আজ এমন একজন বোদ্ধা মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, জাদুবাস্তববাদ নিয়ে যাঁর বেশ স্পষ্ট বোঝাপড়া রয়েছে। তিনি নিজে লিখেছেন ‘জাদুবাস্তববাদ’ নামক গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। ফলে, কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হকের ১ম পর্বের এই আলাপের কথাগুলো নানা কারণেই অনুপেক্ষণীয়। আরো এজন্য বলছি, এ-বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বেশ শক্ত ব্যাপারই বৈকি। এ-বিষয়ে সরস আলোচনা ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’-র মতোই রহস্যময়। তবুও অনেক কিছু সহজ করে বলার অভিপ্রায় এখানে রয়েছে।
[বর্তমান তত্ত্ববিশ্বে একটি যুগান্তকারী ও সাড়া জাগানো শিল্প-দর্শন হিসেবে জাদুবাস্তববাদের ভূমিকা অন্যান্য তত্ত্বের তুলনায় ঈর্ষনীয়। আমাদের জীবন—বেঁচে থাকা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ফ্যান্টাসি, এমনকি বোর্হেসের মিনোটরের মতো গোলকধাঁধা কিংবা বাস্তবাতিরেক পরিস্থিতির মতোই খানিকটা। এসবের মধ্যে বসে উপলব্ধি করা জগতে এই তত্ত্ব এখন অবিসংবাদিত। কথাসাহিত্যই যেন বর্তমান যুগের মহাকাব্য। এই মাধ্যমটার মধ্যে জাদুবাস্তববাদ এতো প্রভাববিস্তারী যে, একে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু আমাদের দেশে লেখক-পাঠকের এক জটিল খেলায় এ-তত্ত্ব বদহজমের শিকার। তারপরও মনে রাখা জরুরি, সাহিত্য বা আর্ট কোনো তত্ত্ব দর্শনের তাবেদারি তো করেই না বরং খোদ তত্ত্বকেই নির্মাণ করতে সাহায্য করে। জ্ঞানের বিশেষায়িত রূপ থাকলেও সব শাস্ত্রই একীভূত হয়ে প্রকৃত জ্ঞান তৈরি করে। তত্ত্ব পাঠে বিমূঢ় হয়ে আর সম্মোহিত হতে হতে একথাটা আমরা প্রায় ভুলতেই বসি। যদিও জাদুবাস্তববাদী সাহিত্য নিজেই এক সম্মোহন, তবুও, আলাপ শুরু করার আগে স্বয়ং মিথ হয়ে ওঠা জাদুবাস্তববাদ, স্বাতিক্রমী যে নয়—কথাটা স্মরণ রাখা স্বাস্থ্যপ্রদায়ী।]
১. বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের
খোরশেদ আলম : “মৃত্যুুর ভেতর কিছু নেই—এ নিয়ে তেমন চিন্তাও করি না, বরং বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্যের ব্যাপার।”—কথাটা যেন কার? ‘জাদুবাস্তববাদ’ নামক বইটাতে আপনি নিজেই উল্লেখ করেছিলেন। বেশ চমকিত হয়েছিলাম কিন্তু পড়ে…
হামীম কামরুল হক : কথাটা ঠিক কার এখন মনে পড়ছে না। মনে হয় দুতিনজনের কাছে এর কাছাকাছি কথাই শুনেছি। মৃত্যু মানে মুক্তি। জীবনযন্ত্রণার ইতি। যন্ত্রণা যেখানে, রহস্যও সেখানে। যেমন ভয়। ভয় আসলে কী? ভয় আসলে ‘ভয়ের চিত্র’ বা ভাবনা-ছবি মনে তৈরি করামাত্র। ভয় জিনিসটা হলো ভয়ের চিন্তা। জাদুবিশ্বাস থেকে যে ধর্মের উৎপত্তি তার ভেতরেও আছে এই ভয়। যদি ভয় না থাকে তাহলে জীবনে বলতে গেলে আর কিছুই থাকে না। ভয়ই বলতে গেলে জীবন-যন্ত্রণার মোক্ষম বিষয়। অনেকেই জানেন, ক্ষুধা, রোগ, শোক, উদ্বেগ আরো যা যা সব কিছু হাত থেকে মুক্তি হয়, যদি ভয় থেকে মুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু এটা কীভাবে হওয়া যায়, তাও এক রহস্যই। আপনি-আমি বললাম, যে, ‘‘হে মানুষ, ভয় পেয়ো না। ভয়ের কোনো মানে নেই। ভয় করবেন না।’’