খোরশেদ আলম
১৯৩৩ সালের ২৫ মার্চ কথাশিল্পী শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছিলেন। জীবন ঘষে বারুদ করা লেখক তিনি। জীবন কী? এর প্রকৃতিই বা কী? কীভাবে জীবনকে জীবন দিয়ে বোঝাপড়া করতে হয় এসব বুঝতে হলে শ্যামলের জীবনযাপন ও উপন্যাসে কথিত জীবনবোধকে সামনে নিয়ে আসতে হয়।
শ্যামল বলতে জানেন,
মানুষকে ভালো ভাবে দেখতে জানলে কঠিন দুঃখেও হাসি পায়।
জীবন চিরন্তন নয়। তাই এ জীবন নিয়ে তাঁর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। সেই নিরীক্ষার কুশীলব কেবল অন্য মানুষ নয়, শ্যামল নিজেই। তিনি জানতেন জীবনের হাসির ভেতর দুঃখের কণা ছিটানো। আলো পড়লে সে দুঃখ ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তাই বলে দুঃখে পুরোদস্তুর নিমজ্জন নয়। বরং দুঃখের নদী কাটা যায় জীবনের সঙ্গে যুদ্ধমান হয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন জীবন একটা মুক্ত বিদ্যানিকেতন। জীবনকে যাপন করে তবেই জীবনকে জানতে হয়। তাই ফার্স্ট বা লাস্ট হওয়া নিয়ে মাথাব্যথা কোনোদিনই তাঁর ছিলো না। তিনি কোনো বাদ বা ইজমেরও ধার ধারেননি।
ঘা খেয়েও লোকটা গান গায়।
উপন্যাসের চরিত্র সম্পর্কে একথা বলা মানুষটি তিনি তো নিজেই। মানুষটা সারাজীবন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। জীবনকে অসম্ভব পরীক্ষায় ফেলা শ্যামল বলতে জানেন,
আমার খুব ইচ্ছে করে একটা গোলমাল বাঁধাতে। তারপর সেই গোলমালের নাগরদোলায় দু-চার ঘুরপাক খেয়ে কায়দা করে নিজের বাঁধানো গোলমাল কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে। এটাই হলো জীবনের মজা।
জীবনের এইসব মজা লুটতে লুটতেই তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে আসে একজন কুবের, ব্রজ দত্ত, ‘হাওয়াগাড়ি’র দীলিপ, ওয়াগন ব্রেকার বজরা এমনকি মোঘল ‘শাহজাদা দারাশুকো’। আরও কতশত চরিত্র শ্যামল কাহিনির ঝুলিতে। তাঁর কাছে মানুষ তো সেই প্রাণি যে সবসময় কিছু বানিয়ে তোলার নেশায় মশগুল। পরাজয় অবধারিত জেনেও, ভেঙে পড়েও, বারবার উঠে দাঁড়ায়। তিনি যেন জানেন-- জীবন থাকলে মৃত্যু আছে, ধ্বংসও আছে। তবুও জীবন সৌন্দর্যময়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে জীবনের নিবিড় সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছিলাম। তারপর যেন সেই সৌন্দর্যের ভিন্নরূপ জানতে পেরেছিলাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে।
শ্যামল প্রকৃত অর্থেই জীবন সন্ধানী। সৌম্য সুদর্শন এই মানুষটি কী যেন একটা অমায়িক চাদরের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখেন। তাঁর দুর্ভেদ্য চরিত্র সহসা উন্মোচন করার সাধ্য কার? সন্তোষকুমারের ভাষ্যে, “তার সম্পর্কে চট করে যে রায় দিতে যাবে, সে বোকা।” এদিকে শ্যামলের ব্যতিক্রমী আচরণ ও স্বভাব সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সুরসিক। একেকদিন আড্ডায় একেকরকম ভেক নিয়ে উপস্থিত হতেন শ্যামল। তাঁকে দেখে তখন বেশ রহস্যময়ই মনে হতো। সুঠাম স্বাস্থ্য, রীতিমতো সুপুরুষ, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর কোঁচা দোলানো ধুতিতে একটা নিষ্পাপ সরল মুখের প্রতিচ্ছবি নাকি ভেসে আসতো। শ্যামলের বিনীত কণ্ঠস্বরের পেছনে থাকতো অবিরাম সাজানো মিথ্যা। সুনীল বলেছেন,
কিছুটা সত্যির সঙ্গে মিথ্যেগুলি, বা উদ্দাম কল্পনাও বলা যেতে পারে, তা শ্যামল মিলিয় দিত এমনভাবে যে ওকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় ছিল না।
বস্তুত সুনীলের এ কথায় শ্যামলের প্রতি আবেগ মেশানো স্নেহ প্রকাশ পায়। সাহিত্যিক মহলে শ্যামল ছিলেন হৈচৈ করা মানুষ। আর কখন কী করে বসেন, তা নিয়ে সবাই থাকতেন তটস্থ। স্নেক ডেন্স তাঁর প্রিয় ছিল। যে-কোনো ভরা মজলিসে সুযোগ পেলে সেই উদ্দাম স্নেক ড্যান্স দেখিয়ে ছাড়তেন। তিনি ছিলেন মেশামেশিতে ওস্তাদ। ‘লাভ, লাভ এন্ড লাভ কোম্পানি’ কথাটা শ্যামল নিজেই তাঁর বন্ধুমহলে ছড়িয়েছিলেন। আসলে বন্ধুমহলে ভালবাসা বিলানোই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। ফলে শ্যামল জড়িয়ে যেতেন মানুষের অন্তরাত্মার সাথে। তাঁর সাহিত্যও বোধ করি সেই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। এমনকি তিনি যখন প্রবন্ধের মতো শক্ত বিষয় লিখতেন, তখনও তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে সরস আনন্দ আর বুদ্ধির অনন্য দীপ্তি সহজে ফুটে উঠতো।
