জগদীশচন্দ্র রায়
হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ প্রকাশনী
Guruchand Thakurer Shikhsha Andolan
By : Jagadish Chandra Roy
Price Rs. 30.00Third Edition: March, 2019Published by : Mili RoyA-13, Sahyadri, Room No. 606Lokdhara, Kalyan East, Mumbai - 421306Copyrights All rights reserved by the Publisherপ্রথম প্রকাশঃ ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭(হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ জন্মজয়ন্তী উদ্যাপনী)দ্বিতীয় সংস্করণঃ ২৫ মার্চ, ২০১৭ (মহাবারুণী)তৃতীয় সংস্করণঃ মার্চ, ২০১৯প্রকাশকঃ মিলি রায়এ-১৩, সহায়াদ্রি, রুম নং ৬০৬লোকধারা, কল্যাণ ইস্ট, মুম্বাই - ৪২১৩০৬কপিরাইট প্রকাশক কর্তৃক সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিতপ্রচ্ছদঃ কৌশিকমুদ্রণেঃ হালদার কম্পিউটারপালপাড়া (পশ্চিম), চাকদহ, নদিয়া। মূল্যঃ তিরিশ টাকা মাত্র। প্রাপ্তিস্হানঃ প্রদীপ কুমার বিশ্বাস, চরমণ্ডল, বাগদা, উঃ ২৪ পরগনা, ৭৪৩২৯৭, মোঃ ৯৭৩২৫০৯৮৬০লেখক-এর ঠিকানাঃA-13, Sahyadri, Room No. 606Lokdhara, Kalyan East, Mumbai - 421306মোঃ ০৯৯৬৯৩৬৮৫৩৬
উৎসর্গ
তরুণ প্রজন্মের
বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে-
মহামানব গুরুচাঁদ ঠাকুরের শি¶া-আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের লেখা পড়েছি। কিন্তু মহানন্দ হালদার রচিত মূল আকর গ্রন্হ “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত” থেকে উদ্ধৃতিসহ তার বিশদ ব্যাখ্যাযোগে জগদীশ চন্দ্র রায়ের লেখা “গুরুচাঁদ ঠাকুরের শি¶া-আন্দোলন” বইটির মতো আগে আর কোনো বই পড়িনি। এমন সহজ-সরল সাবলীল ভাষায় লেখায় যে কেউ অতি সহজেই মহামানব গুরুচাঁদ ঠাকুর অস্পৃশ্য তথা নির্যাতিত সমাজের শি¶ার ব্যাপারে যে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যার ফলে তৎকালীন সমগ্র বঙ্গদেশে যে প্রায় দু’হাজারের কাছাকাছি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সে সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে পারবেন। তাঁর এই শি¶া-আন্দোলনের ফলে নমঃশূদ্র সমাজে যে বিদ্যাশি¶ার এক জোয়ার তথা নবজাগরণ এসেছিল, যার ফলে নমঃশূদ্র সমাজে আজ শি¶ার হার তপশিলি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ ভারতবর্ষের মনুবাদী সমাজব্যবস্হায় সেই মহামানবের বিষয়ে সাধারণের অবগত হওয়ার কোনো ব্যবস্হাই রাখা হয়নি। জগদীশবাবুর লেখা এই বই সকলের প¶ে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প¶ে সেই না জানা ইতিহাস জানতে অতি মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এই বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করি।
১৫ জানুয়ারি, ২০১৭
সুধীর রঞ্জন হালদার
পালপাড়া, নদিয়া।
বৈদিক আর্য-সমাজব্যবস্হায় মূলনিবাসী ভারতীয়দের প্রতি অত্যাচার বঞ্চনার প্রতিবাদে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বাংলার গুরুচাঁদ ঠাকুর। তাঁর সমাজ দর্শন, রাষ্ট্র দর্শন মূলনিবাসী ভারতীয়রা গ্রহণ না করবার ফলে আজ বৃহত্তর সমাজ সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত। গুরুচাঁদ-দর্শনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, রাজা বা ক্ষমতার অধিকারের প্রয়োজনীয়তা ব্রাহ্মণ্য শ্রেণি পালন করে। কিন্তু মূলনিবাসী ভারতীয়দের মধ্যে অন্যতম শাখা নমঃজাতির মতুয়া সমাজ গুরুচাঁদের দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য করণীয় থেকে বহুদূরে। গুরুচাঁদের দর্শন না মানার ফলে মতুয়া সমাজ আজ দেশছাড়া, সম্পদ হারা। ব্যাবসাবাণিজ্য, চাকুরি থাকলেও প্রকৃত অর্থে ভারতীয় আইনে বেনাগরিক। অজ্ঞানতার অন্ধকারে এখনও মতুয়া সমাজ ডুবে আছে। অবাস্তব অলীক কল্পনায় ভগবান নামক শব্দে ডুবে আছে। “ভগবান” শব্দের প্রকৃত অর্থ এরা জানে না। সৃষ্টিতত্ত্বের পঞ্চভূতের আক্ষরিক শব্দের প্রতীক “ভগবান”। এর প্রকৃত রহস্য জানার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর সমস্ত বা সর্বশ্রেণির মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হবার কথা বলেগেছেন। মনে রাখতে হবে ডিগ্রি (certificate) অর্জনটাই শিক্ষার মাপকাঠি নয়। অতীতের সৃষ্টিতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজ ব্যবস্হা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্হা, সম্পদের বন্টনের প্রকৃত সত্য উপলবদ্ধি অর্জনই হ’ল শিক্ষিত হওয়া। ডিগ্রি বাড়িয়ে মাসমাইনের বড় অর্থের চাকুরি করলেই শিক্ষিত হওয়া নয়। কুসংস্কার, বঞ্চনা, অত্যাচার, শোষণের থেকে মুক্তি ও সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাঁরা সারা জীবন লড়াই করেন এবং করবার জন্য অন্যকে সেই শিক্ষা দেন, তাঁরাই প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত। এর বাইরে যারা ডিগ্রি বাড়িয়ে অবস্হান করে, তারা শিক্ষিত মূর্খ এবং সমাজের মধ্যে সব থেকে বড় অপরাধী, ক্ষতিকারক ব্যক্তি। নমঃজাতির মধ্যে মতুয়া সমাজের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ লোভী ক্ষতিকারক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি।
শ্রদ্ধেয় জগদীশচন্দ্র রায় মতুয়া-নমঃজাতির ঘুম ভাঙ্গাতে, বৃহত্তর মূলনিবাসী ভারতীয়দের জাগরিত করার জন্য গুরুচাঁদ-দর্শনকে যেভাবে প্রচারের জন্য চেষ্টা করেছেন, তা ভীষণভাবে সময় উপযোগী। গুরুচাঁদের দর্শনে বৃহত্তর সমাজ যদি শিক্ষিত হয়, তবে মূলনিবাসী ভারতীয় গোষ্ঠীর মতুয়া সমাজ সুরক্ষিত হবে এবং পরবর্তী প্রজন্ম তার অধিকার পাবে। গুরুচাঁদের ধম্মদর্শন-এর মূল ভাবনা রয়েছে তাঁর শিক্ষাদর্শনে। যে শিক্ষাদর্শনে লেখাপড়া (জ্ঞান অর্জন), সমাজদর্শন, রাষ্ট্রদর্শন, সাম্যবাদের দর্শন প্রতিফলিত।
প্রথাগত, প্রচলিত গুরুদেবের বাক্য ও নির্দেশকে মেনে চলে তার শিষ্যগণ। গুরুচাঁদ ঠাকুরকে মতুয়া সমাজ যদি গুরুদেব স্বরূপ মানেন, তবেই এই জাতির মুক্তি আসবে। অন্যথায় নয়।
শ্রদ্ধেয় জগদীশচন্দ্র রায় “গুরুচাঁদের ধম্মদর্শনের” গবেষণার মাধ্যমে মূলনিবাসী ভারতীয়গণ ধর্মের ভাবনা না ভেবে (কারণ, ‘ধর্ম’ হচ্ছে INDIVIDUAL ভাবনা- ক্ষুদ্র পরিসরে) ধম্মের ভাবনায় এবং চেতনায় (ধম্ম হচ্ছে সঠিক সৃষ্টিশীল কর্ম বা কাজের সাম্যবাদের বিজ্ঞান ভাবনা) এগিয়ে চলুক এবং সঠিকভাবে করুক এই আশা রাখি।
মুলনিবাসী ভারতীয় মতুয়া সমাজের সার্বিক সুরক্ষা কামনায়-
২৬/০২/২০১৭
প্রদীপ কুমার বিশ্ব্বাস
সিন্দ্রানী, উত্তর ২৪ পরগণা
গত ইং ৪-২-২০১৭ তারিখে সিন্দ্রানী “হরিচাঁদ গুরুচাঁদ গ্রন্হাগার” কমিটির পক্ষ থেকে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জন্মজয়ন্তীতে গবেষক লেখক ও মতুয়া ধর্ম-দর্শন প্রচারক, শ্রদ্ধেয় জগদীশচন্দ্র রায় (মুম্বাই)-এর লেখা “গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলন” গ্রন্হটি প্রথম প্রকাশিত হয়। গবেষণাধর্মী ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক এই গ্রন্হটি অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পাঠকবর্গের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের দীর্ঘদিনের মনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হওয়ায় অচিরেই মুদ্রিত গ্রন্হটির সমস্ত কপিই শেষ হয়ে যায়। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরও অধিক পাঠকবর্গের অনুরোধ আসতে থাকে। কিন্তু সিন্দ্রানীতে আমরা ১৩ মার্চ ২০১৭ গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম দিবসে “গুরুচাঁদ মিউজিক অ্যান্ড আর্ট অ্যাকাডেমি” প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত থাকায় পাঠকবর্গের চাহিদা পূরণ করতে পারিনি। ১৩ মার্চ ২০১৭ গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে গুরুচাঁদ “মিউজিক অ্যান্ড আর্ট অ্যাকাডেমি” প্রতিষ্ঠা পরবর্তীতে জগদীশবাবুর লেখা “গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলন” গ্রন্হটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের কাজে ব্রতী হলাম। এই সংস্করণে আরও কিছু নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে যা পাঠকবর্গের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনেক অনেক প্রশ্নের অবসান ঘটাবে বলে আশা রাখছি। দ্বিতীয় সংস্করণের প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বে শুরু করার জন্য পাঠকবর্গের কাছে ক্ষমা চেয়ে বইটির বহুল প্রচার ও প্রসারের জন্য আবেদন রাখছি।
ধন্যবাদান্তে-
মিহির সরকার (শিক্ষক)
১৫-০৩-২০১৭ সদস্য
সিন্দ্রানী হরিচাঁদ গুরুচাঁদ গ্রন্হাগার
সিন্দ্রানী, বাগদা, উঃ ২৪ পরগণা, ৭৪৩২৯৭
“মন দিয়ে কর সবে বিদ্যা উপার্জন।
সকল ধনের সার, বিদ্যা মহাধন। ।
এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে।
যতই করিবে দান, ততই যাবে বেড়ে। । ”
কবির এই শিক্ষা সংক্রান্ত সার কথা দিয়ে হাতে খড়ি হয়েছিল আমার। আর গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলনের ফলে আজ কলম ধরতে শিখেছি। তাই সমাজের পিছিয়ে রাখাদের উত্তরণের জন্য “গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা-আন্দোলন”কে সহজ সরল ভাষায় লিখে প্রতিটি শিক্ষানবিশদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য আমার এই ¶ুদ্র প্রচেষ্টা।
এই কাজে আমাকে যাঁরা উৎসাহ যুগিয়েছেন “সিন্দ্রানী হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ গ্রন্হাগার”-এর প্রতিষ্ঠাতাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আর এই মতুয়া ধর্ম দর্শনের আলোয় আলোকিত করার জন্য “হরি-গুরুচাঁদ আম্বেদকর চেতনা মঞ্চ” এবং পরবর্তিতে “বঙ্গীয় হরি-গুরুচাঁদ আম্বেকর চেতনা মঞ্চ”-এর মতুয়া গবেষক, গায়ক ও আমার প্রিয় চেতনা সংগ্রামী সাথিদের প্রতি শ্রদ্ধা চিত্তে কৃতজ্ঞতা জানাই। আর এই বইয়ের অক্ষর বিন্যাস ও প্রুফ রিডিং এবং বই-এর জন্য যিনি শুভেচ্ছা বার্তা লিখে দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, সেই শ্রদ্ধেয় লেখক সুধীর রঞ্জন হালদার ও আমার এই বই প্রকাশের কাজে যাঁরা প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
আর একটা কথা- পরবতর্ীতে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেলে সংযোজন করা হবে। আর নিকট ভবিষ্যতে এই বই হিন্দি ভাষাতেও প্রকাশিত হবে। এই বইটি সমাজের জাগরণের কাজে লাগলে আমার চেষ্টা সার্থক মনে করব।
বিনীত-
জগদীশচন্দ্র রায়
মুম্বাই ১৮/০২/২০১৭
মোঃ ০৯৯৬৯৩৬৮৫৩৬
প্রতিটি মানুষ আজ শিক্ষার কথা বলছে ও শিক্ষা নিয়ে ভাবছে। কারণ, মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, শিক্ষার মধ্যেই সকল মুক্তির বীজ লুকিয়ে আছে। সকাল বেলায় যখন ভোরের শিকারী এসে দাঁড়ায় আমাদের পূর্বদিগন্তে এবং তার সেই হাতের উজ্জ্বল বর্ষা ছুড়ে মেরে অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে দেয়, ঠিক তেমনি শিক্ষা সমস্ত অজ্ঞানতার অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে দেয়। আর জ্ঞানের আলোর প্রকাশ ঘটে। শিক্ষা মানে মুক্তি। শিক্ষা মানে জীবন। শিক্ষা মানে স্বপ্ন। শিক্ষা মানে আমাদের বিকাশ। এইসব কথা হরিচাঁদ ঠাকুরও বুঝেছিলেন। তাই-
অনুন্নত জাতি মাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।
আজ্ঞা করে হরিচাঁদ তাঁরে বিধিমতে। । (গুরুচাঁদ চরিত, পৃঃ ১০১)
সবাই আজ স্কুলমুখী। কিন্তু এখনো অনুন্নত শ্রেণির সন্তানদেরকে স্কুলে শিক্ষা না দেওয়ার শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে পঠনপাঠন কম, আর অন্যান্য আনুসঙ্গিকের আধিক্য। এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের সাধারণ ঘরের সন্তানদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করতে পারলে আবার গোলামির শৃঙখল অাঁকড়ে ধরবে। তাই প্রবাদ আছে যদি ১০০ বছরের জন্য পরিকল্পনা করো তাহলে মানুষের মধ্যে শিক্ষার বীজ বপন করো।
গুরুচাঁদ ঠকুর পিতার আজ্ঞা শিরোধার্য করে এই শিক্ষার বীজ বপন করেছিলেন মানুষ তৈরি করার জন্য। মানুষ অনেকে হয়েছেন। কিন্তু এখনো অন্ধকার দূর হয়নি। অন্ধকার দূর করার জন্য তন-মন-ধন দিয়ে সঙ্গে সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত হতে হবে। প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। তবেই স্বপ্ন সাকার হবে। হতাশা মিটে যাবে। আমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নির্মাণ করতে পারবো।
আমার এই বইয়ের তৃতীয় সংস্করণের অক্ষর বিন্যাস ও প্রুফ রিডিংএর কাজে ও সব রকমের বৌদ্ধিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মূলনিবাসী সংগ্রামী পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় সুধীর রঞ্জন হালদার ও এই বই প্রকাশের কাজে সব রকমের বৌদ্ধিক পরামর্শ দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় দাদা প্রদীপ কুমার বিশ্বাস। তাঁদের আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই। আর বইয়ের প্রচ্ছদের কাজে সহযোগিতা করেছে আমার এই চেতনা সংগ্রামের সহযোদ্ধা কৌশিক রায়। তাকে আমার আন্তরিক ভালোবাসা ও অভিনন্দন জানাই। ৩য় সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা সামান্য কমলেও লেখা প্রায় একই আছে। সামান্য সংযোজন ও বিয়োজন হয়েছ। বইটি ইতিমধ্যে হিন্দি ও উড়িআ ভাষাতেও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে; ইংরেজিতে অনুবাদের কাজও চলছে। বইটি সমাজ জাগরণের জন্য নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের কাজে লাগলে আমার চেষ্টা সার্থক মনে করব।
বিনীত-
মুম্বাই, ৩ জানুয়ারি, ২০১৯ (মাতা সাবিত্রীবাই-এর জন্মদিন)
জগদীশচন্দ্র রায়
