১ম পর্বে জীবন, মৃত্যু, রহস্য, গোলকধাঁধা, স্বপ্ন, রূপকথা, ফ্যান্টাসি বা বাস্তবতার নানা রূপায়ণে জাদুবাস্তব নিয়ে আলাপের একটা প্রচেষ্টা ছিল। ২য় পর্বে এসে সেই আলাপটা মহাদেশ, উপমহাদেশ, আঞ্চলিকতা, দেশজরীতি, ভাষাশৈলী, সংস্কৃতি সর্বোপরি আজকের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসে থেমে যায়। তবুও থেকে যায় অকথিত অনেক কিছু, না বলা অনেক ভাষ্য। আমরা আশাকরি এভাবেই নানাপ্রসঙ্গ ধরে, সাহিত্যের তত্ত্ব-দর্শন কিংবা ইতিহাস, রাজনীতি, শিল্পকলার বিচিত্র বিষয় ও কলাকৌশল নিয়ে উপস্থিত হবো। আপনাদের অভিব্যক্তি কমেন্টে জানালে আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হবে।
১ম পর্বের লিঙ্ক : https://wp.me/p46zKa-T9
৭. ইউরোপ নাকি ল্যাটিন আমেরিকা, কোন পালে হাওয়া?
খোরশেদ আলম : বলা হয় যে, চেকরা কঠিন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য তারা এক ধরনের শূন্যতা আর অসারতায় আক্রান্ত। সেখান থেকে কি জাদুময় বাস্তব তৈরি হচ্ছে? মিলান কুন্ডেরার প্রসঙ্গটা হঠাৎ করেই মনে এলো, তাই চেকের প্রসঙ্গটা…
হামীম কামরুল হক : পাল তো একটাই টানানো হয়েছিল, তা হলো ইউরোপীয়। কারণ তত্ত্ব বলতে যা কিছু, তা খাড়া করেছে ইউরোপীয়রাই। বাকি জায়গায় তত্ত্ব গড়ে ওঠার সময়টাই পায়নি। ঔপনিবেশিক ছাঁচে বা দাসত্বের ভেতরে তত্ত্ব চলে না মনে হয়। ফলে এখনও সময় লাগবে। এই যে জাদুবাস্তববাদ তাও জার্মান ফ্রাঞ্জ রোহ’র কাছ থেকে পাওয়া। লাতিন আমেরিকায় গিয়ে এটা তৎকালীন ‘কমিউনিস্টদের আউটলুক’ হয়ে উঠেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আসলে তো মানবসমাজের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ভাবে নানান রকমের ধোঁকার মধ্যে আছে। আমরা সবাই প্রতারিত। প্রতিটি ব্যবস্থা আমাদের প্রতারিত করে যাচ্ছে। ন্যায় বলে আদতে কোনো কিছু কি আছে? রাষ্ট্র কি ন্যায় দিতে পেরেছে? জগতের সব সম্পদই তো সারা মানবজাতির জন্য। কোনো এক জাতির তা কুক্ষিগত করে ব্যবসা ফাঁদার জন্য নয়। এদিক থেকে দেখলে পারস্পরিক ধোঁকাবাজি বা প্রতারণাই সবকিছুই নিটফল। তাহলে রেহাই কোথায়? কিছুটা তার এই শিল্পসাহিত্যে। তবে সেখানেও ধোঁকা, কিন্তু মজার বিষয় হলো, এখানে ধোঁকার ভেতর দিয়ে ন্যায়ের সংকট দেখানো হয়।
সার্বেন্তেস সম্পর্কে দস্তয়েভস্কি বলেছিলে, ‘‘দন কিহোতে-তে মিথ্যা দিয়ে সত্যকে বাঁচানো হয়েছে।’’ সাহিত্যের বিষয়টাই তা-ই। ফলে এই মিথ্যা, এই অলীক বিষয়টা নানান নামে হাজির হচ্ছে সত্যের/বাস্তবতার স্বরূপ তুলে ধরার জন্য। সেটা চেক দেশে হোক, মিলান কুন্দেরা বলুন বা না বলুন।
৮. আঞ্চলিকতার ঐক্য এবং ভাষাশৈলী
খোরশেদ আলম : একটা বিষয় স্পষ্ট, ল্যাটিন আমেরিকার বাস্তবতাটা ভিন্নতর। তাদের অভিজ্ঞতাও আলাদা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসসহ হুলিও কোর্তাজার, ইসাবেলা আয়েন্দে, আলেহো কার্পেন্তিয়ের সবার অভিজ্ঞতা আর বাস্তবতার একটা ঐক্য রয়েছে। এই ঐক্য খানিকটা আঞ্চলিক, কতকটা ভাষা ও শৈলীগত—আমার কাছে মোটাদাগে এমনটাই মনে হয়।
