বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে আলাপ (পর্ব-২)

১ম পর্বের লিঙ্ক https://wp.me/p46zKa-1aC


২য়/শেষ পর্বের আলাপচারিতা

১ম পর্বের আলাপে উঠে এসেছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। ২য়/শেষ পর্বের মধ্য দিয়ে আজকের মতো বুদ্ধদেব বসুর কথা সমাপ্ত হয়ে যাবে। তবে পাঠকের সাড়া পেলে, মন্তব্য দ্বারা উৎসাহ প্রদান করলে, আমরা বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে আলাপচারিতায় মগ্ন হতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি কোনোকিছু সম্পর্কে স্পষ্ট হওয়ার জন্য প্রশ্ন করা বা প্রশ্ন তোলা জরুরি। প্রশ্নের ভেতর দিয়ে/তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে জানাটা পরিপূর্ণতার দিকে যেতে থাকে।


৮. ধ্রপদী সাহিত্য ও বুদ্ধদেব বসু

খোরশেদ আলম : বুদ্ধদেব বসুর কালে ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্য নিয়ে বেশ ঐতিহ্যবাদী একটা অনুভব ছিল। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুকে মনে হয়েছে, তিনি সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে মোটাদাগে খুব একটা উচ্ছ্বসিত নন। মহাভারতের কথা বইটা কিন্তু আধুনিক-মানবীয় অর্থে বুদ্ধদেব বসুর নতুন পাঠ। মেঘদূতেরও তিনি অনুবাদক। কিন্তু রামায়ণ নিয়ে অন্তর্গত বেশ জটিলতার কথা উপস্থাপন করেছেন।

তারেক রেজা : আপনি যথার্থই বলেছেন। এই ঐতিহ্যবাহী অনুভব-উপলব্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে সমকালীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানবিক বিপর্যয়। ভয়াবহ বর্তমান থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় সমৃদ্ধ অতীতের দিকে মুখ ফেরানো। সেই সমৃদ্ধি বাস্তবানুগ হোক কিংবা কল্পনাজাত। ধ্রুপদী সাহিত্যের বিচিত্র অনুষঙ্গ, কালজয়ী রচনার বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা—এই প্রবণতা বুদ্ধদেবের কালেও নিশ্চয়ই চোখে পড়বে। বুদ্ধদেবদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সাহিত্যকর্মে ধ্রুপদী সাহিত্যের পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমরা জানি। বুদ্ধদেবের সহযোদ্ধাদের কারো কারো রচনায়ও এই ধারার অনুবৃত্তি দেখা যায়। বুদ্ধদেব নিজেও রামায়ণ-মহাভারতসহ নানা কালজয়ী সাহিত্যকর্ম ও ধর্মগ্রন্থ থেকে কাহিনি ও চরিত্রের সারাৎসার গ্রহণ করে নিজের অভিপ্রায়ের অনুকূলে নির্মাণ বা পুনর্নিমাণ করেছেন। ‘কঙ্কাবতী’, ‘দময়ন্তী’, ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের নামকরণ খেয়াল করুন। মনে করার চেষ্টা করুন তাঁর বিভিন্ন নাটকের নাম—‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’, ‘কলকাতার ইলেকট্রা’, ‘সত্যসন্ধ, ‘প্রথম পার্থ’ ইত্যাদি। এসব রচনার নামকরণই বলে দেয়, পৌরাণিক পৃথিবীর সঙ্গে অত্যন্ত গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাঁর। সম্পাদক কিংবা অনুবাদক হিসেবেও তাঁর এই ঘনিষ্ঠতার পরিচয় মিলবে।