শিক্ষা হচ্ছে কোনো জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষাহীন মানুষ বা সমাজ হচ্ছে হালবিহীন নৌকার মতো। সেখানে নিজের কোনো দিশা থাকে না। প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করার শক্তি থাকে না। তাই আমরা এক কথায় বলতে পারি- ‘শিক্ষা হচ্ছে সর্ব শক্তির মূল উৎস। ’
এই ‘মূল উৎস’কে অনুপ্রবেশকারী আর্যরা১ ভাল করে বুঝতে পেরেছিল বলেই তারা ভারতের ক্ষমতা দখল করার পরে যে তিনটি অধিকারকে হনন করেছিল সেগুলো হচ্ছে- শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ও অস্ত্র ধারণ করার অধিকার। তার মধ্যে ‘শিক্ষার অধিকার হনন’ ছিল অন্যতম।
শিক্ষাই হচ্ছে মূল শক্তি বা অমোঘ অস্ত্র। যে অস্ত্রের দ্বারা সব ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব। যার জন্য বলা হয় ‘অসি’র থেকে ‘মসি’র জোর বেশি। অর্থাৎ অস্ত্রের (অসি) থেকেও কলমের কালি(মসি)র জোর বা শক্তি বেশি। সেই মসির শক্তি দিয়ে অনুপ্রবেশকারী আর্যরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্হ যেমন বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, গীতা ইত্যাদি রচনা করে ভারতবর্ষের মূলনিবাসী মানুষদের সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে মানসিক গোলাম বানিয়ে রেখেছে। যে গোলামি এখনও অব্যাহত।
কিন্তু এই গোলামি থেকে মূলনিবাসীদের মুক্ত করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহামানবেরা সংগ্রাম করেছেন। তার মধ্যে মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী মহামানব জ্যোতিরাও ফুলের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজের জীবনসঙ্গিনী সাবিত্রীবাই ফুলেকে প্রথমে শিক্ষিত করে তোলেন। তারপর সাবিত্রীবাই ফুলেকে দিয়ে মহিলাদের শিক্ষিত করার কাজে নিযুক্ত করেন।
জ্যোতিরাও ফুলে শিক্ষা সম্বন্ধে বলেছেন-
বিদ্যা বিনা মতি (বুদ্ধি) গেছে
মতি বিনা নীতি (আদর্শ) গেছে
নীতি বিনা গতি (দিশা) গেছে
গতি বিনা বিত্ত (সম্পত্তি) গেছে
বিত্ত বিনা শূদ্রের পতন হয়েছে
এতসব অনর্থ একমাত্র অবিদ্যার জন্য হয়েছে।
এই আসল সত্যকে বুঝতে পেরে তিনি ১৮৪৮ সালে বিদ্যাদানের জন্য ব্রতী হন। আর নিজের জীবনসঙ্গিনীকে শিক্ষিত করে ভারতের চিরবঞ্চিত নারীসমাজকে সাম্যের অধিকার প্রদান করার জন্য শুরু করেন নারীশিক্ষা-আন্দোলন ।
শিক্ষা সম্পর্কে বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছেন, দু-টাকা উপার্জন করলে এক টাকা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য খাবার কিনে খাও। আর এক টাকা দিয়ে বই কিনে সন্তানদেরকে শিক্ষিত কর। তিনি বলেছেন, শিক্ষা হচ্ছে বাঘিনীর দুধ। এই দুধ পান করলে সব কিছুতে তেজোদ্দীপ্ত হওয়া যায়।
তাই তাঁর শ্লোগান- শিক্ষিত হও, সংগঠিত হও, সংঘর্ষ কর।
আর একজন সমাজ বিপ্লবী ছিলেন সন্ত গাড়্গে মহারাজ, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর। তাঁর নামে মহারাষ্ট্রে একটি বিশ্ব্ববিদ্যালয় রয়েছে। তিনি শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন- “ভগবানের জন্য খরচা করো না। ঐ পয়সা শিক্ষার জন্য ব্যয় কর। পয়সা মন্দিরে না দিয়ে কোনো ছাত্রছাত্রীকে দাও। ভক্তির প্রচার ভালো নয়। শিক্ষার প্রসার অতি ভালো। ”
আর বাংলার মহামানব হরিচাঁদ ঠাকুরও তৎকালীন সমাজব্যবস্হায় ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণ, শৃঙখল ও দাসত্ব থেকে নিপীড়িত জনগণকে মুক্ত করার কাজে ব্রতী হন। তবে তিনি অনুধাবন করেন, তখনকার অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষেরা ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতাকলে পিষ্ট হয়ে ধর্মহীন পতিত হয়ে গেছে। তাই তিনি প্রথমে এই ধর্মহীন পতিত অবস্হা থেকে তাদেরকে মুক্ত করার জন্য সত্য-প্রেম-পবিত্রতার ধর্ম- ‘মতুয়াধর্ম’-এর স্হাপন করেন ১৮৩০ সালে। ২ তিনি তাঁর জীবিতাবস্হায় দ্বিতীয় আন্দোলন অর্থাৎ শিক্ষার আন্দোলন চালু করে যেতে পারেননি। তাই তিনি এই শিক্ষা আন্দোলনের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন স্বীয় পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপর। যেটা আমরা আচার্য মহানন্দ হালদার-এর ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’-এ দেখতে পাই-
“অনুন্নত জাতিমাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।
আজ্ঞা করেন হরিচাঁদ তারে বিধি মতে \”
-গুরুচাঁদ চরিত, পৃঃ ১০১
ঐ সমসাময়িক কালে বাংলায় যে শিক্ষা-আন্দোলন চলে, সেখানে বাংলার অস্পৃশ্য পতিত এবং অনগ্রসর সমাজ মোটেই উপকৃত হয়নি; বরং আমরা দেখতে পাই- বিদ্যাসাগর (ঈশ্ব্বরচন্দ্র শর্মা) ১৮৫৯ সালে বাংলার লেফ্টেনান্ট গভর্ণরকে এক আবেদনে জানিয়েছিলেন- “ইংল্যান্ড এবং ভারতে (বাংলা সহ) এরূপ একটি বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, উচ্চবর্ণের লেখাপড়া শেখার জন্য যথেষ্ট কাজ করা হয়েছে এবং এখন প্রধানত সাধারণ পতিত জনগণের শিক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়- শিক্ষাবিস্তারের সবচেয়ে ভাল ব্যবস্হা হল, যদি না তা একমাত্র প্রযোজ্য ব্যবস্হা বলে গণ্য হয়, কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের ভেতর ব্যাপকভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটানো। ”৩
বাংলার আর এক মহামানব যাঁকে এখনও পর্যন্ত অচ্ছুৎ করে রাখার ফলে তাঁর সম্পর্কে সর্বসাধারণ তেমন কিছু জানেন না। যিনি তাঁর পিতার দেওয়া গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রথমেই দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন-
“খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই \” -ঐ পৃঃ ১৪৪
“ছেলে মেয়েকে দিতে শিক্ষা
প্রয়োজনে করিবে ভিক্ষা। ”
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অশিক্ষা হচ্ছে মারণ রোগ। তার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন, খেতে না পাওয়ার অভাব থেকে অশিক্ষার অভাব আরো অনেক বড়। তাই খাদ্যকষ্টের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেও শিক্ষা স্বরূপ খাদ্য থেকে যদি কেউ বঞ্চিত থাকে তাহলে সে যন্ত্রণা কারো একার নয়, সেটা দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রেও প্রগতির অন্তরায় স্বরূপ। তাই যেকোনো পরিস্হিতিতে সন্তানদের শিক্ষিত করতে হবে। প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও এই অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবে। তিনি আরো বললেন-
কুসংস্কার আছে যত দূর কর’ অবিরত
বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। -ঐ পৃঃ ১১৯
কুসংস্কার হচ্ছে সমাজের ক্ষতিকারক ভাইরাস। এই ভাইরাস থেকে প্রতি নিয়ত দূরে থাকতে হবে। আর তার জন্য ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে হবে। তার জন্য তিনি বলেন-
“অজ্ঞান ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।
জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ \” -ঐ পৃঃ ১৩৭
হ্যাঁ, তুমি যদি এই অজ্ঞানতার ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে চাও তাহলে তুমি একমাত্র জ্ঞানের আলো দিয়েই এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবে। আর তার জন্য তোমাকে বলি-
“তাই বলিভাই মুক্তি যদি চাই
বিদ্বান হইতে হবে।
পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ
চিরসুখী হবে ভবে \” -ঐ পৃঃ ১৩০
যে মহামানবের ভাবনা এত উচ্চমানের সেই মহামানব হচ্ছেন শিক্ষার অগ্রদূত গুরুচাঁদ ঠাকুর। তাঁর সম্পর্কে প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেওয়া দরকার।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম ১৮৪৬ সালের ১৩ মার্চ; বর্তমান বাংলাদেশের ওড়াকান্দী গ্রামে। পিতার নাম হরিচাঁদ ঠাকুর আর মাতা হচ্ছেন- শান্তিমাতা। গুরুচাঁদ ঠাকুরের বয়স যখন সাত বছর পূর্ণ হয়, তখন তাঁর পিতা হরিচাঁদ তাঁকে বোঝান যে, আমাদের সমাজে তো তেমন কোনো বিদ্যা শিক্ষা নেই। তাই-
“আমার প্রাণের ইচ্ছা তোমাকে পড়াই।
বিদ্যার অমূল্য মূল্য জগতে শিখাই \” -ঐ পৃঃ ৩৯
গুরুচাঁদ শিক্ষা গ্রহণে রাজি হয়ে যান। আর পাঠশালার শিক্ষা গ্রহণ করা জন্য পদ্মবিলার সাধু দশরথের কাছে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন।
এর পর মল্লকান্দী গ্রামে গোলকের বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এইভাবে তিন বছর শিক্ষা গ্রহণের পরে তিনি ওড়াকান্দীতে ফিরে আসেন। কিন্তু ওড়াকান্দীতে তিনি কোনো উচ্চবর্ণীয়দের স্কুলে ভর্তি হতে পারেন না। কারণ, তিনি তো পতিত অস্পৃশ্য নিচু জাতির লোক। উচ্চবর্ণীয়রা তাঁকে শিক্ষার অধিকার কেন দেবে? তখন বাধ্য হয়ে তিনি মুসলমানদের মক্তবে ভর্তি হন।
“ওড়াকান্দী মক্তবেতে প্রভুকে পাঠা’ল \
কিছুকাল তথাকারে শ্রীগুরু চরণ।
আরবি পারসি ভাষা করে অধ্যয়ন \” -ঐ পৃঃ ৪০
সেখানে আরবি, পারসি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। মক্তবের শিক্ষা সমাপ্ত হলে উচ্চশিক্ষার কোনো সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৮৫৮ সালে তাঁকে শিক্ষা গ্রহণ বন্ধ করতে হয়। তখন থেকে বাড়িতে থেকেই তিনি বিভিন্ন গ্রন্হ পড়ে জ্ঞানার্জন করতে শুরু করেন।
এরপর সেই সময়ের নিয়মানুসারে ‘বিয়া করি গুরুচাঁদ সংসারী সাজিল। ’ পিতামাতার ইচ্ছানুসারে গুরুচাঁদ ঠাকুর সত্যভামাকে বিবাহ করে সংসারধর্ম শুরু করেন। পিতা হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর উপর সংসারের কর্তব্য পালন করার জন্য দায়িত্ব সঁপে দেন। তবে তিনি পুত্রকে পরামর্শ দেন এই বলে যে, সংসার ধর্ম করতে হলে সংযমী হতে হবে। অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে।
এরপর সময়ের তালে তালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের চার পুত্র ও এক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। পুত্রদের নাম যথাক্রমে শশিভূষণ, সুধন্য উপেন্দ্র ও সুরেন্দ্র। কন্যার নাম করুণাময়ী।
গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্যাবসাবাণিজ্য করে সংসার চালাতেন। সংসারে বেশ আয় উন্নতি হচ্ছিল। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসাবে ১৮৭৯ সালে ২০ টাকা ট্যাক্স দেন সরকারকে। তিনি গরিব লোকদেরকে ব্যাবসা ও কৃষিকাজ করার জন্য অর্থ সাহায্য করতেন।
সংসারের সমস্যা যখন দূর হল এবং সবকিছু বেশ ভালভাবে চলতে লাগল তখন তিনি পিতৃদায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করেন।
গুরুচাঁদ দেখেন, এই বাংলার মধ্যে যারা অনুন্নত জাতির লোক আছে তাদের কাছে শিক্ষা বিষয়টা হচ্ছে গভীর অন্ধকারময়। সকলে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত থেকে দুঃখ ভোগ করছে। এদের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে সকলে এদেরকে প্রতিনিয়ত শোষণ করে চলেছে, অধিকার বঞ্চিত করে চলেছে। তৎকালীন অবস্হার পরিপ্রেক্ষিতে যাদের স্কুলের দরজা দেখার অধিকার ছিল না, সাধারণের জলাশয় থেকে যাদের জলপানের অধিকার ছিল না, তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে একথা ভাবাও যেন পাপ। কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুর জানতেন শিক্ষা ছাড়া মানুষ কখনও প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে না। আর এই প্রকৃত সত্যকে জানতে না পারলে কোনো দিনও তারা অত্যাচারীদের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারবে না। একমাত্র সঠিক শিক্ষাই মানুষকে প্রকৃত সত্য জানতে সাহায্য করে ও শক্তিশালী হতে সাহায্য করে। তাই ১৮৮০ সালে তিনি নিজের বাড়িতেই প্রথমে পাঠশালা স্হাপন করে শিক্ষাদানের মতো মহৎ কাজ শুরু করেন। যে পাঠশালা হল বাংলায় পিছিয়ে রাখা সমাজের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
“নিজগৃহ পরে প্রভু করে পাঠশালা।
দেশবাসী ছাত্র আসি করিল জটেলা \” -ঐ পৃঃ ১০২
সেই পাঠশালায় দূরদূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়াশুনা শুরু করে। তবে সমস্যা দেখা দিল ভাল শিক্ষক পাওয়ার। কারণ-
“অন্য জাতি শিক্ষা দেয় শুধু অর্থ-জন্য।
নমঃশূদ্র গণে মূর্খ-মধ্যে গণ্য \” - ঐ পৃঃ ১০৩
অন্য জাতি অর্থাৎ উচ্চজাতির শিক্ষকরা শুধু অর্থের জন্যই শিক্ষা দেয়। তবে সেই শিক্ষায় নিম্নসমাজের ছাত্রছাত্রীরা মোটেই শিক্ষিত হতে পারে না। শুধু অর্থের অপচয়। কারণ, উচ্চজাতির শিক্ষকরা নমঃশূদ্রদের সব সময় মূর্খ মনে করে। আসলে জাতি ব্যবস্হার জন্য নিম্নজাতির লোকদের প্রতি ঘৃণা ও অস্পৃশ্যতা সব কিছুকে গ্রাস করে নিয়েছিল।
শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার প্রতি নজর না দেওয়ার ফলে ছাত্রদের লেখাপড়ার আগ্রহ কমে যেতে থাকে। ফলে তাদের স্কুল যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
তারপর কয়েকমাস পরে রঘুনাথ সরকার নামক একজন স্বজাতি শিক্ষক স্বেচ্ছায় শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
“বার’শ সাতাশি সনে অঘ্রাণ মাসেতে,
পাঠশালা হ’ল সৃষ্টি চৌধুরী বাটীতে \” -ঐ পৃঃ ১০৮
১৮৮০ (১২৮৭ বাংলা) সালে নভেম্বর মাসে চৌধুরী বাড়িতে পাঠশালা তৈরি করা হয়। এই পাঠশালা কিছুদিন চলার পর গ্রামের মধ্যে উঁচু জায়গা দেখে সেখানে পাঠশালার জন্য বড় একটা ঘর তৈরি করা হয় টিনের ছাউনি দিয়ে। আর ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য আসবাবপত্র ও প্রয়োজন মত তৈরি করা হয়। এই স্কুলের উদ্বোধন করেন গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজে। সেখানে উদ্বোধনী বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন-
“গুরুচাঁদ বলে, “শুন ভাই সব যত।
জাতির উন্নতি কিন্তু এই সূত্রপাত \
যাক জান ধন মান তা’তে ক্ষতি নাই।
সব দিয়ে এই দেশে স্কুল রাখা চাই \
স্বজাতি শিক্ষক এবে পাইয়াছি মোরা।
আর কিসে ভয় করি কিসে দুঃখ করা?