হামীম কামরুল হক : আপনার মনে হওয়াটা সঠিকই বলা যায়। তবে সেখানে নানান ধরনের কি সবধরনের সাহিত্যরীতিই প্রচলিত। বুম হওয়ার ভেতর দিয়ে কেবল জাদুবাস্তববাদটা সামনে একটু বেশি এল। কিন্তু অন্যান্য ধারার সাহিত্য লাতিন আমেরিকায় প্রবলভাবেই চর্চিত। সবচেয়ে মজার কথা, যাঁদের জাদুবাস্তবাদী বলা হয়, তাঁদের নিজেদের বরং বেশিরভাগ রচনা অ-জাদুবাস্তবাদী।
৯. সাংস্কৃতিক বিশ্বাস
খোরশেদ আলম : আলেহো কার্পেন্তিয়ারই সম্ভবত সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইউরোপীয় আর লাতিন আমেরিকান জাদুবাস্তববাদের পার্থক্য নির্দেশ করেছিলেন। বলা হয়, ইউরোপে আছে রূপকথা, মিথ ন্যারেটিভ কিন্তু সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নেই। আসলে ব্যাপারটা কী খুলে বলেন তো…
হামীম কামরুল হক : ওই যে রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্ত রকমের ভিন্নতা থেকে একেকটা জায়গার তো একেটা ধরন থাকে। জাঁ রেনোয়া ভারতে এসে সত্যজিতকে বলেছিলেন, এই যে নদীর ধার, পুুকুর পাড়, বাঁশঝোপ কলাগাছের সারি, নারী-পুরুষের উন্মুক্ত স্নান করার দৃশ্য—এগুলো আনলে তার ছবিতে ভিন্ন মাত্রা বা নিজস্বটা আসবে। নইলে পথ ঘাট ইউরোপীয় পোষাকপরা লোকজন আর সংলাপ শুনে আদতে কী তৈরি হবে?
লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতিতে জাদুবাস্তবাদী প্রকাশ আরো গভীরভাবে দেখানো যায়। ফ্রাঞ্জ রোহ-র বলা চিত্রকলার ঢঙে নয়। সাহিত্যের ভাষায়। বলা যায়, যত মতবাদ আছে, তার ভেতরে এই জাদুবাস্তববাদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা এসেছে সাহিত্য থেকে, গল্প-উপন্যাস থেকে, আর তা সম্ভব হয়েছে লাতিন আমেরিকায়। সেখানে মানুষের চরম অস্তিত্ব সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের দুমদাম গুম হয়ে যাওয়া, মৃত্যু ও নিশ্চিতভাবে মরা লোক বলে যাকে ভাবা হয়েছিল—তার ফিরে আসার, এমন হাজারো অবিশ্বাস্য ঘটনার চাপ এত বেশি ছিল যে, তাঁদের সাংস্কৃতিক বাস্তবতাই জাদুবাস্তববাদকে দাবি করেছিল সাহিত্যে। ‘আরব্যরজনী’র প্রভাব ছিল কিছুটা, কিন্তু আরব্যরজনী তো আর জাদুবাস্তববাদী রচনা নয়, সেখানে জাদুময় অনেক কিছু আছে যদিও। লাতিন আমেরিকার লেখকরা নিজের ভূমিজ বাস্তবতাকে হাজির করেছিলেন, যেটা ইউরোপে মানসপ্রবণতা হিসেবে ছিল, ফলে সংস্কৃতিতে তার শেকড় ততটা প্রোথিত ছিল না।
১০. ভূত-প্রেত, অশরীরী ইত্যাদি
খোরশেদ আলম : ইসাবেলা আয়েন্দের মনোযোগ ডিটেলে, কখনো নস্টালজিক। তাঁর ‘ভূতুরে বাড়ি’র সঙ্গে পারিবারিক কাহিনির প্রসঙ্গই যদি ধরি, মার্কেজের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’-এর মিলও থাকতে পারে। দুটোতেই ইন্দ্রিয়াতীত অনুভব আর ভয়াবহ আতঙ্ককেই যেন জাদুবাস্তব করে তোলা হয়। অশরীরী, ভূতপ্রেত কি কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য?
