Written by
1. প্রথম ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) – বয়স ৫০-৫৫
2. প্রথম ব্রাহ্মণের স্ত্রী – বয়স ৩০-৩৫
3. দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) – বয়স ৪৫-৫০
(সকাল বেলা। চারিদিকে পাখপাখালির ডাক শোনা যাচ্ছে। ১ম ব্রাহ্মণ একমনে গায়ত্রীমন্ত্র যপ করছে।)
১ম ব্রাহ্মণ – ওম্ জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধন্তারিং সর্বপাপাঘ্নংপ্রতি হস্মি দিবাকরম্।
ধদিসংকতু সারাভং শিরার্ণব সমুদ্ভবম্।
নমামি শশিদং ভক্ত্যা , সম্ভোর মুকুট ভূষণম্।
ধরণীগর্ভ সম্ভুতং বিদ্যুতপুঞ্জ সমাপ্রবং।
কুমারং শক্তি হস্তঞ্চ লোহিতাঙ্গং নমামিহম্।
................................................
নীলাঞ্জন সমাহসন রবিপুত্রং যমাগ্রজম্।
ছায়া আগর্ভকম্ ভুতং তাং নমামি শনৈশ্চরং।
অর্ধকায়ং মহাঘোরং চন্দ্রাদিত বিমর্দকং।
সিংঘিকায়ঃ সূতং রৌদ্রং তং রাহুং প্রণমিহম্।
পলা লুধম্ সংকাশং তার গ্রহ বিমর্দকং।
রৌদ্রং রুদ্রাত্মকং ক্রুরং তং কিতুং প্রণিমহম্।
স্ত্রী - শেষ হল তোমার পূজোপাঠ?
১ম ব্রাঃ – হ্যাঁ হল , কেন? কিছু বলবে নাকি?
স্ত্রী - হ্যাঁ, অনেকদিন ধরে ভাবছি তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবো। কিন্তু, তোমার ব্যাস্ততায় সে সুজোগই হয়ে উঠছে না। আজ তো ভারত বন্ধ্ মানে হরতাল। বাজারঘাট সব বন্ধ। তোমারও দোকানে দোকানে ফোঁটা কাটা নেই। তাই ভাবলাম -।
১ম ব্রাঃ – জিজ্ঞাসা? বলো কী জিজ্ঞাসা করতে চাও।
স্ত্রী - বলছি , তুমি এত যে মন্ত্রপাঠ , পূজার্চনা , যপতপ করো ; আমাকেও তো কিছু মন্ত্রপাঠ , পূজার্চ্চনা করা শিখিয়ে দিতে পারো?
১ম ব্রাঃ - (হেসে) কেন? সংসারের কাজকর্ম ছেড়ে তোমার আবার মন্ত্রপাঠের কী দরকার পড়ল?
স্ত্রী - না, মানে – মন্ত্রপাঠ করে পুজো করলে নাকি দেবতারা সন্তুষ্ট হন। তাতে আত্মশুদ্ধি হয়। শরীর মন পবিত্র হয়।
১ম ব্রাঃ - শোনো , যেমন আছো তেমনি থাকো। ওই পাপ কাজটি করার ধৃষ্টতা দেখাতে যেও না কখনো।
স্ত্রী - সে কী গো! মন্ত্রপাঠ করে দেবতার পুজো করবো , এতে পাপ হবে কেন? তা হলে কী তোমরা এই পুরুত বামুনরা এতদিন শুধু পাপ করেছ? তুমি মন্ত্রপাঠ করে পুজো করতে পারো , আমি তোমার সহধর্মিনী আমি পারব না কেন?
১ম ব্রাঃ- কেন? তুমি জানো না, শাস্ত্রানুসারে নারীদের এবং শূদ্রদের বেদ ও মন্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ। মনুসংহিতায় কী বলা হয়েছে জানো?
স্ত্রী - কী বলেছে?
ব্রাঃ- মনুসংহিতায় বলেছে – স্ত্রীলোকদের সংসারের নিমিত্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। তবে, সে সব অনুষ্ঠানে কোনোরূপ বেদমন্ত্র উচ্চারণ করা যাবে না। যদি কোনো নারী ইহা করে , তবে সে নরকগামী হবে। সুতরাং, যেমন আছো তেমনি থাকো। বেদ-মন্ত্র নারীদের জন্য নয়।
স্ত্রী - এটা কেমন বিচার হল? তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে ,আমিও ব্রাহ্মণের মেয়ে। নারী আর পুরুষদের জন্য আলাদা বিচার কেন?
১ম ব্রাঃ – সে তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণই ঠিক করে দিয়ে গেছে। গীতার নবম অধ্যায়ে ৩২নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন –
‘মাংহি পার্থ ব্যপশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রীয়োবৈশ্যস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্’।।
স্ত্রী - এর মানে কী?
