প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক
এলিজাবেথীয় যুগের আলোকচ্ছটার অব্যবহিত পরেই ইংরেজি সাহিত্যে স্তিমিতভাব এসেছিল। চৈতন্যপরবর্তী বাংলা সাহিত্য হয়ে পড়েছিল অনুকরণম্লান। কালিদাস উত্তর সংস্কৃত সাহিত্যে যে স্বাধীন কোনও প্রয়াস মুকুলিত হয় নি, তার অন্যতম কারণ তাঁর প্রগাঢ় ছায়া। অতয়েব রবীন্দ্রনাথের মতো প্রকাণ্ড প্রতিভাকে ধারণ ও জারণ করতে বাংলা দেশের যে বহুকাল সময় লাগবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। রবিতাপে আত্মাহুতি দিতে এগিয়ে আসবেন ঐতিহাসিক স্বভাব কবির দল, স্বভাবতই। যেমন কালদাসের পর ভট্টিকুমার দাস, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈষ্ণব কবিগোষ্ঠী, শেলি-কিটসের পর প্রি-র্যাফায়লিট দল।
শেষোক্তদের কথা বিস্তৃতভাবে বলা যেতে পারে, কেননা ইউরোপীয় রোমান্টিকতার স্বর্ণযুগ শেষে এঁদের কৃতকর্মের সঙ্গে বাংলাকাব্যের রবীন্দ্রপরবর্তী রোমান্টিক ভাবোচ্ছ্বাসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গতি আছে। রোমান্টিকতার মর্মমূলে ছিল রেনেসাঁসের চেতনা, জগতোত্তীর্ণ ঈশ্বরের বদলে, মানুষ ও প্রকৃতি বিষয়ে গভীর কৌতূহল ও সহানুভূতি। শ্রেষ্ঠ কবিরা যতই অন্তর্দৃষ্টির বা কল্পনার কথা বলুন না কেন, বাহ্য জগতকে বিসর্জন দিতে কেউই রাজী ছিলেন না। কিট্স কলম ধরেছিলেন, O for a life of sensations rather than of thoughts এর জন্য, কোলরিজের বিশ্বাস ছিল And in our life alone dose Nature live. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন, দৃশ্যজগৎ ও কবিআত্মার মিলনেই কাব্যসৃষ্টি – That from thyself it comes, that thou must give./ Else never canst receive. কিন্তু ক্রমশ আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসটাই বড়ো হয়ে উঠল। বস্তুজগৎ বিসর্জন দিতে দিতে কাব্য হয়ে উঠল Sad music of senility. সেখানে ঐতিহ্য অপ্রয়োজন, নির্মাণ কলা নৈপুণ্য অবান্তর, তার ভাব ও রস সবই প্রাক্ নির্ধারিত। প্রির্যাফায়লিট কবি গোষ্ঠী শৃঙ্গার, করুণ, শান্ত ও অদ্ভুত এই ক’টি রসস্রোতে অবিরাম ভাসিয়ে চললেন সুন্দর ও সুমিষ্ট শব্দরাশি। এঁদের কাব্যকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন ‘গোপগাথার নকল ভাটিয়ালি’। আর এঁদেরই বঙ্গীয় সংস্করণদের সম্পর্কে বুদ্ধদেবের কঠিনতর মূল্যায়ণ, তাঁরা কাব্যকে করে তুলেছিলেন ‘লাঠি লজেন্স, খেলনা ঝুমঝুমি’। জীবনানন্দের দীর্ঘশ্বাস, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।