মোর পিতা হরিচাঁদ গেছে বলে মোরে।
বিদ্যা শিক্ষা স্বজাতিকে দিতে ঘরে ঘরে \
বিদ্যা বিনা সব বৃথা দেখ মনে ভেবে।
বিদ্যা পেলে ধন মান সব কিছু পাবে \
শুন স্বজাতির গণ সবে মনোকথা।
বিদ্যাশূন্য ধন মান সব জানো বৃথা \
নমঃশূদ্র জাতি যদি বাঁচিবারে চাও।
যাক প্রাণ সেও ভাল বিদ্যা শিখে লও \
আমি বলি বিদ্যাশূন্য রবে যেই জন।
নমঃশূদ্র বলি তারে বল না কখন \
বিদ্যাবান যেই জন তাঁরে মান্য দাও।
বিদ্যার ভিত্তিতে সবে সমাজ গড়াও \
যেই জন বিদ্যাবান পরম পণ্ডিত।
সমাজের পতি তারে মানিবে নিশ্চিত \
বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।
বিদ্যা ধর্ম, বিদ্যা কর্ম, অন্য সব ছার \
বাঁচ বা না বাঁচ, প্রাণে বিদ্যাশিক্ষা চাই।
বিদ্যাহীন হ’লে বড় তার মূল্য নাই \
বারে বারে বলি তাই স্বজাতির গণ।
শেখ বিদ্যা রাখ বিদ্যা করে প্রাণপণ \” -ঐ পৃঃ ১০৮
অর্থাৎ, “ভাই সব আপনারা শুনুন, জাতির উন্নতির সূত্রপাত কিন্তু এই স্কুল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হল। আমাদের ধন মান এমনকি প্রাণ চলে গেলেও ক্ষতি নেই; সব কিছুর বিনিময়ে আমরা এদেশে শিক্ষাব্যবস্হাকে কিছুতেই রুদ্ধ হতে দেব না। আমরা আমাদের সমাজেরই সুশিক্ষিত শিক্ষক পেয়েছি। তাই এখন তিনি আমাদের সন্তানদেরকে নিজের সন্তানের মতো করে শিক্ষা দেবেন। আমাদের আর কোনো ভয় নেই, কোনো দুঃখ নেই।
আমার বাবা হরিচাঁদ, আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন আমাদের প্রতিটি ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনারা ভেবে দেখুন, বিদ্যা না থাকলে সব কিছুই বৃথা হয়ে যায়। আর বিদ্যা অর্জন করতে পারলে ধন মান সব কিছুই পাওয়া যাবে। তাই ভাইসব আপনারা শুনুন, এই বিদ্যা অর্জন করতে না পারলে কিন্তু ধন মান সব কিছুই বৃথা হয়ে যাবে। আপনারা যদি মানুষ হয়ে মানুষের মতো বাঁচতে চান, তাহলে এই বিদ্যা অর্জন করতে গিয়ে যদি জীবন বলিদানও করতে হয় সেটাও ভাল। তবু এই বিদ্যা অর্জনের কাজে যেন কোনো প্রকার অসুবিধা না হয় সেটা লক্ষ রাখবেন। আমি আপনাদের আর একটা কথা বলছি, যারা অবিদ্বান থাকবেন, তাদেরকে কেউ আপন জন বলে মনে করবেন না। যিনি শিক্ষা অর্জন করেছেন তাকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদান করবেন। শিক্ষাকে ভিত করে আপনারা আপনাদের সমাজটাকেও গড়ে তুলুন। তাই আমাদের সকলের একটাই মন্ত্র হবে, সেটা হচ্ছে; বিদ্যাই আমাদের ধর্ম কর্ম এবং সব কিছু। এছাড়া অন্য কিছুর কোনো গুরুত্ব নেই। জীবনকে বাজি রেখে আমাদের এই বিদ্যা অর্জনের কাজকে ত্বরান্বিত করতে হবে। আপনারা এতক্ষণে আশা করি বুঝতে পেরেছেন যে, বিদ্যাহীনের কোনো মূল্য নেই। তাই আমি বার বার একটা কথাই আপনাদের বলি যে, যেকোন প্রতিকূল পরিস্হিতিকে অতিক্রম করে আপনারা নিজেরা যেমন বিদ্যা অর্জনে আগ্রহী হবেন, তেমনি এর গতিকে অব্যাহত রাখাও আপনাদের দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ব আপনারা প্রাণকে বাজি রেখে পালন করবেন। ”
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এরকম চেতনাবর্ধক বক্তব্য শুনে সভার সকলে প্রতিজ্ঞা করেন এই বলে-
“আজ হ’তে সবে মোরা অঙ্গীকার করি।
বিদ্যা ঘরে নিব তা’তে বাঁচি কিংবা মরি \
ঘরে ঘরে জনে জনে করে আলোচনা।
প্রাণ দিয়ে কর সবে বিদ্যার সাধনা \” -ঐ পৃঃ ১০৯
অর্থাৎ, “আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবার কাজ করব। যত রকম প্রতিরোধ সামনে আসুক না কেন, সব বাঁধাকে উপেক্ষা করে আমরা শিক্ষার আলো জ্বালানোর মশালকে জ্বালিয়ে রেখে দিগদিগন্তে পৌঁছে দেব। ”
১৮৮১ সালে খুলনা জেলার দত্তডাঙায় ঈশ্ব্বর গাইনের বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষে এক বিশাল জাগরণী সভার৪ আয়োজন করা হয়। এই সভায় দূরদূরান্ত থেকে বহু জ্ঞানীগুণী জন দলে দলে উপস্হিত হন। প্রায় পাঁচ হাজার লোক এই সভায় যোগদান করেন।
এই সভায় গুরুচাঁদ ঠাকুরকে সভাপতি হিসাবে মানোনীত করা হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তাগণের মধ্যে পাটগাতী গ্রামের দ্বারিক মন্ডল বলেন-
“কুসংস্কার আছে যত দূর কর অবিরত
বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। -ঐ পৃঃ ১১৯
অর্থাৎ দ্বারিক মন্ডল তাঁর বক্তব্যের মধ্যে মূল বিষয় উত্থাপন করেন সকলে কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে হবে। ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে যেন সকলে ব্রতী হন।
এর পর দ্বারিক মোক্তার বলেন-
“‘নমঃশূদ্র’ ‘নমঃশূদ্র’ শুনিমাত্র এই শব্দ
নাহি জানি সব পরিচয়।
অপর যতেক হিন্দু কেহ ত নহে রে বন্ধু
মোদেরে শোষণ করি খায় \’’ -ঐ পৃঃ ১১৯
অর্থাৎ, নমঃশূদ্র ব্যতীত অন্য কেউ আমাদের বন্ধু নয়। অন্যরা তো শুধুমাত্র আমাদের শোষণ করে চলেছে। কিন্তু কেন এই বৈষম্য? কেন এত শোষণ, অত্যাচার? এর মূল কারণ কি? এর মূল কারণ হচ্ছে-
“বিদ্যাহীন আছি মোরা তাই করিতেছে সারা।
ব্রাহ্মণ কায়স্হ আদি যত জাতি। ” -ঐ পৃঃ ১২০
অর্থাৎ আমাদের অশি¶ার সুযোগ নিয়ে উচ্চবর্ণীয়রা আমাদের সব দিক দিয়ে শোষণ করে নিচ্ছে। তবে আমরা যদি এখন থেকে শিক্ষিত হই, তাহলে আর কেউ আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। তাই সকলে মিলে প্রতি গ্রামে জেলায় পাঠশালা তৈরি করতে হবে। আমরা বিদ্যার্জন করতে পারলে আর কেউ আমাদের ঘৃণা করার সাহস পাবেনা।
এইভাবে বিভিন্ন বক্তা তাঁদের বক্তব্য দেবার পর গুরুচাঁদ ঠাকুর ঐ সভায় ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন। তিনি শিক্ষা বিষয়ে যে ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন সেটা এখানে তুলে ধরছি।
বক্তব্যের প্রথমেই তিনি জানান- “আমার পিতার মনে জাতিকে জাগানোর জন্য যে আশা ছিল সেটা তিনি পূর্ণ করে যেতে পারেননি। আমি যতদিন বাঁচব পিতার সেই অপূর্ণ কাজকে পূর্ণ করাই হবে আমার জীবনের লক্ষ্য। ” তাই-
“যে জাতির ঘরে বিদ্যা নাই ভরে’
দুর্ভাগা জানিবে তারে।
ধন-মান বৃথা বিদ্যা নাহি যথা
লোকে উপহাস করে \
*************
বিদ্যা ছিল বলে এই বিশ্ব্বতলে
পৃথিবী সুন্দর এত \” -ঐ পৃঃ ১২৬
অর্থাৎ যে জাতি বা সমাজ শিক্ষিত নয়, তাকে মনে করবে দুর্ভাগা বা অন্ধ। তাদের যতই ধন সম্পত্তি থাকুক না কেন তারা যদি অশিক্ষিত হয় তাহলে লোকে তাদের উপহাস করে। আর পৃথিবী এত সুন্দর কেন? সেটা শুধুমাত্র শিক্ষার জন্য। বিদ্যার কারণেই যত ধর্মগ্রন্হ রচিত হয়েছে। আর যাদের বিদ্যা নেই তারা বিদ্বানদের কাছে অবিদ্যার শিকার হয়েছে।
“বুদ্ধি আছে যার শকতি তাহার
দেহ-বল কিছু নয়।
বিদ্যা দেয় বুদ্ধি চিত্তে আনে শুদ্ধি
তাতে বুদ্ধি বৃদ্ধি হয় \” -ঐ পৃঃ ১২৯
অর্থাৎ বিদ্বানই শক্তিশালী। শারীরিক শক্তি কোনো শক্তি নয়। কারণ, বিদ্যাই বুদ্ধির জাগরণ ঘটায়। ভিতরের অন্ধকার দূর করে অন্তরে আলো জ্বালিয়ে দেয়। যার ফলে চেতনা শক্তির বিকাশ ঘটে। কিন্তু আমাদের সমাজের লোকেরা এত দুর্বল, কারণ-
“বিদ্যাহীন বলে ছলে, বলে, কলে
মোদের চরিয়ে খায় \
বিদ্যা-বলে বলী আছে যত বলী
অসীম শক্তি-ধরা।
বিদ্যাহীন মোরা তাই দেখি তারা
করে রাখে জ্যান্ত-মরা \
তাই বলি ভাই মুক্তি যদি চাই
বিদ্বান হইতে হবে।
পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ
চির সুখী হবে ভবে \” -ঐ পৃঃ ১৩০
অর্থাৎ আমার সমাজের লোকেরা শিক্ষার আলো না পাওয়ার জন্য তাদেরকে উচ্চবর্ণীয়রা ছলে বলে কৌশলে সব সময় অন্যায় অত্যাচার করে। কিন্তু যারা শিক্ষিত তাদের শক্তি হচ্ছে সব থেকে বেশি। আমরা অশিক্ষিত বলেই এই শিক্ষিত লোকেরা আমাদের প্রায় মরার মতো করে রেখে দিয়েছে। তাই আমি আপনাদের আহ্বান জানাই, আপনারা যদি এই অন্যায় অত্যাচার অবিচার ও অশি¶ার অন্ধত্ব থেকে মুক্তি চান, তাহলে আপনাদেরকে শিক্ষিত হতে হবে। আর একবার যদি আপনারা এই শিক্ষাকে অর্জন করতে পারেন তাহলে আপনাদের সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যাবে। শান্তিতে এই পৃথিবীতে জীবনযাপন করতে পারবেন।
“বিদ্যা যদি পাও কাহারে ডরাও
কার দ্বারে চাও ভিক্ষা।
রাজ শক্তি পাবে বেদনা ঘুচিবে
কালে হবে সে পরীক্ষা \” -ঐ পৃঃ ১৩০
আপনারা যদি শিক্ষিত হতে পারেন, তাহলে আর কাউকে আপনাদের ভয় করতে হবেনা। অন্যের কাছে গিয়ে কোনো কিছুর জন্য খোষামোদ করতে হবেনা। আপনাদের কাছে সব শক্তি এসে যাবে। এমনকি রাজকাজ করার শক্তিও আপনারা অর্জন করতে পারবেন। সমস্ত সমস্যা আপনাদের দূর হবে। হ্যাঁ, আমার কথা ভবিষ্যতে মিলিয়ে দেখবেন; আমি এক অক্ষরও মিথ্যা বলছি কি না?
