প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
সাহিত্যে বাস্তবতা - রবীন্দ্রপ্রবন্ধ অনুসারী আলোচনা
“সাহিত্যের পথে” গ্রন্থের ‘বাস্তব’ প্রবন্ধটি লেখা হয় (১৩২১) ১৯১৪ সালে। সেটা বিশ্ব মহাসমরের যুগ। রাজনৈতিক, সামাজিক, শৈল্পিক পটপ্রেক্ষায় তুমুল পরিবর্তনের ক্ষণ। সাহিত্যে বাস্তবতার সীমানা বিষয়ে বহুবিধ মতানৈক্যের প্রবর্তনা শুরু হয়েছে আবিশ্বে।
১৩০৯ বা ১৩১৯ এ বিচ্ছিন্নভাবে, বিবিধ নিবন্ধ ও সৃজনাত্মক রচনায় সাহিত্যে বাস্তবতা বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করলেও “সাহিত্যের পথে”তেই প্রথম প্রণালীবদ্ধভাবে এতদ্বিষয়ে কবি স্বমেধাকে নিয়োজিত করলেন।
বিপিনচন্দ্র পাল, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখরা রবীন্দ্রসাহিত্যে বস্তুতন্ত্রহীনতার জন্য যে ধারাবাহিক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, “সবুজপত্র” পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ তার উত্তর প্রদানে সচেষ্ট হন, রচিত হয় “সাহিত্যের পথে”র প্রবন্ধাবলী। যেগুলোর মধ্যে ‘বাস্তব’ ছাড়াও ‘তথ্য ও সত্য’, ‘সাহিত্যধর্ম’, ‘সাহিত্যতত্ত্ব’, ‘আধুনিক কাব্য’ প্রভৃতি রচনায় – সাহিত্যে বাস্তবতা বিষয়ে রাবীন্দ্রিক স্বীকারোক্তি বিধৃত হয়েছে।
সেকালীন য়ুরোপে সাহিত্যে বাস্তবতাকে স্থান দেওয়ার ব্যাপারে ত্রিবিধ মত প্রচলিত ছিল। গর্কী কথিত Critical realism সামাজিক ত্রুটিসমূহকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করে, টলস্টয়, বালজ়াক বা রবীন্দ্রনাথ এই বাস্তবতাকে স্থান দিয়েছেন স্ব স্ব সাহিত্যে। Naturalism মানুষকে বিচার করতে চাইল বীক্ষণাগারের গিনিপিগের মতো। মোপাসাঁ, জোলা প্রমুখরা মানবমনের জটিলতাগুলিকে সূত্রায়িত ক’রে পরীক্ষামূলক রচনা সৃষ্টিতে সচেষ্ট হলেন। আর বিশ শতকোদ্ভুত Social realism শুধু সমাজ সমালোচনা করে না, পথ সন্ধান করে পথ দেখায়। গর্কী থেকে মায়াকাভস্কির রচনা সেই উজ্জ্বল সমাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারে অভিসিঞ্চিত।
এই বহু শাখায়িত বাস্তবতাতত্ত্বের ঘূর্ণাবর্তে, রবীন্দ্রমানস আত্তীকরণ করেছিল সমালোচনামূলকতাকে, হৃদয়মনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিগতপ্রাণ রোমান্টিক কবিগোষ্ঠীকে। বিশ শতকে উনিশশতকীয় রোমান্টিসিজমের একক ধারক রবীন্দ্রনাথকে লড়তে হয়েছিল মূলত Naturalism এর সঙ্গেই।
অবশ্য ‘বস্তুতন্ত্রতা বস্তু কি’ নিবন্ধে সবুজপত্রের সম্পাদক শ্রীপ্রমথ চৌধুরীও রবীন্দ্রনাথের মতবাদকেই সমর্থন করেন। আসলে কলাকৈবল্যবাদী হলেই তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো কারণ নেই। টেনিসনের মধ্যে হয়তো ভিকতোরীয় যুগকে ধরা যায়, কিন্তু ওয়ার্সওয়ার্থ, শেলি, কিটস্ এর রচনায় মানুষের শাশ্বতমূল্যবোধসমূহ ধৃত হয়েছে। তাঁরা কালের সন্তান হলেও রসগুণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যস্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথ ‘জন্ম রোমান্টিক’। কিন্তু সাহিত্যে বাস্তব দৃষ্টিপ্রেক্ষিতের নিরিখে রোমান্টিকদের সাথে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদীদেরও মেরুপ্রতিম তফাৎ দেখতে পানি নি গর্কী। গ্লাদকোভকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এমন রোমান্টিক লেখকের সন্ধান করেছিলেন, যিনি negative phenomena নয়, romantic positive phenomena থেকে কাব্যদৃষ্টি লাভ করবেন। তাঁর “নীচের মহল” নাটকের সাতিন বলেছিল, “সত্য হল মুক্ত মানুষের ধর্ম”। এই মুক্ত মানসিক সত্যকেই দেখতে পান রোমান্টিকরা। তা বাস্তব সত্যের চেয়েও সদর্থক। তা রসসত্য। রবীন্দ্রনাথ সেই সর্বযুগসঞ্চারী সহৃদয় হৃদয়সম্বেদী বস্তুজগতোদ্ভুত কিন্তু বস্তুত্তীর্ণ রসসায়রের সন্ধান করেছেন। এ রস আলঙ্কারিক নয়, ঔপনিষদিক।
‘বাস্তব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যবস্তুগুলি বিন্যস্ত করে নিলে দাঁড়ায় –
১। সাহিত্যে যদি কোনো বস্তু থাকে তা হল, রসবস্তু, সেটিই নিত্য বস্তু।তার উদ্দেশ্য পাঠকের আনন্দ ও লেখকের আত্মপ্রসাদ বিধান। সংবাদপত্রের সে উদ্দেশ্য নেই, তা বস্তুর হুবহু অনুকৃতিকারক, তাই সাহিত্য নয়। কলা কৌশলী সাহিত্যিক রূপনির্মাণ দ্বারা বস্তু জগতকে নির্বস্তুক রসজগতে উত্তীর্ণ করে দেন, সেই রস কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়।
২। দুঃখী মানুষের কথা শোনা, বলা, বোঝার সঙ্গে দুঃখ বিলাসের সম্পর্ক নেই। দুঃখবিলাসীরাই জনতার কবি হবার জন্য গলদঘর্ম হন, সৎ কবিরা ভঙ্গী দিয়ে চোখ না ভুলিয়ে, নিজের দৃষ্টি ও উপলব্ধির ওপর নির্ভর করেই কাব্যরচনা করে থাকেন। চলমান বাস্তবের বাজারদর কেবলই ওঠা নামা করে নানান নিক্তিতে। কাব্যসত্য বাস্তবোত্তীর্ণ, তাই অমূল্য।
৩। লোকশিক্ষার কী হবে – এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া সাহিত্যের দায় নয়। আত্মপ্রসাদানুভব ও আনন্দদানই তার একমাত্র দায়। সমাজব্যবস্থার বৈষম্য, শ্রম ও বিশ্রামের কালবৈষম্য নিয়ে যারা ভাবিত, তারা যদি লোকহিতের জন্য সাহিত্য থেকে কিছু উদ্ধার করে পারেন – সেটা উপরি পাওনা। সাহিত্য জোর করে মেঠো সুর ধরতে পারে না।
প্রাচীন বিশ্বের আলঙ্কারিক আরিস্টটল, লংগাইনাস থেকে ভরত, আনন্দবর্দ্ধনাদিরা সকলেই একথা বুঝেছিলেন যে, মায়িক জগতই সাহিত্যের জগৎ, বাস্তব নির্ভর হলেও কবি শিল্পীর মনোজগতে সেই বাস্তবের অভিক্ষেপন থেকেই রস কাব্যের কায়া ও কান্তি গ্রহণ করে থাকে। অস্কার ওয়াইল্ডের মতে, “Nature is no great mother who has borne us, she is our creation. It is our brain that she quickens life. They did not exist till Art has invented them.” [Intentions]