১ম ব্রাঃ - অর্থাৎ , হে অর্জুন! স্ত্রী, শূদ্র এবং বৈশ্যের পাপযোনীতে জন্ম। এরাও যদি আমার শরণ করে , তাহলে এদেরকেও আমি উদ্ধার করবো।
স্ত্রী - তাহলে তো কৃষ্ণের মায়েরও পাপযোনীতে জন্ম। আবার আমি, তোমার মা , মানে আমার শাশুড়ীমা , তোমার বোন আমরা সবাই পাপযোনীতে জন্ম নিয়েছি। অর্থাৎ, ব্রাহ্মণের ঘরে একই মা ছেলে জন্ম দিলে প্রশ্ন ওঠে না ; আর মেয়ের জন্ম হলেই সেই মা পতিতা? এ আবার কেমন বিচার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের?
ব্রাঃ - শোনো শাস্ত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে নেই। শাস্ত্র প্রশ্নাতীত , অপৌরুষেয়। বেদ-পুরাণ-গীতা শাস্ত্রাদি হল ভগবানের মুখনিঃসৃত বানী।
স্ত্রী - শাস্ত্রাদি হল ভগবানের মুখনিঃসৃত বানী?
ব্রাঃ - হ্যাঁ।
স্ত্রী - হিন্দু ধর্মে কতগুলো শাস্ত্র আছে?
ব্রাঃ - অনেক আছে – বেদ – বেদান্ত – সংহিতা , রামায়ণ , মহাভারত , গীতা আরো অনেক।
স্ত্রী - এত শাস্ত্রের দরকার হল কেন? অন্যান্য ধর্মে তো একটা করেই ধর্মগ্রন্থ। মুসলমানদের কোরান , শিখদের গ্রন্থসাহেব , বৌদ্ধদের ত্রিপিটক , খ্রিষ্টানদের বাইবেল ইত্যাদি। হিন্দু ধর্মে এতগুলো কেন?
ব্রাঃ - বিভিন্ন যুগে ভগবান বলেছেন তাই।
স্ত্রী - বিভিন্ন যুগে ভগবান বলেছেন? নাকি বিভিন্ন সময়ে তোমরা সহজ সরল মানুষদের শোষণের কৌশল বদলাতে এতসব শাস্ত্রের উদয়। ভগবান কী এই বিকৃত সত্য , অর্ধসত্য , মিথ্যা , ছল-চাতুরী আর কল্পকথার গল্প বলেছেন?
ব্রাঃ - কী বলছ কী তুমি?
স্ত্রী - আমি বলতে চাইছি আসলে একদল শঠ প্রবঞ্চক , স্বার্থান্বেষী বামুনেরাই ভগবানের নাম করে শাস্ত্র আখ্যা দিয়ে কিছু মানুষকে শোষণ করতে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছে। আসল কারণ, একটা মিথ্যাকে চাপা দিতে অনেক মিথ্যার প্রয়োজন হয়। এই মিথ্যার ভিত কে মজবুত করতেই তোমাদের অসংখ্য শাস্ত্রের দরকার পড়েছে।
ব্রাঃ - দেখ , বাজে কথা বলো না।
স্ত্রী - এসব বাজে কথা? আচ্ছা, তুমি আমাকে একটা কথা বলো – তোমাদের কোন্ শাস্ত্রে আছে শুনেছি যে, ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ , বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য আর পা থেকে শূদ্রের জন্ম। কী চমৎকার ব্যাপার , একটা পুরুষই চার বর্ণের মানুষের জন্ম দিয়ে দিল , মা’য়ের আর দরকার পড়ল না? আচ্ছা, এটাও না হয় মেনে নিলাম। এই চার বর্ণের বাইরেও পৃথিবীতে আরো কত মানুষ রয়েছে , তাদের কী ভাবে জন্ম হয়েছে?
ব্রাঃ – তোমার এই সব বাজে কথার উত্তর আমি দিতে পারবো না।
স্ত্রী - বাজে কথা? তুমি তোমার শাস্ত্রকে আর বিজ্ঞান কে পাশাপাশি তুলনা করে দেখ , কত অসার হেঁয়ালি কথায় ভরা তোমার শাস্ত্র। তা ছাড়া বেদে কী আছে? যা শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কটা ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেউ পড়তে পারবে না , শুনতে পারবে না , এমন কী স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারবে না? বেদ যদি সবার মঙ্গলের জন্য হয় , জ্ঞানের গ্রন্থ হয় , তবে সেটা সবার জানা দরকার। তাতে সবাই উপকৃত হবে। কিন্তু, ব্রাহ্মণ পুরুষরা সেটা হতে দেয়নি। তার মানে কী দাঁড়ায়? যে শুধু নিজেরা জ্ঞানী হবে , আর অন্যেরা মুর্খ হয়ে থাকুক। যাতে তারা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে পারে , তাই না?