“সিংহ শিশু হায় ভুলি পরিচয়
মেষ দলে রহে পড়ি।
জাগ সিংহ জাগ বরাভয় মাগ
এ বিশ্ব্ব দলিয়া পায়।
এ বিশ্ব্ব সৃজন করেছে যে জন
সেই দিবে পদাশ্রয় \” -ঐ পৃঃ ১৩০
আপনাদের পূর্বপুরুষ তো সিংহের মতো শক্তিশালী ছিলেন। আপনারা সেই সিংহের ন্যায় শক্তিশালী পূর্বপুরুষদের সন্তান। কিন্তু আপনারা কেন সেই পরিচয় ভুলে গিয়ে ভেড়ার দলে গিয়ে ভিড় করছেন? আপনারা জেগে উঠুন। সমস্ত ভীতিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সমস্ত অন্ধকারকে চিরে আলোর রশ্মি জ্বালান। এই ধরিত্রী আপনাদের। আপনারা এই ধরিত্রীর ভূমিপুত্র। মূলনিবাসী। তাই আপনারা সমস্ত বাধাকে পদদলিত করে অতিক্রম করে এগিয়ে চলুন।
“বিদ্যার অভাবে অন্ধ হয়ে সবে
অন্ধকারে আছে পড়ে।
জ্বেলে দাও আলো মোহ দূরে ফেল’
আঁধার ছুটিবে দূরে \” -ঐ পৃঃ ১৩০
অবিদ্যার জন্য আজ আপনারা সকলে চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে আছেন। আপনারা এই বিদ্যার আলোকে জ্বালিয়ে দিন। সমস্ত কুসংস্কারকে ছুঁড়ে ফেলে দিন। তাহলে দেখবেন এই বিদ্যার আলোতে সমস্ত ধরনের অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।
“পাঠশালা কর এক সাথে মর
ভাই ভাই হোক্ চেনা। ” -ঐ পৃঃ ১৩১
আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুন। সমস্ত বিভেদ ভুলে ভাইয়ের মতো সম্পর্কিত হয়ে শিক্ষার আন্দোলনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ুন। স্কুল তৈরি করুন। তবেই আপনাদের সব সমস্যার সমাধান হবে। আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে শিক্ষার আন্দোলন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে তখন শক্তিশালী হয়ে উঠবেন।
আর একটা কথা জানুন- ‘রাজ শক্তি বিনা সমাজ জাগে না। ’ তাই এই শিক্ষার আন্দোলনের সাথে সাথে সমাজকে জাগানোর জন্য আপনাদের রাজশক্তিকেও অর্জন করতে হবে।
“আত্ম-পরিচয় মনে নাহি হায়
তাই এত দুর্গতি ভালে।
পূর্ব বিবরণ কর রে স্মরণ
শক্তিতে ওঠরে জ্বলে \’’ -ঐ পৃঃ ১৩১
আমি আগেই বলেছি যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা সিংহের মতো তেজোদ্দীপ্ত ও শক্তিশালী ছিল। আমাদের জাতির লোকেরা কিছুতেই নিচ্ বা ক্ষুদ্র নয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সব দিক থেকে বীর্যবান ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনারা সেই পূর্বজদের ঐতিহ্যকে ভুলে গেছেন বলে আজ কপালে এই দুর্দশা নেমে এসেছে। তাই সেই পূর্বের ইতিহাস স্মরণ করে আপনারা আপনাদের শক্তিতে জ্বলে উঠুন। ”
এইভাবে সুদীর্ঘ ভাষণে জাতি তথা সমাজকে জাগানোর জন্য সমস্ত অধিকার অর্জনের জন্য তিনি সকলকে শিক্ষার আন্দোলন প্রসারিত করার জন্য আহ্বান জানান।
দত্তডাঙার সভায় গুরুচাঁদ ঠাকুরের জাতির জন্য উদ্দীপ্ত ভাষণ শোনার পর চারিদিকে শিক্ষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৮১ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে খুলনা শহরে Namasudra Welfare Association গঠিত হয়। উক্ত সংগঠনের তৎকালীন ২২টি জেলার প্রতিনিধি যোগদান করেন। শিক্ষা ও জাগরণের এই সম্মেলনের পর সর্বত্র সর্বশিক্ষা অভিযানের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। দিকে দিকে স্কুল করার জন্য সকলে চেষ্টা শুরু করেন। নিজেদের শত দারিদ্রের মধ্যেও সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য চেষ্টা করেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে শিক্ষা আন্দোলনের যে ঢেউ বইতে শুরু করে; সেই কাজে গতিদান করার জন্য গিরীশ বসু যিনি জাতিতে কায়স্হ (শূদ্র), তিনিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী হন। তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে গিয়ে সমাজের জন্য কিছু করার কথা প্রকাশ করেন।
“এই দেশে চিকিৎসার বন্দোবস্ত নাই।
দাতব্য চিকিৎসালয় করে দিতে চাই \” -ঐ পৃঃ ১৩৭
“এই অঞ্চলে চিকিৎসার কোনোরকম ব্যবস্হা নেই। তাই আমি একটা হাসপাতাল করে দিতে চাই। ”
গিরীশ বসুর এই কথা শুনে গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন-
“প্রভু বলে ‘মহাশয় বড় ভাল কথা।
ব্যাধি দূর করা বটে অতি উদারতা \
অজ্ঞান-ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।
জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ \
উচ্চ বিদ্যালয় এই দেশে কোথা নাই।
উচ্চ বিদ্যালয় কর এই ভিক্ষা চাই \” -ঐ পৃঃ ১৩৭
গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন- “গিরীশবাবু, আপনি খুব ভাল কথা বলেছেন। শারীরিক ব্যাধি দূর করা তো খুব ভাল কথা। কিন্তু এই দেশটা তো ভরে আছে অজ্ঞানতার ব্যাধিতে। সেই অজ্ঞানতার ব্যাধিকে দূর করতে হলে জ্ঞানের আলো দিয়েই সেটা দূর করা সম্ভব। তাই আমার অনুরোধ আপনি জ্ঞানের আলো দিয়ে অজ্ঞানতার অসুখকে দূর করার জন্য উচ্চ বিদ্যালয় স্হাপন করুন। কারণ, এদেশে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় নেই। আমি আপনার কাছে উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে দেবার অনুরোধ জানাচ্ছি। ”
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই করুণ আবেদনে সাড়া দিয়ে গিরীশ বসু ভীষণ আনন্দিত হন।
“তব আজ্ঞা শিরোধার্য আমি করিলাম।
করিব ইংরাজি স্কুল কথা যে দিলাম \” -ঐ পৃঃ ১৩৭
গিরীশবাবু গুরুচাঁদ ঠাকুরের কথা মাথা পেতে গ্রহণ করে জানালেন যে, তিনি ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল তৈরি করে দেবেন।
এখানে আমাদের একটি বিষয় লক্ষ করা দরকার; ঠাকুর হাসপাতালের পরিবর্তে উচ্চ বিদ্যালয় করার জন্য কেন গিরীশবাবুকে অনুরোধ করলেন? কারণ তিনি নিজের সন্তান শশিভূষণকে উচ্চ শিক্ষার জন্য তারক সরকারের বাড়িতে রেখেছিলেন। বাড়ি থেকে অনেক দূরে বা বিদেশে সন্তানকে রেখে পড়ানো গ্রামের দীনদুঃখী মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাই এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই তিনি নিজের এলাকায় উচ্চ বিদ্যালয় স্হাপনের জন্য আহ্বান করেছিলেন।
এরপর সকলের সুবিধা হয় এরকম একটা উঁচু স্হান দেখে সেখানে স্কুল করার জন্য নির্দিষ্ট হয়। গিরীশবাবুও কথা দেন কিছুদিন পরে কলকাতা গিয়ে স্কুলের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নিয়ে আসবেন।
কিন্তু নিচুজাতির অস্পৃশ্য চণ্ডালেরা উচ্চশিক্ষা লাভ করুক এটা যে উচ্চবর্ণীয়দের কাছে বজ্রাঘাতের সৃষ্টি করল।
“হিংসুক ব্রাহ্মণ যত ভাবে মনে মন।
উচ্চশিক্ষা পায় যদি নমঃশূদ্রগণ \
কিছুতে নিস্তার মোরা নাহি পাব আর। ” -ঐ পৃঃ ১৩৯
হিংসুক ব্রাহ্মণেরা মনে করল নিচ্ অস্পৃশ্যরা যদি উচ্চশিক্ষা পায় তাহলে তো তারা আমাদের আর মান্য করবে না। আমাদের কাছে এটা তো অশনি সংকেত।
তাই কয়েক গ্রামের উচ্চবর্ণীয়রা একত্রে শলাপরামর্শ করল যে, গিরীশ বসুকে এই কাজ কিছুতেই করতে দেওয়া যাবে না। আর একান্তই যদি গিরীশ বসু স্কুল করতে চায়, তো সেটা এই অস্পৃশ্যদের এলাকায় নয়; সেটা আমাদের এলাকায় করতে হবে। যাতে আমাদের উচ্চবর্ণীয়রা লেখাপড়া শিখতে পারে।
তারা গিরীশ বসুকে তাদের গ্রামে ডেকে পাঠাল। সমস্ত উচ্চবর্ণীয়রা গিরীশ বসুকে ঘিরে বসে জানায় যে, আমরা তোমাকে কয়েকটি কথা বলতে চাই-
“চিকিৎসালয় দিবে দাও নাহি করি মানা।
স্কুল দিবে কোন মর্মে কিছু ত বুঝি না \
ব্রাহ্মণ কায়স্হ কোথা যেথা তব ঘর।
তুমি বাস কর বাপু নমঃর ভিতর \
নমঃ জাতি চিন তুমি বিদ্যা শিক্ষা নাই।
বিদ্যাহীন বলে মোরা তাদেরে চরাই \
স্কুল যদি পায় তারা বিদ্বান হইবে।
আমাদের মনে বাপু কভু না রহিবে \” -ঐ পৃঃ ১৩৯
দেখ বাপু, তুমি বাস কর নমঃদের মধ্যে। ঐ নমঃদের এলাকায় যদি হাসপাতাল করে দাও তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি ওদের স্কুল কেন করে দিতে চাইছ সেটা ত বুঝতে পারছিনা। তাছাড়া যেখানে বেশির ভাগ ব্রাহ্মণ কায়স্হরা বসবাস করে; তুমি সেখানে স্কুল না করে ঐ নমঃদের এলাকায় গিয়ে কেন স্কুল করে দিতে চাচ্ছ বাপু? তাছাড়া তুমি তো জান, ঐ নমঃদের মধ্যে কোনো বিদ্যাশিক্ষা নেই। আর ওরা অশিক্ষিত বলেই না আমরা ওদের চরিয়ে খাই। এখন তারা যদি স্কুল পায়, তাহলে তো শিক্ষিত হয়ে যাবে। আর শিক্ষিত হলে তখন কি আর ওরা আমাদের মান্যগণ্য করবে? তাই একান্তই তুমি যদি স্কুল করতে চাও, তাহলে আমাদের এখানেই স্কুল কর। তাতে তোমার যেমন পুণ্য হবে; তেমনি আমরা ব্রাহ্মণরাও ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারব।
উচ্চবর্ণীয়দের এই সব কথা শুনে গিরীশ বসুর üদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসে। তিনি এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের কোনো রাস্তা খুঁজে পাননা। কারণ, তিনি তো গুরুচাঁদ ঠাকুরকে কথা দিয়েছেন স্কুল করে দেবার জন্য।
এইভাবে সাত পাঁচ ভাবার পর তিনি ব্রাহ্মণদের বললেন, “আমি কিছুতেই আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারব না। তোমরা আমাকে এই ধরণের কথা আর বল না। ” তখন-
“গিরীশের মুখে শুনি এ মত কাহিনী
জ্বলিয়া উঠিল সব ব্রাহ্মণ বাহিনী \” -ঐ পৃঃ ১৪০
গিরীশবাবুর কথা শুনে সমস্ত উচ্চবর্ণীয়রা তাঁর প্রতি ক্রোধে জ্বলে ওঠে। বিভিন্নভাবে ধর্মীয় কথা বলে তাঁকে ভয় দিতে লাগল। ধর্মগ্রন্হের উদাহরণ টেনে বলতে লাগল-
“শূদ্র পক্ষে তপ জপ ত্রেতাযুগে নাই।
শূদ্রকের মাথা কাটে রামচন্দ্র তাই \
নমঃশূদ্র অতি ক্ষুদ্র ক্ষীণ হয়ে রবে।
বিদ্যাশিক্ষা তার পক্ষে কভু না সম্ভবে \
কৃষিকর্ম করে যারা সেই ভাবে র’বে।
বিদ্যা পেলে কৃষিকর্ম বল কে করিবে?” -ঐ পৃঃ ১৪১
শূদ্রদের কোনো তপস্যা করার অধিকার নেই বলেই তো রামচন্দ্র শম্বুকের মাথা কেটে ফেলেছিল। নমঃদেরও নিচ হয়ে থাকতে হবে। তাদেরকে বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করার কোনো অধিকার দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া তারা তো চাষাবাদ করে। সেটা নিয়েই তারা থাকুক না। তারা লেখাপড়া শিখলে তখন চাষবাস কারা করবে?
আর একটা গূঢ় কথা শোন গিরীশ, আমাদের কাছে তেমন কোনো জমা করা সম্পদ নেই। আমরা যজনযাজন আর রাজকাজ করি এবং লেখাপড়া নিয়ে থাকি। তাই মাঠের কাজ আমরা করি না। তোমার স্বজাতি কায়স্হরাও আমাদের মতোই জীবন যাপন করে। কোনো খাস জমি নমঃকে বর্গা দিয়ে চাষ করায়। তা ছাড়া বঙ্গদেশে কৃষিকাজ তো ঐ নমঃরাই করে। আমরা ব্রাহ্মণরা, আর আমাদের মতো উচ্চবর্ণীয়রা তো এদের কাঁধে ভর দিয়ে চলি। অর্থাৎ তারা ফসল ফলায় আর আমরা ভোগ করি। তাছাড়া ওরা তো-
“লেখাপড়া নাহি জানে বোকা অতিশয়।
শিক্ষিত হ’লে এরা মোদের হবে দায় \” -ঐ পৃঃ ১৪১
লেখাপড়া জানে না একদম নিরেট বোকা। এখন যদি ওরা শিক্ষিত হয়, তাহলে তো আমাদেরই বিপদ বাড়বে। ওরা যদি শিক্ষিত হয়ে রাজ কর্মচারী হয়ে যায়, তাহলে তো আমরা অনাহারে নিশ্চয় মারা যাবো। কারণ, আমরা তো আর ফসল ফলানোর কোনো কাজই করিনা। ফলে এটা তো ব্রহ্মহত্যা হয়ে যাবে। তুমি কি অবশেষে ব্রহ্মহত্যা করতে চাও? দেখ গিরীশ, তুমি যদি নিতান্তই কিছু একটা করতে চাও তাহলে শোন-
“দাতব্য চিকিৎসা-গৃহ দেহ সেই ঠাঁই।
তার চেয়ে পুণ্যকর্ম আর কিছু নাই \
*** *** *** ***
বিদ্যাদান তুচ্ছ কথা প্রাণদান হবে। ” -ঐ পৃঃ ১৪১
তুমি ঐ নমঃদের একটা হাসপাতাল তৈরি করে দাও। এতে তোমার মহা পুণ্য হবে। বিদ্যাদান তো একটা তুচ্ছ ব্যাপার। জীবন দান হচ্ছে মহাপুণ্যের দান।
এইভাবে অনেক কথা শুনে গিরীশ বসু উভয় সংকট থেকে আপাতত মুক্তি পাবার জন্য মনে মনে একটা কৌশল ঠিক করেন। তিনি উচ্চবর্ণীয়দের জানান যে, আপাতত কিছুদিনের জন্য কলকাতা যাবেন, তারপরে চিন্তাভাবনা করে একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। কিন্তু-
“ব্রাহ্মণেরা যুক্তি করে কি হবে উপায় \
সবে জুটি একদলে পরামর্শ করে।
হানা দিল পুনরায় সপ্তাহের পরে \
দশ-বারজন জুটি গেল কলিকাতা। ” -ঐ পৃঃ ১৪১
ব্রাহ্মণরা এক সঙ্গে বসে এই ধর্ম সংকটের সমাধান করার জন্য যুক্তি করে উপায় বের করে। তারা দশ-বারোজন মিলে সপ্তাহখানেক পরে কলকাতা গিরীশ বসুর কাছে যায় এবং তাঁকে পরামর্শ দেয় এই বলে যে-
“শিক্ষা নিবে ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণ যত।
তারা যাতে শিক্ষা পায়, কর সেই মত \
যেই কর্ম যেবা জানে তারে তাই দাও।
কৃষক লাঙ্গল পাবে মাঝি পাবে নাও \
নমঃশূদ্র ভরা দেখি ঘৃতকান্দি গাঁও।
উলুবনে কেন বাপু মুক্তা ছড়াও?” -ঐ পৃঃ ১৪২
ব্রাহ্মণরা এবং অন্য উচ্চবর্ণের লোকেরাই একমাত্র শিক্ষা গ্রহণ করবে। তাই আমাদের সন্তানরা যাতে শিক্ষা পায় তুমি সেই কাজ কর। যার যা কর্ম তাকে সেই কাজ করতে দাও। কৃষকরা চাষাবাদ করবে, মাঝি নৌকার কাজ করুক। আর নমঃরা, ওরা তো পুরো ঘৃতকান্দি গ্রাম জুড়ে আছে। সেখানে তুমি বাপু উলুবনে কেন মুক্তা ছড়াতে চাইছো? ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণীয়রা তো ফুক্রা গ্রামে বাস করে। স্কুল একান্তই তুমি যদি করতে চাও তাহলে এখানে কর। তাতে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।
এইভাবে বিভিন্ন কৌশলে ব্রাহ্মণ-কায়স্হরা প্রায় জোর করেই গিরীশ বসুকে রাজি করায় ব্রাহ্মণ-কায়স্হদের বসবাস স্হল ফুক্রা গ্রামে স্কুল করার জন্য।
কিছুদিনের মধ্যে এই খবর জানাজানি হয়ে যায় যে, নমঃদের এলাকা ঘৃতকান্দি গ্রামের পরিবর্তে ব্রাহ্মণ কায়স্হদের বাসস্হল ফুক্রা গ্রামে স্কুল করা হবে।
গুরুচাঁদ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন যে, এসব ঘটনার পিছনে ব্রাহ্মণ কায়স্হদের হাত আছে। তারা কখনও চায়না যে অশিক্ষিত নমঃরা শিক্ষিত হোক। যার জন্য জোর করেই গিরীশ বসুর মত পাল্টাতে বাধ্য করেছে।
এলাকার নমঃরা গুরুচাঁদের কাছে এসে জানায়- “এখন কী করে স্কুল তৈরি হবে?” তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর সব ঘটনা জানার পর বলেন- “একপক্ষে এই ঘটনায় খারাপের ভাল হয়েছে। সেটা হচ্ছে যে, গিরীশ বসু যদি আমাদের এখানে স্কুল করে দিতেন তাহলে সারা জীবন তাঁর কাছে আমাদের মাথা নত করে থাকতে হত। তার থেকে তোমরা নিজেদের কাজ নিজেরাই কর। ”
“প্রাণপণ কর সবে আর কথা নাই।
যেভাবে সেভাবে হোক স্কুল করা চাই \
উচ্চ বিদ্যালয় যদি করিতে না পার।
যাহা পার তাহা কর কাজে কেন হার?
