[সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ইসলাম শফিক স্বনামখ্যাত টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা, গবেষক ও শিক্ষক। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র- গণযোগাযোগ, গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন ও নিউমিডিয়া। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পেশাজীবন শুরু করেছিলেন কপিরাইটার হিসেবে বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, পরবর্তীতে যোগ দেন টিভি চ্যানেলে। ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন টিভি চ্যানেলে। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয়: টেলিভিশন; বাংলাদেশে গণমাধ্যম গবেষণায় যা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বর্তমানে সম্প্রচারের জন্য অপেক্ষারত একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বে আছেন । ড. ইসলাম শফিক শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র ‘গ্রাফিক ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া’ বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। থিয়েটার, চলচ্চিত্র, শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর পর্যালোচনামূলক ও গবেষণাভিত্তিক বেশ কিছু প্রবন্ধ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম শফিক সবসময়ই মানবকল্যাণবাদী ও সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতার একজন ইতিবাচক মানুষ।]
আলাপ শুরু
১. স্মার্টফোন সমাচার
খোরশেদ আলম : সবার হাতেই একটা স্মার্টফোন। সবাই তো একেকটা চ্যানেল। তাই না?
ইসলাম শফিক : আপনি যথার্থই বলেছেন। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট এই দুই এখন মানুষের হাতে হাতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আলাপ করি, বিটিআরসি’র ওয়েবসাইটের সর্বশেষ আপডেট থেকে তথ্য নিয়ে বলি, ২০১৯-২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়—বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার। ধারণা করা যায়—বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৮ কোটি। ইন্টারনেটের গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ৯৪ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি।
খোরশেদ আলম : সম্ভবত তরুণ প্রজন্মই…
ইসলাম শফিক : হ্যাঁ, এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণ-যুব প্রজন্ম। এই প্রজন্ম এখন আর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেন না, বা কোনো সংবাদ শোনার জন্য সকাল-সন্ধ্যার রেডিও সংবাদের চ্যানেল টিউন করেন না, এমনকি প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা টেলিভিশন সংবাদেও এই প্রজন্মের তেমন আগ্রহ নেই। কারণ হাতের মুঠোয় রয়েছে স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট। ব্যাস্, পৃথিবীর তাবৎ তথ্য পুরনো বা নতুন টাচস্ক্রিনে নির্দেশ দেয়া মাত্র মনিটরে হাজির। এমনকি মাত্র ঘটে যাওয়া ব্রেকিং নিউজ নোটিফিকেশনে জানান দেয় স্মার্টফোন ব্যবহারকারীকে।
খোরশেদ আলম : হয়তো… যোগাযোগের নতুন সূত্র…যেমন নিউমিডিয়া…
ইসলাম শফিক : হ্যাঁ, পুরনো যে সকল ট্র্যাডিশনাল গণমাধ্যম রয়েছে, যেমন—সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এসবের বিপরীতে খুব শক্ত অবস্থানে ভীত গড়ে নিয়েছে কিন্তু হালআমলের ‘নিউমিডিয়া’। এর মূলে কিন্তু রয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ইন্টারনেট সমেত স্মার্টফোন ব্যবহার ও নিজস্ব অভিরুচি। নিউমিডিয়া দ্বি-মূখী যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে এই দ্বি-মূখী যোগাযোগ মাধ্যম গ্রাস করে চলেছে প্রচলিত গণমাধ্যমকে।
খোরশেদ আলম : ‘নিউ মিডিয়া’র একটা আধিপত্য তাহলে ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে…
ইসলাম শফিক : মূলধারার মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন বাদ দিয়ে অন্য যে মাধ্যমগুলো রয়েছে সেগুলোই তো আসলে ‘নিউ-মিডিয়া’। ফলে ‘নিউ-মিডিয়া’ ফরমেটের দিক থেকে ডিজিটাল আর ইন্টারনেটনির্ভর। যার হাতে স্মার্টফোন আছে ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব ব্লগ এসবের কোনো না কোনো একটিতে তার নিজস্ব একাউন্ট আছে। কারো বা সবগুলোতেই আছে, কারো বা একাধিক। সেসব বিবেচনায় ইন্টারনেটসমেত স্মার্টফোনের অধিকারী একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি চ্যানেল নয় বরং বলা যায় তিনি বহু চ্যানেলের মুখ্য সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী! ফলে ইন্ডিভিজুয়াল জায়গা থেকে একটা নতুন ধরনের আধিপত্য গড়ে উঠছে।
২. কন্টেন্ট : ভালো কি মন্দ !