বুদ্ধদেবের অনুবাদে প্রকাশিত ‘কালিদাসের মেঘদূত’ কাব্যের কথা আপনি নিজেই বলেছেন। কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের যে-ভূমিকা তিনি লিখেছেন, তা থেকে আমরা সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে বুদ্ধদেবের বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত অনুধাবন করতে পারি। সংস্কৃত কবিতার সঙ্গে আমাদের যে-বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেই বিচ্ছেদের কারণসমূহ তিনি নির্দেশ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের প্রায় ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে যে সংস্কৃত ‘‍মৃত ভাষা’ হলেও তার সাহিত্য জীবন্ত।” তাঁর মতে, ‘সংস্কৃত কবিতা সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম, আদর্শ ও তত্ত্বের দিক থেকে তা-ই, অভ্যাসের দিক থেকেও তা-ই।’ আধুনিক কবিতার কৃত্রিমতার কথাও তিনি স্বীকার করেছেন। যুক্তি-তর্কই কেবল নয়, বিস্তর উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন, ‘আধুনিক কবিতা অন্ততপক্ষে স্বাভাবিকের অভিনয় করে, আর সংস্কৃত কবিতা সগর্বে কৃত্রিমতাকে অঙ্গীকার করে নেয়।’ বুদ্ধদেবের রামায়ণের কথা নিয়ে আপনি যথার্থই বলেছেন, আধুনিক ও মানবীয় অর্থে তা নতুন পাঠই বটে। শুধু মহাভারতের কথাই নয়, রামায়ণ-মহাভারত অবলম্বনে কিংবা এর কোনো বিচূর্ণ অংশ বা ছায়া অবলম্বনে তিনি যা-কিছু রচনা করেছেন, সবই সেই অর্থে নতুন পাঠ—স্বকালের বাস্তবতায় সেকালের ঘটনার স্মরণ কিংবা সেকালের কোনো চরিত্রকে একালের পরিবর্তিত স্বদেশ-পরিস্থিতি ও বিশ্বব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করানো। রামায়ণ নিয়ে বুদ্ধদেবের যে-মূল্যায়নের কথা আপনি উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ রামায়ণ জটিলতায় ভারাক্রান্ত বলে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ‍বুদ্ধদেব, তা সর্বাংশে সত্য ও যথার্থ বলে মনে করি আমি। শুধু আমি কেন, রামায়ণের যে-কোনো পাঠকই নিশ্চয়ই তা স্বীকার করবেন। ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যকে সহজে গ্রহণ করার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এ-ক্ষেত্রে ভক্ত বুদ্ধদেব দেবতা রবীন্দ্রনাথের কথা রেখেছেন বলে মনে হয়।

৯. ছোটোদের লেখা

খোরশেদ আলম : একবার অবনীন্দ্রনাথের ছোটোদের লেখা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেন, “তিনি ছোটোদের বই লিখতে গিয়ে সকলের বই লিখে ফেলেছেন।” অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের ছড়া সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বসিত বক্তব্য পাওয়া যায়। তিনি নিজেও তো ছোটোদের ছড়া লিখেছেন।

তারেক রেজা : কেবল অবনীন্দ্রনাথের ছোটদের লেখাই নয়, যে-কোনো সফল তথা কালজয়ী শিশুসাহিত্যকেই বুদ্ধদেব কেবল ছোটদের রচনা বলে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ প্রবন্ধটি পড়লেই এ-বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধদেব বসু শিশুসাহিত্যের স্বতন্ত্র কোনো শ্রেণিকরণে সম্মত ছিলেন না। তিনি লিখেছেন, `এমন মত পোষণ করা সম্ভব যে শিশুসাহিত্য স্বতন্ত্র কোনো পদার্থ নয়, কেননা তা সত্যিকার সাহিত্য হ’লে বড়োরাও তাতে আনন্দ পান, আর সাবালক— এমনকি আবহমান সাহিত্যের একটি অনতিক্ষুদ্র বিচিত্র অংশের ছোটোরাও উত্তরাধিকারী। যে-সব গ্রন্থ চিরকালের আনন্দভাণ্ডার, ছোটোদের প্রথম দাবি সেখানেই—সেই মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেল, আরব্যোপন্যাস, বিশ্বের পুরাণ, বিশ্বের রূপকথা, আর সেইসঙ্গে আধুনিক কালের ভাস্কর চিত্রাবলি—ডন কিহোটে, রবিনসন ক্রুসো, গালিবার। শিশুসাহিত্যের বড়ো একটি অংশ জুড়ে এরাই আছে; এই অমর সাহিত্যের প্রবেশিকাপাঠ শিশুদের আদ্যকৃত। পক্ষান্তরে মৌলিক শিশুগ্রন্থ তখনই উৎকৃষ্ট হয়, যখন তাতে সর্বজনীনতার স্বাদ থাকে।’ বোঝা যায়, শিশুসাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন তিনি। এই প্রবন্ধে শিশুসাহিত্য নিয়ে তাঁর যে অভিব্যক্তি, তা কেবল তাঁর শিশু-বয়সে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত বলে মনে হয় না। অর্থাৎ পরিণত বয়সেও তিনি কালজয়ী শিশুপাঠ্য বইগুলো আস্বাদন করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র-মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, কুলদারঞ্জন, সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, অন্নদাঙ্কর রায় সহ আরো অনেক কালজয়ী শিশুসাহিত্য-স্রষ্টার বিখ্যাত সব শিশুতোষ রচনার উল্লেখ করেছেন তিনি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন শিশুবোধ্য ছড়া ও গল্পের কথাও এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের শিশুতোষ রচনার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বুদ্ধদেব। ‘বাংলা শিশুসাহিত্য’ প্রবন্ধে এই ভক্তির প্রমাণ মেলে। তবে এ-ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে এগিয়ে আছেন অবনীন্দ্রনাথ। বুদ্ধদেবের বিবেচনায়, ‘রবীন্দ্রনাথ দূর থেকে শিশুকে দেখেছেন, তার সঙ্গে বিচ্ছেদবোধে ব্যথিত হয়েছেন, বার-বার তৃষিত হয়েছেন তাকে ফিরে পাবার জন্য। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথে এই বিচ্ছেদটাই কখনো ঘটেনি।’ তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথের শৈশব-সাধনা অন্য অনেক কিছুর মতোই একটি দিক মাত্র, কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ সর্বস্ব দিয়ে শিশুদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন, অর্থাৎ এটাই তাঁর সাহিত্য-সাধনার প্রধানতম দিক।