—ওমনি কি লোকে ভয়ের হাত থেকে মুক্ত হয়ে যাবে? মানুষ তো ভয় পেতে ভালোও বাসে। বাচ্চারা ভূতের গল্প শোনে। বড়রা হরর মুভি বানায়, দেখে।—এও এক ভয়। কিন্তু জীবনের গভীর তলে যে ভয়, সেখান থেকে বাকি সব কিছুর উদ্ভব। জাদু এবং জাদুবাস্তবতাও এই উদ্বেগ ও ভয়ের ফল।
২. জাদুই জীবন নাকি জীবনই জাদু
খোরশেদ আলম : ধরুন, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠছি। দুপুরে ঘুমিয়েও অনেক সময় বিকেলে উঠছি। এদিকে আমাদের টাইম-টেবল সত্যি বদলে গেছে! কথা সেটা নয়। কখনো দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ধড়মড় করে উঠে পড়ি, তখন কিন্তু জীবনটা সত্যিই আশ্চর্য মনে হয়।
হামীম কামরুল হক : সুস্থ থাকাটাই তো বিস্ময়কর। নব্বই বছরের একজন মানুষ, দেখা যাবে তিনি নিজের কপালে একটু চুলকাবেন, তার হাতটা উঠছে, কিন্তু দেখা গেল থরথর করে কাঁপছে, কিছু লিখতে গেলেও কাঁপছে।—এই পরিণতি তরুণ বয়সে চিন্তাও হয়তো কেউ করেন না। ফলে আমরা যখন অসুস্থ হই, তখনই জীবনের স্বাদ পাই। টের পাই বেঁচে আছি, কিন্তু আরো ভালো করে বেঁচে থাকতে হবে। অসুখ আমাদের জীবনমুখী করে তোলে।—এটা জানি না অদ্ভুত কথা হলো কিনা। কিন্তু এটাই। ফলে অসুখ আর সুখের একটা সেতু আছে, সেটা হলো সঞ্চারের সেতু। সাহিত্য সেই সঞ্চার দিতে পারে। বিস্ময় ও বাস্তবতা মিলিয়ে সাহিত্য নতুন জগৎ তৈরি করে। আমাদের সত্তার স্তরায়ণ ঘটায়।
৩. আর্ট জীবনের জাদুটাকেই আড়াল করে কি?
খোরশেদ আলম : এমন অনেকবার হয়েছে নিজের মৃত্যুর স্বপ্ন দেখে হতচকিতের মতো জেগে উঠেছি। তখন মনে হতো নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। এমনও হয়েছে, বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তান বা নিকটাত্মীয়-বান্ধবের মৃত্যু দেখছি। কিন্তু ঘুমটা ভাঙলে জীবনটা অন্য অর্থ নিয়ে এসেছে। নিজের মৃত্যুটা তো ভয়াবহ জাদু। সবাই আমাকে খাটলিতে করে নিয়ে যাচ্ছে কবরের দিকে। তার আগে গোসল ও কাফনের কাপড় পড়ানো হচ্ছে। আমি সবই দেখতে পাচ্ছি। অন্যদিকে কে কী ভাবছে, কী আচরণ করছে, কী কথা বলছে আমাকে নিয়ে, সেসবও কিন্তু অবজার্ভ করছি।