‘অফুরন্ত শ্যামল’ নামক একটি প্রবন্ধে সুনীল তাঁর ক্রিয়াকলাপ নিয়েই একখানি বই লিখবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। সেটি সফল হয়েছিল কিনা জানা যায় না। তবে তাঁকে নিয়ে টুকরো স্মৃতিগুলো বেশ মজাদার। যেমন, ‘এক একটি ঘটনা একেবারে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পুরোপুরি গালগল্প নয়,
বিনা টিকিটে দোতলা বাসে কলকাতা ভ্রমণ, কিংবা তাতার দস্যু সেজে লাইট হাউস সিনেমায় টিকিট কাটা, আফগানিস্তান রেডিও থেকে পুস্ত ভাষায় খবর পাঠ কিংবা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়ে স্নেক ড্যান্স দেখানো, এসবই শ্যামলের পক্ষে অসম্ভব কিছু না।
তবে শ্যামলের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে অনেককেই কথা বলতে শোনা গেছে। তাঁর স্ত্রী কন্যারাও শ্যামল সম্পর্কে নানা ভাষ্য দান করেছেন। সাক্ষাৎকারে তাঁর ব্যতিক্রমী জীবনের কথা বলেছেন।
‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল শ্যামলের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এটিকে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বিশ্বাস, “বিভূতিভূষণকে ছাড়িয়ে শ্যামল গ্রাম বাংলার অন্য এক রূপ ফুটিয়েছে সম্পূর্ণ নিজের কলমে।” শুধু তাই নয়, ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’ যে কারো প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় অনায়াসেই উঠে যেতে পারে। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ উপন্যাসে মোঘল রাজদরবারের যে কাহিনি উঠে এসেছে তা এক কথায় তুলনারহিত। একজন নিবিষ্ট শিল্পীর অন্তকরণ খুঁজে পাওয়া যায় এই রচনায়। শোনা যায়, এই উপন্যাসটি রচনা করার জন্য তিনি ফারসি শিখেছিলেন, এমনকি সাংস্কৃতিক আবহজাত সত্যকে ধরার জন্য শিখেছিলেন কীভাবে নামায পড়তে হয়। অন্যদিকে ইতিহাসের সুগন্ধ নির্মাণেই তিনি এতে রাখেন উর্দুয়ানি চালের পৃথক সৌরভ। সময়ের ব্যবধান ডিঙিয়ে বায়োমিথোগ্রাফি তৈরি করেন ইতিহাসকে শৈল্পিকভাবে পাঠযোগ্য করার মানসে। প্রকৃত নিরপেক্ষ লেখক শ্যামলের পক্ষেই সম্ভব মহররমের দিন টালিগঞ্জ পাড়ার মুসলমানদের সঙ্গে শোভাযাত্রায় শামিল হতে। মানুষের টানেটাই সেখানে প্রবল। জীবনকে জীবন দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন শ্যামল। অশেষ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “কমিউনিস্ট না হয়েও শ্যামল পেরেছিল নিজেকে ডিক্লাসিফাই করতে।” তাবত ব্রাত্যদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি ধানক্ষেতের আলে বসে দিব্যি তাড়ি খেতে পারতেন। হয়তোবা সেই তাড়ির সঙ্গে জীবনকেও একচুমুকে পান করে নিতেন। এখানে সুমিতা চক্রবর্তীর একটা কথা প্রাসঙ্গিকভাবে না বললেই নয়।
জীবন নামক বহু-কোণ, বহু-পরত, বহু-বর্ণ বিষয়টির মুখোমুখি দাঁড়াবার প্রচেষ্টা যদি কেউ করেন তাহলে ঈষৎ পরস্পর-বিরোধিতা কেবল স্বাভাবিকই নয়, তা-ই যথার্থ, তা-ই প্রকৃত লেখা।
এভাবেই জীবনের বহুপরত উন্মোচিত হয়েছে শ্যামল উপন্যাসে। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসে সামান্য বসতবাড়ি করতে গিয়ে আগাগোড়া বিষয়ে ডুবে যায় কুবের। জীবন জড়িয়ে যায় জীবনের সঙ্গে। ম্যাজিশিয়ান ভ্যাগাবন্ড ব্রজ দত্তের স্ত্রী আভার প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে মেদনমল্ল দ্বীপে চলে যায় সে। শূন্যহস্ত কুবের একসময় জমি বিক্রয়ের নেশায় পড়ে যায়। কিন্তু এসবই তার কাছে ‘ড্রিম মার্চেন্ট’ হবার সাধ, জমি বিক্রি উপলক্ষ মাত্র। একসময় সমূহ সর্বনাশ জেনেও কুবের পিছুপা হয় না। কেননা তার কাছে জীবন মানেই চ্যালেঞ্জ। আর চ্যালেঞ্জে হারিয়ে পথে বসাও জীবনের অংশ। তাঁকে বলতে শুনি,
এই তো জীবন-- সব দিনের শেষ রাতের অন্ধকারে। তবু এই অন্ধকারেই মানুষ হাতড়িয়ে পথ করে নিচ্ছে। কুবের সারাজীবন তাই করেছে, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও।”
‘হাওয়াগাড়ি’ উপন্যাসের দীলিপও এই সর্বনাশী সবর্গ্রাসী জীবনের প্রতীক। জীবনের প্রয়োজনে গ্রাম থেকে শহরবাসী হতে চেয়ে নতুনত্ব আর আবিষ্কারের নেশায় পড়েছে কুবেরের মতো সে-ও। কিন্তু বন্ধু বন্ধুকে শেষ করে দেয়, স্ত্রী স্বামীকে পরিত্যাগ করে, তাকে ফিরে পেতে চেয়ে অবজ্ঞাত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। প্রতিবিপ্লবী পিতার লাশ বিপ্লবী সন্তান ফেলে রেখে চলে যায় পার্টি আদালতের নির্দেশে। দগদগে জীবনের করুণ সব ঘটনায় ঠাসা শ্যামল উপন্যাস। শ্যামল একসময় শহর কলকাতার প্রেমে পড়েছেন। তাকে ধরতে চেয়ে যন্ত্রণাদিগ্ধ হয়েছেন। প্রথম জীবনে জীবিকার ভয়াবহ তাগিদে বেলুড়ের স্টিল মিলের ফার্নেসে চাকুরি করা শ্যামলের পক্ষে শহরকে আবিষ্কার করতে হয়েছে নিজের জীবন দিয়ে। ‘ঈশ্বরীতলার রূপোকথা’, কিংবা ‘চন্দনেশ্বর জংশন’-এ তিনি শহর জীবন দেখে মুগ্ধ।
জীবনবাদী, তবুও শ্যামলকাহিনির গন্তব্য যেন মৃত্যু। তার কুশীলবদের মৃত্যুতে অনন্য সৌন্দযর্ আছে। তা বিষাদ প্রতিমার স্বরূপে আমাদের হৃদয়কে দগ্ধ করে। অথচ ‘গ্রোথ এন্ড এক্সপান্সন’-এ বিশ্বাসী শ্যামল তো দেবি ইশতারের প্রতিচ্ছায়া। যেখানে উর্বরতা থাকে, প্রবল বাঞ্ছা থাকে জীবনের। আরও যা থাকে শ্যামল নির্মিত কাহিনিতে, আধুনিক মানুষের দুঃসহ প্রাণাবেগ। তাই আঘাতেও মলিন হয় না কেউ। সেখানে থাকে ছড়িয়ে যাবার, উপলব্ধি করবার আধুনিক মানুষের ভবিতব্য, গন্তব্যরেখা। হলুদ জ্যোস্নার আলোয় প্লাবিত মাঠে পড়ে থাকে কুবেরের লাশ, দীলিপ পড়ে রয় তারই তৈরি ধানক্ষেতে। জাঁ পল সাত্রর্ বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবনেই সুপ্ত থাকে মৃত্যুর বীজ।’ জীবনের এই অমোঘতাকে অতিক্রম করেন না শ্যামল।
শ্যামলকাহিনিতে তত্ত্বতালাশের বারোয়ারি আয়োজন নেই, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি যেন একেকটি খণ্ডচিত্রের নির্মাণ করেন তাঁর নিজের গড়া ভাষায়। সে ভাষা আটপৌরে, বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের টানে নির্মিত নয়। অনায়াসেই সেখানে প্রবেশ করে মানুষের মুখের ভাষা, জনজীবনে ব্যবহৃত চলমান শব্দগুচ্ছ। তাঁর ঘটনা উপস্থাপন বেশ সাজানো গোছানো, ক্রমাগ্রসর গল্প ঘটমান বাস্তবতার ব্যবচ্ছেদ। ভাষার জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি সহসা করেন না। বরং বিশ্লেষণী ভাষামাহিমার আদলেই গড়ে ওঠে আখ্যান। সেই আখ্যান যেন নিজের জীবন ছুঁয়ে ছেনে আবিষ্কার করা।
নাটকীয়তা আর আকস্মিকতায় ভরপুর তাঁর আখ্যান। তবু দুর্বল কাহিনি সংঘটনের দায়ও যেন চাপানো যায় না। আসলে একটা ঘনঘোর বাস্তবতায় ব্যক্তিমানুষের আঘাত-অন্তরায়গুলো ক্রমপরিসর ভূমি রচনা করে সেখানে। স্বপ্ন, স্মৃতিকাতর মানুষি অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার হয়ে কাহিনি মানুষের আকাঙ্ক্ষার অতলান্ত জগতকে স্পর্শ করে। লেখকের শ্রম ও স্বীয়-আত্মীকৃত অভিজ্ঞতা প্রবল প্রধান হয়ে ওঠে। যৌবনের চব্বিশ পরগণা তথা চম্পাহাটি তাঁর স্মৃতিভাষ্যে প্রত্নলীন। বাসগৃহ, কৃষিকাজ, সংসার কী নেই সেখানে। শ্যামল লেখাকে বলতে চেয়েছেন ‘দৈবীপাগলামী’। শ্যামল দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জীবনে জীবন প্রবেশের সূত্র আবিষ্কার। এই জীবন যে-সবের অনুষঙ্গপ্রাপ্তিতে গজিয়ে ওঠে, সেসবের তিনি জ্বলন্ত উৎসমুখ সন্ধানী। সে জন্যই তিনি বলতে পারেন,
যেভাবেই হোক একটি হৃদয় আরেকটি হৃদয়কে ছুঁয়ে গেলেই--সব বাঁধন খুলে যায়। বাঁধন খোলাই শিল্পীর দায়।
বাদল সরকার
বিস্তৃত বহু পথ-পরিক্রমায় বাংলা নাটক আজ গৌরবে দেদীপ্যমান। ঐতিহ্যবাহী আখ্যানধর্মিতা থেকে আধুনিক সময়ের বিপুল এক সম্ভার আমাদের নাটক। বাংলা নাটক বিস্তৃত পথ বেয়ে নানা সময়ে ভিন্নতাপ্রাপ্ত, উপাদানে সমৃদ্ধ। এক হিসেবে মধ্যযুগের কথকতানির্ভর বাংলা নাট্যই আমাদের সত্যিকারের সম্পদ। এরপর প্রসেনিয়াম থিয়েটার, সেখান থেকে আবার ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তন। এ-অঞ্চলের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রামী চেতনা দ্বারাও পরিস্রুত ও ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছে নাটক। এই সংগ্রামশীল অস্তিত্বকেই উপজীব্য করেছেন বাদল সরকার (১৯২৫-২০১১)কিংবা সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮। তাঁরাই আমাদের মৃত্তিকা-সন্ধানী নাট্যকার।
আধুনিক যুগের প্রারম্ভে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ নাটক রচনা শুরু করেন। আবার শিল্পের অন্যান্য শাখার মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটকেও ছিলেন সব্যসাচী। তাঁর হাত দিয়ে আমাদের নাটক বহু পথ পরিভ্রমণ করে। বস্তুত শিল্পের সমৃদ্ধ সৌধে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি নাটককে। বহুশিল্পীর হাত ধরে বাংলা নাটক শিল্পের শিখরবিন্দু স্পর্শ করে। নাটকের এই সমৃদ্ধি একদিনে হয়নি। এপার বাংলা কিংবা ওপার বাংলা উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও শিল্পমননের আধুনিকতা নাটক-ললাটে আজ উচ্চতার জয়তিলক এঁকে দিয়েছে। শিল্পের প্রতি এই উচ্চমন্যতার জন্যই এদেশে আবির্ভাব ঘটে মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সাঈদ আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীন, আবদুল্লাহ আল মামুন কিংবা মামুনুর রশীদের মতো বর্ষীয়ান নাট্যকারদের। সমাজ-সচেতন চৈতন্য এবং শিল্পাঙ্গিকে নতুনত্ব তাঁদের নাটককে বিশ্বের যেকোনো দেশের বিখ্যাত নাট্যকারদের সমপক্তিতে দাঁড় করায়।
পশ্চিমবঙ্গে বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার, উৎপল দত্ত, শাওলী মিত্র, তৃপ্তি মিত্র প্রমুখ বিদগ্ধজনের হাত দিয়ে বাংলা নাটকের অগ্রসরমানতা শুধু শিল্পকৌশলে নয়, এক কঠোর দায়বদ্ধতায় গভীরভাবে বেঁধে রাখে। বাদল সরকার থিয়েটারকে পরিপূর্ণভাবেই একটি আন্দোলন তথা মানব-মুক্তির সনদ হিসেবে দেখতে থাকেন। তাঁর নাটক কেবল শিল্প-সমৃদ্ধির প্রসঙ্গে নয়, জাতির ডুবুডুবু নৌকায়ও তা পাল খাটায় বিপদ-সঙ্কুল উজান বাতাসে। বৃহত্তর জাহাজের হালের মতো সুস্পষ্ট লক্ষ্যের দিকে মানবসত্তাকে তা ধাবমান করে। হলাহলযুক্ত সমাজ থেকে নিষ্ক্রান্ত করে স্বাপ্নিক সুন্দর এক সমাজের দিকে নিয়ে যায় তা। যেন প্রলয় শিঙ্গার সজোর ফুৎকারে প্রকম্পিত হয় প্রথাচলিত সমাজের ভিত্তি। মানবচৈতন্যে আধুনিকতার মর্মদাহী পীড়া যা নাকি ব্যক্তিগত বেদনায় নিমজ্জমান, তাকে টেনে তোলে অপূর্ব এক রণবাদ্য। চৈতন্যের যৌথ আবেগ, যৌথ জীবনযাপনের মহত্ত্বে ব্যক্তিবোধ মুহূর্তে ধূলায় লুটায়। ফলে এক সামষ্টিক জীবন-সংগ্রামের অংশী করে তোলে তাঁর নাটক। ‘বাকী ইতিহাস’, ‘হট্টমালার ওপারে’, ‘পরে কোনদিন’, ‘প্রলাপ’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ ইত্যাদি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধারার কয়েকটি নাটক। প্রথমে প্রসেনিয়াম তারপর থার্ড থিয়েটারের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের অন্তর্চেতনা সঞ্চারিত। বঞ্চিতজনকে সম্মানের আসনে আসীন করা এর অন্যতম প্রধান দায়। ক্লেদাক্ত সমাজ, মরণোন্মুখ বিশ্ব অতিক্রম করে তা তৈরি করে এক জটিল স্বপ্নাবেশ।
ঔপনিবেশিক কাল আমাদের শিল্প-সাহিত্যের জগতে ব্যাপক ভাঙচুর ঘটায়। ইউরোপ-বাহিত নাট্য-আঙ্গিককে আমরা ভাবতে শুরু করি সর্বেসর্বা রূপে। যে-কারণে লেবেদেফকে আমরা আধুনিক নাটকের গুরু মেনে নিয়ে যাত্রা শুরু করি। ঔপনিবেশিক আগ্রাসনে আমাদের দেশের চিন্তাবিদ এমনকি সাহিত্যবোদ্ধারাও অজান্তে সংক্রামিত হয়েছেন। এটা সকলেরই জানা —কলকাতার বেলগাছিয়া নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকূল সর্বস্ব’ দেখতে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ক্ষিপ্ত হয়ে জুতা ছুঁড়ে মেরেছিলেন। নাটক দেখে তিনি মন্তব্য করেন:
অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।
বস্তুত সে-নাটকটি ছিল সমাজ-অসঙ্গতির প্রতি অঙ্গুলি-নির্দেশ। তবুও ঔপনিবেশিক রুচি থেকে আমরা নিজেদেরকে বাঁচাতে পারি না। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের ধারা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম ইউরোপেরই সংস্পর্শে। আধুনিক যুগ আসার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্বতা থেকে বিচ্যুত হয়েছিলাম আমরা। নাট্যকার সেলিম আলদীন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন যে, আমাদের সম্ভাবনা নিজেদের মাটিতেই অঙ্কুরিত হবে। তাঁর এ বাণী সত্য হয়ে উঠছে একালে। আমরা ক্রমশ বুঝতে শুরু করি—মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য বা পাঁচালি ইত্যাদির মধ্যে সেই অপার সম্ভাবনাটি লুকিয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাল ও সৃষ্টি সম্পর্কে কতটা সচেতন ছিলেন। আসলে শিল্প-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অন্বেষণ করে একটি বন্ধন রচনা করেছেন। শিল্পচেতনায় তিনি আধুনিক, সর্ব অর্থেই আধুনিক। বিশেষজ্ঞদের মতে—‘ঋতুচেতনা, প্রথা ও সঙ্গীত ব্যবহার করে একটি সম্ভাবনাকে আরেকটি আধুনিক বিন্যাসে রূপ দিয়েছেন তিনি।’ তাই জীবনের মাটি স্পর্শ করেছে তা। পাঠকের মনেও তা স্থান করে নিয়েছে।
বাংলা নাটকের উত্তরসাধক আচার্য সেলিম আল দীন ও বাদল সরকারের শিল্পদর্শন আলাদা। তবে রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত পথটিকেই যেন তা আঙ্গিক ও চিন্তায় অভিনবত্ব দান করেছে। রবীন্দ্রোত্তর কালের প্রতিভাবান ও উল্লেখযোগ্য নাট্যকার সেলিম আল দীন। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্প আঙ্গিকের প্রবক্তা তিনি। উপনিবেশীয় নাট্যরীতিকে পাশ কাটিয়ে দেশীয় এক শিল্পরূপের তিনি আবিষ্কর্তা। তবে তিনি বিশেষ কোনো নাট্য-আঙ্গিককে সর্বদা অনুসরণ করেননি। এজন্য তাঁর নাটকে অভিনবত্বের ঝলকানি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। নাট্যে দেশজ, শেকড়-সন্ধানী এবং নিরঙ্কুশ শৈল্পিক সিদ্ধির অন্যতম উদাহরণ তিনি। ঐতিহ্যের অনুসরণকে সর্বতোভাবে তিনি অনিবার্য মনে করেছেন। মহাকাব্যিক দ্যোতনার সঙ্গে মধ্যযুগের ঐতিহ্যবাহী কাহিনি-কাঠামো সুকৌশলে প্রবেশ করে তাঁর নাটকে। এ-দেশের গ্রামীণ মানুষ, তাঁদের জীবন-যাপন, সংগ্রাম, প্রেম, পরাজয়, বিদ্রোহ, নারীর সৌকর্য, আদিবাসী জীবন সমস্ত কিছুই নাট্যকার ধারণ করেন। সঙ্গত কারণেই উপনিবেশ-উত্তর বাংলা-নাট্যে আত্মশ্লাঘার অবস্থান তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছেন। কারণ ইউরোপীয়-দেশীয় শিল্পরীতির মিশ্রণে তিনি ঘটাতে পেরেছেন ঐক্য, যেটি ‘একাঙ্গীকরণ’ বা ‘ফিউশন’ তত্ত্ব নামে খ্যাত। শুধু ইউরোপ নয়, বরং সমস্ত বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যকে বোঝাপড়া করার ক্ষমতা নিয়েই যেন তিনি নাট্য-নির্মাণে আবির্ভূত হয়েছিলেন। নাট্য-কৌশল নির্মাণে কেবল নয়, মানুষের সঙ্গে শিল্পকে এক-সূত্রে গ্রন্থনের ক্ষমতা ছিল তাঁর। সামাজিক দায়বোধের শিল্পী হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে এ-চেতনা। ফলে শিল্প ও জীবন তাঁর নাট্য-রচনায় একাঙ্গ হয়ে যায় প্রকরণে ও বিষয়ে। তিনি পাঁচালি রীতির অনুসরণে অভিনব বর্ণনাত্মক নাট্যধারায় কথানাট্যের রীতি উদ্ভাবন করেন। বস্তুত আমাদের স্বীয় সত্তার অন্বেষণের সীমায় উপাখ্যান এবং সহস্র বছরের ধারায় নাট্যবর্তী উপাখ্যানের নানা রূপান্তর বাংলা সাহিত্যে তাঁর মাধ্যমেই ঘটেছে।
বাদল সরকার ও সেলিম আল দীনের মধ্যে একধরনের সাযুজ্য আছে। তাঁরা উভয়েই দেশজ রূপের সাধক ও মানুষের শেকড়-সন্ধানী। ঐতিহ্যের অনুসরণ বাদল সরকারের নাটকে অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে নাট্যমঞ্চায়ন অথবা নির্দেশনার ক্ষেত্রে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী যাত্রারীতি অথবা পাঁচালি নাট্যের অনুসরণে তাঁর নাটক তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ যাকে মঞ্চের বাস্তবতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘আড়ম্বড়তার বাড়াবাড়ি’, মঞ্চে সেই আড়ম্বড়তার বাড়াবাড়িকে কৌশলে তিনি পাশ কাটাতে পেরেছেন। সেলিম আল দীনের নাটকেও বর্ণনাত্মক রীতির সঙ্গে নাটকের প্রাচীন ঐতিহ্যকে স্বীকার শুধু নয়, খাঁটি জনমানসের শিল্প তৈরির বাসনাও রয়েছে। সেটাকেও দেখতে চাই রবীন্দ্রনাথের সেই ‘কলাপাতায় ভোজ’ সম্পন্ন করার অনাড়ম্বর মঞ্চরীতি হিসেবে। ফলে নাটক শুধু কলাকৈবল্যবাদী শিল্পের চৌকাঠে মাথা নত করবে না, নাটক হয়ে উঠবে প্রকৃতই জনতার একান্ত নিকটবর্তী। সেলিম আল দীনের এই অভিপ্রায়ের মধ্যে এক উচ্চ নৈতিকতার পরিচয় মেলে। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে তৈরি হয় গ্রামথিয়েটার। ফলে শিল্পের সঙ্গে সংযোগ ঘটে স্বদেশ-আত্মার। আজ গ্রামেগঞ্জে নাটকের যে আন্দোলন তার স্পন্দনে লুকিয়ে আছে সেলিম আল দীনের অন্তর্সত্তা।
বাংলাদেশের মূল শেকড়টি আচার্য সেলিম আল দীন প্রোথিত করেছেন তাঁর শিল্প-মাধ্যমে। এই মূল শেকড়টি কেবল শিল্পের নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনে নয়; শিল্প যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে অর্থাৎ শিল্পে অন্বিষ্ট যে-মানুষ তাকে চেনাতে সাহায্য করে। পাশ্চাত্য শিল্পতত্ত্ব ও সংস্কৃতি-আক্রান্ত এই তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের ইতিহাসকে তিনি পাল্টে দেন, নিজস্বতা ও প্রাতিস্বিকতার চিহ্নায়ন ঘটান। উপনিবেশ-আক্রান্ত একটি জনগোষ্ঠীর জন্য স্বীয় দর্শনের ছত্রছায়ায় তা বীজ থেকে আজ মহীরুহে পরিণত। এই দুরূহ কর্মটিকে স্বঅঞ্চলীয় চেতনালোকে পুষ্ট করে সেলিম আল দীন নাট্যরূপ নির্মাণ করেন। পক্ষান্তরে যে-নাটক নামক শিল্পকে তিনি দাঁড় করান তা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী দর্শনের দ্বারা পরিশ্রুত হয়। তাতে এক ঐতিহাসিক অভিগমন ঘটে। উপনিবেশোত্তর একটি কাল-পরম্পরায়ও সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারে শিল্পে। কিন্তু প্রায় বিস্মৃত মধ্যযুগের শিল্পসম্পদকে বাহন করে তিনিই সন্ধান দেন অমৃতলোকের। অন্যদিকে আধুনিক ও অধুনান্তিক সমস্ত তত্ত্ব ও দর্শনকে ফেরারি না করেও তাঁর নাটকে সংস্থাপিত হয় আত্তীকরণ। স্থানিক পটভূমি ধারণ করেও একটি শিল্প কীভাবে উত্তীর্ণ হয় বিশ্বলোকে—পৃথিবীর মহৎ লেখকরা এ-ব্যাপারে নানা নিদর্শন রেখে গেছেন। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনও তাঁদের সহযাত্রী। তিনি লোকজ মানুষকে ঘিরে নাট্যদৃশ্য ও অঙ্কের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে মহাকাব্যিক সর্গবিভাজনের দ্বারস্থ হন। নিছক লোকবয়ানের নিমিত্তে তা সমর্পিত নয় বরং ঐতিহ্যে সাঙ্গীকৃত করে তা বহু-যুগের ইতিহাস পরম্পরারও সাক্ষ্য বহন করে। ফলে এটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের গ্রামসমাজের অন্তঃস্থল অন্বেষণের প্রক্রিয়াও। চরিত্রসমূহ যথাবিহিত আধুনিক নাটকের অঙ্গসংস্থিত হয়েও পুরাকীর্তিত। গ্রামীণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও আচরণের অমার্জিত অসংস্কৃত ভাবটাও যথাসম্ভব প্রাকৃত স্তরে অভিকর্ষিত হয় শৈল্পিক কারুকৃতিতেই। ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘হাত-হদাই’, ‘চাকা’, ‘হরগজ’ কিংবা ‘যৈবতীকন্যার মন’, ‘বনপাংশুল’ – গোটা শিল্পজগৎকেই তিনি দেশজ প্রকৃতি, সামগ্রিকতা ও রহস্যময় মানবীয় জীবনাস্বাদের আকর করে তোলেন। এ প্রসঙ্গে অরুণ সেন বলেছেন :
কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত-হদাই-তে যে শিকড় সন্ধান ও মহাকাব্যিক বিস্তার, তা পেরিয়ে তিনি চলে যান চাকা, যৈবতীকন্যার মন বা হরগজ নাটকের বর্ণনাত্মক রীতির নতুন পরীক্ষায়, কিংবা সাম্প্রতিককালে বনপাংশুল বা প্রাচ্য-র পুরাণ ও প্রতীকে। কিন্তু সবসময় লক্ষ্য তাঁর স্বদেশের উন্মোচন। নাটকের প্রান্তসীমা ছাড়িয়ে শিল্পের সমগ্রতায় পৌঁছানো। প্রত্নপ্রতিমার সঙ্গে আধুনিক এপিক দৃষ্টির সংযোগ ঘটিয়ে চলা।
সেলিম আল দীনের রচনায় প্রান্তজনরা স্বতঃস্ফূর্ত, যা তাদের জীবনযাপন বৈশিষ্ট্যেরও উপাত্ত। সুলিখিত-সুপঠিত সাহিত্য-মাধ্যমে সেসব মানুষ অর্বাচীন বলেই খ্যাত হবেন হয়তবা। কিন্তু সেলিম আল দীন তাদেরই স্বীকৃতি আদায় করেন আধুনিক মনন-সমৃদ্ধ মানুষের মনে। শিল্পীর সামাজিক দায় উপেক্ষা করেন না তিনি। কিংবা উপেক্ষা করেন না সমকালের দ্রুত পরিবর্তশীল সামাজিক-রাজনৈতিক শৃঙ্খলায় মনুষ্যত্বের বিসর্জন প্রক্রিয়াকেও। পাশ্চাত্যের মতো আলাদা করেন না—শিল্পের উপস্থাপক, শিল্পনির্মাতার মনস্তত্ত্বকেও। ফলে সর্বাঙ্গীণ মাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করে আত্মবন্ধনের মধ্য দিয়ে বাঙালির বহুচর্চিত যৌথ সমাজ-প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক কালকে তিনি গ্রাহ্য করেন। নিষ্পেষিত ও সভ্যতা-দূরবর্তী মানবজীবনকে বিশ্ব-ভূগোলের নৈকট্যে স্থাপন করেন। আফসার আহমদ সেজন্যই বলেছেন :
সেলিম আল দীন এমনি একজন নাট্যকার যিনি সব সময়েই নাটককে মনে করেছেন কমিটমেন্টের শিল্প। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন নাটক হচ্ছে মানুষের জন্য। আর এই মানুষ শুধু নাট্যকারের ভূগোলে বসবাসরত মানুষ নয়, তারা বিশ্বভূগোলের সকল কালের মানুষ। তাই দেশীয় প্রেক্ষাপট থেকে তিনি আন্তর্দেশীয় এবং বিশ্বমানবতার রূপক হয়ে ওঠেন।
লৌকিক জীবনের গল্পই তাঁর রচনায় বিশ্বভূগোল অতিক্রম করে। তাদের বহমান জীবনের নিদারুণ বাস্তবতাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। ‘কিত্তনখোলা’য় দেখি—‘জীনের রাজায় ছুঁইয়া দিল, আনাম মানুষ পাথর হইল।… ‘অলৌকিক বিশ্বাসের প্রতিকল্পে আরো শোনা যায়—“তুই যে ‘কইলি চাইলের ব্যবসা ছাইড়া গাছী হইলেন’ কতাডা শুইনা আমার ছোডবেলার ছগী বুড়ীর কিস্সাটা মনে হইল। জ্বীনের রাজায় মানষেরে পাথর বানাইত—পাথর থিক্যা গাছ—গাছ থিক্যা ফল—ফল থিক্যা পংখী… আমারই হেই দশা হইছে।”
এটা একধরনের মেটামরফোসিস বা রূপান্তর। এই মেটামরফোসিস গ্রামজীবনের মানুষেও যে ঘটে, সেলিম আল দীন সেই রূপান্তর প্রক্রিয়াকে আবিষ্কার করেন প্রাকৃত জীবনের মূলে প্রবেশ করে। কাফকার ‘মেটামরফসিসে’র দোহাই তাঁকে পাড়তে হয় না। সেলিম আল দীন বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের শৈশব-স্বপ্ন ও পরবর্তী জীবন বাস্তবতার মধ্যেই রূপান্তর প্রক্রিয়াটিকে দেখান। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সে-রূপান্তর প্রক্রিয়ার অংশীদার।
অন্যদিকে বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের ‘প্রসেনিয়াম থিয়েটারে’র সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বাদল সরকার প্রবর্তন করেন ‘থার্ড থিয়েটার’। এই ‘থার্ড থিয়েটার’ মঞ্চের জন্য অভিনব নাট্যকৌশল নির্মাণ করে। দর্শকের মধ্যে থেকে তাদেরই জীবনের কথা বলে এই কৌশল। ফলে ‘প্রসেনিয়াম থিয়েটারে’ শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের যে দূরত্ব, তা অনায়াসেই ঘুঁচে যায় এই থিয়েটারে। শুধু সংলাপ বা বাচনভঙ্গি নয়, সঙ্গে শারীরিক অভিনয়ও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই বিশেষ ধরনের অভিনয় রীতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে দর্শকের সঙ্গে শিল্পীর একটা অন্তরঙ্গতা বা একাত্মতা। থার্ড বা তৃতীয় থিয়েটারের সবচেয়ে বড় কথা হল বক্তব্য। বক্তব্যকে দর্শকের কাছে স্পষ্ট ও তীব্র করে তোলাই এই থিয়েটারের প্রধান উদ্দেশ্য।
অভিনেতার মেকআপ-গেটআপ, মঞ্চসজ্জা ও আলোর আধিক্য প্রভৃতিকে খুব একটা আমলে নেয় না এই ‘থার্ড থিয়েটার’। কারণ এর প্রধানতম উদ্দেশ্য হল এক ধরনের যোগাযোগ তৈরি করা। অভিনেতা সেখানে শুধু পারফর্মার নয়; অন্যদিকে দর্শকও কেবলমাত্র নাট্য-উপভোগকারী কেউ নয়। দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে নাটকের এক পর্যায়ে আলাদা কোনো পর্দা থাকে না। এমনকি অভিনয় হতে হতে দর্শকও অভিনেতার সঙ্গে হাতে হাত ধরে মঞ্চের দিকে উঠে এসে পারফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বুর্জোয়া আর্টের সীমানা পেরিয়ে তা চলে যায় বৈপ্লবিক এক পরিবর্তনের দিকে। শিল্পে সর্ব সাধারণের যুক্ততা ‘ফার্স্ট থিয়েটার’ কিংবা ‘সেকেন্ড থিয়েটারে’ ততটা নেই, যতটা আছে এই থার্ড থিয়েটারে। কার্যত সাধারণ মানুষের শিল্প হয়ে ওঠে তা। ফার্স্ট বা সেকেন্ড থিয়েটারে দর্শক কেবল নাটকে অভিনয়-কৌশল দেখে বাহবা দিতে পারে, তার সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারে না। অভিনয়শিল্প ও দর্শকের সঙ্গে দূরত্বটাও তাই বাস্তবে ঘোচে না। টিকেট বিক্রি বা পুঁজিপতিদের অর্থগ্রহণ থেকে প্রথম দু ধারার থিয়েটার নিজেদেরকে রক্ষা করতে কালেভদ্রেই পারঙ্গম হয়। কিন্তু বাদল সরকারের মতে থিয়েটার প্রকৃতই হওয়া উচিত ‘ফ্রি থিয়েটার’। তাঁর অভিমত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোনো কৌশলে বুর্জোয়া নামগন্ধ শিল্পের শরীর থেকে মুছে ফেলাই হবে এ-থিয়েটারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পথে-ঘাটে-খোলামাঠে যেকোনো স্থানে এই ‘থার্ড থিয়েটার’ প্রদর্শিত হতে পারে। দর্শক-জনতার চৈতন্যকে জাগাতে পারার ক্ষমতাই তার মূল লক্ষ্য। দর্শক যদি নাটক দেখে নিজেকে ও তার পারিপার্শ্বিক সমাজকে বদলাতে না-ই পারে তাহলে তা কস্মিনকালেও ‘থার্ড থিয়েটারে’র যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। ফলে এটি কেবল নাট্যকৌশল নয়, একটি গভীর আন্দোলনও। নাটকে অংশগ্রহণকারী দর্শকের স্বত:স্ফূর্ত দানই শুধু এখানে গ্রহণ করা যায়, নাটক-প্রদর্শনে অর্থ-আদায় সিদ্ধ নয়। কারো কাছে জোর করা বা অনাকাঙ্ক্ষিত হাত পাতার নিয়মও এখানে নেই। এমনকি অভিনেতারাও এ-থিয়েটারে বেতনভোগী নাট্য-কুশীলব নয়। এটি একটি সর্বৈব আন্দোলন, যার আলোড়ন তুলতে হয় শিল্প ও জীবনধারার সর্বত্রই। পেশাদারি অভিনয়ের জৌলুশ ও অর্থ-বিনিময় ছেড়ে অভিনেতাকেও তাই একটি পরিবর্তনের জোয়ারে নিজেকে আন্দোলনে সামিল করতে হয়।
এই ‘থার্ড থিয়েটার’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকের এক বিস্তৃত পথভ্রমণে বাদল সরকার সমস্ত অতীতকে মুছে দেন। সে-মুছে দেয়া অতীত অবশ্য সমাজগর্ভে নিহিত প্রথা, সংস্কার, রাজনৈতিক হতাশা নামক কতকগুলো নেতিবাচক বিষয়। তিনি অবশ্য মুছে দেন না সেই অতীত, যা ঐতিহ্যশীল। সংস্কার মুছে ফেললেও ঐতিহাসিকতার মর্মে যে সভ্য-সারাংশ থাকে তাকে সঙ্গী করেন তিনি। শিল্প-আঙ্গিকে তিনি অভিনবত্ব আনেন এক বিশেষ কৌশলের আশ্রয়ে। আসলে শিল্প তো ভূঁইফোর কিছু নয়। গলিত লাভা তাপের তীব্রতা হারিয়ে, দিনের পর দিন পাথর ভেঙে উর্বর মাটি তৈরি করে। এ-মাটি নির্মাণের প্রক্রিয়াটি একদিনে তৈরি হয় না, হয় কালে কালে। সে-মাটির ওপর দাঁড়ায় জনমানুষ। জনমানুষের প্রতিজ্ঞা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ভাষা জন্মায় স্বীয় মাতৃভূমিতেই। সেখানে মাটি আর মনের নন্দীভৃঙ্গীর হিন্দোল আলাদা। কারণ মাটি তার উর্বরতা হারিয়ে ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুনরায় যেন তা জগদ্দল পাথর হয়ে ওঠে মানুষের মনে। পক্ষান্তরে উর্বর ভূমিজ মানুষগুলোর অন্তর তাপিত হয়ে ওঠে বঞ্চনা-গঞ্জনার পরাকাষ্ঠে।
নাটকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জন্ম হয়েছিল থার্ড থিয়েটারের৷ বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের কিংবদন্তী নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকার প্রথম জীবনে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সাড়া জাগানো নাট্যকার হিসেবেই খ্যাতির চূড়া স্পর্শ করেন। কিন্তু ষাটের দশকের কৌতুক নাটক ও অ্যাবসার্ড নাটক রচনার পর্ব পেরিয়ে নতুন এক পর্বের সূচনা হয় সত্তর দশকে। প্রসেনিয়াম মঞ্চে বাদল সরকার নাট্যকার হিসেবে সাফল্য পান ‘সারারাত্তির’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘প্রলাপ’, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’, ‘পাগলা ঘোড়া’র মতো নাটকগুলির মধ্য দিয়ে সাত-আট বছরের মধ্যেই। তারপর তিনি প্রসেনিয়াম থিয়েটার ছেড়ে সরে আসেন। মানুষের সঙ্গে নাটকের আরো বেশি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষার মিশন তিনি হাতে নেন। শুরু হয় থার্ড থিয়েটার বা অঙ্গনমঞ্চ নাটকের পথচলা। সত্তর দশকের উত্তাল সময় থেকে শুরু থেকে ‘থার্ড থিয়েটার’ নামক ভিন্ন এক নাট্য আঙ্গিক ও দর্শনের উদগাতা, নাট্যকার, সংগঠক, পরিচালকের ভূমিকায় পরবর্তী চার দশক ধরে নাট্যজগতে তিনি ছিলেন অমিতবিক্রম। নিজের নাট্যদল ‘শতাব্দী’ গঠনের পর তিনি একেবারে কলকাতার কার্জন পার্কে খোলা আকাশের নিচে নাটক করা শুরু করেন৷ থার্ড থিয়েটারের জন্যই লেখা হয়েছে সত্তর দশক ও তারও পরবর্তীকালে বাদল সরকারের বিখ্যাত নাটক ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘স্পার্টাকাস’, ‘মিছিল’, ‘ভোমা’, ‘সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস’, ‘হট্টমালার ওপারে’, ‘গণ্ডী’, ‘একটি হত্যার নাট্যকথা’, ‘নদীতে-এরা কোথাও’ ইত্যাদি।
ঐতিহাসিক বিবেচনায় প্রাচীন সমাজ ছিল সাম্যবাদী। সেখানে সবার খাদ্যে সবার অংশগ্রহণ ঘটত। মুদ্রা-ব্যবস্থা না জেনেও তারা বিনিময় করতে পারতো পারস্পরিক প্রয়োজন অনুসারে। ক্রমশ পৃথিবী জটিল হয়—মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সম্পত্তির অযাচিত বিলিবণ্টন পাকাপোক্ত রূপ ধারণ করে। আর তখনই প্রয়োজন হয় আইন-কানুন-বিচারসহ নিরাপত্তার নামে নানা নিয়ন্ত্রণবাদী আবেষ্টন। রাষ্ট্র মানুষের নিরাপত্তার ভার নেয়; পক্ষান্তরে তা ধনিক শ্রেণির স্বার্থকে সংরক্ষণ করতে শুরু করে। কিন্তু সমাজে জোর আসন দখল করে অন্যায়-অবিচার, সামূহিক অনৈতিকতা-অরাজকতা। বস্তুত আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র-বিধিব্যবস্থার সুতীক্ষ্ণ ও সুতীব্র ক্ষয়-ক্ষতিকে চিহ্নিত করে তাঁর নাটক। বাদল সরকার তাঁর নাটকে বিষয়ের গভীরতায় এমন একটি জায়গায় পাঠককে আসীন করেন যে, তারা অনায়াসেই দুঃস্বপ্নের এক পৃথিবী ছেড়ে চমৎকার সমাজ-নির্মাণের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। সমসাময়িক যুগের সকল হলাহল নীলকণ্ঠের মতো পান করেও তিনি পাঠক-দর্শককে করে তোলেন চরম আশাবাদী। নিম্নশ্রেণির তথা নিম্নবিত্তের মানসে তিনি সঞ্চার করেন মহিমান্বিত এক সমাজের গাঢ় কল্পনারেখা। সহস্র বছরের বাঙালির সংগ্রামের ভাষাকে অনলপ্রবাহী করে তোলেন তিনি।
নাটক নিছক শৈলীর ক্যারিকেচার বা আপাদমস্তক লড়াই-সংগ্রাম নয়। তা যেন সংগ্রাম-পরবর্তী মহাজীবনেরও আখ্যান। কণ্টকিত পথ বেয়েই আসবে সেই মহালোক। তার অপেক্ষায় নিয়ত প্রতীক্ষমান মানুষের সংলাপকে শিল্পরূপ দান করেন নাট্যকার। নাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও তাঁরা নিয়ে আসেন বৈচিত্র্য। সেলিম আল দীন ও বাদল সরকার দুজনেই বাংলা নাট্য-শরীরে প্রোথিত করেন দেশীয় উপাদান। ঔপনিবেশিক শাসনের যুপকাষ্ঠে বন্দি সমাজচৈতন্যে চাবুকের তীব্র কষাঘাত করেন তাঁরা। বাঙালির বহমান সংগ্রামশীল ঐতিহ্যের পুনর্নিমাণও এর দ্বারা সংঘটিত হয়। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাদল সরকার ও সেলিম আল দীন হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারায় বাঙালির আধুনিক নাট্যনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সমকালেও তাঁরা আমাদের কাছে তাই অনিবার্য হয়ে ওঠেন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ, বাদল সরকার ও সেলিম আল দীন এই তিন নক্ষত্রের প্রদর্শিত নাট্যপথেই উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক-অধুনান্তিক কালে বাংলার নাট্যচর্চা স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পেরেছে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।