বুদ্ধদেব বসু ছোটোদের জন্য খুব বেশি সময় ব্যয় করেছেন বলে মনে হয় না। ‘ঘুমের সময়’, ‘চম্পাবরণ কন্যা’, ‘পরিমল-কে’, ‘পরি-মার পত্র—বাবাকে’, ‘পরি-মার পত্র—রুমিকে’, ‘পাপ্পার জন্মদিনে’, ‘প্রজাপতি’, ‘বারো মাসের ছড়া’, ‘বিদ্যাসুন্দর’, ‘রামধনু’, ‘রুমির পত্র—বাবাকে’, ‘ডলারের ছড়া’, ‘হাওয়ার গান’, ‘নদী-স্বপ্ন’, ‘আকাশ-স্বপ্ন’, ‘পরিরা’  ইতাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ ছড়া-কবিতা। ছোটদের জন্য বেশকিছু ছোটগল্পও লিখেছেন তিনি। ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প নামের একটি সংকলনের কথা এ-প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে। ‘প্রাইজ’, ‘ঘুমপাড়ানি’, ‘নিরক্ষরতা দূর করো’, ‘মহাযুদ্ধ ও শশীনাপিত’, ‘প্রথম দুঃখ’, ‘একটা পরির গল্প’, ‘বিশেষ-কিছু নয়’, ‘খাবার আগের গল্প’, ‘ট্যানির ভাবনা’, ‘কান্তিকুমারের নার্ভাস ব্রেকডাউন’, ‘ঘুমের আগের গল্প’, ‘হারান-জ্যাঠা ও সুজিত-দা’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুবোধ্য গল্প।

১০.  বুদ্ধদেব বসুর শহর ঢাকা

খোরশেদ আলম : কলকাতায় বিকশিত-প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধদেব বসুকে শহর ঢাকা কতটা স্পর্শ করেছিল? জানা প্রশ্নটাই করলাম, ‘পুরান পল্টন’ পড়ে আবিষ্ট হয়নি এমন পাঠক তো মেলা ভার! তাঁর গদ্যে প্রবল আকর্ষিত এক ঢাকা শহরকে পাই। ‘বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যে ঢাকা শহর’ নিয়ে আপনার নিজেরও একটি লেখা রয়েছে। শহর ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু নিয়ে কিছু শুনতে চাই।

তারেক রেজা : এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের সবচেয়ে আলোচিত রচনা ‘পুরানা পল্টন’। তাঁর স্মৃতিকথা বা জীবন-নির্ভর বই ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার যৌবন’ এমনকি তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘উত্তর তিরিশে’ নানা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বুসর ঢাকা শহরের দেখা মেলে। আমার গুরুদেব, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ-এর উপাচার্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের আগ্রহ ও নির্দেশনায় আমি বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যে ঢাকা শহরের খোঁজ করার চেষ্টা করি। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, তাঁর উপন্যাসের পাত্র-পাত্রিরাও নানা-প্রসঙ্গে ঢাকা শহর নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে, যে-রকম আলোচনা হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। আমার ইচ্ছে আছে বুদ্ধদেবের সমগ্র কথাসাহিত্যে কীভাবে ঢাকা শহর ধরা পড়েছে তার একটা তত্ত্বতালাশ করা।  যাই হোক সে-ইচ্ছে পূরণের ভার ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিলাম। পুরানা পল্টন সম্পর্কে বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘আজ যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কোন জায়গা, আমি অনায়াসে উত্তর দিই : পুরানা পল্টন।‘ বুঝতে পারি, বুদ্ধদেবের এই উত্তরে আবেগের তীব্রতা আছে। পুরানা পল্টনের টিনের বাড়িতে তাঁর ছয় বছরের যে-জীবন, সেই সময়টি তাঁর গড়ে ওঠার কাল—‘সমস্ত কলেজ-জীবন, সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্যায়, যৌবনের উন্মেষ থেকে বিকাশ।’ রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।’ সম্মুখের বুদ্ধদেবকে পশ্চাতের এই বুদ্ধদেব নিশ্চয়ই ঠেলা দিয়েছে।

