Written by
1. অমলা
2. বিমল
3. সমু
(নেপথ্যে – দেওয়ালে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকার মতো একটা ঠকা ঠক্ শব্দ।)
অমলা – অনেক্ষণ ধরে ঘরের মধ্যে কী ঠক্ ঠক্ শব্দ হচ্ছে? কী করছে কী উনি? এই যে - ঘরের মধ্যে কী করছ কী তুমি? একি দেওয়ালে কী করছ?
বিমল – দুটো ফুটো করছি। একটা ফটো টানাবো তাই পেরেক পুতছি।
অমলা – ফটো টানাবে, কার ফটো? তাও আবার আমার ঠাকুরের আসনের পাশে? কী ফটো টানাবে শুনি?
বিমল – ওই যে দেখ, খাটের উপর রাখা আছে পেপার দিয়ে মোড়া।
অমলা – তুমি বলই না কার ফটো। তাও এতবড়ো ফটো! আমার ঠাকুরের আসনের পাশে তুমি যে সে ফটো এনে টানাবে, তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে না কি?
বিমল – না গিন্নি, আমার মাথা খারাপ হয়নি। বরঞ্চ খারাপ মাথাটা এবার একটু ভালো হওয়ার দিকে যাচ্ছে।
অমলা – তার মানে? তুমি কি বলতে চাইছো? এতদিন তোমার মাথা খারাপ ছিল মানে? তুমি আমার ভগবান ঠাকুর হরিচাঁদ, শান্তি মাতা, গুরুচাঁদের আসনের পাশে যার তার ছবি টানাবে আর বলছো তোমার মাথাটা এবার ভালোর দিকে যাচ্ছে?
বিমল – ঠিকই বলেছি গিন্নি, ঠিকই বলেছি। এতদিন সত্যিই আমার মাথাটা খারাপ ছিল, তা না হলে প্রকৃত ভগবানকে চিনতে না পেরে, জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করে দিলাম কাল্পনিক দেব-দেবী নামক আলেয়ার পিছনে ছুটে ছুটে। আমার সৌভাগ্য যে, পুরোটা জীবনই নষ্ট করার আগে আমাদের প্রকৃত মুক্তিদাতা,পরিত্রাতাদের কে আমি চিনতে পেরেছি।
অমলা – সে তো তুমি আমাকে বারবার করে বুঝিয়েছো যে, আমরা পতিত জাতির মানুষেরা, যাদের কিছুদিন আগে পর্যন্তও অস্পৃশ্য চণ্ডাল গালি শুনতে হয়েছে। যারা দীর্ঘ কয়েক হাজার বছর ধরে বৈদিক ধর্মের বর্ণবাদী সমাজব্যাবস্থা উচ্চবর্ণীয়দের শোষণ, অত্যাচার লাঞ্ছনা, ঘৃণা, অবহেলা সহ্য করে আসছে। যাদের ধর্মীয় অধিকার ছিল না, শিক্ষার অধিকার ছিল না, ছিল না অর্থ সঞ্চয়ের অধিকার। এমন কী সমাজে মানুষ হয়েও কুকুর বিড়ালের মর্যাদাটুকু পায়নি। সেই দুঃসময়ে কোনো দেব-দেবী আমাদের রক্ষা করেনি। উপরন্তু ওই দেব-দেবীদের শিখণ্ডী করে পুরুত বামুনরা আমাদের লুটেপুটে সর্বস্বান্ত করেছে।
বিমল – দেবদেবী বাস্তবে থাকলে তো রক্ষা করতে আসবে? আমরাও কতো বোকা, ধান্দাবাজদের কল্পনাকে সত্যি ভেবে নিয়ে দিবা স্বপ্ন দেখে যাই। তবে গিন্নি আমার শান্তিটা এখানেই–যে, তুমি আমার কথাগুলো মন দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করেছো। নইলে বৈদিক আচার সংস্কার তো মহিলারাই তো বেশী করে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে।
অমলা – তোমার কথা বুঝতে পেরেই তো আমি আমার ঠাকুরের আসন থেকে সব দেব দেবতার মূর্তি, ছবি সরিয়ে ফেলে শুধুমাত্র পতিতপাবন হরিচাঁদ, শান্তিমাতা আর ঠাকুর গুরুচাঁদের ফটোই রেখেছি আসনে। কিন্তু, এখন আবার কার ফটো নিয়ে এলে তুমি?
বিমল – দাঁড়াও গিন্নি, দেখাচ্ছি। এই দেখ এই যে, এটা কার ছবি বলতে পারো?
অমলা – এটা আবার কার ছবি? চোখে চশমা পরা বেশ সুন্দর চেহারা। কোটপ্যান্ট পরা, হাতে আবার একটা বই! এ কার ছবি বলতো? আমি তো ঠিক চিনতে পারছি না। ইনি কে?
