অমিয় জীবনপিয়াসী শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
খোরশেদ আলম
খোরশেদ আলম
১৯৩৩ সালের ২৫ মার্চ কথাশিল্পী শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছিলেন। জীবন ঘষে বারুদ করা লেখক তিনি। জীবন কী? এর প্রকৃতিই বা কী? কীভাবে জীবনকে জীবন দিয়ে বোঝাপড়া করতে হয় এসব বুঝতে হলে শ্যামলের জীবনযাপন ও উপন্যাসে কথিত জীবনবোধকে সামনে নিয়ে আসতে হয়।
শ্যামল বলতে জানেন,
মানুষকে ভালো ভাবে দেখতে জানলে কঠিন দুঃখেও হাসি পায়।
জীবন চিরন্তন নয়। তাই এ জীবন নিয়ে তাঁর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। সেই নিরীক্ষার কুশীলব কেবল অন্য মানুষ নয়, শ্যামল নিজেই। তিনি জানতেন জীবনের হাসির ভেতর দুঃখের কণা ছিটানো। আলো পড়লে সে দুঃখ ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তাই বলে দুঃখে পুরোদস্তুর নিমজ্জন নয়। বরং দুঃখের নদী কাটা যায় জীবনের সঙ্গে যুদ্ধমান হয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন জীবন একটা মুক্ত বিদ্যানিকেতন। জীবনকে যাপন করে তবেই জীবনকে জানতে হয়। তাই ফার্স্ট বা লাস্ট হওয়া নিয়ে মাথাব্যথা কোনোদিনই তাঁর ছিলো না। তিনি কোনো বাদ বা ইজমেরও ধার ধারেননি।
ঘা খেয়েও লোকটা গান গায়।
উপন্যাসের চরিত্র সম্পর্কে একথা বলা মানুষটি তিনি তো নিজেই। মানুষটা সারাজীবন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। জীবনকে অসম্ভব পরীক্ষায় ফেলা শ্যামল বলতে জানেন,
আমার খুব ইচ্ছে করে একটা গোলমাল বাঁধাতে। তারপর সেই গোলমালের নাগরদোলায় দু-চার ঘুরপাক খেয়ে কায়দা করে নিজের বাঁধানো গোলমাল কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে। এটাই হলো জীবনের মজা।
জীবনের এইসব মজা লুটতে লুটতেই তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে আসে একজন কুবের, ব্রজ দত্ত, ‘হাওয়াগাড়ি’র দীলিপ, ওয়াগন ব্রেকার বজরা এমনকি মোঘল ‘শাহজাদা দারাশুকো’। আরও কতশত চরিত্র শ্যামল কাহিনির ঝুলিতে। তাঁর কাছে মানুষ তো সেই প্রাণি যে সবসময় কিছু বানিয়ে তোলার নেশায় মশগুল। পরাজয় অবধারিত জেনেও, ভেঙে পড়েও, বারবার উঠে দাঁড়ায়। তিনি যেন জানেন-- জীবন থাকলে মৃত্যু আছে, ধ্বংসও আছে। তবুও জীবন সৌন্দর্যময়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে জীবনের নিবিড় সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছিলাম। তারপর যেন সেই সৌন্দর্যের ভিন্নরূপ জানতে পেরেছিলাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে।
শ্যামল প্রকৃত অর্থেই জীবন সন্ধানী। সৌম্য সুদর্শন এই মানুষটি কী যেন একটা অমায়িক চাদরের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখেন। তাঁর দুর্ভেদ্য চরিত্র সহসা উন্মোচন করার সাধ্য কার? সন্তোষকুমারের ভাষ্যে, “তার সম্পর্কে চট করে যে রায় দিতে যাবে, সে বোকা।” এদিকে শ্যামলের ব্যতিক্রমী আচরণ ও স্বভাব সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সুরসিক। একেকদিন আড্ডায় একেকরকম ভেক নিয়ে উপস্থিত হতেন শ্যামল। তাঁকে দেখে তখন বেশ রহস্যময়ই মনে হতো। সুঠাম স্বাস্থ্য, রীতিমতো সুপুরুষ, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর কোঁচা দোলানো ধুতিতে একটা নিষ্পাপ সরল মুখের প্রতিচ্ছবি নাকি ভেসে আসতো। শ্যামলের বিনীত কণ্ঠস্বরের পেছনে থাকতো অবিরাম সাজানো মিথ্যা। সুনীল বলেছেন,
