Writer
ভারতবর্ষের মাটিতে সুপ্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি অনেক মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে । তাঁদের মধ্যে কেউ ধর্মীয়, কেউ রাজনৈতিক, কেউ সামাজিক কেউবা সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ নিজ স্বকীয় মহত্বের সাক্ষ্য রেখে গেছেন । যা মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনে তাঁদের স্মরণ করতে বাধ্য করে । মানুষই মানুষের রক্ষক আবার এই মানুষই মানুষের কাছে হয়ে ওঠে চরমতম ভক্ষক । মানুষই মানুষকে করে শোষণ, বঞ্চনা; আবার মানুষই মানুষের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য জীবন পণ করে । বিভিন্ন সময়ে শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য অনেক মহাপুরুষ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন; তাঁরা অবতীর্ণ হয়েছেন পরিত্রাতার ভূমিকায় । এই তালিকায় অনেক মহাপুরুষের নাম উঠে আসে । কিন্তু, আমরা শুধুমাত্র ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর এঁদের সম্পর্কে আলোচনা করবো । আমরা দেখব এঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছেন এবং এঁদের মধ্যে কোনো সমন্বয় সাধন করা যায় কী না ।
আমরা যারা ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর এঁদের দর্শন, কর্ম ও বানী অনুসরণ করে যৌক্তিক ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলি, তাদেরকে প্রায়ই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, যে, তোমরা ভগবান ঠাকুর হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের পাশে কেন বাবাসাহেব আম্বেদকরকে বসাও ? ঠিক তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতেই আজ এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা ।
আমরা একটা কথা ভালো ভাবেই জানি , “যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর”। তবু, যে দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই প্রশ্ন করুক না কেন, প্রশ্নকর্তাদের প্রশ্ন অবশ্যই সঙ্গত । সাধারণ দৃষ্টিতে আমরাও তো দেখি ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ধর্মীয় পথে পতিতপাবন হয়েছেন এবং বাবাসাহেব আম্বেদকর রাজনীতির পথ ধরে হয়েছেন শোষিত, বঞ্চিত দলিত জাতির মসিহা । এঁদের মধ্যে তথা ধর্ম আর রাজনীতির সমন্বয় কী ভাবে সম্ভব ? এমন সহজ সরলীকরণে আমরা অনেকেই বিশ্বাসী । মজার ব্যাপারটা হল – ধর্ম বলি, রাজনীতি বলি আর সংস্কৃতিই বলি, এসব কাদের জন্য ? সবটাই তো মানুষের জন্য । কোনও ধর্মপ্রাণ মানুষ কী কোনও দেশের সীমানার মধ্যে বসবাস করেন না ? না কী কোনও সামাজিক প্রাণী নয় ? ধর্মীয় পথে যে মানুষটি আত্মমুক্তি খুঁজছেন, তাকে কোনো না কোনো ভাবে রাজনৈতিক বদান্যতায় রাজশক্তির লালনে পালনেই সমাজ সংসারে বসবাস করতে হয় । হিমালয়ের চূড়ায় গিয়ে আধ্যাত্মিক পথে বৈরাগ্য সাধনে আত্মমুক্তির সন্ধানে বসলেও, সেটাও কোনো না কোনো দেশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভূক্ত । বলা যায় রাজনীতি ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক । যেখানে আমাদের পালনীয় ধর্ম তো প্রশস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম । গুরুচাঁদ ঠাকুরই বলেছেন – “ রাজশক্তি বিনা দেখ গৃহস্থ বাঁচে না । শক্তি বিনা জীবমধ্যে পরাণ নাচে না” । সুতরাং, কখনও যদি রাজশক্তি বিরূপ হয়, তবে ধর্ম পালনে তার প্রভাব পড়বেই । আবার কখনও যদি ধর্ম বিকৃত হয় তবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে । রাজনৈতিক শক্তি স্থির করে, দেশের জনগণ কোন্ কোন্ নিয়ম-শৃংখলার মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ সুন্দর নিরাপদ জীবন যাপন করবে । যথার্থ ধর্ম শেখায়, ওই নাগরিক মানুষটিই আরো কত সুন্দর ভাবে ভিতরে বাইরে সমান্তরাল ভাবে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে ।
এবার দেখা যাক ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে, কীভাবে এই মানুষের জন্য নিজ নিজ কর্মপ্রণালী দ্বারা মহৎ কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গেছেন ।