বুদ্ধদেবের ঢাকা শহরের খোঁজ নেয়ার জন্য আমার প্রবন্ধ-পাঠ জরুরি নয়। আমার পরামর্শ হলো বুদ্ধদেবের রচনাবলি পড়ে নেয়া। সমগ্র সাহিত্যকর্ম না হোক, অন্তত ‘পুরানা পল্টন’ প্রবন্ধটি পাঠ করা উচিত। তবে বলে রাখি, বুদ্ধদেব যে পুরানা পল্টনের কথা বলেছেন, সেই পুরানা পল্টন নিশ্চয়ই কোথাও নেই। বুদ্ধদেবের সময়েও ছিল বলে মনে হয় না। বুদ্ধদেব তাঁর ঢাকা শহরকে স্মৃতি ও স্বপ্নের ভেতর দিয়ে নতুন করে সৃষ্টি করেছেন। একইভাবে আমার প্রবন্ধে বুদ্ধদেবের যে ঢাকা ধরা পড়েছে, সেখানেও কেবল বুদ্ধদেবেরই নয়, আমার কল্পনা-প্রতিভার কিছু আঁচড়ও নিশ্চয়ই পড়েছে। কিন্তু সেটি ভিন্ন বিবেচনা।

১১. রাজনীতি ও কবিতা

খোরশেদ আলম : বিদ্রোহ বিপ্লব বা রাজনীতিকে কবিতা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু সোমেনচন্দকে নিয়ে নিজেই কবিতা রচনা করেছেন। সুকান্ত, সমর সেন, নজরুল ইসলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখকে নিয়ে আলোচনাও করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন কালের আবর্তে বদলে যাচ্ছিলেন অর্থাৎ সে-সময় তাঁর সমাজ-রাজনৈতিক অভিজ্ঞান থেকে উঠে আসা কবিতার ব্যাপারে বুদ্ধদেবের উষ্মার ভাব ছিল না, বরং প্রশংসা ছিল। অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর এতো বোঝাপড়া যে, সেটাকে একটা প্রশ্নে আঁটানো মুশকিল। এ-নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত আলাপ করা যাবে।

তারেক রেজা : এ-বিষয়ে আলোচনা অন্যদিন করাই নিরাপদ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমার আগ্রহের প্রধানতম জায়গা কবিতার অন্তর ও অবয়বে রাজনীতি অন্বেষণ করা। উচ্চাশিক্ষার নাম করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার প্রকৃতি-প্রভাব চিহ্নিত করতে গিয়ে এটি আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে বলা যায়। বুদ্ধদেবের কবিতায়ও রাজনীতি নিশ্চয়ই আছে। সেই রাজনীতির ধরন-ধারণ তথাকথিত রাজনৈতিক কবিতার মতো নয়। কবিতাকে রাজনীতি থেকে মুক্তি দেয়ার অর্থ হলো কবিতা থেকে জীবনকে ছুটি দেয়া। সেটা অসম্ভব বলেই আমি মনে করি। আমার একটি প্রবন্ধের নাম আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই—‘কবিতার সংগ্রাম : সংগ্রামের কবিতা’। কবিতার উদ্ধৃতিবিহীন এই দীর্ঘ প্রবন্ধে আমি কবিতায় বিম্বিত আন্দোলন-সংগ্রামের গতি ও গভীরতা নির্দেশ করার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, কবিতা কোনো নিরীহ শিল্পমাধ্যম নয়—একথা দিবালোকের মতোই সত্য-স্বীকৃত-সর্বজনগৃহীত। যে-জীবন আমরা যাপন করি, কবিতা তারই শিল্পভাষ্য। বেঁচে থাকার ব্যাপারটি যেহেতু সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসরমান, তাই কবিতায়ও আমরা সংগ্রামী মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। কবিতার ইতিহাস জীবনসংগ্রামের ইতিহাস—এই সত্যকে স্বীকার করে নিলে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সংগ্রামের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতায় কবিতাও ক্রমাগত নিজের চলার পথটিকে আপন ইচ্ছের অনুকূলে বদলে নেয়।

