বুদ্ধদেব বসু সেই কবি, যিনি আধুনিকতার এক প্রবল-পরাক্রমী বোধকে মমার্থ দিয়ে গ্রহণ করতে ও করাতে সক্ষম ছিলেন। আমরা তাঁর প্রভুত সমালোচনা আজকের যুগে বসে করতে পারি। কিন্তু তাঁর সহজ, হার্দিক, মন্দ্রমধুর প্রকাশের কাছে ঋণ-স্বীকারে বিকল্প দেখি না। আমরা অনেকের প্রশংসা করেও, বাস্তবে, কাব্য-পাঠে ভালোলাগাতে পারি না, ব্যর্থ হই। সেক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু নিরঙ্কুশভাবে আমাদের কালের ভালোলাগার কাব্য-নায়ক। কারণ আমরা তাঁর কবিতা বা গদ্য আজও আনন্দচিত্তে পাঠ করি। ভাষার তীব্র মাদকতায় মোহাবিষ্ট ও আকর্ষিত হই। এ-মনোভাবকে সমালোচনার বাইরে রাখতে হয়তো অপারগ হবেন অনেকেই। আমাদের আজকের এই আলাপটি বুদ্ধদেব বসুর প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে যতটা, তার চেয়েও বরং কী কারণে তাঁর সমালোচনা করা যায়, তারই অভিপ্রকাশ। আজ এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছি, বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে যাঁর বেশ জানাশোনা রয়েছে। তিনি শূন্যদশকের একজন কবি, গান লিখতেও ভালোবাসেন। সর্বোপরি তাঁর নিজের লেখাপত্র ও বই রয়েছে বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে।
১. আত্মগত আত্মবিরোধ
খোরশেদ আলম : বুদ্ধদেব বসুর আত্মগত ভাষা, কাব্যের মোহনীয় ব্যঞ্জনা প্রবল আকর্ষণ তৈরি করে। একটা উচ্ছ্বলতা, প্রাণশীলতা তাঁর অনন্য শব্দ-সেতারে বেজে চলে। পাঠকমনে আনন্দবেদনার সুর ঘন হয়। গদ্যেও তিনি সব্যসাচী শিল্পী। বিষয় হিসেবে প্রেম ও যৌনতা তাতে প্রতিষ্ঠিত। তারপরেও অনেকে বলেন, প্রেমের কবিতায় বুদ্ধদেব বড় নিষ্প্রভ। এই আত্মবিরোধের কারণ কী মনে হয় আপনার কাছে?
তারেক রেজা : বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে আপনার বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের অধিকাংশেই আমার সম্মতি আছে। তবে তাঁর প্রেমের কবিতা সম্পর্কে ‘অনেকে’র বরাত দিয়ে আপনি যা বলেছেন, তাতে আমি একমত নই। এই মতবিরোধ প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা হিসেবে আমি জীবনানন্দের শরণ নিতে চাই। তিনি বলেছেন, কবিতা অনেকরকম। যদি তাই-ই হয়, তাহলে তো অনেক রকম পাঠকের উপস্থিতিও আমাদের স্বীকার করতে হবে। তাঁর সমস্ত প্রেমের কবিতাই যে অসাধারণ দীপ্তি-সমৃদ্ধ কালজয়ী সৃষ্টি, সে-দাবি আমি করছি না। কিন্তু অনেক কবিতাই তো এখনো অনেক পাঠকের মর্মে মুদ্রিত আছে, বিশেষ মুহূর্তে স্মৃতি থেকে গড়গড় করে বেরিয়ে আসে বুদ্ধদেবের প্রেমের কবিতার কিছু ম্যাজিক লাইন। পূর্ণ কবিতাও কারো কারো মনে-মগজে চিরস্থায়ী হয়েছে। অনেক উদাহরণ হাজির করা যাবে। আপাতত তাঁর দুইটি কবিতার নাম করি—‘একখানা হাত’ ও ‘চিল্কায় সকাল’। অভিজ্ঞতা, বয়স ও রুচির তারতম্য-ভেদে কবিতার নাম হয়তো বদলে যেতে পারে। কিন্তু প্রেমের কবিতার একনিষ্ঠ কারিগর হিসেবে বুদ্ধদেবকে মনে না-করে আমাদের উপায় নেই। মুক্তি নেই—একথা হয়তো বলা যায়। কারণ বুদ্ধদেব তো প্রেমকে, বিশেষ করে প্রেমের কবিতাকে আত্মমুক্তির হাতিয়ার হিসেবেই হাজির করেছেন।
দুইটি শব্দের ওপর আপনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন—‘আত্মগত’ ও ‘আত্মবিরোধ’। বুদ্ধদেবকে এই দুইয়ের কোনো একটিতে ফেলে বিচার করা খুবই বিপজ্জনক। শুধু বুদ্ধদেব কেন, যে-কোনো মানুষের মধ্যেই তো এই দুটি ধারা গঙ্গা-যমুনার মতো সতত বহমান থাকে। প্রশ্নটি যদি তাঁর প্রেমের কবিতার সাপেক্ষে গ্রহণ করি, তবে তাতে ‘আত্মগতে’র পাল্লাই হয়তো ভারি হবে। কারণ এই সমুদ্রে তিনি যে নৌকা ভাসান, সেই নৌকায় বুদ্ধদেব ছাড়া আর কোনো মাঝি-মাল্লা নেই। প্রেয়সীর উপস্থিতি কিংবা উদ্দামতার কথা হয়তো অনেকে বলবেন। আমি বিবেচনায়, সেই প্রেয়সীও একান্তভাবে বুদ্ধদেবেরই সৃষ্টি। বাইরের বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে বুদ্ধদেবের নায়িকাদের নেড়েচেড়ে দেখার ইচ্ছে যারা করবেন, তারা হতাশ হবেন।