একটা কথা প্রমাণীত সত্য যে, আমরা বঞ্চিত, অবহেলিত ও শোষিত শ্রেণির জনজাতির মানুষ । মহামানব হরিচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণের হাত থেকে মুক্তির জন্য শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষকে দিয়েছেন সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী ধর্ম, আত্মোন্নয়ন ও আত্মজাগরণের ধর্ম ‘মতুয়া ধর্ম’ । তদ্পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর সেই মহান ‘মতুয়া ধর্মে’রই প্রচার প্রসার ঘটিয়েছেন ওই শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তিকে আরো ত্বরান্বিত করার জন্য । পক্ষান্তরে দেখি বাবাসাহেব আম্বেদকরও এই দলিত শোষিত বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের আত্মসম্মান ও মুক্তির জন্যই আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন । অতি অদ্ভূত ভাবেই এই তিন মহামানবেরই আন্দোলনের একমাত্র উপজীব্য সেই বঞ্চিত শোষিত অবহেলিত মানুষ । এঁদের প্রত্যেকের লড়াইটাই একই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, পিছিয়ে রাখা মানুষের স্বার্থে ।
ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর । প্রথম দুইজন ভারতের পূর্বপ্রান্তে, অপরজন অবস্থান করতেন ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে । এই পূর্বপশ্চিমের মিলন কখনও ঘটেনি, ঘটতেও দেওয়া হয়নি । অথচ, কী অদ্ভূত ভাবে এঁদের কর্ম আন্দোলনের অভিমুখ মিলিত হয়েছে সেই একটি বিন্দুতেই । মিছেই আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে এঁদের তারতম্য চিহ্নিত করতে যাই ।
এবার দেখা যাক ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ও বাবাসাহেব আম্বেদকর শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে কে কী বলেছেন এবং তার মধ্যে কোনও সমীকরণ হয় কী না ।
প্রথমেই আসি আদর্শ চরিত্র গঠনে মানুষের করণীয় সম্পর্কে ঠাকুর হরিচাঁদ এঁর কী নির্দেশ ছিল –
“জীবে দয়ে নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা ।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা” ।।
একই বিষয়ে বাবাসাহেব বলেছেন –
“ নিষ্ঠাবান ব্যক্তি প্রতিপক্ষের নিকট থেকেও সম্মান পায় এবং জীবনে সাফল্য অর্জন করে । সমাজকে যে ভালবাসে সমাজের সেবার অধিকার কেবল তারই আছে”।
ব্রাহ্মণ্যবাদী নীতি, শাস্ত্র ও কুসংস্কার সম্পর্কে হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন –
“কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ, কোথায় বৈষ্ণব ।
স্বার্থ বসে অর্থলোভী যত ভণ্ড সব”।।
“তন্ত্র মন্ত্র ভেক ঝোলা সব ধাঁধাবাজী ।
পবিত্র চরিত্র রেখে হও কাজের কাজী”।।
গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন –
“ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ ।
ব্রাহ্মণ প্রধান মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র”।।
বাবাসাহেব এই একই বিষয়ের উপর বলেছেন –
“ব্রাহ্মণরা দেব-দেবীর স্রষ্টা । দেব-দেবীর মূর্তিকে সাক্ষী গোপাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে কৌশলে চলছে ব্রাহ্মণ শ্রেণির অবাধ লুণ্ঠন । ব্রাহ্মণ্যবাদই নির্যাতিত শ্রেণির দুঃখ দুর্দশা ও সামাজিক নিপীড়নের মূল কারণ । ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকেই অস্পৃশ্যতার জন্ম” ।
সমাজ সংসারে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্রাদির মধ্যে গীতা, মনুসংহিতায় যেখানে বলেছে – নারী নরকের দ্বার । যেখানে নারীদের কোনও ধর্মীয় অধিকার, সামাজিক অধিকার, শিক্ষার অধিকার তথা ন্যূনতম সম্মানটুকুও ছিল না । এরকম প্রেক্ষাপটে হরিচাঁদ ঠাকুর নারীর যথাযোগ্য সম্মান দিতেই বসিয়েছিলেন মহিলা কাছারী, মতুয়া হরিনামের আসরে পুরুষের সাথে সমান স্থান দিয়েছিলেন মহিলাদের, নারীর সম্পত্তির অধিকার প্রসঙ্গে বলেছিলেন –
“পিতার থাকিলে ধন পুত্রকন্যা পায়”।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের বচনে আমরা ঠাকুর হরিচাঁদের ভাবনার প্রতিফলন দেখি-
“সমাজে পুরুষ পাইবে যে অধিকার ।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার”।।
এই একই প্রসঙ্গে নারী জাতিকে যে শাস্ত্র সবচেয়ে চরমতম অপমান করেছে, সেই মনুসংহিতাকে বাবাসাহেব প্রকাশ্য রাজপথে পুড়িয়েছিলেন । সাংবিধানিক ভাবে আইন করে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছেন । নারীর সম্মান প্রসঙ্গে বলেছেন –“ স্ত্রী স্বামীর দাস নয় । সে তার স্বামীর জীবন সঙ্গিনী, উভয়ের মর্যাদা সমান”।
