠন, বৃত্তি ইত্যাদি সম্পর্কেও জানতে পেরেছিলাম । জেনেছিলাম ওর এক পুত্র ও দুই মেয়ে; এক মেয়ে বিয়ে করেনি, ওর সাথেই থাকে ।
ভালবাসার জন্ম, তীব্রতালাভ ও নিম্নগমন
আমার বয়স যখন ১২-১৩ বছর সেই সময় তোষিতার প্রতি এক প্রদীপ্ত ভালবাসার বীজ আমার হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল । এক বছর পর ও বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায় । তারপর ওর সাথে আমার দেখা হয়নি, জীবনের শেষ পর্যায়ের পূর্ব পর্যন্ত কথাও হয়নি । কিন্তু ওর প্রতি আমার ভালবাসা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমার সম্পূর্ণ হৃদয় অধিকার করে নেয় । এই ভালবাসা মরে যায় নি, হৃদয়ে প্রোথিত থেকে আমার একাকীত্বের মুহূর্তগুলিকে আনন্দ ও দুঃখের সংমিশ্রণে এমন এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে মহিমান্বিত করেছে যা কেবল অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না ।
এই মেয়েটির প্রতি ভালবাসায় দীর্ঘ এক দশকের অধিক আমার হৃদয়-মন বিবশ হয়ে ছিল । আমার বাল্যের ভালবাসার পাত্রীকে যে চোখে দেখেছিলাম অন্য কাউকে সে চোখে দেখতে পারিনি ।
পরবর্তীকালে যোগাযোগ ও দর্শনের অভাবে ও সময়ের প্রভাবে এই ভালবাসার তীব্রতা হ্রাস পেতে পেতে সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, রেখে যায় শুধু স্মৃতিটুকু ।
তবে আমার এই ভালবাসা হয়ত আমাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পথে এগোতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
স্মৃতি মলিনতা
পুষ্টিকরণের অভাবে তরুলতা যেমন কালক্রমে শুকিয়ে যায় তোষিতার প্রতি আমার ভালবাসাও যোগাযোগের অভাবে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গিয়েছিল । সেই সময় তোষিতা কদাচিৎ আমার মনের আয়নায় দেখা দিত । তবে যখনই আমি সঙ্গীবিহীন অবস্থায় বিমর্ষ বোধ করতাম তখনই ওর স্মৃতি আমাকে উজ্জীবিত করে তুলত । কৈশরের এই একতরফা ভালবাসার স্মৃতি দীর্ঘকাল আঁকড়ে থাকার বিষয়ে মনোবিদরা কি বলবেন জানি না, তবে যা ছিল আমার একান্ত তাই আমি এখানে ব্যক্ত করলাম ।
বিদ্যালয় পরবর্তী প্রথম যৌবন
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে দু-একজন নারী আমার প্রতি তাদের আগ্রহ প্রদর্শন করেছিলেন । বিদ্যালয় পরবর্তী কলেজ জীবনে স্নাতক পাঠকালে আমার এক সহপাঠিনি আমার প্রতি তাঁর ভালবাসার ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন । কিন্তু আমি তখন জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়নে নিমগ্ন থাকায় তার ডাকে সাড়া দিতে পারি নি । চাকুরী জীবনের প্রারম্ভে অপর এক নারী আমার প্রতি তীব্রভাবে আকর্ষিত হয়েছিলেন । সে সম্পর্কে বিস্তারিত পরবর্তী অনুচ্ছেদে বলেছি ।
এ ছাড়া আমার জীবনের কোন এক বিশেষ সময় এক দূর্বল মুহূর্তে অপর এক নারী আমার জীবনে প্রবেশ করেছিল । সেও ছিল সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী ও পোসেসিভ । ওর সান্নিধ্যে আমি আরেকবার (তোষিতার পর দ্বিতীয়বার) প্রকৃত ভালবাসার স্বরূপ ও তার স্বর্গীয় মহিমান্বিত অনির্বচনীয় আনন্দ হৃদয়ে উপলব্ধি করেছিলাম । আমি ওকে গভীর ভাবে ভালবেসেছিলাম । আমার মনে হয়েছিল, সে ও আমাকে গভীর ভাবে ভালবাসে । হয়ত তা ঠিক, হয়ত বা তা ঠিক নয় । তবে এটা ঠিক, এই সম্পর্ককালে আমি স্বর্গীয় আনন্দ উপলব্ধি করেছি ।
যে নারী দৃশ্যতঃ আমাকে গভীর ভাবে ভালবেসেছিল
এটা ঘটেছিল আমার কোন এক চাকুরীস্থলে, চাকুরী জীবনের প্রথম দিকে । সেটা ছিল ১৯৭০ সালের শেষ বা ১৯৭১ সালের শুরু । আইন প্রয়োগকারীদের (Law Enforcement) একজন সরকারী আধিকারিক বদলী হয়ে সপরিবারে আমার কর্ম্মস্থলে এলেন এবং আমার প্রতিবেশী হয়ে তার নির্দিষ্ট সরকারী বাসভবনে উঠলেন । আমি তখন গাড়ী চালাতে শুরু করেছি । ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে সরকারী সফরে গাড়ী নিয়ে জেলা সদর সহ নানা স্থানে যাতয়াত করছি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই । এরূপ অবস্থায় একদিন ডাকে একখানা চিঠি পেলাম । Well-wisher (শুভানুধ্যায়ী) হিসাবে কেউ একজন আমাকে গাড়ী না চালাতে অনুরোধ করে চিঠিখানা লিখেছিলেন । চিঠিটি ছিল মেয়েলি হাতে লেখা । আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম কে এটি লিখেছেন । তিনি ছিলেন আমার নতুন প্রতিবেশীর কন্যা, সুন্দরী, গৌরবর্ণা যদিও কিঞ্চিৎ খর্বকায়া । নিজেকে প্রকাশ না করে এইভাবে তিনি প্রথমবার আমার জন্য তার উদ্বেগ প্রকাশ করেন । লেখিকাকে সনাক্ত করতে পারলেও আমি চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম । তবে চিঠিটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষাও করতে পারলাম না; এরপর গাড়ী চালাবার সময় কাণে বাজতে থাকা ঐ অনুরোধ আমাকে সজাগ করে অধিকতর সাবধান হতে প্রণোদিত করত । চিঠিটিতে আমার জন্য অপরিচিতা লেখিকার উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল । এর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন ।
পরবর্তীকালে ঐ গৌরবর্ণা সুদর্শনা নারী একাধিকবার বিভিন্ন ভাবে আমার জন্য ওঁর ভালবাসা ও উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন । আমার যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে তবে আমার বিরুদ্ধে জেল ওয়ার্ডারদের চক্রান্তের[2] খবর মহকুমা শাসকের কাছে পৌঁছোনর পশ্চাতেও ওঁরই মুখ্য ভূমিকা ছিল । ওঁর আচার আচরণে আমার মনে হয়েছে উনি আমাকে প্রগাঢ় ভাবে ভালবাসেন এবং আমার সাথে একই তরীতে ভাসতে ব্যকুল । একবারের বেশী ওঁর সাথে আমার বাক্যালাপ হয়নি, আর তাও হয়েছিল দুই-তিনটি শব্দে । তার সূত্র ধরে উনি ওঁর হৃদয় উন্মোচিত করেছিলেন । সেটা ছিল এক শীতের সকাল । আমি তিস্তা নদীর বাঁধ ধরে প্রাতর্ভ্রমণ করছিলাম । উনি ওঁর বান্ধবীকে দূরে সরিয়ে একাকিনী বসে ছিলেন । আমি পেরিয়ে যওয়ার পর পিছন থেকে "শুনুন" বলে ডেকে দাঁড় করিয়ে উনি ওঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন । ওঁর কথা শুনে আমি বেদনাহত হয়েছিলাম । কিন্তু ওঁকে বলার বা দেয়ার আমার কিছু ছিল না । সেই সময় আমি অবিবাহিত ছিলাম ঠিকই, কিন্তু ইতিমধ্যে আমার পছন্দ অন্যত্র স্থির হয়ে গিয়েছিল এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পথেও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল ।
ঐ রমণী কিছুদিন পর পরিবারের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান । কিন্তু তিনি আমার প্রতি ওঁর ভালবাসা হৃদয়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন । আমি যখন বদলি হয়ে আমার নতুন স্থানে কর্ম্মরত সেই সময় একদিন ওঁর পিতা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন । পূর্ববর্তী স্থানে ব্যক্তিগত স্তরে আমাদের আলাপ ছিল না, যদিও সরকারী স্তরে ওঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল । । এমতাবস্থায় আমার খোঁজখবর নিতে আমার সাথে ওঁর দেখা করার কোন কারণ ছিল না, যদি না তা ওর কন্যাদ্বারা প্রভাবিত হওয়ার দরুণ হয়ে থাকে । তাই আমার বিচারে ওঁর কন্যাই ওঁকে পাঠিয়েছিলেন আমার খোঁজ নিতে । ওর কন্যার হৃদয়ে আমার প্রতি ভালবাসা যে অটুট ছিল এটাই তার পরিচায়ক । সময় বা দূরত্ব কিছুই এর উপর প্রভাব ফেলতে পারে নি । সত্যিকারের ভালবাসার এটাই ধর্ম যা আমি কৈশরের প্রভাত কাল থেকে উপলব্ধি করেছি । যাহোক, ওঁর পিতা কৌশলে আমার বৈবাহিক অবস্থান জেনে নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন । সেই শেষবার এই বিষয়ের অবতারণা হয়েছিল ।
আমি ওর জন্য কষ্ট পেয়েছিলাম, যদিও ওঁর অনুভূতি জাগাবার মত কিছু আমি করিনি । অজান্তে ওঁর বেদনা ও হতাশার কারণ হওয়ায় আমি মাঝে মাঝে তীব্র বেদনা বোধ করি । অনুভূতি-সম্পন্ন মানুষ হওয়ার বোধহয় এটাই অভিশাপ ।
নারী-পুরুষের ভালবাসা সম্পর্কে আমার উপলব্ধি
আমার কাছে ভালবাসা যতটা না শারীরিক তার চাইতে অনেক বেশী এক প্রগাঢ় অনুভূতি । আমার জীবনে এই দুর্লভ তীব্র অনুভূতি দুবার এসেছিল, প্রথমবার শৈশবে আর দ্বিতীয়বার প্রাপ্তবয়সে । প্রথমবার একতরফা (বাল্যের অধরা প্রেম), দ্বিতীয়বার যুগ্ম সাধনে । আমি নির্বিদ্বধায় বলতে পারি দুবারই আমি উচ্ছ্বসিত আনন্দ ও প্রকৃত ভলবাসার স্বর্গীয় রূপ উপলব্ধি করেছিলাম । যদিও প্রথমবার ছিল আমার একক মনের অনুভূতি, অন্য পক্ষের কোন সক্রিয় ভূমিকা ছিল না ।
তবে পার্থিব চাহিদা সম্পন্ন চিরাচরিত কোন আধুনিকা নারীর পক্ষে আমার নীতি ও মূল্যবোধ প্রধান জীবনের সাথে মানিয়ে নেয়া কষ্টকর ছিল বলেই আমার বিশ্বাস ।