“জীবদ্দশাতেই খ্যাতির জন্য মরিয়া হলে তা আসলে লেখার সব কিছুকে ধ্বসিয়ে দিতে পারে।”
“সাহিত্য গণমুখী যতটা, ততটাই তা রাজকীয়, রাজসিক বিষয়।”
“আজকাল কেউ রাজকীয় মেজাজের সাহিত্যিক নন, সব উঞ্ছবৃত্তিতে প্রলুব্ধ লোক আমরা সাহিত্যের সাম্রাজ্যে হানা দিতে চাই, আর তাই এত রাজনীতি।”
“অন্য জাতিকে ঘৃণা করা যে আসলে নিজেরই নীচতার প্রকাশ, আর ভালোবাসা যে নিজেকেই ভালোবাসারই প্রকাশ,—এই সহজ বোধটা আমাদের হলো না?”
উপরিউক্ত বাক্যসমূহ লেখক হামীম কামরুল হকের চিন্তার সারাংশ হয়ে উঠে এসেছে এই আলাপে। এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁর সঙ্গে আলাপের অংশ হয়ে উঠেছে। বস্তুত এই অন্তর্গভীর চিন্তার স্পর্শই সৃজনশীল লেখকের কাছ থেকে এক বড় আবিষ্কার।
আলাপ পর্ব-১ (লিঙ্ক) : যে পথে কেউ যায়নি, সেটাই তোমার পথ। কিন্তু কোন পথে কে কে গেছেন তাও তো জানা চাই।
আলাপ পর্ব-২ (লিঙ্ক) : সারা জগতের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে হলে সারা জগতের সাহিত্যকে বুঝতেই হয়।
আলাপ পর্ব-৩
২১. আমাদের সময় নেই কেন?
খোরশেদ আলম : আইনস্টাইন বলেছিলেন—‘সময় চলে যায় না, আমরাই চলে যাই’—এই যে সময় নেই, তবুও মানুষ নিঃসঙ্গ কেন?
হামীম কামরুল হক : সত্যিই সময়ের আপেক্ষিকতা মারাত্মক। সময়কে বলা হয় আধুনিক মানুষের সৃষ্টি। আমাদের সময় নেই, কারণ আমরা আমাদের মধ্যে নেই। টি.এস.এলিয়টের সেই বিখ্যাত কথাগুলি: “কোথায় আমাদের জীবন যা আমরা হারিয়েছি জীবিকার ভেতর?/ কোথায় আমাদের প্রজ্ঞা যা আমরা হারিয়েছি জ্ঞানের ভেতর?/ কোথায় আমাদের জ্ঞান যা আমরা হারিয়েছি তথ্যের ভেতর?” ‘কোরাসেস ফ্রম দ্যা রক’ কবিতায় ১৯৩৪ সালে লিখেছিলেন। সেখানে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘‘সমস্ত জ্ঞান আমাদের অজ্ঞতার কাছাকাছি নিয়ে যায়,/ সমস্ত অজ্ঞতা আমাদের নিয়ে যায় মৃত্যুর কাছে।”—এই যে অজ্ঞতা এটা সময়কে হাতে না রাখতে পারার অজ্ঞতা। সময়ের হাতে থাকা, আর সময়কে নিজের হাতে রাখা—দুটোর পার্থক্য আছে। আমি হাতঘড়ি পরি, ওই সময়কে নিজের হাতে রাখার জন্য, ওটা না পরলে মনে হয় সময় বয়ে যাচ্ছে, আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।—আমার এমনটা মনে হয়। বাতুলতাও মনে হতে পারে অন্যের কাছে। সেই কিশোর বয়সে শুনেছি, আর্ট ইজ লং, বাট টাইম ইজ শর্ট। কিন্তু আর্ট তো সময়ের অধীন। আমরা চলে যাই, কিন্তু সময়ের হাতে মহাকালের হাতে আর্ট তো থেকে যায়। আমি হয়ত পারিনি, কিন্তু রিলে রেসের বাটনটা হাত বদল করে করে এই আর্টের সাধনা এগিয়ে নেওয়া যায়। কোনো কিছুই সময়ের বাইরে থাকতে পারে না।
২২. ভেঙেপড়া এবং গজিয়ে ওঠা
খোরশেদ : রিলকের সেই কবিতাটির কথা ভাবি যেখানে তিনি বলছেন, “যখন আমরা সাজাতে চাই, সবকিছু বারবার ভেঙে পড়ে, কিন্তু যখন আমরা সাজিয়ে উঠি, তখন আমরাই ভেঙে পড়ি।”
