কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা
(অনুলেখন : খোরশেদ আলম)
অভিজ্ঞতার বাইরে আমি কিছুই লিখিনি : হাসান আজিজুল হক
কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের বক্তৃতা (সার-সংক্ষেপ)|
(অনুলেখন : খোরশেদ আলম)
(১৯-০৬-১৩ তারিখ। স্থান : বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)
বাংলাসাহিত্যের অবিসংবাদিত একজন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। ষাটের দশকের নিরীক্ষাপ্রবণ কথাসাহিত্য তথা গল্পের তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক। ১৯.০৬.১৩ তারিখ বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে এসেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বয়সের ভারে কিছুটা ক্লান্ত দেখালেও তাঁর কণ্ঠ ছিল খুবই সাবলীল। মনকে নিবিষ্ট রাখার মতো অনায়াসে কথা বলতে পারেন তিনি। কথা বলার সময় মোবাইলে একটি কল এলো। কাঁপা কাঁপা হাতে কলটি ধরলেন তিনি। আসলে তো বয়স বেড়েছে। ৪৩ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। শিক্ষকতার চেয়ে তাঁর আর কোনও ভালো নেশা ও পেশা নেই-- তাঁর কথায় ছিল এই অকপট বিশ্বাস। যেন এক ব্রতচারী মানুষ। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন। সেমিনারে উপস্থিত ব্যাক্তিগণ এমনকি সিনিয়র অধ্যাপক সবাই প্রায় তাঁর ছাত্র-বয়সী। তাই স্বভাবসুলভ শিক্ষকের অধিকার নিয়েই যেন অকপটে শুরু করলেন তাঁর জীবন ও সাহিত্যের একটুকরো মেঘ-বৃষ্টি ভরা কথামালা। সেদিন তন্ময় হয়ে তাঁর কথা শুনছিলাম আমরা সবাই। তিনি আমাদেরকে ভ্রমণ করালেন ইতিহাস-দর্শন-সাহিত্যে। আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো সরল গভীর-সত্যে স্নাত হলাম। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। শৈশব, কৈশোর, যৌবন-- তাঁর বেড়ে ওঠা নানা বিষয়ে। নিরন্তর অন্বেষণ আর জীবন-অভিজ্ঞতার সারাৎসারই এই গল্প লেখকের প্রধান অবলম্বন। একটি অন্তরঙ্গ উপস্থাপনা ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা থেকে সেদিন যা আহরণ করেছিলাম তারই সার-সংক্ষেপ এখানে প্রকাশ করছি :
“অভিজ্ঞতার বাইরে আমি কিছুই লিখিনি। আমি হয়ত কখনো গল্প নির্মাণের জন্য কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু তা খুবই সীমিত। এত সীমিত যে তা না বলাই ভাল। আমি প্রতিভা স্বীকার করি না। মানুষ তাঁর চারপাশে যা দেখে তার বাইরে কিছু নেই। আমিও আমার চেনাজানা জগতের বাইরে যাইনি। সেই চেনা জগতটাই আমার সাহিত্যে কিছুটা স্বপ্ন মিশিয়ে পরিবেশন করা। আসলে তা কেবল আমার অভিজ্ঞতা। গল্প আমি কখনো বানাই না। গল্প বানাতে পারিও না। যে গল্পটা জানি তাকেই রূপ দেই। আমি মধ্যবিত্ত সমাজের একজন। তবে বেগানা মধ্যবিত্ত। হ্যাঁ, আমি এই জগতটাকে ভাল চিনি। তবে আমি নিম্নবিত্তের মানুষকেও অত্যন্ত ভেতর থেকে দেখেছি।