আত্মবিরোধ প্রসঙ্গে বলা যায়—এই প্রবণতার ভেতর দিয়েই একজন মানুষকে আত্মগত হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হয়। বিচিত্র সংশয়-সন্দেহের দোলাচলকে দায়িত্বের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়। নানা পথের গোলকধাঁধাঁর ভেতর থেকে বেছে নিয়ে হয় একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পথ। তাতে ভুল হয় না এমন নয়। কিন্তু বুদ্ধদেব সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যিনি ভুলকেও ফুলের সৌরভ ও সমৃদ্ধি দিতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রেমের প্রসঙ্গে আপনি যৌনতার সংশ্লেষ স্মরণ করেছেন। খুবই প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক এই অনুধাবন। এ-বিষয়ে আলাপ করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ এবং রবি-প্রভাবিত কবিবৃন্দের সঙ্গে বুদ্ধদেবদের বিরোধ-ভিন্নতার দীর্ঘ ইতিহাস আলোচনা করা দরকার। কিন্তু বাংলা কবিতার পাঠকমাত্রই তা কমবেশি জানেন। বুদ্ধদেবের নারীরা কল্পনাপ্রসূত বা মস্তিস্কজাত বলে দাবি করেছি আমি। কিন্ত পাঠকের কাছে তারা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে। অর্থাৎ যা-কিছু আমরা স্পর্শাতীত বলে ভাবতে শিখেছি, বুদ্ধদেব তাকে স্পর্শের সীমায় এনে হাজির করতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় যখন যৌন-চেতনা, দেহবাসনা, স্পর্শকাতর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর্যুপরি ব্যবহারের একটি কারণ সম্ভবত এই। আরো অনেক কারণ নিশ্চয়ই আছে। সব বলতে গেলে আমাদের আলাপচারিতার লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
২. স্বতোশ্চল নাকি স্থির?
খোরশেদ আলম : পঞ্চপাণ্ডব নামক বর্গটাতে সবাই যে যাঁর মতো স্বতন্ত্র। সে-অর্থে বুদ্ধদেব বসুও স্বতন্ত্র। আধুনিক কবিতা প্রকাশ্যে যা বলে, তারও চেয়ে বেশি বলার ক্ষমতা রাখে। এটা তাঁর নিজেরই অভিমত। তবুও বুদ্ধদেব বসু কাব্যে আধুনিকতার ক্রম-বিবর্তমান অর্থকে সঙ্গী করেও একধরনের স্থিরতার কাছে যেন পৌঁছে গেলেন। এটা কি কবি হিসেবে ভাষা-আঙ্গিকের চর্চা অব্যাহত রাখার পরেও তাঁর আত্ম-সমাধি?
তারেক রেজা : আমার কাছে কিন্তু এর উল্টোটা মনে হয়। বুদ্ধদেব বরং অস্থিরতাকেই আমৃত্যু অন্তরে লালন করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন, ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরেরও পিয়াসী।’ এই চাঞ্চল্য ও দূরের তৃষ্ণাকে বুদ্ধদেব তাঁর মতো করে বুকের ভেতর ধারণ করেছেন। বুদ্ধদেবের স্থিরতা যদি তাঁর কবিতার ভাষা বা প্রাকরণিক কাঠামোর সাপেক্ষে অন্বেষণ করা হয়, তাহলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। চিন্তা ক্ষেত্রে, আপনি যেটাকে আধুনিকতার ক্রম-বিবর্তমান অর্থ’ বলছেন, সেখানে তত্ত্ব ও তথ্যের নানা আঘাত-আবর্তন লক্ষ করা যাবে। বুদ্ধদেব কিন্তু তত্ত্ব-তথ্যের গোয়ার্তুমিতে খুব বেশি পাত্তা দিতে চাননি। আধুনিকতার উপলব্ধি তাঁর কাছে অন্যরকম। চিত্ত ও চিন্তাকে বিশেষ কাঠামো বা কারাগারের চৌহদ্দি থেকে মুক্তি দেয়ার মধ্যেই আধুনিকতার মুক্তি বা উদ্ধার বলেছেন তিনি। সরাসরি কোথাও বলেছেন কি-না, এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। কিন্তু তাঁকে পাঠ করার অভিজ্ঞতা থেকে বুদ্ধদেবের আধুনিকতা-বিষয়ে এই রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
ভাষা-আঙ্গিকের বিশেষত্ব নিরূপণের ক্ষেত্রে আমরা এমন কিছুই তো খুঁজি যা থেকে একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়। ভাষার বদল কাঁচা-বাজারের আলু-পেঁয়াজ-সব্জির মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল নয়। বদল নিশ্চয়ই হয়, তবে তার গতি অতি ধীর। বুদ্ধদেবের কবিতার ভাষায়ও এই পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। তবু তাঁর কবিতার ভাষা তাঁরই ভাষা, যার সঙ্গে অন্য কাউকে মেলানো যাবে না। নদী যেমন বাঁক বদলের কিছু চিহ্ন রেখে যায়, তেমনি বুদ্ধদেবের কবিতার ভাষার গতায়াতেও আমরা কিছু চিহ্ন খুঁজে পাই। এই চিহ্ন কিছুতেই স্থিরতার দ্যোতক নয়।