খোরশেদ আলম : কিন্তু কন্টেন্ট ভালো খারাপের কোনো বিধি-নিষেধ যেন নেই। যার যা খুশি করছে—
ইসলাম শফিক : তথ্য ও বিনোদন জগতে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে এই ওয়েব দুনিয়া। টেকনোলজি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সম্প্রচার প্রযুক্তিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাধ্যম। টেকনোলজির বিকাশে মানুষের অভ্যাসে পরিবর্তন আনছে।
খোরশেদ আলম : হ্যাঁ, নতুন প্রজন্মের দিকে তাকালে তো…
ইসলাম শফিক : ঠিক, নতুন প্রজন্ম পত্রিকা, বইপড়া বা টিভি সেটের সামনে থেকে সরে গিয়ে ভার্চুয়াল বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এসময়ে একজন মানুষের কাছে ইন্টারনেটসহ একটি স্মার্টফোন হাতে থাকা মানে, হাজারো বিনোদন তার হাতের মুঠোয় চলে আসা। নানারকম তথ্য ও বিনোদনমূলক কন্টেন্ট দেখার জন্য দর্শক এখন অনলাইনে বা স্মার্টফোনে সময় কাটাচ্ছে ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন কিংবা ব্লগে।
খোরশেদ আলম : কন্টেন্ট আপলোডের স্বাধীনতা বলেও কিন্তু একটা কথা…তাই-না?
ইসলাম শফিক : এসব মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট তারা দেখছে এবং নিজেরা পছন্দ মতো কনটেন্ট নির্মাণ করে আপলোডও করছে। ওভার দ্য টপ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অডিও-ভিডিওসহ নানা কনটেন্ট প্রচার বাড়ছে পৃথিবীব্যাপী। দেশ বিদেশের সংবাদ, জাতীয়, স্থানীয়, পাড়া-মহল্লার খবর, এমনকি ঘরের চার দেয়ালের ভেতরের খবরও মুহূর্তে জগতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
খোরশেদ আলম : একটা সময় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার জন্য আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম।
ইসলাম শফিক : সেসবই আসলে স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে, মানে গেছে এরমধ্যেই। টেলিভিশনের লিনিয়ার সম্প্রচার পদ্ধতির কারণে অনুষ্ঠান দেখার জন্য দিন-ক্ষণের অপেক্ষার যে প্রহর গুণতে হয়, অনলাইন মাধ্যমে সেই বাধ্যবাধকতা নেই। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সম্প্রচার সময়ের এই প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে উত্তরণ করেছে। যখন ইচ্ছা, তখন দেখা যায়। যখন ইচ্ছা, তখন কনটেন্ট আপলোড করা যায়। কারো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। নেই তেমন কোনো বিধি-নিষেধ। সিঙ্গেল স্ক্রিনে দেখা যায়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি ছোট্ট একটি মনিটরে কনটেন্ট দেখতে পান।
খোরশেদ আলম : প্রাইভেসিও হয়তো একটা ফ্যাক্টর…
ইসলাম শফিক : হ্যাঁ, তাই। প্রাইভেসির দিক দিয়ে শতভাগ নিশ্চিত থাকেন একজন দর্শক। এই ব্যক্তি প্রাইভেসির বিষয়টিকেই পুঁজি করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের নাম করে অতিমাত্রায় যৌনতানির্ভর খোলামেলা কনটেন্ট খুব সহজে দেখার জন্য তৈরি হচ্ছে।
খোরশেদ আলম : কঠোর নীতিমালা দরকার…
ইসলাম শফিক : সরকার কিন্তু ইতোমধ্যে এসব কনটেন্টের উপর কড়াকড়ি বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এছাড়া ফেসবুক ও ইউটিউবের রয়েছে নিজস্ব বেশ শক্তিশালী নীতিমালা। এখন বাকিটা আইনের প্রয়োগের ব্যাপার।
৩. রুচির মানদণ্ড
খোরশেদ আলম : ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমি কি কন্টেন্ট আপলোড করছি, সেটার তো রুচির মানদণ্ড রয়েছে বা থাকা উচিত; কী বলেন?