এই নকল ঝুমঝুমিওয়ালা অকবি অথবা স্বভাবকবির দল যে ঐতিহাসিক নিয়মেই আবির্ভূত হন, বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে অভিজ্ঞতার কারণেই আধুনিক বাংলা কবি-সমালোচকদের তা অজানা ছিল না। তাই রোমান্টিকতা উত্তর ইউরোপে যে কাজ করেছিলেন বোদলেয়ার, মালার্মে, এলিয়ট এবং কিয়দংশে ইয়েটসও, বাংলাদেশে সেই কাজে হাত লাগালেন তাঁরা। দরকার হল বহু পুরোনো একটি প্রত্যয়ের পুনরুচ্চারণ – কবিতা এক নির্মাণ শিল্প, যা আত্মসচেতন কিন্তু আত্মগত নয়, হৃদয়সঞ্চারী কিন্তু মেধা বিমুক্ত নয়। কল্পনার অশ্বকে বৈদগ্ধের বল্গা পরানোই কবির কাজ।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘জন্ম রোমান্টিক/ রসতীর্থ পথের পথিক’। কিন্তু Romantic fallacy র বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি তাঁর কণ্ঠে বারবার শোনা গেছে। তিনি বলেছেন, জগতের ওপর মনের কারখানা বসেছে। বাহ্যজগৎ সংবেদনশীল মানব মনকে রাঙিয়ে তুলছে। আর তার উপরে বিশ্বমনের কারবার। সাহিত্যের উৎপত্তি সেই উপর মহল থেকে। অর্থাৎ ঐ সংবেদনশীল মানুষটির যদি আপন অনুভবকে বিশ্বাতিশায়ী ক’রে তুলবার ক্ষমতা থাকে তবেই তিনি সাহিত্যিক। সে জন্য কী প্রয়োজন? রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রয়োজন কলাসৃষ্টির নৈপুণ্য, শ্রী ও হৃ, অর্থাৎ সৌন্দর্যকে নির্মাণ ও তার দ্বারা অন্যের হৃদয় হরণ করার দক্ষতা। নীলনদকে দেখে যুগে যুগে কত মানুষই তো মুগ্ধ হয়েছে, কত ভাবোচ্ছ্বাস জেগেছে তাদের মনে কিন্তু সেই নীরব কবিত্বের কোনও বিশ্বাতিশায়ী মূল্য নেই। মূল্য আছে নীলকে নিয়ে শেলি, বায়রন, লি হান্টের লেখা কবিতার। তার মধ্যে বিশেষ ক’রে শেষোক্তজনের কবিতাটি যে পাঠক জনপ্রিয়তর তার কারণ ওর ছন্দ, শব্দচয়ন, গ্রন্থনা – এককথায় নির্মাণ কলানৈপুণ্য। এখন নীলনদটা যেহেতু বয়ে চলেছে এবং তাকে নিয়ে যেহেতু উৎকৃষ্ট কাব্যরচনা হয়েছে, অতয়েব যে কোনও অদীক্ষিত মানুষই যদি কাব্যরূপে আপনার নীলদর্শন অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাতে থাকে, তাহলে সাহিত্যের ভার বাড়বে, ধার বাড়বে না।রবীন্দ্রনাথ বার বার স্মরণ করেছেন প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকদের, যাঁরা বিশ্বাস করতেন বিষয়ের গুরুত্বে নয়, রীতি, ধ্বনি, অলঙ্কারের চমৎকারিত্বেই রসনিস্পত্তি হয় কবিতার। আমাদের কি মনে পড়বে দেগাকে দেওয়া মালার্মের উপদেশ, ‘One makes poetry with words, not with ideas’ অথবা ‘What do you read My lord?’ পলোনিয়াসের এই প্রশ্নের জবাবে হ্যামলেটের সংলাপ ‘Words, words, words.’