হামীম : এটা আমি পড়েছিলাম আমার একসময়ের ফেসবুকের প্রথমদিককার এক বন্ধু মোশে পার্লস্টাইনের একটা গবেষণাপত্রে বা রিসার্চ আর্টিকেলে। একেবারে সূচনায় উক্তিটি দেওয়া ছিল। তিনি তখন জার্মানির বন বা বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিলেন। তেল আবিবের মানুষ। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু পরে হলেন থিয়েটারের ডিরেক্টর। তো থিয়েটারে সময় কীভাবে কাজ করে তা-ই নিয়ে তার ওই রিসার্চ আর্টিকেলটা। প্রকাশিত হয়েছিল কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার জার্নালে। আমি যদি ভুল না করি। ২০০৭ সালের দিকের ঘটনা। তিনি বলেছিলেন, রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ীরাই আমাদের পৃথিবীতে সমস্ত রকমের বিভেদগুলি জিইয়ে রেখেছে। এখন মোশের ওই আর্টিকেলে কথাটা পড়ে আমি সচকিত হয়েছিলাম। কী ভয়াবহ নিয়তি আমাদের। মহানমানুষরাও তো সাজাতে চেষ্টা করেছিলেন এই পৃথিবীকে। হয়ত পৃথিবী একদিন সত্যিকারের কল্যাণ সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতায় সেজে উঠবে, (তবে লক্ষণ বলে পৃথিবী এভাবেই চলবে)। সেটা কবে হবে, না হলে আমার বর্তমান সময় ব্যর্থ হয়ে যাবে—এটা তো মনে করি না। পুরাণে ফিনিক্স পাখির কথা আমরা জানি। বার বার আগুনে ছাই হয়ে সে ফের জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ‘সিসিফাসের মিথ’ সম্পর্কে আমাদের জানা আছে। পাথরটা পাহাড় চূড়ায় তোলার পর পরই ফের সেটা গড়িয়ে নিচে চলে যায়। গুন্টার গ্রাস এর দারুণ ভিন্ন একটা মানে করেছিলেন, যে, ওই পাথরটা খুব দরকারি পাথর। জীবনের জন্য, প্রতিদিনের জন্য আমার সবার এমন একটা পাথর চাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানিতে তরুণ লেখক হিসেবে শুরু দিকে কাম্যুর এই বইটা তাকে ভীষণ আলোড়িত করেছিল। নতুন করে বাঁচার জোর দিয়েছিল। সেও তো ভেঙে গজিয়ে ওঠারই ব্যাপার, তাই না। সভ্যতা মূল নীতি বলে ‘চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড রেসপন্স’। আমি মনে করি এটাই জীবনের মূলনীতি: বাধা আসবে আর বাধার মোকাবেলা করতে হবে। হাজার বার পড়ে গেলেও উঠে দাঁড়াতে হবে, এটাই হলো জীবনে দিকে এগুনোর পথ। তাই না? এটা অনেক পুরোনো কথা, তাও বলতে হয়।
২৩. জীবনের সামগ্রিক উদযাপন
খোরশেদ : সাহিত্যের একটি বড় দিক জীবনকে সামগ্রিকভাবে উদযাপন করা। আপনি বলেছিলেন, “সাহিত্য পড়ে যারা ন্যূব্জ, খঞ্জের মতো থাকেন, জীবনযাপন করেন, তারা জীবনকে সামগ্রিকভাবে উপলব্ধি করেন না। সাহিত্য যদি বেঁচে থাকার সাহস না দেয়, চরম বিপর্যয়ের ভেতরেও জীবনের পক্ষে থাকার ও বেঁচে থাকার রসদ না দেয়, তাহলে সেই সাহিত্যচর্চার মানে কী?”
