প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
পিঞ্জরে বসিয়া শুক
চতুর্থ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবঃ একটি প্রতিবেদন
What did prison signify?...
An aimless anxiety in the present-
a continual sacrifice — by which
nothing can be acquired in the future … [Crime and Punishment Epilogue / Ch-2]
রাভান্না, উত্তর ইতালির এক ছোট্ট জনপদ। সমুদ্র এখানে ধূসর ,আকাশ সীসার মত ভারি। মাঝে মাঝে জাহাজ ভেসে আসে, যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনও জলজন্তু। আর অবিরাম ধূম্রবমন করে চলে কারখানা। চলমান টারবাইন, বয়লারের বাষ্পোচ্ছ্বাস। দাঁতালো যন্ত্রগুলি ঘিরে সরু মোটা জটিল পাইপ। অবিরাম শব্দ হয়। যন্ত্রশব্দে ডুবে যায় মানবস্বর। এইখানে গিউলিয়ানা থাকে, তার স্বামী, শিশুসন্তান নিয়ে। প্রযুক্তিবিদ লোকটি যন্ত্রসঙ্গ করে, ছেলে খেলা করে রোবটের সাথে। আর গিউলিয়ানা ঘুরে বেড়ায় বুনো ঝোপ, কাদা মাড়িয়ে। কখনও পাথুরে রাস্তায় নিঃসঙ্গ জুতোর শব্দ তুলে। এক গাড়ি দুর্ঘটনার পর থেকে সে আর স্বাভাবিক নয়, সদা আতঙ্কিত, বিষাদিত। গিউলিয়ানারূপী মনিকা ভিত্তির চোখ দুটি কলে পড়া জন্তুর মতো মূর্ছায় অসাড়, নিরাপত্তাহীনতায় ত্রস্ত আবার বিচিত্র এক মেদুরতা সেথা খেলা করে। ঐ যৌগপত্য থেকে আমরা তুলে নিতে পারি মিকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনির সমস্ত ছবির প্রাথমিক অভিজ্ঞান, যিনি অচিকিৎস্যভাবে রোমান্টিক এবং অনিবার্যত বন্দী।
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায় । কিন্তু কী বলবে তারা ? ঐ সব ধর্মঘটী শ্রমিক , যারা কলের বাঁশি মরমে পশা মাত্র উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে আসে কর্মস্পৃহদের বাধা দেবে বলে ! কিম্বা গিউলিয়ানার কুড়িয়ে পাওয়া বন্ধু , করাডো , এক নূতন প্রকল্পে কর্মী সংগ্রহের জন্য ম্যাপ , চার্ট আর বিমূ্র্ত রাশিমালা হাতে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে ! কী বলবে ওদের পরিচিত জনপদবাসীরা, যারা জমায়েত হয় পার্টিতে ; অবিরাম মদ খায় ; অকারণ হাসতে হাসতে , খেলতে খেলতে , গাঢ় লাল কেঠো ঘরখানার মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে করতে , হঠাৎই লাথি মারতে থাকে দেয়ালে ; সোল্লাসে ভেঙে আনতে থাকে এক একটা লাল তক্তা । ছুঁড়ে ফেলে আগুনে । আর এই সমুদ্র সংলগ্ন ঘরটির বাইরে ধীরে ধীরে নোঙর করে এক বিরাট মারী আক্রান্ত জাহাজ , মাস্তুলে উড়িয়ে দেয় রোগজ্ঞাপক পতাকা । ওরা বেরিয়ে আসে । ত্রস্ত গিউলিয়ানা ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে । সকলেই যখন তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে , এক ঝটকায় দ্বার খুলে গাড়িতে উঠে বসে মেয়েটি । অ্যাকসিলারেটরে পাদস্পর্শ পাওয়ামাত্র তীব্রলক্ষ্যে গাড়িটি ওকে পৌঁছে দেয় জলের কিনারে । কোনও মতে ব্রেক চাপে গিউলিয়ানা । পিছনে মহামারী , সামনে ধূ ধূ জল । মাঝখানে মোচার খোলার মত এক যন্ত্রশকট , স্টিয়ারিঙে হাত রেখে এক মেয়ে , আর্তনাদও যার কাছে বিলাসিতা ।
আন্তোনিওনি নিঃসঙ্গতার মহাকাব্য রচেছেন সারাটা জীবন । সেই নিঃসঙ্গতার কারণগুলি হয়ত প্রকাশিত হয় কখনও , কিন্তু কারণ বা অতিক্রমণ নয় , তার প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণ ঘটান তিনি । নিঃসঙ্গতার বিরুদ্ধে মানুষের অসহায় লড়াই , পরিণামে বশ্যতা । কিন্তু ‘রেড ডেজার্ট’ ছবিতে ঐ বশ্যতার মধ্যেও জীবনের এক অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটান তিনি । গিউলিয়ানা ছেলেকে গল্প শোনায় – কোনও দূর প্রবাল দ্বীপের গল্প । সেথা সূর্যস্নাত সোনাবেলা আছে , আছে এক পরমা জলকুমারী । সেই গল্পসূত্রে দেখা গেল সিনেমার ইন্দ্রজাল । রাভান্নার আকাশ হয়ে গেল ঘন নীল । দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা যেন গান গেয়ে উঠল। সন্তরণরতা জলকন্যাটি দেখল দিগন্তের বুকে জেগে উঠেছে এক পাল তোলা নৌকা । নৌকাটি ক্রমে এগিয়ে আসতে থাকে । আরোহী নেই কোনও , মাঝি দাঁড়ি নেই , তবু আসে । তারপর হঠাৎই মুখ ঘুরিয়ে নেয় , যেমন এসেছিল তেমনই তরতরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় প্রবাল পাহাড়ের আড়ালে । গল্প থামে । আমরা ফিরে আসি রাভান্নায় । এই আগমনী কবিতার রেশ কিন্তু থামে না । অন্তিম দৃশ্যে পশ্চাৎপটে কারখানা , চিমনি উদ্গীরণ করছে হলুদ আগুন । সামনের পথে হেঁটে আসে গিউলিয়ানা , ছেলের হাত ধ’রে । ছেলে শুধোয় , ধোঁযার রঙ অমন কেন ? মা বলে , ওতে যে বিষ আছে , তাই । - যদি কোনও