ইসলাম শফিক : কনটেন্টের দিক থেকে কী নেই অনলাইনে! সব আছে—টকশো, বিনোদন শো, নাটক, থিয়েটার, সিনেমা, প্রামাণ্যচিত্র, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অর্থনীতি, কুইজ, হাস্যরস, কৌতুক, রঙ্গ, ব্যঙ্গ, যৌনতা, মৌনতা, খেলাধুলা, রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান, আবহাওয়া, যখন যা চাই, পাওয়া যাচ্ছে ‘নিউ-মিডিয়া’ শাখা-প্রশাখায়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব সিরিজ, চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক নাটক, মিউজিক ভিডিও, ই-বুক কতকিছু।
খোরশেদ আলম : তবুও উপযুক্ত কন্টেন্ট কিন্তু…
ইসলাম শফিক : ঠিক। বাঙলা ও বাঙালির ঐতিহ্য, শেকড়ের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধ, জনসাধারণের সাংস্কৃতিক রুচি বিনির্মাণ এসব নিয়ে কনটেন্টের ভীষণ অভাব রয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা লাভের পঞ্চাশ বছর পরেও আমরা আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক রুচির মানদণ্ড দাঁড় করাতে পারিনি। সেই কারণে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কন্টেন্ট আপলোড করার ক্ষেত্রেও ব্যক্তিরুচির মানদণ্ড তৈরি হয়নি।
খোরশেদ আলম : বেশিরভাগ মানুষই তো অন্ধ-অনুকরণ করতেই পছন্দ করে…
ইসলাম শফিক : কথা খুবই সত্য। অন্ধ অনুকরণ-বৃত্তে আবর্তিত হয়ে চারিদিকে একটা হযবরল প্রতিবেশ তৈরি হয়েছে। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য বর্তমানে আমাদের রুচির যে গাইডলাইন বা টাইমলাইন তৈরি করে যাচ্ছি ,তা নিয়ে ভবিষ্যতে শির উঁচু করে অহংকার করার মতো তেমন আশার আলো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। এজন্যই ভালো-মন্দের বিচার কোনো কোনো সময় আমার কাছে আপেক্ষিক মনে হয়! ভালোর অভাবে মন্দের উত্থান ঘটে। মন্দের ভালো নিয়ে আমরা তুষ্টির ঢেকুর তুলি বিধায় কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, গুজব বা জঙ্গিবাদ খুব দ্রুত নিজেরা জায়গা করে নিতে পারে।
৪. সংস্কৃতি ও আত্মনির্মাণ
খোরশেদ আলম : একটা রুচি তো সহসা তৈরি হয় না। রুচির জন্য সাংস্কৃতিক পরিবর্তন লাগে, সুসংস্কৃত হতে হয়। আগে নিজেকে বা নিজেদেরকে তৈরি করতে হয়।
ইসলাম শফিক : হা, আমি আপনার সঙ্গে এ-প্রসঙ্গে একমত। তবে সময়তো কম গড়ালো না। বাঙলা ও বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, শেকড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার বছরের। স্বাধীনতা লাভেরও অর্ধ শতাব্দী পার করছি। আলাপ হতে পারে—আগে নিজেকে বা নিজেদেরকে তৈরি করার জন্য শুরুটা করতে হবে। প্রশ্নটা হলো—শুরুটা কে করবে? ব্যক্তি? পরিবার? সমাজ? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান? নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান? নাকি সম্মিলিত জাতীয় সমন্বিত মহাপরিকল্পনা। কোনটা? পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা অর্থাৎ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো ক্রীড়া বা সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ নেই। আমরা তৈরি করতে পারছি না বই পড়ার অভ্যাস, মাঠে গিয়ে খেলার আগ্রহ।
খোরশেদ আলম : সারাদেশেই সাংস্কৃতিক একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে আসলে…
ইসলাম শফিক : সারা দেশব্যাপী নাট্যসংগঠন, সঙ্গীত একাডেমি, খেলাধুলার ক্লাব, আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, বিতর্ক ক্লাব, চলচ্চিত্র কেন্দ্র—কেতাবে নয়, এখন কোথায়, কয়টা কার্যকর রয়েছে? যারা দিবস নির্ভর নয়, সারাবছর অনুশীলন করে। এই তালিকায় পাবেন হাতে গোনা এক-দুইটা বিচ্ছিন্নভাবে। জাতীয় মহাপরিকল্পনাতেই আত্মসংস্কৃতি ও আত্মনির্মাণ বিষয়টি অবহেলিত!
