“যেখানে দেখিবে মধু সেখানেই যাবে যাদু”
শুনলাম বদলে যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষা-পদ্ধতি। তা বদলে যাক ক্ষতি নেই। যদি সেটা যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে হয়, ভালো। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হলে আরও ভালো। কিন্তু অন্তর্গত স্পিরিটের পরিবর্তন না-ঘটানো পর্যন্ত সবই কেবল আশায় গুড়েবালি হবে। কেন একজন ছাত্র ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা পড়ে পুলিশ-প্রশাসন-কাস্টমস-ট্যাক্স বিভাগে যেতে চায়? শুধু এনাদের দোষ দিচ্ছি কেন বেশিরভাগের অবস্থাই এইরকম। রাষ্ট্রের সবচে অবহেলিত ক্যাডার হচ্ছে শিক্ষা ক্যাডার। এর পেছনে কারণ খতিয়ে দেখলে মনে হয় ক্ষমতা ও টাকা এই মানদণ্ড নির্ধারণে সহায়ক হয়ে উঠছে। অথচ প্রত্যেকটি ক্যাডার সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকে যার যার কাজে দক্ষ হয়ে উঠবেন, দেশকে সেবা দেবেন, সেটাই তো চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো।
আবার অনেককে দেখেছি বিসিএস নিয়ে পরিহাস করতে। পরিহাসের বিষয় তা মোটেও নয়। আমরা যেভাবেই ভাবি না কেন, এঁরাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি ধারণ করে দেশকে শৃঙ্খলা, সেবা প্রভৃতি প্রদান করেন। আর তাই তো দেবার কথা। তাহলে কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে প্রত্যেকটি ক্যাডারের সমমূল্য? বিষয়টা কঠিন ও জটিল। বিভিন্ন জনকে নানা ক্যাডার নিয়ে সমালোচনাও করতে শুনি। তারাই আবার সেসব ক্যাডার পেলে বগল বাজিয়ে নৃত্য-উৎসব করেন। তাদেরকে সবসময় সবখানে তোয়াজ-তদবির তো করেনই—সেসব কথা না হয় বাদই দিলাম। যাতে নিজের কাজে লাগে সেজন্য লাইন-ঘাট ‘ক্লিয়ার’ রাখতে সবসময় কণ্ঠে মাখন-মাখানো সুর বজায় রাখেন। আবার কী যেন অদ্ভূত সব কারণে সমালোচনার ঝড় তোলার পর নিজেরাই আবার ‘পায়ের কাছে কুকুর’ হয়ে বসে থাকতেও দ্বিধা করেন না। কিন্তু এই দ্বিচারিতা থেকে বের হবার রাস্তা কি? আমি অনেক ছাত্রকেই বলি যেসব বিষয় নিয়ে বাজে সমালোচনা হয়, বর্তমান অবস্থায় সেইসব পদগুলো নিজেরা ধারণ করার চেষ্টা করো।
যদি কেউ সত্যি সত্যি মনে করেন টাকা আর ক্ষমতায়নে দেশ ভেসে গেছে, তাহলে সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব চেয়ারগুলোতে বসার অমিত প্রচেষ্টা করুন আর সততার সংগ্রাম করার চেষ্টা করুন। তারপর একসময় নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে সবাইকে কীভাবে মূল্যায়ন করা যায়, মূল্যবোধ সঞ্চার করে সবার মধ্যে একটা সমতা আনা যায় সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। অন্যদিকে যদি আন্তরিকভাবে সবার মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সঞ্চারিত হয়, অন্যায় ও অসাম্যের কারণগুলো দূরীভূত হয়, তাহলে সবার জন্যই মঙ্গল। আসলে আমরা সবই বুঝি কিন্তু তালগাছটা আমার আমার বলে তসবি টিপি।
এখন সবাই যদি যাদু মিঞার মতো মধু খেতে ভালোবাসে, তাহলে বড়ই সমস্যা। যাদু মিঞার নজর সবসময় মধুপাত্রের দিকে। সেই পাত্র যেখানে আছে যাদু মিঞা অনেক লড়াই করে অন্য সবাইকে পিছে ফেলে সেই মধুভাণ্ডটাই বগলদাবা করতে চায়। এখানে উদ্দেশ্যের সততার বিষয়টি নীতিনির্ধারক ও ক্যাডার-ইচ্ছুক উভয় দিক থেকেই প্রযোজ্য। সব কথার বড় কথা—যদি ভেতর থেকে কোনোকিছু ঠিক না হয়, তাহলে বাহ্যিক সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভেস্তে যায়। বিসিএস পরীক্ষা-পদ্ধতির যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন চাই, তেমনি একইভাবে অন্তর্গত স্পিরিটের পরিবর্তন চাই। বরং এই অন্তর্গত পরিবর্তনটাই চাই সবার আগে। তাহলে আর যাদু মিঞারা মধুভাণ্ডের লোভে ছোঁক ছোঁক করবে না। বরং “দেশ ও দশের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব” বলিয়া যা-কিছু আমরা মুখে উচ্চারণ করি, সেই বাল্যকালীয় স্কুল পিটির নিত্যকার ‘ওয়াদা’টা মানে মানে সফলতার মুখদর্শন করে।