এখানে উল্লেখ করা দরকার, প্রথানুবর্তন ছেড়ে শব্দসজ্জার ঐতিহ্যসম্মত অথচ নিজস্ব উপায়টি খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়; বিশেষত রবীন্দ্রনাথের করোজ্জ্বল জীবৎকালে। রবীন্দ্রনাথ ঔপনিষদিক ও সমকালীন দুই ভূখণ্ডে পা রেখে দাঁড়িয়ে অজস্র কাব্য উৎপাদন করেছেন – কখনও 'ক্ষণিকা'র মতো খেলাচ্ছলে, কখনও 'গীতাঞ্জলি'র মতো পূজার ছলে, কখনও 'লিপিকা' বা 'পুনশ্চ'-র মতো গল্পচ্ছলে । এমন কি সহজপাঠের শিক্ষাছলে লেখা পদ্যও যে কবিতা হয়ে উঠেছে তার মূল কারণ হল গভীর সংবেদন ও বিরাট কারুপ্রতিভা। অথচ বাঙালীর তা এতই আপনার, এতই সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হল যে কবিতা লেখাটাই হয়ে উঠল সহজ ব্যাপার। Best words এবং Best order দুইই পাওয়া গেল রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভাণ্ডারে – অফুরন্ত পরিমাণে। পাখনা পুড়ল যতীন্দ্রমোহন, কিরণধণ, করুণানিধান, কুমুদরঞ্জনের। এঁদের আত্মাহূতির পরে মোড় ফেরার ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, বিশেষত নজরুল। কিন্তু এঁদের এবং তৎপরবর্তী আধুনিক কবিদের গোড়ার দিকের রচনাতেও রবীন্দ্রনাথের প্রবল ও সরব পদধ্বনি। এর নিদর্শন ‘বিষের বাঁশী’, ‘মর্ম্মবাণী’, ‘তন্বী’, ‘ঝরা পালক’। তবু ‘মর্ম্মবাণী’র কবি যে একদিন ‘শীতের প্রার্থনাঃ বসন্তের উত্তর’ লিখতে পারবেন, তার কারণ, তাঁরা ঠিক সময়ে রবীন্দ্রানুসারী কবিদের ‘কৃত্রিম,কবিতা লেখারই জন্য ফেনিয়ে তোলা অনুভূতি’ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, কবিতা লিখতে হবে নিজস্ব ও সমকালীন অনুভবে, বিদগ্ধ কণ্ঠস্বরে। তাদের প্রথাবিরোধিতার পিছনেও কিন্তু ছিল রবীন্দ্রনাথেরই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা। অমিত রায়ের মুখে অনেক আগেই আমরা জেনেছিলাম, ফজলি আমের পর ফজলিতর আম নয়, বরং আতা ফলের অর্ডার দিতে হয় সাহিত্যবাসরে। রবীন্দ্রনাথের পর রবীন্দ্রতর নয়, রবীন্দ্রউত্তর হয়ে উঠতে হয়।।
রচনাটি অপ্রকাশিত। রচনাকাল ১৯৯৯
সুভাষ মুখোপাধ্যায় সুন্দর : নূতন প্রণয়ের ইস্তাহার
বাংলা সাহিত্যের ভগীরথ বঙ্কিমচন্দ্র একদা বঙ্গদর্শনের পাতায় আহ্বান জানিয়েছিলেন,"কবিগণ সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে থাকুন"। তাঁর আহ্বান বৃথা হয়নি বটে, কিন্তু সুন্দরের সংজ্ঞা, স্বরূপ ,অবস্থান ও জাতিবিচারে তৈরি হয়েছে নানা প্রভেদ। এই প্রভেদের মূলে আছে বিবিধ কালপর্ব, সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ, বিশেষ বিশেষ শৈল্পিক মতাদর্শের প্রভাব এবং অবশ্যই ব্যক্তিগত মর্জির ছাপ। তাতে সুন্দর আপন মূল্য হারায়নি বরং তিলে তিলে নূতন হয়েছে।