সুখী ও সুস্থ দাম্পত্য জীবনের প্রসঙ্গে হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন –
“লয়ে নিজ নারী ব্রহ্মচারী সৎচরিত্র রবে ,
পরপতি পরসতী স্পর্শ না করিবে”।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের মুখে একই ভাবনার প্রতিধ্বনি শোনা যায়-
“একনারী ব্রহ্মচারী পালো গৃহধর্ম”।
বা
“একনারী ব্রহ্মচারী বলেছে দয়াল হরি ।
দুই নারী বিয়ে করে মূঢ়” ।।
এক সতী এক পতি এই শ্রেষ্ঠ ধর্মনীতি ।।
বাবাসাহেবও এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । তিনি তাঁর সীমার মধ্যে যা করণীয়, তাই করেছিলেন । তিনি সাংবিধানিক ভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন । সংবিধানে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আইন তৈরি করেন । স্পষ্ট ভাবে নির্দেশ করেন – কোনো সরকারী বা আধাসরকারী কর্মচারী, সংসদ সদস্য বা বিধায়ক একাধিক বিবাহ করতে পারবে না, করলে তাঁদের চাকরী বা সদস্যপদ বাতিল করা হবে”।
এবার দেখি শিক্ষা বিষয়ে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর কী বলেছেন । গুরুচাঁদ চরিতে পাই –
“ অনুন্নত জাতি মাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।
আজ্ঞা করেন হরিচাঁদ তাঁর বিধি মতে” ।।
গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন-
“সবাকারে বলি আমি যদি মান মোরে
“অবিদ্বান পুত্র যেন নাহি থাকে ঘরে ।।
খাও বা না খাও তাতে দুঃখ নাই ।
ছেলেমেয়ে শিক্ষা দাও এই আমি চাই”।।
বাবাসাহেব আম্বেদকর এই শিক্ষা বিষয়ে কী বলেছেন তা একটু তুলনামূলক বিচার করা যাক । বাবাসাহেব বলেছেন –
“শিক্ষা মানুষের শোষণ মুক্তির শক্তিশালী হাতিয়ার” ।
“শিক্ষাই শক্তির মূল উৎস” ।
“জ্ঞানই শক্তি । জ্ঞানবান ব্যক্তিরাই সমাজে নেতৃত্ব দান করে থাকেন” ।
তাহলে এবার বিচার করে দেখুন, এই মহামানবত্রয়ের মধ্যে ভাবনা চিন্তার কোনও পার্থক্য আছে কী ?
শিক্ষার শেষে প্রয়োজন কর্মসংস্থান । সরকারীভাবে সেই কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পেলেই একজন চাকুরীজীবী উপলব্ধি করতে পারে তার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অবস্থান । সে কারণে গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষার শেষে চাকুরী ক্ষেত্রে অনগ্রসর পিছিয়ে রাখা মানুষের আসন নিশ্চিত করতে আন্দোলনও করে সংরক্ষণ আদায় করেছিলেন এবং শিক্ষিত সমাজকে উৎসাহিত করতে বলেছিলেন –
“দেশের শাসনযন্ত্র কিভাবে কি চলে ।
কিছু নাহি বোঝা যায় চাকুরী না পেলে”।।
বাবাসাহেব আম্বেদকর সে ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করেছেন একটু দেখা যাক । সংবিধান প্রণেতার অবস্থান থেকে তিনি স্পষ্ট করে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেন-
“তফশিলী ও আদিবাসী জাতি সমূহের সংখ্যানুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারের চাকুরীতে ন্যায্য অংশগ্রহণের ব্যবস্থা আইনানুগ করতে হবে”।
সেই সঙ্গে তিনি নারীদের চাকুরীক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট আসনের নিশ্চয়তার করেন আইনীভাবে ।
ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণযন্ত্রে নিষ্পেষিত জাতিকে আর্থিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ হওয়ার হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে জাতির উদ্দ্যেশ্যে হরিচাঁদ ঠাকুর যে নির্দেশ দিয়েছিলেন – তার মধ্যে
“যাগযজ্ঞ তন্ত্রমন্ত্র, পূজাপার্বন দীক্ষা ।
কোনো কিছুর নাহি প্রয়োজন” ।
গুরুচাঁদ ঠাকুর আরো স্পষ্ট করে বললেন –
“বিবাহ শ্রাদ্ধাদিতে সবে কর ব্যয় হ্রাস ।
শক্তির চালনা সবে রাখ বারোমাস”।।
এ প্রসঙ্গে বাবাসাহেবের বক্তব্য একটু মিলিয়ে দেখা যাক । বাবাসাহেব বলেছেন –“যাগযজ্ঞ পুজাপার্বন, দশবিধ সংস্কার প্রভৃতি হল ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণযন্ত্র । মন্দির, তীর্থস্থান প্রভৃতি শোষণের কারখানা । ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সমাজের রক্তচোষা বাদুড়” ।
তাহলে কী পেলেন এই তিন জনের বক্তব্য থেকে ? কোনো মিল কী খুঁজে পাচ্ছেন ?
