অনুলেখন : খোরশেদ আলম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এক অভাবিত আনন্দের উৎস। পার্বণ আর অনুষ্ঠানের যথার্থ নগরী হয়ে ওঠে প্রতিবছর। ছাত্রজীবনে সেলিম আল দীন নাট্যমঞ্চে মামুনুর রশীদের অভিনয় প্রথম সরাসরি দেখি। ‘সংক্রান্তি’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এরপর আরো কি একটা নাটকে… ঠিক এখন নাম মনে আসছে না। সংক্রান্তি দেখে ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের এই বর্ষীয়ান অভিনেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। আমাদের ছোটবেলায় ওনারাই ছিলেন ছোট পর্দার নায়ক। এরপর বড় পর্দায় ‘মনপুরা’ দেখলাম সিনেমা হলে গিয়ে। অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক মামুনুর রশীদের বর্ণাঢ্য জীবন কথা আমরা সবাই তো কমবেশি জানি। তবুও তাঁকে কাছ থেকে একটু অবলোকনের চেষ্টা করা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সেমিনারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হল। সেমিনারে কাকে কাকে বক্তা হিসেবে আনা হবে এ-নিয়ে ভাবা হচ্ছে। অনেক পছন্দের ব্যক্তিত্বের মধ্যে আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। সেমিনার কমিটির প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ। কারণ প্রস্তাবটা দিতেই একবাক্যে তাঁরা রাজি হয়ে যান। আমার তত্ত্বাবধানেই সেমিনার কিন্তু অন্যের মতামতকে কখনো অগ্রাহ্য করতাম না। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রেজা মুহম্মদ আরিফের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে নাট্যকার মামুনুর রশীদকে ফোন করলাম। উনি তখন ঢাকার বাইরে একটা শুটিং-এ ছিলেন। আমার সঙ্গে ওনার পূর্ব-পরিচয় ছিল না। ফোন করে পরিচয় দিলাম। আর জাহাঙ্গীরনগরে সেমিনারের কথা বলতেই কোনো কিছু না ভেবেই শুধু বললেন, “নিশ্চয়ই আসবো…, একটা শুটিং-এ আছি। পরে আমাকে ফোন করে কথা বলবেন…”
সহকর্মী বশীরুজ্জামানের উপস্থাপনায় নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে সেমিনার শুরু হল। আমি শুভেচ্ছা বক্তব্য সেরে সরাসরি বক্তৃতা পর্বে প্রবেশ করলাম। মামুনুর রশীদের বক্তব্যে উঠে আসে ওনার শৈশব কৈশোর যৌবন প্রৌঢ় কালের বাংলাদেশ ও থিয়েটার। মামুনুর রশীদ বক্তৃতায় যা বলেছেন, তারই একটি রূপ অনুলেখনে দেয়ার চেষ্টা করেছি।
মামুনুর রশীদের বক্তৃতা
থিয়েটার বরাবরই একটি সংগ্রামের বিষয়। আজ আমাদের দেশে নাট্যমঞ্চ আছে। বেইলি রোডে থিয়েটার পাড়া আছে। আমরাই সংগ্রাম করে করে আজ থিয়েটারকে এ-পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। প্রথম দিকে তেমন ভাল কোনো প্রযুক্তিও ছিল না। আজকে তো লাইটিং কস্টিউম ডিজাইন নিয়ে তেমন ভাবতে হয় না। কিন্তু সেসময় আমরা হাতে বানানো ডিমার দিয়ে আলো কম বেশি করতাম। বালতির মধ্যে লবন পানির দ্রবণে অ্যানোড আর ক্যাথোডে লোহার শলাকা ডুবিয়ে আমরা আলো কমবেশি করতাম। একজনকে সার্বক্ষণিক ওখানে ধরে রাখতে হতো। আজকের প্রসেনিয়াম মঞ্চে এসব নিয়ে আর ভাবতে হয় না। নাটক নিয়ে আমরা কত জায়গা ঘুরেছি এই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। নাটকের দল নিয়ে অনেক সময় ট্রেনে করে যেতাম।