ব্রাঃ - দেখ, বেদ হল ভগবানের বানী , বেদ পাঠের অধিকার অর্জন করতে হলে পুর্বজন্মের পূণ্যের প্রভাবে ব্রাহ্মণ পুরুষ হয়ে জন্ম নিতে হয়।
স্ত্রী - বাঃ বাঃ ,কী দারুন কথা – ভগবানের বানী , পাপ-পূণ্য , জন্মান্তরবাদ। এটাই তো তোমাদের বড় অস্ত্র। যেখানে সহজ সরল , ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ আর প্রশ্ন করার সাহস পায় না। তারা এক অদ্ভূত ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে পরম ভক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে ধোকাবাজির তত্ত্বকে ভাগ্যলিখন বলে মেনে নেয়।
ব্রাঃ - শোনো গিন্নী , তুমি বাপের বাড়িতে লেখাপড়া শিখেছ , কিছু বইপত্র পড়েছ মানলাম ; তাই বলে দেব-দেবতার লীলাখেলা তোমার দ্বারা বোঝা সম্ভব নয়, বুঝলে?
স্ত্রী - দেব-দেবতা! তুমি এই কথাগুলি শুনেছ নিশ্চই – “মানুষই দেবতা গড়ে তাহারই কৃপার পরে করে দেব-মহিমা নির্ভর।
ব্রাঃ - মানুষই দেবতা গড়ে বুঝলাম। কিন্তু, এই মানুষকে কে তৈরি করল শুনি?
স্ত্রী - তোমাদের ওই তিন হাজার বছরের তেত্রিশ কোটি দেবতা নিশ্চই নয়? কারণ , তোমাদের দেবতা জন্মানোর কয়েক লক্ষ্য বছর আগেই মানুষের জন্ম হয়েছে।
ব্রাঃ - শোনো, যা বোঝো না , তা নিয়ে কথা বোলো না তো।
স্ত্রী - তোমরা তো আমাদের বুঝতেই দাও নি। তবে আমি যা লেখা পড়া শিখেছি , তাতে আমি বাস্তবকে বুঝি , যুক্তিকে বুঝি ,মানব ধর্মকে বুঝি।
ব্রাঃ - ভগবানের বানী শাস্ত্রের তত্ত্ব তোমার ওই যুক্তি তর্কের অনেক উর্দ্ধে বুঝলে।
স্ত্রী - কখনোই নয় – সবার উপর মানুষ সত্য। তোমার ভগবান যুক্তি , বাস্তবের ধার না ধারলেও মানুষকে তা মেনে চলতে হয়। তাদের ক্ষিদে পেলে খেতে হয় , আঘাত পেলে ব্যাথা পায়।
ব্রাঃ- কিন্তু, ভগবান কে ডাকলে মানুষ মনের শান্তি পায়। দেবতার শরণ নিলে মনোবল পায়।
স্ত্রী - সেটা মানুষের চিত্তের দুর্বলতা। নিজের অজ্ঞতার কারণে সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া।
ব্রাঃ - জগৎটাই তো মিথ্যা। ব্রহ্মই সত্য। গীতায় তো এই কথাটাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন।
স্ত্রী – হ্যাঁ , গীতা তো তোমাদের এখন বেদের জায়গা নিয়েছে। কুরুক্ষেত্রে নিজের আত্মীয়স্বজনকেই মারতে হবে বলে অর্জুন যখন বিষাদগ্রস্ত। অস্ত্র ত্যাগ করেছে। ক্ষত্রিয় অর্জুনের ক্ষত্রিয়ত্ব জাগিয়ে তোলার জন্য , স্বজনকে মারতে উৎসাহ জাগাতে কৃষ্ণ যে উপদেশ দিয়েছেন , তা-ই হল শ্রীমদ্ভাগবতগীতা তাইতো?
ব্রাঃ - হ্যাঁ , ঠিকই বলেছ।
স্ত্রী - ওই ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যেও বলেছে কৃষ্ণ , শুনেছে অর্জুন। লিখেছে কে?
ব্রাঃ- কেন , কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব।
স্ত্রী - ব্যাস দেব। তিনিও যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষ্ণের পাশে ছিলেন নাকি?
ব্রাঃ - নাতিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন না। তিনি ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা সব জানতে পেরেছিলেন।
স্ত্রী - ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা? ব্রহ্মজ্ঞান তো মূলনিবাসী সনাতনী ভারতীয়দের অনন্ত বিজ্ঞান-ভিত্তিক জ্ঞান। আর বৈদিক ব্রাহ্মণদের ব্রহ্ম তো প্রবাহন সৃষ্ট প্রতারণা, জালিয়াতির তত্ত্ব ; যার দ্বারা ব্রহ্ম শব্দের মূল অর্থটাই বিকৃত হয়ে গেছে, যা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত। তোমার এই শ্রীকৃষ্ণের অর্জুনকে উপদেশ দেওয়ার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বলেছেন জানো?
