প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
কৌশিক মূলত নাটককার - প্রাবন্ধিক। তার লেখা একটি মাত্র ছোটোগল্পের খোঁজ পেয়েছি আমরা।
গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে 'রৌরব’ পত্রিকায়, জুলাই - সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সংখ্যায়।
শিকারগড়ের রূপকথা
দুটো স্কলার আর একটা মেয়ে, জঙ্গলে গেছিল শুকনো পাতা কুড়াতে। সকলেই ট্রেনে চেপেছিল একসঙ্গে, সকলেই এসেছিল শিকারগড়ে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। প্রথম স্কলার চায় শুকনো পাতার ছিলা ও তন্তুগুলি পুড়িয়ে তা দিয়ে কাজল তৈরি করা যায় কিনা পরীক্ষা করে দেখতে। তার বিষয় জৈববিদ্যা। দ্বিতীয়জন বিচার করে পাতাদের রং ও শরীর বিন্যাস-- তার পুনর্সৃষ্টি ঘটবে কাগজে, মঞ্চে। তার বিষয়ে কলা।মেয়েটি স্কলার নয়, তাই এখনও একটু একটু গান গায়, বৃষ্টি হলে পা সুড়সুড় করে নাচার জন্য, সুযোগ হলেই বিনুনিতে গুঁজে নয় আকাশী ফুল।
মেয়েটি পাতা কুড়োয়, কাঠ কুড়োয়, মরা বাকল কুড়োয়, তাই দিয়ে হাভাতে বাচ্চাদের জ্বালানি হবে বলে। প্রথম স্কলার বলে প্রজেক্ট ফর স্লাম চিল্ড্রেন, দ্বিতীয় স্কলার বলে প্রজেক্ট ফর স্পাসটিক'স এইড। মেয়েটা বলে কিছুইনা, শুধু দু'মুঠো অন্ন জোগাড় হাঘরেদের, যার কেউ নেই নেই তারও কেউ না কেউ থাকে। ওদের বাড়ি আলাদা আলাদা পল্লীতে। ১ জন থাকে পাতাল রেলের গুহায়, ১জন কলকাতার মেঝেয়,১জন উঁচুতে ইলেকট্রিক তার কিংবা কেবলের ওপর ঝুলে ঝুলে, সে মাটিতে নামলে কানে একটা ভুঁইকুমড়োর ডাল গুঁজে রাখে যায় ওতে দোষ কেটে যায়।
১জন গুহা থেকে মাটিতে এলে প্রায়শ্চিত্ত করে গোবর খেয়ে, গালে মাখে জিংক আর ভুসো কালি। মেয়েটি আলোয় কালোয় আসে যায় খুশিমতো। তার পাসপোর্ট নেই, কোন ভিসা নেই।
ট্রেনে চাপার আগে শিকারগড় নামটা তিনজনেই শুনেছিল। কখনো আসেনি। ট্রেনে চাপার পর প্রথম স্কলার দ্বিতীয় স্কলার এর সাথে মেয়েটির আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল," একে আমি ডাকি নন্দিনী বলে।" দ্বিতীয়জন বলেছিল --" নমস্কার। তার চেয়ে নন্দা ভালো।" মেয়েটি আসল নাম বলেনি নিজের! শুধু হেসেছিল। তার কোনো মানে নেই আবার অনেক মানে।প্রথমজন রাতের খাবার নিতে নিতে বলেছিল -- "তোমাকে বরং নদী বলা ভালো। স্রোতে স্রোতে একেবারে পয়মাল করে দিলে।" দ্বিতীয়জন আঁচিয়ে এসে ঘোষণা করেছিল -- "বুঝলাম। কিন্তু তারচেয়ে নীনা ভালো।"
নীনা কিংবা নন্দিনী কিংবা নদী কিংবা নন্দা সেই মেয়েটি ট্রেনের ধিকিনাক দুলুনিতে রাতে স্বপ্ন দেখেছিল এক গোপবালকের, যে মোহনবাঁশীতে সুর বাজালেই জ্বলে ওঠে অজস্র ভিয়েন, তাতে ধবলী গাইয়ের দুধ ফুটে ওঠে হাভাতে শিশুদের জন্য।