হামীম কামরুল হক : হয় তো, এমন বহু লোকেরই বেলায় ঘটে। কত বিচিত্র স্বপ্ন দেখে মানুষ। তার অবদমিত বাসনা, তার উদ্বেগ-আকাঙ্ক্ষা কত কিছুর চাপ মানুষকে স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের জগতে ফেলে দেয়। বোর্হেসের কথার শরণ নিয়ে বলতে চাই, আর্ট হলো স্বপ্নকে ভাষায় বা রঙে অনুবাদ করে দেওয়া। আবার এর ভেতরে আড়ালও থাকে। সব বলে ফেলার, বা সব রহস্য ফাঁস করায় তো মজা নেই। মানুষ সমস্যা ভালোবাসে। রহস্য ভালোবাসে। রস তো জীবনের সর। তাতে রহস্য মিশেই থাকে। ফলে বলা হয়, যদি সব সমস্যা জগৎ থেকে দূর করে দেওয়া যায়, তখন মানুষ পাজেল নিয়ে বসবে। কিউব নিয়ে বসে মেলাবে। মানুষ নিজেই কত কিছু ভেঙে, আবার গড়তে চায়। শিশুদের বালির বাড়ি বা এখন ওই প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরি কী সব আছে না! ফ্রয়েড বলেছিলেন, লেখক শিল্পীরা তো বড়-শিশু। প্রাপ্তমনস্ক শিশুমাত্র। এই ভাঙা-গড়ার খেলাই তাকে সৃষ্টিশীল রাখে।
মানুষ সাধারণত সমস্যা ছাড়া থাকতে পারে না। সমস্যা মানে গণিতে যেমন ‘সমস্যা’, দর্শনেও যেমন। মানুষের সমস্যা চাই, নইলে সে অস্তিত্বকেই বোধ করতে পারে না। আমি আমাকে অনুভব করব, যে আমি আছি, সেই ‘আছি’র জন্য বিচিত্র সমস্যা চাই। সাহিত্যও তো সমস্যা। ফুয়েন্তেস বলেছিলেন, পবর্ত ডিঙানোর শ্রম দিতে পারলেই তো সাহিত্যস্বাদ পাওয়া যায়। সাহিত্যের স্বাদ অমৃততুল্য। যারা তা পায় জানে তা কী! অমৃতের স্বাদ পাওয়া নিশ্চয় অনায়াস বা সস্তা কোনো বিষয় নয়।
৪. পরাবাস্তব নাকি জাদুবাস্তব
খোরশেদ আলম : আমার কাছে একসময় ওপরে যা উল্লেখ করেছিলাম—ওই মৃত্যুময় ব্যাপারগুলো আরকি—সবই পরাবাস্তব মনে হতো। কিন্তু জাদুবাস্তববাদ যেদিন থেকে জানলাম, মনে হলো, আসলে অলৌকিকতা আর রহস্যময়তার ভিন্ন নাম আর আবহ থাকতেই পারে।
হামীম কামরুল হক : আসলে সবই বাস্তবতাকে বুঝতে চাওয়ার মানদণ্ড। দেবেশ রায়ের কথায় ‘অবজারভেটরি’। আমরা নাম দিই, একই জিনিসের কদিন পর আলাদা নাম দিতে পছন্দ করি। ‘উত্তরাধুনিকতা’য় আগের নানান বিষয়ের নাম নতুন করে দেওয়া হয়েছে। ইহাব হাসানের লেখাপত্র পড়লে পাঠকরা সেসব জানতে পারবেন।
নাম দেওয়া মাধ্যমে আমরা একটা সময়চৈতন্যকে যোগ করে দিই, নতুনমাত্রা আনি। জাদু, জাদুবাস্তবতা আগেও ছিল, কিন্তু সেটা যখন জাদুবাস্তববাদ হয়ে উঠল তখন তাতে নতুন মাত্রা লাগল। আধুনিকতার তত্ত্ব দিয়ে, যুক্তি দিয়ে একে খারিজ করা যায়। রোবের্তো বোলানিয়োর মতো লেখকরা জাদুবাস্তববাদকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন। তিনি একে এঁদো গন্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বোর্হেস এবং কোর্তাজারের নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যরচনার দিকে ফিরতে চেয়েছেন। বোলানিয়ো-র উপন্যাস ‘দ্যা স্যাভেজ ডিটেকটিভ’ বা ‘২৬৬৬’ মধ্যে দিয়ে সেটি ভালো করে টের পাওয়া যায়, তিনি যেটাকে আন্ত্রিকবাস্তবতা বলেন, সেদিকেই যেন আসতে চেয়েছেন। আগামীতে বোলানিয়োকে উড়িয়ে দিয়ে আবার নতুন কোনো মানদণ্ড তৈরি হবে হিস্পানি সাহিত্যে।