হামীম : আমরা তো ষড়রিপুর কথা জানি। কাম ক্রোধ লোভ মদ মোহ মাৎসর্য। ষড়গুণও আছে: সন্ধি, বিগ্রহ, আসন, যান, দ্বৈধ এবং আশ্রয়।—এগুলি হলো রাজার আচরণীয় ছয়টি গুণ। বরাবরই যেটা হয় আমার, ষড়রিপুর কথা মনে রাখলেও ওই ষড়গুণের কথা মনে থাকত না। বহু চেষ্টা করেছি, মুখস্থ করেও মনে থাকত না। আসলে তো রাজার গুণ। দৈনন্দিন জীবনে ষড়রিপুর সঙ্গে মানুষের যে সংলগ্নতা তা তো ষড়গুণের সঙ্গে নেই, তারওপরে সেগুলি সব রাজার গুণ। ফলে আমি নিজে বহুদিন ভেবেছি, সবার জন্য ষড়গুণ কী কী হতে পারে? তারপর একদিন আবিষ্কারের মতো পেলাম, সেটা নিজেরই বের করা: বুদ্ধি, সাহস, উদ্যম, কল্পনা, পরিকল্পনা, শ্রম। বুদ্ধি দিয়ে শুরু আর শ্রম দিয়ে শেষ। একজন শুনে তো পারলে আমাকে পুরস্কার দেয়! তো, আমার ধারণা সাহিত্য মানুষকে যদি এই বোধগুলি না দেয়, তাহলে সাহিত্য পড়া কেন? রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গুণ ছিল। তিনি যেমন বুদ্ধিমান, তেমন বাস্তববাদী, তেমন তার কল্পনাশক্তি তেমন তার পরিকল্পনা আর শ্রমের কথা তো বলা বাহুল্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লিখেছিলেন, এক জীবনে দুই জীবনে কাজ নিজের কাছ থেকে আদায় করা গেছে।—আমার তো মনে হয়, এক জীবনে পাঁচ জীবনের কাজ আদায় করেছেন।… বাংলাদেশে একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, বিরাট একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধান, তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘‘শুধু পড়ালেখা করলে চলবে? ক্ষমতাও অর্জন করতে হয়।” অদৃশ্য বার বারবেল তোলার মতো করে তিনি দুহাতের দুটি মুঠি নিচ থেকে ওপরের দিকে তুলতে তুলতে কথাটা বলেছিলেন। আমি অত্যন্ত চমৎকৃত হয়েছিলাম।… চেশোয়াব মিউশের তো কথাই আছে, কী লাভ কবিতা লিখে যদি না বাঁচায় জীবন ও মানুষ।—এখন কথা হলো, সাহিত্য জীবনের জন্য। জীবন সাহিত্যের জন্য সবার হয় না, যাদের হয়, তাদের কেউ বোর্হেস হন, কেউ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কেউ রোর্বেতো বোলানিয়ো বা এমন অনেকের কাছেই তাদের জীবনটাই সাহিত্য। আপনার কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে জীবন ও সাহিত্য ভেদ ছিল না? অন্নদাশংকর রায় বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে সবচেয়ে বড় যেটি আমাদের শেখার কথা ছিল, তা হলো ‘কীভাবে বাঁচতে হয়’টা শেখা, হাউ টু লিভ। রবীন্দ্রনাথ জীবন দিয়ে দেননি সাহিত্যের জন্য। কিন্তু বাঁচতে বাঁচতে সাহিত্যটা করেছেন।
২৪. আত্মহত্যা
খোরশেদ : কিন্তু জগতের অনেক কবি-লেখকই আত্মহত্যা করেছেন। আর্থার কোয়েসলারের মতো বহুপ্রজ ও মহাপ্রাজ্ঞ ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে একযোগে আত্মহত্যা করেছিলেন। হেমিংওয়ে সিলভিয়াপ্লাথ ভার্জিনিয়া উল্ফ এমনকি আমাদের কায়েস আহমেদ সহ এরকম আরো অনেকে আত্মহত্যা করেছেন? তাদের সাহিত্যে চমৎকার বোধ রয়েছে। কিন্তু নিজেদের জীবন এমন হলো কেন?