হামীম কামরুল হক : সাহিত্যের মৌলিক এবং আদি বৈশিষ্ট্য। রূপকথা, উপকথা, লোককথা জুড়ে এর উপস্থিতি। কাফকা ইদ্দিশ লোকসংস্কৃতি থেকে যে বহু কিছু গ্রহণ করেছেন, কিন্তু গবেষকরা দেখেছেন তাঁর সাহিত্যের কোথাও ‘ইহুদি’ শব্দটাই নেই। এটা কাফকার মতো লোক পারেন। মার্কেসের ‘শতবছরের নিঃসঙ্গতা’র নারীবাদী সংস্করণ বলা হয় ইসাবেলা আয়েন্দের বইটাকে। বোলানিয়ো ইসাবেলা আয়েন্দের লেখালেখিকে একেবারেই পাতলা/ অগভীর বলেছেন। তাঁদের তাঁদের ব্যাপার এগুলো। আমরা বাংলা সাহিত্যের লোকজন। আমরা তারাশঙ্করের মর্ম বুঝতে যদি পারি তো অনেকটাই কাজে লাগতে পারব বলে মনে হয়। মার্কেস-ইসাবেলা সম্পর্কে জেনে রাখলে ভালো, না জানলে যে খুব ক্ষতি হবে—এমনটা মনে হয় না। আমাদের বাংলা ভাষাকে আমরা দুর্বল করে রেখেছি, কিন্তু বাংলা সাহিত্য বোধ হয় অত দুর্বল নয়। নতুন করে ফিরে পড়তে হবে চর্যাপদ থেকে মধুসূদন বঙ্কিম থেকে সতীনাথ কি ইলিয়াস। অনেক মাল আছে কাজে লাগানোর।
১১. জাদুবাস্তবতার প্রাচ্য রূপ, জাদুবাস্তবতার উপমহাদেশ
খোরশেদ আলম : পশ্চিমবঙ্গে জাদুবাস্তববাদের চর্চার ধরনটা এক কথায় কেমন? প্রাচ্যের বিষয়টা তো আরো ব্যাপক। এই পর্বে এক কথায় বলাও কঠিন, অন্য কোনো পর্বে বিস্তারিত বলা যাবে। কিন্তু এটা না বললেই নয়, অনেকে ‘রামায়ণ’ বা ‘মহাভারতে’র মধ্যে, কেউ ‘আরব্য রজনীর গল্পে’র মধ্যে, এমনকি লোককাহিনির মধ্যে জাদুবাস্তববাদ খুঁজতে যান। এটা কতটা প্রাসঙ্গিক?
হামীম কামরুল হক : আগেই বলেছি ওসবে জাদু আছে, জাদুবাস্তবতাও আছে। কিন্তু জাদুবাস্তববাদী নয় সেসব। জাদুবাস্তববাদ কোনো লেখক নিজের সাংস্কৃতিক ভূমি আহরণ করেন, এর নিজস্ব রীতিকে প্রকাশ করেন। এটা ভূত প্রেত অলৌকিক বিষয় নয়। এটা অভিব্যক্তি/এক্সপ্রেশানজাত। একটা ঘটনাকে সরাসরি না বলে জাদুবাস্তববাদী রচনারীতিতে বলা। সেটা প্রেমপড়ার ঘটনা হতে পারে, বা ভয়ের ঘটনা হতে পারে। যেমন একটা লোক যা কিছু ধরলে সব ঘোলাটে সাদা রঙের হয়ে যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে ভয় বা বিরাট দ্বিধা উদ্বেগের মধ্যে আছে। এখন ওই সব লোকায়ত রচনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে যদিও কিছু কিছু বিষয় এমন এসেও পড়ে, তাতে তা জাদুবাস্তববাদী হয়ে ওঠে না।
পশ্চিমবঙ্গের অনেকের লেখায় এমন লোকায়ত অলৌকিক কাহিনিকে জাদুবাস্তবাদী লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়েছে। ‘অলীক মানুষে’র কথা তো বললামই। আফসার আমেদের কিস্সা ধরনের যে উপন্যাসগুলি আছে, সেগুলিকেও মনে করা হয়েছে সেসব এই লক্ষণাক্রান্ত। এছাড়াও লোকনাথ ভট্টাচার্যের ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’, অভিজিৎ সেনের ‘রহুচণ্ডালের হাড়’, নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘হারবার্ট’ ইত্যাদি অনেকের লেখায় এমন লক্ষণ আছে বলে মনে করা হয়। আসলে এসবে ঠিক জাদুবাস্তবাবাদী অভিব্যক্তিজাত কিছু নেই।