বুদ্ধদেবের কবিতায় রাজনৈতিক অনুষঙ্গের অনুবর্তন বিষয়ে আপনার বিবেচনা যথার্থ বলেই আমি মনে করি। সোমেনচন্দকে নিয়ে বুদ্ধদেবের কবিতার কথা আপনি বলেছেন। বাংলা সাহিত্যে যাঁরা প্রগতি-কবিতার পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত-সম্মানিত, তাঁরা সবাই বুদ্ধদেবের আলোচনায় স্থান পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতি-নির্ভর কবিতা বিষয়ে বুদ্ধদেবের অভিব্যক্তি সম্পর্কে আপনি যথার্থই বলেছেন। ‘এক পয়সায় একটি’ কাব্যের ‘শান্তিনিকেতনে বর্ষা’ কবিতায় বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘হানে গান শান্তিনিকেতনে/রবীন্দ্রনাথের মনে বেদনার নিঃশব্দ ক্ষরণে,/বৃষ্টি-থামা অস্তরাগে, অন্য কোন সন্ধ্যার স্মরণে।’ রবীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেবের সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, বলার ইচ্ছে সংবরণ করাও অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বুদ্ধদেব থেকে ধার করে বলি. ‘অন্য কোনো সন্ধ্যার স্মরণে’ আমরা এ-বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে চাই। আলোচনা দীর্ঘ না করে এটুকু বলা যায়, বুদ্ধদেবকে ‘আত্মমগ্ন’, ‘ব্যক্তিনিষ্ঠ’ কিংবা ‘বিবরবাসী’ সাহিত্যস্রষ্টা বলার পেছনেও কাজ করে পাঠক-গবেষক-সমালোচকের রাজনীতি, যাকে আমরা সাহিত্যের রাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি।

১২. সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু

খোরশেদ আলম : বুদ্ধদেব বসু নিয়ে যথেষ্ট আলাপের পরও আসলে তা যথেষ্ট নয়, যদি না তাঁর সম্পাদক সত্তা নিয়ে কথা বলি। বাংলা সাহিত্যে অনেকেই মূল্যায়িত হয়েছেন, আলোর মুখ দেখেছেন—বুদ্ধদেব বসু সেখানে স্পষ্টই নৌকার প্রচালক। এক অনন্য বাতিঘরের খোঁজে যিনি সদা সন্তরমান। সমকালীন যুগ ত্রিশের দশক কি ত্রিশোত্তর সময়ের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মাঝে  এ-কারণেই কি তাঁকে স্বতন্ত্র করে চেনা যায়? কবির বাইরে অন্য এক সত্তা যেন সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু। তাতে তাঁর কবিত্ব একটুও ফিকে হয়নি, সেটাও একশভাগ মানি।

তারেক রেজা : আপনি যথার্থই বলেছেন, বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদক-সত্তা নিয়ে আলাপ না করলে তাঁর সমগ্রতার একটা বিরাট অংশ আড়ালে থেকে যাবে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক-সমালোচকদের চিন্তা-চেতনায় ‘কল্লোল যুগ’ বলে যে ধারণা এখনো সক্রিয় আছে,  তার প্রধান কারণ বোধকরি বুদ্ধদেব বসু। একটি বিশেষ যুগের প্রধান কাণ্ডারি হিসেবে তাঁর অবদান ও অবস্থানকে নানাভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ আছে। বাংলা কবিতার যে সমৃদ্ধি, সংহতি ও সুরকে আমরা ‘আধুনিকতা’ হিসেবে দেখতে ও বুঝতে শিখেছি, সেই দেখার চোখ ও শেখার আগ্রহও বুদ্ধদেবই সৃষ্টি করেছেন। সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন, “তাঁর লক্ষ্য ছিল আধুনিকতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং ‘আধুনিক’ কবিতা লেখকদের পক্ষে সমর্থন করা।” এই প্রতিষ্ঠা ও সমর্থনের কাজটি তিনি সম্পন্ন করেছেন প্রধানত দুটি পত্রিকা অবলম্বনে—‘প্রগতি’ ও ‘কবিতা’। ঢাকা থেকে ‘প্রগতি’ পত্রিকাটি বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা অবস্থানকালে প্রেমের মিত্রের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন ‘কবিতা’ পত্রিকা। হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই তিনটি পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে আমরা জানি। এটি বিস্ময়কর যে, পত্রিকা অবলম্বনে একটি যুগের জন্ম হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। এ-প্রসঙ্গে জগদীশ ভট্টাচার্যের বিবেচনা বেশ তাৎপর্যবহ। তিনি লিখেছেন, “আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় ‘কল্লোল যুগ’, সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।” এই বুদ্ধদেবই আরো পরিণত, প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে ধরা দিয়েছেন ‘কবিতা’ পত্রিকায়।