বিমল – এই ছবি কার? এই ছবি কার? এই ছবিটা যে তুমি চিনতে পারছো না এটাও আমাদের লজ্জা। হায় রে আমার মানুষ আমরা আমাদের প্রকৃত মুক্তিদাতাদেরই চিনি না। এ তোমার দোষ নয় গিন্নি, এ তোমার দোষ নয়। আমাদের সমাজের শিক্ষিত চাকুরীজীবী মানুষেরা যারা এই মানুষটির দয়াতেই করে কম্মে খাচ্ছে, তারাইতো এই মহাজ্ঞানী মহামানব কে চিনতে চায় না ; আর তুমি তো সাধারণ ঘরের বৌ, তাও মোটে আট ক্লাশ পাশ। তুমি চিনবে কী করে বলো। আর আমি ই কী চিনতে পারতাম? আমি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েও, আমি শুধু জানতাম এই মহাপুরুষ শুধু ভারতবর্ষের সংবিধান রচনা করেছেন। ব্যাস্ এই টুকুই। ওই ক্লাশের বই পত্তর পড়ে আর কিচ্ছু জানতে পারিনি। যদি মণিদাদা এনার সম্পর্কে না বলতো, বাবাসাহেবকে হয়তো কোনো দিনই জানতে পারতাম না।
অমলা – ও এবার চিনতে পেরেছি। ইনি তো আম্বেদকর তাই না। নাম শুনেছি। কিন্তু ছবিতে চিনতাম না।
বিমল – হ্যাঁ গিন্নি ঠিকই চিনেছ। ইনি হলেন ভারতবর্ষের বহুজন সমাজের মুক্তিদাতা বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর।
অমলা – সবই বুঝলাম, ইনি ভারতের সংবিধান লিখেছেন, পড়াশুনা জানা একজন জ্ঞানী মানুষ। কিন্তু, আমার ঠাকুরের পাশে এনাকে বসাবে কেন? এইটা কিন্তু আমি মেনে নিতে পারছি না। সে তুমি যাই বলো–
বিমল – গিন্নি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এনার সম্পর্কে তোমাকে কিছু না বলেই, আমি আমার একার সিদ্ধান্তে ঠাকুরের আসনের পাশে বাবাসাহেবের ছবি টাঙ্গাতে চেয়েছি। আচ্ছা, এই ছবি আমি এখনি টাঙ্গাচ্ছি না। আগে এনার সম্পর্কে জানো। তারপর তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে নাহয় টাঙ্গানো যাবে। এখন শুধু আমি না হয় অন্তত এই পেরেকটাই পুতে রাখি, ঠিক আছে?
অমলা – আহা তুমি পেরেকই বা পুতে রাখবে কেন? আমার আসনে আছে ঠাকুর হরিচাঁদ, শান্তি মাতা আর ঠাকুর গুরুচাঁদ। এনারা হলেন জগতপিতা, জগতমাতা। স্বয়ং ভগবান। তাদের পাশে তুমি একজন মানুষকে স্থান দিতে চাও? হোক্ সে বড়মানুষ বা মহাজ্ঞানী। তাই বলে ভগবানের পাশে আমি মানুষের ছবি রেখে পুজো করবো? এটা কিন্তু ঠিক হবে না।
বিমল – ঠিক্ আছে। এখানে না হয় আমি আর একটা সুন্দর দেখে হরি ঠাকুরের ছবি টানিয়ে দেবো। তুমি আমাকে পেরেকটা তো পুততে দাও।
(নেপথ্যে–মা কোথায় তুমি? ঘরে আছো?)
অমলা – ওই যে অফিস থেকে সমু ফিরেছে। তুমি ওসব রাখো এখন। সমু এসব দেখলে রাগ করবে।
সমু – মা কী করছো? একি বাবাও ঘরে আছো? বাবা তুমি আজ দোকানে যাওনি?
বিমল – না বাবা, আজ তো শুক্রবার।
সমু – ও হ্যাঁ তাই তো। আজ তো দোকান বন্ধ থাকে। তোমার ছুটির দিন। তোমার হাতে হাতুড়ি কেন বাবা?
অমলা – ও কিছু না। চল হাত মুখ ধুয়ে নে। এখন কিছু খাবি।
সমু – না মা, এখন আর কিছু খাবো না। অফিস থেকে ফেরার পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা হল ; তার সঙ্গে কিছু খেতেও হল। একি খাটের উপর আম্বেদকরের ছবি কেন? বাবা বুঝি দেওয়ালে টাঙ্গানোর জন্যে এনেছে।
অমলা – আরে, তোর বাবা কার কাছে কী শুনে এসে এই ছবি নিয়ে হাজির। ওই ছবি এখন আমার ঠাকুরের ছবির পাশে টাঙ্গাবে। তোর বাবার আক্কেলটাও বলিহারি। বলতো বাবা এটা কী ঠিক হচ্ছে–আমার ঠাকুর আমার ভগবানের পাশে একজন মানুষের ছবি?
সমু – দেখো মা, তোমার ঠাকুর সম্পর্কে আমার যে ভাবনা, তা বলে আমি তোমাকে আর আঘাত দিতে চাইনা আর তোমাদের ধর্ম নিয়েও আমার কোনো উৎসাহ নেই। তোমরা তোমাদের মতুয়া ধর্ম, হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ নিয়ে থাকো, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এখন বিজ্ঞানের যুগ, ধর্ম, ঠাকুর দেবতা আমার কাছে বড় ন্যাকামি আর সেকেলে মনে হয়। আমি একটাই ধর্মকে মানি, সেটা মানব ধর্ম। সেখানে জাত-পাত ধর্ম এসবের কোনো বালাই নেই। আমার পরিচয় আমি মানুষ। তোমরা তোমাদের আসনে কার ছবি রাখবে আর কার ছবি রাখবে না, সেটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার। আমাকে আর এর মধ্যে টেনো না।
বিমল – বাব সমু, আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। তোমার কী এখন শোনার সময় আছে?