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর উত্থান চল্লিশের গোড়ায়। বালক বেলায় তিনি দেখেছেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল বাংলাদেশ, কৈশোরে শুনেছেন ঝুটাআজাদির বিরুদ্ধে শ্লোগান, তারুণ্য কাটিয়েছেন দাঙ্গা, দেশভাগে রক্তাক্ত মানুষের পায়ে পা মিলিয়ে। তাদেরই সঙ্গে এসে দাঁড়িয়েছেন রক্তপতাকার তলায় । স্বভাবতই প্রাগাধুনিক 'কলাকৈবল্যবাদী' কিম্বা আধুনিক 'প্রকৃতিবাদী'দের নন্দনভাবনার মধ্যে তাঁর কবিসত্তা আশ্রয় পায়নি । অথচ সৌন্দর্য সৃষ্টি করাকে প্রধান বা একমাত্র না হলেও, কবির অন্যতম কাজ বলে সুভাষও মনে করেন । বিশ্বাস করেন , সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ উদ্ভাস প্রেমে। তাই 'হে দিকভ্রান্ত আমি তো বুঝি/ তোমার জটিল হারানো পথে/ বাতি যে ধরব সেটুকু পুঁজি/ আলেয়ার নেই'- সমকালীন ও অগ্রজ ও কবিদের উদ্দেশ্যে এ কথা উচ্চারণ করেই তিনি লেখেন, 'ঠিকানা বদলে প্রণয় খুঁজি'- এই প্রণয় সংঘে লালিত। হাতে হাত ধরে লাল টুকটুকে দিন আনার স্বপ্নে মশগুল। 'সুন্দর' এই নূতন প্রণয়ের ইস্তাহার।
কবিতাটির বিষয় একটি সুন্দরী মেয়ে নয়, বরং একটি মেয়েকে সুন্দর করে দেখা । তাই এখানে যে কোনো সার্থক কবিতা বা শিল্পকর্মের মত সৌন্দর্যসৃষ্টি তো হয়েইছে, উপরন্তু এটি হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি সরস ডিসকোর্স। সুন্দর কী ও কোনখানে সে বিষয়ে কবির দৃষ্টিভঙ্গি এত বিশ্বস্ত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে যে আমরাও অজানতে ঐ বিশ্বাসের অংশীদার হয়ে পড়ি।
আলোচ্য কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রধান উপকরণ চিত্রকল্প। তুলির একএকটি ঋজুরেখার মত পংক্তিগুলিতে একটি মেয়ের নানা ছবি ফুটে উঠেছে ত্বরিতে, কিন্তু অনিবার্যভাবে। সেগুলি পরস্পরলগ্ন করে দেখলে কবিমানসীর সামগ্রিক রূপটি গোচরীভূত হয়, কিন্তু চিত্রকল্পগুলি শুধু সামগ্রিকতার অংশ নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণও বটে। প্রথমে আঁকা হয় শাড়ির উড়ন্ত আঁচলটি। আঁচল দমকা হাওয়ায় উড়ছে, অর্থাৎ আকাশসীমা কিছুটা ধরা পড়ছে প্রেক্ষাপটে। অতঃপর বিকেলের উল্লেখ ,আকাশে অস্তসূর্য। তার আলো প্রতিফলিত হয় মেয়েটির মুখে, ঘামের বিন্দুতে। মুখটিও আঁচলের মতোই আকাশপটে লগ্ন থাকে। ঘামের ফোঁটা 'জ্বলছিল' বা আঁচল 'উড়ছিল' এ ধরণের শব্দব্যবহারে চিত্রকল্পের মধ্যে একধরণের স্পর্শবেদ্য অনুভব সঞ্চারিত হয়। শাড়ির আঁচল ও মুখের ছবির যে ফ্রেম তা অকস্মাৎ বহুদূর প্রসারিত হয়ে যায় 'আকাশ উদ্ভাসিত করে' মেয়েটির হেসে ওঠায়। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, সুভাষ যে কথাই বলুন না কেন, তা দুলে ওঠে এক বেপরোয়া স্ফূর্তির সুরে। উল্লিখিত চিত্রকল্পগুলির দ্রুতি, সংক্ষিপ্ত ও উষ্ণতার মধ্যে সেই সুর স্পষ্ট শোনা গেল। উপরন্তু বোঝা গেল কবি মেয়েটিকে স্রেফ বিচ্ছিন্ন করে, একার করে দেখতে চাইছেন না, বরং একটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের উপর রেখেই দেখতে চাইছেন। কিন্তু খটকা লাগে প্রতিটি চিত্রকল্পের পর ‘তখনও নয়’ পদবন্ধের প্রয়োগে। তাহলে কি তিনি আকাশের চেয়েও বড়, আরও তাৎপর্যপূর্ণ, গভীর, আরও বেশী বজ্রবিদ্যুৎ ধারণক্ষম, আরো স্বপ্নসম্ভব কোনও প্রেক্ষাপটের সন্ধানে আছেন, যা তাঁর মানসীর প্রকৃত সৌন্দর্যকে স্পষ্ট করে তুলবে? যে নেতির পদ্ধতিতে, ডিডাকটিভ লজিকে কবি সুন্দরের সন্ধান করেছেন তা যেহেতু দর্শন আলোচনায় সুপরিচিত তাই ক্রমান্বয়ে ‘তখনও নয়’ পদবন্ধের মধ্যে শুধু ব্যক্তিগত প্রেমের নয়, একটা দার্শনিক আততিও সঞ্চারিত হয়ে যায়।
সর্বশেষ চিত্রকল্পটির চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল, কবি যার ছবি আঁকতে চান তাকে আর দেখাই গেল না। মনে হল তাকে না দেখলেও চলে। আসলে যে কোনও চিত্রকল্পেরই প্রধান কাজ বাহ্যরূপের মধ্যে চারিত্রিকতার আরোপ। এখানে মেয়েটিকে ঘিরে ধরা মাথায় চটের ফেঁসো জড়ানো মজদুরেরা, তার হাতকে আচ্ছন্ন করা সহস্র মেহনতী হাত ঐ মেয়েটির চারিত্রিকতাকে, তার কামারাদেরিকে যতটা স্পষ্ট করে চিনিয়ে দেয়, আগেকার কবিপ্রসিদ্ধ ছবিগুলি তা পারেনি। এই জন-সংঘই মানসীকে দেখার, চেনার, তার সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার শ্রেষ্ঠ চিত্রপট। এখানেও আকাশ আছে, কিন্তু তার উত্তোলিত বাহু ও ছড়ানো ইস্তাহারে আচ্ছন্ন। ঐ ইস্তাহারের আহ্বানে, বাহুর আন্দোলনে যে সংকেত। তা হয়তো সত্যিই আকাশের চেয়েও গভীর, আরও স্বপ্নসম্ভব। প্রথম তিনটি ছবিতে একটি মেয়ে এবং অনুরক্ত কবির চাহনি- এর বেশী কিছু ঠাহর করা যায় না। ‘কী একটা কথা’ শোনা যায় বটে কিন্তু বক্তা যা কবি স্বয়ং তা বলা হয় না। মনে হয় এই রঙ্গমঞ্চে আরো পাত্রপাত্রী আছেন, যদিও তাঁরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন। এরকম সন্দেহও হতে থাকে যে কবি মেয়েটিকে দেখেছেন, গোপন এক অন্তরঙ্গতায়। শেষে যখন বেনো জলের মত অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে জনস্রোত, সেই নিভৃতি ভেঙে যায়। আকাশ সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গেলে, কবিমনের গোপন দ্বীপটি যে সেই ভাসানে তলিয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কবিতার অন্তিমে আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করি, জনসমুদ্র কবি ও তাঁর মানসীকে বিচ্ছিন্ন করে নি, বরং এক করে দিয়েছে। অগণ্য লড়াকু মানুষের সহযোদ্ধা হিসেবে নতুন এক সেতুবন্ধন রচনা করেছেন তাঁরা দুজনে। এতক্ষণ নেতির শাসনে বন্দি আমাদের সৌন্দর্য-তিয়াস বিপুল উল্লাসে স্বস্তি পায়। শেষ পংক্তিটি যেহেতু দার্শনিক প্রত্যয়সঞ্জাত, তাই প্রফেটিক। অথচ ‘আশ্চর্য সুন্দর’ শব্দবন্ধের প্রয়োগে এক মধুর ও ব্যক্তিগত অনুভবকে, সেই অনুভবের তীব্রতাকে চমৎকার ধারণ করে থাকে।
