স্মৃতিকথা : ভাবি বিস্ময়ে শৈশবের সেইসব দিন

খোরশেদ আলম

আমাদের ছোটকালে স্টেরিও ক্যাসেটের (ফিতা ক্যাসেট) প্রচলন ছিল। বাজারের বিভিন্ন দোকানে সেইসব স্টেরিও ক্যাসেটে নানা ধরনের গান ভেসে আসতো। বিচিত্র সেইসব গানে এক একটা মিশ্র অনুভব তৈরি হতো। বিশেষ করে একটু গ্রামীণ পরিবেশময় মফস্বলের দিকে পালা, জারি, কিসসা, ভাওয়াইয়া নানা ধরনটা টের পাওয়া যেতো। এখন আর সে-রকম শোনা যায় না। এখন সেসব জায়গাতেও উদ্বায়ী একটা সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে। মনকে শান্ত করে না-- এমন সব গান বাজে সিডি প্লেয়ারগুলোতে।

মনে পড়ে, মহররমের আশুরা এলে স্টেরিওতে শোনা যেতো একটা গান :

“ধীরে ধীরে চালাও ছুরি শিমর আমারও গলায়

জয়নাল আবেদীনের কান্দন শুনতে দাওনা রে আমায়।।...”

ইমাম হোসেনের (রা.) পুত্র জয়নাল আবেদীন। একটা কল্পনা কাজ করতো এই গানে। শিমার ছুরি দিয়ে ইমাম হোসেনের গলা কাটছে। আর তখন তাঁর শিশুপুত্র জয়নাল আবেদীনের কথা মনে পড়ছে। কারবালা-ট্রাজেডির এই গানটা যখন বাজতো তখন মানুষের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হতো। যেখানে স্টেরিও ক্যাসেট বাজতো, সেইসব দোকান বিশেষত চায়ের দোকান বা পানের ক্ষুদ্র দোকানগুলোতে ভিড় হতো। দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চ/বেঞ্চগুলোতে মানুষজন একসঙ্গে বসে শুনতো, কেউ চোখের পানিও ফেলতো।

পথচারীরা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় থমকে দাঁড়িয়ে যেতো। কেউ কেউ ব্যস্ততার মধ্যেও আসরে শামিল হয়ে যেতো। স্কুলে যাবার সময় আমরাও কান পেতে সেসব শুনতাম। কখনো অবসর পেলে সেইসব জায়গায় অনায়াসে বসে যেতাম। সেখানে মানুষের বিচিত্র আবেগ আর অনুভব ঝরে ঝরে পড়তো।

এককাপ চা খেতে খেতে কিংবা ক্ষুধার্ত গ্রামবাসী একটুখানি জিলাপি-লাড্ডু, চিড়ে-মুড়ি-গুড় চিবাতে চিবাতে সংস্কৃতির পাঠশালায় হাজির থাকতো। এক ধর্মের মানুষ অনায়াসে অন্যধর্মের কিসসা-কাহিনি শুনতো।

কিছু মানুষ এখনো সেইসব দিন স্মরণ করে, সেই যৌথ-সাংস্কৃতিক জীবনকে অন্তরে ধারণও করে। আত্মনিবেদিত হয়ে সেগুলো চর্চাও করেন কেউ কেউ। কিন্তু সময় বোধ হয় পরিবর্তনশীলতার বড় নিয়ামক। দিনকে দিন সেই একসঙ্গে সংস্কৃতি-যাপনের বিষয়টি হারিয়ে যাচ্ছে। আলগা হয়ে যাচ্ছে মানুষে-মানুষে সংযোগের বোধ। এখন সবাই যেন কিসে ব্যস্ত! আর্থিক কর্মকাণ্ড, কখনো অনর্থ নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ নিমগ্ন।

ভাবি বিস্ময়ে, আবার যদি ফিরে আসতো সেইসব দিন! আবার স্টেরিও ক্যাসেটে শুনতে পেতাম :

“ধীরে ধীরে চালাও ছুরি শিমর আমারও গলায়...

জয়নাল আবেদীনের কান্দন শুনতে দাওনা রে আমায়।।”