বাস্তবজগৎ ও কাব্যজগৎ তাই আলাদা। উভয়ের সম্পর্কটি পারস্পরিক ও মীথষ্ক্রিয়াশীল। বর্তমান সামাজিক প্রসঙ্গ ও তথ্যাদি যদি অবিকৃতরূপে রচনান্তর্গত হয়, তবে তা সাহিত্য হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের “গোরা”য় ধর্মসঙ্কীর্ণতা ও হিন্দুয়ানীর কালানুগ প্রতিবিম্ব থাকলেও, তা যে ‘পৈতা সংহার কাব্য’ হয়ে ওঠে নি তার কারণ স্বসমাজকে তিনি সরস শিল্পবস্তু করে তুলতে পেরেছিলেন।ওয়ার্সওয়ার্থ, শেলি, কিটস্ এর রচনায় একাকী নির্জন কবির যে বংশীধ্বনি শুনতে পাই, তাও বৃহদর্থে বাস্তব কেননা তা চিত্তপ্রসারী, “বাস্তবতার মানে এমন নয় যা সদা সর্বদা হয়ে থাকে, যা যুক্তি সংগত। যে কোন রূপ নিয়ে যা চেতনাকে স্পর্শ করে, তাই বাস্তব”। সুতরাং বিপরীত পক্ষে ইম্পিরীয়ালিজ়মের বাস্তব জ্বরোত্তাপ ইংরেজি সাহিত্যকে যতই আগ্নেয় করে তুলুক না কেন, তাতে কালসঞ্চারী সত্যরস নেই, তা বৃহদর্থে অবাস্তব, তা চিত্ত-স্পর্শী ও চিত্ত-প্রসারী নয়।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “বস্তুর কারবারী ও বাস্তবরসের স্রষ্টা ঠিক এক নহে। বস্তুপুঞ্জ হইতে বাস্তব রস নিষ্কাষণের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পবোধ সাপেক্ষ।” Bernard Bosanqut এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বিবিধ হতে পারে বলে মনে করেন। 1. Asthetic princilples of Art ও 2. Moralistic principles of Art. রবীন্দ্রনাথ প্রথমোক্তটিকে গ্রহণ করেছিলেন। সমালোচকের ভাষায় “সাহিত্যের পথের আলোচনায় সাহিত্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই কথাই আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে বস্তু এবং মানবাত্মা এই দুটির মধ্যবর্তী সেতু হচ্ছে সৌন্দর্যচেতনা”। [নন্দনতত্ত্বের সূত্র/অরুণ ভট্টাচার্য] সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ‘অবাস্তববাদী’ এই সিদ্ধান্ত অমূলক। তিনিই বিশিষ্ট ও সৎ অর্থে সৌন্দর্যবাদী ও বাস্তববাদী। অভিযোগকারীরা ‘বস্তুর কারবারী’মাত্র, তাই সর্বদা সুন্দরকেও কুৎসিত করে তোলেন। সাহিত্য আসলে ‘দর্পণে বিম্বিত অগ্নি যাতে দীপ্তি আছে, দাহ নেই’।‘চতুর্মাত্রিক অস্তিত্বজগৎ’ সাহিত্যে ঠাঁই পাওয়ার প্রয়োজন নেই, সে জগৎ হবে ‘সদসদ্ বিলক্ষণ’।[সাহিত্যতত্ত্বে রবীন্দ্রনাথ/ সত্যেন্দ্রনাথ রায়]
সাহিত্যরচনের মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা ক’রে তাকে রসবস্তু ও নিত্যবস্তু করে তোলে - প্রাচীন সাহিত্যসম্ভার তার উজ্জ্বল নিদর্শন। রামায়ণ মহাভারতের মধ্যে কোনো আঁকাড়া বাস্তবতা নেই, সাধারণ মানুষের কথাও নেই। তবু তা যে যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষের জীবনবেদ হয়ে আছে তার কারণ, সন্ধানী সমালোচক বলেছেন - “বর্তমান যুগের পূর্বে সাহিত্যের সহিত জীবনের যোগাযোগ কোথাও ঘনিষ্ঠ হইয়া দেখা দেয় নাই… ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রামায়ণ ও তাহা হইতেও বিশেষ করিয়া মহাভারত - এমনতর একটি কথায় লক্ষ ক্ষেপনের দ্বারা রচিত বিপুলকায় প্রতিবাদ। জীবনসত্যই তো এই দুই কাব্যের মূল উপজীব্য”।শুধু রামায়ণ মহাভারতই নয়, চর্যাপদ থেকে মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণবসাহিত্যেও বৃহত্তর বাস্তবের জীবনযোজন খুঁজে পেয়েছেন রসায়িত রূপে ও বাস্তব অবস্থানে।[শিল্পলিপি/ শশীভূষণ দাশগুপ্ত]
‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বললেন যে জিনিসের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণকে দেখি তাই সার্থক অর্থাৎ বাস্তব। ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ প্রবন্ধে জানা গেল, বাস্তবতার মূল্য তার নিঃসংশয় প্রকাশের দ্বারা নির্দিষ্ট। ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধে বলেন, বিশশতাব্দীতে কাব্যে বাস্তব বিষয়ের আত্মতা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু উনিশ শতাব্দী ছিল বিষয়ীর আত্মতার যুগ, সেইটাই বরণীয়। ক্রোচে জগতাশ্রয়ী অনুভূতি (perception)এর বদলে বস্তুরূপাশ্রয়ী প্রতিভান(intuition)এর আবাহন দেখেছিলেন সৎ-সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথও প্রতিভানের রূপকার। শ্রী অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের এতদ্বিষয়ক ধারণাকে নতুন রকমের বলে মনে করেনি নি। তাঁর ভাষায় “প্রকৃতির প্রতিরূপ ইন্দ্রিয়পথে মনে প্রবেশ করে এক প্রকার মনঃপদার্থ (mind stuff) হয়ে ওঠে এবং কবিকল্পনার দূতিয়ালীতে সেই মনঃপদার্থই সাহিত্যবস্তু হয়ে ওঠে।… কবির আত্মানুভূতিই হচ্ছে শিল্প সাহিত্যের বস্তুসত্তা নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি।যা তাঁর কাছে শিল্পের উপাদানরূপে সত্য হয়ে ওঠে, তাই হচ্ছে তাঁর উপাদানগত বাস্তব অবলম্বন। আর নিরেট বাস্তব তার স্থূল শরীর ও প্রবল কন্ঠস্বর নিয়ে…কালের দরবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।”[সাহিত্য জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ/ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়]
“সাহিত্যের পথে”র ‘তথ্য ও সত্য’ এবং আরও বহু প্রবন্ধে বাস্তব ও সাহিত্যের বাস্তবকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখেছেন, তাকে বিন্যস্ত করা যায় এইভাবে -
তথ্য
১। বিজ্ঞান
২। সাধারণ ও তথ্যাশ্রিত
৩। সংকীর্ণ রূপ
৪। বাহ্যরূপ
৫। বস্তুরূপ
সত্য
১। কলা শিল্প সাহিত্য
২। যথার্থ ও নির্বিশেষ, সত্যাশ্রিত
৩। অসীম ও অরূপ
৪। কাল্পনিক ও অন্তররূপ
৫। রসরূপ
এর মধ্যে দ্বিতীয় তালিকাটির দিকেই আবিশ্বের অধিক অংশ কথোকোবিদদের সমর্থন। রবীন্দ্রনাথও স্বভাবতই ব্যতিক্রম নন।
ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় জ্যৈষ্ঠ,১৩২১ এর “প্রবাসী”তে লিখেছেন যে, “রবীন্দ্রসাহিত্য সার্বজনীন নহে। রবীন্দ্রনাথ দরিদ্রের ছবি আঁকিয়াছেন। তিনি দৈন্যের মধ্যে বিশ্বাসের ছবি আঁকিয়াছেন। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সঙ্গীত গাহিয়াছেন। কিন্তু সে ছবি, সে সঙ্গীত, জনসাধারণকে – সমগ্রজাতিকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সামাজিক তাঁর সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক ঐতিহ্য ও শ্রেণি অবস্থানের কারণেই জনতার কবি হয়ে উঠতে পারেন নি, সেটা সম্ভবও ছিল না।কিন্তু জনবিচ্ছিন্নতা নিরসনের আজীবন সংগ্রামে তাঁর সাহিত্য প্রোজ্জ্বল। মনোবিদের মতে- “বিচ্ছিন্নতা- বিচ্ছিন্নতা নিরসনের সংগ্রাম – নবস্বরে সংযুক্তি – রবীন্দ্রমানস প্রগতির এই হচ্ছে ডায়ালেক্টিক্স।”[বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎ/ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়] দুঃখী মানুষের প্রাঙ্গনসীমানায় বারবার তাঁর পদপাত। ভিতরে প্রবেশ না করলেও, ভঙ্গী দিয়ে তিনি চোখ ভোলাতে চান নি। সাহিত্য তত্ত্বালোচনার সূচনাপর্ব থেকেই তাঁর কাব্যদর্শনে মানব প্রত্যয় সুদৃঢ়মূল। সমালোচক সাধনা-র এতদ্বিষয়ক প্রবন্ধগুলি বিশ্লেষ করে দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ মনে করেন-
১। সাহিত্যের জগৎ মানেই মানবজীবনের সাথে মিশ্রিত জগৎ
২। আমরা কাটাছেঁড়া তত্ত্ব নয়, সাক্ষাৎ বা পরোক্ষভাবে মূল মানুষটাকেই চাই
৩। সমগ্রমানবকে প্রকাশের চেষ্টা সাহিত্যের প্রাণ। সাহিত্যে আমরা সত্য চাই নে, মানুষ চাই।
৪। হ্যামলেটের ছবি সৌন্দর্যের ছবি নয়, মানবের ছবি; ওথেলোর অশান্তি সুন্দরমাত্র নয়, মানবস্বভাবগত।[সাহিত্য জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ/অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়]
প্রশ্ন উঠবে- এখানে ‘মানুষ’ অর্থে কোন মানুষ?
অবশ্যই সেই পূ্র্ণ ও অখণ্ডিত বিশ্বমানব, যার বিবিধ প্রকাশ লেখকের ‘নিজত্বের মধ্যে’ যখন যেভাবে ধরা দেয়, তখন সেভাবেই তা সত্য হয়ে ওঠে।“লেখকের বিশেষত্বের মধ্যেই মনুষ্যত্ব দেখা দেয়”। সুতরাং সে দুঃখী মানুষ, সুখী মানুষ, গরীব না বড়োলোক – এসব বড়ো কথা নয়। লেখকের হৃদতন্ত্রীতে অনুরণন তুলে বিশ্বাতিশয়ী হয়ে ওঠার মতো নির্বিশেষ রসগত উপাদান তার মধ্যে লভ্য কি না - এইটাই বড়ো কথা। ‘মানুষের ধর্মে’ লিখেছিলেন, “এই সার্বজনীন মনকে উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ করে উপলব্ধি করাতেই মানুষের অভিব্যক্তির উৎকর্ষ। মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি সীমানাকে পেরিয়ে বৃহৎ মানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত সাধনা এই বৃহৎ মানুষের সাধনা। এই বৃহৎ মানুষ অনন্তের মানুষ, বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের জাত, অন্তরে আছে একমানব।” কাজেই তিনি যেহেতু জাতমানা কবি নন, এমনকি অর্থনৈতিক শ্রেণিমানা কবিও নন, দারিদ্র্যবিলাসের প্রয়োজনও তাঁর নেই। তিনি আনন্দবাদী। দুঃখের জন্য দুঃখ তাঁর ব্রত বা বৃত্তি নয় – “মানবজীবন যে দুঃখময় এই কথাটার সাক্ষ্য নেবার জন্য কবির দ্বারে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই – কথাটা সর্বাঙ্গীন ও গভীর সত্যও নয়।” [‘সাহিত্যরূপ’; “সাহিত্যের পথে”]
রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত কবি, সাহিত্য রচনাই তাঁর কাজ। সাংসারিক- সামাজিক অসাম্য অন্যায় অবিচার নিরসনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া তাঁর কাজ নয়। সেজন্য সমাজনীতিবিদ, রাজনীতিজ্ঞরা আছেন।কবি সাহিত্যিক হৃদয়োপলব্ধ মানবিক যাতনাকে বাণীবদ্ধ করতে পারেন মাত্র।যে কোনও সৎ কবির পক্ষেই জাগতিক যন্ত্রণাকে ও দুঃখী মানুষের দুঃখকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে, খেচর কুহুগীতিমগ্ন থাকা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু অনুভূতির সত্যতা ও গাঢ়তা থেকে তিনি যে রসসৃষ্টি করবেন তাতেও স্ব-আনন্দই হবে মুখ্য বিষয়। দুঃখী মানুষের দুঃখ ঘোচাবার জন্য তিনি কলম ধরেন নি।সমালোচকের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যরচনার উদ্দেশ্য ছিল, “তাঁহার আত্মধর্মের মধ্যে নিরন্তর বিচিত্রভাবে আত্মপ্রকাশের ভিতর দিয়া আত্মোপলব্ধির যে একটা তাগিদ রহিয়াছে, তাঁহার জীবনের নিরলস সাধনার ভিতর দিয়া, তাহাকেই সত্য করিয়া তোলা”। [শিল্পলিপি/শশিভূষণ দাশগুপ্ত] এই প্রক্রিয়া পথে বৃহৎমানবের যেমন আতিথ্য, প্রয়োজনানুসারে দুঃখী আতুরও সসম্ভ্রমে নিমন্ত্রিত।
ন্যাচারালিস্টরা যেমন জীবনের কদর্য দিকটুকুকেই প্রধান করে তুলতে চান, ভালগার মার্ক্সিস্টরাও তেমনি যান্ত্রিকভাবে দুঃখী মানুষের কথা লেখেননি বলে মহৎ সাহিত্যিকদের নস্যাৎ করতে চান; বস্তুত রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই এবঙ্গে এমত প্রয়াস চলছিল দীর্ঘদিন, দুই শিবির থেকেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো দুঃখকেই সাব্লিমেট করেই আনন্দে পৌঁছন- “দুঃখের উপলব্ধিও আনন্দকর, কেননা সেটা নিবিড় অস্মিতাসূচক”।মার্ক্সবাদী লুকাচ তাঁর Writer and Critic গ্রন্থে জীবনবেদের মতো গ্রহণ করেছিলেন একজন অমার্ক্সবাদী ও তথাকথিত বৃহৎভাব মার্গচারী কবি গ্যয়েটের একটি অমরবাণী- “And if man falls speechless in his torment God give me to say what I suffer!” এই চিরন্তন যন্ত্রণার গান রবীন্দ্রনাথও গেয়েছেন। জাতমানা সমালোচকের দল তাঁর সাহিত্যকে কালের সাম্প্রতিকতম দাবী ও উপস্থিততম দারিদ্রের সন্নিবেশনের নিক্তিতে যতই বিচার করুন না কেন, মহাকালের দরবারে তিনি মৃত্যুত্তীর্ণ রসসাহিত্যের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। কবির অন্তরে থাকে অনুভূতির প্রসাদ ও টলস্টয় কথিত Religious perception. তার রস ও আনন্দোপলব্ধির জন্য ‘ধ্রুপদগুলির নিগূঢ় মধুকোষে’ প্রবেশ করার সাধনা করতে হবে পাঠককেও। কালিদাস লোকহিতৈষী দরিদ্রসেবী পাঠ্যপুস্তক ও তানসেন যন্ত্রণার্ত মেঠো গান-সুরের চর্চা শুরু করবেন – এ আশা না করাই ভালো। বরং কালক্রমে শিক্ষিত হয়ে মানুষই পৌঁছে যাবে সেই অনিন্দ্যরসসায়রের উপকূলে।