আমি জন্মেছিলাম মাতুলালয়ে। আমার মামা গান গাইতেন। সেইসব প্রেরণা কিন্তু কাজে লেগেছে। আমার ছোট মামা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখন কিন্তু গ্রামেও একটা মুক্ত সমাজ ছিল। তখন অবশ্য বোঝার সুযোগ নাই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’কারণ আমি তখন নিতান্তই ছোট। কলকাতা থেকে একটা ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা আসতে কয়েকদিন লাগতো। আমার বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। বদলির চাকরি। সেই সূত্রে নানাস্থানে আমাদেরকে যেতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টারের রতনকে আমি আজো দেখতে পাচ্ছি। আমরা যখন একস্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যাচ্ছি। এই রতনের মতো একটা মেয়ে আমাদের বাড়িতেও কাজ করতো। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ততক্ষণে পালে হাওয়া লাগিয়েছে। আবার আরেক জায়গায় গিয়ে আরেক রকম স্মৃতি তৈরি হয়। এই রকম কত স্মৃতি রয়েছে। আমি তখন স্কুলে যাই, ময়মনসিংহের ফুলপুরের সেই পোস্ট অফিসের কথা মনে আছে, হালুয়া ঘাটের দিকে ফুলপুর। পরে শামসুর রাহমানকে নিয়ে আমি হালুয়া ঘাটে যাই গারোদের একটা উৎসবে। আমার যখন ৪/৫ বছর বয়স সেই সময়ের পোস্ট অফিসটা খুঁজতে বের হই। দেখি সেটা নেই, পোস্ট অফিসের সামনে যে একটা বিশাল প্রান্তরের মতো জায়গা ছিল সেটাও নেই, ঘিঞ্জি দালান উঠে গেছে। তারপর পোস্ট অফিসে ঢুকলাম। শামসুর রাহমান সেটা পরে লিখেওছিলেন। সেখান থেকে একটা পোস্ট কার্ড কিনলাম। তারপর আমার বাবার কাছে একটা চিঠি লিখলাম। শামসুর রাহমান অবাক হয়েছিলেন। পোস্ট মাস্টারকে বললাম আমার বাবা এখানে পোস্ট মাস্টার ছিলেন, সেই ১৯৫২ সালের দিকে। উনি বেশ খুশি হলেন। আজকে ইন্টারনেটের যুগেও সেই চিঠি কিন্তু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ একজন আরেকজনকে আর চিঠি লেখে না। আমি এখনও মাঝে মাঝে চিঠি লিখি।
টেলিভেশনের জন্য একসময় প্রচুর নাটক তৈরি করতে হয়েছে। তাছাড়া রেডিওতেও প্রোগ্রাম হতো। আমি তো শুধু মঞ্চ-নাটকের লোক নই। পথ-নাটক নিয়ে ফেরি করে করে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের কাছে গিয়েছি। নাটক করতে গিয়ে অনেক সমস্যার মুখেও পতিত হয়েছি। বিশেষত স্থানীয় শিল্পীদের নিয়েও নাটক করতাম। নাটকে এলাকার শোষণ-নির্যাতনের কথা থাকতো। থাকতো মাতবরের নির্যাতন, সুদখোর দাদন ব্যবসায়ীদের কথাও। ফলে সেই সব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনেক সময় নাটক করতে বাধাও প্রদান করেছে। আবার অনেক সময় নাটক হয়ে যাবার পর, আমরা চলে আসার পর স্থানীয় শিল্পীদের ওপর নির্যাতন করতো। আমাদের সামনা সামনি কেউ কেউ হয়তো আসার সাহস পেতো না। কিন্তু স্থানীয় শিল্পীদের অনেক সহ্য করতে হয়েছে। আমাদের কাছে খবর আসতো। আমরা হয়তো প্রশাসনের মাধ্যমে চেষ্টা করতাম। কিন্তু তারা সবসময় সহায়তা করতে পারতো না। ভিলেজ পলিটিক্সের কাছে শিল্পীরা হেরে যেতো। সেই শিল্পীরাই আমাদের সম্পদ, আমাদের জন্য তারা