হামীম : এমিল ডুর্খেইমের বিখ্যাত কাজ আছে ‘সুইসাইড’। সমাজতত্ত্বের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ বই। কাম্যুর মতে নাকি জীবনের একমাত্র রহস্য এই আত্মহত্যা। ভার্জিনিয়া উল্ফ, আর্থার কোয়েসলার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ বা কায়েস আহমেদ বা যারাই এটা করুন না কেন, জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে এসে তাঁদের মনে হয়েছে—এইভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না, বা আর তিনি জীবনকে ধারণ বহন কোনোটাই করতে পারছেন না, জীবনকে স্থাপনও করতে পারছেন না কোথাও, না প্রেমে না কামে না লেখায় না সামাজিক কোনো কাজে, হতে পারে। কোয়েসলারের মতো অমন মানুষ! থ্রিলারের মতো মনে হয় তাঁর জীবন ও লেখাগুলিকে। সারা পৃথিবীর সমাজ সভ্যতার জটিলাবর্তের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন এঁদের মতো লোক, কিন্তু নিজেদের শেষ করে দিয়েছেন! কেন? জগতের মহান তিনজন গ্যোয়েটে, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ তো তা করেননি। আমার তো মনে হয় তলস্তয়ের মতো পুরুষসিংহের জন্য আত্মহত্যাচিন্তা করা সম্ভবও ছিল কিনা। আমরা মনে হয়, প্রজ্ঞাতে পৌঁছাতে না পারার সমস্যা এটা। অনুভব বা জ্ঞানের বা জানার জট না ছাড়তে পারার সমস্যা। প্রাজ্ঞ, সুস্থ, স্বাস্থ্যবান মানুষ কি আত্মহত্যা করেন? ঋষিদের সাধুদের আত্মহত্যার সংবাদ আমরা কি জেনেছি? তাদের কাছে জীবন-মৃত্যুর কোনো ভেদ নেই। দুটোর সৌরভই তারা পান। মৃত্যুটা কেবল শারীরিকভাবে হয়। ভেদাত্মক জীবনই বোধ করি আত্মহত্যার কারণ।
২৫. বিবমিষা
খোরশেদ : গ্যেটের প্রথম উপন্যাস The Sorrows of Young Werther কারণে অনেক তরুণ একসময় আত্মহত্যা করেছিল।এমন নেতিবাচক বদল অনেকের জীবনে ঘটেছে সাহিত্য পড়ে। হ্যামলেট পড়েও অনেক যুবক জীবনে বিবমিষার বোধ পায়।
হামীম : আমি তো বললাম, জন্ম-মৃত্যু, প্রেম-বিরহ, যুদ্ধ-শান্তি এমন আরো যা যা আপনি আনুন না কেন সবই আসলে একই জিনিসের উল্টাপিঠ। ভিগেটিয়াসের বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘‘Si vis pacem, para bellum” ল্যাটিনে বলা কথাটা। ইংরেজিতে পড়েছিলাম, ‘‘লেট হিম হু ডিজায়ার পিস, প্রিপ্রেয়ার ফর ওয়ার।” এভাবেও বলে, “If you want peace, prepare for war.” তাহলে কী দাঁড়াল? সেই দিক থেকে শুভ-অশুভেরও ভেদ নেই। একটার ভেতরেই অন্যটা পোরা থাকে। বা দুটোই আসলে এক। তর্ক উঠতে পারে, দুটো প্রবল বিপরীত জিনিস কী করে এক হয়? এখানে রহস্য। জরথ্রুস্টের ‘জেন্দাবেস্তা’য় আহুর মজদা ও আহুরমিনের কথা আছে। এরা সহোদর, কিন্তু একজন শুভ/আলোর দেবতা, অন্যজন অশুভ/ অন্ধকারের দেবতা, কেউ কাউকে কখনো নির্মূল করতে পারে না, কেবল সময়সাপেক্ষে তাদের আধিপত্য বাড়ে কমে। ফলে আসলে একই। জীবনভুবনের এই অভেদাত্মক বাস্তবতা বুঝতে না পারলে তো এই বইপত্র পড়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে পারে। বইপড়ায়ও আলোকিত যেমন কেউ হতে পারে, ততটাই হতে পারে অন্ধকারমুখী। অশুভ ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তিদের পুস্তকিজ্ঞান কিন্তু কম নয়, জানেন বোধ হয়।
২৬. খ্যাতির বিড়ম্বনা
খোরশেদ : যেমন দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের কথায়, আমরা বর্তমানে, ‘খ্যাতির ক্রীতদাস, বিকৃতদাস আমরা সবাই’। খ্যাতির বিড়ম্বনা লেখকের জীবনে কী সমস্যা বয়ে আনতে পারে?