আত্ম-সমাধির প্রশ্নে আমি খুব বেশি কথা বলতে প্রস্তুত নই। আমি বরং ‘আত্মসমাহিত’ শব্দটির পক্ষে। এই শব্দে আত্মমগ্নতার একটি আবহ সঞ্চিত আছে বলে মনে হয় যা একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য, বিশেষ করে কবির জন্য অপরিহার্য বলেই আমি বিশ্বাস করি। সমাহিত হওয়ার প্রথম শর্তই বোধ করি, নিজের ভেতর ডুব দেয়া। লালন যে-রকম বলেন, ‘আপনাকে আপনি চিনে নে।’ আধ্যাত্মিকতার খোলস ঝেড়ে ফেললেও এই উচ্চারণ তার তাৎপর্য হারায় না। নিজের ভেতর থেকে কবি যা-কিছু উদ্ধার করেন, তা যে কেবল তাঁর ভেতরেই গচ্ছিত ছিল—এরকম দাবি করা ভুল হবে। বাইরের অনেক বস্তু-চিন্তা-ভাব-কল্পনার একটা বিরাট ভাণ্ডার তিনি সঙ্গে নিয়ে যান। ভেতর থেকে যখন তিনি বাইরে এসে দাঁড়ান, তখন তাঁর উচ্চারণ আমাদের মনে মুগ্ধতা ছড়ায়। মুগ্ধতা ছড়ানোর সমুদয় উদ্দীপক তো কবি তাঁর ব্যবহৃত শব্দের শরীরেই গেঁথে দেন। ফলে আপনি যে আত্ম-সমাধির কথা বলছেন, তাতে মুক্তিরও ইঙ্গিত আছে এবং এই মুক্তি কখনোই যুক্তির মানদণ্ডে বিচার্য নয়। রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলি, ‘হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব’। বুদ্ধদেব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দ্বারে হাত পাতার এই শিক্ষাও আমরা বুদ্ধদেব থেকেই পেয়েছি।
৩. কবিতার শত্রুমিত্র
খোরশেদ আলম : জাগতিক অন্যান্য বিষয়ের মতো কাব্য-জগতেও শত্রু-মিত্রতার শেষ নেই। যতটা বুঝি, তিনি তাঁর সময়ে শত্রু-মিত্র বিবেচনার চাইতে কাব্যমূল্যটাই আগে বিচার করতেন। আজকাল সাহিত্য-জগতে গোষ্ঠীতন্ত্র বলে একটা অপবাদ চালু হয়ে গেছে? বুদ্ধদেব বসুর শত্রুমিত্র/গোষ্ঠী বিবেচনা কতটা ছিল বলে মনে হয়?
তারেক রেজা : শত্রু-মিত্রতার এই ব্যাপারটি বোধকরি পৃথিবীরই সমান বয়সী। তখন ছিল, তার আগেও ছিল, এখন আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। আপনি যথার্থই বলেছেন, বুদ্ধদেব কাব্যমূল্যটাকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজের শত্রুকে চিহ্নিত করে তাকে নিরস্ত্র করার লড়াই তিনি খুব একটা করেননি। কিন্তু অন্য অনেক কবির শত্রুদের তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন—শত্রুপক্ষকে আঘাত বা আক্রমণ করে নয়, বরং স্পর্শ করে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই বৈরিতা শেষ পর্যন্ত সুখকর কিছুই উপহার দেবে না। তাঁর সমকালের কিংবা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অনেক কবিকে নিয়েই তিনি প্রাণ খুলে লিখেছেন, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারণার বাইরে গিয়ে তাঁদের প্রতিভার উজ্জ্বলতম দিকগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন। ফলে আগে যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাদের অনেকেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, মনও বাড়িয়েছেন কেউ কেউ।
বুদ্ধদেব বিশ্বাস করতেন, শেষ পর্যন্ত কবিতাই স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠকচিত্তে চিরস্থায়ী হবে। আর যা-কিছু তা কেবল, কথার কথা—ক্ষণস্থায়ী আলোড়ন-আস্ফালনমাত্র। কবিতার পাঠক হিসেবে আমরা জানি, পৃথিবীর অন্য যে-কোনো শিল্পমাধ্যমের তুলনায় কবিতাই অধিকতর সহনশীল, অর্থাৎ পরমত-সহিষ্ণু। এ-কারণেই পাঠকচিত্তে কবিতার নবজন্ম ঘটতে পারে, কবির অভিপ্রায়কে অতিক্রম করেও কবিতা কালজয়ী হয়ে উঠতে পারে। বুদ্ধদেবের কাব্যভাবনার প্রতিনিধিত্বশীল প্রবণতা চিহ্নিত করতে গেলে শত্রু-মিত্র কিংবা গোষ্ঠী-বিবেচনার বাইরে দাঁড়ানো দরকার, নইলে পদে পদে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হতে হবে।
৪. নিরপেক্ষতার প্রশ্নে
খোরশেদ আলম : বুদ্ধদেব বসু আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনে কতটা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ? বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি সেখানে স্থান পাননি এমন কথা তো মিথ্যে নয়? কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি ‘শিশুসুলভ প্রতিভা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