এখানে বলে রাখা ভালো, আমাদের এশীয় কোনো সাহিত্যধারা কী আছে? এশীয়াতে এত দেশ, এত জাতি এত ভাষা, তাদের সমাজ ও ঐতিহ্য সুপ্রাচীন, কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে এশীয় ধারা আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি? সেখান থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার দিকে তাকিয়ে আমরা নানান জনের সাহিত্যকর্মের দিতে হা করে তাকিয়েছি। কিন্তু আমাদের মনে হয় নিজেদের সাহিত্যের দিকে আবার ফেরা দরকার। আমাদের দেশেই তো তারাশঙ্করের মতো লেখক ছিলেন,(অথচ চিনুয়া আচেবে নিয়ে লোক মাতামাতি করে, বহু আগে যা তারাশঙ্করে পাওয়া যাবে) বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে অতি-আধুনিকবাদীরা তাঁকে গেঁয়ো বলে ঠাট্টা করেছে, কিন্তু এই তারাশঙ্করের ধারায় সিক্ত হওয়া সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ যুগান্তকারী ‘অলীক মানুষ’ লিখেছেন। ইলিয়াসে মানিকের প্রভাব আছে ছোটগল্পে, অথচ ‘খোয়াবনামা’ কিন্তু তারাশঙ্করীয় ধারার লেখা। তারাশঙ্করে কিন্তু নানান অলৌকিক বিষয়াদি পাবেন, কিন্তু তা জাদুবাস্তববাদী নয়। ফলে আমাদের কেবল পশ্চিমের দিকে তাকালে চলবে না। আমাদের ভাণ্ডারেও বিস্ময়ের ও বাস্তবতার অনেক কিছু মজুত হয়ে আছে।
৫. ফ্যান্টাসি আর গোলকধাঁধা
খোরশেদ আলম : এই যে ফ্যান্টাসি, তা তো ‘রোমান্টিক সাহিত্যে’র বৈশিষ্ট্য। আবার পরাবাস্তবের মধ্যেও এক ধরনের গোলকধাঁধা থাকে। তাহলে ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজমে’র সঙ্গে পার্থক্যটা আসলে কোথায়? বোর্হেসের মিনোটরের মতো ধাঁধাময় বাস্তব তো নানাদেশের সাহিত্যেই তৈরি হয়েছে। যেমন মারিও বার্গাস ইয়োসার ‘সৎমায়ের প্রশংসা’, আবার ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র তমিজের মধ্যেও কিন্তু পরিস্থিতিগত মিল পাচ্ছি।
হামীম কামরুল হক : রোমান্টিকতা তো উন্মাদনা, মনের উদ্দাম মুক্তি ও মুক্ত প্রকাশ। গ্যোয়েটে বলেছিলেন, ‘‘The classical is health; and the romantic, disease.’’ মানে, ক্ল্যাসিক যদি স্বাস্থ্য হয়, তো রোমান্টিক হলো ব্যাধি বা ব্যামো। কিন্তু আমরা এখন বুঝতে পারি, সবেতে সব মিলে মিশে গেছে বা আছে। রোমান্টিক চেতনা ছাড়া ক্ল্যাসিক হয় নির্জীব, আবার ক্ল্যাসিক চেতনা ছাড়া রোমান্টিক হয় তরল/অসংহত। আগেই বলেছি, বাস্তবতাকে বোঝার একটা মানদণ্ড হলো জাদুবাস্তববাদ। একটা অভিব্যক্তি যাতে বাস্তবটা সবচেয়ে শৈল্পিক মাত্রা নিয়ে হাজির হয়। ওই হাতের স্পর্শ পেয়েই পাত্রের তরল রঙিন হলো, বোঝা গেল মনে রঙ লেগেছে, মানে প্রেমে পড়েছে উইলেসেস, ‘সরলা এরিন্দেরা ও তার নিঠুর দাদিমা’ গল্পে আছে এমন। কিন্তু ‘কর্নেলকে কেউ লেখে না’ নভেলেট তো পাক্কা বাস্তববাদী। মার্কেস এখানে তো জাদুবাস্তববাদ খেলাননি।