বিশ্বনাথ কবিরাজ সাহিত্যকে চতুর্বর্গ ফলপ্রাপ্তির উপায় বলে মনে করেছিলেন। লোকশিক্ষা তার মধ্যে অন্যতম। আবার কোনো কোনো আলংকারিকের মতে “আনন্দরসনিঃষ্যন্দী রূপককে যাঁহারা ইতিহাস প্রভৃতির মত (বাস্তবজ্ঞানের) বুৎপত্তিমাত্র মনে করেন, সেইসব আস্বাদপরাঙ্মুখ লোকদিগকে নমস্কার”। রবীন্দ্রনাথও ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে সাহিত্য থেকে লোকশিক্ষার দাবীটিকে সরাসরি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাঁর মতে মানুষ হল “এঞ্জেল অফ সারপ্লাস”। সাহিত্য সেই উদ্বৃত্ত শক্তিকে মসীবদ্ধ করে অপ্রয়োজনের আনন্দে।বিশ্বদেবের বিশ্বসৃষ্টিলীলা যেমন “নপ্রয়োজনবত্বাৎ... লোকবত্তুলীলাকৈবল্যম্” সাহিত্যও তেমনি ‘মনের বাগানবাড়ি’, দরকারের দালানকোঠা নয়। সুতরাং সাহিত্যদ্বারা লোকশিক্ষার প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা লোকশিক্ষা বা সাহিত্য কারো উপরেই সুবিচার করে না।
প্লেটো সমাজ হিতবাদী দৃষ্টিপ্রেক্ষিতে কবিদের নির্বাসন চেয়েছিলেন। কিন্তু উরূপাখণ্ডের অলঙ্কারশাস্ত্রগুরু আরিস্টটল কাব্য থেকে মানুষ আনন্দিত ও সংযত হতে শেখে ব’লে, কবিকে বৃহৎ আসন দানের পক্ষপাতী। স্যার ফিলিপ সিডনি ‘An apology for poetry’ তে বলেন “No learning is so good as that which teacheth and moveth to virtue and that none can both reach and move thereto so much as poetry.” আবার শেলীর মতে, নীতিশিক্ষার সাথে সাহিত্যের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু সাহিত্য এক সুসমঞ্জ অলৌকিক আনন্দ জগতে প্রবেশ করায় আমাদের- “It makes us the inhabitants of world to which the familiar world is a chaos.”( ‘A defence of poetry’). সুতরাং সাহিত্যজগৎ আমাদের শিক্ষিত নয়, সানন্দ; পণ্ডিত নয়, প্রাণিত করে। কেন না, তথাকথিত জ্ঞান ও শিক্ষা হল বস্তুজাগতিক ও বাচনিক তথ্য, সাহিত্য অনির্বচনীয় সত্যস্বরূপ ও রসরূপময়। তার আবেদন ভিন্নমার্গী।
রবীন্দ্রনাথ, বাল্মীকি, বেদব্যাস, কালিদাস, তানসেন প্রমুখ অমর স্রষ্টার উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন এরা কেউই তথাকথিত লোকশিক্ষা দানের জন্য কলম বা যন্ত্র ধরেন নি, কার্য কারণ সম্পর্কযুক্ত প্রত্যক্ষগোচর জগৎ-জীবনের ফটোগ্রাফিক ছবি আঁকতেও বসেন নি, রচনা করেন নি দুঃখী মানুষের জীবনবেদ, কিন্তু তা সত্ত্বেও যে কালের সম্মার্জনীকে তুচ্ছ করে এঁরা টিকে আছেন তার মুখ্য কারণটি হল, এঁরা সত্যানুভূতি ও আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন, পাঠক লাভ করেছে আনন্দ।