পাখি উড়তে উড়তে গিয়ে পড়ে ওখানে ? মা তাকে আশ্বস্ত করে , পাখিরা এখন বুদ্ধিমান , তারা অনেক ওপর দিয়ে ওড়ে । কথা বলতে বলতে ওরা টুকটুক করে হেঁটে গেল ফ্রেমের বাইরে । যন্ত্রশব্দ চলতে থাকল , আকাশ ধূ্ম্রলাঞ্ছিত হতে থাকল যথাপূর্বং যতক্ষণ না ফেড আউট হয় । যতক্ষণ না জ্বলে ওঠে রবীন্দ্রসদনের বাতিগুলি । বাইরে যখন সন্ধ্যা, চতুর্থ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ‘রেড ডেজার্ট’ দেখে বেরিয়ে আসে মানুষ , কিন্তু ঢোকার সময় যেমন ছিল তার চেয়ে আরও একটু একা হয়ে । দেখো , ঐ যে প্রবীণ, সাদা চুল উড়ছে বাতাসে , বৃক্ষতলে বসে তাকিয়ে আছেন সূর্যাস্তের দিকে , ওঁকে চিনি । ছবিটা উনি প্রথম দেখেন আশির গোড়ায় , সরলা মেমোরিয়ালে । তারপর তিরানব্বইএ , যখন প্রায় চলৎশক্তিহীন চলচ্চিত্রী স্বয়ং এসেছিলেন নন্দন চত্বরে । প্রয়াত সতীর্থর উদ্দেশে নিবেদন করেছিলেন গোলাপগুচ্ছ। সেদিনের কথা ভেবে উনি আজও ছলছল হয়ে যান । অমন প্রগাঢ় বর্ণের গোলাপ নাকি ঐ একবারই ফুটেছিল । আন্তোনিওনির হাত থেকে সত্যজিতের ঘুমচোখে ঝরে পড়বে বলে । আজ ‘রেড ডেজার্ট’ পুনরপি দেখে , সব কোলাহল বারণ হয়ে গেল ওঁর । পাশে দেখো, এক অনতিতরুণ । সে এসেছিল গত উৎসবেও । তারকোভস্কির মুখোমুখি হবে বলে মুখস্থ করে ফেলেছিল ‘স্কাল্প্ টিং ইন টাইম’ বইখানা । তারপর প্রদর্শনের কী এক গোলমালে ক্ষিপ্ত হয়ে শিশির মঞ্চের পর্দার সামনে লাফিয়ে উঠে খ্রীষ্টের ভঙ্গিতে হাত নেড়েছিল –‘ স্টপ ইট!স্টপ ইট!’ সেদিন ওর সাদা পাঞ্জাবিতে ‘সোলারিস’ এর লেলিহান আগুনের প্রচ্ছায় দেখে যারা বিরক্ত হন , তারা জানতেন না , ঐ প্রদর্শন ছিল ওর কাছে পিতৃ্তর্পণের মত । এবারে এসেছে শুধু তারকোভস্কি নয় , একযোগে উনিশজন স্রষ্টার মুখোমুখি হবে বলে । উনিশটি ক্লাসিক, উপরন্তু ব্রেসোঁ , সাতটি প্রতিনিধিস্থানীয় ছবি নিয়ে । আজ জীবনে প্রথম তাকিয়েছিল মনিকার মুখের দিকে । এখনও থরথর করছে উত্তেজনায় । দেখো ঐ কুণ্ঠিত দপ্তরবাবুটিকে । অকর্তিত নগ্নতার জন্য হন্যে হয়ে উনি গিয়ে পড়েছিলেন আন্তোনিওনির কুহকে । উঠি উঠি করেও উঠতে পারেন নি । এখন মাথা নীচু ক’রে হেঁটে যাচ্ছেন কী যেন ঘটে গেল ভাবতে ভাবতে ।ওকে ডাকো।সম্বিত ফেরাও । নয়ত ছেড়ে যাবে হাবড়া লোকাল । দেখো এই উৎসব প্রাঙ্গণ , যেথা বিরলপ্রজাতিরা এসে জড়ো হয় । এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ ক’রে চলে যায় । জিন্দলের লাউডগা কন্যাটি আসে , মিত্তল পুত্রের সঙ্গে সেলুলারে অ্যাপো ক’রে , তাদের পকেটে মহার্ঘ গেটপাস । সে থাক । তারা হলে ব’সে ফানমাঞ্চ খায় , খাক । ওরা ব্রেষট খাবে , বেঠোফেন খাবে , সিপিএম খাবে , নকশাল খাবে , ডোভার লেন , বই মেলা সব খেয়ে নেবে , সিনেমা তো খাবেই । অতয়েব বৃহন্নলা তুমি শুধু রূপ পড়ো , রূপ । ঐ যে কবিটি শো ভাঙতে না ভাঙতে ছুটেছে মন্ত্রীর গাড়ির দরজা খুলে দেবে বলে , এসো ওকে ক্ষমা করি। আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই । স্তন যার করুণ শঙ্খের মতো , দুধে আর্দ্র , অপিচ শরীরে ছেনালি । মনিকা ভিত্তি থেকে আনা কারিনা । রবীন্দ্রসদন থেকে শিশিরে । আন্তোনিওনি থেকে গোদারে ।
‘রেড ডেজার্ট’ তৈরি হয়েছিল ’৬৪ সালে । গোদারের ‘দ্য লিটল সোলজার’ ১৯৬০-এ । প্রথমটি রঙিন। দ্বিতীয়টি সাদাকালো এবং দুটিই অনিবার্যত রঙিন ও সাদাকালো । আমরা মনে রাখব এ ছবি তৈরি হচ্ছে ফরাসি যুবদ্রোহের প্রাক্কালে । এরপরেই গোদার প্রবেশ করবেন তাঁর তীব্রতম রাজনৈতিক ক্রোধের বিচ্ছুরণ পর্বে – আলফাভিল থেকে শিনোয়াজে । এ ছবিতেও রাজনীতি আছে । প্রেম , যৌনতা , আত্মরতি, অত্যাচার, হনন – আত্মহনন আছে । দুটি জঙ্গীদল FLN এবং OAS, তাদের হন্তারকরা ছবিজুড়ে সক্রিয় , অথচ প্রথম টাইটেল কার্ডেই বলা হয়ে গেছে , সক্রিয়তার সময় শেষ – এখন প্রতিফলনের সময় । কীসের প্রতিফলন ? আত্মার? গোদার জানান, কোনও জিনিস যে এগিয়ে যায় , তার কারণ বাইরের নয়, ভিতরের দ্বন্দ্ব । আনা কারিনা ছোট্ট ঘরের মধ্যে নাচে , বসে ,ওঠে, হাঁটে । আর ব্রুনো কেবলই তার ছবি তোলে । একটা গোল টেবিল , টেবিলে ফুলদানি , তাতে দীর্ঘডাঁটা একটি গোলাপ , চিবুকে ভর দিয়ে আনা সিগারেট খাচ্ছে – সেই বিখ্যাত স্টিল।তাকে ক্যামেরা বন্দী করতে করতে ব্রুনো বলে ,আমি যখন কোনও মুখের ছবি তুলি , আসলে তার আত্মাটাকে দেখাতে চাই । সেই আত্মা স্কাইস্ক্রেপারে বন্দী । কমোডের ফ্ল্যাশের সঙ্গে হাতকড়া আঁটা । তবু সে স্বপ্ন দেখে , এবং তা অনিবার্যভাবে থেঁৎলে দিয়ে যায় ।