হামীম : ড্যাম টু ফেইম। স্যামুয়েল বেকেটের জীবনীর নাম, লেখক জেমস নোউলসন। আমার সঙ্গে সঙ্গে একটা বাংলা মনে জেগেছিল, ‘খ্যাতির খ্যাতা পুড়ি’। বা ‘খ্যাতির মুখে লাথি’। বা যেটা বললাম, এর ভেতরেই নিহিত আছে প্রবল খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা। বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা, তাই না। একটার ভেতরে অন্যটা পোরা থাকে। কিন্তু খ্যাতির জন্য লেখাটা সত্যিই বিপদের। মানে লক্ষ্যটা যদি কেবল খ্যাতিই হয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’-এর একদম ১ নম্বর কথাই হলো: ‘‘যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।” পরিষ্কার! ফলে খ্যাতির জন্য লিখলে কোনোটাই হবে না। লিখতে হবে কত ভালো করে লেখাটা লেখা যায়—সেই উদ্দেশ্যে। এখন লেখায় খ্যাতি না সিনেমা বানিয়ে খ্যাতি হবে, ইত্যাদি দ্বন্দ্বে যারা ক্ষতবিক্ষত তাদের কথা বলতে পারব না। খ্যাতির চেয়ে ক্ষতি হলো বইয়ের বিপুল বিক্রিতে প্রকাশকদের তাগাদায় লেখকের ক্ষয়ে যাওয়া। ইলিয়াসের খ্যাতি আর হুমায়ূনের খ্যাতি তো এক নয়। জীবনানন্দের খ্যাতি ও নজরুলের খ্যাতিও এক নয়। সবাই প্রয়াত। কিন্তু তাদের এই খ্যাতি অটুট। এই খ্যাতি তো ক্ষতিকর নয়। কিন্তু জীবদ্দশাতেই খ্যাতির জন্য মরিয়া হলে তা আসলে লেখার সব কিছুকে ধ্বসিয়ে দিতে পারে। অতুল প্রতিভায় ক্ষমতাবান ও বিপুল পরিশ্রমী লেখকের খ্যাতি আপনাআপনিই জুটে যায়, আগে আর পরে।
২৭. রবীন্দ্রনাথের পথ
খোরশেদ : আপনার লেখা থেকেই উদ্ধৃত করি— “রবীন্দ্রনাথ যতই মরমি, আধ্যাত্মিক লোক হন, তাঁর কথার পরতে পরতে যুক্তির লীলা। তিনি বলেন, ‘আর্টিস্ট অলুব্ধ’। মানে লোভহীন আসক্তিহীন, কিন্তু আমরা দেখি আর্টিস্ট মানেই প্রলুব্ধ, তাঁদের লোভের সীমা নেই, বিশেষ করে অর্থের ও খ্যাতির। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জন্তুরা পেয়েছে বাসা, মানুষ পেয়েছে পথ”, কী সেই পথ?
হামীম : কোথায় লিখেছিলাম মনে নেই। রবীন্দ্রনাথের পথ আসলে মরমী পথ। হাজার বছর ধরে যে পথের সন্ধান করেছেন বুদ্ধ তাওবাদী সাধকরা জেন সাধকরা। পাশ্চাত্যে দেখতে পাই হারমেন হেসকে সে পথে। আত্মসন্ধান, আত্মআবিষ্কার, আত্মমুক্তি—এই তো পথ। প্রথমে নিজে খোঁজা, অতঃপর নিজেকে পাওয়া, শেষে নিজের নিজের হাত থেকে মুক্তি। কী করে এই পরম্পরা তৈরি হয়? সেটা তো তাঁদের যাপনের ভেতরে নিহিত আছে। ওই যে সৈয়দ মুজতবা আলী জগদীশচন্দ্র বসু আর রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ নিতে গেলে, জগদীশ তার পেতে দেওয়া পাতায় লিখেছিলেন, ‘‘নো দাইসেল্ফ”, আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তার তলে: ‘‘ফরগেট দাইসেল্ফ।” নিজেকে জানো, আর নিজেকে ভুলে যাও। ওই যে বলেছিলাম, একটার ভেতরে আরেকটা পোরা। এখানেও তাই। এর দুটোকে যেমাত্র শাব্দিত অর্থে দেখা হবে, তো ভুলের সূচনা হবে। নিজেকে জানা মানে কি সব বাদ দিয়ে নিজেকে জানা? বা নিজেকে ভুলে যাওয়া মানে কী?