সীমাহীন স্যাক্রিফাইস করেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বেশ কষ্ট করেছি। আমি কাদের সিদ্দিকীর এলাকার মানুষ। উনি তখনো অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। সেনাবাহিনি কিছু গোলাবারুদ ফেলে গেছে, একটি এলএমজি। কাদের সিদ্দিকীকে খবর দিলাম। এরমধ্যে অনেক স্টোরি আছে। যুদ্ধের একটা পর্যায়ে গিয়ে তো ক্যাম্পট্যাম্প করতাম। একটা সময়ে গিয়ে মনে হলো যে, এর চেয়ে আমি বেশি কন্ট্রিবিউট করতে পারবো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে গেলে। তারপর বহুপথ অতিক্রম করে একসময় আগরতলা যাই। আর্মি টার্গেট করে গুলি করছে নৌকায়। তখন আমরা নদী পার হচ্ছি। খুব ঝঞ্ঝার সময় সেটা। তারপর কোনো রকমে আবার ঢাকায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে চলে আসি। আজকের মতো এতো সহজ ছিল না সেসময়ের দিনগুলো। বেশ সংগ্রাম করেই ধীরে ধীরে একটা অবস্থান করে নিতে হয়েছে। দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেল। আমার একটা দায় ছিল। এই যে সদ্য স্বাধীন দেশ, সব ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায়। তখন মনে হলো শিল্প দিয়ে যদি কিছু করা যায়। পশ্চিমবঙ্গ তখন অনেক এগুনো, রবীন্দ্র সদন, কলকাতার একাডেমি, মিনার্ভাতে নাটক হয়। আমাদেরকে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। ষাটের দশকে আমরা যখন নাট্যচর্চা করতাম ঐ রকম প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ছিল না, নিয়মিত কিছু ছিল না। আমাদের স্বপ্ন ছিল কীভাবে একটা প্রপার মঞ্চ তৈরি করা যায়। ১৯৭১ সালে কলকাতায় মঞ্চ নাটক দেখতে গিয়ে সেই প্রেরণা পেলাম। উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র তখন যৌবনে, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘তিন পয়সার পালা’ এসব নাটক হচ্ছে। প্রতিজ্ঞা করি প্রফেশনাল এটিচ্যুড নিয়ে নাটক করবো। ওখানে বসে তখনি আমি একটা নাটক লিখি ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’। ১৯৭২ সালে ‘আরণ্যক’ প্রতিষ্ঠা করি। আলী যাকেরকে নিয়ে এলাম, সুভাষ দত্ত, হাসান ইমাম আরো অনেকে ছিল। ম হামিদ তখন ডাকসুর নাট্য বিষয়ক সম্পাদক ছিল। মুনীর চৌধুরী যাকে আমরা সামনে পেয়েছিলাম তিনি একজন আধুনিক নাট্যকার। তাঁকে তো নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই সময় সুভাষ দত্ত, নাজমুল হোসাইন, মুহম্মদ ইনামুল হক, আলী যাকের এদেরকে নিয়ে ‘কবর’ নাটকটি করলাম ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে। আধুনিক নাট্যকার নাসির উদ্দিন বাচ্চু ভাই সহ অনেককেই আমার চলার পথে সাহায্য করেছেন।