সমু – হ্যাঁ বাবা বলো। আমার হাতে সময় আছে। তবে ধর্ম টর্ম নিয়ে কিছু বলোনা বাবা। আমার ওসব ভালো লাগে না।
বিমল – ঠিক আছ, আমি তোমার মানব ধর্ম, বিজ্ঞানের যুগ নিয়েই কয়েকটি কথা বলবো। এই যে এই ছবিটা দেখছো, এটা কার ছবি তুমি নিশ্চই জানো?
সমু – হ্যাঁ, ডঃ বি আর আম্বেদকরের।
বিমল – হ্যাঁ, ইনি বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। তুমি যে শিক্ষিত হয়েছো এবং সরকারী চাকরীও করছো এস. সি. কার্ডের সুবাদে; এই তোমার জীবনে এই বাবাসাহেবের কী অবদান আছে জানো?
সমু – অবদান বলতে উনি স্বাধীন ভারতের সংবিধান লিখেছেন। সেই সংবিধান মেনে দেশ চলছে। আর চাকরী বাকরীতে পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে গেছেন।
বিমল – আর তুমি সেই সংরক্ষণের আওতায় আজ চাকরী করছো।
সমু – হ্যাঁ, তবে আমার মতে সংরক্ষণ না থাকলেই বোধয় ভালো হতো। অন্তত, অফিস আদালতে সোনার চাঁদ, কোটার মাল এসব কটুক্তি তো শুনতে হতো না?
বিমল – একদম ঠিক কথা বলেছ। এসব শুনলে তোমার আত্মসম্মানে লাগে তাই না?
সমু – যার আত্মসম্মান বোধ আছে, তারই লাগবে বৈকি।
বিমল – তুমি কী একবারও ভেবে দেখেছো তোমার এই আত্মসম্মান বোধ কী করে জন্মালো? আজ যে তুমি বলছো মানুষে মানুষে বিভেদ মানো না, জাত-পাত মানো না, তোমার পরিচয় শুধু মানুষ, তুমি মানব ধর্মে বিশ্বাসী ইত্যাদি। তুমি কী জানো? এসব কথা তুমি আজ কেন বলতে পারছো?
সমু – এটা তো সিম্প্ল, আমি লেখাপড়া শিখেছি, আমার জ্ঞান হয়েছে, তাই আমার আত্মসম্মান বোধ জন্মেছে।
বিমল – না তুমি লেখা পড়া শেখনি। তোমাকে লেখাপড়া শেখানো হয়েছে। আজ যে মানুষগুলো তোমাকে সোনার চাঁদ, কোটার মাল বলছে, ওই মানুষগুলোর সঙ্গেই জীবনপণ লড়াই, সংগ্রাম করে তোমার শিক্ষার অধিকার আদায় করে নেওয়া হয়েছে। আর সেই অধিকার থেকে তুমি শিক্ষিত হয়েছ এবং তোমার আত্মসম্মান বোধ জন্মেছে। আর তুমি কিন্তু চাকরী পাওনি। দেশের সরকারী কাজে তোমাকে তোমার জাতির প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়েছে।
অমলা – আচ্ছা সমুর বাবা, তুমি কেমন লোক বলো তো? সবে মাত্র অফিস থেকে ফিরল ছেলেটা। কোথায় এখন ও একটু বিশ্রাম নেবে, তা না তুমি এখন ওকে জেরা করতে শুরু করলে।
সমু – দাঁড়াও মা। বাবার কথায় কোথায় যেন একটা ভয়ংকর সত্যি লুকিয়ে আছে। আমিও কখনও কখনও ভেবেছি আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে, আমার পরিচয় নিয়ে। কিন্তু, সে ভাবে গভীরতা দিয়ে খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনি।
বিমল – এবার একটু গভীরভাবে খুঁজে দেখ সমু। নিজেকে একবার সঠিক ইতিহাসের আলোকে খুঁজে নিতে চেষ্টা করো। তাহলেই দেখবে এই পৃথিবীতে তুমি শিরদাঁড়া সোজা রেখে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। আর কোনো কটুক্তি, সমালোচনাই তোমাকে সংকুচিত করতে পারবে না।
সমু – কিন্তু বাবা, এই সঠিক ইতিহাস আমি কোথায় পাবো? কী ভাবে আমার সত্যকে আমি জানতে পারবো?
বিমল – তুমি শিক্ষিত হয়েছো, এটা খুঁজে নেওয়া তোমারই দায়িত্ব। তবু আমি বলবো–এই ইতিহাসের সন্ধানে তোমাকে বেশী দূরে যেতে হবে না। তুমি যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগ করে শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত, শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত পড়ো; তুমি বাবাসাহেবকে জানো। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে পড়ে দেখ। তা হলেই তুমি জানতে পারবে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস এবং আমাদের পরিচয়।
সমু – কিন্তু বাবা, স্কুল কলেজে তো বাবাসাহেব সম্পর্কে সে ভাবে আমরা কিছু পাইনি।
বিমল – এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, ভারতবর্ষ এখনও বকলমে মনুবাদী শাসকশ্রেণীর হাতেই নিয়ন্ত্রিত। বাবাসাহেব তো ওই মনুবাদীদের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁদের তৈরি সিলেবাসে তুমি বাবাসাহেবকে কোথায় পাবে?