আমি বলি মধ্য বাংলা কি মধ্য ইংরাজি।
স্কুল কর, স্কুল কর কথা সোজাসুজি \” -ঐ পৃঃ ১৪২
“তোমরা প্রতিজ্ঞা কর, যেভাবেই হোক স্কুল করতে হবে। উচ্চবিদ্যালয় যদি করতে না পার তাহলে তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেটা পার সেটা কর। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মধ্য পর্যায়ের বাংলা বা ইংরাজি স্কুল অবশ্যই একটা করতে হবে। একটা কাজ কর, ওড়াকান্দী গ্রামের যে স্কুলটা আছে সেটাকে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল কর। ”
এইভাবে গ্রামবাসীদের গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষা আন্দোলনের জন্য সামিল করে উচ্চবর্ণীয়দের বিরোধীতার জবাব দেন।
ওড়াকান্দী ও ঘৃতকান্দি গ্রামের নমঃরা মিলিত হয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতেই স্কুল স্হাপনের কাজ শুরু করেন। স্কুলবাড়ি করার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর জমি দান করেন। সেই জমিতে সকল গ্রামবাসীরা মিলিত হয়ে স্কুল তৈরি করে। গুরুচাঁদ-পুত্র শশিভূষণ ঠাকুর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। আর রঘুনাথ সরকার যিনি প্রথমেই পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন, তিনি সহ-শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন।
“ঊনিশ শ’ আট অব্দে আছে নিরূপণ।
ওড়াকান্দী হাইস্কুল হইল গঠন \” (ঐ পৃঃ ২২৯)
১৯০৮ সালে এই উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণের ফলে নমঃ তথা অন্যান্য নিম্নশ্রেণির লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য একটা সাড়া পড়ে যায়। যার ফলে-
“শিক্ষা আন্দোলন যবে প্রভু করে দেশে।
ভকত সুজন যত তার কাছে আসে \
নমঃশূদ্র তেলী মালী আর কুম্ভকার।
কপালী মাহিষ্য দাস চামার কামার \
পোদ আসে তাতী আসে আসে মালাকার।
কতই মুসলমান ঠিক নাহি তার \
সবারে ডাকিয়া প্রভু বলে এই বাণী।
‘শুন সবে ভক্তগণ আমি যাহা জানি \
নমঃশূদ্রকুলে জন্ম হয়েছে আমার।
তবু বলি আমি নাহি নমঃর একার \
দলিত পীড়িত যারা দুঃখে কাটে কাল।
ছুঁস্নে ছুঁস্নে বলে যত জল-চল \
শিক্ষাহারা দীক্ষাহারা ঘরে নাহি ধন।
এই সবে জানি আমি আপনার জন \’” -ঐ পৃঃ ১৪৪
এই শিক্ষার আন্দোলন যখন গুরুচাঁদ ঠাকুর শুরু করেন তখন ঠাকুরকে যাঁরা শ্রদ্ধা করতেন বা তাঁর কথা মেনে চলতেন এরকম বিভিন্ন জাতির লোকেরা ঠাকুরের কাছে আসেন; যেমন- তেলী, মালী, কুম্ভকার, কপালী, মাহিষ্য, দাস, চামার, কামার, পোঁদ (পৌন্ড্র), তাঁতী, মালাকার। এছাড়া অগনিত মুসলমানও ঠাকুরের কাছে আসে। এদের সবাইকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন, “তোমরা আমাকে ভক্তি শ্রদ্ধা কর। কিন্তু আমি যা জানি সেটা হচ্ছে আমি জন্মগত কারণে নমঃ জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেও আমি কিন্তু শুধু নমঃদের নই। আমি তাদের, যারা দলিত, পীড়িত, অত্যাচারিত, যাদের সব সময় দুঃখকষ্ট নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। যাদেরকে দেখলে উচ্চবর্ণীয়রা অচ্ছুৎ বলে ঘৃণা করে। যাদের পেটে খাবার নেই। শিক্ষার আলো যাদের মধ্যে পৌঁছায়নি। যাদের সহায় সম্বল বলে কিছুই নেই। তারাই হচ্ছে আমার আপনজন। তাই আমি তোমাদের সবাইকে বলছি যদি তোমরা আমাকে মানো তাহলে-
“খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই \” -ঐ পৃঃ ১৪৪
“তোমরা খেতে পাও বা না পাও তার জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু অবিদ্বান সন্তান যেন তোমাদের ঘরে না থাকে। তোমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলবে, এটাই আমার একমাত্র আশা। ”
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই শিক্ষাদানের বার্তা সারা বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঠাকুরের ভক্তগণ দলে দলে গ্রামে গ্রামে পাঠশালা তৈরি করতে শুরু করেন।
প্রবাদ আছে প্রত্যেকের সাফল্যের পিছনে একজন শুভানুুধ্যায়ী থাকে। যার শুভকামনা ও সহযোগিতা বিনা সেই সাফল্য অর্জন করা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই যে শিক্ষা-আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলন, তার প্রথম প্রেরণা হচ্ছেন তাঁর পিতা হরিচাঁদ ঠাকুর। যার কাছে তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন। কিন্তু অন্যজন, যিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের পাশে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো থেকে সমস্ত কাজের জন্য সহযোগিতা করেছেন তিনি হচ্ছেন, অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি ডাঃ সি এস মীড (ডাঃ সিসিল সিলাস মীড)। যিনি খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারের জন্য এবং দীন-দরিদ্রদের সেবা করার জন্য ঘুরতে ঘুরতে বঙ্গদেশে আসেন। আর ১৯০৬ সালে প্রথমে ফরিদপুরে (জেলা) আসেন। তারপর ঘটনা ক্রমে তিনি তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে ওড়াকান্দীতে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে আসেন এবং তাঁর উদ্দেশ্যের কথা ঠাকুরের কাছে ব্যক্ত করেন। তিনি ছিলেন একাধারে ডাক্তার অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক। তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে আসেন খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার ও জনসেবা করার জন্য। সঙ্গে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য। তাই তিনি এই কাজের জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুরের সহযোগিতার আহ্বান জানান। গুরুচাঁদ ঠাকুর মীড সাহেবের সব কথা জানার পর তাঁকে বলেন-
“অশি¶া আঁধারে আছে যেবা পড়ে
তারে ধর্ম দে’য়া মিছে \
মোর জাতি তায় যদি শিক্ষা পায়
কেবা জানে ভবিষ্যত।
শিক্ষিত হইলে তাহারা সকলে
নিতে পারে তব মত \
আদি প্রয়োজন বলে মোর মন
শিক্ষাহীনে শিক্ষাদান।
তারা শিক্ষা পেলে মনপ্রাণ ঢেলে
রাখিবে তোমার মান \” -ঐ পৃঃ ১৬১
“যারা অশি¶ার অন্ধকারে ডুবে আছে; তাদের যে কোনো ধর্মের কথাই বোঝানো হোকনা কেন সেটা অপাত্রে ঘি ঢালার মতো। কারণ আমার জাতির লোকেরা লেখাপড়া জানেনা। আজ আপনি ধর্মের কথা বোঝাচ্ছেন, আপনার কথা শুনে তারা রাজি হয়ে যেতে পারে; আবার কাল যদি অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী এসে তার ধর্মের কথা বোঝায় ও প্রলোভন দেয় তাহলে তার কথায়ও রাজি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি প্রথমে এদের শিক্ষিত করেন, তাহলে কোনটা সঠিক আর কোনটা ঠিক নয় সেটা বিচার বিশ্লেষণ করার বুদ্ধির উদ্ভব হবে। তাই আমি বলি, প্রথমে আপনি এই শিক্ষাহীনদেরকে শিক্ষাদান করুন। তারপর হয়ত দেখবেন এরা আপনার কথা মেনে নিতে পারবে এবং এরা শিক্ষিত হয়ে আপনার মান সম্মানও যাতে অ¶ুণ্ন থাকে সেটাও নিশ্চয় করবে। তাই আপনি এই পতিত সমাজের জন্য উচ্চবিদ্যালয় স্হাপন করুন।
“তা ছাড়া নমঃশূদ্রদের গ্রামে কোনো উচ্চবিদ্যালয় নেই। আর বর্ণহিন্দুরা আমাদেরকে তাদের বিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার দেয় না। আমরা শিক্ষিত হই, সেটা তারা কখনোই চায় না। তারা মনে করে আমাদের লোকেরা তো প্রায় সকলেই কৃষিজীবী, তারা অশিক্ষার অন্ধকারেই ডুবে থাক। আমি আপনাকে যেসব কথা বলছি, এর অনেক প্রমাণই আমি পেয়েছি। কারণ, গিরীশ বসুর স্কুল বানানোর একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ-কায়স্হরা সেই স্কুল করতে দেয়নি। ”
গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণদের চরিত্রের বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, “তারা আমাদের হীন বা নিকৃষ্ট পশুর মতো সর্বদা ঘৃণা করে। কোনো কারণে আমরা যদি ওদের জল স্পর্শ করি, তাহলে তারা আর সে জল গ্রহণ করে না, ফেলে দেয়। আর আমাদের লোকদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করে। কিন্তু, “অর্থ দিলে নেয় কুতুহলে, মনে পায় বড় হর্ষ। ” (পৃঃ ১৬১) এইভাবে তারা তাদের চরিত্রের কদর্যতাকে প্রকাশ করে। “যদি থাকে পৈতা, স্বর্গে উঠা মৈ টা লাগা- থাকে তার পায়। হোক্ ব্যভিচারী হলে পৈতাধারী সমাজে তাহারা মান্য। ” (পৃঃ ১৬১) যদিও ভারতের পূর্বভাগে অর্থাৎ আমাদের এই বাঙলায় অনেক জ্ঞানীগুণিজন ছিলেন (বৌদ্ধ ও পালযুগে)। তাঁরা মানবজাতির কল্যাণের জন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (নালন্দা, তক্ষশিলা, বিক্রমশিলা ইত্যাদি) স্হাপন করেছিলেন ও অগণিত শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোনো হিংসাদ্বেষ ছিল না। যার জন্য তাঁদের সময় ভারত বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেছিল। যদিও সুদীর্ঘকাল (প্রায় সাড়ে চারশো বছর) পরে ব্রাহ্মণরা আবার তাদের ক্ষমতা কায়েম করে (বল্লাল সেনের সময়)। যার ফলে আবার “ঘিরিছে অাঁধার রাতি”, অর্থাৎ আবার অন্ধকার যুগ ফিরে এসেছে। যাই হোক, আমাদের লোকেরা অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে সেই দিশার আলো আপনি দেখান। ”
এসব কথা শোনার পর মীড সাহেব গুরুচাঁদ ঠাকুরের কথায় রাজি হয়ে যান। তারপর মীড সাহেবের সমস্ত শর্ত সম্পর্কে গুরুচাঁদ ঠাকুর অনেকগুলো গ্রামের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে ডেকে একটা সভা করেন। সভায় সপক্ষে বিপক্ষে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়। অবশেষে সভাসদগণকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বোঝাতে সক্ষম হন যে, জাতিকে জাগানোর জন্য মীড সাহেবের সাহায্য গ্রহণ করা একান্ত কর্তব্য। তখন সভাসদগণ গুরুচাঁদের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য শুনে মীড সাহেবেকে নমঃদের জন্য স্কুল করার জন্য সম্মতি দেন।
এরপর মীড সাহেব কিছুদিন পর আবার গুরুচাঁদ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। মীড সাহেব স্কুল করার জন্য দশ বিঘা জমির আবেদন জানান। গুরুচাঁদ ঠাকুর সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজের দশ বিঘা জমি দিতে রাজি হন। আর জানান আরো যদি জমির প্রয়োজন হয় তাহলেও তিনি জাতির উদ্ধারের জন্য অশি¶ার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর পথ দেখানোর জন্য দেবেন। আর এই স্কুলের জন্য
“নিজ ভক্ত হ’তে প্রভু অর্থ চাহি লয়।
বারশত টাকা প্রভু এই ভাবে দেয় \” -ঐ পৃষ্ঠা নং ২২৯
ভক্তরা সকলে মিলে ১২০০ টাকা সংগ্রহ করে ঠাকুরকে দেন।
১৯০৮ সালে ওড়াকান্দীতে ঠাকুর বাড়িতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল স্হাপন করা হয়েছিল যেটাকে মিড্ল ইংরাজি স্কুল (M.E) বলা হত, সেই স্কুলটি সিএস মীডের সহায়তায় উচ্চ ইংরাজি স্কুলে (M.E) উন্নীত করা হয়। আর তখন ডাঃ মীডের নামানুসারে এই স্কুলের নাম করণ হল ‘মীড হাইস্কুল’। তবে তখনও এই স্কুলটি গ্রামবাসীদের চাঁদার উপর নির্ভর করেই চলত। এই স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য পাওয়ার জন্য মীড ডিরেক্টরের কাছে আবেদন জানান। স্কুল সংক্রান্ত কমিশন মীডের সুপারিশে জন্য প্রতি মাসে ৭৫ টাকা করে সরকারি অনুদান দিতে স্বীকৃত হয়। এটাই বাংলায় অনুন্নত শ্রেণির প্রথম উচ্চবিদ্যালয়।
১৯১০ সালে তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার স্যামুয়েল ন্যাথান ওড়াকান্দী পরিদর্শনে আসেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর কাছে শিক্ষা, ছাত্রাবাস ও স্বাস্হ্য কেন্দ্রের জন্য দাবি জানান।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা-আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে নমঃশূদ্র নেতৃবর্গ যশোহরের মসিয়াহাটি এবং ৯৬ গ্রামে মধ্য ইংরাজি স্কুল স্হাপন করেন। পরে সেটা উচ্চ ইংরাজি স্কুলে উন্নীত হয়। আরও পরে এই দু’স্হানে কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাবতেও অবাক লাগে সেকালের নিরক্ষর নমঃরা এবং পিছিয়ে রাখা জাতির নেতৃবর্গ যেভাবে সমাজকে উন্নত করার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, শিক্ষিত হওয়ার পর তাদের বংশধরদের মধ্যে আজ আর সেরকম মানসিকতার নেতৃবর্গ সেভাবে নিঃস্বার্থে সামাজিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসছেন না কেন? এর জন্য গভীরভাবে ভাবা দরকার বলে মনে হয়।
গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষাদান করেই কিন্তু ক্ষান্ত হননি। শিক্ষা গ্রহণের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে চাকরি করা বা শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সাবলম্বী হওয়া। গুরুচাঁদ পুত্র শশিভূষণ, রাধানাথ, ভীষ্মদেব, মোহন, কুমুদ মল্লিক- এঁরা উচ্চশিক্ষা লাভ করার পরও কোনো চাকরি পাচ্ছিলেন না। তখন ১৯০৭ সাল। এই কাজের জন্যও গুরুচাঁদ ঠাকুর ডাঃ মীড সাহেবের স্মরণাপন্ন হন।
“প্রভু বলে ‘দেখ মীড কি করি তা’ বল।
এই সব ছেলে যদি চাকুরি না পায়।
লেখা পড়া কেহ নাহি করিবে হেথায় \
এদের ব্যবস্হা তুমি কর মহাশয়।
এরা ধন্য হোক সবে তোমার কৃপায় \” -ঐ পৃষ্ঠাঃ ২২৯
গুরুচাঁদ ঠাকুর বললেন, “মীড সাহেব দেখুন, এই সব ছেলেরা যদি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরেও চাকরি না পায় তাহলে আমাদের সমাজের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই তুমি এদের জন্য এমন কিছু ব্যবস্হা কর, যাতে তোমার কৃপায় এরা জীবনে ধন্য হতে পারে। ”
গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছ থেকে সব কথা শুনে মীড বলেন-
“মীড বলে “বড়কর্তা শুন দিয়া মন।
কি জন্য তোমার জাতি পতিত এমন \
এই দেশে উচ্চ বর্ণ হিন্দু যত আছে।
শুন সবে কিবা বলে রাজশক্তি কাছে \
তোমার জাতির কথা বলে ঘৃণা ভরে।
সেই লাগি রাজ শক্তি চেনেনা তোমারে \
এই জন্য কর এবে পত্রিকা প্রচার।
তা’হলে তোমার জাতি পাবে উপকার \” -ঐ পৃষ্ঠা ২০৫
অর্থাৎ “বড়কর্তা, তোমার জাতি যে পতিত রয়েছে, তার কারণ হচ্ছে, উচ্চবর্ণীয়রা সরকারের কাছে এমনভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সূচক মিথ্যা কথা বলে অভিযোগ জানিয়ে রেখেছে যে, সরকার তোমাদেরকে চেনেই না। তাই আমি প্রস্তাব করি কি তোমরা একটা পত্রিকা প্রকাশ কর। সেই পত্রিকায় তোমাদের সম্বন্ধে সব কথা লেখ। তাহলে সরকার তথা সকলে তোমাদের আসল পরিচয় জানতে পারবে। আর সবাই মিলে লাট সাহেবের কাছে চলো, আমি সব কিছু সাহেবকে তোমাদের কথা বুঝিয়ে বলব। ”
মীড সাহেবের পরামর্শ মতো গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে ঐ বছরই অর্থাৎ ১৯০৭ সালে “নমঃশূদ্র সুüদ” নামে পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়।