—এখান থেকে বোঝা যায় বলে দেওয়া কথা, আর বলতে চাওয়া কথার পার্থক্য যদি ধরা না যায় তো রবীন্দ্রনাথের পথের সন্ধান পাওয়া সম্ভব না। ইম্মানুয়েল লেভিনাস দর্শনের আলোচনায় এতে ‘জ্ঞানের জন্য প্রেম’ নয়, প্রেমের জন্যই জ্ঞান’—এভাবে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার আগে এটা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, কতটা ভালোবাসার সঙ্গে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু এই ভালোবাসা আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষের মিলেমিশে হেসেকেঁদে ভেসেডুবে ভালোবেসে বেঁচে থাকার ভালোবাসা নয়, সেই ভালোবাসার ধরন আলাদা। তাঁদের মতো মানুষের কাছে ভালোবাসা অর্থ আলাদা। মরমের পথে না গেলে সেটা বোঝাই যাবে না। বস্তুবাদী মন দিয়েও বোঝা যাবে না, আবার পুরো বিমূর্তবাদী চিন্তা দিয়েও ধরা যাবে না। পরের মুখে যেমন ঝাল বোঝা যায় না, এও তাই নিজে এর স্বাদ নিলে তবে বোঝা যেতে পারে। নিজেকে জানার ভেতরেই আসলে নিজেকে ভুলে যাওয়া পথ, বা উল্টাটা।
২৮. জীবন কি জাদুবাস্তব?
খোরশেদ : হ্যাঁ, যা বলছিলাম, জীবনে বাস্তবতা কি সত্যি বাস্তবতা? আমরা আবার স্বপ্নের ভেতরেই নেই তো! যেমন বলেছিলেন রেনে দেকার্ত?
হামীম : নিপাট বাস্তবতা বা কঠোর বাস্তবতা মানুষের জন্য মনে হয় অসহনীয়। এককাট্টা বাস্তবতার ভেতরে যারা থাকতে পারে, তারা অন্য ধাতের মানুষ। কিন্তু আদৌ কি এমন মানুষ আছেন? এটা ওই মানুষের মতো যে মানুষ ২৪ ঘণ্টাই জেগে থাকে, কোনোভাবেই ঘুমায় না। ভাবা যায় এমন মানুষের কথা? এমন মানুষ কি বাঁচতে পারে? স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে? ঠিক তেমনই বাস্তব বলে আমরা যা যা জানি, চোখের দেখা কি কার্যকারণ যেগুলোর পেছনে আছে, তা তো কিছু আছেই, কিন্তু সব কিছুর পেছনেই কার্যকারণ আছে? অনেকে বলবেন, নিশ্চয়ই আছে। কেউ বলবেন, নেই। বাস্তবতা ইটের মতো। আর ভাবনা সিমেন্টের মতো—এমন বলতে পারি কি? বাস্তবতার বিপরীত কী? অবাস্তবতা? বিমূর্ততা? আমার মনে হয় বাস্তবতাও বহু এর বিপরীত জিনিসগুলিও বহু। ওই একটার ভেতরেও অন্যটা পোরা। এগুলো আমার কাছে জটিলই লাগে। জীবনে সব কিছু বুঝতে চাইনি, বুঝতে পারিনি, এটা একটা বাঁচোয়া।
২৯. সত্য কী?