সাহিত্য প্রাণ পায় তার ভেতরের জোরে। সেটা হয়ত ক্ল্যাসিক, রোমান্টিক, আধুনিকবাদী নানান চোঙের ভেতর দিয়ে চুইয়ে আনা হয় নতুনত্ব তৈরি করতে , নতুন করে বলবে, ‘ হাউ টু সে’, কীভাবে বলার ভেতরে একটা ওই যে সময়চৈতন্য (জাইদগাইস) প্রকাশ পায়। সময়ের চিহ্ন তো সাহিত্যে লেগেই থাকে। ফলে পার্থক্যটা অভিব্যক্তিতে। নতুন করে বলায়। অমিয়ভূষণ তো মনে করতেন, তার লেখায় জাদুবাস্তববাদ আছে। সাহিত্যে যা ঘটে জীবনে তা তো ঘটে না। ফলে সেটাই জাদু। তিনি রুশদের ওই দস্তয়েভস্কির ভেতরেও এর প্রকাশ আছে বলে মনে করেছিলেন।
৬. রূপকথা এবং ফ্যান্টাসি
খোরশেদ আলম : একটি দেশের জাতীয় সাহিত্যে রূপকথা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। অন্যদিকে ফ্যান্টাসি জাদুবাস্তববাদ শুধু নয়, রোমান্টিকতাবাদেরও মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এদিকে জাদুবাস্তববাদে যে-বাস্তবতার কথা বলা হয়, সেটা নিয়তি-নির্ভর বা বাস্তব-বিবর্জিত নয়। তাই না?
হামীম কামরুল হক : রূপকথা আকাঙ্ক্ষা পূরণের রচনা: অতঃপর তাহারা সুখে দিনাতিপাত করিতে লাগিল। অন্যদিকে, জাতীয় সাহিত্য তো জাতীয় জীবনের সংকট-আশা-আকাঙ্ক্ষাকে হাজির করে। ‘অ্যা বয় মিটস অ্যা গার্ল’ সেখানে অংশ হতে পারে। বা দেখা গেল, তাদের প্রেমের পথে বাধা হয়ে উঠছে সব ধর্মঘট, রাজনৈতিক গোলযোগ, মহামারী সেসবও হতে পারে। কলেরা কি করোনার দিনগুলোতে কি প্রেম হয় না/ হবে না?
কোনটা জাতীয় সংগীত হতে পারে, আর কোনটা তা হতে পারে না—এ থেকেই বুঝে নেওয়া যেতে পারে কী আমরা জাতীয় সাহিত্যের লক্ষণ হিসেবে দেখতে পারি। ফ্যান্টাসি মুক্তমনের উন্মাদনা-মতো। কল্পনার ফানুস উড়িয়ে সুখবোধ। ইচ্ছাপূরণ যদিও নয়, উন্মত্ত ক্রোধও এতে এসে পড়ে। যেমন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’। কিন্তু এতে তো প্রেমও আছে। প্রেমের তীব্রতা আছে বলেই দ্রোহ আছে। বলা হয় না, প্রেম আসলে ঘৃণার আড়ালে মোড়ানো একই বিষয়, নইলে সম্পর্কের অবনতি হলে তা কী প্রচণ্ড ঘৃণায় রূপ নেয় না? দেশপ্রেমেও, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রেমেও ঘৃণা মিশে থাকে। বিশ্বাসের বিপরীতে অবিশ্বাসেও এটা এভাবেই মিশে থাকে। বাংলা প্রবাদে আছে, ‘হিঁদু যখন যবন হয়, গরুখোরের যম হয়।’ ফলে ভেতরে সব বিদ্যমান। কেবল পরিস্থিতিমতো প্রকাশ ভিন্ন।