সকাল এগারোটা অবধি ট্রেনের বাকি পথটায় একজন তাকে ডাকলাম 'মোনা' বলে। অন্যজন 'লিসা'। দুজনেই পরস্পরের সামনে ওকে ডাকল 'ওগো' বলে। ও ও কথা বললো ভাববাচ্যে। কখনো 'শুনছো'। কখনো 'এই যে'। কখনো স্রেফ ইশারায়।
জলে জঙ্গলে সাত দিন সাত রাত্রি হেঁটে একটা ন্যাড়া বেল গাছের গোড়ায় তাঁবু খাটাতে খাটাতে প্রথমজন দ্বিতীয় জনকে খুব নিচু গলায় জানিয়ে রাখল শরীরে ওই মেয়েটির শরীরে কটা তিল আছে তা সে বহু বছর ধরেই জানে। দ্বিতীয় জনের নাম ছিল গলাবাজিতে -- হাসি-- গান-- গল্পে -- সে ঠাট্টা করে বন ফাটা হাসি বমি করতে করতে বলল -- "অল দি রিলেশনশিপ ইজ অনলি দ্য রিলেশনস অফ রিলেশনশিপ অ্যান্ড দ্য ফ্রেন্ডশিপ অফ ফ্রেন্ডলি রিলেশন আর এভরিহোয়ার।" প্রথমজন কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল -- "স্ট্রাকচারালি এই মেসেজটার একটা কন্ট্রোভার্শিয়াল অ্যাপ্রোচ আছে --।"
মেয়েটি গিয়েছিল হরিণ ধরতে। ওদের হাসিতে খুশি হয়ে সে এনে দিল ঝর্ণার জল আর ফলমূল। হরিণ খেয়েছে তার আমিশাষী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে।
ক্যাম্পফায়ারের আগুনে ওরা মুখ দেখেছিল পরস্পরের। আভা নাচছিল মেয়েটির পুকুর চোখ, পবিত্র ওষ্ঠ আর অনাদি কপোলে। সে কাঁচুলির ভিতর থেকে বার ক'রে দেখাল একটা হীরের আংটি। ওটা ও কুড়িয়ে পেয়েছে এখানেই। এই জঙ্গলে। ভরা সন্ধ্যেয়।
শিকারগড়ের নামটাই ওরা শুনেছিল। কখনো আসে নি। তাই জানতো না, এখানে বালি -- চোরাবালি -- জঙ্গল -- ঝোপঝাড় -- জল -- ঘোলা ডুবজল -- আবার স্বচ্ছতোয়া ঝরণাও আছে। সেই ঝরণাটা মেয়েটি আবিষ্কার করেছিল। সক্কালবেলা সূর্য ঠাকুর যখন কুমকুমের মত প্রথম আলোটি ফেললেন সেই জলে, ওরা স্নান সেরে উঠল। কিন্তু নির্মল হল না। কেন? জীবনে প্রথম কেন সকাল বেলা শুদ্ধতা দিল না তাকে -- মেয়েটি ভাবে। আর পাতা কুড়োয়। জানতে চায় ২য় জনের কাছে। ১ম জন ধারেকাছে নেই দেখে সে পকেট থেকে বার করল হলুদ কস্তুরী। বড় সুগন্ধ। ম্যাজিশিয়ানের মত ঝাঁঝালো সুগন্ধী মেয়েটির দুই চোখের উপর দোলাতে দোলাতে সে ধরল সম্পর্কের গান --
" শিল্প কোথায় মানুষে
মানুষ কোথায় ফানুসে
ফানুস কোথায় ডুবজলে
সেথায় সবুজ মখমলে
পিদিম জ্বেলে একখানি
খাচ্ছ তুমি জলপানি ।
আমার ছায়া দোলে
তোমার পিঠে কোলে
মনের খবর আমি
সবচে বেশি জানি
(যদি) আকাশে দাও পাড়ি,
(সবাই) শুদ্ধ হতে পারি।
বন্ধু মানুষ মানুষ ভাই
ফানুস ছাড়া মানুষ নাই।। ''
ঝিঁঝিঁ পোকার মত এই অনন্ত সঙ্গীত শুনতে শুনতে ক্রমশঃ ভারী হয়ে বুঁজে আসছিল মেয়েটির চোখের পাতা। এমন সময় ১ম জন শুকনো পাতার ভারী বস্তাটা ধমাস করে ফেলে, এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। ২য় জন তাড়াতাড়ি একটা ভুঁইকুমড়োর ডাল দোলাতে লাগল বাতাসে। ওতে সব দোষ কেটে যায়। সম্বিত ফিরে পেয়ে মেয়েটা ১ম জনকে জিজ্ঞাসা করল আকুল হয়ে -- " ওগো, তুমি কি জানো, কেন আমি শুদ্ধ হলাম না?"