৫. বিজ্ঞাপনের এথিকস, বিজ্ঞাপনের সাতকাহন
খোরশেদ আলম : বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কী কোনো এথিকস মানা হচ্ছে? বিষয়টা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। বিজ্ঞাপন তৈরি, তৈরির কৌশল থেকে প্রচার-প্রসার, এমনকি বিষয় ও উপস্থাপন সবক্ষেত্রেই…
ইসলাম শফিক : বিজ্ঞাপনের মধ্যে বয়ে চলছে সময়। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের ফলে মানুষের সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবকিছুই যেন চলে গেছে বিজ্ঞাপনের দখলে। চোখ মেললেই দেখা যায় চারদিকে মানুষের অবিরাম ব্যস্ততা, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভাব আর বিচিত্র বিজ্ঞাপন। চোখ বন্ধ করলেও কানে ভেসে আসে বিজ্ঞাপন। ঘর থেকে বাইরে পা বাড়ালেই শুরু হয় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে চলা। রাস্তায়, বাড়ির ছাদে, মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে বিলবোর্ডের। দেয়ালে বিজ্ঞাপন না লেখার জন্যও দিতে হয় বিজ্ঞাপন। চাকরির বিজ্ঞাপন, বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন, পড়াতে চাই, পাত্রী চাই, গাড়ি-ফ্ল্যাট-জমি বিক্রি; মোবাইল মেসেজে বিজ্ঞাপন, অনলাইনে, অফলাইনে বিজ্ঞাপন—এসব আমাদের নিত্য ঘিরে রাখে। শূন্য আকাশেও ঠাঁই করে নিয়েছে বেলুন বিজ্ঞাপন। রঙবেরঙের সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, ফ্লায়ার, ব্রুশিয়ার, নিয়ন সাইন, এলইডি ডিসপ্লে—সবই জানান দিচ্ছে এর উপস্থিতি। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার—সর্বত্রই তো বিজ্ঞাপনের দাপট।
খোরশেদ আলম : মানুষ হয়তো নিয়ন্ত্রিতও হচ্ছে…
ইসলাম শফিক : আসলেই তো! এটি নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের আবেগ, ভাবাবেগ। মানুষের রুচি ও সাজসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, জীবনধারার সবকিছুই চলে গেছে বিজ্ঞাপন সংস্কৃতির দখলে; এমনকি মানুষ কথা বলছে বিজ্ঞাপনের ভাষায়। বিজ্ঞাপনের এথিকস প্রসঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষ’র বিখ্যাত কবিতা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ থেকে কয়েকটি লাইন উল্লেখ করলেই আশা করি আপনার প্রশ্নের উত্তর পাঠক পেয়ে যাবেন—
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
খোরশেদ আলম : সবার আগে এথিকসের চর্চা মনে হয় জরুরি…
ইসলাম শফিক : বিজ্ঞাপনের এথিকস বিষয়টি নিয়ে বিতর্কটা কিন্তু বেশ পুরনো। বিজ্ঞাপন যেহেতু অর্থের বিনিময়ে প্রকাশ বা প্রচার করতে হয়। তাই এর মূল উদ্দেশ্যই থাকে পণ্য বা সেবার বিক্রয় বৃদ্ধি বা ব্র্যান্ড তৈরি করা। বিজ্ঞাপনের এথিকস বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞাপনতাত্ত্বিক ও গবেষক Professor Jef Richards এর একটি উক্তি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে౼ “Creativity without strategy is called art, creativity with strategy is called advertising”
৬. মিডিয়ার শৃঙ্খল
খোরশেদ আলম : বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো টেলিভিশন মিডিয়ায় যেভাবে কাজ করতো সেরকম করে করতে পারছে কী? নিউমিডিয়া টেলিভিশনকে যেন একটা বেরিকেড দিয়ে দিচ্ছে, একটা শৃঙ্খল যেন আপনি বেঁধে যাচ্ছে টেলিভিশনের গলায়…
ইসলাম শফিক : দেখুন, সারা দুনিয়া মেরুদণ্ড বাঁকা করে ঝুঁকে গেছে অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর। গুগলে এখন সবচেয়ে বেশি খোঁজা শব্দগুলোর মধ্যে ঠাঁয় করে নিয়েছে—ই-কমার্স, ই-বিজনেস, ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন, ওটিটি, ওভিসি, এসব। গণমাধ্যমের পুরনো যেসব ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া রয়েছে-যেমন: সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন। এসব পুরনো গণমাধ্যমের থেকে বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন প্রচার বাজেট কমিয়ে ফেলছেন। নুতন করে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পণ্য বা সেবার টার্গেট ভোক্তা অনুযায়ী বিজ্ঞাপন প্রচারের স্থান নির্বাচন করা যায় এবং প্রচার পরবর্তী কতজন এই বিজ্ঞাপনটি দেখলো, সেটাও পরিসংখ্যান আকারে জানা যায়। ভোক্তার পেশা, বয়স, লিঙ্গ, স্থান, এলাকা প্রভৃতি বিবেচনা করে সিলেকটিভ আকারে প্রচার-ব্যবস্থা করা যায়। এতে করে আগের চেয়ে তুলনামূলক খরচও কম হয়ে থাকে।