এরপর মীড সাহেবের কথামতো উপযুক্ত সময়ে সকল নমঃশূদ্র শিক্ষিত যুবকগণ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুরে লাট সাহেবের দরবারে যান। সেখানে গুরুচাঁদ ঠাকুর রাজকীয় পোশাক পরে যান। যে পোশাকের তৎকালীন মূল্য ছিল ৫০০ টাকা। গুরুচাঁদের পোশাক দেখে মীড সাহেবও বিস্মিত হয়ে যান। গুরুচাঁদ ঠাকুরের সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট মীড সাহেবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, “এই ভদ্রলোক হচ্ছেন নমঃশূদ্র জাতির একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি। ” তখন ম্যাজিস্ট্রেট জানান যে, তিনি তো নমঃশূদ্র বলে কোনো জাতির কথা জানেন না। তবে ‘চণ্ডাল’ জাতি বলে একটা জাতির কথা জানেন। তখন মীড সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটকে সব কথা বুঝিয়ে বলেন।
মীড বলে, “রাজভক্ত এই মহাশয়।
রাজার বিরুদ্ধে কভু কথা নাহি কয় \
স্বদেশী আন্দোলনের বড়ই বিরোধী।
রাজার মঙ্গল চিন্তা করে নিরবধি \” ঐ পৃঃ ২১৩
আর অনুরোধ করেন লাট সাহেবের কাছে গুরুচাঁদ ঠাকুর সম্পর্কে জানাতে যে, তিনি একজন রাজভক্ত। তিনি রাজার বিরুদ্ধে কখনও কোনো বিরুদ্ধতা করেননি। এমনকি স্বদেশী আন্দোলনেও তিনি অংশগ্রহণ করেননি। তিনি তাঁর এলাকার একজন বিশিষ্ট গুণীজন। তাঁর পুত্রকন্যারা সকলে বিদ্বান। তাঁর বড় পুত্র শশিভূষণ চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। এঁরা ভীষণ সভ্য, শিষ্ট, শান্ত ও সকলের ব্যবহার ভদ্রোচিত। আর আপনার অধীনে যত কর্মচারী আছে, তারা আপনাদেরকে এঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে এঁদের সম্পর্কে সত্য কথাকে লুকিয়ে রেখেছে। আমি তো এঁদের মধ্যে সব সময় ঘোরাঘুরি করি, তাই আমি এঁদের খুব ভাল করে জানি। এই নমঃশূদ্র জাতির পরিচয় রাজার কাছে না থাকার জন্য এই জাতি শিক্ষিত হয়ে এখনও পতিত হয়ে রয়েছে। ” এইভাবে বিভিন্ন কথা বলে মীড সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝান। তখন ম্যাজিস্ট্রেট মীড সাহেব যা যা বলেছেন, সব নোট করে রাখেন লাট সাহেবকে জানানোর জন্য।
এরপর লাট সাহেব দরবারে এলে সময়মতো লাট সাহেবের উদ্দেশ্যে শশিবাবু মানপত্র পড়ে শোনান। মানপত্র পাঠ শুনে লাট সাহেব জানান, “সুখী আমি অতিশয়। ” অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। এরপর মীড সাহেব লাট সাহেবের কামরায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে নমঃশূদ্রের গুণের সব কথা জানান। আর শেষে নমঃশূদ্র শিক্ষিতরা যাতে চাকরি পায় সে সবও জানান।
উপরের ঘটনাটা এত বিস্তারিত এই জন্যই লিখছি কারণ সেই সময়ে সরকারের কাছে ‘নমঃশূদ্র’ বলে কোনো পরিচয়ই ছিল না। পরিচয় ছিল ‘চণ্ডাল’ বলে। যেটা উচ্চবর্ণীয়রা গালি স্বরূপ ব্যবহার করত। আর সরকারের কাছে এঁদের সম্পর্কে মিথ্যা অভিযোগ করত। গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা-আন্দোলনের ফলে যখন উচ্চশিক্ষার বন্যা বইতে শুরু করে, তখন সমস্যা দেখা দেয় চাকরির। আর সেই চাকরি গ্রহণের পূর্বে এতসব প্রক্রিয়া করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর সেই প্রয়োজন মেটানোর গুরুদায়িত্ব যেমন গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপর বর্তায় তেমনি মীড সাহেবের উপরও সেই গুরুদায়িত্বের বোঝা সঁপে দেওয়া হয়। কারণ সেই কাজ মীড সাহেব বিনা কিছুতেই সম্ভব হওয়ার ছিল না। আর এতসব প্রক্রিয়া যে সহজে সম্পন্ন হয়নি সেটা বোঝানোর জন্য এই বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন। ভারতের সংবিধানের মাধ্যমে তপশিলি জাতির মানুষ শিক্ষা ও সরকারি চাকুরিতে সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছে, যে সুবিধা সে সময়ে ছিল না। তবে এই সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়ার জন্য বাবাসাহেবকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
যাইহোক, মীড সাহেবের প্রচেষ্টা ও লাট সাহেবের কৃপায় শশিভূষণ ঠাকুর ১৯০৭ সালে সাব্রেজিস্টারের চাকরি পান। কুমুদ বিহারী মল্লিকও ডেপুটি পদে চাকরি পান। এরপর মোহন, তারিণী আর শ্রীরাধাচরণ তাদের ইচ্ছানুসারে চাকরি পান। এইভাবে গুরুচাঁদের শিক্ষা আন্দোলন মীড সাহেবের সহায়তায় সবদিক দিয়ে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
প্রতিটি ধর্মে (ধম্মে নয়) নারীকে নিকৃষ্ট হিসাবে গণ্য করা হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। নারীকে পুরুষের সম্পত্তি মনে করা হয়। নারী যে মানুষ তারও একটা মন আছে, তার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা বা স্বতন্ত্রতা থাকতে পারে সেটা প্রায় অকল্পনীয়। বর্তমান আধুনিক যুগে এর অনেক পরিবর্তন হলেও এখনও নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকই মনে করা হয়।
কিন্তু আমরা হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘মতুয়াধর্ম’-এ নারীর প্রতি অমর্যাদার ব্যতিক্রম খুঁজে পাই। হরিচাঁদ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন কোনো জাতি, ধর্ম, সমাজ বা দেশের প্রগতির পিছনে যদি নারীকে সামানভাবে সামিল না করা হয় তাহলে সর্বক্ষেত্রের প্রগতি পূর্ণতা পেতে পারেনা। যে কোনো মা-ই সন্তানকে সঠিকভাবে এবং অতি সহজে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারে কারণ, প্রত্যেক শিশুর প্রথম শিক্ষক হল তার মা। তাই তিনি নারীর সমান অধিকার প্রদান ও শিক্ষাদানের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।
মহাকবি তারক সরকার রচিত জীবনীমূলক কাব্য গ্রন্হ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’-তে আমরা দেখতে পাই, মতুয়া ধর্ম অনুসারে নারী-পুরুষ যখন একসঙ্গে ভোজন করে, একসঙ্গে ঠাকুরের গান করে। সেখানে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। এটা দেখে তৎকালীন উচ্চবর্ণীয়দের গাত্রদাহ হয়। যার ফলে তারা জমিদারের কাছে নালিশ জানায়। জমিদারের পেয়াদা এসে অন্যায়ভাবে অত্যাচার চালায়। তখন জমিদারের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতীকী বিচার সভা বসিয়েছিলেন। আর সেখানে বিচারক ছিলেন একজন মহিলা।
আবার আমরা দেখতে পাই- সংসারজীবনে নারীকে সম্মান প্রদানের জন্য পুরুষের ব্যভিচার বন্ধ করার জন্য বলেছেন-‘এক নারী ব্রহ্মচারী’। অর্থাৎ একজন স্ত্রীকে নিয়েই সুখে জীবনযাপন করতে হবে। পরনারীকে মাতৃ জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে হবে।
হরিচাঁদ ঠাকুর কর্তৃক নারীর প্রতি এই সম্মান ও অধিকার প্রদানের কথাকে শিরোধার্য করে গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর শিক্ষা আন্দোলনে নারীকে সামিল করেন। যদিও তৎকালীন সমাজ ব্যবস্হায় নারীকে শিক্ষাদানের কথা ভাবাও ছিল পাপ। সেরকম একটা সামাজিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি নারীমুক্তি-আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য নারীশিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন।
“শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার।
নারী ও পুরুষ পাবে সম অধিকার \
সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার \”
১৯৩২ সালে ওড়াকান্দীতে ‘হরি-গুরুচাঁদ মিশন’ প্রতিষ্ঠা করে সেই মিশনের সহায়তায় ওড়াকান্দীর তালতলায় নারী শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
“নারী শিক্ষা তরে প্রভু আপন আলয়।
‘শান্তি-সত্যভামা’ নামে স্কুল গড়ে দেয় \” ঐ পৃঃ ৫৪৬
‘শান্তি-সত্যভামা’ (শান্তি গুরুচাঁদ ঠাকুরের মা, আর সত্যভামা গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবনসঙ্গিনী) নামে একটা আলাদা বিদ্যালয়ের স্হাপন করেন। তিনি বলেন-
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে ভালো হয় ছাও \” ঐ পৃঃ ৫২৯
অর্থাৎ ছেলেমেয়ে উভয়কে শি¶া অর্জনের জন্য স্কুলে পাঠাতে হবে। বিশেষ করে নারীদের উপর শি¶ার জন্য জোর দিতে হবে। কারণ, ‘মা’ যদি শি¶িত হন, তাহলে তাঁর গুণে সন্তানও ভাল হবে।
১৮৮১ সালে দত্তডাঙ্গা গুরুচাঁদ ঠাকুর জাতির জন্য যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তারপর থেকে পিছিয়ে-রাখা শ্রেণির মধ্যে শিক্ষা আন্দোলনের যে জোয়ার বইতে শুরু করে, আর দিকে দিকে যে পাঠশালা তৈরি হতে থাকে সেই সব পাঠশালার মধ্যে বহু পাঠশালা ১৮৯০ সালের মধ্যে ইংরাজি ও উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। আর এইসব বিদ্যালয়ে নারীশিক্ষার জন্যও ব্যবস্হা গ্রহণ করা হয়।
এই নারীশিক্ষাকে অগ্রগতি দানের জন্য মিসেস্ মীডের (Alice Pappin)৫ সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দীতে একটি নারীশিক্ষা ট্রেনিং স্কুলও স্হাপন করা হয়। এই সময় প্রসূতি মা ও শিশু-সেবার জন্য মাতৃমঙ্গল প্রতিষ্ঠান করা হয়। যেখানে নারীদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ বিধবা নারীদের ধাত্রীবিদ্যার প্রশিক্ষণও দেওয়া হত। ডাঃ সিএস মীড নিজেই বিধবাদের এই প্রশিক্ষণ দিতেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই নারীশিক্ষা আন্দোলনের অগ্রগতিতে উচ্চবর্ণীয়দের মধ্যে একদিকে যেমন গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়, অপরদিকে তেমনি গুরুচাঁদ ঠাকুরও নমঃরা যে একটা সুসভ্য জাতি তার প্রমাণ স্বরূপ বিধবাদের বিবাহেরও ব্যবস্হা করেন।
“তেরশত ষোল সালে বারুণী সময়।
বিধবা বিবাহ দিতে প্রভু আজ্ঞা দেয় \” ঐ পৃঃ ২৬১
১৯১০ সালে মার্চ মাস নাগাদ (বাংলা ১৩১৬ সাল), বারুণীর সময় অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন পালনের মাসে (১১ মার্চ) গুরুচাঁদ ঠাকুর পতিত জাতির মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন। আর বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের সামাজিক আন্দোলনে নারীশিক্ষার অগ্রগতি প্রদানের জন্য মিসেস্ মীড সক্রিয় সহযোগিতা করেন। তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরকে “ধর্ম পিতা” বলে সম্বোধন করেন। তারপর মিসেস্ মীড জানান, “আমি আপনাকে পিতা বলেছি, তাই আমি আপনার কন্যা। কিন্তু আমি তো অন্য ধর্মের। তাই আপনি কি আমার হাতের খাবার খাবেন?” তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর জানান-
“শুন কন্যা, গুণে ধন্যা, আমার বচন।
জাতি-ভাগ মোর ঠাঁই পাবে না কখন \
নরাকারে ভূমন্ডলে যত জন আছে।
‘এক জাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে \
আমার পিতার ভক্ত আছে যত জন।
এক জাতি বলে তারা হয়েছে গণ \
লোকাচারে তার কেহ কায়স্হ ব্রাহ্মণ।
‘মতুয়ার’ মধ্যে তাহা নাহি নিরূপণ \
নমঃশূদ্র, তেলী মালী, ব্রাহ্মণ কায়স্হ।
ইস্লাম, বৈদ্য জাতি-রোগে সিদ্ধহস্ত \
মতুয়া সকলে এক, জাতিভেদ নাই।
বিশেষতঃ কন্যা হ’লে নাহিক বালাই \” ঐ পৃঃ ২০০/২০১
অর্থাৎ “জাতিগত কারণে বা ধর্মীয় কারণে সে যে জাতি বা ধর্মেরই হোক না কেন আমার কাছে তার কোনো অস্তিত্ব পাবে না কখন। এই বিশ্বে যত লোক আছে, সকলে আমার কাছে ‘এক জাতি’ অর্থাৎ মানব জাতি বলে গণ্য হবে। আমার পিতা ঠাকুর হরিচাঁদের যত ভক্তরা আছেন তাদেরকে সব সময় এক জাতি বলেই গণ্য হয়েছে; যদিও তারা লোকাচারে কেউ ব্রাহ্মণ, কায়স্হ বা অন্য জাতির লোক। তবে এটা সত্য যে, বিভিন্ন জাতি বা ধর্মের লোকেরা নিজেদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাকে প্রাধান্য দেয়। যার ফলে সমাজের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়। যেটা একটা কঠিন সামাজিক ব্যাধি। তবে আবার বলি, মতুয়ারা সকলে একই জাতি। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। আর অন্য জাতি বা ধর্মে যেমন নারীদেরকে মর্যাদা দেওয়া হয় না, কোনো অধিকার দেওয়া হয় না, সেক্ষেত্রে মতুয়াধর্মের নিময়ানুসারে আমার কাছে নারীরা সব মর্যাদা পাবেন, অধিকার পাবেন। তাদেরকে কখনও পৃথক দৃষ্টিতে দেখা হবে না বরং তাদের প্রগতির জন্য আমি আরও বেশি করে কাজ করব। যেখানে কোনোরকম ভেদাভেদ বা জাতি ধর্মের পরিচয় থাকবে না। ”
একবার ভেবে দেখুন, একজন ধর্মগুরু (প্রকৃত পক্ষে সমাজসংস্কারক) যিনি কিনা শিক্ষার আন্দোলন করার জন্য তাঁর অনুগামীদের নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই নির্দেশ শিরোধার্য করে গ্রামে গ্রামে পাঠশালা নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার প্রদীপ জ্বলতে শুুরু করেছে। এটা কি এক অভাবনীয় ঘটনা নয়? ভেবে দেখুন তো, আর কোনো ধর্মগুরু এইভাবে অস্পৃশ্য পতিত মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন কিনা? এটা ইতিহাসে বিরল ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম ঘটনা নয় কি? যদিও এই ঘটনা বর্ণবাদীদের দ্বারা রচিত ইতিহাসে তেমন করে এখনও স্হান পায়নি।
তবে আমরা ‘ডাঃ অতুলচন্দ্র প্রধানের’ গবেষণা গ্রন্হে দেখতে পাই- In Bengal, even though the Depressed class pupils found no difficulty in securing admission to common schools during 1931, there existed 569 special schools for the backward class in presidency division, 246 special schools for the Santhals in the Burdwan division, and 1067 schools exclusively meant for the Namasudra children in Dacca division. (তথ্য সূত্রঃ Atul Chandra Pradhan, the Emergence of depress classes, Book land International, 126 Ashok Nagar, Bhubaneswar 751005, 1st Ed 1986, p.33)৬
এখানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি যে, গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুগামীদের সহায়তায় ১৯৩১ সাল নাগাদ পিছিয়ে রাখা সমাজের সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে ৫৬৯টি, সাঁওতাল বা আদিবাসী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বর্ধমান ডিভিশনে ২৪৬টি এবং নমঃশূদ্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য ঢাকা ডিভিশনে ১০৬৭টি স্কুল স্হাপন করেন। তো দেখা যায় সর্বমোট ১৮৮২টি স্কুল স্হাপন করেন। আর ডাঃ সি এস মীডের সহায়তায় ব্রিটিশ সরকার দ্বারা এই স্কুলগুলিকে প্রথমে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষার স্কুল এবং পরে মিড্ল ইংলিশ স্কুলে অনুমোদন করান। আর পরবর্তীতে এর মধ্য থেকে কিছু স্কুল উচ্চ ইংরাজি স্কুলে উন্নীত হয়। গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে গঠিত স্কুলের সংখ্যা আমরা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকশিত দশম শ্রেণির ‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’ বইয়ে দেখতে পাই ‘তাঁর উদ্যোগে ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষা-আন্দোলনের ক্ষেত্রে এতবড় ভূমিকা গ্রহণ করা সত্ত্ব্বেও ইতিহাসের পাতায় তাঁর কোনো নাম নেই কেন? সেটা কি শুধুমাত্র তাঁর জন্মগত জাত পরিচয়ের জন্য?
ঈশ্ব্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য “বিদ্যাসাগর” উপাধি পেয়েছেন। যেখানে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস পর্যন্ত এই সাত মাসে তিনি মাত্র ৩৫টি বিদ্যালয় স্হাপন করেন; সেখানে এতগুলি বিদ্যালয় গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ক্ষেত্রে কি আমরা জাতি বৈষম্য লক্ষ করতে পারছি না?