ব্রাঃ - কী বলেছেন?
স্ত্রী - কবিগুরু বলেছেন –
“যখন কুরুক্ষেত্রের তুমুল যুদ্ধ আসন্ন , তখন সমস্ত ভাগবদ্গীতা নিবিষ্ট চিত্তে শ্রবন করিতে পারে ভারতবর্ষ ছাড়া এমন দেশ জগতে আর নাই।’’
ব্রাঃ - রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষকে ছোট করল না বড় করল?
স্ত্রী - কেন? তুমি তোমার ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে বুঝে দেখ ছোট করল না বড় করল।
ব্রাঃ - মনে তো হচ্ছে ছোটই করল। আসলে রবীন্দ্রনাথ মনে হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহিমাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে নি।
স্ত্রী - আচ্ছা , এ সব না হয় ছেড়েই দিলাম। এটা তো বলো – শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – স্ত্রী , শূদ্র এবং বৈশ্যেরা তাঁর শরণ নিলে এদেরকে তিনি উদ্ধার করবেন। আমরা নারীরা অনেকেই তো অনেক কাল ধরে জ্ঞানে অজ্ঞানে কৃষ্ণের শরণ নিয়ে চলেছি। তাতেও কি আমরা উদ্ধার হতে পারলাম না? আসলে এসব হল তোমাদের পুরুষ-তান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ফল। তেত্রিশ কোটি কাল্পনিক দেব-দেবতা , শাস্ত্র-পুরাণের নাম করে নারীদেরও শোষণ করার ষড়যন্ত্র। তোমরা এই বৈদিক-বাদী ব্রাহ্মণরা আমাদের কী দিয়েছো – অশিক্ষা! জহরব্রত! সতীদাহ আর দাসত্ব!
ব্রাঃ - দেখ , এসব কথা নিয়ে আমি আর আলোচনা করতে চাই না।
স্ত্রী - সে তো চাইবেই না। যুক্তিতে যখন আর পেরে উঠবে না , তখন আলোচনা করতে আর ইচ্ছা করবে কেন? আমি কিন্তু কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার আরো অনেক প্রশ্ন আছে – সব প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দিতে হবে। আর ওই বেদের মন্ত্র আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে। আমি জানতে চাই যে , তোমাদের বেদে আর মনুসংহিতায় কী আছে। নইলে আমি কিন্তু তোমার ভাত রান্না করা বন্ধ করে দেব বলে রাখলাম।
ব্রাঃ - আরে বাবা রাগ করছ কেন? সে হবেখন। কিন্তু, এখন আমাকে বেরতে হবে।
স্ত্রী - আর একটা কথা , আমরা তো বাংলায় কথা বলি। তোমাদের মন্ত্রটা বাংলায় বলতে পারো না? না কি দেবতারা বাংলা বোঝেন না?
ব্রাঃ - আবার সেই প্রশ্ন। তুমি জানো না, হিন্দু ধর্মের নিয়ম-বিধি আচার-বিচার নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে নেই? তাতে পাপ হয়।
স্ত্রী - হোক্ পাপ। কিন্তু , আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। নইলে , এই অন্যায়,অবিচার আমি সহ্য করবো না।
ব্রাঃ - অ্যাঁ , এ তো দেখছি মহাবিপদ! ঠিক আছে পরে দেখা যাবে ; এখন আমার নামাবলীটাতো দাও। অনেক বেলা হয়েছে, এক যজমানের বাড়িতে যেতে হবে।
স্ত্রী - যেখানে যাবে যাও। তবে, ফিরে এসে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চাই।
(পথে মুখোমুখি দুই ব্রাহ্মণের দেখা। )
২য় ব্রাঃ – কী দাদা কোথায় গিয়েছিল? মুখটা এতো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
১ম ব্রাঃ - আর বলো না , এক যজমানের বাড়িতে। সেখানে যা কান্ড!
২য় - সেখানে আবার কী হল?
১ম - কী আর বলবো ভাই। ওই ছোটলোক শূদ্ররা কদিন আগেও ভালো ছিল। ব্রাহ্মণকে বেশ মান্যিগণ্যি করত। এখনকার শূদ্রদের বিশেষ করে ওই অস্পৃশ্য নমঃশূদ্রদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে শ্রদ্ধা-ভক্তি আর নেই। ওরা বুঝে গেছে যে, ওরা আসলে শূদ্রই নয়। দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে গেল।
২য়- ঠিকই বলেছো ভায়া। কিন্তু , ঘটনাটা কী?
১ম- আরে, ওপাড়ায় আমার এক যজমান আছে। তার ছেলের নতুন বিয়ে হয়েছে। বৌটাকে দেখতে বেশ সুন্দর। অল্প বয়স, কিন্তু, ডাগরডোগর চেহারা।
২য়- আরেকজনের বৌয়ের ডাগডোগর চেহারা , অল্প বয়স তাতে তোমার কী?