১২. বাংলাদেশে জাদুবাস্তবতাবাদ
খোরশেদ আলম : আমাদের দেশের সাহিত্য ইউরোসেন্ট্রিক জাদুবাস্তববাদ নাকি ল্যাটিন আমেরিকান জাদুবাস্তববাদ ঘেঁষা? নাকি স্বতন্ত্র কোনো স্বরের অন্বেষণ মেলে? বড় কথা হলো, আমাদের নিজস্বতার সন্ধানে, শক্ত কথা, এই বিশেষ ধরনের তত্ত্বজাতীয় প্রবণতাকে ঠেসে ধরার প্রয়োজন রয়েছে কিনা? নাকি আমাদের কথাসাহিত্যকে নিজেদের গতিতেই চলতে দেয়া উচিত? আর্ট তো কারো তাবেদার নয়, না তত্ত্বের, না কোনো খোঁয়ারে পোরা রাজনীতির।
হামীম কামরুল হক : আমাদের আমাদের সাহিত্যের যদি একটা তাত্ত্বিক ভূমি তৈরি করে তা ভেঙে ভেঙে কিছু রচনার জন্ম দিতে পারতাম তাহলে হয়ত বাংলাদেশে সাহিত্য বলে কিছু একটা হয়ত হতে পারত। তার বদলে ভাষায় শব্দ প্রয়োগে কিছু স্বেচ্ছাচারী মনোভাব আমাদের সাহিত্যের কোনো নান্দনিক নিজস্বতা দিতে পারছে না। আমাদের লোকায়ত আখ্যানগুলি, মৈমনসিংহ গীতিকা, বাউল সংস্কৃতিজাত দর্শন এবং বাংলা জাতিধর্মবর্ণ নিরপেক্ষ চেতনার কোনো সাহিত্যিক প্রকাশ কি তৈরি করতে পেরেছি? সাহিত্য যদি ধর্মের কথাই বলে, তো সাহিত্য আর কেন? ধর্ম বিভেদাত্মক, আর সাহিত্য অভেদাত্ম, মানে তার লক্ষ্য সর্বমানবীয়। ফলে হিন্দু সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য বলে কিছু হয় না। ইয়াসের কামেল বা ওরহান পামুকের লেখা কি মুসলিম সাহিত্য? মো ইয়ানের লেখা কী চিনা কোনো ধর্ম মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে? মো ইয়ান পড়তে গেলে চমকে উঠতে হয়, যে আরে এ তো দেখি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতোই কায়দাকানুন মানুষকে ও জনসমাজকে হাজির করার ক্ষেত্রে।
আমাদের দেশে জাদুবাস্তববাদ হাল আমলে সাহিত্য-ফ্যাশান হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মনে হয় জমে যাওয়ার আগেই থিতিয়ে আসছে কিনা! কারণ জীবন এখন এত যান্ত্রিক ও নাগরিক হয়ে উঠেছে, যে ফের মহাবাস্তববাদেই আমাদের ফেরত আসতে হবে। কারণ জীবনের মৌলিক সংকটগুলো তো যায়নি। তারপরও ইলিয়াস, নাসরীন জাহান প্রমুখের লেখায় কেউ এর লক্ষণ খুঁজতে আগ্রহী। বিশেষ করে শহীদুল জহিরের গায়ে তো বাংলাদেশের মার্কেসের তকমাই সেঁটে দেওয়া হয়েছে, যা একেবারেই অমূলক। তিনি একান্তই শহীদুল জহিরীয়। তাঁর বয়নকৌশলে রচনারীতিতে নবউপন্যাসের লক্ষণও আছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও সৈয়দ শামসুল হকের রচনারীতির সম্মিলিত প্রভাবও আছে; কিন্তু তিনি মার্কেসীয় সাহিত্য বাংলায় ফলিয়েছেন—এটা ঠিক নয়। যেমন, ওয়াল্টার স্কটের চেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র অনেক বড় লেখক। কিন্তু বঙ্কিমকে বলা যায় ‘বাংলার স্কট’। এসব আমাদের হীনমন্যতার প্রকাশ ছাড়া আর কী! আমাদের লেখা যদি একালে জাদুবাস্তববাদী না হয় তো কি কোনো অসুবিধা হবে তাতে?