আমার বেড়ে ওঠা রাঢ়বঙ্গে। সেই রাঢ়বঙ্গ আর আজকের সময় অনেক পার্থক্য। হয়ত তোমরা অবাক হবে আমার শৈশব-কৈশোরের কথা শুনে। আমাদের পাশে সব ছিল হিন্দু পরিবার। তার মধ্যে গুটিকয়েক পরিবার মুসলমান। সে-সময় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার বালাই ছিল না। একমাত্র আমাদের পরিবারেই কিছুটা শিক্ষা ছিল। আমি ও আমার ভাই দুজন পাঠশালায় যেতাম। পাঠশালায় যাবার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ছিল না কারো। পাঠশালাকে দুশ্শালা বলে সরিয়ে রাখত তাই অনেকে।
আমাদের সময়ের গুরুভক্তির ব্যাপারটি ছোটবেলা থেকেই শিখতে হোত। অনেক কিছুই শিখতে হোত। শেখা ছাড়া চলত না। যেমন একদিন আমার বাবার পা ধুয়ে দেবার জন্য পানি ঢালছি। আমি একটু এদিক-সেদিক নাড়াচাড়া করে পানি ঢালার চেষ্টা করছিলাম। বাবা বললেন, তুই বদনা নাড়াচ্ছিস কেনো? পা নাড়াবো তো আমি। আমি তো জানি কোথায় পানি দরকার। তুই একজায়গায় স্থির করে বদনার নল ধরে রাখ।
আমরা কীভাবে প্যান্ট পড়তাম তা জেনে অবাক হবে অনেকে। আজকের প্যান্ট তো নয়ই বরং পাজামা। পাজামার ফিতে বাঁধা থাকত দড়ি দিয়ে। এটাই আমার শৈশব। তার ভেতরে আজকের মত শার্ট গুজে ভদ্রলোক সাজা যেত না। আমার জীবন বর্ণাঢ্য। ব্রিটিশ ভারত দেখেছি, পাকিস্তান দেখেছি, তারপর দেখলাম বাংলাদেশ। ঔপনিবেশিক শাসন পার হলেও জাতির সংগ্রাম কিন্তু সবসময় অব্যাহত। পাকিস্তানের দেশ বিভাগ আমাদের মনের ভেতরে তীব্র যাতনা তৈরি করেছিল। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে আজকের দিনে চিন্তা করা যাবে না। ৪৭ সালের দেশবিভাজন আমাদেরকে ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছে। যে-অভিজ্ঞতা আমার জীবনে সঞ্চয় করেছি তা আমার গল্পের জগতে বলবার চেষ্টা করেছি। মন্বন্তর দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সত্য কথা বলতে সে-মন্বন্তরের আঁচ লেগেছিল আমাদের পরিবারেও। মানুষকে দেখেছি গাছ-গাছালির আড়ালে পোষাকহীন অবস্থায়। দারিদ্র্য এত চরম অবস্থায় পৌঁছেছিল। পরনের কাপড় দূরের কথা অন্নও জোটেনি।
আমি মনে করি একজন কথাসাহিত্যিক মিথ্যে বলতে পারেন না। তাঁর সাহিত্যে গল্প-উপন্যাসে সত্যটাই উচ্চারিত হয়। আজকের দিনে কোনো অভিজ্ঞতা নেই কেউ গল্প-ঔপন্যাসিক হয়ে উঠল। ব্যাপারটা এমন নয়। শিল্পী হবার জন্য অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে। সমালোচনাকে আমি ততটা গুরুত্ব দেই না। আমার সাহিত্য পোস্ট-কলোনিয়াল হয়ে উঠল কীনা, পোস্ট-মডার্ন হলো কীনা এগুলো নিয়ে আমি একদম ভাবি না। আজকাল এগুলোর মাতামাতি বড্ড বেশি। এগুলোর ধারে কাছেও আমি নেই। আমি শুধু জানি জীবন লিখতে হবে। আমার সম্পদ অক্ষর(বর্ণ)। আমি অক্ষর লিখি। ভাল কোনো মাধ্যমের অভাবেই এটা করি। যদি হোমারের সময় হোত তাহলে আমি ইলিয়াডের মত কাহিনি নিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতাম। মানুষের মাঝে বসে গল্প শোনাতাম। এখন আধুনিক যুগ। লেখকরা তাই হোমারের মত মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরে না। আসলে তার প্রয়োজনও হয়ত ফুরিয়ে গেছে।