কিছুটা সত্যির সঙ্গে মিথ্যেগুলি, বা উদ্দাম কল্পনাও বলা যেতে পারে, তা শ্যামল মিলিয় দিত এমনভাবে যে ওকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় ছিল না।
বস্তুত সুনীলের এ কথায় শ্যামলের প্রতি আবেগ মেশানো স্নেহ প্রকাশ পায়। সাহিত্যিক মহলে শ্যামল ছিলেন হৈচৈ করা মানুষ। আর কখন কী করে বসেন, তা নিয়ে সবাই থাকতেন তটস্থ। স্নেক ডেন্স তাঁর প্রিয় ছিল। যে-কোনো ভরা মজলিসে সুযোগ পেলে সেই উদ্দাম স্নেক ড্যান্স দেখিয়ে ছাড়তেন। তিনি ছিলেন মেশামেশিতে ওস্তাদ। ‘লাভ, লাভ এন্ড লাভ কোম্পানি’ কথাটা শ্যামল নিজেই তাঁর বন্ধুমহলে ছড়িয়েছিলেন। আসলে বন্ধুমহলে ভালবাসা বিলানোই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। ফলে শ্যামল জড়িয়ে যেতেন মানুষের অন্তরাত্মার সাথে। তাঁর সাহিত্যও বোধ করি সেই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। এমনকি তিনি যখন প্রবন্ধের মতো শক্ত বিষয় লিখতেন, তখনও তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে সরস আনন্দ আর বুদ্ধির অনন্য দীপ্তি সহজে ফুটে উঠতো।
‘অফুরন্ত শ্যামল’ নামক একটি প্রবন্ধে সুনীল তাঁর ক্রিয়াকলাপ নিয়েই একখানি বই লিখবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। সেটি সফল হয়েছিল কিনা জানা যায় না। তবে তাঁকে নিয়ে টুকরো স্মৃতিগুলো বেশ মজাদার। যেমন, ‘এক একটি ঘটনা একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পুরোপুরি গালগল্প নয়,
বিনা টিকিটে দোতলা বাসে কলকাতা ভ্রমণ, কিংবা তাতার দস্যু সেজে লাইট হাউস সিনেমায় টিকিট কাটা, আফগানিস্তান রেডিও থেকে পুস্ত ভাষায় খবর পাঠ কিংবা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়ে স্নেক ড্যান্স দেখানো, এসবই শ্যামলের পক্ষে অসম্ভব কিছু না।
তবে শ্যামলের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অনেককেই কথা বলতে শোনা গেছে। তাঁর স্ত্রী কন্যারাও শ্যামল সম্পর্কে নানা ভাষ্য দান করেছেন। সাক্ষাৎকারে তাঁর ব্যতিক্রমী জীবনের কথা বলেছেন।
‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল শ্যামলের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এটিকে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বিশ্বাস, “বিভূতিভূষণকে ছাড়িয়ে শ্যামল গ্রাম বাংলার অন্য এক রূপ ফুটিয়েছে সম্পূর্ণ নিজের কলমে।” শুধু তাই নয়, ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ যে কারো প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় অনায়াসেই উঠে যেতে পারে। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ উপন্যাসে মোঘল রাজদরবারের যে কাহিনি উঠে এসেছে তা এক কথায় তুলনারহিত। একজন নিবিষ্ট শিল্পীর অন্তকরণ খুঁজে পাওয়া যায় এই রচনায়। শোনা যায়, এই উপন্যাসটি রচনা করার জন্য তিনি ফারসি শিখেছিলেন, এমনকি সাংস্কৃতিক আবহজাত সত্যকে ধরার জন্য শিখেছিলেন কীভাবে নামায পড়তে হয়। অন্যদিকে ইতিহাসের সুগন্ধ নির্মাণেই তিনি এতে রাখেন উর্দুয়ানি চালের পৃথক সৌরভ। সময়ের ব্যবধান ডিঙিয়ে বায়োমিথোগ্রাফি তৈরি করেন ইতিহাসকে শৈল্পিকভাবে পাঠযোগ্য করার মানসে। প্রকৃত নিরপেক্ষ লেখক শ্যামলের পক্ষেই সম্ভব মহররমের দিন টালিগঞ্জ পাড়ার মুসলমানদের সঙ্গে শোভাযাত্রায় শামিল হতে। মানুষের টানেটাই সেখানে প্রবল। জীবনকে জীবন দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন শ্যামল। অশেষ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “কমিউনিস্ট না হয়েও শ্যামল পেরেছিল নিজেকে ডিক্লাসিফাই করতে।” তাবত ব্রাত্যদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি ধানক্ষেতের আলে বসে দিব্যি তাড়ি খেতে পারতেন। হয়তোবা সেই তাড়ির সঙ্গে জীবনকেও একচুমুকে পান করে নিতেন। এখানে সুমিতা চক্রবর্তীর একটা কথা প্রাসঙ্গিকভাবে না বললেই নয়।
জীবন নামক বহু-কোণ, বহু-পরত, বহু-বর্ণ বিষয়টির মুখোমুখি দাঁড়াবার প্রচেষ্টা যদি কেউ করেন তাহলে ঈষৎ পরস্পর-বিরোধিতা কেবল স্বাভাবিকই নয়, তা-ই যথার্থ, তা-ই প্রকৃত লেখা।
এভাবেই জীবনের বহুপরত উন্মোচিত হয়েছে শ্যামল উপন্যাসে। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসে সামান্য বসতবাড়ি করতে গিয়ে আগাগোড়া বিষয়ে ডুবে যায় কুবের। জীবন জড়িয়ে যায় জীবনের সঙ্গে। ম্যাজিশিয়ান ভ্যাগাবন্ড ব্রজ দত্তের স্ত্রী আভার প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে মেদনমল্ল দ্বীপে চলে যায় সে। শূন্যহস্ত কুবের একসময় জমি বিক্রয়ের নেশায় পড়ে যায়। কিন্তু এসবই তার কাছে ‘ড্রিম মার্চেন্ট’ হবার সাধ, জমি বিক্রি উপলক্ষ মাত্র। একসময় সমূহ সর্বনাশ জেনেও কুবের পিছুপা হয় না। কেননা তার কাছে জীবন মানেই চ্যালেঞ্জ। আর চ্যালেঞ্জে হারিয়ে পথে বসাও জীবনের অংশ। তাঁকে বলতে শুনি,
এই তো জীবন-- সব দিনের শেষ রাতের অন্ধকারে। তবু এই অন্ধকারেই মানুষ হাতড়িয়ে পথ করে নিচ্ছে। কুবের সারাজীবন তাই করেছে, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও।”
‘হাওয়াগাড়ি’ উপন্যাসের দীলিপও এই সর্বনাশী সবর্গ্রাসী জীবনের প্রতীক। জীবনের প্রয়োজনে গ্রাম থেকে শহরবাসী হতে চেয়ে নতুনত্ব আর আবিষ্কারের নেশায় পড়েছে কুবেরের মতো সে-ও। কিন্তু বন্ধু বন্ধুকে শেষ করে দেয়, স্ত্রী স্বামীকে পরিত্যাগ করে, তাকে ফিরে পেতে চেয়ে অবজ্ঞাত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। প্রতিবিপ্লবী পিতার লাশ বিপ্লবী সন্তান ফেলে রেখে চলে যায় পার্টি আদালতের নির্দেশে। দগদগে জীবনের করুণ সব ঘটনায় ঠাসা শ্যামল উপন্যাস। শ্যামল একসময় শহর কলকাতার প্রেমে পড়েছেন। তাকে ধরতে চেয়ে যন্ত্রণাদিগ্ধ হয়েছেন। প্রথম জীবনে জীবিকার ভয়াবহ তাগিদে বেলুড়ের স্টিল মিলের ফার্নেসে চাকুরি করা শ্যামলের পক্ষে শহরকে আবিষ্কার করতে হয়েছে নিজের জীবন দিয়ে। ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’, কিংবা ‘চন্দনেশ্বর জংশন’-এ তিনি শহর জীবন দেখে মুগ্ধ।