১ম - আরে ভাই তুমিতো জানো , ক’দিন আগেও আমাদের ‘গুরুপ্রসাদী’ প্রথার চল ছিল। অর্থাৎ কোনও বাড়ির নতুন বৌকে আগে কুলগুরু ভোগ করে শুদ্ধ করে দেবে, তার পর তার স্বামী নিয়ে সংসার করবে। কিন্তু এখন ওই ব্যাটা নমঃশূদ্ররা কেমন ঠ্যাটা হয়ে গেছে। ওই ‘গুরুপ্রসাদী’ প্রথা আর মানতেই চায় না।
২য়- কলি দাদা কলি। ঘোর কলি কাল। অধর্মে দেশটা ভরে গেছে। তা তোমার কী হয়েছে। ব্যাপারটা খুলে বলোতো।
১ম- সেটাই তো বলতে চাইছি। আমার যে যজমান , সে আর তার স্ত্রী আমাকে অন্ধের মতো মানে। তার ছেলেটাও তার বাবা,মায়ের কথায় কম-বেশী মান্যি করে। কিন্তু অত ভক্তি নেই অবশ্য। একটু লেখাপড়া শিখেছে না? কিন্তু, কাল হল গিয়ে ওই ছেলের নতুন বিয়ে করা নতুন বৌ’টা
২য় – ভায়া, আমি একটা ব্যাপার দেখি - সব ধর্মেই ধর্মের নামে নারীদের শোষণ করা হয় ,নারীদের দাসীর স্থান দেওয়া হয়। অথচ এই নারীরাই ধর্মীয় আচার বিচার অতিভক্তি ভরে পালন করে। তা তোমাকে এই নতুন বৌটা আবার কী করল?
১ম - কী আর বলব ভায়া , ভাবলাম গুরুপ্রসাদী প্রথাটা একেবারেই উঠে যেতে বসেছে। তা একটু কায়দা করে ওই প্রথাটাকে একটু বাঁচিয়ে রাখা যায়।
২য় - তা কী কায়দা করলে শুনি।
১ম - ওই নতুন বৌ’টা যখন আমাকে প্রণাম করতে এলো। তার রূপ সৌন্দর্য দেখে তো আমার বুকটাহু হু করে উঠল। হায়রে গুরুপ্রসাদী! আজও যদি থাকতো এই সুন্দরী কচি বৌ আমি প্রসাদ বানাতে পারতাম। ভাবলাম হিন্দু ধর্মের এই মহান ঐতিহ্যটা ফিরিয়ে আনতেই হবে। যে করেই হোক একে গুরুপ্রসাদ বানাতেই হবে। নইলে আমার গুরু জীবনটাই বৃথা!
২য়- তারপর , তারপর ; তারপর কী করলে?
১ম - আমি বাপ-ঠাকুর্দার মতোই অব্যর্থ একটা ফন্দি আটলাম। যাতে করে ওই বৌটাকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়।
২য় - কী ফন্দি আঁটলে দাদা?
১ম - আমি ওই বৌয়ের শাশুড়িকে ডেকে বললাম – তোমার এই নতুন বৌমার কপাল দেখে যা বুঝলাম, তাতে তোমার বৌমা কিন্তু অপয়া, অলক্ষ্মী। এসব তোমাদের গুরুদেব হিসাবে তোমাদের ভালোর জন্যই বলছি - ওর জন্যে কিন্তু তোমাদের সংসারে ঘোর অমঙ্গল ঘনিয়ে আসবে।
২য় - বাঃ মোক্ষম চাল চেলে দিলে। তারপর , তারপর? আরে তারপর কী হল সেটা তো বলো।
১ম - ওই বৌএর শাশুড়িতো আমাকে অন্ধের মতো ভক্তি করে। সে তো আমার পা চেপে ধরে আর ছাড়ে না। বলল – বাবা এখন কী হবে? এর থেকে মুক্তির কী উপায়? মুক্তির উপায় বলে দেন গুরুদেব। আপনি আমার সংসারটাকে বাঁচান। আমি তো এই সুযোগটাইখুঁজছিলাম।
২য় - আর এই সুযোগেই তুমি দাওটা মেরে দিলে?
১ম - আরে দূর , দাও তো মেরেছিলাম। কিন্তু, সে তো ফসকে গেল?
২য় - যাঃ ফসকে গেল? বলি ফস্কে গেল কী করে? এপর্যন্ত তো সব ঠিকই আছে। তা ফস্কে গেল কী করে?