খোরশেদ আলম : তাহলে তো ট্রাডিশনাল মিডিয়াগুলো বিজ্ঞাপন পাবে না…
ইসলাম শফিক : এ কারণে দেখবেন, প্রায় সকল বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে চলেছে। এতে শুধু টেলিভিশন শিল্প নয়, অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া হাউজগুলোও আর্থিকভাবে বিপাকে পড়েছে। তবে আশার কথা হলো—টেলিভিশনগুলো খুব দ্রুত নয়াপ্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের সম্প্রচার আঙ্গিক ও কনটেন্টে পরিবর্তন এনেছে। এই সময়োপযোগী পরিবর্তনে অনেকে টেলিভিশন শিল্প নিয়ে আশার আলো দেখছেন।
৭. প্রদর্শনের বাস্তবতা
খোরশেদ আলম : কী দেখাবো আর দেখাবো না, সেটারও তো জাতীয়-আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে। এমন একটা বিজ্ঞাপন বানানো হলো, এই সেদিনও ইউনিলিভারের একটা বিজ্ঞাপন নিয়ে বেশ সমালোচনা হলো। একটা মেয়ে টাকার জন্য, বাড়ি করার জন্য ডাক্তার হতে চায়। সেই গল্প আবার পরিরবারের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠে…মা-বাবা কিংবা সন্তানের আবেগ নিয়ে এক ধরনের খেলা চলে কিছু কিছু বিজ্ঞাপনে।
ইসলাম শফিক : বিজ্ঞাপন মানেই প্রচারণা, আর প্রচারেই প্রসার। সাধারণভাবে বললে—বলা যায় বিজ্ঞাপন পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করে। ভিন্নভাবে বললে বলতে হয়—বিজ্ঞাপন হলো পণ্য বিক্রয়ের একটি যোগাযোগ ফাঁদ। বিজ্ঞাপনদাতারা প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে এতো বেশী সফল যে, মানুষের সাধারণ ইচ্ছা-অনিচ্ছাও বিজ্ঞাপন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
খোরশেদ আলম : তার মানে মানুষের ব্যক্তিসত্তা বলে কিছু থাকছে না?
ইসলাম শফিক : একজন মানুষ কী খাবে এবং কী খাবে না, সেটাও তো আর ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়! বিজ্ঞাপনে যা বলে, সেটাই তার ইচ্ছা! বিজ্ঞাপনের কপি লেখার সময় পণ্যের প্রত্যাশিত ভোক্তার শ্রেণির মনন, রুচি, চাহিদা এমনকি সূক্ষ্ম আবেগ-অনুভূতির বিষয়গুলো গবেষণা করে এবং নানাবিধ ব্যাখা-বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে বিজ্ঞাপনের একটি গল্প তৈরি করা হয়। বিজ্ঞাপনের গল্পের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতার মনে কৃত্রিম চাহিদার বীজ বুনে দেয়া হয়।
খোরশেদ আলম : একটা রূপান্তর যেন…
ইসলাম শফিক : তা তো বটেই… একজন সাধারণ দর্শক বিজ্ঞাপন দেখার পর দর্শক থেকে ক্রেতায় রূপান্তরিত হন। এই রূপান্তর করণের শক্তিটাই বিজ্ঞাপনের অন্তর্নিহিত শক্তি। তাই বিজ্ঞাপন দেখার জন্যও সাধারণ দর্শককে আলাদা চোখ তৈরি করতে হবে।
৮. বিপদে টেলিভিশন, ভিন্ন-চিন্তা
খোরশেদ আলম : টেলিভিশন কি বিদায় নেবে? একটা সময় কিন্তু মনে হতো হার্ডকপির বই কিংবা প্রিন্টেড পত্রিকা নাই হয়ে যাবে। বাস্তবে কিন্তু সেটা হচ্ছে না। একটা আরেকটার সাপ্লিমেন্ট তথা সহযোগী মাধ্যম হতে পারে কিন্তু বিকল্প তো নয়? যেমন আমার কিন্তু নিজেরও, অনেক বিষয় অনলাইনে যেমন, পড়ালেখার বিষয়ে সাহায্য নেই। কিন্তু তারপরও মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প ভাবতে পারি না। হয়তো একটা জেনারেশন আসবে, তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবু যুক্তি দিয়ে মানতে কষ্ট হয়। মানুষের স্বাস্থ্য একটা বড় সমাচার। এটার তো পরিবর্তন সম্ভব নয়। “শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয়”, একথা সহজে বলে দেয়া যেতে পারে কিন্তু শরীর সর্বংসহা নয়, তার একটা সীমাবদ্ধতা কিন্তু আছেই।