একদিকে আমরা দেখতে পাই ১৮৫৮ সালের ব্রিটিশ শিক্ষানীতিকে ধোঁকা দিয়ে এই পতিত অস্পৃশ্য সমাজের ছাত্রছাত্রীরা যাতে শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারে তার জন্য ১৮৭০ সালে অনুমোদিত স্কুলগুলিতে উচ্চবর্ণীয়রা সুকৌশলে এই পিছিয়ে রাখা সমাজের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেয়। আসলে উচ্চবর্ণীয়রা কখনই চায় না যে, তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত সমাজ শিক্ষার আলো পাক। যার জন্য তারা ব্রিটিশদের নতুন শিক্ষানীতির প্রয়োগ শধুমাত্র কাগজে কলমে দেখাত। যেটা বাস্তবে আদৌ ছিল না। ব্রিটিশ শিক্ষানীতির প্রয়োগ ও তার ত্রুটি-বিচ্যুতির সঠিক সত্য জানার জন্য সরকার Sir W.W. Hunter -এর নেতৃত্বে ১৮৮২ সালে একটা শিক্ষা কমিশন বসান। যেটা Hunter কমিশন নামে খ্যাত। কমিশন তার রিপোর্টে জানান- “নিম্নবর্ণের শিশুদের স্কুলে ভর্তির সামাজিক ও ধর্মীয় বাঁধা-নিষেধ বর্তমান। নিম্নবর্ণের ছেলেমেয়েরা পড়ার সুযোগ পায় না। এমনকি সরকারি স্কুলেও উচ্চস্তরের অফিসারদের বারবার চাপ প্রয়োগ বিনা তাদের ভর্তি করা হয় না। উচ্চবর্ণের অভিভাবকরা চায় না তাদের ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিচু জাতের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেলামেশা হোক। ”৭
তো Hunter সাহেবের এই রিপোর্ট থেকে বুঝতে পারা যায় যে, উচ্চবর্ণীয়রা কখনই চায় না তাদের দ্বারা দাবিয়ে রাখা নিম্নবর্ণীয়রা লেখাপড়া শিখুক।
গুরুচাঁদ ঠাকুর উচ্চবর্ণীয়দের এই ষড়যন্ত্রকে খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পোঁছে দেবার জন্য ১৯৩১ সাল নাগাদ প্রায় দু’হাজারের মতো স্কুল স্হাপন করিয়েছিলেন।
আমরা সন্দীপ দাশগুপ্তের লেখায় (আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয়, ঐতিহাসিক কলম, তারিখ- ১৪/০৪/২০০২) দেখতে পাই তিনি লিখেছেন- “ইতিহাসে অধরাদের তালিকায় এমন আরও নাম আছে। ---- তথ্যের দিক থেকে একথাও উড়িয়ে দেওয়া গেল না, গুরুচাঁদ ঠাকুর নামে কার্যত অজ্ঞাত অন্য এক বাঙালির আন্দোলনেই পূর্ববঙ্গে হাজারেরও বেশি স্কুল হয়েছিল। এদের কারও কাজের ব্যাপকতা হয়তো বহু কথিত দু’এক জন মহাজনের মতো নয়। এটাও ঘটনা, অভাগাদের কাটতিও মন্দ। যাদের কেউ চেনেই না তাদের পাদপ্রদীপে এনে কোনও কোনও গবেষকের লাভ নেই। বই ছাপা হলে সব কপিই হয়তো পড়ে থাকবে। হয়তো-----”৮
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, যাদের জন্য, যে সমাজের লোকদের দ্বারা এইসব স্কুল নির্মাণ করা হয়েছিল, পরবর্তীতে যে স্কুলগুলো, যে লোকদের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে সরকারি স্কুলে পরিণত হয়েছিল, উচ্চবর্ণীয়দের ষড়যন্ত্রের ফলে সেইসব স্কুলে সেই পিছিয়ে রাখা সমাজের ছেলেমেয়েরা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত। এর থেকে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণ্যবাদ কত নিষ্ঠুর কত জাতিবাদী; কত প্রগতির পরিপন্হী। তারা কী করে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে উচ্চ স্হানে বসাবে? কারণ তাদের নীতিটাই তো সমাজহিতকারক নয়। সেখানে একজন সমাজ হিতকারীকে কী করে সম্মান দেবে?
এসব তথ্য থেকে এটাই কি প্রমাণ হয় না যে, জাতিগত কারণেই গুরুচাঁদ ঠাকুরের এত বড় অবদানকে ইতিহাসের পাতায় স্হান দেওয়া হয়নি?
আমরা দীর্ঘক্ষণ জানলাম গুরুচাঁদ ঠাকুর পিতৃআজ্ঞা পালন করার জন্য অর্থাৎ শিক্ষা-আন্দোলনকে প্রসারিত করার জন্য কীভাবে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। উচ্চবর্ণীয়দের ষড়যন্ত্রের কাছেও তিনি হার মানেননি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যারা এই মহামানবের অবদানের সুফল ভোগ করে শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তারা কি কখনও পিছন ফিরে দেখেছেন, এই অসম্ভব কাজ কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
না, এটা শুধু আমার মুখের কথা নয়। কবি মহানন্দ হালদারই এই প্রশ্নগুলো তপশিলিদের কাছে তুলে ধরেছেন।
“আজি যারা তপশীলী জাতি সাজিয়াছে।
শিক্ষা ছাড়া উন্নতি কি সম্ভব হয়েছে \
শিক্ষার প্রেরণা তারা কোথা হতে পায়।
আদি-গুরু গুরুচাঁদ আদি-শিক্ষা দেয় \” -ঐ পৃঃ ১৪৫
আজ আপনারা যারা তফশিলী সার্টিফিকেট বের করে তফশিলি হয়েছেন, তারা কখনও ভেবে দেখেছেন শিক্ষা ছাড়া আপনাদের উন্নতি কখনও হয়েছে কি? আর এই শিক্ষা গ্রহণের প্রেরণার উৎস কি? তিনিই আপনাদের প্রথম শিক্ষাগুরু, গুরুচাঁদ ঠাকুর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই শিক্ষাগুরুকে চিনেছেন বা জেনেছেন কি? আর যদি জেনে শুনে থাকেন, তাহলে তাঁর প্রতি তাঁর অবদানের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন কি?
আপনারা তো জানেন গাছের উপরে তার ফলটি থাকে। যেটা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। যে ফুলগাছের ফুল দেখলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কি ঐ ফলের গাছে ফল ফলানোর জন্য কী কী করতে হয়েছে? যে ফুল দেখে আপনি মুগ্ধ হয়েছেন, সেই মুগ্ধতা আনার পিছনের শ্রমকে কখনও অনুধাবন করেছেন কি?
আপনারা একবার ভেবে দেখুন তো-
এক সময়ে যে সমাজ অন্ধকারে ডুবেছিল। বিশ্ব্বের কাছে যাদের কোনো পরিচয় বলে কিছু ছিলনা। মানুষ হয়েও পশুর মতো জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছিল। যাদের ধন-মান কিছুই ছিল না। যাদের কোনো সহায় সম্বল ছিল না। যাদেরকে সর্বহারা বানিয়ে রেখেছিল। যারা অন্তরের জ্বালা নিয়ে বোবা হয়ে মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকত। আজ তাদের জন্য ঘরে ঘরে কে সঞ্জীবনী সুধা এনে দিয়েছে? মৃতপ্রায়কে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সব অধিকার কে এনে দিয়েছে। যাদেরকে শিক্ষা দিয়ে জ্ঞান দিয়ে ধন-মান দিয়ে তেজদীপ্ত করে গড়ে তুলেছেন, তিনি কে? আজ এই বঙ্গদেশে যারা মান সম্মান পাচ্ছেন, রাজ ক্ষমতাও চালাচ্ছেন তারা কি কখনও একবারের জন্যও ভেবে দেখেছেন এসব কী করে সম্ভব হল?
আসলে এ সব তারা জানবেন কী করে। তারা তো সব সুবিধা গ্রহণ করে নিজের জাত পরিচয় লুকিয়ে রেখে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। যদিও এরকম হওয়ার কথা তো ছিল না। কারণ-
“আত্মশক্তি-পরিচয় নহে হীন বল।
‘তপশীলী’ বলি যারা আছে এক দল \
বিশ্ব্বের সভায় যারা পেয়েছে আসন।
তারা কি করেছে মনে সে চিন্তা কখন?
কে সে শক্তিধর যাঁর চরণ পরশে।
জাগিয়া উঠিল প্রাণ নবীন হরষে?
কোন আলোধারী ঘরে জ্বেলে দিল আলো?
কোন সে দরদী দীনে এত বাসে ভালো?
সে তরুর মূল কোথা গাঢ় অন্ধকারে।
প্রাণক্ষয়ে রস এনে বাঁচায় শাখারে \
ফুল হাসে ফল নাচে জুড়ায় নয়ন।
কে সে রস দেয় তাহা করে কি স্মরণ \
তপশীল জাতি মধ্যে যা’ কিছু হয়েছে।
হরিচাঁদ-কল্পবৃক্ষে সকলি ফলেছে \” -ঐ পৃঃ ১৪৫
যে তপশিলিরা বিশ্ব্বের দরবারে উচ্চস্হান পেয়েছেন; তাদের অনেকেই আত্মপরিচয়কে গোপন রাখেন। ভিতরে ভিতরে এই পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগেন। কিন্তু আত্মপরিচয় প্রকাশ করা তো হীনবল নয়। সেটা তো গর্বের বিষয়। আসলে এরা তো নিজেদের সঠিক ইতিহাসই জানেন না। তারা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছে যে, কোন শক্তিধরের পদস্পর্শে মৃতপ্রায় সমাজের মধ্যে সঞ্জীবনী প্রকাশ করল নতুন উদ্যমে? কোন উজ্জল জ্যোতিষ্ক এসে গভীর অজ্ঞানতা অশি¶ার অন্ধকারকে দূর করে জ্ঞানের আলো, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিল?
কোন দীনদরদি সে, যে তার দেশবাসীকে এত গভীর ভালবাসে? সেটা কোন গাছ- যে গাছের ফল ফুল পেয়ে সবাই আনন্দিত; আর যার মূল লুকিয়ে আছে গহন অন্ধকারের মধ্যে? যে মূল নিজের প্রাণ ক্ষয় করে রস এনে দিয়ে শাখাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সেই গাছের ফুলের শোভায় আর ফলের স্বাদে চোখ জুড়িয়ে যায় আর ফলের স্বাদে তৃপ্ত হওয়ার বেশিরভাগ লোকেরা জানেই না এত কিছু কে দিয়েছে? তবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন বা না করুন জেনে নিন, সেই জ্যোতিষ্ক, সেই পরম শক্তিধর, দেশ ও সমাজের জনক, সেই রস, ফল ও ফুল দানকারী বৃক্ষ সেই দীনদরিদ্রের কাণ্ডারী হচ্ছেন- হরিচাঁদ কল্পবৃক্ষ। হ্যা, তপশিলি জাতির মধ্যে যত ধরনের প্রগতি হয়েছে তার মূলে হচ্ছেন এই হরিচাঁদ নামক কল্পবৃক্ষ। আর সেই কল্পবৃক্ষের যে ফল ফলেছে সেই ফল বিতরণ করেছেন সেই পরমপুরুষ গুরুচাঁদ ঠাকুর।
কিন্তু দুঃখের বিষয়-
“কেন হেন হল কেন জাগিয়েছে জাতি।
কে করেছে প্রাণদান জেগে দিবারাতি \
আজ কেহ নাহি করে তাহার সন্ধান।
শুধু শুধু হল নাকি সবে মান্যবান?
সরল-সহজ সত্য তাই আজি বলি।
গুরুচাঁদ কৃপাগুণে হয়েছে সকলি \” -ঐ পৃঃ ১৪৫/৪৬
তপশিলি সমাজের মধ্যে এই যে, প্রগতি হয়েছে, সেই প্রগতির পিছনে কে নিজের জীবনকে বাজি রেখে সারাটা দিন তার সমাজকে জাগানোর জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছেন, সেকথা কেউ আর জানতে চায় না। তারা ভাবতে চায় না এসব কি এমনি এমনি করে হয়ে গেলে? তাদের কাছে খুব সহজ-সরল ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে, গুরুচাঁদ ঠাকুরের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই এত কিছু প্রগতি হয়েছে।
সাধারণভাবে শিক্ষা হচ্ছে দু’প্রকার। প্রথাগত শিক্ষা (Academic Education) এবং সামাজিক শিক্ষা (Social Education)। গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা-আন্দোলনকে (১৮৮০ থেকে ১৯৩৭ সাল) বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি পিছন ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদের চক্রান্তে পিছিয়ে পড়া সমাজের মহামানবেরা যুগান্তকারী পরিবর্তন করেছেন। যার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক প্রগতি হয়েছে।
কিন্তু এই প্রগতির মূল কারণ হচ্ছে- Academic Education. প্রথাগত বিদ্যার সাথে সামাজিক শিক্ষার সংযোগ হলে বিপ্লব হয়। শুধু প্রথাগত বিদ্যাতে মানসিক প্রগতি লাভ করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে বহু উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদাধিকারীরা নিজেদের প্রগতির কথাই ভেবে যায় সারা জীবন, তারা সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের জালে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে আরো জড়িয়ে ফেলে। তারা মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে ব্রাহ্মণ দিয়ে পূজা করায় এবং পূজার পর বিগ্রহের সাথে সাথে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত পূজারীকেও প্রণাম করে। বাবাসাহেব সর্বকালের সর্বোচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও প্রথাগত শিক্ষায় মাত্র মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কিন্তু সামাজিক শিক্ষায় বিশেষ শিক্ষিত মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলেকে নিজের গুরু করেছিলেন। বাংলাতেও গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ও সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
সারা ভারতবর্ষে যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেই পরিবর্তনকারী বা বিপ্লবীদের মধ্যে বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর হচ্ছেন সর্বাধিক উচ্চশিক্ষিত। বাকি প্রায় সকলেই অল্পশিক্ষিত বা Academic Education গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হচ্ছে যাঁরা অল্পশিক্ষিত বা শিক্ষাঙ্গনের দোরগোড়ায় প্রবেশ করেননি বা তাঁদের সময় প্রবেশাধিকার ছিল না; তা সত্ত্ব্বেও এই মহামানবেরা সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। আর সেই সামাজিক শিক্ষা কিন্তু কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয় না। সেই মহামানবেরা তৎকালীন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে সমাজ-দর্শনের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের মধ্যে যে ব্রাহ্মণ্যবাদী কূট-কৌশলের ফলে মানুষকে জাতব্যবস্হায় বিভক্ত করে নীচ করে রেখেছিল, মানুষকে পশুর সমতুল্য করে তুলেছিল, সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল; এসব কিছু তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যার ফলে তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন।
তাহলে এখানে আমরা কী কী ঘটনা দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি-
* প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সমাজের পরিবর্তন মূলক কাজ করা যায়।
* সামাজিক পরিবর্তনমূলক কাজ করার জন্য আত্মোপলব্ধির দরকার।
* সমাজের প্রতি অনুরাগী হওয়া দরকার।
* সমাজে বিপ্লব আনার জন্য সংগ্রাম করা দরকার।
গুরুচাঁদের শিক্ষা আন্দোলন থেকে আমরা বুঝতে পারছি, উপরের চারটি গুণই তাঁর ছিল। অর্থাৎ তিনি প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ বেশি না পেলেও যেটুকু পেয়েছিলেন, সেটাকে হাতিয়ার করে পিতৃআজ্ঞাকে শিরোধার্য করে ময়দানে নেমে পড়েছিলেন। সমাজের ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্তকে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। যার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। আর সেই আন্দোলনের ফল শুধু নমঃশূদ্ররা নয়, শুধু বাংলার পিছিয়ে রাখা নির্যাতিতরা নয়, সারা ভারতবর্ষের পিছিয়ে রাখা সমাজ ভোগ করছে। কীভাবে? গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলনের ফলে যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীরা মীড সাহেবের সহযোগিতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি পেয়েছিলেন, সেটা শধু বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সে আন্দোলনের ফসল বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, গুরুচাঁদের তরীকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান রাজনৈতিকভাবে। তিনি বাংলা থেকে সংবিধান সভায় বাবাসাহেবকে কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে পাঠাতে সক্ষম হন। বাবাসাহেব সংবিধানে পিছিয়ে রাখা (SC, ST & OBC) সমাজের জন্য সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব বা representation -এর ব্যবস্হা করেন। যে ব্যবস্হার সুফল বর্তমান প্রজন্ম উপভোগ করছেন।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্মীয় আন্দোলনকে অগ্রগতি দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষার আন্দোলন ও সমাজসংস্কার মূলক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যদিও তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন করার জন্যও ঘোষণা করে যান- “যার দল নেই তার বল নেই। ”
সেই ঘোষণাকে শিরোধার্য করে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল রাজনৈতিকভাবে (Scheduled Caste Federation) আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। যার ফল স্বরূপ তিনি বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠাতে সক্ষম হন। আর সংবিধানে সুবিধা প্রদানের ফলে পিছিয়ে রাখা সমাজের মানুষেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের নিজের প্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহামানবেরা যে আন্দোলন করেছিলেন সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কি প্রয়োজন নেই? যদি থাকে তাহলে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথের পরে আর কোনো নেতৃত্বকে সেভাবে দেখতে পাই না কেন? তাহলে কি এই আন্দোলনের সুবিধাভোগীরা শুধু ভোগী হয়েই থাকবেন? তাদের মধ্য থেকে ত্যাগী কবে বেরিয়ে আসবে?