এরপর আসি জাতিকে সংগঠিত হওয়ার প্রসঙ্গে । হরিচাঁদ ঠাকুর দিলেন মতুয়া ধর্ম । দিলেন ডঙ্কা, কাসর , শিঙ্গাঃ মানুষকে সংবদ্ধ করলেন ‘হরিবোল’ ধ্বনি দিয়ে । গুরুচাঁদ ঠাকুর এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নিলেন ? গুরুচাঁদ চরিতে দেখতে পাই –
“ঘরে ঘরে আন্দোলন প্রয়োজন হল ।
সভা কর সভা কর প্রভুজি হাকিল”।।
বাবাসাহেবও এই বঞ্চিত অবহেলিত জাতিকে একত্রিত করতে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন –
“শিক্ষিত হও, সংগঠিত হও এবং আন্দোলন করো” ।
জাতির প্রতি দায়বদ্ধতায় গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনার প্রকাশ পাই গুরুচাঁদ চরিতে । সেখানে দেখি –
“ জাতি ধর্ম জাতি মান, জাতি মোর ভগবান, জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই”।
বাবাসাহেবকে জাতির প্রতি দায়বদ্ধতায় কী বলতে শুনি –
“আমার কাছে আমার জীবন অপেক্ষা আমার দেশের স্বার্থ অনেক বড় । আমার অসহায় ও নির্যাতিত অস্পৃশ্য সমাজের স্বার্থ অনেক বড়”।
রাজনৈতিক নাগরিক সমস্যা সমাধানে গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজের প্রতি বার্তা ছিল –
“ জাতি ধর্ম যাহা কিছু উঠাইতে চাও। রাজশক্তি থাকে হাতে যাহা চাও পাও”।।
বা
“রাজশক্তি মূল শক্তি কহিনু নিশ্চয় । রাজশক্তি বিনা কিছু বড় নাহি হয়”।।
বাবাসাহেব আম্বেদকর তো স্বয়ং সেই পথেরই পথিক ছিলেন । জাতির রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল-“রাজনৈতিক ক্ষমতা হল মহাচাবি । যার দ্বারা আমরা সমস্ত প্রকার অধিকারের দ্বার মুক্ত করতে পারি”।
এরপরও কী আমাদের বুঝে নিতে খুব অসুবিধা হয় ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এবং বাবাসাহেব আম্বেদকর সমাজের বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, দলিত মানুষের জন্য কী চেয়েছিলেন এবং তাঁদের ভাবনা চিন্তার মধ্যে পার্থক্যই বা কতটুকু ? ব্রাহ্মণ্যবাদী কুচক্রী মানবজাতির শত্রুরা আপনার চোখে যে ধর্মীয় ঐন্দ্রজালিক কুয়াসায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সে আবরণ এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসুন যৌক্তিক বাস্তবতার মাটিতে । শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদী আধ্যাত্মিক পথে আত্মমুক্তি খুঁজতে যাবেন না । হরিচাঁদ ঠাকুর গুরুচাঁদ ঠাকুরও স্বয়ং আধ্যাত্ম নির্ভর বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি ভাবনার বিরোধী ছিলেন। দেখবেন আগুনে পুড়ে মরলেও মরণ, আর জলে ডুবে মরলেও মরণ । মৃত্যুটা একই । তার কোনো আলাদা চেহারা হয় না । তেমনি, কে চুলের মুঠি ধরে টেনে প্রাণ বাঁচালো বা কে পা ধরে টেনে বাঁচালো তা বিবেচ্য নয়; জীবন ফিরে পাওয়াটাই মুখ্য । পরিত্রাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা বোধও একই হওয়া উচিৎ।
আরও কিছু লেখাঃ