১ম - কী আর বলব ভাই দূঃখের কথা। বৌমার অপয়াত্ব দূর করার বিধান দিলাম যে – সারা রাত যজ্ঞ করতে হবে একটি বন্ধ ঘরে। সে ঘরে আমার সঙ্গে শুধু ওই নতুন বৌমাকে থাকতে হবে। যজ্ঞের ধোঁয়ায় বৌমার কষ্ট হবে চিৎকার করবে। কিন্তু, ঘরের কাছেও কারো আসা চলবে না। যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে বৌমার সব দোষ কেটে যাবে। বাড়ির সকলে তা মেনেও নিলো। যজ্ঞের সব আয়োজন হল। বৌটাকেও তার শাশুড়ি অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ঘরে আমি একা আর ওই নতুন বৌ’টা।
২য় - আহাঃ। তারপর শান্তি করে ডাগরডোগর নতুন সুন্দরী বৌটাকে গুরু-প্রসাদ বানিয়ে দোষমুক্ত করলে?
১ম - আরে ভাই, আমার দূঃখটা তো সেখানেই। তা আর পারলাম কোথায়?
২য় - কেন কেন? সবই তো ঠিকঠাক আছে? আবার কী হল?
১ম - কী বলব ভাই , যজ্ঞ-টজ্ঞ তো অং-বং-চং করে যা করার করলাম। যখন বৌ’টার হাত ধরে কাছে টানতে চেষ্টা করলাম। বৌ’টা তো বেঁকে বসলো। যখন একটু জোর খাটালাম – ও শালী আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমাকে তো লাথি চড় মেরে , চিৎকার চেঁচামেচি করে হাত ফস্কে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
২য় - যাঃ পাখি উড়ে গেল? কি সব্বনাশ। গুরুপ্রসাদী হল না?
১ম - ওর শাশুড়ি তো অমঙ্গলের ভয়ে আবার জোর করে ঘরে ঠেলে দিতে চাইলো। তখন আবার ব্যাগড়া দিলো ওই ছেলেটা। কাজটা হয়েই যেত। কিন্তু, ওই হারামজাদা ছেলেটা বলে কি না – এরকম শয়তান গুরু-ফুরু তার দরকার নেই। অপয়া বৌ নিয়েই নাকি সে সংসার করবে? কতবড় আস্পর্ধা! একটুও অমঙ্গলের ভয় করলো না!
২য় - সে কী! ব্রাহ্মণকে অমান্যি? এতবড় অপমান! তাইতো বলি দাদা ঘোর কলি কাল। তার উপর বললে আবার একটু লেখাপড়া শিখেছে। এসব হয়েছে ওদের ওই হরিচান গুরুচানের জন্যে।
১ম - সে যাই বল , আমিও ছাড়বার পাত্র নই ভায়া।ওই বৌয়ের শ্বশুর শাশুড়িকে ভালোমতো ভড়কে দিয়ে , ওই রাতেই ছেলে বৌ’কে বাড়ি ছাড়া করিয়েছি। খুব লেখাপড়া শিখেছে? এবার বোঝ্ ঠ্যালা।
২য় - বেশ করেছ। উচিৎ শিক্ষা দিয়েছ। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকে অপমান। ধর্মে সইবে কেন?
১ম - ঠিক বলেছো ভায়া। তা তুমি কোথায় গিয়েছিলে? ব্যাগ-ট্যাগ বেশ ভারী দেখছি। বড় দান ঝেড়েছো না কি?
২য় - না – না - , কী যে বল। কোথায় বড় দান? পরিশ্রমের মূল্যটাই তো পেলাম না। একটা শ্রাদ্ধ করাতে গিয়েছিলাম। তুমিই বলো , শ্রাদ্ধের মতো অতো বড় একটা কাজ ; তাতে পেলাম কি না মোটে দুই ব্যাগ জিনিস? আজ আর কোথায় সেই ব্রাহ্মণকে দান-ধ্যান করা। গরু দান, জমি দান , সোনা দান , গৃহ দান ; আজ আর সে সব কিচ্ছু নেই। সবাই তো চতুর্থী অন্নজল করেই ছেড়ে দেয়।
১ম - আরে ভায়া বলছি কী? ওই নমঃশুদ্ররা এখন সত্যিই চালাক হয়ে গেছে। ওই ছোট জাত হরিচান, গুরুচান, আম্বেদকরে মত মেনে ওরা লেখাপড়া শিখে এখন বুঝে গেছে যে , পরজন্ম , স্বর্গ-টর্গ বলে কিছু নেই। সব যে আমাদের লুটে খাওয়ার ধান্দা, ধোকাবাজি এসব ওরা এখন ধরে ফেলছে। অনেক দিনের নিয়ম , তাই কেউ কেউ একটু আদটু মানছে। দেশের সব মানুষ শিক্ষিত হয়ে গেলে না , এও পাবে না। শেষে আর পুরুতগিরি করে পেট চালানোই দায় হয়ে যাবে।
২য় - না ভায়া অত সহজ নয়। এই মানুষ না , অন্ধ কুসংস্কারকে সহজে ছাড়তে চায় না। ওরা আমাদের কাল্পনিক দেব-দেবীর উপর নির্ভরশীল হয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে আরাম পেয়ে গেছে। দেখনা , এখনও ওই শুদ্ররা , নমঃরা অনেক শিক্ষিত হয়েও আরো বেশি ঘটা করে পুজো-আশ্রা করে। আর আমাদের পুজো করে দেওয়ার জন্যে ডাকে। অত সোজা না ভায়া।
১ম - কিন্তু, ভায়া ভয় হয় , আর কতদিন চালাতে পারব এই বিনাপুজির ব্যাবসা। অনেকদিন তো এই শূদ্রদের, নমঃদের ঘোল খাইয়েছি। এখন তো দেখছি বাড়ির বৌএর মুখই বন্ধ করা দায় হয়ে পড়েছে। ঠিক আছে যাই ভাই বাড়ি গিয়ে দেখি কী আছে কপালে।
২য় - আচ্ছা , ঠিক আছে। আমারও একটু তাড়া আছে।
১ম ব্রাঃ - কী গো কোথায় গেলে?