অমলা – কিন্তু, বাবাসাহেব কী করেছে আমাদের জন্য সেটা তো বলো? আর কেনই বা তার ছবি নিয়ে এলে আমার ঠাকুরের আসনের পাশে রাখার জন্য?
সমু – মা, তুমি আবার সেই তোমার ঠাকুরের আসন নিয়ে শুরু করলে?
বিমল – তোমার মা ঠিকই বলেছে সমু। কারো ছবি বা মূর্তি আসনে রাখা বা দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখার অর্থ তাঁর জীবন-দর্শনকে সর্বদা স্মরণে রাখা এবং মেনে চলা। সুতরাং তাঁদের সম্পর্কে তো আগে জানতেই হবে। আর আমাদের ইতিহাসটা আসনের ওই ঠাকুর হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।
সমু – সেটা কেমন বাবা? হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর তো ধর্মীয় লাইনের। ওনারা তো এতো ধর্মের পরেও আবার একটা নতুন ধর্ম তৈরি করেছেন মতুয়া ধর্ম।
বিমল – তুমি বললে না তুমি মানব ধর্মে বিশ্বাস করো? আর তোমার মনের মধ্যে এই মানব ধর্মের ভাবনারও জন্ম দিয়েছে ওই ঠাকুর হরিচাঁদ–গুরুচাঁদ ঠাকুর।
সমু – বাবা আমার কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বলো তো।
বিমল – শোনো বাবা সমু, তুমি আমার চাইতে অনেক বেশী শিক্ষিত, সরকারী চাকরীও করছো। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানমনষ্ক ছেলে তুমি। আমি যতটুকু জেনেছি, বুঝেছি তোমাকে বলছি। অবশ্যই তুমি তোমার যুক্তি- বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ করবে। বাকী কিছু জানার থাকলে নিজের চেষ্টায় তোমাকে জানতে হবে।
অমলা – সমুর বাবা, আমিও শুনতে চাই তোমার কথা। আমি জানতে চাই তুমি কেন বাবাসাহেবের ছবি ঠাকুর হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের আসনের পাশে রাখার জন্য আনলে?
সমু – আচ্ছা বাবা, আমাকে একটা কথা বলতো হরিচাঁদ ঠাকুর এতো ধর্ম থাকা সত্ত্বেও মতুয়া ধর্ম নামে আরেকটা নতুন ধর্ম দিতে গেলেন কেন?
বিমল – হরিচাঁদ ঠাকুর তো কোনো নতুন ধর্ম দিতে চাননি, বরঞ্চ ধর্মের নাগপাশ থেকে ধর্মীয় মোহগ্রস্থ মানুষদের মুক্তি দিতে চেয়েছেন। তোমার বিজ্ঞান ও মানবতার ধর্ম যেমন মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী। হরিচাঁদ ঠাকুরও তেমনি ধর্মীয় আচার, কুসংস্কারে শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আজকে তুমি যেমন বলছ তুমি মানবধর্মে বিশ্বাস করো। সে ওতো একটা ধর্ম।
সমু – তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্মের নাম মতুয়া ধর্ম কেন? আর ওই ডঙ্কা, কাসর, নিশান, আচার মালা এইসবই বা কেন?
অমলা – ও মা, এ সব না হলে আমরা মতুয়া বোঝাবো কী করে?
বিমল – বাবা সমু, একদল নিরীহ মানুষ যারা অপর একটি দল স্বার্থপর মানুষের কাছে শোষিত, অত্যাচারিত হয়েছে ধর্মীয় মোড়কে। ধর্মশাস্ত্রের মাধ্যমে লুটেপুটে নিয়েছে তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য, সম্পদ। আর ওই রিক্ত নিঃস্ব মানুষগুলোও আত্মসমর্পন করে বসেছিল ধর্মের কাছে। ধর্মই তাদের আবার সুদিন ফেরাবে, এই ছিল তাদের আশা। তাই হরিচাঁদ ঠাকুর স্বীয় প্রজ্ঞাজাত সুকৌশলে স্থবিরতা আর প্রগতি-বিরুদ্ধ ধারাকে প্রবাহিত করতে চাইলেন কর্মমুখর মানবতা, বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর প্রগতিশীলতার অভিমুখে। পরশ্রমজীবী হিংসুক নিন্দুকেরা সেই প্রচেষ্টার অপপ্রচার করতে গিয়ে বলল ও ব্যাটারা হরিবোলা মতো। ঠাকুর হরিচাঁদও নিন্দুকদের সেই উপহাসকে উপহার মনে করে তাঁর অনুগামীদের কর্ম ও বানীর দর্শনের ধর্ম দিলেন মতুয়া।
সমু – আর ডঙ্কা, কাঁসর মালার ব্যাপারটা?