পত্রিকার, বিশেষ করে সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদক সম্পর্কে আজকের দিনে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে ‘প্রগতি’ বা ‘কবিতা’র সম্পাদক বুদ্ধদেবকে কিছুতেই মেলানো যাবে না। ভালো লেখা নির্বাচনে বুদ্ধদেবের যে শিল্পদৃষ্টি সক্রিয় ছিল তা তাঁর নিজস্ব শিল্পভাবনা দ্বারা তাড়িত বা পীড়িত হয়নি। এই দুই পত্রিকার মাধ্যমে এমন অনেক লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, যারা কেবল ভিন্নতর রাজনৈতিক ভাবাদর্শেরই নয়, শিল্পচিন্তায়ও তাঁরা ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। এ-জন্য বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ ও সম্পর্ক প্রণয়নে কোনো অসুবিধা হয়নি।

কেবল সম্পাদক নয়, ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও বুদ্ধদেব অনন্য, যদিও এই পৃষ্ঠপোষকতার কাজটি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর সময়ের অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিককে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন, তাঁদের সাহিত্যে প্রতিফলিত শিল্পভঙ্গি ও জীবনবোধের বিশেষ ব্যাকরণ চিহ্নিত করেছেন। অন্য একটি প্রশ্নে আপনি সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সমর সেনের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতো আরো অনেক কবির নাম করা যাবে যাদের নিয়ে বুদ্ধদেব দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন—পাঠকের সামনে তাঁদের শক্তি ও সম্ভাবনার তাৎপর্যপূর্ণ দিকগুলো উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়িয়ে যে নতুন পথে নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজেছেন বুদ্ধদেব এবং তাঁর সমকালের কবি-সাহিত্যিকেরা, সেই পথ ও পদ্ধতির মুখপাত্রও ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই। এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না।’ বিশ্বভ্রমণের এই আহ্বানে কেবল যে আন্তর্জাতিক মানসেরই প্রকাশ ঘটেনি, তাতে রবীন্দ্র-বলয়ের বাইরে দাঁড়ানোর প্রাসঙ্গিকতাও যে ধরা পড়েছে, তা আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু বুদ্ধদেব সরাসরি মাঠে নামলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বললেন, ‘তাঁর কাব্যে বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা নেই, সংরাগের তীব্রতা নেই, নেই জীবনের জ্বালাযন্ত্রণার চিহ্ন।’ ফলে তাঁকে ‘বাস্তবের ঘনিষ্ঠতা’, ‘সংরাগের তীব্রতা’ ও ‘জীবনের জ্বালাযন্ত্রণা’র খোঁজে নতুন পথে নামতে হলো, যে-পথ আমাদের ঠেলে দিল পশ্চিমের দিকে। লক্ষণীয় হলো, নিজের পথটি খুঁজে নিয়ে বুদ্ধদেব ‘একলা চলো’ নীতি অনুসরণ করলেন না, সবাইকে সেই পথে টেনে নিতে চাইলেন। এখানেও বুদ্ধদেব পথিকৃতের ভূমিকা ভূমিকা পালন করেছেন।

১৩. বর্তমান পাঠকের কাছে

খোরশেদ আলম : এখন তো উত্তরাধুনিক কবিতার যুগ। আবার এটাও ঠিক, আধুনিকতার প্রান্তই আমরা এখনো স্পর্শ করতে পারিনি। বুদ্ধদেব বসু কিংবা তাঁর কালের, তাঁর মেজাজের কবিরা বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাসের বাইরে কতটা পঠিত হয় বলে আপনার মনে হয়? কেবল কবিতা নয়, তাঁর গল্প যেমন ‘আমরা তিনজন’, উপন্যাস তিথিডোর, রাত ভ’রে বৃষ্টি এগুলোও তো ভোলা যায় না। আমরা এসব পড়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি।