ইসলাম শফিক : এসব প্রশ্নের উত্তর আমি সময়ের কাছে ছেড়ে দিতে চাই! সময়ই বলে দেবে আসলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে! কারণ বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি যেভাবে প্রতি মুহূর্তে রূপবদল করছে তাতে অনাগত দিনে কী ঘটবে তা সমকাল দিয়ে বিচার করা সমীচীন নয়। দুই হাজার বছর আগের সভ্যতা কিন্তু আজকের প্রযুক্তির দুনিয়ার অগ্রগতির কথা ভাবতেও পারেনি! আর ভেবে থাকলেও যেমনটা ভেবেছে, আমি নিশ্চিত তেমনটা হয়নি। কিন্তু আজ বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি কল্পনাতীত বিষয়কেও বাস্তব রূপ দিয়েছে। আপনি আশঙ্কার মধ্যদিয়ে ঠিকই বলেছেন, ‘টেলিভিশন বিদায় নেবে!’ কিন্তু আসবে অন্যভিশন। হা, সময়ের প্রবাহে ট্র্যাডিশনাল লিনিয়ার টেলিভিশনকে একসময় হয়তো বিদায় নিতেই হবে।
খোরশেদ আলম : নতুন কিছুর সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। এখন মাল্টিলিনিয়ার প্রযুক্তি যদি…
ইসলাম শফিক : সেই প্রসঙ্গেই আসছি… ট্র্যাডিশনাল টেলিভিশন একসময় বিদায় নিলেও টেলিভিশন থাকবে ভিন্ন ফরমেটে, ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। এটাই প্রযুক্তির সৌন্দর্য, নির্মম হলেও প্রযুক্তিসত্য। আপনি খেয়াল করে দেখেন—আমাদের যাপিতজীবনে গত দুই থেকে আড়াই দশক আগেও টর্চলাইট, হাতঘড়ি, ক্যালকুলেটর, ফিল্ম-ক্যামেরা, রেডিও এসব আলাদা আলাদা ডিভাইস—কী অসাধারণ সব প্রয়োজন মিটিয়েছে। প্রযুক্তির ক্রমবিকাশে পর্যায়ক্রমে এসব যন্ত্র বা ডিভাইস স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্ব বা চাহিদা হারিয়েছে; কিন্তু অস্তিত্ব বিলীন হয়নি। বরং এসবের প্রয়োজন ও ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আঙ্গিক পাল্টেছে, পাল্টেছে চরিত্র। টর্চলাইট, হাতঘড়ি, ক্যালকুলেটর, ই-বুক, ক্যামেরা, রেডিও, টেলিভিশন এসব এখন হাতের মুঠোয় স্মার্টফোনে জায়গা নিয়েছে। কাব্য করে যদি বলি তবে রবীন্দ্রনাথই আশ্রয়—‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’ তেমনী মুদ্রিত গ্রন্থ বা রেডিও-টিভির পুরাতন রূপ নিয়ে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। অস্তিত্বের প্রয়োজনে ভোক্তা, পাঠক ও দর্শক চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মুদ্রণ গ্রন্থ, রেডিও-টিভি কালে কালে প্রযুক্তির নয়ারূপ পরিগ্রহ করবে।
০৯. চাকরি ও মিডিয়া-হাউস
খোরশেদ আলম : নিউমিডিয়া আসার পর অনেকে চাকরি হারাচ্ছে। সমাজের সব ক্ষেত্রেই যেন লিকুইডিটি বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাপনেও এই প্রভাব পড়ছে। এমনকি মিডিয়া হাউসগুলোও সেখান থেকে পিছিয়ে নেই। শুধু চাকরি হারোনো প্রসঙ্গে নয় বরং আরো অনেক না-বলা প্রসঙ্গ নিয়েই কথাটার অবতারণা করছি কিন্তু…
ইসলাম শফিক : দেখেন… বহুমুখী সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশের মিডিয়া। মিডিয়া খাত এখনো পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক শিল্পখাত হিসেবে মর্যাদা পায়নি। মিডিয়া বলতে আমি বলতে চাচ্ছি, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, নাটক, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, প্রোডাকশন হাউজ, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম এসব। কোভিড-১৯ এর মহাদুর্বিপাকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পৃথিবীবাসী নতুন এক অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নিয়ত সংগ্রাম করছে। খাবার-দাবার, কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন, শিক্ষা, তথ্য, চিকিৎসা প্রায় সকল ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অনলাইন নির্ভরতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব এখন নয়াপথে হাঁটা শুরু করেছে।
খোরশেদ আলম : হয়তো সহজলভ্য হয়ে উঠছে…
ইসলাম শফিক : নিশ্চয়ই… নিউমিডিয়া মানুষের মধ্যে যোগাযোগ, বিনোদন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষমতা, তথ্য আদান-প্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতি সহজীকরণ ব্যবস্থা হাতের কাছে নিয়ে এসেছে। জনমানুষ পুরাতনকে ছেড়ে নতুনের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। যার ফলে পুরোনো সব মিডিয়াহাউজ বেশ বিপাকে পড়েছে। এটা সংবাদপত্র অফিস, রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন স্টেশন, বিজ্ঞাপন এজেন্সি থেকে শুরু করে প্রোডাকশন হাউজ, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মসহ এ-জাতীয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। বিপাকের মূলে হলো বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাওয়া। বহুজাতিক কোম্পানিসহ স্থানীয় প্রায় সকল কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপন বাজেট পুরনো প্রথাগত মিডিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। এতে রুগ্ন হয়ে পড়েছে পুরাতন মিডিয়া হাউসগুলো।