খোরশেদ : ভারতের একজন সাধক কবি রজ্জব বলেছিলেন, যে সত্য সর্বসত্যে মিলে, তা-ই আসলে সত্য। রবীন্দ্রনাথের বহু কথা জগতে আরো আরো ভাবুক, চিন্তক ও কবি-লেখকের সঙ্গে যদি মিলিয়ে দেখা যেত, তাহলে হয়তো আমরা তার কথা কিছুটা হলেও শুনতাম।
হামীম : সত্যের জায়গাটা আসলে এখন খুব মুশকিলের। তলস্তয়েরা যে সত্যকে আরাধ্য মনে করতেন, সেই সত্য কি এখন আছে? বলা হয় ক্রিটিক্যাল থিওরির যুগ শুরু হওয়ার পর সত্যকে একদম নাশ করে দেওয়া হয়েছে। যা সত্য তাই মিথ্যা, যা মিথ্যা তাও সত্য—এমনও কেউ বলবেন হয়ত। আমি বলেছি অভেদাত্মভাবে দেখা কতটা যায়, বিভেদাত্মকভাবে কতটা যায়? বিভেদাত্মকভাবে দেখাটাই সব রকম ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। সব বাদ্যযন্ত্র আলাদা, আকৃতি, প্রকৃতি, কার্যকারিতার দিক থেকেও, কিন্তু সবগুলিতে নানান ভাবে ঐক্যতান তৈরি করা যায়। ফলে মনে হয় প্রকৃতি ও বস্তুজগতে এত ইশারা ইঙ্গিত আছে, জীবনের এই সব প্রশ্নের উত্তর আছে। প্রকৃতিপাঠ মানেই প্রজ্ঞার পাঠ। কারণ ওই কোথায় আমাদের প্রজ্ঞা? জ্ঞান তো জানলে পড়লে হতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞার পথ কী? মরমীপথ। বিভেদমুক্তির পথ। তখন সত্য মিথ্যাও আলাদা থাকে না। এটা মহাহেয়ালির মতো শোনালেও আসলে দেখা যাবে এটাই সত্য ও গভীর নিবিড় অর্থে বাস্তব।
৩০. সাহিত্যে এতো রাজনীতি কেন?
খোরশেদ : এর অবশ্য দুরকম অর্থ হতে পারে?
হামীম : রাজনীতি তো দুটো অর্থে। সবার ওপরে যে নীতি, আবার কূটকৌশল করে স্বার্থসিদ্ধির যে উপায়, ক্ষমতা অর্জনের উপায়। সাধনা থাকলে জীবনে কি সাহিত্যে কোথাও রাজনীতি থাকে না। একজন অতিপণ্ডিত ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, এই সব সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষা,—সব বুর্জুয়াপনা। স্বয়ং মার্কস বুর্জুয়াদের কিছু গুণের কথা বলেছিলেন যা সভ্যতাকে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সাহিত্য গণমুখী যতটা, ততটাই তা রাজকীয়, রাজসিক বিষয়। মজার ব্যাপার হলো সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ সব কিছু নিয়ে সাহিত্যের রাজসিক নির্মাণ। এর জন্য সত্যিই একটা রাজকীয় মন থাকতে হয়। প্রতিটি প্রকৃত সাহিত্যিক তাঁর নিজের রাজ্যের মহারাজাধিরাজ। নিজের কাছে তার স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি পাশ নম্বর, ফেল নম্বর। সেখানে নিজের সঙ্গে তার কোনো রাজনীতি নেই। কিন্তু যেমাত্র সে নিজের রাজ্যচ্যুত সেমাত্র তাকে রাজনীতিতে পেয়ে বসে, কূটচাল ও কূটক্যাচাল দুটো একসঙ্গে পেয়ে বসে। আজকাল কেউ রাজকীয় মেজাজের সাহিত্যিক নন, সব উঞ্ছবৃত্তিতে প্রলুব্ধ লোক আমরা সাহিত্যের সাম্রাজ্যে হানা দিতে চাই, আর তাই এত রাজনীতি।
৩১. মানবতা
খোরশেদ : গুস্তাফ ফ্লবেয়ার বলেছিলেন যে, তিনি তার বমি উগরে দেওয়ার ভেতর দিয়ে তার মানবতা প্রকাশ করবেন। কথাশিল্পী হিসেবে মানবতা বিষয়ে আপনার মত কী? বিষয়টা অবশ্য তত্ত্ব হিসেবে বেশ পুরনো হয়ে গেল।
হামীম : সেই হ্যামলেটে বলা শেক্সপিয়রের কথা, আমি কঠোর হবো দয়ালু হওয়ার জন্য। ঘৃণাকে প্রকাশের ভেতর দিয়ে ভালোবাসা জানানো। এমনিতে তো সাহিত্য সুন্দরের জগৎ। কিন্তু এখানে সুন্দর ও সৌন্দর্যসৃষ্টির ভেতর দিয়ে লেখককে নৈতিক ও দার্শনিক কাজটি করতে হয়। সাহিত্য হলো জীবনের অদার্শনিক অনৈতিহাসিক অরাজনৈতিক এমন কি অবৈজ্ঞানিক তদন্ত। এই যে এতগুলি ‘অ’ দিলাম, এগুলি সব মিলে সাহিত্য। যখনই ‘অ’ সরে গিয়ে ওই দর্শন ইতিহাস রাজনীতি সাহিত্যের ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করবে, সেখানেই সাহিত্যের বারোটা। দেবেশ রায় বলেছিলেন, সমকাল ছাড়া উপন্যাসের চলে না, আবার শুধু সমকাল ধরেও উপন্যাসের চলে না। ওটাই যোগ করে দেওয়া যেতে পারে দর্শন ছাড়া সাহিত্যের চলে না, আবার শুধু দর্শন নিয়েই সাহিত্যের চলে না। এতে দর্শনের জায়গায় ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান আরো যা যা বসিয়ে নিন। এজন্য সাহিত্যে আসলে সবার ওপরে জীবন ভুবন ও মানুষ। সাহিত্য যেমন শব্দ নির্ভর, তেমন সাহিত্য মানবতা নির্ভর, এছাড়াও সাহিত্য নেই তা তো নয়। কিন্তু যে-সাহিত্য যুগে যুগে মানুষের মানবতার হয়ে কথা না বলে, তা কি আদৌ টিকে থাকার সামর্থ্য রাখে?