‘আরণ্যক’ নাট্যদল থেকে আমরাই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম ইউরোপে নিয়ে যাই। স্কটল্যান্ডের এডিনবরা আসলে নাটকের শহর। শেকসপীয়রকে তারা গভীরভাবে চর্চা করে এখনো। সেখানকার উৎসবে নাট্যমঞ্চগুলো সাজ সাজ রবে জেগে ওঠে। একসাথে ২৬০ টি ভেন্যুতে এডিনবরার ফিল্ম ফেসটিভ্যালে একমাস ধরে নাটক হয়। প্রায় ১০ লাখ দর্শক। ২০ লক্ষ টিকেট বিক্রি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শেক্সপীয়র কেমন সেটা দেখানোই ছিল এই নাটকের উদ্দেশ্য। একক অভিনয়ের প্রধান বিষয় আমি শেক্সপীয়রের চরিত্রে অভিনয়ে ছিলাম। শতাধিক বছর পেরুনো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চার শতাধিক বছরের পুরনো লেখক শেক্সপীয়রের সংলাপে মেতে ওঠে নাট্যমঞ্চ। রবীন্দ্রনাথকে তারা চিনতেন একজন সেইন্ট হিসেবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভেতরে প্রতিবাদী চেতনা ছিল। জালিওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি স্যার উপাধি বর্জন করেছিলেন। তো ঐ নাটকে আছে রবীন্দ্রনাথ একটা ব্যাগ নিয়ে স্ট্রাডফোর্ডে শেকসপীয়রের বাড়িতে গিয়েছেন। সেখানে সোর্ড, তলোয়ার এটা সেটা নানাকিছু ছড়ানো ছিটানো আছে। রবীন্দ্রনাথ একটি তলোয়ারে হাত রাখলেন। হঠাৎ করে গর্জে উঠল শেক্সপীয়রের কণ্ঠস্বর। ‘হু ইজ হ্যান্ডস আপ দেয়ার।’ তখন রবীন্দ্রনাথ জবাব দিচ্ছেন, ‘আই এম এ পার্ট ফ্রম বেঙ্গল, ট্রাভেলিং ইন দ্য গ্লোব ফ্রম ওয়ান হানড্রেড ফিফটি ইয়ারস। আই অ্যাম ইয়োর ফ্রেন্ড।’ তারা তো সাড়ে তিনশো বছরের বড় ছোট। রবীন্দ্রনাথ শেক্সপীয়রের জন্য একটা সনেট লিখেছিলেন ১৯১১ সালের দিকে। তিনি সেটা তাঁকে পড়ে শোনাতে চাইলেন। শেক্সপীয়র তখন আশ্বস্ত হলেন। শেক্সপীয়রের ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’-এর সংলাপ দিয়ে আমরা আসলে শুরু করি। শেক্সপীয়র তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার একটা নাটক আছে ‘ডাকঘর’। তখন তিনি সেখান থেকে পড়ে শোনালেন। তখন শেক্সপীয়র বলছেন, ‘ও, হোয়াট অ্যা বিউটি অব ম্যানকাইন্ড।’ আসলে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্ম-উৎসব হিসেবে ভাবছিলাম যে, কী করা যায়। সেটারই প্রতিফলন আরকি। পুরোটাতেই শেকসপীয়র আড়ালে থাকেন, লাস্ট সিনে তিনি এপিয়ার করেন। বলতে থাকেন, ‘গো ব্যাক টু দ্যা ওয়ার্ড, আই অ্যাম গোয়িং ব্যাক টু দ্য গ্রেভ। হোল ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়েটিং ফর ইয়োর ওয়ান ফিফটি ইয়ারস সেলিব্রেশন।’ তো সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের চেতনার সঙ্গে মেলাতে হবে। আমাদের সংগ্রামের সঙ্গে, স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে, প্রাসঙ্গিকভাবে বর্তমানের সঙ্গে। যাই হোক, এডিনবরার ওই উৎসবটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম একটা পাওনা।
হয়কি অভিনয় করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। মঞ্চ শিল্পীরা আমাদের দেশে এখনো অবহেলিত। তারা নিজেরা জীবিকার জন্য বিভিন্ন পেশায় জড়িত। তারা সবাই নিজের কাজের বাইরে নিতান্ত স্যাক্রিফাইস না থাকলে নাটক করতে পারত না। তাদেরকে নিয়ে অভিনয় করাতে গিয়ে কত সমস্যাতেই পড়তে হয়, এখনো হচ্ছে। সেসব সামলেও উঠেছি, ওঠার চেষ্টা করি। আর সেন্সরশীপের যন্ত্রণার কথা মনে পড়ছে। একটা সময় গেছে যখন নাটক জমা দিতে হয়েছে। তারপর সেই নাটক সেন্সরশীপ পাস হয়ে এলে তবেই নাটক মঞ্চস্থ হতো, নচেৎ নয়। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না, নানা বিধি-নিষেধ তো ছিলই। আমাকে মোল্লারা একবার নাম দিলো মুরতাদ। আমার একটা নাটক আছে ‘ইবলিশ’ নাম। তারা আসলে একটা খোপে বন্দি। সেই জায়গা থেকেই সবসময় বিচার করে। আমার নাটকে ছিল সুর করে যেমন আজান দেওয়া হয়। তেমনি করে মোল্লা সাহেব সুর করে সমাজের অন্যায়ের কথাটা বলে না কেন?—এটাই আমার অপরাধ। তারা তো পড়ে দেখে না আসলে কী বলা আছে !!