কারা? গোদার জানাচ্ছেন, ছবিটা আসলে প্রবন্ধ , মানুষের সঙ্কটকে নিয়ে খেলা করে যে গুপ্তচর তাকে নিয়ে লেখা । কে সে ? ব্রুনো ভেরোনিকাকে দেখার আগেই বাজি ধরেছিল কিছুতেই প্রেমে পড়বে না , এবং বাজি হেরেছিল , তারপর গোটা ছবি জুড়ে ভেরোনিকাকে প্রশ্ন করে গিয়েছিল – তুমি কি ভালোবাসো আমাকে ? সত্যি বাসো? অতঃপর সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল মেয়েটির সঙ্গে । কেন ? ভেরোনিকা ম’রে গেল । ঠিক কীভাবে ?এসবের কোনও উত্তর নেই । গোদারের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় ছবি জুড়ে আকস্মিকতা , কাকতালের সমাবেশ , ফিচেল ভঙ্গিতে তত্ত্ব পরিবেশন এবং সিগারেটের ধোঁয়া – কাফে – আর অবশ্যই একটি দৃশ্যে স্বয়ং পরিচালক , কালো চশমায় চোখ ঢেকে জেব্রা ক্রশিংএ দাঁড়িয়ে । এই আপাত স্মার্টনেসের মধ্যে এমন এক শীতল অসহায়তা আছে যা আমাদের হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিতে পারে ।
বন্দী মানুষের অসহায়তাকে আন্তোনিওনি প্রকাশ করেছেন মরমীয়া ভঙ্গিতে , গোদার পর্যবেক্ষকের ভঙ্গিতে আর রোবের ব্রেঁসোর ক্ষেত্রে ভঙ্গিটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয় , কারণ তিনি অন্যের নয় , নিজেরই অসহায়তার প্রদর্শন করেন । প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে আত্মপ্রক্ষেপ ঘটান এবং আত্মপীড়নের মধ্যে দিয়ে মুক্তির সন্ধান করেন । এটা লক্ষণীয় বিষয় যে তাঁর চরিত্ররা বন্দী হয় – অনিবার্যত নয় , কোনও অনুঘটকের ফলে আর অনেকটাই আপন সিদ্ধান্তে । ‘ লেডিজ অফ দ্য বোলন উড ’ তোলা হয়েছিল ১৯৪৫ এ । এ ছবিতে হেলেন তার ভূতপূর্ব প্রেমিক জাঁ এর উপর প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে কৌশলে তার কন্ঠলগ্না করে দিল ক্যাবারে নাচিয়ে অ্যাগনেসকে । জাঁ না হয় এই চক্রান্তের বিষয়ে অজ্ঞ , অ্যাগনেস তো তা নয় । তবু সে কেন আলোর পোকার মত ছুটে যায় ট্র্যাজেডির দিকে ? অর্থ লোভে? কিম্বা প্রণয়ক্ষুধায়? অথবা কিছুদিনের জন্য হলেও নিজের জীবনটাকে পালটে ফেলার প্রণোদনে ? এসবই হয়ত সত্যি , কিন্তু আরও বড় কোনও তাগিদ আছে । তাগিদটা যত না অ্যাগনেসের তার চেয়ে ব্রেসোঁর । অ্যাগনেস মারা যায় , কিন্তু ’৫৯ সালের ‘পিকপকেট’ ছবিতে আমরা দেখব , তার নায়ক মিশেল নতুন ক’রে বেঁচে উঠছে । মিশেল ভুগত চুরি রোগে । জেলখানায় ব’সে জেনএর ভালবাসার স্পর্শ পেল সে । এই আরোহণের জন্যই যেন অবতরণ প্রয়োজনীয় ছিল। এমত অন্তর্যাত্রার সবচেয়ে নির্মম প্রকাশ ’৬২ সালে নির্মিত ‘ দ্য ট্রায়াল অফ জোয়ান অফ আর্ক ’। তাকে নিয়ে তোলা ড্রায়ারের প্রবাদপ্রতিম ছবিটিতে গুরুত্ব পেয়েছিল জোয়ান হত্যার খ্রীষ্টিয় অনুসঙ্গ আর এখানে ব্যক্তি জোয়ান । একঘণ্টা ধরে ক্যামেরা নিষ্ঠুরভাবে আটকে থাকে পাথুরে দেয়ালের মধ্যে । কখনও বিচারকক্ষ কখনও গারদ । বিশপ , ইনকুইজিটর , ইংরেজ গভর্নরের হিংস্র প্রশ্নবাণ আর জোয়ানের উত্তর , যা সর্বদা অবিচলিত নয় , বরং ভয় , লজ্জা , দ্বিধা নানা মানবিক আবেগে কম্পিত । তার প্রায়ান্ধকার গারদের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মারে লোভী চোখ। সে সারারাত আরও আরও কুঁকড়ে যেতে থাকে । জোর সঞ্চয় করে তখনই যখন ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ আসে । গোটা ছবিটা যেন এই অদৃশ্য প্রত্যাদেশ আর দৃশ্য আদেশের সংঘাত । জোয়ান যখন মৃত্যুকে বেছে নিল , ব্রেসোঁ খুব যত্ন ক’রে দেখান লোহার ভারি চেন খুলে নেওয়া হচ্ছে তার পা থেকে । দহনপর্বে কোনও আর্তনাদ নেই । শুধু কালো ধোঁয়া আর কাঠপোড়ার চড়চড় আওয়াজ । সব যখন শেষ , ধূসর আকাশের পটে আধপোড়া একটা খুঁটি , স্খলিত শৃঙ্খল আর মৃদু ধূম্র আন্দোলন । জোয়ান নেই । জীবনের জন্য মৃত্যু , মুক্তির জন্য বন্ধনের কথা বলেছেন ব্রেসোঁ – একের পর এক ছবিতে। কিন্তু কোথাও সোচ্চার দার্শনিকতা নেই । একেবারেই আবেগাতিশয্য নেই । তীব্র শুধু যন্ত্রণা অথচ যারা যন্ত্রণাকাতর তাদের মুখ বেশিরভাগ সময়েই ভাবলেশহীন ।
ত্রুফো বলেছিলেন , প্রথাগত চিত্রপরিচালনা যদি হয় নাট্য সংলাপ , ব্রেসোঁর ছবি তাহলে স্বগত কথনের মত । তাঁর ব্রতজীবী চরিত্রেরা সকলেই নির্জন , অন্তর্মুখী । ‘ দ্য চান্স, বালথাজার ’ ( ১৯৬৬ ) , ‘ মুশেত ’ ( ১৯৬৭ ) আর ’৮৩ সালের , কলকাতায় অদৃষ্টপূর্ব রঙিন ছবি ‘ মানি ’কে পরপর সাজিয়ে পড়লে এই নির্জনতার মধ্যে এক সূক্ষ্ম বিবর্তন হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে ।
বালথাজার ম’রে যায় । মুশেত মৃত্যুকে বেছে নেয় কতকটা প্রতিবাদের মত । আর ‘মানি’র ইগর মৃত্যুর আগে একের পর এক কুঠারের ঘা মারে জীবন্মৃতদের নরম করোটিতে । বালথাজার যে একটা গাধার নাম , তা জেনে ও অন্তিমে তার মৃত্যু হবে জেনে , আমার ‘মহেশ’ পাঠ করা চক্ষুদয় যখন অশ্রুবমনের জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে , তখন ব্রেসোঁ একটি অসম্ভব প্রেমের গল্প ফেঁদে বসেন । মূক পশু ও প্রায় মূক বালিকা মারির পারস্পরিক আকর্ষণের বৃত্তান্ত । বালথাজারের যত বয়স বাড়ে সে একের পর এক মালিকের হাত বদল হয় , মারিও ক্রমে নারী হয় , শিকার হয় যৌনলাঞ্ছনার । আমাদের স্মৃতিধার্য হয়ে থাক সেই নৈশদৃশ্য , আধো অন্ধকারে গাধার শিরোভূষণ রচনা করছে মারি , ফুল দিয়ে । আর ঝোপ ভেঙে উঠে আসছে আততায়ীরা । বালথাজার যখন মানুষের বিপুল লোভ আর পাপ নিজের কাঁধে বইতে বইতে অবশেষে ম’রে গেল , তার পিঠে ছিল রেশম , সোনা আর সুগন্ধী , তার দেহ প্রদক্ষিণ করছিল ভেড়ার পাল । আবহে তাদের গলার ঘণ্টাধ্বনি। তবুও , খ্রীষ্টকে ভুলে এ ছবির পাঠোদ্ধার সম্ভব । যারা বিশ্ব জুড়ে নিয়ত নিজের ক্রুশ নিজে বহন ক’রে চলেছে , সকলের তো বাইবেল মুখস্থ নেই । তারা মারিকে চেনে , মুশেতকে চেনে ।
মুশেত এক নিঃসঙ্গ দরিদ্র কিশোরী । তার বাবা মদ্যপ , স্কুলের বন্ধুরা বিমুখ , প্রতিবেশীরা বিরক্ত , মা মৃত্যুপথযাত্রী । একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি আসে । ঝড় ওঠে । চোরাশিকারি আর্সেনের হাতে সে ধর্ষিত হয় । খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে বালথাজারের দুর্বৃত্ত বণিক এবং আর্সেন দুটি চরিত্রেই ব্রেসোঁ ব্যবহার করেন জাঁ ক্লদ গিলবার্টকে , যে অসাধারণ অভিনেতাটির মুখমণ্ডল দেবদূতের চেয়েও নিষ্পাপ । আসলে পাপী ও নিষ্পাপকে ব্রেসোঁ কিছুতেই দুই পৃথক জগতে ভাগ করতে পারেন না। ছবির প্রথম শটেই আমরা দেখেছিলাম আর্সেনের হাতের ক্লোজআপ – ঝোপের মধ্যে একটি পাখি ধরার ফাঁদ পেতে রাখছে । পাখি ধরা পড়ে। তারপর অন্য একটি হাত ফ্রেমে ঢুকে তাকে উড়িয়ে দেয় । দ্বিতীয় হাতটি এক অরণ্যরক্ষীর । মুশেতের সাহায্য পেলেই সে গ্রেপ্তার করতে পারত আর্সেনকে । কিন্তু সেই ঝড়ের রাতে হঠাৎ নারী হয়ে ওঠা মুশেত ওকে জানায় , আর্সেন তার প্রেমিক ছিল । প্রতিবেশীর কাছ থেকে পাওয়া একটি দীর্ঘ সাদা পোশাক হাতে নিয়ে সে হেঁটে যায় নদীর দিকে। পোশাকটা গায়ে জড়িয়ে ঢালু পাড় বেয়ে গড়াতে শুরু করে । কাঁটায় পোশাক আটকে যায় । ফের চেষ্টা করে । এবারেও জল অবধি পৌঁছতে পারে না । আবার চেষ্টা , এবারে সে তলিয়ে যায় নদীতে । আবহে তখন চার্চের ঘন্টা বাজছে । ‘মানি’র শেষে ইভনের ফাঁসির প্রাক্ মুহূর্তে ব্রেসোঁর প্রিয় ঐ ঘন্টাধ্বনি কিন্তু আর শোনা যাবে না । তার অপচয়িত মৃত্যু সত্ত্বেও পাওয়া যাবে না কোনও ঐশ্বরিক সান্ত্বনা ।
ইভন ছিল রীতিমত সংসারী মানুষ , কপাল দোষে তার হাতে এসে গেছিল একটা জাল নোট । সেটা চালাতে গিয়ে সে ধরা পড়ে । জেলে যায় । স্ত্রী তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে । জেলের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ইভন ব্যর্থ হয় । আর পুনর্মুক্তির পর বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে আত্মসুখী মানুষজনেদের । এমনকি যে পরিবারে সে আশ্রয় পেয়েছিল তাদেরও। এবং ধরা দেয় । খুবই শীতল ও শুষ্ক চক্ষুতে দেখে সেই ধাতববলয় পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার হাতে , অবশ্যই শেষবারের মত । কিন্তু তারপর কী ? মুক্তি ? না, সন্দেহ করি , আশির দশকে পৌঁছে মুক্তির তথাকথিত ধারণাটি বদলে গেছে ব্রেসোঁর কাছে । বড় হয়ে উঠেছে বন্দীত্বই অথচ তা আর সুফলপ্রসূ নয় । তবু ইগর সেই অন্ধকার চায় কেননা বহিঃপৃথিবী অধিকতর অন্ধ , সে জানে । যেমন , রাসকলনিকভ । সমালোচকরা অবশ্য দস্তয়েভস্কি নন, সঙ্গত কারণেই অস্তিত্ববাদী সাহিত্যধারা থেকে উদ্ধার করতে চান ব্রেসোঁর প্রতিমান । আমি স্মরণ করি অ্যালবেয়ার কামুকে । চারিদিকে যদি রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরেরা ধায় তবে স্টেডিয়াম হয়ে যায় স্বাস্থ্যশিবির । নাকি মৃত্যুশিবির ? যাই হোক মুক্তিশিবির অন্তত নয়। কে মুক্ত? যারা পথে, প্রেক্ষাগারে , পানশালায়? না । নগরকপাটই তো রুদ্ধ হয়ে গেছে ! এমনকী ফাদার পেনেলুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেছে চার্চবেল । আছেন শুধু ডাক্তার লিও । যিনি একের পর এক মৃতমুখ চাদরে ঢেকে অস্ত্রোপচারের জন্য এগিয়ে যান পরবর্তী মরণোন্মুখের দিকে । অকারণ , তবু যান , যেতে হবে বলে । এসকল চলচ্চিত্রে লিওর ছুরিকাটি হয়ে যায় ক্যামেরা । আর তাঁকে পর্দায় দেখা যায় না কারণ তিনি ক্যামেরার পিছনে আছেন । তাঁর নাম রোবের ব্রেসোঁ । প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে বলে রাখা যাক , চতুর্থ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি একটি ত্রিভাষিক স্মারকগ্রন্থ ছাড়াও প্রকাশ করেছেন পাঁচটি সুমুদ্রিত পুস্তিকা । জলদরে বিকিয়েছেন – আইজেনস্টাইন , কুরোশাওয়া , ক্লাসিক ফিল্মঃ ক্লাসিক ডিরেক্টর , নেলসন পেরেইরা এবং ব্রেসোঁ । শেষ বইটিতে পরিচালকের যে প্রতিকৃতি সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন জানলায়, গরাদে হাত রেখে । যিনি ব্যঞ্জনাগর্ভী ছবিটি চয়ন করেছেন , এসো তাঁকে রং দিই কিছু । এসো একবছরের আনন্দবাজার সের দরে বেচে দিয়ে কিনে নিই পুস্তিকাসকল ।
ব্রেসোঁর বালিকাদের ছেড়ে, চলো ফের যুবতীসকাশে । লিভ উলম্যান , যিনি তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা , ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইসপারস্’ ছবির মাত্র একটি আতপ্ত চুম্বন দৃশ্যে যিনি পৃথিবীর সকল অসুখের থেকে , অস্বাভাবিকতা থেকে আমাদের টেনে তুলছিলেন আর একটু হলেই । কিন্তু পারেন নি । কারণ বার্গম্যান তাকে নিক্ষিপ্ত করেছেন এক অন্ধকার প্রাসাদে – কক্ষ ও কক্ষান্তরে লাল গালিচা , লাল পর্দা ; ক্রমাগত নৈশদৃশ্যে মৃদু মোম জ্বলে । এ কি স্বপ্নের ভুবন ? বার্গম্যান তার চার নায়িকাকে (লিভ উলম্যান, ইনগ্রিড থুলিন, ক্যারি সিলভান ও হ্যারিয়েট এন্ডারসন) লেখা চিত্রনাট্যপ্রতিম এক দীর্ঘ চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ইদানীং প্রায়ই স্বপ্ন দেখছেন এক লাল প্রাসাদের যেখানে ক’জন নারী অন্ধকারে কাঁদে আর পরস্পরকে সান্ত্বনা দেয়। এই অন্ধকারে যেন মাতৃগর্ভের নিবিড়তা আছে। মা অবশ্য ছবিতে এসেছেন খুব সামান্য সময়। তার তিন মেয়ে মুখ্য চরিত্র। বড়বোন ক্যান্সারের যন্ত্রণায় থেকে থেকে তীব্র চিৎকার ক’রে উঠছে। মেজ আর ছোট তাকে সাথ দিতে চায়, কিন্তু তাদের নিজেদের অতৃপ্ত প্রেম, আত্মকেন্দ্রিক জীবনায়োজন থেকে কিছুতেই বেরোতে পারে না। প্রকৃত অর্থে সেবা করে তার পরিচারিকা আনা, এক স্বামীপুত্রহীনা মেয়ে। আসেন ডাক্তার ডেভিড। মেজবোনের চুম্বন পাশ থেকে নিজেকে কোনওমতে মুক্ত ক’রে বলে যান, মৃত্যু আসবে, হয়ত আজ কিম্বা কাল রাতেই। রোগিনী মারা যায়। যাজক এসে প্রার্থনা করেন- “যদি তুমি ঈশ্বরের দেখা পাও, তাঁকে বোলো, যন্ত্রণা, উদ্বেগ, ক্লান্তি আর সন্দেহগুলো থেকে যেন আমাদের অব্যহতি দেন। তিনি যেন আমাদের সার্থকতা এনে দেন কোনও। বোলো, আমাদের যেন মুক্তি হয়।” কিন্তু কীসের মুক্তি ? সে রাত্রেই ফের শোনা যায় রোগিনীর আর্তনাদ। তিনজন ছুটে যায়, অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ভয় পায়; মৃতার শীর্ণ হাত আঁকড়ে ধরতে চায় জীবিতদের। এগিয়ে যায় শুধু আনা। সুপুষ্ট স্তন উন্মোচন করে বুকে চেপে ধরে জীবন্ত শব। সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকেরা পেয়ে যান মাতা বসুন্ধরার আর্কেটাইপ। প্রায় কমিকস্ট্রিপের কায়দায় এ ছবি থেকে নানা সাদা কালো আর্কেটাইপ খুঁজে বার করা হয়েছে।বড়বোন- পবিত্রতা, মেজবোন- কামনা, ছোটবোন- আত্মপরায়ণতা। হায়, জীবন এত সরল নয়, দেখো ঐ জটিল চিত্রকল্প। মৃত্যুর পাশের কক্ষে বসে দুটি নারী জড়িয়ে ধরেছে দুজনকে, তারা পরস্পরকে আদর করছে জীবনে প্রথমবার, হয়ত শেষবার। অবিশ্বাস অনপনেয়, তবু এই উত্তাপগ্রহণের মরিয়া চেষ্টা- এইতো বার্গম্যানের আত্মবীক্ষা। যারা ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ন’ পড়েছেন, জানেন বালকবয়সে এক চ্যাপেলের মধ্যে কফিনের সঙ্গে তাঁর বন্দীসময়ের বৃত্তান্ত। তখন থেকেই তাঁকে তাড়া করবে এই আতঙ্ক, জন্মমৃত্যুর সন্নিধি।অথবা প্রেম ও যৌনতার সন্নিধিজনিত টানাপোড়েন, কুমারী জ্যেষ্ঠা, বিধবা পরিচারিকা ও দুই অতৃপ্ত নাথবতী- এদের যে ক্ষুধা, তাও উদিত হতে পারে দর্শকজনমনে। ছবির শেষ দৃশ্যে আনা মৃতার ডায়েরি পাঠ করে। সেই সূত্রে স্বেন নিখভিস্টের অলৌকিক ক্যামেরা বেরিয়ে আসে বাইরে, বাগানে। মা ও তিনবোন উজ্জ্বল সূর্যালোকে ঘুরছে। যেন মাতৃগর্ভ থেকে তাদের নবজন্ম হল। কিন্তু পরক্ষণেই স্মরণ হয় এও তো অতীত। ভবিষ্যতের জন্য তবে কী রয়ে গেল ? কিছু কান্না, কিছু অস্ফুট কণ্ঠস্বর।
ইতিহাস প্রমাণ করেছ এই অস্ফুটতা, অনির্বচনীয় রহস্যময়তাই হল সিনেমার জিয়নকাঠি। আগে ছিলাম আমি ও আমার বই, এক অণুবিশ্ব। লেখক ফেলে যেতেন তাঁর অহংকার, আমি গড়ে তুলতাম পাঠ। পরস্পরের মাঝে যে গর্ভিনী শূন্যতা, সিনেমার আবিষ্কার, বিশেষত ভিডিওর প্রাদুর্ভাব সেই শূন্যতাক মাড়িয়ে দিয়ে গেল। যেন এক চলমান নাশকতা। যেন সব সত্য ও শেষ সত্য বলে দেওয়া হবে এখনই । গোলাপ হয়ে গেল গোলাপ এবং গোলাপই। আমি তাকে সুন্দর বলার আগেই যন্ত্রায়িত ও সাধারণীকৃতভাবে সুন্দর। অনেক চেষ্টায় সেই কর্কশ সত্যবচন থেকে অধিকতর সত্যর দিকে, বাস্তবতা থেকে রহস্যময়তার দিকে, চিৎকার থেকে ফিসফিসানির দিকে যাত্রা করেছে সিনেমা। আমরা পেয়েছি কিছু জীবন বদলে দেওয়া অভিজ্ঞতা। বারবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে, আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো।
আইজেনস্টাইন আর ব্রেষটের যদি ‘অপর’ পাঠ করার কোনও সম্ভাবনা থাকত, আমি কিছুতেই এ লেখা লিখতাম না। কারণ আইজেনস্টাইন পূর্বোক্ত বাক্যগুলিতে ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে তারপর তাকে ছিঁড়তে বলতেন। শব্দগুলোকে ভাগ করতেন। নিক্তি, স্কেল আর কম্পাস নিয়ে হিসেব করতেন, তারপর আঁক কষে প্রমাণ করে দিতেন সব রহস্যময়তার রহস্য। য-ফলা এমনকী র-র ফুটকিটাকে পর্যন্ত ছাড়তেন না। তুমি সাক্ষী, অদৃষ্টপূর্ব বেজিনমেডো’র হাতছানি সত্ত্বেও, এবারে অন্তত মূর্খ আমি ওঁর কাছে ঘেঁষিনি। ব্রেষট দেখানো হচ্ছিল নন্দন দুই-এ। তিনি তো চলচ্চিত্রী ছিলেন না। স্রেফ পেটের দায়ে বকনার ন্যায় বারকয় গুঁতো মেরেছিলেন হলিউডের দেয়ালে। আর দেশত্যাগের আগে যে ‘কুলেভ্যাম্প’-এর চিত্রনাট্য বানিয়েছিলেন, তা দেখে বোঝা গেল, চলচ্চিত্রকে তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কাস্তের মতো। মানুষ যে অপ্রয়োজনের আনন্দে কাস্তের বাঁটে রাত জেগে কাঠখোদাই করে, যেমন করেছেন কবি ব্রেষট, নাট্যকার ব্রেষট, এখানে সেই শিল্প অনুপস্থিত। স্রেফ প্রয়োজনীয় লড়াই আর জরুরি বিদ্রোহ। তবু আরও একদিন জনবিরল প্রেক্ষাগৃহে আমার মুণ্ডু উঁকি মারে। দেখি সেকেন্ডে আট ফ্রেম- এরকম অদ্ভুত গতিতে ‘মান ইস্ট মান’ নাটকের ক’টি চরিত্র তুর্কিনাচ দিচ্ছে, কোনও লিপিচিত্র নেই, শব্দ নেই। ছিলনা আয়োজকের তরফে কোনো ব্যাখ্যাপত্র। ফলত ব্রেষটের নাট্যাবলী, যা ক্যামেরায় ধরে রাখা হয়েছে, তার সবগুলিই এমত অদ্ভুত কিনা – এ দফায় জানা হয়নি আমার। বোঝা হয়নি নেশা-বন্দী ও মুক্ত পুন্টিলার দ্বৈতসত্তার রহস্য। শহীদের মুক্তি না চেয়ে ভীতু গ্যালিলেও যখন স্বেচ্ছাবন্দীত্বকে বরণ ক’রে নিচ্ছেন, তখন তাঁর দ্বন্দ্বদীর্ণ মুখখানিও দেখা হয়নি আমার। যখন শুক্কুরবারের প্রার্থনাকালে মসজিদের পাঁচিল ডিঙোনর মত পাপ মুখে, ভয়ে ভয়ে হল ছাড়ি, তখনও দেখি নাট্যপীরেরা বসে আছেন ‘অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্টে’। পাদনখশিরে আনঅ্যাকাডেমিশিয়ান অজিতেশ লিখেছিলেন, এইসব ছবি দেখে ব্রেষটকে বোঝা যায়না বরং বোঝাটা গুলিয়ে যায়। এই বাক্য আমাকে ঈষৎ সান্ত্বনা দেয়। আর পিঠ চাপড়ে দেয় জানুসির বচন। তিনি শ্মশ্রূহীন অবস্থায় উদিত হয়েছিলেন গতবছর, এবারেও , ‘উইকএন্ড স্টোরিজ’ নামক ক’টি টিভি চিত্র নিয়ে। ওপেনফোরাম শেষ হলে পর বারোয়ারি কফি খেতে খেতে বললেন, ‘ ফিল ফ্রি তু তেক এনি ফুদ ফ্রম এনি প্যাভিলিয়ন। দিস ইস লাইক ফুদ ফেসতিভ্যাল। ইউ লাইক কোকোকোলা বাত আই ক্যান হ্যাভ আ ব্যানানা’। এবং কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে ‘ উই বোথ দোনত লাইক মনোপলি’ বলে ‘ইরুভার’ দেখতে চলে গেলেন। এইখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা হল যে মনিরত্নমের ‘ইরুভার’ এর মত ছবি উৎসবে থাকা উচিত। একটি দুর্ভেদ্যরকমের পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রের প্রথম পঁয়ষট্টি মিনিট দেখে বেরিয়ে এসে আমি যখন এলেবেলে, বন্ধু বলেছিল নন্দন তিন-এ যেতে। সেথা উঁকি দেওয়া মাত্র অন্ধকারে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এ আর রহমান। এক মার্জার সুন্দরীর কটাক্ষ। ঐশ্বর্য রাই তন্মুহূর্তে নাচছিলেন বলে, তাকে দেখলাম বলে আমার পীড়িত স্নায়ুগুলি বিপুল উল্লাসে স্বস্তি পায়। খুব আগ্রহসহ ‘ইরুভার’ দেখলেন , জানুসি ছাড়াও ইতালির সান্দ্রো বালদোনি। আগ্রহী হলেও ওঁর মুখটাই আসলে ঐরকম।ছবিও ঐরকম, যেন ত্যারচা একটুকরো হাসি। বালদোনির কথা কিঞ্চিৎ বিশদ করা যেতে পারে। কেননা তাঁর এবারের প্রদর্শ ‘এ ক্যান অফ ওয়র্মস’ ছবিটি শুরু হয় একটি বিরাট খাঁচার ছবিতে। শেষেও খাঁচা। শুধু খাঁচাবন্দীরা বদলে গেছে। প্রথম দৃশ্যে ভেতরে কুকুর, মানুষেরা দেখছে। পরে মানুষেরা খাঁচার ভেতরে থাকে ও ঘেউঘেউ করে। উপমাটি যে বেশ মোটা দাগের তাতে সন্দেহ করিনা। বালদোনির ছবিতে সবই মোটা। চড়া রং, কড়া ব্যঙ্গ, ধুন্ধুমার নাটক, আর এমন একটা ওভারস্মার্টনেস, যা দেখা গেল মানুষের ভালো লাগছে। তৃতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে ওঁর ‘স্ট্রেঞ্জ স্টোরিজ’ ছবিটির সুখ্যাতি হয়েছিল। এবারেও জনতা সহর্ষ অভিনন্দন জানিয়ে গেছেন।
এক সুবৃহৎ বিজ্ঞাপন সংস্থা একটি বহুজাতিক কোম্পানির হয়ে অ্যাড কমার্শিয়াল বানাতে চায়। বিজ্ঞাপিত দ্রব্যটি হল পোকার কৌটো। কৌটোগুলি আসলে ছিল মাংসের। আর্জেন্তিনায় চালান দেওয়ার প্রাক্কালে আবিষ্কৃত হয় মাংসে পোকা জন্মে গেছে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে চলেছে তাদের। অতয়েব ফন্দি হল, এগুলি যেহেতু আর মনুষ্যভোগ্য নয়, অথচ বিক্রি করতেই হবে, নতুন লেবেল লাগানো হোক। বলা হোক এই পোকা প্রোটিন সমৃদ্ধ। সারমেয়কুলের পক্ষে অতীব উপযোগী। অতঃপর ডগফুড হিসেবে বেচে দেওয়া হোক তৃতীয় বিশ্বে। এজন্য ডগফুডের নাম, লেবেল, বিজ্ঞাপনরীতি নিয়ে ধনকুবের স্বয়ং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো সমেত বিজ্ঞাপনাধিকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সারাদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যে। এক তরুণী বিজ্ঞাপনে ব্যবহারের তরে সুন্দর একটি সারমেয় সংগ্রহ ক’রে তাকে বিউটিপার্লারে সাজিয়ে, নিয়ে আসছে সংস্থার অফিসে। কিন্তু পথে পথে বেকার বামপন্থীদের মিছিল। রাস্তা বন্ধ। এই দুই ক্ষেত্রে- বিজ্ঞাপন সংস্থার প্রাসাদ ও তুলকালাম রাজপথে ক্যামেরা ঘোরে প্রায় একে সাত চল্লিশের গতিতে। আর মাঝে মাঝে প্রস্তাবিত কমার্শিয়ালগুলির সূত্রে আমরা পৌঁছই তৃতীয় কল্পক্ষেত্রটিতে। পর্দায় দেখা যায় ডগফুডের বিজ্ঞাপন মেলা- কুকুর নায়ক ধর্ষণকারীর হাত থেকে কুক্কুরীকে বাঁচিয়ে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে পোকা। এইরূপ আরও কিছু শিভালরি।
বিজ্ঞাপন জগতের নাটকীয়তা, দ্রুতি, চমক, গ্ল্যামার ও তার অন্তঃশায়ী শূন্যতা এসবই বালদোনি ব্যবহার করেন নির্মাণ পদ্ধতিতে। চরিত্রায়নে। বিজ্ঞাপন কর্তা, যিনি অনবরত জিনসেং খেয়ে যান, তার সহকর্মী স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন গোটা ছবিতে মাত্র তিনটি চকিত লহমায়। প্রতিবারই স্ত্রী যন্ত্রের মত বস্ত্রউন্মোচন ক’রে তিনটি নূতন যোনিবন্ধনী দেখান। একটি চামড়ার, একটি শিকলশোভিত, অন্যটিতে লাল আলো জ্বলে। সেগুলিকে মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান ক’রে কর্তা পিছলে যান অন্য ঊর্বশীদের দিকে। ওদিকে মনপসন্দ বিজ্ঞাপন না মেলায় বহুজাতিকটি ক্রমে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন। তার মন ও সংস্থার মান রক্ষায় মরিয়া তাগিদের মধ্যে রাজপথ ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। কর্মহীন জনতা, অটোমেশনের কল্যাণে ছাঁটাই হয়ে যাওয়া বিজ্ঞাপন কর্মীরা দপ্তর আক্রমণ করে। এই দৃশ্যটিতে হিংস্রতা নয়, যেন কার্নিভালের মেজাজ। শ্লোগান, ভাঙচুর, রক্তপতাকার আন্দোলন, কর্তাব্যক্তিদের তুমুল পলায়ন- তার মধ্যে সারমেয়টির আত্মরক্ষাপ্রয়াস অবশেষে পূর্বোক্ত খাঁচার দৃশ্য ফেড ইন করে। বিজ্ঞাপন গোষ্ঠীর মানুষেরা কুত্তাসদৃশ আচরণ করে যান খাঁচার ভেতর। সম্ভবত এও এক কমার্শিয়াল। অবিবেকী সভ্যতার বেলাভূমে দাঁড়িয়ে বালদোনিকৃত তিক্ত পাঁচনের বিজ্ঞাপন । তাঁর এ ভঙ্গিটি কার্টুনিস্টের। দার্শনিকের নয়। তিনি কোনও নূতন কথা বলেন নি। শুধু বহুজাতিকের বিজ্ঞাপনমোড়া চলচ্চিত্র উৎসবে বিজ্ঞ বিদূষকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। আর দর্শনের কথা যদি বলি, মনুষ্যহৃদয়ের গূঢ় উন্মোচনের কথা যদি বলি, তবে স্মরণ করা যাক রুশ চলচ্চিত্রী পোলাকাকে। তাঁর ছবির নাম ‘ রিটার্ন অফ দ্য ব্যাটলশিপ’। নির্মাণ সময় ১৯৭৭। বিশ্বসিনেমা বিভাগে এবারের সেরা প্রাপ্তি এবং এখানেও কিমাশ্চর্যম, এক বন্দীর করচিহ্ন।
এই বন্দীত্ব নিয়মতান্ত্রিকতার। বন্দীর নাম হার্টজ, কমরেড হার্টজ। জন্ম সূত্রে জার্মান। রুশবিপ্লবোত্তর গৃহযুদ্ধে অংশ নেবার পর থেকে মনে প্রাণে রাশিয়ান। ১৯২৫ সালে মস্কো থেকে শ্রমকমিশনার হিসেবে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সিনেমা শহর ওডেসায়। এক রৌদ্রপীড়িত দিনে এক গাদা বই, একটা টিনের তোরঙ্গ আর কাঁধের উপরে একটি যন্ত্রমগজ বয়ে ওডেসার বিশ্ববিশ্রুত হর্ম্যরাজীতে নোঙর করলেন তিনি। যেথা সর্বদা দাবড়ে বেড়ায় ঘোড়সওয়য়ার, নকল ঘোড়সওয়য়ার। ছোটে কাউবয়, নকল কাউবয়, হাসে আমুদে মানুষেরা, নকল আমুদে। এসকলই মায়া, শুটিং এর তরে। এ হল শিল্পীর দুনিয়া। কিন্তু হার্টজের কারবারক্ষেত্র আর্ট নহে, ইন্ডাস্ট্রি। তিনি অপরিসীম গাম্ভীর্য নিয়ে দপ্তরে বসেন। যে হতদরিদ্র ‘অতিরিক্তরা’ এক রোজ কাজ পাবার চেষ্টায় মরিয়া, তারা নেচে, গেয়ে, ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে, পশ্চাতের কাপড় মাথায় তুলে , সর্ববিধ নারকীয় কাণ্ড করেও হার্টজের নীতিনিষ্ঠাকে টলাতে পারেনা। তিনি স্তালিনের ন্যায় অকম্পিত গুম্ফ ট্রটস্কির ন্যায় অবিচলিত শ্মশ্রূময় মুখমণ্ডল কঠিন রেখে খাতায় টিক দেন। লালকালি। নীলকালি। যে করুণ বিধবাটি সিনেমার অনিশ্চিত রোজগারে উপোসি থাকতে থাকতে একদিন দুই শিশুর সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিল খাবার ফেরির জন্য , তার নাম কেটে দেওয়া হল। হার্টজ প্রত্যাখ্যান করলেন তার প্রণয়প্রস্তাব। লালকালি, নীলকালি। আইজেনস্টাইন নামে এক তরুণ পরিচালক ১৯০৫ এর নৌবিদ্রোহ বিষয়ক ছবি তুলতে এলেন ওডেসায়। ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন অনভিজ্ঞ আমজনতাকে। পথের ভিখারি, অন্ধ গায়ক, নাম কেটে দেওয়া মা- শিশুসন্তান সহ। হার্টজ প্রাণপণ বিরোধিতা শুরু করলেন এই প্রথাবিরোধী প্রকল্পের। লালকালি-নীলকালি। ওডেসা সিঁড়ির সেই তাণ্ডব দৃশ্যের শুটিং সময়ে তিনি ঢুকে যান ক্যামেরা ক্ষেত্রে। প্রবল হট্টগোলের মধ্যে কঠিন পাথরের উপর দাঁড়িয়ে- অনেক উঁচুতে ক্রেনআসীন স্রষ্টার দিকে মুখ তুলে অহংক্ষুব্ধ চিৎকার শুরু করেন- আইজেনস্টাইন ! আইজেনস্টাইন!! যেন মল্লযুদ্ধের আহ্বান। পাথর ও আসমানের যুদ্ধ। অবশেষে হার্টজের পতন। পাথরের সিঁড়িতে ঠোক্কর খেতে খেতে তিনি গড়িয়ে পড়েন মাটির দিকে। তারপর রেজারেকশান। ওডেশার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল পোটেমকিন। মানুষ আসছে শহর ভাসিয়ে। সেই সকল লোক, যারা অনেকেই আপনাকে শনাক্ত অথবা আবিষ্কার করে জাদুপর্দায়। সেই সকল মুখ, যেখানে রং নয়, কিছু প্রতিজ্ঞা। দেহ, যা লাস্যময় নয় বরং শ্বেত সন্ত্রাসের সামনে প্রসারিত সাহসে। সেই অদৃষ্টপূর্ব চোখগুলি, যেথা হাসি বা অশ্রুর বদলে কিছু আগুন আছে। তারা ছবিটি দেখে দুবার, পাঁচবার, দশবার, মনে হয় সিনেমা তাদের পূর্বধারণামত অতিজৈবনিক নয়, পোটেমকিন শুটিং এর কালে যা বুঝেছিল সেই জৈবনিকও নয়। বরং মহাজৈবনিক হতে পারে। ক্লাভিদা নামের সেই করুণ মেয়েটি পেয়েছিল মায়ের পার্ট, উল্টোনো প্যারাম্বুলেটর থেকে গুলিবিদ্ধ সন্তানকে বুকে তুলে নিয়ে পলায়নপর জনস্রোতের বিরুদ্ধে বন্দুকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পার্ট। শুটিংএ সে লিপ্ত হয়েছিল ব্যক্তিগত মাতৃ অনুভবে। এখন প্রদর্শন কালে সেই অনুভব সহস্র মনে সৌন্দর্য্যময় সমসত্ত লাভ করে। তুচ্ছ মানুষগুলি বড় হয়ে ওঠে। রূপোলি আলো কাঁপে তাদের মুখে। আলো ক্রমে আসিতেছে। হার্টজও দেখেন ছবিটি। দেখেন ক্লাভিদাকেও। আরোপিত ব্রহ্মচর্যের ঔদ্ধত্যে একদা যাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আজ এই চন্দ্রাহত মুহূর্তে অবসৃত হল গারদ সকল- অপ্রেমের, অন্ধতার। এই অভিঘাতে হার্টজের সময় থেমে গেল। বয়স আর বাড়ল না। বয়ে চলল ভোলগা। অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এগোল রাশিয়া। পোটেমকিনের অভিনেতৃবর্গ কেউ প্রয়াত হলেন, কেউ, এমনকী ক্লাভিদাও পালটে ফেলল জীবন। ছবিটিও প্রাচীন, স্মৃতিধার্য, শেষমেষ ঐতিহাসিক হয়ে গেল। তবু আজও প্রতি রাতে সেই প্রেক্ষাগারে চলছে পোটেমকিন। হার্টজ আসেন, একা। রুক্ষ শ্মশ্রূ, ছিন্নবেশ, আতুর চোখ। ছবি দেখেন। নিঃশব্দে বেরিয়ে যান, আবার আসবেন ব’লে। আসবেন কেননা এখনও কোথাও মায়া রহিয়া গেছে। দীর্ঘায়িত হয়েছে বন্দীত্বের দ্বিতীয় পর্যায়, যা প্রথম অমায়িক পর্যায়ের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া। অথবা একে কি সর্বোত্তীর্ণ দশা বলা যেতে পারে ? এক নিঃসময় সৌন্দর্যলোকে মুক্তি, যেথা আকাঙ্ক্ষা আছে কিন্তু নিবৃত্তি নেই। হার্টজ তো সেই নারীকে দেখেন না তাঁর অবচেতন যাকে কামনা করেছিল, দেখেন তার চেয়ে বেশি কিছু। We do assume the attitude of aesthetic contemplation towards real events or objects. But every one of us can feel in him a sort of recoil in relation to the object contemplated which slips into nothingness so that, from that moment on, it is no longer ‘perceived’. It functions as an analogue of itself, that is, an unreal image of what it is- appears to us through its actual presence. যদি অনুমতি করো, রচনার অন্তিমে সার্ত্রকে সাক্ষী মানিতে চাই যে বাস্তব কখনই সুন্দর নহে। সুন্দর হয় এক মূল্যায়ন যা কল্পিত, অতয়েব পার্থিব পিঞ্জরকে অবশ্যই অস্বীকার করে।
'পিঞ্জরে বসিয়া শুক' প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে সোমনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত পত্রিকা 'অপর' এর জানুয়ারী - ডিসেম্বর, ১৯৯৮ সংখ্যায়।