আসলে আমি যেভাবে মানুষের জীবন পর্যবেক্ষণ করেছি সেভাবেই লেখার চেষ্টা করেছি। কল্পনা, প্রতিভা এসব ব্যাপার আমার নেই। আমার কাছে মনে হয় গল্পে ওগুলোর ধার ধারিনি আমি। আমি আমার মত করে নির্মাণের চেষ্টা করেছি। আমি মধ্যবিত্ত সমাজের একজন। তাতে কী? আমি শৈশব-কৈশোরে যে-মানুষদের সঙ্গে বসবাস করেছি তারা বেশির ভাগই নিম্নশ্রেণির। ফলে কোথাও আমাকে ধার দেনা করতে হয়নি। অত্যন্ত কাছ থেকে আমি তাদেরকে দেখেছি। একজন কথাসাহিত্যিককে খুব নিবিষ্ট মনের অধিকারি হতে হয়। টলস্টয় মুঝিক(কৃষক) শ্রেণির চরিত্র নির্মাণ করেছেন। তাতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। অথচ তিনি ছিলেন উচ্চবিত্ত সমাজের। কিন্তু মুঝিকদের জীবনের চুলচেরা বিশ্লেষণে টলস্টয় কোথাও কি ভুল করেছিলেন? এটাই তো একজন সাহিত্যিকের বৈশিষ্ট্য। তিনি যা দেখবেন, উপলব্ধি করবেন মন দিয়ে, তাকেই অঙ্কন করবেন। মিথ্যা কথা তিনি বলতে যাবেন কেন? আর মিথ্যা দিয়ে সাহিত্য হয় না। আমার মনে হয়-- কথাশিল্পকে পিকটোরিয়াল বা ছবির কাছাকাছি হতে হয়। তাহলেই বাস্তব দৃশ্যটা বর্ণনা করা যায়। পেইন্টিংস একারণেই গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। পেইন্টিংস-এ ফাঁকি চলে না। আমার কথাসাহিত্যকে আমি যথাসম্ভব পিকটোরিয়াল করে তোলবার চেষ্টা করি। এবং অবশ্যই তা বাস্তবসম্মত চিত্রধারণ।
সত্যি বলতে, আমি যখন প্রথম গল্প লিখি তখন আমি গল্পের সংজ্ঞাই জানি না। কাকে বলে ছোটগল্প? আমি গল্প লেখার আগে শিখিনি-- এটাও বলতে পারি। মনে পড়ে, আমি যখন ৬০-এর দশকে ‘শকুন’ গল্পটি লিখে ফেললাম তার আগেও গল্প সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে ছোটবেলায় পড়েছি সাহিত্যের অনেক বই। হাইস্কুলে থাকতেই শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা পড়েছি। তবে ছোটদের সংস্করণ। পাঠ্যসূচিতে থাকবার জন্য পড়েছি অপুর ছোটবেলা নিয়ে। বিভূতিভূষণ নিয়ে এর বেশি নয়। আর আমি যখন গল্প লিখি তার আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখারও পড়েছি দুএকটা। আসলে আমি যা বলতে চাই তা হল-- গল্প লেখার জন্য একজন লেখকের বাইরের বেশি কিছু জানবার দরকারও নেই। তবে লিখতে লিখতেই জানা ও পড়া হয়ে যায় অনেককিছুই। লেখক নতুন কি পুরানো কালের এটা বোধ হয় ব্যাপার নয়। তাঁর শিল্প মানুষের কথা বলতে পারল কীনা এটাই বড় কথা। যে মানুষটা চিরন্তন তার বেদনাও চিরন্তন। সেটাকেই ভাষা দিতে হয়। আমি আমার সাহিত্যে