সেই 'চিরকুট'-এর আমল থেকেই সুভাষ কাব্যিক অনুভূতিকে আটপৌরে চলতিবুলিতে বাঁধার চেষ্টা করে চলেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান হাতিয়ার অভাবিত অন্ত্যমিল ও চার বা ছ'মাত্রার মধ্যলয়ের ছন্দ, কখনও বা হস্ ধ্বনির ঠেকনা দেওয়া পয়ার। 'সুন্দর' কবিতায় অন্ত্যমিল নেই। সমমাত্রিকপংক্তি নেই। যতিপাতের মধ্যে গদ্যছন্দের অলক্ষ্যচারী স্পন্দন আছে মাত্র। অলংকারের বাড়াবাড়িও নেই। কেবল মুখের উপর জ্বলে ওঠা বিন্দু বিন্দু মুক্তো আর 'মাথায় চটের ফেঁসো জড়ানো এক সমুদ্র'। এখানে তুলনাটা হচ্ছে সমুদ্রের সঙ্গে জনতার, কিন্তু জনতা বা সাধারণ ধর্ম হিসেবে উভয়ের তীর ভাঙা প্রাবল্যের কোন উল্লেখ নেই । জনতা সমুদ্রের মতো নয়, স্বয়ং সমুদ্র হয়ে উঠেছে। উপমাটা আরো স্পষ্ট হয় 'বাহুর তরঙ্গে' পদবন্ধে। জনতার অঙ্গ বাহু আর সমুদ্রের অঙ্গ তরঙ্গ। কিন্তু অলংকার জগতে এ জাতীয় রূপক মোটেই অদৃষ্টপূর্ব নয়। কবিতাটির আসল জোর ছন্দ বা অলঙ্কারে নয়, আগেই বলা হয়েছে চিত্রকল্পের মধ্যে এবং যে অকৃত্রিম সারল্য ও আশাবাদে চিত্রকল্পগুলি স্পন্দিত হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে নিহিত ।
‘সুন্দর’ কবিতাটি যেকোনো সার্থক লিরিকের মতোই একটুখানির মধ্যে অনেকখানি ভাবব্যঞ্জনাকে বিকশিত করে। একটি সামান্য ঘটনার আশ্রয়ে, সৌন্দর্যবিচারের প্রচলিত মতাদর্শ খণ্ডন করে নূতন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠা দেয়। ধ্রুপদী তত্ত্ব বলে, যা সুন্দর তা ঈশ্বরসৃষ্ট, সাব্লাইম। কেবল ধ্যানীরাই তা উপভোগ করতে পারে। ‘সুন্দর’-এর কবি ধ্যানী নন, রুটি-রুজির লড়াইয়ে ব্যস্ত। কারখানা সংলগ্ন পথের ধূলায় তথাকথিত সাব্লিমিটিকে তিনি নিশ্চিহ্ন করেছেন। রোমান্টিক নন্দনতত্ত্ব বস্তুর উপর চেতনাকে আর প্রকৃতিবাদ চেতনাকে নস্যাৎ করে বস্তুকে গুরুত্ব দেয়। সুভাষ ঐদুই রাস্তার কোনোটাতেই হাঁটেন নি। বরং মার্ক্সবাদসম্মত রূপে বস্তুভিত্তিক চৈতন্যকে বাণীবদ্ধ করেছেন। উদ্দিষ্ট মেয়েটি প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর কি কুৎসিত সেটা এখানে বিচার্যই নয়। দেখার বিষয় হলো, কবি তাকে আপন কাল, শ্রেণী ও সংগ্রামী বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে কীভাবে আবিষ্কার করছেন। ‘সাহিত্য মেলা’ ১৩৬৪’তে ‘পাঁচ বছরের কবিতা’ শীর্ষক একটি আলোচনায় সুভাষ বলেছেন, ‘আমি দেখেছি চোখের ঘোর মুছতে মুছতে অগণিত মানুষ দুরন্ত স্পর্ধা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। একবার আশায়, একবার হতাশায়, কখনো প্রেমে, কখনো সংগ্রামে। একই কবির মধ্যে তা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এর কোনটাই আলাদা করে সত্যি নয় একসাথে সত্যি। আবার একসাথেও এরা সত্যি হবেনা যদি দেখার চোখ না থাকে।’ এই চোখ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদীর, যা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাধনা করতে গেলে অর্জন করতেই হয়। যেমন করেছিলেন ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধের মধ্যে এলসার প্রণয় রচয়িতা আরাগঁ। ‘ So deep your eyes that I lean to drink/ Their pools the light of all the suns reflect’- এই পংক্তি প্রণেতা সিমোনভ। কিম্বা সুভাষের প্রিয় কবি নাজিম, যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রিয়তমাকে দেখেছিলেন, ‘নক্ষত্রের নীচে জ্বলা অগ্নিকুণ্ডের মত’।
বাংলা কবিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, সুভাষের আগে বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সমর সেন- আরো অন্তত তিনজন আধুনিক কবি মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু বিষ্ণু দে হয়তো বৈদগ্ধের অভিমানেই, হাটুরে প্রাত্যহিকতায় নেমে আসেন নি কখনো। রবীন্দ্রনাথের আনন্দ-নিষ্যন্দী সুন্দরকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেননি। প্রেমেন্দ্র সেই চেষ্টা করেছিলেন, কারণ তার ধারণা ছিল প্রিয়ার সাশ্রু মিনতির দিকে নজর দিতে গেলে কামার-মুটে-মজুরের সামীপ্য লাভ রীতিমতো অসম্ভব। সমর সেনও ‘মহুয়ার দেশ’ অর্থাৎ ভালোবাসার এলডোরাডো আর ‘ধূসর শহর’-এর দূরত্ব এঁকেছেন।তাঁর কাব্যে দৈনন্দিনতায় ক্লান্ত ম্লান মেয়ের প্রেমের কথা আছে, প্রেমজ আনন্দ নেই। সুভাষ এই দুই জগৎকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। এই জন্যই আলোচ্য কবিতাটি, অথবা ‘মিছিলের মুখ’, ‘জয়মণি, স্থির হও’, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ প্রভৃতি সমজাতীয় কবিতাগুলি বাংলা কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক বলে বিবেচিত হতে পারে। বুদ্ধদেব বসু ১৯৩৮ সালে লেখা সমালোচনায় ‘চিরকুট’এর মধ্যে কোনও প্রেমের কবিতা খুঁজে পাননি। কিন্তু পরে, প্রেমের কবিতা সংকলন করতে বসে আবু সৈয়দ আয়ুব যখন ‘মিছিলের মুখ’কে বেছে নেন তখন বোঝা যায় সুভাষের নূতন প্রণয়ন, তাঁর রেভলিউশনারি রোমান্টিসিজম, দেরিতে হলেও কবি প্রসিদ্ধ হয়েছে।
‘সুন্দর’-এর উদ্দিষ্টা প্রেমিকা কি একটি মেয়ে মাত্র, নাকি স্বয়ং প্রেম ? সে কি কাব্যের নায়িকা, নাকি স্বয়ং কবিতা? যদি প্রেম হয় তাহলে মৃত্যুঞ্জয়, কেননা তা পরীক্ষিত হয়েছে সংগ্রামে, সহকর্মিতায়, সহমর্মিতায়। যদি কবিতা হয় তাহলে তার মধ্য দিয়ে শুধু আজ নয় ভবিষ্যতেও পারাপার করে চলবে ‘দুটি হৃদয়ের সেতুপথে/ সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলমুক্ত ভালোবাসা’।
রচনাটি অপ্রকাশিত। রচনাকাল ১৯৯৯