তারেক রেজা : কবিতার পাঠ, অনুধাবন, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন ব্যক্তি-নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয়। কবির কাছে ব্যক্তি-নিরপেক্ষতার দাবি নিয়ে হাজির না-হওয়াই নিরাপদ। একথা কবিতার পাঠকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনের যে বুদ্ধদেব, তাঁকে আমি কবি বুদ্ধদেব বলতে প্রস্তুত নই। সেখানে তিনি কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক। পাঠের যে-অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তা ও রুচিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে, তারই প্রভাব লক্ষ করা যাবে সেই সংকলনে। বাংলাদেশ কিংবা ভারত তাঁর বিবেচনায় সক্রিয় ছিল কি-না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কবিতা নির্বাচনে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন, আত্মনিষ্ঠ এবং অহংকারী—নজরুলের ভাষায় বলতে গেলে ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’ ফলে আধুনিক বাংলা কাব্য সংকলনের কবিবৃন্দ ও কবিতাসমূহ মাথায় রেখে বুদ্ধদেবকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের সিদ্ধান্ত বিষয়ে আপনি প্রশ্ন তুলেছেন। আজকের দিনে বুদ্ধদেবকে পাঠ করার লোকের সংখ্যা বাস্তব কারণেই কমে এসেছে, যে-রকম কমেছে অন্য কবিদের বেলায়ও। কিন্তু বুদ্ধদেবকে পাঠ না করেও তাঁর একটি সিদ্ধান্তের বরাত দিয়ে তাঁকে হেনস্থা করতে ছাড়ে না। নজরুলের প্রতি ভক্তিবশতই বুদ্ধদেবের প্রতি এই অবিচার। এই নজরুল-ভক্তিও যে তাঁকে পাঠ করার অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত নয়, তা আমরা জানি। কিন্তু সে-আলোচনা অন্য অবসরে করা যাবে। আপাতত এইটুকু বলে রাখি, নজরুলের সাহিত্যচিন্তা, সমাজভাবনা, রাজনৈতিক দর্শন—এসবের বিপরীত শিবিরেই অবস্থান করতেন বুদ্ধদেব। ফলে কবিতার কাছে তাঁর প্রত্যাশা ছিল অন্যরকম, যা নজরুলের কবিতায় বরাবরই অনুপস্থিত থেকেছে। তাতে বুদ্ধদেব কিংবা নজরুল, কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। প্রতিভাবান বালক বলায় নজরুলের নিন্দা করা হয়েছে বলে যারা দাবি করেন, তারা হয়তো খেয়ালই করেননি যে, নজরুল সম্পর্কে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মূল্যায়ন বুদ্ধদেবই করেছেন, বলেছেন, সব সত্ত্বেও এ-কথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।’ যে-বৈশিষ্ট্যের কারণে নজরুলের কাব্যাদর্শের এই প্রকৃতি ও পরিণতি, তাও তো বুদ্ধদেবই প্রথম চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নজরুল বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের পটভূমির ভিন্নতায়।’ বুদ্ধদেবের এই মূল্যায়নে কবিতা ও জীবনের সম্পর্কের প্রগাঢ়তা স্বীকৃত হয়েছে।
নজরুলের গানের বৈভব-বৈচিত্র্য বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত আমাদের চোখে পড়ে না। বুদ্ধদেবও লিখেছেন, ‘নজরুলের সমস্ত গানের মধ্যে যেগুলি ভালো সেগুলি সযত্নে বাছাই করে নিয়ে একটি বই বের করলে সেটাই হবে নজরুল-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয়; সেখানে আমরা যাঁর দেখা পাবো তিনি সত্যিকার কবি, তাঁর মন সংবেদনশীল, আবেগপ্রবণ, উদ্দীপনাপূর্ণ।’ বিদ্রোহী কবি সাম্যবাদী কবি, সর্বহারার কবি বলে যে নজরুলকে আমরা চিনি, তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পড়াশোনার, বিশেষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার; কিন্তু গানের কবি নজরুলকে প্রতিদিনের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির, স্বপ্ন-কল্পনার, সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের, দুঃখ-দীর্ঘশ্বাস ও আনন্দ-অভিমানের। এই নজরুলের সঙ্গে আমাদের কখনো বিচ্ছেদ ঘটবে বলে মনে হয় না। বুদ্ধদেবও সে-রকমই বলেছেন, ‘কালের কণ্ঠে যে মালা তিনি পরিয়েছেন, সে-মালা ছোট হলেও অক্ষয়।’ নজরুলের সমগ্র শিল্পসৃষ্টির মধ্যে তাঁর গানের গুরুত্ব ও গভীরতা বিষয়ে সেকাল-একালের অধিকাংশ নজরুল ভক্ত এবং নজরুল-গবেষক তো এ-রকমই মত দিয়েছেন। তাঁর কবিতার বিশ্বে প্রবেশ করলে অনেকেই অস্বস্তি বোধ করেন, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব মেলাতে পারেন না। তাতে নজরুলের কবিত্ব বা কৃতিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। নজরুল যা করতে চেয়েছেন তাই করেছেন—তাঁর কবিতায় যা নেই, তার চেয়ে তাঁর কবিতায় যা আছে তাঁর গুরুত্ব অবশ্যই অধিক। আবার জীবনানন্দের কথা স্মরণ করি—কবিতা অনেকরকম। পাঠকের কথা আর না-ই-বা বললাম।