মানুষের কথা বলবার চেষ্টা করেছি। তথাকথিত ‘হিউম্যানিটি’র কথা নয়। এসব গৎবাধা কথা। ইউরোপ থেকে ঔপনিবেশিক সময়ে আমাদের এখানে প্রবেশ করেছে। আমি যা বুঝি তা হচ্ছে ‘মানুষ’। একান্তই আমি যেভাবে দেখেছি সেই মানুষ। এখানে কোনো তত্ত্ব-টত্ত্ব নেই। এগুলো সমালোচকদের কাজ। একটা বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে হবে তাই। তা সবসময় লেখকের মনোপুত হয়ও না। সাহিত্যটা ম্যাজিক রিয়্যালিটি হলো কী হলো না তা নিয়ে অনেকে কথা বলেন। আসলে ম্যাজিক রিয়্যালিটি কী জিনিস? আমার বোঝার দরকার নেই। জীবনের ম্যাজিক। এইতো। মার্কেজসহ অনেকে ল্যাটিন আমেরিকায় তা করেছেন। ওটা ওখানকার বাস্তবতা। কীভাবে আমেরিকা সেখানকার মানুষদের শোষণ করল, আদিবাসীদের বিতারিত করল; কীভাবে আমেরিকান পুঁজি সেখানে প্রভাব ফেলল-- এসব বিষয়কে তারা সাহিত্যে বলবার চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘকালের শোষণ-বঞ্চনার একটি রূপ তাদের সাহিত্যে তৈরি হয়েছে। সেখানে মার্কেজ গল্প লিখেছেন-- তা হয়েছে ম্যাজিক রিয়্যালিটি। আমি মনে করি, একজন শিল্পী যা দেখেন তাকে একটু ভিন্ন রূপ দেবার চেষ্টা করেন। তবে প্রকৃত সত্যটাকে কখনোই আড়াল করে নয়। আমিও আমার অভিজ্ঞতার জগতকে ব্যবহার করেছি; আবার তার থেকে যতটুকু প্রয়োজন নিয়েছি। অনেকটা বাদও দিয়েছি। আমি এখন যেভাবে কথা বলছি সেটা তো আর সাহিত্য নয়। আসলে গল্পের জন্য কাহিনি-চরিত্র তৈরি করতে হয়। সেই চরিত্রগুলো দিয়ে লেখককে কাহিনি লিখতে হয়। কাজেই যখন লিখি তখন দৃশ্যমান জগতটা কিছুটা পরিবর্তিত হয়। আমি হয়ত তাই করেছি। সব সাহিত্যিকই করেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর কাহিনি বলবার জন্য চরিত্র বানিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজের আসল সত্যটা কোনো না কোনোভাবে তাতে এসেই পড়েছে। একটা মানুষ নষ্ট, খল, খারাপ স্বভাবের; তাকে সাহিত্যে ওভাবেই আনতে হবে। ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ, নানা ধরনের মানুষ সেখানে থাকবে।
লেখককে কাহিনি নির্মাণে বাস্তববাদী হতেই হয়। নির্বস্তুক লেখকরাই ভাববাদী। দেকার্তই তো প্রথমে মানুষের চেতনাকে আলাদা করেছেন। বস্তু সত্তা পৃথিবীর সত্তা। আর মানুষের চৈতন্য সত্তা তার কাছে আলাদা। সাহিত্যের বিষয় মানুষের এই চৈতন্য সত্তা নিয়ে কাজ করা। আমার জীবনে বহু রকম মানুষ দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গে বড় হবার দরুণ সেখানকার সাঁওতাল দেখেছি। তবে ঐ সাঁওতাল আর বাংলাদেশের সাঁওতাল এক নয়। তাদের ভাষা ব্যবহারে অনেক পার্থক্য আছে। আদিবাসীরা নানারকম লড়াই-সংগ্রাম করেছে এবং করছে। সেগুলোর প্রতি আমারও পূর্ণ সমর্থন আছে। তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে এবং করে চলেছে।