বিমল – মতুয়া ধর্ম আসলে জাতপাত, ভেদাভেদ, কুসংস্কার, ধর্মের নামে অমানবিকতা, গোঁড়ামি, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধর্ম। ঠাকুরের দেওয়া ডঙ্কা হল অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দামামা। নিশান হল বিশ্বের সমস্ত হিংসাকে সত্য, প্রেম, পবিত্রতা দিয়ে বেষ্টিত করার প্রতীক ; আর আচার মালাটি হল ধর্মীয় অনাচারের প্রতিবাদের প্রতীক। আর জীবনীশক্তির উজ্জীবক ধ্বনি হল হরিবোল।
সমু – মতুয়া ধর্মের মূল লক্ষ্য কী?
বিমল – তুমি আজকে মানব ধর্মের সমর্থক হয়ে যে যে স্বাধীনতার, যে যে অধিকারের দাবি করছো, হরিচাঁদ ঠাকুর তৎকালীন সময়ে ঠিক সেই কাজটি করতে চেয়েছিলেন।
সমু – যেমন?
বিমল – তাঁর প্রথম ঘোষণা ছিল–জীবে দয়া নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।/ ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা। ঠাকুর সমস্ত প্রকার ধর্মীয় অনাচার আর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। সেই সঙ্গে এই অনাচার শিক্ষা দেয় যে শাস্ত্রগ্রন্থগুলি তার বিরুদ্ধেও তিনি শোষিত মানুষদেরকে সচেতন করতে থাকেন। প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি সদর্পে ঘোষণা করেন-কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই। /বেদবিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।
সমু – হরিচাঁদ ঠাকুর বেদবিধি শৌচাচারের এতটা বিদ্বেষী ছিলেন? আচ্ছা বাবা, হরিচাঁদ ঠাকুর কী লেখাপড়া জানতেন? তিনি কী বেদ পড়েছেন? তিনি বেদের এতোটা বিরোধী কেন?
বিমল – সমু, ঠাকুর স্কুল কলেজে লেখাপড়া শিখতে পারেননি সমাজের ওই বেদাচারী হিংস্র মানুষগুলোর কারণেই। কিন্তু তিনি পরিবার, সমাজ, প্রকৃতির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন, তা তাঁকে করে তুলেছিল অপার জ্ঞানের অধিকারী, পরম মহাজ্ঞানী। তাঁর সেই অনির্বচনীয় প্রজ্ঞার আলোকে তিনি সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন–বেদ বা অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ কোনোদিন শূদ্র, পতিত সমাজের মানুষেরা পাঠ করেননি, পাঠ করার অধিকারও তাদের ছিল না। কিন্তু, যাদের অধিকার ছিল, যারা বেদ শাস্ত্রাদি পাঠ করেছে, তাদের কাছ থেকে সমাজ কী পেয়েছে? দেখা গেছে ওই বেদপাঠি বেদাচারী মানুষগুলো–মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করছে। অন্যের শিক্ষা সম্পদ স্বাস্থ্যের অধিকার হরণ করেছে। অন্যের পরিশ্রমের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিজেরা সমাজে কুসংস্কারের বিষ ছড়াচ্ছে। তাই তিনি সমাজের মানুষকে ওই বিষবৃক্ষ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। ঠাকুর বলেছেন–কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ কোথায় বৈষ্ণব / স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভণ্ড সব।/ তন্ত্রমন্ত্র ভেক ঝোলা সব ধাঁধাবাজি। / পবিত্র চরিত্র রেখে হও কাজের কাজী।
সমু – বাঃ চমৎকার! মা তুমি বুঝতে পেরেছো ব্যাপারটা?
অমলা – কী বাবা?
সমু – ধরো, এমন একটা সুদৃশ্য ফল আছে, যে ফল খাওয়ার অধিকার সবার নেই। যারা ওই ফল খাওয়ার সুযোগ পায়, তারা ওই ফল খাওয়ার পর দেখা গেল পাগল, কেউ ভণ্ড, কেউ হল চোর, গুণ্ডা, বদমায়েশ, সন্ত্রাসী ; যারা নিজের ভালো ছাড়া অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। যারা অন্য মানুষকে ঘৃণা করে। হরিচাঁদ ঠাকুর ওই ফল এবং ফল খাওয়া পাগল, ভণ্ড, চোর, গুণ্ডাদের থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কারণ দুই থেকেই মানুষের ক্ষতি।
অমলা – কী সুন্দর কথা না? পবিত্র চরিত্র রেখে হও কাজের কাজী।
সমু – বাবা, গুরুচাঁদ ঠাকুর এ ব্যাপারে কী ভেবেছিলেন?
