স্মৃতিকথা : আজ ও সেদিন
স্মৃতিকথা : আজ ও সেদিন
প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। আমাদের বাড়িতে তখন আসবাবপত্র তৈরির কাজ করছেন সাইদুর মিস্ত্রি। বেশ কিছুদিনব্যাপী হরেক রকম জিনিস তৈরির ম্যারাথন কাজ। স্কুল ছুটি হলে বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে বা খাবারটা কোনোরকমে মুখে তুলেই তখন বড় কাজ হলো সাইদুর মিস্ত্রির পাশে বসে তাঁর নিপুণ হাতের কারুকাজ দেখা। সাইদুর মিস্ত্রির ছিলো ঝাঁকড়া বাবরি দোলানো চুল। তাঁর ঝাঁপিতে ছিল বাউল গান আর হরেকরকম গল্প-কিসসা। কখনও কণ্ঠ ছেড়ে উচ্চস্বরে নিজের মনের খেয়ালেই গান গাওয়া শুরু করতেন। আমাদের বাড়ি একেবারেই রাস্তার পাশ ঘেঁষে। মিস্ত্রির গান শুনে পথচারির দল ভিড় করে দাঁড়িয়ে যেতো। কিন্তু মিস্ত্রির কাজ থামতো না। কাজ, কাজের ফাঁকে গান, মুখে খিলি পান। সাইদুর মিস্ত্রির গানের মধ্যে প্রচুর গল্প থাকতো। পরে জেনেছি তাঁর নিজেরই একটা দল রয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন স্থানে, কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে গানের আসর করে বেড়াতেন। অপরূপ সেসব কিসসা কাহিনি। তার সবটা মনে নেই। তবে নানা ধরনের ভাব ও দর্শনমূলক গান ছিল তাঁদের কণ্ঠে। পুরনো দিনে ঘটে যাওয়া রূপকথা, কিংবদন্তী, পুরুষ ও নারীর অধিকার, গ্রাম বাংলার মানুষের ঘটনাপ্রবাহ, ধর্মীয় বিষয় প্রভৃতি ছিল তাঁদের গানের বিষয়বস্তু।
সে-সময় যাঁরা গানের শ্রোতা ছিলেন তাঁদেরকে কখনও সম্প্রদায় বিভাজন করতে দেখিনি। সংস্কৃতি-নির্মাণের নামে মিডিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপও তখন ছিলো না। অথচ সেইসব কাহিনিমূলক গান শুনে হৃদয় তৃপ্ত হতো। সে-কারণে মনেও পড়ছে। মনে দাগ ফেলেছিল বলেই তো সেসব স্মৃতিতে ফিরে আসছে। সাইদুর মিস্ত্রিরি হাতে কতো রকম নকশা আঁকা হতো। সেইসব নকশার সবটা খেয়াল নেই। কারণ এতোদিন পরে সেই আসবাবপত্রগুলো খুব একটা টিকে নেই। তবে নানা ধরনের ফুলের চিত্রের সঙ্গে ময়ূর বা পাখি জাতীয় ছবি খোদাই করে বসানো হতো। আমাদের গ্রাম সমাজ তখন বেশ ধর্মপ্রবণ। বাড়িতে বাড়িতে নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, কৃত্য হওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলেনি খাটে, শোকেসে, আলমারিতে মযূর বা পাখির চিত্র অঙ্কন করা যাবে না। পাখি খোদাই করতে করতে সাইদুর মিস্ত্রি পয়গম্বরদের কিসসা বলতেন, আসবাবে রঙের প্রলেপ দিতে দিতে হাসান-হোসেনের মর্সিয়াগীতি উপহার দিতেন। মানুষের মধ্যে ভেসে উঠতো আত্মনিবেদন। গভীর আত্মতৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে কাহিনি শেষ হলে শ্রোতাগণ যে যার কাজে যেতেন। সুন্দর একটা মন তৈরির স্বভাবী চেষ্টা মানুষের গভীর মনোবৃত্তির সঙ্গে মিশে যেতো।
জীবনের স্বাভাবিকত্বের সঙ্গে এগুলো টিকে গিয়েছিল বলে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। বৈশাখের উৎসব ঘিরে আজ বাংলাদেশে বহুধাবিভক্তি দেখে স্বভাবতই মন প্রশ্ন তুলছে, তাহলে এমনভাবে চৌচির হয়েছে এদেশের সংস্কৃতি! যখন মানুষ মানুষকে অস্বীকার করছে, অপমান করছে। এগুলো স্রেফ উপলক্ষ্য। আসলে সমাজের গভীরেই প্রবেশ করেছে বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা কখনও প্রপাগাণ্ডা দিয়ে তৈরি, কখনও শ্রেণিবিদ্বিষ্ট সমাজের ফলাফল। তার মানে দিনে দিনে মানুষ ক্রমশ অবনমনের দিকে যাচ্ছে। আবার এটাও মনে হয়, আগেও হয়তো বিভাজন ছিল। কিন্তু তা বর্তমানের মতো নগ্ন আর স্পষ্ট ছিল না।
‘লাইমলাইট’-এ আনা বলে একটা কথা আছে। এখন অনেক বিষয়ই আরোপিত। জীবনের স্বাভাবিক আচারের সঙ্গে না মেলানো মানুষের মন এখন বিচ্ছিন্ন-বিভগ্ন। নানারকম দ্বৈতাচার, স্বৈরাচার আর জবরদস্তিতে ভরা গোটা জীবন। সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী, মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতি-নির্মাণের কারখানা এখন অস্পষ্ট আর জীবনবিমুখ। তারা তর্কের নামে কুতর্ক করতে বেশি ভালোবাসে। মানুষের দায়িত্ব রয়েছে অনেকরকম। সেসব বাদ দিয়ে আজাইরা কূটকচালে লিপ্ত। নিজেকেই এখন চেনে না মানুষ, কী চায় তাও সুনির্দিষ্ট নয়। কেবল আত্মকুহরে নিমজ্জিত, স্বার্থমগ্ন, জিঘাংসাপ্রবণ।
জীবনের স্বভাবধর্ম, নৈতিকতা, সংযোগ, গভীর জীবনতৃষ্ণা আর পরোপকার-তৃপ্ত মনোভাব প্রায় হারিয়ে যাবার পথে। ঘৃণা, উদ্বেগ, বিবমিষা তৈরি করে আমরা জানান দিতে থাকি কে কার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই যেন শেষ হবার নয়। এক ফুটো কলসি অপর ফুটো কলসিকে ব্যঙ্গ করছে তোমার তলা ভাঙা। ফলে এমন একটি সমাজে মানুষে-মানুষে সংযোগ-সৃষ্টি তো নয়ই, বরং বিচ্ছিন্ন হতে হতে কোথায় যে তলিয়ে যাবো আমরা! তার হদিসও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন আমাদের নির্মিত ফানুসের ফসিলগুলো আমাদেরকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে-- যাদের মানবতা ক্ষুণ্ণ, গভীরতা স্বার্থজালে নিবদ্ধ, তাদের আবার কীসের জীবন আর কীসেরই বা সংস্কৃতি? সংস্কৃতি ধোয়া পানি পড়াও কেউ খায় না, সংস্কৃতি দিয়ে পেটও ভরে না। তবে সংস্কৃতি কাজে লাগে মন তৈরির জন্য। সুন্দর জীবনের জন্য মন তৈরি করতে হয়। সেই মনের কারখানাই যেন আজ বিকল।