৩২. ভালোবাসা ও ঘৃণা
খোরশেদ : জীবনকে ভালোবাসা ও জীবনকে ঘৃণা করা—এই দুই কি তাল মিলিয়ে চলে?
হামীম : রুমির সম্পর্কে বলা হয়, তিনি হলেন এমন একজন কবি, তার কোথাও এতটুকু ঘৃণা নেই। কীভাবে? জীবনের প্রতি প্রবল ভালোবাসাই সমস্ত ঘৃণার বিরুদ্ধে তীব্রতম ঘৃণাপ্রকাশ, নয় কি? ফলে একসঙ্গেই তো। আমি বলেছি, সব অভেদাত্মক। আলাদা করে আমরা নিজেদের সুবিধার জন্য পড়তে বুঝে নিতে পারি, কিন্তু দেখতে সব হয় সামগ্রিকভাবে, সার্বিকভাবে। খণ্ডিতভাবে দেখি বলেই প্রাচ্য প্রতীচ্য মেলে না, কিপলিংয়ের কথাই বাস্তব হয়ে থাকে। আপন পর অপর মিলে যে সামগ্রিকতা, সেখানে আমরা তাকালাম কোথায়? ভেদজ্ঞানই সবখানে। এই দেশাচার, লোকাচার সব আলাদা হয়েও এক হতে পারত। কিন্তু হতে দেওয়া হয়নি। মানুষ তত সভ্য হতে পারেনি। ফলে অন্য জাতিকে ঘৃণা করা যে আসলে নিজেরই নীচতার প্রকাশ, আর ভালোবাসা যে নিজেকেই ভালোবাসারই প্রকাশ,—এই সহজ বোধটা আমাদের হলো না? তাই সব ফিরে আসে। আমার এমনও মনে হয় জীবন হলো বিশাল এক পাথুরে পর্বতের মতো। বাকি সব হলো প্রতিধ্বনি। দর্শন ইতিহাস রাজনীতি সমাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের দুঃখে সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে আয়না, কারণ সেই বলে একমাত্র হাসতে পারে না। সাহিত্যকে সেই ধরনের আয়নাও মনে হয়। তাই বলে, এটা কেউ ভেবে বসবেন না সাহিত্য জীবনের দর্পণ। দর্পণে ‘দর্প’ জাগে, মানে অহংকার থেকে আসা, যেখানে নিজে অহমিকা জেগে ওঠে। সাহিত্য আর যাই হোক অহমিকার জগৎ নয়, যদিও সাহিত্যে অহমিকা আছে, ইতিবাচকভাবে বললে, গৌরব আছে কি লেখায় কি পাঠে।
আড্ডা পর্বটি ৩টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। ১ম ও ২য় পর্ব আগেই প্রকাশিত। আজ ৩য় পর্ব সম্পন্ন হলো। ৩য় পর্ব প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই আলাপী আড্ডা সমাপ্ত হলো। আড্ডা-পর্বে অংশ নিয়েছেন : কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক, শিক্ষক, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট এবং খোরশেদ আলম, লেখক ও শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।