কালিদাস যদি লোকসাধারণের নৈতিক ও জাঠরিক উন্নতিবিধানের জন্য ইস্কুলপাঠ্য বই লিখতেন, তানসেন যদি মেঠোসুর ধরতেন, রামায়ণ মহাভারতে কৃষান কাঙালের ঘরকরনাই বর্ণিত হত শুধু, তবে তার আনন্দরসকে জোর পূর্বক খাটো করা হত; জেগে থাকত পাণ্ডিত্যের আস্ফালন এবং অচিরাৎ ‘স্বেদ কম্প রোমাঞ্চের ভিতর দিয়া একেবারেই দশমদশা প্রাপ্তি’ ঘটত।
মহৎ সাহিত্য থেকে যদি লোকসাধারণ শিক্ষিত হয়ে ওঠে তাহলে তা উপজাত ফলমাত্র, লেখকের উদ্দেশ্যের অঙ্গ নয়। ভাববাদী কান্ট বলেছিলেন, একটি বস্তু তখনই সুন্দর হয়, যখন তা আমাদের প্রয়োজনাধীন করে না ও তার সাথে কোনো interest জড়িত থাকে না।
কিন্তু এই কলাকৈবল্যবাদী তত্ত্ব মানেনি নি কার্ল মার্ক্স। তাঁর মতে, পৃথিবীর মানুষ একটিও কাজ করেন না যা উদ্দেশ্যহীন। নীতি প্রচার যেমন উদ্দেশ্য, সৌন্দর্যরচনাও উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে এরিখ নিউটনের সমন্বয়ী মতামত বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি সাহিত্যকে তুলনা করেছিলেন একটি চকচকে লাল আপেলের সঙ্গে, যা সুন্দর, আনন্দজনক ও ক্ষুন্নিবৃত্তিকারকও বটে। রবীন্দ্রনাথ সুন্দর ও মঙ্গলকে পৃথক করে দেখেন নি। ‘সৌন্দর্যবোধ’ প্রবন্ধে স্পষ্টতই বলেছেন, “সত্যের যথার্থ উপলব্ধি মাত্রই আনন্দ, তাহাই চরম সৌন্দর্য।” কাজেই লোকহিতকারি সত্যজ্ঞান তো সাহিত্যে থাকবেই। টলস্টয়ও বলেছিলেন, “All art has this characteristics that it units people.”(‘What is art’) তবে এই মানবৈক্য ও সত্যজ্ঞানের সামাজিক উপযোগ যেখানে প্রচ্ছন্ন থাকে, কাব্য সেখানেই সার্থক হয়ে উঠতে পারে। তথাকথিত বাস্তববাদীরা নীতিশিক্ষা দানের বিষয়টাই সাহিত্যে মুখ্য করে তোলেন, ফলে সত্যজ্ঞান ও মানবৈক্যও অধরা থাকে, কাব্যানন্দ ও সৌন্দর্যও থেকে যায় অনায়াত্ত।
সমালোচক বলেন, “সকল সৎ সাহিত্যেরই একটি অপ্রত্যক্ষ suggestive ক্ষমতা আছে।… সাহিত্যের মধ্য দিয়া যুগ যুগ ধরিয়া জীবনের সহিত জীবনের গভীর সংযোগ গড়িয়া উঠিয়াছে।… অনন্ত জীবনের সহিত সাহিত্যের সম্পর্ক আছে বলিয়াই তাহা নিত্য নব ও চিরন্তন।” [সাহিত্য ও পাঠক/ ব্রজেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য] ব্রেখট্ ১৯৫৯ এ সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সূত্র প্রণয়ণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, সাহিত্য আত্মিক প্রেরণাসঞ্চারী, সেই প্ররণাই বড়ো কথা, লোকশিক্ষা নয়। রসসম্পূটই নিত্যবস্তু। মার্ক্সবাদী গর্কীকেও রোমান্টিক কূলের সক্রিয়তা দ্বারা সেই শাশ্বত শিক্ষা লাভে সচেষ্ট হতে হয় – “Active Romanticism strives to strengthen man’s will to live and raise him up against the life around him, against any yoke it would imposed.”(‘On Literature’) সেই প্রজ্ঞাসঞ্চার বাস্তববাদী নয়, বাস্তবোত্তর রসস্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব।।
রচনাটি অপ্রকাশিত। রচনাকাল ১৯৮৯