প্রসেস্ড ফুড, সভ্যতা ও অপমৃত্যু

খোরশেদ আলম

আগে জানতাম যতবেশি চলাচল তত বেশি জ্ঞান, এখন জ্ঞান বলে দিচ্ছে যতবেশি চলাচল ততবেশি অরক্ষা। যারা কেন্দ্র থেকে সরে যেতে চেয়েছেন বা কেন্দ্রের বাইরে বিকল্প কেন্দ্র বা বিকেন্দ্রের কথা বলেছেন তাদেরকে আমরা কেউ পাত্তা দেইনি। কারণ আমাদের বানাতে হবে চকচকে ঝলমলে নাগরিক সভ্যতা। আর সভ্যতার পেছনে থাকবে ভেজাল, ২ নম্বর আর ২য়/৩য় পক্ষের খাদ্য তথা প্রসেস্ড ফুড। যতবেশি সুপারমার্কেট ততবেশি ভেজাল। আমেরিকার সুপারমার্কেটেও নাকি ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। 

ফলে যতবেশি নাগরিক হবেন, ততবেশি আজাইরা জিনিস উৎপাদন করতে হবে। জুস-উৎপাদন তার মধ্যে একটি। জেনেশুনে বিষপান করাবো আমরা বাচ্চাদের। যখন আপনি বিকেন্দ্র গ্রামকে উন্নত করবেন, তখন খাদ্য-উৎপাদন ও খাবার সংস্কৃতি পরিবর্তিত হবে। পুরনোধারার সতেজ খাবারেই নতুন নতুন মাত্রা যোগ হবে। আপনি অবশ্যই টাটকা আর সজীব খাবার গ্রহণ করতে পারবেন। এটা এমনিই হয়ে উঠবে, বেশি কসরত করতে হবে না। এলাকাগুলো উন্নত হলে যার যার এলাকাতেই কর্ম-সংস্থান হবে। জাতীয় সংস্কৃতিই বদলে ফেলতে হবে। জীবনযাপন সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসগুলোকে পরিবর্তন করতে হবে। কারো বাৎলে দেওয়া হুজুগে পথ পরিহার করার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। 

কিন্তু আমরা কীসের বিনিময়ে কী কিনছি? যতবেশি ইন্ডাস্ট্রি, জেনে রাখবেন, ততবেশি প্রাণহানী। নারায়ণগঞ্জের জুস ইন্ড্রাস্টিতে অগ্নিকাণ্ড হলো। দেদারসে শ্রমিক মারা গেল। দুর্ঘটনা তো এদেশে বারবারই ঘটেছে, ঘটছেই। বারবার ঘটতেই থাকবে, থামাতে পারবেন না। অথচ মানুষ আজ প্রয়োজনে অক্সিজেন পাচ্ছে না। বগুড়ার একজন ব্যবসায়ী খুব কম খরচে অক্সিজেন উৎপাদন করার যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। কিন্তু দেখবেন শেষপর্যন্ত কেউ পেট্রনাইজ করবে না। আচ্ছা, বানান যত পারেন কালো টাকা ! আর পারবেন তো পাচার করতে ! কিন্তু যাবেন কোথায়? করোনার মতো মহামারি মানুষকে আটকে ফেলবে। যত বাহাদুর হন মৃত্যূর চেয়ে, অসুস্থতার চেয়ে বড় শত্রু নাই। অথচ নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র কিনছেন। সেই অস্ত্র তো মানুষের দিকেই তাক করা। মানুষের পাহারাদার যাদের বানাবেন তারাই ডাকাতি করবে। 

মানবজীবনের সাংঘাতিক সব ট্রাজেডিকে উপেক্ষা করার সাহস আমাদের নাই। কিন্তু নৈতিকভাবে বাঁচার ইচ্ছাও আমাদের নাই। নিরাপদ খাদ্য ও জীবনধর্মী প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমাদের কোনোই নজর নাই। কারণ, এগুলো তো অত লাভজনক নয়। পক্ষান্তরে ঝুঁকি আছে, সামাজিক অপবাদ আছে। পড়াশুনা করে উদ্যোক্তা হবেন, দেখেন আপনার পাশে কেউ দাঁড়াবার আছে কিনা? খুঁজে পাবেন না। হয়তো আমরা চাই না বলে সমাজ চায় না। আর সমাজ চায় না বলে আমরাও চাই না। শিক্ষিত হয়ে সবাই চায় ‘হোয়াইট কলার জব’ আর সহজে ধনী হওয়া যায়, এমন পেশা গ্রহণে বেশিরভাগ মানুষের মারাত্মক ঝোঁক। ফলে যেনতেনভাবে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে পারলেই হলো। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। খালি পয়সা বানানোর ধান্দা। আজ এই ধান্দার শিকার নারায়নগঞ্জের জুস ইন্ডিাস্ট্রি। যেখানে মরা মানুষের দাম বিশ হাজার, জখম হলে দশহাজার। মায়াকান্না করে কী হবে? পুরো দেশের মানুষের শিক্ষা আর সংস্কৃতির বদল না হলে কোনোভাবেই এগুলো সামলানো যাবে না। আমরা কী বানাবো, কী তৈরি করবো, কী খাবো এ-বিষয়ে শিক্ষিত হওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে। জীবনদায়ী খাদ্যদ্রব্য ও জীবনধর্মী জিনিস ব্যবহারের সংস্কৃতি পরিবর্তন না করলে অকালে সবারই অপূরণীয় ক্ষতি হবে। আর এরজন্য প্রয়োজন যথার্থ বিকেন্দ্রিকরণ। করোনা কি এই উপলব্ধি দিচ্ছে না?