৫. রবীন্দ্রনাথে নৈবেদ্য, রবীন্দ্রনাথে মালিন্য
খোরশেদ আলম : রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা কাব্য পরিচয় বইটা প্রকাশ করেন, তখন বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর একটা মতান্তর তৈরি হয়। বুদ্ধদেব সেই কবি, যিনি রবীন্দ্র-সাহচর্যে থেকেছেন, আজীবন তাঁর ঋণকে স্বীকার করে গেছেন। অন্যদিকে বহুবার এমন হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সরাসরিই তাঁর মনোমালিন্যের প্রকাশটাও ঘটেছে।
তারেক রেজা : আপনার মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, এ-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এ-বিষয়ে আমার আগের বক্তব্যই প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধদেব মতান্তরে বিশ্বাস করতেন, মনান্তর প্রত্যাশা করতেন না। রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেবের সম্পর্ক নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা কঠিন। আলোচনা জরুরিও নয়, কারণ এ সম্পর্কে আমাদের সকলেই কমবেশি জানাশোনা আছে। ‘আমার কাছে, প্রত্যেক আধুনিক বাঙালি লেখকের কাছে, —কিন্তু বিশেষ ক’রে আমার কাছে আপনি দেবতার মতো।’—এই হলেন বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সমগ্রতাকে স্পর্শ করার চেষ্টায় আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন তিনি, বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেই জাতের লেখক, সমগ্রভাবে না-দেখলে যাঁকে চেনাই যায় না।’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাষায় যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সিদ্ধিদাতা গণেশ, তাঁর সম্পর্কে বুদ্ধদেবের স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘রবীন্দ্রনাথ সেই অমরবৃন্দের অন্যতম, যাঁর বিষয়ে নির্ভয়ে বলা যায় যে, সাহিত্যের আদর্শে যতই পরিবর্তন ঘটুক, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কারণে তিনি সমাদৃত হবেন এবং কোনো না কোনো কারণে প্রতি যুগ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবে।’ রবীন্দ্রনাথের লড়াইটা বুদ্ধদেবের মতো করে আর কেউ উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধিসাধনে রবীন্দ্রনাথের অবদান বিষয়ে বুদ্ধদেবের সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে—‘যেহেতু ভাষা ছিল অপেক্ষাকৃত অপরিণত বাংলা, তাই সমগ্র বাংলা সাহিত্যের দায়িত্ব তাঁকে নিতে হয়েছিল। শুধু কবিতা লেখা নয়—তাঁকে সৃষ্টি করতে হলো ভাষা, ছন্দ ও রূপকল্প।’ কবি বুদ্ধদেবের চেয়েও সমালোচক বুদ্ধদেব আমাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন যখন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’, ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’, ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি বইয়ের কাছে যাই।
আপনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বুদ্ধদেবের মনোমালিন্যের কথা বলেছেন। আমি অবশ্য মনোমালিন্যের পরিবর্তে ‘মান-অভিমান’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের পক্ষে এবং এই মান-অভিমানকে দেবতার ওপর ভক্তের আক্ষেপ বা মনোবেদনার বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ে বুদ্ধদেবের বইপত্র পড়লেও সেটা বোঝা যায়। চিন্তা ও রুচির ভিন্নতার কারণেই যেহেতু বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথের পথ থেকে অনেক দূরে এসেছেন, সঙ্গত কারণেই দুজনের সিদ্ধান্তে বৈপরীত্য ধরা পড়বে। রবীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেবের এই বিরোধ-বিতর্কে অনেকেই অংশ নিয়েছেন, নিজেদের ইচ্ছের অনুকূলে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সেটা ভিন্ন বিবেচনা। বুদ্ধদেবের মতো করে রবীন্দ্রনাথকে পাঠ ও আস্বাদন করেছেন—বাংলা সাহিত্যে এমন লেখকের তালিকা খুব দীর্ঘ হওয়ার কথা নয়।
৬. মাইকেল কি আধুনিক কবি?