স্ত্রী - এই যে এলেন মহারাজ। দুইদিন পর বাড়ি ফিরলেন আমার পরম গুরু পতিদেবতা।
১ম - তুমি ওরকম ভাবে কথা বলছ কেন? দুইদিন পর কত কষ্ট করে এলাম।
স্ত্রী - বলব না! তুমি আমার পতি পরমেশ্বর। তোমরা বর্ণশ্রেষ্ঠ বামুন। নারীরা তোমার দাসী , ভোগের সামগ্রী। ধর্মের নামে , শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে , নারীদের জীবন নিয়ে তোমরা যা খুশি তাই করতে পারো। তোমাদের মতো পুরুত বামুন , গুরুঠাকুরদের একটু সম্মান করব না?
ব্রাঃ - কেক্ কেক্ কেন? আমি আবার কী করলাম?
স্ত্রী - তুমি কী ভেবেছিলে? আমি বাড়ী থাকি বলে তোমার কুকম্মের কোনো খবর রাখি না?
ব্রাঃ - ক্কি ক্কি কী খবর? তুমি আবার কোথা থেকে কী খবর পেলে?
স্ত্রী - শোনো তুমি এতদিন ঘুঘু দেখেছ , ফাঁদ দেখনি।
ব্রাঃ - ভনিতা না করে তুমি কী শুনেছ বলবে তো।
স্ত্রী - আচ্ছা বলো তো, নারীরা আর কতদিন তোমাদের ভোগের সামগ্রী হবে বলতে পারো?
ব্রাঃ - তা তা তার মানে? তুমি কী বলতে চাইছ?
স্ত্রী - তোমাদের কবে সুবুদ্ধি হবে? জানো না ওরা শিক্ষায় আর পিছিয়ে নেই? গুরুচাঁদের শিক্ষান্দোলনের ফলে নব আলোকে আলোকিত হয়ে একে ব্রাহ্মণদের পূজা-পার্বন মানতে চাইছে না , তাতে আবার এই জঘন্য কাজ করতে গেলে তুমি কোন্ সাহসে?
ব্রাঃ - জঘন্য কাজ মানে? পূজার্চ্চনা জঘন্য কাজ? শোনো। এখনও ওদের বেশীরভাগই আমাদের ছাড়া চলতে পারছে না। এখনও ওদের পুজো-পার্বন ছেড়ে দেওয়া অনেক দেরী। আমাদের আর দোষ কী?
স্ত্রী - আবার তুমি কথা বলছো? হরিচাঁদের দর্শন সম্পূর্ণ না মানতে পারলেও , তাঁর বানী কিন্তু, নারী সমাজকে নতুন করে সসম্মানে বাঁচতে শিখিয়েছে। তাই নারীরা আর তোমাদের ভোগের সামগ্রী হয়ে থাকবে না।
ব্রাঃ - অ্যাঁ - .......................
স্ত্রী – ঠাকুর হরিচাঁদ বলেছেন –
‘লয়ে নিজ নারী ব্রহ্মচারী সৎ চরিত্র রও।
চরিত্র পবিত্র রাখিকাজের কাজী হও।।
পরপতি পরসতী স্পর্শ না করিবে।
হরিকে না ডাকো হরি তোমাকে ডাকিবে’।
ব্রাঃ – এতে আমার কী আসে যায় বলো তো? এসব আমাকে শোনাচ্ছো কেন?
স্ত্রী - শোনো, ভালোয় ভালোয় বলছি , এ পর্যন্ত তোমার অনেক অপকম্ম সহ্য করেছি। এই তোমরা বামুন ছাড়া আর অন্য মানুষকে মানুষ বলেই গন্য কর না। এমন কী তোমাদের ঘরের মা বোন স্ত্রীকেও নয়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তোমরা নিরীহ মানুষদের উপর অনেক অত্যাচার করেছো। আর নয়।
ব্রাঃ - কেন তোমাকে আবার কী করলাম?