বিমল – গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের যোগ্য উত্তরসূরী পরম মহাজ্ঞানী। তিনি তো আরো সোজাসুজি বলেছেন ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ। / ব্রাহ্মণ প্রধান মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।
সমু – বাঃ বাঃ গুরুচাঁদ ঠাকুরও একদম সঠিক যায়গাটা ধরেছেন। তিনি বুঝেছেন যে, ব্রাহ্মণরা প্রচার করে থাকে বেদ শাস্ত্রাদি নাকি ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বানী। যতসব বুজরুকি। নিজেরা নিজেরা লিখে দেবদেবতার নাম করে চালিয়ে দিয়ে লোক ঠকানো ব্যবসা ফেঁদে নিয়েছে।
অমলা – আচ্ছা সমুর বাবা, ওই বাবাসাহেব এ ব্যাপারে কিছু বলেছেন কি না, আমার একটু জানতে ইচ্ছা করছে।
বিমল – তুমি একটা সুন্দর প্রশ্ন করেছ সমুর মা। তুমি যদি বাবাসাহেব সম্পর্কে জানতে পারো না? তুমি অবাক হয়ে যাবে। দেখবে, ঠাকুর হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ আমাদের জন্য যা যা বলে গেছেন বা যা যা করতে চেয়েছেন, বাবাসাহেবও ভারতবর্ষের দলিত শোষিত বহুজন মানুষের জন্য ঠিক একই কথা বলেছেন এবং একই কাজ বাস্তবে পরিণত করতে চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়ে বাবাসাহেবের তো অনেক কথা আছে। তার মধ্যে একটা কথা যেমন, ‘ব্রাহ্মণরা দেবদেবীর স্রষ্টা। দেবদেবীর মূর্ত্তিকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে দাঁড় করিয়ে কৌশলে চলেছে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অবাধে লুণ্ঠন। ব্রাহ্মণ্যবাদই নির্যাতিত শ্রেণীর দুঃখ দুর্দশা ও সামাজিক নিপীড়নের কারণ’।
অমলা – আমি শুনেছি আমাদের নারী সমাজের নাকি আগে কোনো অধিকার কোনো স্বাধীনতা ছিল না।
সমু – হ্যাঁ মা, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্র, গীতা, মনুসংহিতায় তো নারীকে নরকের দ্বার বলেছে।
বিমল – এই নারীকেই ভারতবর্ষে প্রথম ঠাকুর হরিচাঁদ পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। শ্রীশ্রীহরি লীলামৃতের অনেক যায়গাতেই তার প্রমাণ আছে। গুরুচাঁদ ঠাকুরও তাঁর কথায় বলেছেন–শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার।/ নারী ও পুরুষ পাবে সম অধিকার। গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজে বলেছেন–সমাজে পুরুষ পাবে সেই অধিকার।/ নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।
সমু – বাবসাহেব তো শুনেছি প্রকাশ্য রাজপথে মনুসংহিতাই পুড়িয়ে দিয়েছিল। আর সংবিধানেও আছে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা। বাবাসাহেব তো এও বলেছেন–‘স্ত্রী স্বামীর দাসী নয়। সে তার স্বামীর জীবন সঙ্গিনী, উভয়ের মর্যাদা সমান। নারীকে যারা হেয় বলে প্রতিপন্ন করেছে তারা মানব সমাজের শত্রু’। এই মতের সাথে আমিও একশো শতাংশ একমত বাবা।
বিমল – তাহলে বুঝতে পারছো সমুর মা, সমুর মানব ধর্মের সাথে হরি-গুরুচাঁদের মতুয়া ধর্ম দর্শন আর বাবাসাহেবের দর্শনের কত মিল?
অমলা – তাইতো দেখছি। আমি তোমাদের কথা শুনছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি।
সমু – বাবা, আমি একদিন আমার অফিসের কলিগের কাছে শুনেছিলাম যে–সংবিধানে বাবাসাহেব লিখেছেন–‘নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন বহুবিবাহ বন্ধ করা। কোনো সরকারী বা আধাসরকারী কর্মচারী, সংসদ সদস্য বা বিধায়ক একাধিক বিবাহ করতে পারবে না। করলে তাঁদের চাকরী বা সদস্যপদ বাতিল হবে’।
বিমল – সমু, হরিচাঁদ ঠাকুর এ বিষয়ে অনেক আগেই সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন–‘করিবে গার্হস্থ ধর্ম লয়ে নিজ নারী’। গুরুচাঁদ ঠাকুর তো আরো সুন্দর করে বলেছেন–একনারী ব্রহ্মচারী পালো গৃহ ধর্ম।গৃহধর্ম নষ্ট হলে নষ্ট সব কর্ম।পরপতি পরসতী স্পর্শ না করিবে। হরিকে না ডাকো হরি তোমাকে ডাকিবে।
সমু – কী দারুন কনসেপ্ট! কত আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত ভাবনা। সারা পৃথিবী যদি এই শর্ত মেনে চলে, তাহলে ভয়ঙ্কর মারণ রোগ এইডস এর অস্তিত্বই থাকতো না।
বিমল – সমু, তোমাকে বলছিলাম না–যে তুমি লেখা পড়া শেখনি, তোমাকে লেখাপড়া শেখানো হয়েছে?