আমি এমন একটা দিনে জাহাঙ্গীরনগরে এসেছি যখন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে একই সময়ে চলছে নাট্যকার সেলিম আল দীনের ওপর পিএইচডির আলোচনা। আসলে সেলিম আল দীন আর আমার পথ আলাদা নয়। নাটক শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে সংগ্রামী অস্তিত্বের বিষয়। আমার সময়ে আমি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাঈদ আহমদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে পেয়েছি। তাদের প্রতি আমার ধন্যবাদের সম্পর্ক নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আযোজকদের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের মতো আমার কথা শেষ করছি। আপনাদের কোনো কিছু জানার থাকলে প্রশ্নোত্তর পর্বে জবাব দেবো।
এই সেমিনারে অভিনেতা শুভাশীষ ভৌমিককে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তিনিও নাটক সম্পর্কে, বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চ, নাটকের ইতিহাস নিয়ে বেশ মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। দর্শকের সঙ্গেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। নাটক এক মানবিক চর্চার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসই রচনা করে। এইসব প্রশ্নের উত্তরই অবশেষে আমরা পেলাম। নাটক জীবনের সংগ্রাম এবং অত্যন্ত যত্নের, একথাও পরিষ্কার ভাষণে উঠে আসে। আমাদের আমন্ত্রণে মঞ্চে এসেছিলেন কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক। তিনি তাঁর মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন এবং প্রশ্নোত্তর পর্বেও অংশগ্রহণ করেন। এরপর বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নাহিদ হকের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্রশ্নোত্তর পর্ব
দর্শক : আপনি কি মনে করেন নাট্যমঞ্চের আজকের রূপবদলের মধ্য দিয়ে নাটককে নতুন ভাবে নির্মাণ করা দরকার? প্রসেনিয়াম থিয়েটার যে-কারণে অবান্তর হয়ে ওঠে।
মামুনুর রশীদ : কলকাতায় আপনারা দেখবেন, একধরনের নাটক হচ্ছে যা সন্ধ্যার সময় হয়। অর্থাৎ নাটক একটা সময়ের শিল্প। তারা কিন্তু এই ধরনের নতুন ঘরানা তৈরি করছে। আর প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে এখনি অস্বীকার আমরা করতে পারবো না। আমি একসময় পথ নাটক করে গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছি। এগুলোও তো নাটকের এক একটা বিশেষ রূপ। সময়ের সঙ্গে রূপ বদল একটা বিশেষ ব্যাপার। সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। আবার হঠাৎ করেই কোনো কিছুকে ভেঙে ফেলা যায় না। আসলে সময়ই বলে দেয় কখন কী করা উচিত।
দর্শক : আমাদের মধ্যযুগের নাটকে যে ফর্ম আছে সেইসব ফর্ম কি এই প্রসঙ্গে কার্যকর?
মামুনুর রশীদ : আসলে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য একধরনের পরিবেশনারীতি। এই পরিবেশন রীতি বারবার ফিরে আসতে পারে। বিভিন্ন ঢং-এ বিভিন্ন ফর্মে তা ফিরেও আসে।
দর্শক : পারফর্মিং থিয়েটার সম্পর্কে আপনার এই ধারণাটা মধ্যযুগ থেকে বর্তমানে নিয়ে আসা তাহলে সম্ভব। কিন্তু প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ধারণা কি ভবিষ্যতে বাতিল হয়ে যাবে? অথবা প্রসেনিয়াম থিয়েটারই কি আমাদের নিজস্ব ধারার নাটক তৈরিতে বাধা প্রদান করে?
মামুনুর রশীদ : আসলে আমি তা মনে করি না। এটা পাশাপাশিই চলতে পারে। আর আমরা ইউরোপ দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছি, সঙ্গত কারণেই প্রসেনিয়াম থিয়েটার থেকে চট করে সরে আসা প্রায় অসম্ভব। আমরা তো পথনাটক কৌশলের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ধারার একটা থিয়েটার তৈরি করেছি। সেসব থিয়েটারে মানুষের জীবনের কথাই ব্যক্ত হয়েছে।
এরপর প্রাসঙ্গিকভাবে নাট্যজন ইউসুফ হাসান অর্ক, ফারহানা আখতার, হাবীব মাসুদসহ অনেকেই নিজেদের মতো নিজেদের কথা বলেছেন। রাশান নাট্যকার লেবেদেফের প্রসঙ্গটা ছিল উল্লেখ করার মতো। নাট্য-অভিনেতাদের সংগ্রামী জীবন এবং গভীর অপ্রাপ্তিবোধ ‘লেবেদেফ’ নাটকের লেবেদেফ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে যেন সঞ্চারিত হয়েছে। সেখানে নাট্যকার মামুনুর রশীদ ঐকান্তিকভাবেই অভিজ্ঞতার অংশীবাহী।
“যাহারা যুগ যুগান্তর ধরিয়া পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেদের উৎসর্গ করিয়াছে, নির্মল আনন্দ দিয়া নিজেরা নিঃশেষ হইয়া গিয়া সেই সকল বিষয়বুদ্ধিহীন মানুষের প্রতি বাংলা নাটকের দ্বিশতবর্ষ পূর্তিতে লেবেদেফ নাটকটি উৎসর্গ করা হইলো।”
—মামুনুর রশীদ, উৎসর্গপত্র, ‘লেবেদেফ’
আড্ডা পর্ব
ইতোমধ্যে দুপুরের খাবার সময় সমাগত প্রায়। সময় স্বল্পতার কারণে ইচ্ছে থাকলেও প্রশ্নোত্তর পর্ব এখানেই সমাপ্ত করতে হলো। সম্ভবত এর বাইরেও কিছু প্রশ্ন ছিল। দুপুরের খাবার শেষে বিভাগে সভাপতির রুমে আড্ডা গাড়লাম সবাই। সেখানে অধ্যাপক ড. আখম আশরাফ উদ্দিন স্যার, ড. নাহিদ হক, ড. মো. খোরশেদ আলম, ড. হিমেল বরকত, ড. তারেক রেজা, ড. রেজোয়ানা আবেদীন, জনাব বশীরুজ্জামান সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এই আড্ডা নিছক আর আড্ডা থাকেনি। বিশ্বরাজনীতি, মার্কসবাদ, স্ট্যালিন, বিশ্বনাটক, দেশের অবস্থা—নানাদিকেই তা গড়াল। ফলে সেই আড্ডা এক আড্ডা-বিকেল হয়ে উঠলো; এক অর্থে তা স্মৃতি, আরেক অর্থে যেন ইতিহাস।
–: সম্প্রতি ‘স্ট্যালিন’ নাটক নিয়ে বেশ রিপার্গেশন হচ্ছে।
মামুনুর রশীদ : দ্যাখেন, স্ট্যালিনকে ভুল বোঝাটা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্ট্যালিনের রাশিয়াতেই সবচে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। বড় বড় রাস্তাগুলো কে তৈরি করেছে? স্ট্যালিন না হলে হতো না। এছাড়া থিয়েটার, নাট্যমঞ্চ তো আছেই।
–: গোর্কিকে স্ট্যালিনই কি নির্বাসনে দেননি?