খোরশেদ আলম : মাইকেল মধুসূদন দত্তের আধুনিকতা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তা মানলেন না। তাঁর সম্পর্কে অভিযোগের একটা হলো—শব্দের তাৎপর্যের চেয়ে ধ্বনিগত বিষয়ের দিকেই নাকি মাইকেলের অধিক নজর!
তারেক রেজা : মাইকেল মধুসূদন দত্তের আধুনিকতা নিয়ে দ্বিমত না-থাকাটাকে আমি খুব ইতিবাচক মনে করি না। মধুসূদনের আধুনিকতার ধারণার সঙ্গে তাঁর কালের অনেক কবিরও তো ভিন্নমত লক্ষ করি। কিন্তু তাঁদের কাউকেই আমরা কবিতার আসনে অপাঙক্তেয় মনে করি না। মধুসূদন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিবেচনা-মূল্যায়নের কথাও আমরা এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। তাতে মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথ—কারো আধুনিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। আধুনিকতা আমাদের সেই শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে যার ওপর ভর করে আমরা নানা ‘মীমাংসিত’ বিষয়েও আপত্তি তুলতে পারি, খারিজ করতে পারি, নতুন সিদ্ধান্তের প্রস্তাব করতে পারি। বুদ্ধদেবের বিবেচনাও এর অধিক কিছু নয়। ‘শব্দের তাৎপর্যের চেয়ে ধ্বনিগত বিষয়ের দিকেই নাকি মাইকেলের অধিক নজর!’—মাইকেল সম্পর্কে এই অভিযোগ কি বুদ্ধদেব একাই করেছেন? আজকের পাঠকের মনেও কি এই প্রশ্ন ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’ না? বুদ্ধদেবের প্রশ্ন বা সিদ্ধান্ত তাই বলে মাইকেলের কবিত্ব বা কৃতিত্বকে খারিজ করে না। কবি হিসেবে মধুসূদনের একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতাকেই চিহ্নিত করে মাত্র।
৭. বুদ্ধদেব বসু কি সামাজিক কবি?
খোরশেদ আলম : বুদ্ধদেব বসু তো কলাকৈবল্যবাদী। দীপ্তি ত্রিপাঠীর মতো মানুষ যখন বলেন, “বুদ্ধদেব বসু ব্যক্তিজীবনে বিশ্বাসী, বিষ্ণুদে-র মতো বিরাট সামাজিক জীবন তাঁর মনকে আকৃষ্ট করেনি।” তিনি আসলে রাজনীতি-সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে নীরব থাকতে পছন্দ করতেন। কিন্তু এখনকার যুগে এসে সবাই আমরা রাজনীতি-সচেতন। প্রবলভাবে সমাজ-রাষ্ট্র আমাদেরকে, আমাদের কবিতাকে প্রভাবিত করছে। সেখানে বুদ্ধদেবের কবিতা নিয়ে একধরনের ‘অনড় বিশুদ্ধতা’ কি ‘আত্মপরতায় বন্দি থাকা নয়?
তারেক রেজা : আজকের দিনে এসে বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে দীপ্তি ত্রিপাঠীর সিদ্ধান্ত বা বিবেচনাকে বেদবাক্য ভাবার কোনো অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। তাঁর বিবেচনা কতোটা তাঁর চিত্তপ্রসূত আর কতোটা পরিকল্পনাজাত, তার কিছু খোঁজখবর এতোদিনে পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে। কিন্তু সেটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা বরং বুদ্ধদেব বসুর কাছে ফিরে যাই। আপনার বিবেচনায় বুদ্ধদেব কলাকৈবল্যবাদী। আপনার এই সিদ্ধান্তে আমারও সায় আছে। কিন্তু কলাকৈবল্যবাদের প্রকৃতি ও পরিসরকে আমি একটু বিস্তৃত করে নেয়ার পক্ষে। এই বিস্তৃতির ধারণাও আমি বুদ্ধদেব থেকেই গ্রহণ করেছি। সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত—‘সব সাহিত্যই রচিত, প্রকাশ মাত্রেই উপায় নৈপুণ্যের মুখাপেক্ষী। তার সার্থকতা নির্ভর করে অবিশ্বাসের অপনোদনে, পাঠক ও শ্রোতার মনে সম্মোহ সৃষ্টির ক্ষমতায়।’ এই অনুধাবনের বিপক্ষে লড়াই চলে না। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কালজয়ী কবিতা ‘ছবি’র একটি পঙক্তি খুব মনে পড়ছে—‘বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি?’ বুদ্ধদেব ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ বলতে কিছু আছে বলে বিশ্বাস করতেন না। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, “‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটাও অর্থহীন, কেননা মানুষ ছাড়া কে-ইবা আছে তার স্রষ্টা বা ভোক্তা—স্পষ্টত মানুষের জন্যই শিল্প। স্পষ্টত মানুষের জন্যই শিল্পকলা। স্পষ্টত মানুষের পক্ষে তা প্রয়োজন, যেমন প্রয়োজন ধর্ম ও সমাজনীতি ও বিজ্ঞান—তেমনি কিন্তু ভিন্নভাবে, ভিন্ন কারণে। নীতিশিক্ষা নয়, জ্ঞান লাভ নয়, সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য নিশ্চয়ই নয়, মানুষের আত্মার পক্ষে, দেহ প্রাণ ও মনের সমন্বয়ে রচিত তার সামগ্রিক সত্তার পক্ষে অবিচ্ছেদী এক প্রয়োজন।’ ফলে যে-বিতর্কের দীর্ঘ রেখা দিয়ে আমরা শিল্পসাহিত্যের বাইনারি-বিবেচনাকে সক্রিয় রাখি, তার অস্তিত্ব বাস্তব ক্ষেত্রে সবসময় দৃশ্যমান হয় না।
সমাজজীবনে বুদ্ধদেবের অবিশ্বাস বিষয়ে একটা গভীরতর অভিযোগ প্রায়শই উত্থাপিত হয়। আপনিও নিশ্চয়ই তা লক্ষ করেছেন। বুদ্ধদেবের বিরুদ্ধে এই অভিযোগকে শক্তপোক্ত করার জন্য তাঁর বিপরীতে দাঁড় করানো হয়, তাঁরই সমকালের আরেক শক্তিমান কবি বিষ্ণু দে-কে। কেউ কেউ আবার আরেকটু সামনে এগিয়ে সমর সেনের কথাও বলেন। কারণ সমর সেন খানিক পরে কবিতার মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেও তাঁদের কাব্যচর্চার সময় খুবই কাছাকাছি। এই বিচার-বিবেচনার সারবত্তা বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। যে জীবনবোধ ও শিল্পদৃষ্টি বুদ্ধদেবকে বিক্ষত করেছে, তাঁর অন্তর্গত সৃষ্টি-সম্ভাবনাকে সার্থক করে তুলেছে, তার সঙ্গে অন্য কারো মিল না-হওয়াটাই অধিকতর স্বাভাবিক, সঙ্গত। একই সময়ে পৃথিবীর সমুদয় বৃক্ষ একই ফল উপহার দেয় না। একই কালের কোনো নদীর জল বহন করে বেড়ায় পলিমাটি, আবার অন্য নদীর জল এতো স্বচ্ছ যে, নিজের চেহারাটাও স্পষ্ট দেখা যায়। একইভাবে সমাজজীবনের কথা বিষ্ণু দের মতো বুদ্ধদেবের সাহিত্যকর্মে নেই। একজন সাহিত্যস্রষ্টার সমাজজীবন সম্পর্কে বুদ্ধদেবের বিবেচনা একটু ভিন্ন রকম। সমাজের প্রথাবদ্ধ বিধি-নিষেধের বাইরে এসেই একজন স্রষ্টাকে নিজের ভাব-চিন্তা-কল্পনার উপযোগী একটি পৃথিবী নির্মাণ করে নিতে হয়। তিনি বলেছেন, মানুষ যখন সামাজিক তখন পৃথিবীর আর দশটা প্রাণির মতোই, অর্থাৎ জীবমাত্র। যখন সে নিজের অস্তিত্বের ভিন্নতর কোনো দীপ্তি অন্তরে অনুভব করতে থাকেন, তখন সে অন্য সবাইকে অতিক্রম করে যায়। অর্থাৎ অন্যের সঙ্গে তার সম্পর্কের সমাজ-সিদ্ধ সম্পর্কের সূত্রটি ছিন্ন হয়ে যায়। আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতার যে-বেদনা আমাদের শিল্পসাহিত্যে রূপায়িত হতে দেখি, তার বীজ বোধকরি এই বিচ্ছিন্নবোধের গভীরেই প্রোথিত।
সমাজ-রাজনীতির দায় এড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু কেবল অন্তর আর আসমানের (আসলে কল্পনার) দিকে দৃষ্টি প্রসারিত রেখেছেন এমন নয়। মাটি ও মানুষের কবি হিসেবে আমরা যাঁদের জানি, বুদ্ধদেবও তাঁদের মতো নিজেকে সাধারণ, বঞ্চিত বা ব্রাত্য ভেবেছেন। তাঁর বিবেচনায়, ‘শিল্পী স্বভাবতই ব্রাত্য; কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ে ভর্তি হওয়া, কোনো সংঘবদ্ধ মতবাদ গ্রহণ ক’রে সেই মতেই নৈষ্ঠিকতা বাঁচিয়ে চলা—এটা তাঁর প্রকৃতির পক্ষে অনুকূল নয়। অন্য সমস্ত চিন্তার ধারা বর্জন ক’রে তিনি যদি একান্তভাবে একটিমাত্র মতবাদেই দীক্ষা নেন—সে-মতবাদের নিজস্ব মূল্য যা-ই হোক না—তাহ’লে তাঁর দৃষ্টি ব্যাহত হবার, ব্যক্তিত্ব সংকুচিত হবার আশঙ্কা থাকে।’ বাংলা কবিতার অভাজন হিসেবে আমার বিশ্বাসও অনেকটা এই-রকম।
আমার বক্তব্য হলো, বুদ্ধদেব তাঁর মতো করে মানুষের কথা বলেছেন এবং সেই মানুষও নিশ্চয়ই সমাজেই বসবাস করে। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ-বদলের কোনো সম্ভাবনা দেখেননি বুদ্ধদেব। এ-কারণেই উপযোগিতামূলক সাহিত্য রচনায় তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাই বলে তাঁকে জীবনবিমুখ ভাবলে মর্মান্তিক ভুল হবে। তিনি বরং জীবনের দিকেই মুখ ফেরানোর কথা বলেছেন, জীবনের শক্তি ও সম্ভাবনার বিচিত্র দিক উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন, ‘আমি যদি কবি হই তাহলে কবি হিসেবে আমার কর্তব্য ভালো কবিতা লেখা, তা ছাড়া কিছু নয়, জীবনের সঙ্গে সেই আমার যোগসূত্র। আবার বৈরি বাস্তবতায় বিক্ষত মানুষের মর্মবেদনা তাঁর সময়ের আর সকল সৃষ্টিশীল মানুষের মতো তাঁকেও রক্তাক্ত করেছে, বলেছেন, ‘আজ পৃথিবী ভ’রে লোক যখন তার বীভৎসতম মূর্তিতে প্রকট তখন আমরা কবিরা, শিল্পীরা স্বভাবতই, নিজের প্রকৃতির অদম্য টানেই, ঐ বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো—এর মধ্যে রাজনীতির কোনো গূঢ়তত্ত্ব নেই, আমাদের মনুষ্যত্বের, কবিচরিত্রের এটা ন্যূনতম দাবি।’ ফলে সমাজবিমুখতা, রাজনীতি-নিস্পৃহতা ইত্যাদি অভিধা বুদ্ধদেব বসুর মতো সৃষ্টিশীল মানুষের ব্যক্তিত্বের ব্যাকরণ অনুধাবনে বিশেষ কোনো অবদান রাখে না।
আপনি একালের মানুষের রাজনীতি-সচেতনতা সম্পর্কে বলেছেন। আপনার বক্তব্যে আস্থা রাখতে পারলে খুব খুশি হতাম। আমরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি, অর্থাৎ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাই কিন্তু মাথাকে রাজনীতির উপযোগী করে তৈরি করি না। মেরুদণ্ডের যত্ন-আত্তির কোনো আগ্রহই আমাদের মধ্যে নেই। যাদের মধ্যে রাজনীতি-সচেতনতা আছে বলে আমরা চিন্তা করি, তারাও রাজনীতিকে ব্যক্তিগত লাভালাভের মানদণ্ডেই গ্রহণ কিংবা বর্জন করেন। রাজনীতিতে যে বৃহত্তর স্বার্থের সম্ভাবনা সক্রিয় থাকে তাতে আস্থা রাখলে আমাদের জীবন ও সৃষ্টির পথে পথে এতো পাথর ছড়ানো থাকতো না। সমাজ-রাষ্ট্র আমাদের জীবন ও কবিতাকে প্রভাবিত করছে না, বরং গ্রাস করছে। এই আগ্রাসনের স্বভাব ও প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা আছে, আপাতত চুপ করে যাওয়াই নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত।
বুদ্ধদেবের কবিতায় বিশুদ্ধতার দাবি নিশ্চয়ই আছে, তবে তাকে ‘অনড়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়তো সঙ্গত হবে না। কবিতায় ব্যক্তি-মানুষের আক্ষেপ-আর্তনাদ, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অনুরণন অধিক—একথা স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ব্যক্তি-মানুষ বলতে আমরা যাকে চিহ্নিত করতে চাই, তিনি তো ভিন্ন গ্রহের কেউ নন। বুদ্ধদেবের কবিতার মানুষগুলো সজাগ-সক্রিয়-স্বতঃস্ফূর্ত বলেই তাঁর কবিতায় বিম্বিত বিশ্বের দোলাচলতা পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। আত্মপরতা কিংবা আত্মমগ্নতাও তো অনেকটা আত্মসমাহিত হওয়ার মতো। আত্মপরতায় নয়, বুদ্ধদেব বন্দি ছিলেন কবিতায়, তাঁর ভাষায়, ‘বাল্যকাল থেকে জেনেছি আমি কবি, আমি সাহিত্যিক, আমার মধ্যে যা-কিছু ভালো যা-কিছু খাঁটি তা রচনাচর্চাতেও একান্তে প্রয়োগ করেছি।’ কেবল ভালো নয়, আরো ভালো লেখার ইচ্ছার গভীরে প্রোথিত তাঁর ‘সমস্ত জীবনের মূল প্রেরণাশক্তি’। বুদ্ধদেবের এই শক্তিকে ‘আত্মপরতা’র দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেললে ক্ষতি আমাদেরই।
২য় পর্বের লিঙ্ক : কবি তারেক রেজার সঙ্গে আলাপ (পর্ব-২)