রাঢ়বঙ্গের মানুষের সঙ্গে এখানকার উত্তর-পশ্চিমের ভাষা ও খাদ্যাভ্যাসে অনেক পার্থক্য আছে। তারা কতকগুলো শব্দ ব্যবহার করে যা এখানে আলাদা। সুন্দরবনে আমি বেশ কয়েকবার গেছি। আমার গল্পও আছে এ-নিয়ে। ‘মা-মেয়ের সংসার’ গল্পটি সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে লেখা। তবে আরো যদি কয়েকবার যেতে পারতাম তাহলে তাদের জীবন নিয়ে আরো বেশি কিছু লিখতাম। হুম্ম.. মনে ঠিক পড়ছে না, তবে আমি সিডরের (সিডরে ধ্বংসপ্রাপ্ত) একেবারে শেষের গ্রামটাতে গিয়েছিলাম।
একটা দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা এখনো বাঙালি হতে পারিনি। দুটো দেশ বিভাজন হলো। অনেককিছু দেখলাম। অখণ্ড বাংলা দেখলাম। বিভক্ত বাংলা দেখা হলো। এই একটি প্রশ্ন অমীমাংসীত থেকে গেল। আদিবাসিরা তো আদিবাসী বাঙালি। আমরা বাঙালি কিংবা বাংলাদেশের বাঙালি-- আমি এভাবেই দেখতে পছন্দ করি। আমরা আসলে বাঙালি হলাম না। আমাদের মজ্জার ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটি এখনো লুকিয়ে আছে। বাইরে বোঝা যাবে না কিন্তু খুব শিক্ষিত মানুষের ভেতরে-ভেতরে সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে তারা সাম্প্রদায়িকতা পুষে রাখেন। এখনো আমাদের দেশকে অনেক অতিবামপন্থিরা ঝোঁকের বশে পূর্ব-পাকিস্তান বলে। তাহলে অন্যেরা কী করবে?
পশ্চিম বাংলায় যেখানটায় বড় হয়েছি সেখানে এক জমিদার ছিলেন। সে জমিদার ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু। ফলে বিয়ের ব্যাপারে বড় একটি ঝামেলা হয়। উচ্চবর্ণের কেউ তাকে মেয়ে দেয়নি- না ব্রাহ্মণ, না ক্ষত্রিয়, না কায়স্থ। কে তাকে মেয়ে দেবে! এমনি ছিল জাত্যাভিমান। পরে নিম্নবর্ণের এক মেয়েকেই তাকে বিয়ে করতে হলো। পরে তিনি সেই স্ত্রীর নামে স্কুল গড়ে দিলেন। নিম্নবর্ণের অনেকে তখন শিক্ষার সুযোগ লাভ করল। সেই জমিদার নিম্নবর্ণ থেকে উঠে এসেছিলেন বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করি। ছোটবেলা থাকতে দেখেছি পর্দার নানা ধরণ। তা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই ছিল। হিন্দু রমণীরা কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর দিত। তবে আকণ্ঠ ঘোমটা ছাড়া কাউকে বের হতে বিশেষ দেখিনি। অনেক নিম্নবিত্ত মুসলমান মেয়েরা বাইরে এসে মাঠে-ঘাটে কাজ করত। তাদের মধ্যে এত পর্দার বালাই ছিল না। অনেক মানুষের অভাব-অভিযোগ নিজের চোখে দেখা। এখনো আমি নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে আনন্দ পাই। বড়লোকের বাড়িতে, সত্যি কথা, আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। আমি নিজের মধ্য থেকে সেই অস্বস্তিকে কখনোই বাদ দিতে পারিনি। আজো পারি না। তোমরা হয়তো ভাবতে পারো লোকটা খুব পুরনো ধাঁচের। খুবই পুরনো কথা বলছে। এক্কেবারে ধ্যাধ্ধেরে হয়ে গেছে। কিন্তু যা সত্য আমি তা-ই বলছি। আমার সাহিত্যও একবিন্দু বাড়িয়ে বলা নয়।