সমু – হ্যাঁ বাবা।
বিমল – আমার বাবা, মানে তোমার ঠাকুরদা আমাকে লেখাপড়া শেখানোর প্রেরণা পেয়েছিলেন হরি-গুরুচাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে। আমার বাবা গুরুচাঁদের একটা কথাকেই জীবনের ব্রত করে ছিলেন যে খাও বা না খাও, ছেলে মেয়েকে শিক্ষা দাও। আমিও তোমাকে লেখাপড়া শেখানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছি ওই হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের আদর্শ মেনেই। হরিচাঁদ ঠাকুর পতিত সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে ভাবনা ভেবেছিলেন, আর গুরুচাঁদ ঠাকুর তাকেই বাস্তবায়িত করেছিলেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন – ‘মোর পিতা হরিচাঁদ বলে গেছে মোরে।/ বিদ্যাশিক্ষা স্বজাতিকে দিতে ঘরে ঘরে’। তিনি বলেছেন–‘সবাকারে বলি আমি যদি মানো মোরে।/ অবিদ্বান পুত্র যেন নাহি থাকে ঘরে’। তিনি আরো বলেছেন–‘বিদ্যাছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।/ বিদ্যা ধর্ম বিদ্যা কর্ম অন্যসব ছার’। এই বিদ্যা শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে পাঠশালা গড়ে তুলেছেন। তাঁরই উত্সাহে সে কালে প্রায় দুই হাজার পাঠশালা গড়ে উঠেছিল। কারণ উচ্চবর্ণীয়দের স্কুলে আমাদের পড়ার কোনো অধিকার ছিল না। দীর্ঘকাল অশিক্ষার অন্ধকারে থেকে থেকে আমাদের মানুষের চিন্তা বুদ্ধি, ভাবনাশক্তি প্রায় লোপ পায়। সেই মৃতপ্রায় মানুষদের পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছিলেন ঠাকুর হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ। তাঁদেরই দর্শন মেনে আমি যেমন দেশ ভাগের পর ওপার বাংলা থেকে শূন্য হাতে এদেশে এসে ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি, তেমনি তোমাকে লেখাপড়া শেখানোরও অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আর এদেশের মাটিতে তুমি যে সরকারী চাকরী করছো সে বাবাসাহেবেরই ভাবনার ফসল। আজ তুমি শিক্ষিত হয়েছো বলে ভাবতে পারছো মানব ধর্মের কথা, বিজ্ঞান যুক্তিবাদের কথা, জাতপাতহীন মানব সমাজের কথা। এই ভাবনা তুমি কাদের জন্য পেলে বলো?
অমলা – ঠিকই বলেছ বাবা। আচ্ছা, বাবাসাহেব শিক্ষার ব্যাপারে কিছু বলেনি?
বিমল – হ্যাঁ বাবাসাহেবও শিক্ষার ব্যাপারেই বেশী জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন – ‘শিক্ষা মানুষের শোষণ মুক্তির হাতিয়ার। তাই একমাত্র ব্যাপক ভাবে শিক্ষাদানের দ্বারা জনগণকে রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব’। বাবাসাহেব চেয়েছিলেন – তফশিলী ও আদিবাসী জাতি সমূহের সংখানুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চাকুরীতে ন্যায্য অংশগ্রহণের ব্যবস্থা আইনানুগ করতে। আর এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতেই তিনি সংবিধানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া সমাজের জন্য চাকুরীতে সংরক্ষণের ব্যাবস্থা করেছিলেন। এই চাকুরীতে সংরক্ষণের দাবি অবশ্য গুরচাঁদ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারেরকাছ থেকে আগেই আদায় করেছিলেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন – ‘দেশের কার্য যে যে ভাবে চলে।/ কিছু নাহি বোঝা যায় চাকুরী না পেলে’।
সমু – কিন্তু বাবা, জাতির ভিত্তিতে কেন সংরক্ষণ হল? এটা অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ ছিল না?
বিমল – বাবা সমু, তোমার এই কথাটাও সত্যি। কিন্তু এই সভ্য সমাজের মানুষের কাছে সবচাইতে শ্রেষ্ঠ সম্পদ কী বলোতো? সেটা হল বিদ্যা শিক্ষা। গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন – ‘তাই বলি ভাই মুক্তি যদি চাই বিদ্বান হইতে হবে।/ পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ চির সুখী হবে ভবে’। তিনি আরো বলেছেন – ‘বিদ্যা যদি পাও কাহারে ডরাও কার দ্বারে চাও ভিক্ষা’? আমাদের দেশের নিম্নবর্গের অশিক্ষিত মানুষেরা তো এই বিদ্যা শিক্ষা সম্পদে দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র। বিশ্ববরেণ্য বাবাসাহেব তাইতো দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছর ধরে শিক্ষা নামক মহামূল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত দেশের পঁচাশি শতাংশ মানুষের মধ্যে এই সম্পদ বন্টন করতে চেয়েছেন, যা মাত্র পনের শতাংশ উচ্চবর্ণীয়রা এতকাল কুক্ষীগত করে রেখেছিল। যদিও গুরুচাঁদ ঠাকুরই প্রথম এই সংরক্ষণ নিয়ে আন্দোলন করেন এবং সংরক্ষণ আদায় করেন।
সমু – কিন্তু চাকরীতে বিশেষ সুযোগ সুবিধা কেন?