সে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ধমকে উঠল -- " চুপ! আগে ওদিকে চল ঝোরার পিছনে, পাথরের ঝুপসি আড়ালটায়।" মেয়েটাকে নিয়ে গেল টানতে টানতে। হাত পা শক্ত করে বাঁধল বুনো লতায়। ছিঁড়ে ফেলল ঘাগরা ও কাঁচুলি। তারপর জিজ্ঞাসা করল -- " এখনো জানতে চাও, সব জটিল ধাঁধার উত্তর?"
মেয়েটা চোখের জল গিলে ফেলে বলল -- "চাই। তুমি তো কত সহজে আমাকে দিক দিগন্তের রহস্যের কথা বুঝিয়ে দিয়েছ!" ১ম জন তৎক্ষণাৎ তার নখ দিয়ে মেয়েটার যোনি থেকে গ্রীবা অবধি চিরে ফেলল লম্বা করে। ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্ত নিজের আর মেয়েটার দুই গালে মাখতে মাখতে বলল -- " এইবার দেখা যাচ্ছে তোমার লিভার থেকে ল্যারিংস। আমি তোমাকে চিনলাম। এখন শুদ্ধ হও।...
ওঁ প্রাণীয় স্বাহাঃ!"
২য় স্কলার ভুতুম জঙ্গলের মধ্যে পাতা কুড়োতে কুড়োতে আর একটা গান বেঁধেছিল সেদিন। নাম দিয়েছিল অবচেতনার গান। ১ম স্কলার তা শুনে কাষ্ঠহাসি হেসে ওর পিঠে হাত রেখে বলেছিল- “ এটা বোদলেয়ারের প্রভাব ।তুমি মাত্রা গুণতে শেখোনি।”
প্রথম দিন বিকেলে ভাতঘুম দিয়ে উঠে ১ম জন কাউকে খুঁজে পেল না ।একটু দূরে পোড়া ছাই থেকে তখনও ভাপ উঠছিল গরম। ওর পাশের কম্বলে তখনও বন্ধুর ওম লেগে আছে।তাঁবুর কাণাতে সাঁটা আছে চুমকির টিপ, শুধু তারা নেই। ১ম জন পাগলের মত জোঁক, কাদা আর বালি মাড়িয়ে ছুটল সোজা উত্তরে। সঙ্গে নিল না কিছুই। পিছনে পড়ে রইল শুকনো পাতার তিনটে বস্তা, অনেক বই, ল্যাবরেটরির সাজসরঞ্জাম, ডায়েরি আর কলম, কম্পাস আর ম্যাপ, একটা ভোজালী। ভোজালীটা এতদিন বয়ে বেড়িয়েছে সে । দরকারে অদরকারে একটুখানি কুপিয়ে দিয়েছে মাটি, জল কিম্বা বাতাস। আজ ভুলে গেল। হু হু হাওয়া বইতে লাগল তাঁবুর ফুলে ওঠা কাণাতে। উইয়ের ঝাঁক এগিয়ে এল ওদের বাক্সে বিছানায়।
শিকারগড় স্টেশনে তখন শোনা যাচ্ছে লাস্ট ট্রেনের হুইসল।দূরে বিন্দুর মত কিন্তু প্রত্যয়ী একটা শব্দ ফুটে উঠেছে দিগন্ত রেখায়। ট্রেন আসছে। রক্ত বমি করতে করতে ১মজন সেই মুহূর্তে এসে পৌঁছল প্লাটফর্মে । তার পা ক্ষতবিক্ষত। তখনও সে রক্তের গ্রুপ নিয়ে ভাবছিল। রক্তের জ্যামিতি,তার স্ট্রাকচার ,ঘনতা উচ্চতা নিয়ে। ভাবছিল নকল রক্ত বানানো যায় কিনা! হঠাৎ লেভেল ক্রসিং বরাবর চোখ আটকে গেল তার। সিল্যুট আলোতে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মূর্তি। ১মজনের পা যেন বহুযুগের বৃদ্ধ বটের মত আটকে গেল মাটিতে। মুহূর্তে খেয়াল হল সে কে- ওরা কারা -কেন সে এখানে এসেছে। নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য ও মন্ত্রের মতো আউড়াতে লাগল ফয়েরবাখের কোটেশন। তারপর লেভি স্ত্রাউস, শেষমেষ সিমো দ্য বোভোয়া।
