জীবনানন্দ দাশ
শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে -ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ।
বধূ শুয়ে ছিলো পাশে-শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো আশা ছিলো জ্যোৎস্নায় তবু সে দেখিলো
কোন ভূত?ঘুম কেন ভেঙ্গে গেলো তার?
অথবা হয় নি ঘুম বহুকাল
লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
কোনোদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।
তবুও পেঁচা জাগে;
গলিত স্হবির ব্যাঙ আরো দুই মুহুর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে
টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা
মশা তার অন্ধকার সঙঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবেসে।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন-যেন কোন বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথ্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা,
যে জীবন ফড়িঙের ,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।
অশ্বথ্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ?জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি,'বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!'
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ সুপক্ক ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের-
তোমার অসহ্য বোধ হলো
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্ত মাখা ঠোঁটে।
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উর্দ্ধতনে উঠে এসে বধু
মধু আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড় হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনোদিন কেঁপে উঠে নাই;
তাই
লাস কাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে
জানি তবু জানি
নারীর হৃদয় প্রেম শিশু গৃহ নয় সবখানি;
অর্থ নয় ,কীর্তি নয় সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বথ্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টালে কয়:"বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার-
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার--"
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি
ক'রে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু'জনে মিলে শূন্য করে চলে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।