ফলে জাদু আসলে সবচেয়ে স্বাভাবিক সত্য বলে যেটা মনে হয় সেটাকেই অভিব্যক্ত করে। প্রসঙ্গত বলি, মার্কেস সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাস’ নাকি চারশো বার পড়ছেন। নিয়তি, বাস্তবতা, আরো কত কিছুর যে ইশারা কি প্রকটতা এ নাটক থেকে হাজার বার পাওয়া যায়, তা যারা এ নাটকটি বার বার পড়বেন, বুঝতে পারবেন। এরিস্টোটল সাধে তো আর ট্রাজেডিকে মহাকাব্যের চেয়ে উন্নততর বলেননি! উপন্যাসকে আবার এপিক, ট্রাজেডি ও কমেডিকে হুবহু এর কোনো রূপে না গিয়েও এই তিনে মেশা এক বিষয় বলে মনে হয়। উপন্যাসের সবচেয়ে বড় জিৎ হলো এটা ‘ওপেন’(বিদিশা), মহাকাব্যের মতো ‘ক্লোজড’(দিশা) নয়। উপন্যাস সেদিক থেকে রোমান্টিকদের মতো উন্মুক্ত।
২য় পর্বের লিঙ্ক : https://wp.me/p46zKa-VU
কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক
জন্ম ২২ জানুয়ারি ১৯৭৩। নব্বই দশকরে মাঝামাঝি থেকে লেখালেখি করছেন। তিনি লিখে চলছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সমালোচনা। এছাড়াও করছেন অনুবাদ ও গবেষণামূলক কাজও। বর্তমানে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। এর ভেতরে উপন্যাস: রাত্রি এখনো যৌবনে (২০০৮, কাগজ প্রকাশন), গোপনীয়তার মালিকানা (২০১০, ভাষাচিত্র), রক্ত অশ্রু ঘাম (২০১৬, বেহুলাবাংলা), আবছা আলোয় দেখা কয়েকটি মুখ (২০১৭, কথাপ্রকাশ), মঙ্গলবারের জন্য অপেক্ষা (২০১৮, পেন্সিল), চারু তাপসের আবেগ ও অর্জন (২০১৮, দেশ প্রকাশনী), দীর্ঘশ্বাসের সমান (২০১৯,গ্রন্থকুটির)। দুটো নভেলার সংকলন: গোলাপের সিঁড়ি (২০১২, ত্রৈবিদ্য)। ছোটগল্পগ্রন্থ: শূন্যপরান ও অন্যান্য গল্প (২০১৩, রোদেলা), অক্ষরপুরুষ ও অন্যান্য গল্প (২০১৭, গ্রন্থকুটির), আচ্ছন্নতার বাগান (২০১৮, গ্রন্থকুটির)। প্রবন্ধগ্রন্থ: ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতি ও অন্যান্য বিবেচনা (২০১৭, কথাপ্রকাশ)। গবেষণাগ্রন্থ: মৃত্যুক্ষুধা : গতি প্রকৃতি ও পাঠবিবেচনা (২০০০, নজরুল ইন্সটিটিউট), জাদুবাস্তববাদ (২০১৬, সংবেদ)। সম্পাদনা: লেখার শিল্প, লেখকের সংকল্প (মুহম্মদ সাইফুল ইসলামের সহযোগে, ২০১৭, দ্বিতীয় সংস্করণ, সংবেদ)।
২০০৭ সালে রাত্রি এখনো যৌবনে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির জন্য তিনি পেয়েছিলেন ‘কাগজ তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার’। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রতি আগ্রহের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই তাঁর। তিনি বিশ্বাস করেন, ভালোবাসাই হলো জগতের সমস্ত প্রশ্ন, সমস্যা ও সংকটের একমাত্র উত্তর। তিনি বাংলাদেশের নৌবাহিনী উচ্চবিদ্যালয় চট্টগ্রাম থেকে প্রাথমিক, সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উর্ত্তীণ হন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর; পরর্বতীকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে ‘তুলনামূলক নাট্যতত্ত্ব’ বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করছেন।
খোরশেদ আলম, লেখক; শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।