এই ত্যাগীকে বের করে আনার জন্য সুবিধা ভোগীদেরকে আত্মঋণ শোধ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আর এই এগিয়ে আসার জন্য তাদেরকে সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিজের পরিবার নিয়েই শুধু সুখে জীবনযাপন করতে থাকলে সেই সুখ কিন্তু দীর্ঘস্হায়ী হবেনা। পরবর্তী বংশধররাই তখন বলবে- “আমার পূর্বপুরুষরা শুধু মহামানবদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলকে ভোগ করেই গেছে; তারা আমাদের জন্য সেই ফল খেয়ে বীজ রোপন করে যায় নি। তাই এই পূর্বপুরুষেরা বেইমানে পরিণত হয়েছে। ”
তো বন্ধুগণ আর দেরি নয়, প্রথাগত শিক্ষা তো অনেক পেয়েছেন; নিজের সন্তানকেও দিচ্ছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজে এবং সন্তানকেও সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসুন। হতাশা নয়; আশার আলোকে সামনে নিয়ে এগিয়ে আসুন। কে করবে বা কে করবে না সেটা না ভেবে নিজে অৗ্তু এই সামাজিক ঋণ শোধ করার জন্য তন্-ম্ন-ধন্ দিয়ে শুরু করুন। আপনার ব্রাহ্মণ্যবাদী বিচার ধারাকে পরিবর্তন করে সামাজিক প্রগতিতে সামিল হন। কারণ, প্রত্যেক পরিবর্তনের মূল হচ্ছে মানসিক বিচারধারার পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ঢেউকে যদি সংগঠিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার সংকল্প গ্রহণ করেন তবেই সার্থক হবে হরি-গুরুচাঁদ, যোগেন্দ্রনাথ, আম্বেদকর ও অন্যান্য মহামনীষীদের সংগ্রামের ঋণ শোধ করা।
এই শিক্ষা বিষয়ক লেখার আপাতত ইতি টানতে চাই বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের এই বাণীটি দিয়ে, “THOSE WHO DON’T KNOW THEIR HISTORY, CAN NOT MAKE HISTORY.’’ অর্থাৎ যে জাতি বা সমাজ তার ইতিহাস জানেনা, সে জাতি বা সমাজ ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেনা। তাই এই লেখা সমাজের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য, যাতে আগামী দিনে নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই নির্মাণ করা যায়। আর মহামানবদের চালানো আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া যায়।
শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত- লেখক আচার্য মহানন্দ হালদার।
(প্রকাশ ২০০৯ ঠাকুরনগর, ঠাকুরবাড়ি)
বাকি সব তথ্যের সূত্র ও ব্যাখ্যা দেওয়া হলো-
(১) অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূলনিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা- লেখক- মনি মোহন বৈরাগী- পৃঃ নং ২৪ ও ২৫ {এ সম্বন্ধে লেখা আছে- “ভাষাগত দিক থেকে বিচার করলে অতীত ভাররবর্ষে দুটি আর্য জাতির সন্ধান মেলে। প্রথমটি হল আলপাইন আর্য জাতি এবং অন্যটি হল নর্ডিক আর্যজাতি। অনেক চিন্তাশীল লেখকেরাই ব্যাপারটাকে ঘুলিয়ে ফেলেন এবং বলেন, ডঃ আম্বেদকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নয়। তাই ডঃ আম্বেদকরকে তারা ঠিক বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। আসল কথা হল ডঃ আম্বেদকর বলেছেন, আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর বা নাগেরা বহিরাগত নয়; কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যভাষীরা হলেন বহিরাগত। তবে ঐতিহাসিক কারচুপির ফলে আর্য বলতে তো বর্তমানে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকি। যারা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত। অতএব নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ এবং উত্তরভারতে আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর বা নাগ উভয়েই যেহেতু আর্য ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত, তাই কৌশলী ব্রাহ্মণেরা নাগ বা অসুরদের ইতিহাস চিরতরে মুছে দিতে নিজেদেরকে আর্য বলে প্রচার দিয়ে দেশীয় অসুর বা নাগদের অনার্য বলে প্রচার দিলেন। এবং নাগ বা অসুররা অনার্য মানবগোষ্ঠী হিসাবে প্রচার পাওয়ার সাথে সাথে একেবারেই মাটি চাপা পড়ে গেল যে দেশীয় অসুর ও নাগদের এক অংশও প্রকৃতপক্ষে আর্য ভাষাগোষ্ঠীরই মানুষ। যদিও উভয়ের মধ্যে রয়েছে দেশী এবং বিদেশী সহ নর্ডিক এবং আলপাইন মানবগোষ্ঠীগত এক মস্ত বড় পার্থক্য। ” (অনুসন্ধানী পাঠকবর্গ -এবিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে এই বইটা পড়ে দেখতে পারেন)}
(২) (ক) ঠাকুর শ্রীশ্রীহরিচাঁদ মানব পুরুষঃ অধ্যাত্ম পুরুষ- সংকলক ও সম্পাদক- শ্রী সন্তোষ কুমার বারুই, পৃষ্ঠা-২৭৮ (এই বইতে লেখা আছে- ১৮৩০খ্রিঃ হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্ম ও সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন।)
(খ) অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর জাতির মুক্তি আন্দোলনে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর ও মতুয়া ধর্ম। লেখক- মনি মোহন বৈরাগী। পৃষ্ঠা-১৭ (এই বইতে লেখা আছে- “উচ্চশ্রেণির মানুষের সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মীয় গোড়ামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তন করেন। ঠিক সমসাময়িককালে অর্থাৎ প্রায় একই সময়ে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে হরিচাঁদ ঠাকুর অস্পৃশ্য পতিত এবং অনগ্রসর সমাজের মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য মতুয়া ধর্মের প্রবর্তন করেন। তাইতো বাংলার পতিত এবং অনগ্রসর সমাজের মানুষেরা ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই মতুয়া ধর্মের পতাকা তলে সংগঠিত হতে শুরু করেন। ”)
(৩) (ক) অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর জাতির মুক্তি আন্দোলনে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর ও মতুয়া ধর্ম। লেখক- মনি মোহন বৈরাগী। পৃষ্ঠা নং- ১১৫
(খ) বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (লেখক বিনয় ঘোষ) বইয়ের পরিশিষ্ট ৩, এর ৫৪২ থেকে ৫৪৫ পৃষ্ঠায় লেখা আছে। আর যেমন আছে সেরকমই দেওয়ার চেষ্টা করছি, যার ফলে দেখতে পাবেন কিছু বানান অন্যরকম আছে। আর বোঝার সুবিধার্থে কিছু লাইন Bold I underline করে দিয়েছি।
অব্রাহ্মণ হিন্দুদের সংস্কৃত কলেজে পাঠাধিকার সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের চিঠি।
From: The Principal of the Sanscrit Collage.
To
Captain F. F. C. Hayes, M.A.
Offg. Secretary, Council of Education
Dated From Willam 28th March 1851
Sir,
I have the honor to acknowledge the receipt of Secretary Dr. Mouat’s letter No. 79 dated the 7th January last, requesting me to report on the subject of any other castes than Brahmanas and Vaidyas, being admitted to the Sanscrit College and to ascertain and submit to the Council the opinion of the Principal Professors of the Institution of the question.
2. In reply beg leave to state that I see no objection to the admission of other castes than Brahmanas and Vaidyas or in other words, different orders of Shudras, to the Sanscrit College. But as a measure of expediency, I would suggest that at present Kayasthas only be admitted-they form a very respectable portion of the Hindu Community of Bengal. The prohibitions in the Shastras with regard to the Shudras do not apply in their full extent to the Kayasthas. The most orthodox Brahmins do not hesitate to give them instructions and even those Brahmins who perform the part of spiritual guides to Kayasthas are not held in disrepute, but rather are highly esteemed inspite of the Dictum of Manu, “Let him not give temporal advice to a Shudra; nor what remains from his table; nor clarified butter of which part has been offered to Gods, not let him give spiritual counsel to such a man, nor inform him of the legal expaintion for his sin”.
3. In the days of Manu, the only duty prescribed for a Shudra was to serve the three superior orders, nameluy Brahmans, Kshatriyas and Vaishyas- but practice has now so far superseded precent that the Kayasthas, though considered to be of the Shudra class- not only perform almost all the duties of the higher classes. But are virtually the heads of the Religious Societies in Calcutta and its Suburbs.
4. There is no direct prohibition in the Shastras against the Shudras studying Sanscrit literature. The only portions of it, from the perusal of which they are excluded are the sacred writings. But there are not wanting authorities which allow this privilege. From certain texts of the Bhagavata Purana clear inferences may be drawn to show that they are privileged to read the above works i.e. acknowledged to be a divine Revelation and to be the essence of all the Upanisads, the most sacred portion, of the Uedas.
ইদং ভগবতাপূর্বং ব্রহ্মণে নাভিপংকজে।
স্হিতায় ভবভীতায় কারুণ্যাৎ সম্প্রকাশিতম্। ।
B. XII, Ch. XIII, V. IX.
The (the Bhagavata) was first revealed by Vishnu to Brahma, situated in the Lotus (growing out) of his Naval and afraid of (being from into) the world.
সর্ববেদান্ত সারঙঘি শ্রীভাগবত মষ্যতে।
B. XII, Ch. XIII, V. XIII.
By Studying it (the Bhagavata) a Brahmana obtaios wisdom, a Kshatriya territory, a Vaisya Weasth, a Shudra purification from sin.
5. Very lately a curious occurrences took place in this part of Bengal which to a certain extent, favours the admission of the Kayasthas to this Institution. An opulent Kayastha, the late Raja Rajnarayan Bahadur of Andool attempting to prove that the Kayasthas are Kashatriyas and therefore not subject to the restrictions enjoyed against the Shudras, insisted orthodox Pundits to give this opinion on the subject and a host of them have subscribed in the affirmative.
6. By the existing rules of the Sanscrit Colllege Vaidyas are admitted to it, though Raghunandana, whose works are the classes them with the Shudras. I can therefore conceive no reason, why Kasyasthas, who occupy from sharing the boon with their brother- Shudras, the Vaidyas.
ইদানীন্তনক্ষত্রিয়াণমপি শূদ্রত্বমাহমনুঃ শনকৈ স্তু ক্রিয়ালোপাদিমাঃক্ষত্রিয়জাতয়ঃ। বৃষলত্বং গতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ। এবঞ্চ ক্রিয়ালোপাদ্বৈশ্মানামপি তথা। এবম শষ্ঠাদীনামপি। ।
Shudddi Tattwa, Page 150 Serampore Edn.
Manu has pronounced that the kayasthas of the present age are become Shudras as “By degrees from the extinction of ceremonies and omission of the study of the Vedas, the Kshatriya are become Shudras”. So from the extinction of ceremonies, the position of the Vaishyas, is the same, and also of the ambasthas, (or Vaidyas) and the like.
7. It would not be irrelevant to state here that in the years 1828 and 1829 during the time of Dr. Wilson, some students of the Hindu College were allowed to study Sanskrit in this Institution, among whom was a kayastha named Baboo Amritalall Mitter, a near connection of Radhakant Bahadur, who received instructions from our Pundits in Grammar and Literature, passed examinations in these branches and obtained prazis.
8. The reason why I recommend the exclusion of the other orders of Shudras at present, is that they, as a body, are wanting in respectability and stand lower in the scale of social considerations’ their admission, therefore, would I fear, prejudice the interests of the Institution.
9. In conclusion, I beg leave to submit the poinion of the Princilal Professors of the College on the subject in original with its English translation from which it will be seen that they are averse to this innovation.
I have the honour to be
Sir,
Your most obedient servant,
ESHWAR CHANDRA SARMA
সংস্কৃত কলেজে সুবর্ণবণিক ছাত্রদের পাঠাধিকার সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের চিঠি।
From
The Principal Sanscrit Collage.
To
G. Gardan Young Esq., Director of Public Instruction
Dated Fort Willam, the 21st Nov. 1855
Sir,
With reference to the Memorial of Baboo Shamacharan Sen forwarded for report under your endorsement No. 1289 dated 15 Aug. last, I have the honor to remark that up to year 1851 the admissions to the Sanscrit College, were confined to Hindoos of the Brahmin and Baidya Cast only. When under order of the late council of Education the privilege of studying in that institution was extended to the Kayasthas the most repectable calte among the Sudras. In the year 1854 this privilege was further extended to all the respectable castes of Hindoos under further orders.
But these orders I regret cannot apply to the people of the caste to which the memorialist belongs nor would it in my humble opinion be expendient at present to admit applicants of that class. It is true that some families of Sonar Baniya of Calcutta are a popular men but in the scale of castes the class the class stands very low. Admission from that class will I am sure not onlyshock the prejudice of the orthodoz Pundits of the Institution but materially injure to its popularity as well as respectability. Personally I have a always been opposed to the exclusive system as will appear from my former reports to the late Council on the subject of admitting applicants of other castes than Brahmans and Baidyas, I would have been glad to admit the son of the memorialist. The greatest latitude that expediency would allow has I believe already been under present circumstances.
The papers received under your endorsement are herewith returned as required.
I have etc.
ESHWAR CHANDRA SHARMA
(৪)“জাগরণী সভা” কাকে বলে? সে বিষয়ে জানতে দেখুন-
গুরুচাঁদের প্রত্যক্ষ শিক্ষা (দ্বিতীয় খন্ড) লেখক-ডাঃ মণীন্দ্রনাথ বিশ্ব্বাস(মনু)। পৃষ্ঠা নং- ৪১
এ বিষয়ে এরকম লেখা আছে- গুরুচাঁদ ঠাকুর ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “তোমরা আমার জাগরণী সভা যখন শুনেছ, তখন নিশ্চয়ই জেনে থাকবে, এই জাগরণী সভায় কী ধরনের আলাপ আলোচনা হয়। এক কথায় বলতে গেলে যে সকল আলোচনায় পতিত জাতির মোহনিদ্রা ভেঙে দিয়ে চেতনার জাগরণ ঘটায়- সেই সবই জাগরণী সভায় আলোচিত হয়। জাতির এই মোহনিদ্রা ভাঙতে হলে যে যে বিষয়ে আলোচনা দরকার সে সব হল- পতিত বলতে কী বুঝায়- আমরা কীভাবে পতিত হলাম- এই পাতিত্য হতে মুক্তির উপায় কী? আবার এই পাতিত্য মুক্তির উপায় খুঁজতে আমাদের যে যে রাস্তায় এগোতে হবে তা হল- আমরা কারা, আমাদের পূর্বপরিচয় কী ছিল, বৈদিক ধর্ম-দর্শনের সঙ্গে তাঁর (হরিচাঁদ) ধর্ম-দর্শনের পার্থক্য কী? তারপর বুঝতে হবে বর্তমান সময়ে আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্হান কোথায়? বৈদিক বর্ণবাদীরা আমাদের (নমঃদের) বৈদিক ধর্মের মানুষ হিসাবে আদৌ মেনে নিয়েছে কিনা? অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র- এই চারবর্ণের ভিতরে আমাদের জায়গা আছে কি না? আর এই চার বর্ণের মানুষের সঙ্গে আমাদের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কোনও সাদৃশ্য আছে কিনা? এই সব জানার পর সকলের কাছে পরিস্কার হবে যে আমার পিতা হরিচাঁদ ঠাকুর আলাদা করে কেন মতুয়াধর্ম দিলেন। নমঃরা তো হিন্দুঘেঁষা হয়ে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিন্তু পিতা সেখান থেকে সরিয়ে এনে একেবারে নিজস্ব জায়গায় দাঁড় করিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব এই অবৈদিক মতুয়াধর্ম হাতে তুলে দিলেন কেন, কেন তিনি জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলেন মতুয়াদের বেদের বিধান কিছুতেই মানা চলবে না, নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি নিয়ে এক বলিষ্ঠ জাতি গঠন করতে হবে? এই সকল অবৈদিক চেতনা নিয়ে যেসব গান শুনে আমাদের নিজের জাতির প্রতি ভালবাসা জন্মে üদয়ে ত্যাগ-তিতিক্ষার উদয় হয়- জাতির উন্নতিতে কিছু করার জন্য মন আনচান করে ওঠে- এই সবই হল জাগরণী গান।
(৫) শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা-প্রণেতাঃ-শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর। সম্পাদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার। পৃষ্ঠা নং-৩৪৩
(৬) অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর জাতির মুক্তি আন্দোলনে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর ও মতুয়া ধর্ম। লেখক- মনি মোহন বৈরাগী। পৃষ্ঠা নং- ১২২
(৭) ঐ পৃষ্ঠা নং- ১২৩/১২৪
(৮)ঐ পৃষ্ঠা নং- ১২৪