‘সাবিত্রী উপাখ্যান’-এ যে মেয়েটির কথা বলেছি সে আমার জন্মের কিছুকাল আগের কথা। দুর্বৃত্তরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটমাস ধরে যৌন নির্যাতন চালায়। নানা ধরনের পুরুষ মানুষ এই দীর্ঘ সময় ধরে তাকে ধর্ষণ করে। আমার বইটির উৎসর্গ পত্রে আমি বলেছি, “সাবিত্রী আমাদেরকে ক্ষমা করো।” এই ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা আশাকরি সবাই বুঝে নিয়েছে। আমি মনে করি, একজন লেখকের লেখা আত্মজৈবনিক। ধরা যাক, আমার আগুন পাখি উপন্যাসটি একরকম আত্মজৈবনিক। আমার ছোটবেলায় দেখা মোষ, মোষের গাড়ি, মোষের শির, কাদায় আটকে যাওয়া মোষ-- এসব কিছু এ-উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। সে-সময় মানুষের যাতায়াতের অবলম্বন বেশি কিছু ছিল না। বর্ষাকালে রাস্তাঘাট প্যাচপ্যাচে কাদায় ভরে থাকত। সেই কাদা মাড়িয়ে, গায়ে একরকম মাখামাখি করে মানুষজন পথ চলত। এমনি তো ছিল গ্রামের অবস্থা। ছোটবেলার ঘটনা যতটুকু মনে আছে স্মৃতি ঘেটে-ঘেটে বের করেছি। তার মধ্যে কিঞ্চিৎ কল্পনা আছে। তবে নিছক বানানো কোনো ব্যাপার একেবারেই উপস্থাপন করিনি। আমি তো আগেই বলেছি-- অভিজ্ঞার বাইরে আমি পথ হাঁটিনি।
আমার বক্তব্যে কোনো ভুল হলে, মুখ ফসকে কোনো অকথা বেরিয়ে গিয়ে থাকলে, বয়সের কারণেই হোক আর যাই হোক, তোমরা ক্ষমা করবে। এখানে অনেক অধ্যাপকও উপস্থিত। আমার সামনে ছাত্র যারা আছে তাদেরকে আমি আলাদা করছি না। আমি মনে করি এরা আমার ছ্ত্রা, ছাত্রই তো। শিক্ষকতা তো আর চাকরি নয়। অন্যেরা চাকরি করে। শিক্ষকরা তা করে না।”
এই ছিল কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের মুখ নিঃসৃত অমিয় বাণীবন্ধ। যে-জীবন তিনি যাপন করেছেন অভিজ্ঞতার জটিল সংশ্লেষণে তাকেই শিল্পের রসে রূপান্তরিত করেছেন। বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে, বহুবছরের সাহিত্য-সাধনায়, দার্শনিক প্রজ্ঞায়, জীবনযাপনে, বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার সার সঞ্চয় তাঁর মনন-মগজ। তিনি তো এখন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। যে জ্ঞান-প্রদীপের উজ্জ্বল বিভায় আলোকিত করছেন নানা বয়স ও বৈচিত্র্যময় চেতনাসম্পন্ন মানুষের হৃদয়। তাঁর কথামালা শিল্পেরই আরেক পাদপীঠ। অজানা অনির্বচনীয় যা শিল্পীর দৃষ্টি ও মুখচ্ছবিতে ভেসে ওঠে তা যেন শিল্পেরই অন্য এক পরিপূরক শক্তি। তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন অনেক অনেক দিন; কালান্তরিত হয়ে থাকুক তাঁর অনবদ্য শৈল্পিক-বচন।
অনুলেখন : খোরশেদ আলম
লেখক, শিক্ষক
বাংলা বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মুঠোফোন : ০১৭১৬৪৯৮২২৮
Khorshed.ju.bngl@gmail.com