মেয়েটা খুব আস্তে আস্তে বলল –
“যাচ্ছি।”
২য় স্কলার হাওয়ায় গলা ভাসিয়ে দিয়ে বলল- ওনলি দা ফ্রেন্ডলি অ্যাটমোস্ট ফেয়ার ক্যান রিমেইন ইন দ্য ফ্রেন্ডশিপ অন্ড লাভ বাট ফ্রেন্ডস আর নট ইন্ডিভিজুয়াল অ্যাজ আ হোল ম্যাগনিচিউটস অফ পারসন্স অ্যান্ড পারসোনালিটিস হাওয়েভার।
ট্রেনটা শুঁয়োপোকার মত নেই আর। দুরন্ত নেউলের মত ফুঁসে উঠে শিস দিতে দিতে মাটি কাঁপিয়ে এসে দাঁড়াল শিকারগড় হল্টে। এক মিনিটের মধ্যেই ঝমাঝম শব্দে শব্দে চৈতন্য বধির করে চলে গেল যেন। লাস্ট ট্রেন এর অন্তিম কামরার পিছনের গোল গোল লোহার দুটো ১ম স্কলারের চোখের ওপর ভেসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দূর দূর দূর অন্ধকারে হারিয়ে গেল টুপ করে। চরাচর জুড়ে সুর লাগল শেয়ালের কান্নায়। ঘন হয়ে এলো শিশির ভেজা বন-ধুঁধুলের গন্ধ। সে ভারী আশ্চর্য হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। নারীমুক্তির কোন প্রশাখায় ঐ নারীটির মুক্তি ঘটল- ভাবতে লাগলো একমনে। য়ুরোপীয়ান স্কুলে-কিম্বা ফ্রেঞ্চ অথবা ব্রিটিশ। সে যাই হোক! ‘নারীমুক্তি জিন্দাবাদ !’ বলে খাবার জন্য গোবর খুঁজতে লাগলো একটু।
জিন্দাবাহার মেয়েটি রেলের করিডোর ধরে দুলতে দুলতে মধ্যরাতে এসে দাঁড়াল খোলা দরজায়। দুধ জ্যোৎস্নায় দ্রুত অপসৃয়মান অপার্থিব পৃথিবীকে প্রণাম করল মনে মনে। তারপর আকাশকে জিজ্ঞাসা করল গাঢ় স্বরে-‘তুমি কি জানো-
আমি কেন শুদ্ধ হলাম না?”
আকাশ উত্তর দিল না কোনো। শুধু মেঘ ডাকল একবার। আর কুড়িয়ে পাওয়া হীরের আংটিটা বুকে চেপে কন্যা লাফ দিল শূন্যে। সহজে গো ।বড় সহজে। দুনিয়ার হাভাতে শিশুদের সানকিতে সে শিউলির মত ফুটে উঠল অন্ন হয়ে, শুদ্ধ হয়ে।
রেলের গুমোট কামরায় তাদ্ধিনাক্ ঝিমুনিতে ২য় স্কলার তখন স্বপ্ন দেখছিল ।স্বপ্নে স্বপ্নে জ্যান্ত ভাবনার সুড়ঙ্গগুলো খুঁড়ে চলে সে। বার হয় কত রঙের দিগন্ত । ঘুমের মধ্যে নিশ্চিত বুঝলো শিল্প হলো নারী, নারী হলো গিনিপিগ, গিনিপিগ হয় সাদা, ঘুম হয় সাদা, মন হয় ক্ষ্যাপা ঃ ইমোশন রিকালেকটেড ইন ট্রাংকুলিটি।
ট্রেনের দুলুনিতে তার মুঠোয় ধরা ভুঁই কুমড়ো লতা দোলে।।