বিমল – ওই যে বললাম সংখ্যানুপাতে অংশগ্রহণ। তুমি চাকুরীক্ষেত্রে তোমার সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছো। তোমার সমাজের মাথা গুনতিতে সংরক্ষিত আসনে তুমি চাকরী করছো। এটা কোনো বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যাপার নয়। তুমি তোমার ন্যায্য অধিকার অর্জন করেছো। আর যদি বিশেষ সুযোগ সুবিধার কথাই বলো? তাহলে বলবো – তোমার ডান পায়ে যদি চোট লেগে কোনো হাড় ভেঙ্গে যায়। তবে তুমি কী বাম পায়ের মতো সমান ভর দিয়ে হাটতে পারবে? পারবে না। তোমাকে হাটতে হলে তোমার ডান পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে, লাঠি ভর দিয়ে বাম পায়ে বেশী ভর দিয়ে হাটতে হবে। যতদিন না ডান পা সুস্থ্ হয়, ততদিন ওই পা’টিকে তোমার সাবধানে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
সমু – বাবা, পুরো বিষয়টা এবার আমার কাছে একদম জলের মতো পরিষ্কার। দীর্ঘকাল একটি জাতিকে ধর্মীয় চক্রান্তের শিকার করে অশিক্ষার অন্ধকারে এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে রেখে রেখে ভারতবর্ষের একটি বড় অঙ্গ ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে। সংরক্ষণের মাধ্যমে ওই অঙ্গের সেবা শুশ্রূষা করে আবার ভারতবর্ষকে সুস্থ সবল করে তোলার চেষ্টা। ব্রিলিয়াণ্ট আইডিয়া।
অমলা – আমিও আজকে অনেক কিছু জানতে পারলাম তোমাদের এই আলোচনায়। বুঝতে পারলাম ঠাকুর হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ জাতির মঙ্গলের জন্য যা যা করতে চেয়েছে, ওই বাবাসাহেবও একই কাজ করেছে। সমুর বাবা, তুমি এতদিন এই বাবাসাহেবের ছবিটা আনোনি কেন? হায় ঠাকুর এতবড়ো একজন মহান মানুষকে, এমন ভগবানকে আমি এতদিন চিনতে পারিনি!
বিমল – তুমি ঠিকই বলেছো সমুর মা। ঠাকুর গুরুচাঁদ বলেছেন – যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর। বাবাসাহেবও আমাদের সমাজের মুক্তিদাতা। তাই সে ও আমাদের ভগবান। ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ধর্মীয় পথে মুক্তি এনেছেন, বাবাসাহেব মুক্তি এনেছেন রাজনৈতিক ক্ষমতার পথ ধরে। কিন্তু, বাবাসাহেব সম্পর্কে আমাদের আরো জানতে বাকী আছে। আমিতো সামান্যই জেনেছি। তবু যতটুকু জেনেছি, ততই অবাক হয়েছি। আমার ঠাকুর হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের সাথে চিন্তা ভাবনায়, কাজে কর্মে, আদর্শে এত মিল?
সমু - বাবা, আজ যেন আমার আবার নতুন করে জন্ম হলো। আমি যেন এক নতুন বিস্ময়কর জগতের সন্ধান পেলাম। আমার সামনে খুলে গেল এক অনন্য জ্ঞানের দুয়ার। বাবা, তোমাকে আজ আমার বাবা বলে ভাবতে বড় গর্ব হচ্ছে। তুমি যদি আজ এই বাবাসাহেবের ছবিটা বাড়িতে না আনতে, তাহলে হয়তো আমার জাতির মুক্তিদাতা, সর্বশ্রেষ্ঠ মানবধর্ম মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক পতিতপাবন হরিচাঁদ ঠাকুর, মহান শিক্ষাবিদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকেও চিনতে পারতাম না। বাবাসাহেব সম্পর্কেও একটা ভুল ধারণা হয়তো দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে হতো আমাকে। আমি জানবো বাবা, আমি অবশ্যই জানবো। আমার অস্তিত্বকে আমি জানবো। আমার ইতিহাসকে আমি নিশ্চই জানবো। আমি চিনবো আমাকে নতুন করে সত্যিকারের ইতিহাসের পথ ধরে। আর সকল শিক্ষিত সমাজকে বলবো – তোমরাও এসো আমার সাথে যত লাঞ্ছিত বঞ্চিত, শোষিত দলিত ভাই-বোন, এসো আমরা আমাদের সঠিক ইতিহাসের সন্ধান করি।
বিমল – সমু, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন। আজ তোমার নিজের ইতিহাস জানার আগ্রহ দেখে আমারও গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে বাবা। আর তোমার ইতিহাসের পথ ধরে জানতে গিয়ে তুমি চিনতে পারবে আমার সমাজের আরো অনেক মহাপুরুষ, মহাজ্ঞানীদের। তুমি পাবে – মহামতি তারক সরকারকে, মহানন্দ হালদারকে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে, পাবে জ্যোতিবা ফুলে, সাবিত্রীবাঈ ফুলে, সাহুজী মহারাজ, রামস্বামী নাইকারের মতো মহামানবদের। তুমি পাবে মহামতি অশোক, বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধকে, পাবে পূর্ববুদ্ধগণকে। এসব জানতে পারলে দেখবে তুমি এক অন্য মানুষে পরিণত হয়েছো। যে মানুষটির শিরদাঁড়া সোজা, উন্নত শির, চোখে মুখে এক বিশ্বমানবতাবোধের অম্লান দীপ্তি।
অমলা – তা হলে আর দেরী কেন? চলো আমরা সবাই মিলে পতিতপাবন ঠাকুর হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের আসনের পাশে মহামানব বাবাসাহেবের আসন পাতি।
সমু – আর সেই সাথে এসো আমরা সকলে মিলে বলি – সবাই – “আত্মপরিচয় মনে নাহি হায় তাই এত দুর্গতি ভালে। পূর্ব বিবরণ কররে স্মরণ শক্তিতে ওঠরে জ্বলে।
সমাপ্ত
আরও কিছু লেখাঃ