মামুনুর রশীদ : আসলে মূল ঘটনাটা ভিন্ন। গোর্কির সঙ্গে তার অন্যরকম সম্পর্ক ছিল। তবে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল। এ-নিয়ে আমার একটা লেখা ‘প্রথম আলো’ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। স্ট্যালিন আসলে আমরা যা ভাবি তার চেয়ে অনেক ওপরে।
–: বাংলাদেশে নাটক করার বিষয়ে আপনার আরো কোনো অভিজ্ঞতা আছে কীনা। যেমন আলোচনায় বলছিলেন…
মামুনুর রশীদ : নাটক করে একবার ফিরছি। নির্মলেন্দু গুণ আমাদের সঙ্গে। তখন ওর থাকার জায়গা নেই, খুব খারাপ অবস্থা। সে আমার অকৃত্রিম বন্ধু। তবে ওর জন্য বিপদে পড়েছিলাম। হাহাহাহা। ওর অভ্যেস টিকেট না কেটে ট্রেনে ওঠা। একাজটা সেবারও করলো। কী একটা কেলেঙ্কারি অবস্থা। পরে স্টেশনে নেমে স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটেছিলাম।
–: বাংলা নাটক বিষয়ে আপনারা যে-অবস্থান তৈরি করছেন তাতে আশাবাদী ভবিষ্যতের কোনো নিদর্শন আছে?
মামুনুর রশীদ : আমরা তো আশাবাদী। আর আশাবাদী না হয়ে উপায় কি? সেটাও নয়, আসলে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। তবে সুযোগটাও কিন্তু বাড়ছে।
–: বর্তমান নাট্যকারদের প্রসঙ্গে বিশেষ করে আপনার পথনাটকের অভিজ্ঞতা থেকে যদি…
মামুনুর রশীদ : দেখেন, বাংলাদেশে আমি যেটা বলছিলাম, অন্তত ৫০ হাজার নাটক লেখা হয় প্রতি বছর। আমার কাছে কত কত স্ক্রিপ্ট আসে। আমি তো এসব অভিজ্ঞতার মধ্যেই আছি। তো এই লেখাগুলো সব তো পড়ে দেখার সময় নেই। লেখা কিন্তু হচ্ছে, বিস্তর। কিন্তু ভালো লেখা কম হচ্ছে। বেশির ভাগই হয়তো কাজ চালানো গোছের। আপনাদের একাডেমির উপযোগী সব হবে না।
–: আপনাকে আমাদের মাঝে আবার পেতে চাই।
মামুনুর রশীদ : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি আসলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাক ফেলি না। একটা স্কুল থেকে ডাকলেও আমি সেখানে যাই। কারণ এটাই তো মূল জায়গা।
আলাপে আলাপে সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। এবার ফেরার পালা। মামুনুর রশীদ আর শুভাশীষ ভৌমিক গাড়িতে উঠলেন। তাদেরকে আবারও সম্ভাষণ জানিয়ে বিদায় নিলাম। সমৃদ্ধ একটা দিন যেন পার হয়ে গেল চোখের পলকে।
অনুলেখন : খোরশেদ আলম, লেখক ও শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।