মোজাফ্ফর হোসেনের সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের সমকালীন জাদুবাস্তব গল্প’ নামে একটা গল্পসংকলন বেরিয়েছেন। লক্ষণীয় তিনি কিন্তু ‘জাদুবাস্তববাদী গল্প’ বলেননি। বহু আগে আলম খোরশেদের সম্পাদনায় যে বইটি যাদুবাস্তববাদী গল্পের সংকলন হিসেবে বেরিয়েছিল, তা থেকে আমরা এর স্বাদ পেলেও এর ব্যাকরণটা ধরতে পারছিলাম না। ফলে একটু গবেষণা করে দেখতে হয়েছে বিষয়টি আসলে কী। তাতে করে এই রচনাশৈলী আয়ত্ত করা খুব সোজা বলে মনে হয়নি। যেমন উইলিয়াম ফকনারের লেখাকে ইম্প্রেশনিজম ছাড়া বোঝা মুশকিল। নইলে ফকনার পড়ে তালগোল পাকিয়ে যাবে। ফলে তত্ত্ব কিছু মানদণ্ড দেয় যা দিয়ে কিছুটা বোঝা যায় সাহিত্যের কোনো কিছুকে। কিন্তু তাতেও তো পুরোটা ধরা যায় না। বেকেটে আপনি বহু কিছু পাবেন। বাখতিনের তত্ত্ব পরবর্তীকালে বহু কিছুকে প্রভাবিত করেছে। মনে করেন, জাদুবাস্তববাদ থেকে আমাদের নতুন প্রণোদনা যদি পাওয়া হয়, সাহিত্যের নতুন মাত্রা যদি তৈরি হয় তাতে কাজ হতেও পারে। জাদুবাস্তববাদ তো শেষ কথা নয়।
খোরশেদ আলম : আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার সৃষ্টিশীল মূল্যবান সময় কেড়ে নেয়ার জন্য আন্তরিকভাবেই দুঃখিত। কিন্তু কথা তো বলতেই হবে…এ এক অনন্য শিল্পিত নিয়তি…
হামীম কামরুল হক : আসলে এসব আলাপে সমান্তরাল টেক্সট/প্যারালাল টেক্সট তৈরি হয়। আমাদের সাহিত্যচিন্তাভাবনাকে বোঝার নানান নিরিখ তৈরি হয়। ফলে এগুলি অকার্যকরী কিছু নয়। এগুলিও সাহিত্যচর্চার অংশ। কিন্তু লেখকের কাজ আসলে লেখা। সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যসমালোচনা ঠিক সাহিত্যিকদের প্রধান বিষয় নয়। কিন্তু এ পোড়া দেশে যিনি এখানে সাহিত্যরচনা করেন, তাকেই সাহিত্যতত্ত্বের কাজও গুরুত্বের সঙ্গে করতে হয়, তাকেই সাহিত্য সমালোচনাও লিখতে হয়। সাহিত্যিকরা কিছু গদ্যরচনা করতেই পারেন। রবীন্দ্রনাথ তো করেইছেন। কিন্তু তাতে বঙ্গদেশে সাহিত্যের তত্ত্ব বা সমালোচনার রীতি তৈরি হয়েছে কি?
নর্থথ্রপ ফ্রাই সুন্দর করে এটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সাহিত্যের ক্রিটিসিজম পড়া বা করা আসলে ঠিক সাহিত্য পাঠ নয়। বড় অর্থে যদিও সেসবও সাহিত্যের অংশ। মার্কস কি এম.এন. রায় কি দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বী কি সুধীর চক্রবর্তীর রচনা পড়াও সাহিত্য।
আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ।
হামীম কামরুল হক, কথাসাহিত্যিক; শিক্ষক, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
খোরশেদ আলম, লেখক; শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।