খোরশেদ আলম : বড়ই চ্যালেঞ্জিং…
ইসলাম শফিক : তা তো বটেই! তবে, এই খাদ থেকে সহসা ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন! কারণ চ্যালেঞ্জ নয়ামিডিয়ার সাথে। এই চ্যালেঞ্জের বিপরীতে নিজেদেরকে প্রস্তুত না করে, উল্টো কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে কর্মীবাহিনীর মাঝে সর্বক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে হতাশা, অদক্ষতা, পরনিন্দার ফুলঝুরি। যারা দক্ষ ও মেধাবী তাদের কোণঠাসা করতে অযোগ্যরা দল পাকিয়ে হুক্কাহুয়া কোরাস গায়। বেশিরভাগ হাউসগুলো নিয়মিত বেতন-ভাতা হয় না, তবে নিয়মিত যেটা হচ্ছে সেটা হলো চাকুরি থেকে ছাটাই। এর কিছু প্রকাশ্যে, তার চেয়ে বেশি ঘটে গোপনে৷ মিডিয়া শিল্পের প্রধান শ্ত্রু হলো অফিসের অপরাজনীতি! অপরাজনীতি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে প্রযুক্তিবান্ধব সৃজনশীল পেশাদার আলোক উজ্জ্বল পরিবেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে এই রুগ্নশিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।
১০. যেমন খুশি তেমন সাজো; মিডিয়ার রাজনীতি
খোরশেদ আলম : তবে, মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। আগে যেখানে প্রবল প্রাতিষ্ঠানিক খবরদারিত্ব ছিল, সেটা মনে হয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আগেই যেটা বললাম, মানুষ যা ইচ্ছা তাই, “যেমন খুশি তেমন সাজো”র ‘সঙ’ নামক কিম্ভূত প্রাণিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিষয়টা গোলমেলে যদিও… অন্যদিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক খবরদারিত্ব থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে, মুক্তি ঘটছে—কথাটা আপনি না-ও মানতে পারেন। হয়তো আরো বেশি জেঁকে বসছে। সেটা একান্তই জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্ষমতা ও পলিটিক্সের বিষয়। আমরা আর কিইবা করতে পারি?
ইসলাম শফিক : মিডিয়ার রাজনীতি জটিল একটি অঙ্ক—তৈলাক্ত বাঁশ ও বানরের মতো। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের আদি ইতিহাসের দিকে তাকালে আপনার প্রশ্নের জবাব অনেকাংশে পাঠক বা দর্শক পেয়ে যাবেন। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম যে টেলিভিশনের আগমন হয়েছিল সেটার নেপথ্যেও রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ইতিহাস। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে একটা অসামরিক রূপ দেবার প্রস্তুতিপর্বে তদানীন্তন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে নির্বাচনের আগেই ঢাকা এবং লাহোরে একটি করে টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরকারি নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের পর ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ১০ পৌষ ১৩৭১ বঙ্গাব্দ সন্ধ্যায় ডিআইটি ভবনে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
খোরশেদ আলম : মানে, একটা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদী আচরণ…
ইসলাম শফিক : সেটা সবসময়ই ছিল। ১৯৬৪-৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে টিভি অনুষ্ঠান বা সংবাদ বলতে শুধুমাত্র বিটিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠান বা সংবাদই প্রতিষ্ঠা পেয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ফলে বিটিভি সবসময় শাসকদলকে ক্ষমতায়ন করেছে। সামরিক শাসক থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক সরকারও টেলিভিশনকে নিজেদের প্রচার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য মতে—‘এরশাদ যেকটি শক্ত খুটির উপর ভর দিয়ে দীর্ঘসময় স্বৈরাচার শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন তার একটি হলো বাংলাদেশ টেলিভিশন’। ১১ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় কঠোর সমালোচনা করে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে টেলিভিশনকে ‘মিয়া-বিবি-গোলামের বাক্স’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে এরশাদ বিদায় নিলেও বিটিভিতে তাঁর সময়ে চালু হওয়া অপসংস্কৃতির অবসান হয়নি। ১৯৯১ সালে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে তারাও টেলিভিশনকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করেও বিটিভিতে পূর্বের ধারা বহাল রাখে। পর্যায়ক্রমে এই ধারা আরও সুসংহত হচ্ছে।
খোরশেদ আলম : বেসরকারি চ্যানেলগুলোর কোনো ভূমিকা…? বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়টি তাহলে…
ইসলাম শফিক : বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে প্রথম টেলিভিশন হিসেবে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে ‘একুশে টেলিভিশন’। বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল উন্মুক্ত হওয়ার পর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক টিভি চ্যানেল চালু হতে থাকে। বর্তমানে প্রায় ত্রিশটি টিভি চ্যানেল স্যাটেলাইট প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ২৪ ঘণ্টা নিয়মিত অনুষ্ঠান ও খবর প্রচার করছে। এসব গণমাধ্যম বেশিরভাগ হাউজই গণমাধ্যমের নিজস্ব আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি তারা প্রতিফলন করতে দেন না। তারা জনগণের কাছে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করেন। এতে করে আজ গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা হুমকির মুখে পড়েছে। মিডিয়া যখন নিজ দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়, তখন ভিন্ন ভাষা আর অপসংস্কৃতি এসে হানা দেয়। তাতে ভাষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে উত্থান ঘটে গোঁড়ামী, কুসংস্কার, তথ্যবিকৃতি ও গুজব সন্ত্রাসের।
১১. গণমাধ্যম সেবকের পথের নিশানা
খোরশেদ আলম : একজন মিডিয়া-ম্যান ও শিক্ষক হিসেবে তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার থাকলে শুনবো। কেননা তারাই বর্তমানের সৃষ্টিশীল মানুষ, সেইসঙ্গে তাদের পথপ্রদর্শকেরও প্রয়োজন রয়েছে। যদিও এখন আর কেউ কাউকে উপদেশ দেয়াটা পছন্দ নাও করতে পারে।
ইসলাম শফিক : বয়স বিবেচনায় তরুণ শব্দটির যে-অর্থে সমাজে প্রচলিত আমি তাতে একমত নই। আমি মনে করি—যার মধ্যে নব নব সৃজন দক্ষতা, সৌন্দর্যচেতনা, সজীবতা, উদ্দীপনা ও জীবনীশক্তি বিদ্যমান তিনিই তরুণ! আমি তারুণ্যকে কখনও সময়ের সাথে বা নির্দিষ্ট কোনো বয়স সীমায় আটকাতে রাজি নই। আপনার সঙ্গে আমি একমত ‘এখন কেউ আর উপদেশ দেয়াটা পছন্দ করেন না। উপদেশ তো নয়ই, রবং আমি পেশাদার জায়গায় যে-সঙ্কট প্রত্যহ মোকাবেলা করি, সেসব থেকে বলি। তাতে করে যদি কারো পছন্দ বা প্রয়োজন হয়, তিনি সেটা অনুসরণ করলেও করতে পারেন। সময়টা প্রযুক্তির, সবাই প্রযুক্তির পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছি। কিন্তু অনুকরণ বৃত্তে ঘোরপাক খাচ্ছি আমরা। প্রযুক্তি জ্ঞানের সাথে নয়া নয়া সৃজনশীল চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। প্রযুক্তি এখন অনেকটা সহজ এবং হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি—পেশাদার বাজারে ভীষণ অভাব রয়েছে সৃজনশীন কন্টেন্ট কারিগরের। গবেষণা, পাঠ-পরিধি, পর্যবেক্ষণ, কল্পনাশক্তি, নন্দনভাবনা, সময়জ্ঞান প্রভৃতির চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে; আর বাড়াতে হবে ধৈর্য্য, বিনয়, মানবিকতা ও দেশপ্রেম।
খোরশেদ আলম : অশেষ ধন্যবাদ বিস্তৃতভাবে সব বিষয় সম্পর্কে বলার জন্য। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা এসেছে আপনার জবাবে।
ইসলাম শফিক : আপনাকেও, মূল্যবান প্রশ্নসমূহ উত্থাপনের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার-গ্রহণ
খোরশেদ আলম প্রাবন্ধিক গবেষক ও গল্পলেখক। পেশায় শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। খোরশেদ আলম সম্পর্কে এই লিঙ্কে ব্রাউজ করুন : https://khorsed-alam.blogspot.com/