জীবনবাদী, তবুও শ্যামলকাহিনির গন্তব্য যেন মৃত্যু। তার কুশীলবদের মৃত্যুতে অনন্য সৌন্দযর্ আছে। তা বিষাদ প্রতিমার স্বরূপে আমাদের হৃদয়কে দগ্ধ করে। অথচ ‘গ্রোথ এন্ড এক্সপান্সন’-এ বিশ্বাসী শ্যামল তো দেবি ইশতারের প্রতিচ্ছায়া। যেখানে উর্বরতা থাকে, প্রবল বাঞ্ছা থাকে জীবনের। আরও যা থাকে শ্যামল নির্মিত কাহিনিতে, আধুনিক মানুষের দুঃসহ প্রাণাবেগ। তাই আঘাতেও মলিন হয় না কেউ। সেখানে থাকে ছড়িয়ে যাবার, উপলব্ধি করবার আধুনিক মানুষের ভবিতব্য, গন্তব্যরেখা। হলুদ জ্যোস্নার আলোয় প্লাবিত মাঠে পড়ে থাকে কুবেরের লাশ, দীলিপ পড়ে রয় তারই তৈরি ধানক্ষেতে। জাঁ পল সাত্রর্ বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবনেই সুপ্ত থাকে মৃত্যুর বীজ।’ জীবনের এই অমোঘতাকে অতিক্রম করেন না শ্যামল।
শ্যামলকাহিনিতে তত্ত্বতালাশের বারোয়ারি আয়োজন নেই, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি যেন একেকটি খণ্ডচিত্রের নির্মাণ করেন তাঁর নিজের গড়া ভাষায়। সে ভাষা আটপৌরে, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের টানে নির্মিত নয়। অনায়াসেই সেখানে প্রবেশ করে মানুষের মুখের ভাষা, জনজীবনে ব্যবহৃত চলমান শব্দগুচ্ছ। তাঁর ঘটনা উপস্থাপন বেশ সাজানো গোছানো, ক্রমাগ্রসর গল্প ঘটমান বাস্তবতার ব্যবচ্ছেদ। ভাষার জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি সহসা করেন না। বরং বিশ্লেষণী ভাষামাহিমার আদলেই গড়ে ওঠে আখ্যান। সেই আখ্যান যেন নিজের জীবন ছুঁয়ে ছেনে আবিষ্কার করা।
নাটকীয়তা আর আকস্মিকতায় ভরপুর তাঁর আখ্যান। তবু দুর্বল কাহিনি সংঘটনের দায়ও যেন চাপানো যায় না। আসলে একটা ঘনঘোর বাস্তবতায় ব্যক্তিমানুষের আঘাত-অন্তরায়গুলো ক্রমপরিসর ভূমি রচনা করে সেখানে। স্বপ্ন, স্মৃতিকাতর মানুষি অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার হয়ে কাহিনি মানুষের আকাঙ্ক্ষার অতলান্ত জগতকে স্পর্শ করে। লেখকের শ্রম ও স্বীয়-আত্মীকৃত অভিজ্ঞতা প্রবল প্রধান হয়ে ওঠে। যৌবনের চব্বিশ পরগণা তথা চম্পাহাটি তাঁর স্মৃতিভাষ্যে প্রত্নলীন। বাসগৃহ, কৃষিকাজ, সংসার কী নেই সেখানে। শ্যামল লেখাকে বলতে চেয়েছেন ‘দৈবীপাগলামী’। শ্যামল দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জীবনে জীবন প্রবেশের সূত্র আবিষ্কার। এই জীবন যে-সবের অনুষঙ্গপ্রাপ্তিতে গজিয়ে ওঠে, সেসবের তিনি জ্বলন্ত উৎসমুখ সন্ধানী। সে জন্যই তিনি বলতে পারেন,
যেভাবেই হোক একটি হৃদয় আরেকটি হৃদয়কে ছুঁয়ে গেলেই--সব বাঁধন খুলে যায়। বাঁধন খোলাই শিল্পীর দায়।