স্ত্রী - তোমার মুখ দেখাতে লজ্জা করছে না? এই বুড়ো বয়সে তোমার কামনা , লালসার শীকার করতে গেছ একটা বাচ্চা মেয়েকে? ছি! ছি! ছি!
ব্রাঃ - এসব কী যা তা বলছো তুমি? শাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের এই অধিকার আছে। এটা একটা পবিত্র বিধান। এতা কোনো পাপ নয়। আর আমি তো কিছুই করিনি।
স্ত্রী - কিছু করোনি? তাদের একটা সর্বনাশ করতে না পেরে , মনের সাধ না মেটাতে পেরে , আরেকটা বড় ক্ষতি তুমি তাদের করে এসেছো। ওই ছেলেটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সে সব বলেছে আমাকে। তোমার কথা মতো তার বাবা-মা তাদেরকে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে। বেচারা নতুন বিয়ে করেছে , কোথায় সুখে শান্তিতে সংসার করবে। সেই সুখের সংসারে তুমি আগুন জ্বেলে দিয়ে এলে। একটা নিরপরাধ মেয়ের কপালে তুমি অপবাদের কলঙ্কচিহ্ন এঁকে দিয়ে বলছো কিছু করনি।
ব্রাঃ - ব্যাটা এইসব বলেছে? সব মিথ্যে কথা। সত্যিই আমি কিছু করিনি। ওদের সংসারের মঙ্গলের জন্য যজ্ঞ করেছিলাম। ওই মেয়েটি যজ্ঞের নিয়ম মানেনি ; তাই ওর শ্বশুর শাশুড়ি বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি কী করতে পারি?
স্ত্রী - থামো , তোমরা কী করতে পারো আমার তা জানা আছে। ভালো চাও তো ওই সংসারকে আবার জোড়া দিয়ে এসো। ওরা তোমাদের গুরু হিসাবে মানে। আর তোমরা নিজের স্বার্থের জন্য দ্রোনাচার্যের মতো বারবার একলব্যের আঙ্গুল কেটে নাও। এতদিন ধরে একের পর এক অন্যায় করেও তোমাদের মনে একটু বিবেকবোধ জাগে না? তোমরা তো সব স্বার্থে অন্ধ হয়ে গেছ। কান খুলে শুনে নাও , ওই ছেলে মেয়ে দুটো যদি সুখে সংসার করতে না পারে , তবে তোমার সংসারেও আমি আগুন জ্বালিয়ে দেব এই বলে রাখলাম।
ব্রাঃ - এখন আমি কী করতে পারি?
স্ত্রী – তুমি সব পারো। ওরা তোমাদের মতো পুরুত বামুনদের অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তুমি ওদের গিয়ে বোঝাবে যে , ওসব অপয়া, অলক্ষ্মী , অমঙ্গল এবং যজ্ঞ করার কথা তুমি তোমার আদিম বাসনা মেটানোর জন্য বলেছো। ও কথা যখন শুনেছে, এ কথাও নিশ্চই শুনবে। এক্ষুণি গিয়ে বলে আসবে যাও।
ব্রাঃ - ঠিক আছে যাচ্ছি। দেখি কদ্দুর কী করতে পারি।
স্ত্রী - আরেকটি কথা ওই মানুষগুলোকে দয়া করে বলে এসো – কর্মই ধর্ম। দেব-দেবী , মন্ত্র-তন্ত্র আসলে সব ভাওতাবাজি। মনভুলানো গল্প।
পতিতপাবন হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন –
“জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।/ ইহাছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা’’।
ব্রাঃ – ঠিক আছে দেখছি। জীবে দয়া নামে রুচি ........................।
স্ত্রী - দেখ , চোখের ঠুলি খুলে ফেলে দেখ। এই তোমাদের মতো বৈদিক ব্রাহ্মণদের স্বার্থের কারণে আজ শাস্ত্র, তন্ত্র-মন্ত্র, আচারে বিচারে , হাজার রকম জাতপাতে ভারতবর্ষ একটি ভূতের কারাগারে পরিণত হয়েছে। এই তোমরা পুজারী বামুনরা যদি একবার একজোট হয়ে ভারতবর্ষের স্বার্থে একদিনের জন্যও বলো যে, আজ সমস্তরকম যাগযজ্ঞ , ধর্মীয় আচার , পূজার্চনা বন্ধ। আমার বিশ্বাস যে , সেই দিন ভারতবর্ষের কয়েকশো কোটিটাকার অপচয় বেঁচে যাবে।ডাকো না তোমরা একবার বন্ধ। অনির্দিষ্টকালের হরতাল। তখন দেখবে , ‘ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’।
গান বাজবে – বলো বলো সবে শত বীনা বেনুরবে ..............................।
সমাপ্ত
বঙ্গীয় হরি-গুরুচাঁদ আম্বেদকর চেতনামঞ্চ
আরও কিছু লেখাঃ