তারেক রেজা : আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, ঔপনিবেশিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ইত্যাদি অনুষঙ্গ আমাদেরকে কেবলই তত্ত্বের দিকে ঠেলে দিতে চায়, শিল্পের দিকে নয়। এ-প্রসঙ্গে আমি বুদ্ধদেব বসুর বিবেচনাকে শিরোধার্য মনে করি। তিনি বলেছেন, ‘সাহিত্য জিনিশটা মানুষের চিত্তের নির্যাস আর মনের মহিমা এখানেই যে সে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে না; অনেক বিরোধ ব্যতিক্রম, অসংগতির মধ্য দিয়েই তার প্রকাশের পথ এঁকে-বেঁকে চলতে থাকে। এইজন্য সাহিত্যকে যে-কোনো রকম ফর্মুলার মধ্যে বাঁধতে গেলে বোধের বিকৃতি অনিবার্য হ’য়ে পড়ে।’ শিল্প-সাহিত্যের নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজ নেয়ার জন্য তত্ত্বের প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমার আগ্রহ শিল্পের সত্যের দিকে, তত্ত্ব যাকে কোনদিনই স্পর্শ করতে পারবে না। এ-বিষয়ে আলাপচারিতা আজকের এই কথোপকথনের আত্মিক ও আন্তরিক আবহকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে হয়। তবু কথা বলা যায়। আপত্তি না থাকলে অন্য একদিন আমরা এ-সম্পর্কে কথা বলতে পারি।

বুদ্ধদেবের পাঠক সম্পর্কে আপনি জানতে চেয়েছেন। আপনার প্রশ্নটি কেবল বুদ্ধদেব সম্পর্কেই নয়, অন্য যে-কোনো, বিশেষ করে তাঁর সমকালের যে-কোনো লেখক সম্পর্কেই করা যেতে পারে। সিলেবাসের বাইরে সাহিত্যপাঠের অবস্থা সম্পর্কে আপনি জানেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে আপনি এটাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেন যে, সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত রচনাবলি পাঠেও শিক্ষার্থিদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। এই অভিযোগ অবশ্য সর্বকালের পাঠক সম্পর্কেই করা হয়েছে। তবুও শিল্পসাহিত্যে আমাদের পথচলা থেমে নেই, থেমে যাবে না কোনোদিনই। বুদ্ধদেবের সঙ্গে একালের পাঠকের বিচ্ছেদ হয়নি বলেই আমার মনে হয়। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থিরা তো বটেই, প্রাণের টানে যারা সাহিত্যের দ্বারস্থ হন, তারাও বুদ্ধদেবকে ভালোবাসেন, তাঁর সাহিত্যকর্মের বর্ণাঢ্য বিশ্বে পরিক্রমণ করেন। সমালোচক বুদ্ধদেব বসু তো এখনো অনেকের অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল উৎস। তাঁর ভাষার অনুকৃতি থেকেও বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক-সমালোচক নির্মাণ করে নিয়েছেন তাঁদের বয়ানভঙ্গি ও বুনন-কৌশল। ফলে বলাই যায়, বুদ্ধদেব এখনো জেগে আছেন।

বুদ্ধদেবের যে-সব রচনার কথা আপনি বলেছেন, সেগুলো একালের পাঠককেও আকৃষ্ট করে। প্রাণের টানেই অনেক পাঠক বুদ্ধদেবের এসব কালজয়ী রচনা পাঠ করে আনন্দিত ও আলোকপ্রাপ্ত হয়। তবে কবিতার লোক হিসেবে বুদ্ধদেবের কবিতার প্রতিই আমার প্রেম অধিক। শুধু আমি নয়, আরো অনেক কবিতা-ভক্তের কণ্ঠে আমি বুদ্ধদেবকে আবৃত্ত হতে দেখি। তাঁর অনেক কবিতাই এখনো স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করেন অনেক প্রাণবন্ত পাঠক। ‘বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা’ বইয়ের ‘মানুষ’ কবিতার সেই মহিমান্বিত উচ্চারণ, ‘আমি যে রচিব কাব্য, এ-উদ্দেশ্য ছিল না স্রষ্টার।/তবু কাব্য রচিলাম। এই গর্ব বিদ্রোহ আমার।’—এখনো অনেকের মুখে মুখে ফেরে। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার কথা বলেছেন, খোদার আসন আরশ ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। বলার ভঙ্গিটা একান্তই নজরুলীয়। বুদ্ধদেবও তো সে-রকমই বলেছেন, বিধাতার ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কাব্য রচনা করেছেন। তাই বুদ্ধদেবের গর্ব ও বিদ্রোহের অংশীদার হতে পারলে আমাদের ভালো লাগে।

