কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হকের সঙ্গে আড্ডা (পর্ব-২)

১ম পর্ব : লিঙ্ক

“যে পথে কেউ যায়নি সেটাই তোমার পথ, কিন্তু কোন পথে কে কে গেছে সেটাও তো জানা চাই।

আড্ডা-পর্ব (২)

“কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা, বা ব্যক্তি ধরে কোনো কিছু লিখতে আমি আগ্রহী নই, বরং তুচ্ছ বিষয় ও ঘটনা নিয়ে বড় কিছু করতে ইচ্ছা করে।”


১১. ধ্রুপদী কিংবা আধুনিক তত্ত্ববিশ্ব

খোরশেদ আলম : সাহিত্যের জন্য আমাদের ধ্রুপদী, আধুনিক আবার আধুনিকের মধ্যে নানাভাগ রোমান্টিক, বাস্তব, পরাবাস্তব ইত্যাদি। আবার পৃথিবী এখন উত্তর-আধুনিকবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদ নিয়ে ভাবিত। এরকম আরো অনেক ফ্যাক্টর চিন্তার জগতকে জর্জর করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন শিল্পীর এতো জেনে কাজ কী? অথবা যদি এটাও বলি একজন শিল্পীর জন্য আত্মজ্ঞানই যথেষ্ট কীনা? কারণ চিন্তা যতই প্রভাবশালী হোক চিন্তাগুলো অন্যের। আর চিন্তার ভাষাও প্রভাবিত করে। এই চিন্তাগুলো অজান্তেই একটা মানস-উপনিবেশ গড়ে তোলে। এ-বিষয়ে আপনার মত কী? আমি কিন্তু আমার ব্যক্তিজটিলতার জায়গা থেকেই কথাগুলো বললাম। অন্যের ক্ষেত্রে উল্টো ব্যাপারও হতে পারে। মনে হতে পারে, তারা আসলে সমৃদ্ধই হচ্ছেন।

হামীম : দারুণ প্রশ্ন, কিন্তু উত্তরটা প্রশ্নের মধ্যেই দেওয়া আছে। কারণ আত্মজ্ঞানের কথাটা এসেই গেছে। দেখুন, ভার্জিনিয়া উলফ একটা কথা বলেছিলেন, তাঁর সূত্রে আমারও মনে হয়, রুশ সাহিত্য ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে পড়ায় সময় দেওয়া স্রেফ সময় নষ্ট মাত্র। এটা দেবেশ রায়ের কাছেও শুনেছিলাম, রুশরাই যা কিছু ইউরোপে লেখার মতো লিখেছিল। এর পর আর লেখা কোথায়, যেটাকে সত্যিকারে ক্ল্যাসিক লেখা বলব?  মুহম্মদ সাইফুল ইসলামের সহযোগে আমরা একটা বই করেছিলাম ‘লেখার শিল্প, লেখকের সংকল্প’, এতদিনে দুটো সংস্করণ হয়েছে বইটার। বইটার নাম সাইফুল ভাই রাখতে চেয়েছিলেন ‘ক্ল্যাসিক সাহিত্য চাই’, আমারও পছন্দ হয়েছিল নামটি, কিন্তু শেষমেশ এটা রাখা হয়নি, কারণ যে ধরনের রচনা নিয়ে বইটি সংকলিত, তাতে ওটা নিহিত ব্যাপার হয়েই আছে, তা থাকুক, লেখালেখিতে তরুণ লেখকদের যদি কোনো সহায়তা দিতে পারে, এজন্য নামটা বদল হলো। এটা বলছি এজন্য যে, আমরা ওই রচনাগুলিতে একটি মাত্র সাহিত্যতত্ত্বওয়ালা লেখা রেখেছিলাম এমিল জোলার ‘কথাসাহিত্যে প্রকৃতি-পন্থা’ নামে। এছাড়া কোনো তত্ত্ববাদী লেখা নেই। আর আপনি জানেন, সূক্ষ্ম তত্ত্বচিন্তা/ভাবনা বা ক্রিটিক্যাল থিওরির যুগটা আসলে শুরু হয়েছে সেই অর্থে সম্প্রতি, এই আশির দশকে। ফলে লেখক হয়ে ওঠার জন্য তত্ত্ব দরকার হয় না, কেবল এটুকু বুঝতে হবে, যে কোনো ব্যক্তির লেখালেখি করার প্রতিভা বিন্দু হলেও আছে কিনা, ১% হলেও আছে কিনা, বাকিটা অনুশীলন। ওইটুকু থাকলে, লিখতে লিখতে লেখক-টাই লেখক। প্রতিভাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিশ্রমেরই অন্য নাম বলেছিলেন। প্রতিভা নিয়ে বসে থাকলে, হেলায় হেলায় দিন কাটালে লেখক হওয়া যায় না। ফলে ওই আত্মজ্ঞান আর আত্ম-তদন্তটা জরুরি। আমি লেখক কিনা, আর আমি যা লিখি, তা কতটা লেখা হয়ে উঠল সাহিত্য ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে—এ দুটো বার বার লেখককে জানতে হয়। তত্ত্ব অবশ্যই তাকে সহায়তা করতে পারে। আমি ওই পিটার বিকসেলের গল্পটার কথা বলেছি। বাখতিনের উপন্যাসতত্ত্ব পড়লে ঔপন্যাসিকের লাভ হবে, না পড়লে খুব ক্ষতি হবে বলা যায় না। আর মানস-উপনিবেশ যদি লেখকের ভেতরে গড়ে ওঠে, তবে তিনি টের পাওয়া মাত্র স্বাধীন হয়ে নেবেন। প্রকৃত লেখক মাত্রই সেটা পারেন।


১২. অনুরোধের লেখা

খোরশেদ : অনুরোধের লেখা আর নিজের লেখার মধ্যে কী তফাৎ দেখেন আপনি? একবার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন—কেউ যেন আপনার কাছে লেখা না চায়। অর্থাৎ আপনার নিজের মতো চলতে চান।

হামীম : পত্রপত্রিকার পেট ভরানো লেখা লিখতে লিখতেই আমাদের এদেশে লেখককে গড়ে উঠতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবাহ করতে হয়। হ্যাঁ, মার্কেস কলাম লিখতেন, সৈয়দ হক লিখেছেন কলাম। সেগুলি আসলে তাদের স্বাধীন চিন্তা ও মনোভাব থেকেই জাত। বেঁধে দেওয়া হলেও তারা সেটা সামাল দিয়েছেন। আমার সঙ্গে এ নিয়ে প্রশান্ত মৃধার আলাপ হয়েছে বহুবার। তিনি বলেছেন, কবি জাহিদ হায়দারের কথায়, একটা বয়সে আর এসব লেখা উচিত না, এতে বড় লেখা বা নিজের লেখাটা আর হয়ে ওঠে না, পরে আর সময় পাওয়া যায় না। আমি ২০০৭ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছি এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার, পাইনি। যদিও এখন অনেকটাই না করতে পারি। কারণ আমি কী চাই এসব লেখা থেকে? প্রচার? অর্থ? ছাপা অক্ষরে নাম দেখার সুখ। সত্যি বলতে কি এগুলোর কোনোটাই এতে আসে না। কবি আলতাফ হোসেন বা ওয়াসি আহমেদ চমৎকার কিছু কলাম লিখেছিলেন, কিন্তু তাতে কি লেখক হিসেবে তাদের খ্যাতি প্রতিপত্তি বিপুলভাবে তৈরি হয়েছে? বঙ্কিমচন্দ্র সেই কবে বলেছিলেন, বাঙ্গালা সাহিত্য হলো ‘‘খবরের কাগজে জড়ান কতকগুলি অপক্ক কদলী।” কথাটি কমলকান্তের দপ্তরের ‘বড় বাজার’-এ আছে। সঙ্গে সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য সাহিত্যেরও তুলনা আছে। সংস্কৃত হলো অমৃত আর পাশ্চাত্য সাহিত্য হলো সুস্বাদু ফল। আমি বলব, নাটকের ক্ষেত্রে গ্রিসের সাহিত্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে রুশ সাহিত্য অমৃতই। ফলে বুঝে নেওয়া যায় বাংলা সাহিত্যের এই পত্রিকা নির্ভর চর্চা কাঁচকলা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও এরও কিছু ইতিবাচক দিক বের করা যায়, কিন্তু একটা বয়সের পর পত্রিকালগ্ন সাহিত্যের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা না করলে বিপদ। যেতে হয় ভালো বইয়ের দিকে, বইয়ের প্রকাশনার দিকে। ও হ্যাঁ, অনুরোধের লেখা ও নিজের লেখার মধ্যে তো তফাৎ আছেই। আপনি একটু আগে তত্ত্ব নিয়ে যেমন বললেন, ‘‘চিন্তা যতই প্রভাবশালী হোক ‘‘চিন্তাগুলো অন্যের,’’ বললেন না, দশা ওটাই। অনুরোধের লেখা নিজের লেখার দিকে যাওয়ার জন্যও বাধা। নিজের লেখার সঙ্গে লেখকের দেখা হওয়াতে সুদীর্ঘ সময় লেগে যায়, অতিপ্রতিভাবানদের কথা আলাদা, কাফকা জাতের যারা, কিন্তু গ্যোয়েটে? ১৭৪৯ সালে তাঁর জন্ম। ১৮০৬ সালে লেখা শেষ হয় ‘ফাউস্ট’-এর প্রথম খণ্ড, এর পূর্ব পর্যন্ত নাকি তিনি তেমন কোনো লেখক হিসেবে গণ্যই হচ্ছিলেন না, নিজেকেও গণ্য করতে পারছিলেন না। দেবেশ রায় ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ শেষ করেছেন পঞ্চান্ন বছর বয়সে। ধরা যাক পঞ্চাশে শুরু করেছিলেন। অন্য কেউ বলে দিলে পর আমি সেবিষয়ে লিখছি; আর নিজের অন্তর ভেদ করে যে লেখা জেগে উঠতে চাইছে বা যা না লিখলে আমি নিদ্রাজাগরণের একমুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না, সে দুটো কী এক? যদিও বাংলা সাহিত্যের বড় অংশই অনুরোধের ঢেঁকি গেলা লেখক। ফলে যা হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় তো বলাই হলো। কিন্তু বাস্তবতাও আছে। পশ্চিমা লেখকদেরইবা কজন শুরুতেই পেশাদার হতে পারেন? বিশেষ করে সিরিয়াস সাহিত্যের লেখকদের পেশাদার হওয়াটা সবখানেই শুনেছি সংখ্যায় কম।


১৩. নিজের লেখা, নিজের ভাবনা

খোরশেদ : আপনার নিজের লেখার বিষয়ে ভাবনা কী?

হামীম : আসলে এখনও ভাবনার ভেতরে আছি। নিজের লেখাটা লিখে উঠতে পারিনি। হঠাৎ একদিন মনে হলো, আমার লেখার মধ্যে স্পষ্টতই দুটো ভাগ হয়ে যেতে পারে। ঠিক তুলনা নয়, কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, মানিকের যেমন প্রথম ভাগে আছে যৌন-তাড়িত বা বাসনা-তাড়িত মানুষদের কাহিনি, যাকে বলা হয়েছে তাঁর ফ্রয়েড প্রভাবিত পর্ব। পরের ভাগে মার্কস প্রভাবিত পর্ব যেখানে জীবন ও শিল্প-তাড়িত মানুষের কাহিনি। কীভাবে সেটা ব্যাখ্যা করা এখানে অল্পতে যাবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, জীবন যেমন একটা যৌনপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয়, লেখাও তাই। বীজটা যৌন। টমাস মান তো বলেইছেন যে, ইরোস হচ্ছে সমস্ত শিল্পের মূল। এই ইরোটিক একটা প্রবলচাপের হাত থেকে লেখা একটি মুক্তির পথ দেখায়, কিন্তু সেখানে আটকে গেলে চলে না। সুবিমল মিশ্রের লেখা পড়লে প্রথমে সেই চাপটাই টের পেতাম। তিনি আমার কাছে দরকারি লেখক, যেমন দরকারি লেখক দেবেশ রায়। কেউ কিন্তু অত প্রিয় লেখক নন। কিন্তু তাঁদের না পড়লে লেখাটা লেখা এবং লেখায় থাকাটা সম্ভব হতো কিনা জানি না। অন্যদিকে, অনেকেই তো তাঁদের পড়েন না, তো তাঁরা কি লেখেন না? আমি পারিনি, এটা আমার সীমাবদ্ধতা। তো লেখার ভাবনায় অনেক কিছু কাজ করে, যেমন মনে হতো ‘পথের পাঁচালী’র মতো উপন্যাস যদি লেখা যেত, যেটা একজন কিশোর থেকে শুরু করে অতি মননশীল ব্যক্তিও পড়তে পারবেন অবলীলায়। যেমন পরে মনে হতো, মতি নন্দীর গদ্যে ইলিয়াস বা দেবেশের মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখতে চাই (যেমনটা কাম্যুর লেখাকে এককথায় বলা হতো: কাফকাস কনটেন্ট, রিটেন বাই হেমিংওয়ে।), যেখানে আমার পরিশ্রমটা গোপন করতে পারব। পাঠক যাতে পড়ে একবারও মনে করবে না, এর জন্য আমাকে কতটা খাটতে হয়েছে। ওই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না যে, যে-বই পড়লে মনে হয় কোনো বই-ই আসলে পড়ছি না, ওটাই আসল বই। মানে, জীবনের সঙ্গে মিশে আছি, তেমন বই লিখতে ইচ্ছা করে। এগুলি সাহিত্যভাবনা নয় বোধ করি। তবে, একটা বিষয়: কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা, বা ব্যক্তি ধরে কোনো কিছু লিখতে আমি আগ্রহী নই। বরং তুচ্ছ বিষয় ও ঘটনা নিয়ে বড় কিছু করতে ইচ্ছা করে। বড় ঘটনা ও ব্যক্তি নিয়ে যে লেখা উপন্যাসই হয় না, অথচ উপন্যাস নামে চালানো হচ্ছে, বা বলা হচ্ছে এটা নতুন ধরনের উপন্যাস—এই রকম কিছু লিখতে চাই না।… লেখকের উপন্যাস প্রকল্প ভেতর থেকে জাত। বাইরের বিষয় ও ব্যক্তি নিয়ে তৈরি উপন্যাস জগতে খুব একটা সফল হয়নি। ফলে ইতিহাস সাক্ষি, তা করতে গেলে আপাতভাবে বাজার পাওয়া যায়, কিন্তু আখেরে সেটি আসলে উপন্যাস হিসেবে আর গণ্য হয় না। তবে, আজকাল আমাদের যা দশা, শিল্পবোধ, ভাষাবোধের যে অবস্থা তাতে শিল্প-অশিল্প, ভাষা ও ভাষাহীনতা সব লুপ্ত। প্রতি পদে পদে ইংরেজি দিয়ে বাংলা লেখার ভেতরে যারা স্মার্ট বাংলা তৈরি করছেন তাদের লেখা পড়ে বিপন্নবোধ করি। বাংলা ভাষার তাহলে কাজ কী? যদি তা এত ধার করে অনর্থক ইংরেজি শব্দ দিয়ে লিখতে হয়?… ফরাসি জর্জ পেরেক তাঁর একটি উপন্যাস (La Disparition) ‘লা দিসপারিসঁ’ (১৯৬৯ ফ্রান্সে প্রকাশকাল) হবে মনে হয় উচ্চারণটি, তাতে একটিও শব্দে ‘ই’ বর্ণটি ব্যবহার করেননি অথচ ফরাসি ভাষায় ‘ই’ বর্ণটি বহুল ব্যবহৃত। এবং ইংরেজিতে যখন ওই উপন্যাসটি ‘অ্যা ভয়েড’ (A Void) নামে অনূদিত হয় ১৯৯৪ সারে, সেখানেও কিন্তু কোনো শব্দে ‘ই’ নেই। আর আমরা আজকাল একটি বাক্য বলতে পারি না ইংরেজি ছাড়া? প্রতি পদে অনর্থক ইংরেজি শব্দ ব্যবহারকে মনে হয়—আমরা যে দুশ বছর বৃটিশের গোলাম ছিলাম সেটা স্মরণ করা। এই গোলামি যাদের পছন্দ তারা করুক। আমি আসলে বাংলায় উপন্যাস লিখতে চাই। পুরো বাংলায়। আপাতত এটাই ভাবনা, কী করে সেটা লিখব।


১৪. বিশ্বসাহিত্যের জরুরি পাঠ

খোরশেদ : ভালো সাহিত্যিক হতে হলে বিশ্বসাহিত্যে ডুবে যাওয়া পাঠের প্রয়োজন রয়েছে কতটা? মানে, লেখকের আগে ভাল পাঠক হতে হয়—এটাই তো বলতে চাচ্ছেন?

হামীম : আসলে একটা হলো নিজ ভাষা সাহিত্য, অন্যটা হলো বিশ্বসাহিত্য। নিজ ভাষা সাহিত্য দিয়ে যে চলে না তা তো নয়। গ্রিক সাহিত্য যখন লেখা হলো প্রাচীন কালে তখন গ্রিক ছাড়া তো আর কোনো সাহিত্য ছিল না তাদের কাছে। একই দশা সংস্কৃত সাহিত্যে, তাই না। কিন্তু একপর্যায়ে এসে বোঝায় যায়, বিশ্বসাহিত্য ছাড়া এগুনো যায় না। আমি সবসময় বলি, ভাষা যার যার, কিন্তু সাহিত্য সবার। ফলে অন্য দেশের সাহিত্যও আমারই সাহিত্য। এমন অনেক দেশের সাহিত্য মিলে যা, তা আসলে সাহিত্য-ই। এখন তাদের একনামে বিশ্বসাহিত্য বলি, কারণ সেগুলি ওই ওই ভাষার বা নানান ভাষার নির্বাচিত বা সেরা লেখা দিয়ে তৈরি। কিন্তু সবার আগে নিজের ভাষাটা, মানে লেখার ভাষাটা শেখার উপায় কী? পড়া ছাড়া তো উপায় নেই। আমি তো মনে করি বাংলা ভাষা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, মীর মশাররফ হোসেনদের মতো লেখকের সমস্ত বা নির্বাচিত লেখা পড়লেও সেই ভিত্তি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। পরের লেখকদের তো আপনাআপনিই পড়া হয়ে যাবে। যারা এ ধারায় তৈরি হন না, তাদের বাংলা ভাষা নিয়ে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না। কিন্তু পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের বিষয়গুলি জানা দরকার। ওই যে জর্জ পেরেকের কথা বললাম। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের বর্তমানে সবচেয়ে চর্চিত লেখকদের একজন, রোবের্তো বেলানিয়ো-র মতে, আগামী উপন্যাস লেখকদের জন্য জর্জ পেরেকের চারটি উপন্যাসই অবশ্য পাঠ্য। একজন ফরাসি লেখককে বিশেষভাবে অনুমোদন করছেন একজন স্প্যানিশ ভাষার লেখক। যেমন  সাদাত হাসান মান্টো আর ভৈকম মুহম্মদ বশীর হলেন,  উপমহাদেশের সবচেয়ে খাঁটিত্বসম্পন্ন/অরিজিনাল লেখকদের দুজন, তাঁদের বাদ দিয়ে ছোটগল্পের পাঠ বাঙালিরও অসম্পূর্ণ—এ জায়গাটাই বিশ্বসাহিত্য বা অন্য ভাষার সাহিত্যে কাজ করে। এর আরো অনেক বিষয় আছে। সারা জগতের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হতে হলে সারা জগতের সাহিত্যকে বুঝতেই হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে সোয়াশো বছর আগে এসব বলে গেছেন। আমি আর নতুন করে কী বলব?


১৫. পশ্চিমের সঙ্গে বোঝাপড়া

খোরশেদ : ইউরোপের মানুষকে আমরা ব্যক্তিবাদী বা ইন্ডিভিজুয়ালিজমের ব্যাপক প্রভাবে বিচ্ছিন্ন-বিদীর্ণ বলেই জানি। যেমন আপনি নিজেও একটা লেখায় বলেছেন, “পশ্চিমের কোনো কোনো দেশের কোনো শহরে বা জনপদে বা কমিউনিটিতে এমনও রীতি আছে ওই অঞ্চলের লোকেরা ঠিক করে যে, এই সপ্তাহে ওই শহরের সবাই অন্য যাই পড়ুক না পড়ুক, একটি বিশেষ বই ওই সপ্তাহে সবাই পড়বে। এমনিতে ওই শহরের লোকজন নিজেরা সবাই নিজেদের মতো থাকে। খুব একটা মেলামেশা করে না। কিন্তু তারা এই বিচ্ছিনতার ভেতরেও সংযুক্ত থাকার একটা পথ বের করে নিয়েছে। সপ্তাহে একটি বিশেষ বই সবাই পড়ার ভেতর দিয়ে।”—এই চিন্তাটা আমার কাছে নতুন মনে হয়েছে।

হামীম: একটা খটকা আছে জানেন: ইউরোপের-আমেরিকার মানুষ আসলে ভেতরে ভেতরে তাদের চরম হীনমন্যতার জায়গা থেকেই এত ওপরে উঠে গেছে, কিন্তু তাদের কুৎসিত প্রবণতা দাঁতে নখে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ে। তাদের বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব। সাপ হয়ে দংশন করা ওঝা হয়ে ঝাড়ার যে কৌশল তারা নব্য-ঔপনিবেশিকতায় দেখিয়ে আসছে তা ভয়াবহ! যদিও এও সত্য, আধুনিক মানুষ ও বিশ্বমানবতার ডাক তারাই দিয়ে থাকে। কিন্তু তাও যেন অতীত হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে ভয়াবহ ব্যক্তিসর্বস্বতায় নিমজ্জিত পশ্চিমাজগতের মুক্তি না হলে বিশ্বে আমাদেরও মুক্তি হবে না। কারণ এটা চরম সত্য, যেভাবেই হোক এশিয়া আফ্রিকাকে লুটেপুটে হোক, দাস বানিয়ে নিজেদের শিল্পসাম্রাজ্য গড়ে তোলাতেই হোক, তারা এগিয়ে গেছে। আজকে আমরা জানি না, আমাদের দেশে কটা মাদ্রাসা আছে, সেখানের প্রকৃত অবস্থা কী, কিন্তু সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় জানে। যাই হোক, তারা তাদের ভেতরে পাঠ-অভ্যাসের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সূচনালগ্ন থেকে নিজের সংযুক্তি রাখতে চেয়েছে। মিলান কুন্দেরার মতে, আধুনিক ইউরোপীয় মন ও মনন উপন্যাসের সৃষ্টি। সেটা তো কার্ল মার্কসের বালজাক পড়ার ভেতর দিয়ে সমাজ রাষ্ট্রকে বোঝার উদ্যোগেও টের পাওয়া  যায়। ফলে তাঁদের সাহিত্য একটা সংযোগ তৈরি করে। তারা অনেক সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়ে সেটা বের করেছে। প্রবল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ভেতরও ব্যক্তি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জের মতো ঘটনাগুলিতে বার বার সেটির সীমা আমরা দেখতে পাই। কদ্দুর আসলে তারা সত্য ও গণতন্ত্রকে সহ্য করতে পারে? আর অ্যাসেঞ্জও তো কোনো অবতার নন। সত্য এখন বিদীর্ণ, চুরমার দশায় আছে।


১৬. প্রাচ্যের অভিনবত্ব

খোরশেদ : পশ্চিম থেকে যা ভাল নিতে পারি। কিন্তু পূর্বের সাহিত্যদর্শনকেও ঘাটাঘাটি করা জরুরি কীনা?

হামীম: আরে পূর্বেই তো যা হওয়ার তৈরি হয়ে বসে আছে। লালন গেয়েছিলেন, ‘‘বেদবিধির পর শাস্ত্র কানা/ আরেক কানা মন আমার।” পশ্চিমা সভ্যতার মুরদ এই এক কথায় অনেকটা ধরা পড়ে গেল না? পশ্চিমারা তাদের কানা শাস্ত্র নিয়ে দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটালো। জগতের মনন চর্চার ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিদের একজন মার্টিন হাইডেগার নাৎসি সমর্থক হলেন। আর ফ্রয়েডের হাত যে মনের বরাত খুলল, আদতে কতটুকু খুলল? লাঁকা নতুন করে ফ্রয়েডকে হাজির করলেন। তাতে কী লাভ হলো? বর্ণবাদী মন থেকে পশ্চিমা মন মুক্ত হলো? আমরা দীর্ঘদিন ধরেই নিয়েছি পশ্চিমারাই সব ভালো গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তুর্গেনেভের তুলনায় বঙ্কিম হীন লেখক—এই ধারণাগুলি আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করেছে। আমার সবসময় খটকা ছিল, ঘটনাটা কী। বঙ্কিমের উপন্যাস পড়ে, বিভূতির উপন্যাস পড়ে বা তারাশঙ্কর মানিক বা সতীনাথ কি সমরেশ বসু বা সৈয়দ হক-ইলিয়াসরা, এঁরা বর্তমান পশ্চিমা লেখকদের তুলনায় কতটা কোথায় পিছিয়ে? এখন তো দেবেশ রায়ও সেই জায়গা থেকে মুক্ত করে বলেছেন যে, বঙ্কিমের ‘কপালকুণ্ডলা’ সেই সময় বিশ্বের সেরা উপন্যাসের একটা এবং আজোও সেরা। স্কটের সঙ্গে তুলনা করে বঙ্কিমকে ছোট করার কোনো মানেই হয় না। শুধু পশ্চিমের যা ভালো কেন, সারা বিশ্বের যা ভালো, ফিলিপাইনে বা ফিজিতেও যদি তেমন কিছু পাওয়া যায়, নেব। সাহিত্যদর্শন তৈরি করার তো সময় পেলাম না আমরা, বা এখনও পাচ্ছি না। বলা হয়, সাহিত্যতত্ত্বের যা কিছু, সেসব ইউরোপের বাইরে কিছুই হয়নি, এমনকি আমেরিকায়ও নয়। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্তমানে যে তার খোঁয়ারি চলছে, তাতেও সময় লাগবে আরো কিছুদিন আমাদের নিজেদের সাহিত্যদর্শন তৈরি করতে। সম্প্রতি দেবেশ রায়ের ‘উপন্যাসের বিবিধ সংকট’(২০১৮)-এ তিনি দেখালেন, আমাদের উপন্যাসের গতি-প্রকৃতি কতটা কীভাবে যেতে পারে। শিল্পের আরো আরো দিক তো বাকি পড়েই আছে।


১৭. সর্বাধুনিক প্রযুক্তি

খোরশেদ : আপনার একটা মন্তব্য ভালো লেগেছিল— “মেসেঞ্জার, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে মানুষ তাদের মনের ভাব আদান-প্রদান করছে। সেখানে জীবন অন্যরকম ভাষা পেয়েছে।”—এই ভাষাটা আসলে কী? কী পেল মানুষ সর্বাধুনিক সভ্যতার কাছে?

হামীম : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এসবকে বলেছেন: উপেক্ষিত মানুষের মুক্তির জগৎ। তারা সেখানে কথা বলতে পারছে। সাধারণ মানুষদের বাঁচিয়ে দিয়েছে ওই সব মাধ্যম। যাকে কেউ গুণত না, ধর্তব্যের মধ্যেই আনত না, সেও নিজেকে সেখানে ঘোষণা করছে, সে কী জুতা কিনেছে, রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু সত্যিকারের মননশীল মানুষরা এটাকেও নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষণা বা অস্তিত্বের প্রদর্শন হিসেবে দেখছেন না, তারা সেটিকে তাদের মতো করে কাজে লাগাচ্ছেন। উমাবার্তো একো বলতেন, ১৫/২০ মিনিট যথেষ্ট এসবে সময় দেওয়া। কিন্তু যাদের এসবে আসক্তিতে পায়, সেটি যেকোনো আসক্তির মতোই ক্ষতিকর। কিন্তু বেকেটের লেখা থেকে টের পাওয়া যায় যে, আসলে সংযোগ তৈরি হয় না, সংযোগ তৈরির কোনো মানেও হয় না। কিন্তু বেকেট বলেছেন বলেই তো এটা বেদবাক্য হয়ে যায় না। বেদাবাক্যই তো আর মানা হয় না। যে সব মানুষ সর্তক নয় সেসব  মানুষ এক প্রবল ফাঁপা আমিত্বের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। আরো বেশি করে ঢুকে পড়ছে— এটা এদিক থেকে আরেক বিপদ তৈরি করেছে। সংযোগের বদলে কথায় কথায় আনফ্রেন্ড ব্লক এসবও আছে। এই কৃত্রিম প্রযুক্তি মানুষের মন নিয়ে খেলে। তাঁরা নিশ্চয় গবেষণা করে ওই সব সুযোগ রেখেছে যে কী করে তা করা যাবে। মানুষ বস্তু নিয়ে খেলতে পারে, কিন্তু বস্তু যদি মানুষকে নিয়ে খেলে, তাতে অবস্থা কী দাঁড়ায়?


১৮. প্রদর্শনের বাস্তবতা

খোরশেদ : আপনি যে বলেছিলেন, “লেখার চেয়ে লেখা প্রদর্শনের বাতিক এখানে বেশি। আমরা কমবেশি সবাই ক্রমে প্রদর্শন বাতিকগ্রস্ত হয়ে উঠছি। কোথাও দাঁড়ানোর সময় নেই।”

হামীম : ‘আমাকে দেখুন’ নামে আমার এক প্রিয় লেখক প্রফুল্ল রায়ের বই আছে। আমি প্রফুল্ল রায়ের লেখা পড়ি তাজা হাওয়া পেতে। ওটা ৩/৪  খণ্ডে লেখা। কিন্তু এসম্পর্কে তিনি একটি লেখায় বলেছিলেন, ওটা হলো তার ‘সিরিয়োকমিক’ লেখা, ‘নিজেই নায়ক’ ও তেমন লেখা। আমাদের দশা ওই: আমাকে দেখুন, আমিই নায়ক—ধরনের, তাই না। আর আমি বহু আগে একটা কলাম লিখেছিলাম: সবাই দৌড়াচ্ছে, কাউ না কাউকে দাঁড়াতে হবে। আমার অনুজ লেখক স্বকৃত নোমান বলেছিল, এই কথাটা তাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। গ্রিক পুরাণে জলপরী দাফনির কাহিনি তো জানা অনেকের। এত এত প্রেম করে, পুরুষদের বুকে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার খেলায় দাফনির দিন কাটছিল। তারপর অ্যাপেলোর পাল্লায় পড়ে দাফনি পালাতে গিয়ে শেষে লরেল গাছে পরিণত হলো।—এটা নিয়ে ছুটে চলা জীবন ও দাঁড়িয়ে পড়া জীবনের রূপক সন্ধান করা যায়। দাফনি দাঁড়িয়ে বৃক্ষে পরিণত হলে সে এত দিনে নেওয়ার বদলে দিতে শিখল। ফলে প্রদর্শন বাতিকগ্রস্ত যে, সে কেবল প্রদক্ষিণ করে বেড়ায়, বুঝতেই পারে যে, না দাঁড়ালে তো দেওয়া যায় না। স্থির হয়ে এক চলমানতা ধারণ করাই কাজ।


১৯. পুরস্কার বনাম সাহিত্য

খোরশেদ : আপনার পুরস্কার পাবার বিষয়ে জানতে পেরেছিলাম আপনি নিজে বই জমা দেননি, বন্ধুরা অজান্তে দিয়েছিল। আপনার দর্শন একটা লেখায় প্রকাশিত হয়েছিল এভাবে, “লিয়াজোঁ করে পুরস্কার বাগানো এবং নানান কিছু থেকে থাকার চেষ্টাই তার অন্যতম কাজ হয়ে ওঠে, তার কাছে সাহিত্য হয়ে যায় গৌণ ব্যাপার।”

হামীম : আমি আসলে পুরস্কারের জন্য ব্যস্ত কোনোকালেই হইনি। বন্ধুরা ঠিক না জেনে নয়, আমার কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে নিজেরা জমা দিয়েছিল। পুরস্কার তেমন কাজ করে পেলে তো মন্দ হয় না। কিন্তু একটা খটকা আছেন জানেন! সেটা হলো, সত্যিকারের লেখক এক ধরনের সন্ন্যাসীর মতো মানুষ। তিনি প্রবল প্রখর এক নৈতিকবোধের মানুষ। কল্যাণ-ন্যায় তার জীবনে সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে সমাজ বা প্রতিষ্ঠান যে সব পাপ করে, লেখক তো তা করেন না, কিন্তু পুরস্কার দিয়ে লেখককে সেই পাপের ভাগী করে তোলা হয়। টমাস বার্নহার্ডের বিরাগ ছিল পুরস্কার নিয়ে, তবু তিনি নিতেন। তাও তাঁর মনে হতো, পুরস্কার নিতে গেলে যে, কেউ একজন বা একাধিক ব্যক্তি তার মাথার ওপর প্রস্রাব করে দিচ্ছে। সোজা বাংলায় মুতে দিচ্ছে। কিন্তু এর একটা ভয়াবহ বাস্তবতাও আছে। পুরস্কার না পাওয়া লেখকের বিপদ অনেক। যদিও সত্যিকারের লেখক এসব পুরস্কার- তিরস্কার ফুঁড়ে নিজের লেখা দিয়েই টিকে থাকতে পারেন, সার্ত্রের মতো যারা। আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমাদের কজনের সেই আত্মবিশ্বাস আছে?


২০. নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব

খোরশেদ : নগরের জীবন মানুষকে বিচ্ছিন্ন, একা করে দেয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘মানুষ যেখানে সম্পূর্ণ একলা সেইখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন’। শহীদুল জহিরও বলেছিলেন, “যে মানুষ নিঃসঙ্গ নয়, সে দুর্ভাগা।” আমার কাছে কিন্তু নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বকে ভিন্ন মনে হয়।

হামীম : আমার কাছেও ভিন্ন মনে হয়। একাকিত্ব একটা নেতিবাচক জিনিস। নিঃসঙ্গতা ঠিক নেতিবাচক নয়। দুটোর মধ্যেই আবার দুটো মিশে আছে। এটা অনুভব করার ব্যাপার যে, আপনি একা না নিঃসঙ্গ। যেমন আমি একা নই, কিন্তু আমি নিঃসঙ্গ। কারণ আমার বন্ধু আছেন অনেক, প্রিয় বন্ধু তারচেয়ে কম, আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু একদম কম। কিন্তু তারপরও আমি আমার পড়ার সময়, ভাবনার সময়, লেখার সময় যদি নিঃসঙ্গ না হই তো আমি কাজই করতে পারব না। ফলে জহিরের কথাটা ওই দিকে ঠিক। রবীন্দ্রনাথ একলা বলেছেন, একা ও একলাতেও মনে হয় তফাৎ আছে। জানি না ঠিক কোনটায় জোর ছিল তাঁর। তবে নিঃসঙ্গ মানুষ স্বাধীন হতে পারে। কিন্তু মানুষ আসলে একা হতে পারে কি? কতটা? যে আসলেই একা, ধরা যাক এক সময় সচিব ছিলেন, বিরাট অর্থ বিত্তের অধিকারী হয়েছেন। এখন বিরাট বাসায় তিনি একা। বৌ ছেলেমেয়ে সবাই বিদেশে। কেউ খোঁজ নিতে আসে না। তার নিজের কোনো ভাবনা চিন্তার জগৎ নেই—এই ধরনের মানুষই তো একা, তাই না। কিন্তু নিঃসঙ্গ মানুষ তা নয়, সে কাজের মানুষ। লেখক বিজ্ঞানী চিত্রশিল্পী সংগীতপ্রেমী সিনেমাপ্রেমী মানুষ আরো যারা সৃজনশীল কাজ করেন তাদের একাকিত্বের সঙ্গী হলো নিঃসঙ্গতা।—আমার কাছে এমনটাই মনে হয়।


আড্ডা পর্বটি ৩টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম পর্ব আগেই প্রকাশিত। আজ ২য় পর্ব সম্পন্ন হলো। এরপর ৩য় পর্ব প্রকাশের মধ্য দিয়ে এটি সমাপ্ত হবে। কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে আড্ডা-পর্বে অংশ নিয়েছেন : খোরশেদ আলম, লেখক; শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।