বুদ্ধদেব বসুর রচনাপাঠের অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা নিশ্চয়ই তাঁর রচনার অনেক চৌম্বক অংশের প্রেমে পড়েছেন, মগজে মুদ্রণ করে নিয়েছেন। মনে পড়বে ‘একখানা হাত’ কবিতার সেই আবেগঘন উচ্চারণ—‘বিছানায় শুয়ে আছি, ঘুম হারায়েছে;/না জানি এখন কত রাত;/—কখনো সে-হাত যদি ছুঁই জানিবো না,/এ-ই সেই হাত।’ কারো মাথার ভেতর নড়েচড়ে উঠবে ‘নির্মম যৌবন’ কবিতার কালজয়ী উক্তি—‘যৌবন করে না ক্ষমা।/প্রতি অঙ্গে অঙ্গীকারে করে মনোরমা।/বিশ্বের নারীরে। অপরূপ উপহারে কখন সাজায়/ বোঝাও না যায়।’ তাঁর ‘চিল্কায় সকাল’ কবিতার কোনো পঙক্তি না-হয় নাই-বা বললাম। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’ নাটকে ঋষ্যশৃঙ্গের সেই সংলাপ—‘তরঙ্গিনী, আমার শেষ কথা তোমারই সঙ্গে। তুমি আমাতে যে উপহার দিলে আমি এখনো তার নাম জানি না। কিন্তু হয়তো তার মূল্য বুঝি। আমি তোমার কাছে চিরকাল ঋণী থাকবো। তোমাকে আমি অভিনন্দন করি।’—এখনো অনেককেই মন্ত্রবৎ আওড়াতে দেখি। কিংবা অনেকেরই মনে পড়বে লোলাপাঙ্গীর অন্য একটি সংলাপ : ‘সব নারী পত্নী হতে পারে, সতী হতে পারে না। বহুচারিণী হতে পারে, বারাঙ্গনা হতে পারে না। এক পুরুষে আসক্ত থাকলেই সতী হয় না; বহুচারিণীও সতী হতে পারে, কিন্তু বহুচারিণী মাত্রই যথার্থ বারবধূ নয়। সতী, বারাঙ্গনা—দুয়েরই জন্য হতে হয় গুণবতী, প্রাণপূর্ণা। দুয়েরই জন্য অসামান্য প্রতিভা চাই।’ যৌবন ও সতীত্ব বিষয়ে বুদ্ধদেবের ভাবনা প্রচলিত সমাজ-বিধানের পথ ধরে এগোয়নি। লোলাপাঙ্গীর এই উচ্চারণ অবধারিতভাবেই বুদ্ধদেবের বিশ্বাস-প্রসূত। এ-জাতীয় অনেক প্রসঙ্গেই বুদ্ধদেব বসুকে অপরিহার্য মনে হয়। সুতরাং বলাই যায়, তিনি ‘আমাদের লোক’।

বুদ্ধদেব বসু নিজের সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন। সেই যুগে লেখালেখি করে সংসার চালানোর কথা চিন্তা করেছেন। যদিও জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছেন দেশে-বিদেশে শিক্ষকতার কাজে। তুলনামূলক সাহিত্য-সমালোচনার যে ধারাটি বাংলা ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে, তাও বুদ্ধদেবের হাত ধরেই। আত্মকথায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার কেবলই মনে হচ্ছে আমি অপেক্ষা ক’রে আছি, আমার অন্তর প্রসারিত হয়ে নিজেকে মেলে দিচ্ছে আকাঙ্ক্ষায়, মনে হচ্ছে আমার এই চুপ করে চেয়ে থাকার অর্থ আর-কিছু নয়, শুধু একটা ‘এসো ‘এসো’ ডাক, একটা অবিরল আহ্বান। কখনো আসবে কিনা জানি না, কিন্তু আমি যে অপেক্ষা ক’রে ছিলাম, এইটুকুতেই আমার পরিচয় লেখা হয়ে থাক—যতদিন না সব লেখা ধুলোয় মিশে যায়।’ ঠিক এই অভিব্যক্তিরই প্রকাশ লক্ষ করি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায়—‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা—/ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা।’ আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, বুদ্ধদেবের সব লেখা কোনদিনই ধুলোয় মিশে যাবে না।


খোরশেদ আলম : আজকের এই আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য কবি তারেক রেজা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার ব্যস্ততা থেকে অনেক মূল্যবান সময় নিয়ে নিলাম।

তারেক রেজা : আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ। কথোপকথনের এই দীর্ঘ পরিসরে আমিও আপনার সান্নিধ্য, ব্যক্তিত্ব ও পাণ্ডিত্যে উষ্ণ ও ঋদ্ধ হয়েছি, আনন্দ লাভ করেছি—আসলে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছি। এই আলাপচারিতা যারা পাঠ করবেন, তাদের প্রতিও অশেষ শুভেচ্ছা , শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি।