প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
মাদাদোয়া
বহুবার শোনা কথাটাও নতুন করে শুনতে হল সেদিন। ব্রাত্য, আমাদের বন্ধু ই টিভি-র একটি অনুষ্ঠানের পরিচালক – ‘নবীন V/S প্রবীণ’। এর আগে একবার ডাক পড়েছিল সেখানে, নবীনদের তরফে বিতর্কে অংশ নিতে। ক’দিন আগে ফের ব্রাত্যর ফোন, আবারও যেতে হবে, এবারের বিতর্ক অন্য বিষয়ে।আমার ভূমিকা প্রবীণের। আমি অবাক হয়ে শুধোলাম ‘সে কিরে! এই ছত্রিশ বছরেই প্রবীণ?’ ব্রাত্য আরও অবাক হয়ে বলল, ‘বয়স? বয়সে কী এসে যায়? তুই কি বিশ বছরের প্রবীণ আর আশি বছরের নবীন দেখিস নি কখনও?’ সেই প্রোগ্রামটা যদিও ঘটে ওঠে নি শেষ পর্যন্ত, কিন্তু কথাটা ঢুকে গেছিল আমার মাথায়। সত্যিই কি দেখি নি আমি, শুনি নি, পড়ি নি – বয়োবৃদ্ধ নবীনদের মুখচ্ছবি? যাঁদের দেখে আমাদের অকাল বার্দ্ধক্য লজ্জা পায়। বাঁচতে ইচ্ছে করে বহুদিন, ‘গলিত স্থবির ব্যাঙ’এর মতো নয় বরং ‘সিন্ধু সারসে’র মতো।
প্রথমেই মনে পড়ল, প্রফেসর সুহিতোর নাম। জাপানের এক মফস্বল শহরের সাধারণ একটি কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক। তিনি যে বিরাট কোনও পণ্ডিত এমন নয়, স্বভাবতই পাণ্ডিত্যের অভিমান তাঁর নেই। তবু ছাত্ররা তাঁকে ভালোবাসে, বৈদগ্ধের জন্য নয়, নিষ্ঠার জন্য, আন্তরিকতার জন্য। তিনি নাম জানেন প্রত্যেক ছাত্রের, জানেন তাদের একাডেমিক এমনকি ব্যক্তিগত সমস্যার কথাও। সীমিত সাধ্য সত্ত্বেও তিনি চেষ্টা করেন তাদের সাথ দিতে।
সেটা চল্লিশ দশকের কথা। বিশ্বযুদ্ধের আগুন হঠাৎ আছড়ে পড়ল সেই ছোট্ট মফস্বলেও। চারিদিকে বোমা, আগুন, মৃত্যু। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও সুহিতো কিন্তু তাঁর কাজে অক্লান্ত। কারণ তাঁর বিশ্বাস, যে বিপর্যয়ই আসুক না কেন, শেখা আর শেখানো তো থামানো যাবে না কখনও। বোমার আঘাতে স্ত্রীর মৃত্যুর পরদিন এক প্রিয় ছাত্রকে সুহিতো বলেন, আমি ইতিহাস পড়েছি, পড়িয়েছি যুদ্ধের কথা, জয় আর পরাজয়ের ইতিবৃত্ত, কিন্তু মৃত্যু আসলে কী তা তো এতদিনে শিখলাম! যে শিক্ষা জীবন দিয়ে শিখতে হয়, সেই তো আসল শেখা!
যুদ্ধ শেষ। মিউনিখ চুক্তিতে শ্মশানের শান্তি নেমেছে দেশে। চলছে পুনর্গঠনের কাজ। ইতোমধ্যে রিটায়ার করেছেন সুহিতো। তবু তিনি কলেজ যান। বিনা মাইনেতেই ক্লাস নেন একটি দুটি। কিন্তু একদিন কলেজ কর্তৃপক্ষ জানালেন, এখন আমাদের বেশি বেশি দরকার চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ। হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের জন্য ঘরের বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হবে। অতএব, সুহিতো শুরু করলেন পাঠদান, নিজের ফুটোফাটা ঘরেই, যথারীতি বিনামূল্যেই। বয়স বাড়ছে – সত্তর, বাহাত্তর, তিয়াত্তর। বাড়ছে শারীরিক প্রতিবন্ধ। তবু কাজ থামছে না। তাঁর পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনে প্রিয় প্রাক্তন ছাত্ররা আয়োজন করল এক সম্বর্ধনার, স্যারের বাড়িতে। বেশ কয়েকটি প্রজন্মের ছেলে – মেয়েরা, যারা অনেকেই প্রতিষ্ঠিত এখন, তাঁকে অনুরোধ করল,স্যার এবারে অন্তত বিশ্রাম নিন। এই পরিশ্রম বন্ধ করুন। জীবনের শেষ কটা বছর বরং ব্যয় করুন তাত্ত্বিক পড়াশুনোয়, লেখালিখিতে। বৃদ্ধ চুপ করে শুনলেন সব, তারপর সস্মিত মুখে বললেন – ‘মাদাদোয়া’, যার ইংরাজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, নট ইয়েট – এখনও নয়।
প্রফেসর সুহিতো এক কল্পমানব।‘মাদাদোয়া’ আকিরা কুরোশাওয়া পরিচালিত সর্বশেষ ছবি। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যখন গুটিকয় ইউরোপীয় দেশের বাইরে ভালো ছবির কোনো ঐতিহ্যই গড়ে ওঠেনি, তখন বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে তিন অখ্যাত দেশ থেকে উঠে এসেছিল সিনেমার তিন রাজপুত্র। ভারতের সত্যজিৎ, জাপানের কুরোশাওয়া আর সুইডেনের বার্গম্যান। প্রথম দুজনের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব অটুট ছিল সারাজীবন। এবং দুজনেই বার বার ভেবেছেন বৃদ্ধদের নিয়ে, বার্দ্ধক্যের সমস্যা নিয়ে। প্রবীণ সত্যজিৎ ডাক্তারদের নিষেধ সত্ত্বেও অপারেশনের ধকল কাটিয়ে, অ্যাম্বুলেন্স আর ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন লোকেশনে। তাঁর শেষ তিনটে ছবিতেই ছায়া ফেলেছে প্রবীণ মানুষদের লড়াকু মনোভাব, একাকীত্ব-যন্ত্রণা আর সেই জেদ – আমি কখনও কূপমণ্ডূক হব না, কখনও থামবে না ‘ভাণ্ডারলুস্ট’- একটি জার্মান শব্দ – যার কাছাকাছি বাংলা হতে পারে ‘বিস্মিত হবার আকাঙ্ক্ষা’। সত্যজিতের ছবি এই লেখার পাঠকরা প্রায় সকলেই দেখেছেন। হয়ত পড়েওছেন কুরোশাওয়াকে নিয়ে লেখা তাঁর অসাধারণ নিবন্ধটি। যেখানে তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, কুরোশাওয়া এক সামুরাই পরিবারের সন্তান, এক আমৃত্যু যোদ্ধা। যিনি মৃত্যুর প্রাক্ মুহূর্তেও তরবারি কোষবদ্ধ করেন না, বলেন, নট ইয়েট। কুরোশাওয়ার প্রসঙ্গে এ লেখার শেষে আমরা আবার ফিরে আসবো। তার আগে কল্পমানব কিম্বা তার স্রষ্টাদের বদলে ক’জন রক্তমাংসের মানুষের কথা বলা যাক। যাঁরা ভাবেন – এসব শুধু সিনেমাতেই ঘটে, তাঁদের জন্য।
সিস্টার ফ্লোরেন্সকে আমি দেখেছি। ঠিক পনের বছর আগে, ছাত্রাবস্থায়। সদ্য গিয়ে উঠেছি বৌবাজারের এক হোস্টেলে। সেখান থেকে কয়েক পা এগোলেই মিশনারিজ অফ চ্যারিটির একটি শাখাভবন।সেখানে প্রায় প্রত্যেক রোববারেই কোনও না কোনও কাজে আসতেন মাদার টেরিজা।আসতেন অন্যান্য কিছু চ্যারিটেবল খ্রীস্টীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও। আলাপ – আলোচনার জন্য। আমাদের এক নেপালি সহপাঠীর সঙ্গে হানা দিয়েছিলাম সেখানে। কাঠমাণ্ডু থেকে ওর বোন মাদারের অটোগ্রাফ চেয়ে পাঠিয়েছে, তাই। প্রাধিকারীরা সবাই তখন মিটিং এ ব্যস্ত। এক তরুণী সন্ন্যাসিনী হীরালালের বোনের অটোগ্রাফ খাতাটি চেয়ে নিয়ে সস্নেহে বললেন পরদিন আসতে। উনি সই করিয়ে রাখবেন। পরদিন, ঘটনাচক্রে আবারও বসেছিল একই রকম মিটিং। আমরা যাওয়ামাত্র খাতাটি তো পেলামই, বাড়তি লাভও হল একটা। মিটিং শেষে, গাড়িতে ওঠার পথে প্রথম দেখলাম মাদারকে। তাঁকে তো সবাই চিনি। তরুণীটি চিনিয়ে দিল অন্যদেরও – উনি সিস্টার সিসিল, উনি নির্মলা, উনি ফ্লোরেন্স। মাদারকে পরেও দেখেছি ১৯৯২ এ, বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টারে।দেখতে এসেছিলেন সদ্য অস্ত্রোপচার হওয়া দেড় বছরের অনাথকে। হাতে জপমালা। সকলকেই প্রতিনমস্কার করছেন। বয়স তাঁকে আরও সুন্দর করেছে।
মাদারের কর্মকাণ্ডের কথা সবাই জানেন, আমরা বরং সিস্টার ফ্লোরেন্সের কথা বলি। সেই যাকে দেখেছিলাম, কিন্তু টেরিজার আলোকচ্ছটায় লক্ষ্য করিনি তেমন ভাবে। শুধু মনে ছিল, তাঁর পরনে ছিল চিরাচরিত সন্ন্যাসিনীর পোশাক নয়, নার্সের ইউনিফর্ম। সম্প্রতি ইন্টারনেটে তাঁর ছবি দেখে চমকে উঠলাম। বরাবর আলোকবৃত্তের বাইরে থেকে যাওয়া মানুষটি সম্প্রতি খবর হয়েছেন, তার কারণ তাঁর বয়স হল পুরোপুরি একশো বছর। এখনও সদাহাস্যময়ী, অক্লান্তকর্মী সুদূর কানাডা থেকে নার্সিং ট্রেনিং সাঙ্গ ক’রে, স্যালভেসন আর্মির সঙ্গে কিছুদিন কাজ করে, এদেশে এসেছিলেন আঠাশ বছর বয়সে। যোগ দিয়েছিলেন অক্সফোর্ড মিশন ট্রাস্ট অ্যাসোসিয়েশনে। আত্ননিয়োগ করেছিলেন অসুস্থ পথশিশুদের নিরাময়ের কাজে। তাঁর শততম জন্মদিনে শুভার্থী ও সহকর্মীরা সংবর্দ্ধিত করেছেন তাঁকে। সাংবাদিকরা সবিস্ময়ে শুনেছেন, এ বছরই তিনি আইনগতভাবে দত্তক নিয়েছেন দু’দুটি পথশিশুকে। সে কি? এখনও? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ফ্লোরেন্স শুধু বলেছেন আমার তো একটাই কাজ, আমি তো এটাই পারি। আর মনে মনে নিশ্চয়ই ওঁর মাতৃভাষাতেই উচ্চারণ করেছেন – থামা যায় না, যাবে না, এখনও নয়, কখনও নয়।
সম্প্রতি বিখ্যাত হয়েছেন আরও একজন। এভারেস্ট বিজয়ের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে দিল্লী, কাঠমাণ্ডু এবং লন্ডনে বেশ ক’দিন জুড়ে চলল ধামাকা। জমায়েত হলেন অসংখ্য মানুষ, যাঁরা একাধিকবার উঠেছেন ২৯,০৩৫ ফুট উঁচু পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে, যাঁদের পকেটে রয়েছে নানান রকমের রেকর্ড। এঁদের মধ্যেই ছিলেন জাপানের এক স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ইউচিরো মিউরা। এই তথ্য বিপ্লবের যুগে সংবাদপত্রে, টিভিতে, ইন্টারনেটে ভেসে ওঠে অসংখ্য মুখ। ফের মুছে যায় নতুন নতুন গরমাগরম খবরে। কিন্তু ইউচিরোর মুখ আমি ভুলি নি, ভুলতে পারি নি। তার কারণ ইনি সত্তর বছর বয়সী এবং প্রবীণতম এভারেস্ট আরোহণকারী – শুধু এই জন্য নয়, বরং প্রত্যাবর্তনের পর মিডিয়ার সামনে বলা তাঁর কথাগুলির জন্য।
ইউচিরো বলেছেন, পর্বতারোহণ আমার বহুদিনের নেশা। আমার ছেলেরও। আমি ইতোপূর্বে পা রেখেছি মাউন্ট কামেট, মাউন্ট অ্যাবি জেমিন, মাউন্ট সাকাং-এ। কিন্তু চোমোলাংমার কাছে এরা তো নেহাত শিশু। যখন রিটায়ার করলাম স্কুল থেকে, বুঝলাম এভারেস্টে ওঠার স্বপ্ন, বয়স জনিত কারণেই পূরণ হবে না আর। মনে মনে মেনেও নিয়েছিলাম কথাটা। উৎসাহিত করেছিলাম ছেলেকে। কিন্তু ইন্টারনেটে এক ভয়াবহ খবর দেখে আমি চমকে উঠলাম- এভারেস্ট এখন সবচেয়ে দূষিত শৃঙ্গ। সেখানে জমে আছে অভিযাত্রীদের ফেলে আসা তিনশ টনেরও বেশি জঞ্জাল, আশে পাশে ছড়িয়ে আছে প্রায় পঁচাত্তরজন হতভাগ্য আরোহীর মৃতদেহ। সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিই, আমিও যাবো। ছেলে, তার সহযাত্রী বন্ধুরা, ডাক্তারবাবুরা বারণ করেছিলেন বারবার। বলেছিলেন, জঞ্জাল সরানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে সেই ১৯৯৬ সাল থেকেই। কাজ চলছে। কিন্তু আমি বললুম, চলুক না কাজ, কিন্তু হাত লাগাতে হবে আমাকেও, একজন পর্বতপ্রেমী হিসেবে। আমি তো প্রবীণতম, আমার দায়িত্ব তাই সমধিক।
কিছুতেই বাবাকে বাগ মানাতে না পেরে ছেলে প্রস্তাব দিয়েছিল আঠাশজনের দলটিতে তুমি হবে দশম আর আমি একাদশতম আরোহী। মিউরা রাজি হন নি। বলেছিলেন, পাহাড়ে তুমি আমার ছেলে নও, সহযাত্রী। আমি তোমার সঙ্গে থাকব না, থাকব আরো পিছনে। অন্যদের সঙ্গে। হয় কিছু জঞ্জাল নিয়ে ফিরে আসব একসঙ্গে, নয়ত বরফাচ্ছাদিত ছিয়াত্তরতম মৃতদেহটা হবে আমার।
মিউরা কথা রেখেছেন। এভারেস্টে উঠেছেন। বয়ে এনেছেন অন্তুত তিরিশ টন রাবিশ। তিনি কি পড়েছিলেন এক নবীন বাঙালীর কবিতা – “যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল”!
প্রবীণসভার যে সব সদস্যদের জন্ম ত্রিশ-চল্লিশ দশকে, যৌবনে তাঁরা অনেকেই হয়তো আক্রান্ত হয়েছিলেন বিটলস্-ম্যানিয়ায়। যাঁরা হননি, তাঁদের জানিয়ে দেওয়া যাক, বিটলস্ ছিল লিভারপুলের একটি পপ ব্যান্ড। চার সদ্য যুবক হাতে গিটার, ব্যঞ্জো আর তাল বাদ্য নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সুবিখ্যাত হয়ে ওঠেন। দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন সারা বিশ্ব। তাঁদের গানে উঠে আসতে থাকে ষাট দশকের র্যাডিকালিজম্, হিংসামুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন, প্রেমের স্বাধীনতা আর আন্তর্জাতিকতার আহ্বান। কিন্তু সঙ্গীতে যতই তারুণ্য থাক না কেন, ধীরে ধীরে শারীরিক বয়স বাড়তে থাকে তাঁদের। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, কেউ প্রয়াত হন দুর্ঘটনায়, কেউ ডুবে যান নেশায়। এখনও বিটলস্-এর একমাত্র যে সদস্য জীবিত রয়েছেন তাঁর নাম পল ম্যাককার্টনি, বয়স বাষট্টি বছর। ১৯৯৮ এ গোটা সঙ্গীত বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে শুনেছিল স্বেচ্ছা অন্তরীণ ম্যাককার্টনি। তাঁর নীরবতা ভাঙার ইচ্ছা হলেও কোনওদিনই মঞ্চে উঠতে পারবেন না আর। দুরারোগ্য ক্যান্সার হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই কেড়ে নেবে তাঁর স্বর্ণকণ্ঠ।
কিন্তু ২০০২ এর গোড়ায় শোনা গেল নতুন খবর। অপারেশন, রেডিওথেরাপি ও এগারোটি কেমো নেওয় পলকে ডাক্তাররা ফের অনুমতি দিয়েছেন গাইতে। তিনিও রাজি হয়েছেন। সেই বছরই এপ্রিল থেকে শুরু হল তাঁর ঝটিকা সফর – মেক্সিকো থেকে জাপান – দুই মিলিয়ন নষ্টালজিক শ্রোতা আপ্লুত হল ফিনিক্সের উড়ানে। অবশেষে গত ১ জুন লিভারপুলে পল করলেন আপাতত তাঁর শেষ অনুষ্ঠান। পিছনের পর্দায় প্রক্ষেপিত হচ্ছে বিটলস্-এর স্বর্ণযুগের ভিডিও ক্লিপ। পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগলেন তাঁর প্রথম গানের তালে তালে – ‘হোম ইজ হ্যোয়ার দ্য হার্ট ইজ’।
প্রত্যেক প্রয়াত সঙ্গীর জন্য পল গেয়েছেন একটি করে গান। জর্জ হ্যারিসন, যিনিও ক্যান্সারেই মারা গেছেন, তাঁর তৈরি ইউনিকল নামে এক বিচিত্র তারবাদ্য বাজিয়ে। সব শেষে অশ্রুচোখে শুনিয়েছেন, গুলিতে নিহত সহকর্মী লেননের লেখা সম্ভবত সচেয়ে জনপ্রিয় গান – ইমাজিন, দেয়ার ইস নো কান্ট্রি! মনে করো কোনও রাষ্ট্র নেই। আছে শুধু এক বিশ্ব। মনে করো পাতালে নেই নরক, আকাশে কোনও স্বর্গ । প্রতিটি মানুষ বেঁচে আছে প্রতিটি মানুষের জন্য। ইমাজিন, দিস ইজ নট হার্ড টু ট্রাই! আমি জানি তবু তোমরা চেষ্টা করবে না, ভাবতে চাইবে না এরকম! ইফ ইউ সে আই অ্যাম আ ড্রিমার, আই নো আই অ্যাম নট দ্য অনলি ওয়ান! সাম ডে ইউ উইল জয়েন আস, অ্যন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইউল বি ওয়ান।
এই গান গাইতে গাইতে কাঁদতে কাঁদতে কাশতে কাশতে বসে পড়েছিলেন ম্যাককার্টনি। কিন্তু পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের শুভকামনা, আমরা আশা করব আবার সুস্থ করে তুলবে তাঁকে। যারা বলেছে নতুন গান লিখতে। স্টিল গড লিভ ইন ইয়োর পেন্সিল, পল। গো অ্যাহেড। পল উত্তর দিয়েছেন, আমার এই অনুষ্ঠান উৎসর্গ করলাম প্রথমা স্ত্রী লিস্তা এবং বর্তমান স্ত্রী হিদার মিলস্ কে। তারপর লাজুক মুখে শুনিয়েছেন, হিদার সন্তানসম্ভবা – এই আটচল্লিশ বছর বয়সে। কারণ বিটলস্ এর উত্তরাধিকার তো থেমে যেতে পারে না- নট ইয়েট। সো লেট ইট স্টার্ট মাই ফ্রেন্ড! লেট ইট স্টার্ট, লেট দ্য টিয়ার্স কাম রোলিং ফ্রম ইয়োর হার্ট! অ্যান্ড হোয়েন ইউ নিড লাইট ইন দ্য লোনলি নাইট – ক্যারি মি লাইক আ ফায়ার ইন ইয়োর হার্ট!
এই বৃত্তান্ত শেষ হবার নয়। স্মৃতিতে ভিড় করে আসছে আরো নানা চিরযুবার প্রতিকৃতি। কিন্তু কোথাও তো থামতেই হয়। তাই পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো ফিরে আসা যাক কুরোশাওয়ায়। আমরা এতক্ষণ যাঁদের কথা বলছিলাম, তাঁরা সকলেই সফল, কোনও না কোনও ভাবে সেলিব্রিটি। কিন্তু কুরোশাওয়ার ‘ইকিরু’ ছবির নায়ক সাধারণ, একেবারেই সাধারণ, আমাদের মতো। কিন্তু কখন, কীভাবে সাধারণের মধ্যে জেগে উঠতে পারে অসাধারণত্ব- তা-ই এই ছবির বিষয়। ‘ইকিরু’ শব্দের মানে বেঁচে থাকা। ছবির নায়ক আটান্ন বছর বয়স্ক এক পৌর করণিক – ওয়াতানবি। আত্মজীবনীতে পরিচালক লিখেছেন – এই মধ্য বয়সেই কখনও কখনও কোনও বিনিদ্র রাতে আমার মনে হানা দেয় মৃত্যুচিন্তা। মনে হয় বেড়ে যাচ্ছে বয়স। তবু, মৃত্যুর পরেও কি অর্থপূর্ণ থাকে না আমাদের জীবন? এই প্রশ্নই আমাকে তাড়িত করেছিল ইকিরুর চিত্রনাট্য লিখতে।
গতস্ত্রী ওয়াতানবি টোকিও পৌরভবনে বড়োবাবুর কাজ করেন গত পঁচিশ বছর ধরে। কাজ মানে স্রেফ দিনযাপন – চুপটি করে বসে থাকা, পর্বতপ্রমাণ ফাইলের স্তূপ থেকে সারাদিনে মাত্র দুটি একটি ফাইল নাড়াচাড়া করা আর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের বলা – আজ আমরা ব্যস্ত আছি। আপনি অমুক দিন আসুন! সরকারি আমলাদের এ হেন ব্যবহারে আমরা প্রায় সবাই অভ্যস্ত। এটাই তরিকা। দিব্যি আর দুটো বছর অকাজে বা কাজের অছিলায় কাটিয়ে দিতে পারতেন ওয়াতানবি। কিন্তু গোল বাধল শরীরে। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। তিনি বাধ্য হলেন হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে। ডাক্তাররা খুব নরম স্বরে জানালেন, অন্ত্রে ক্যান্সার হয়েছে। তাঁর আয়ু আর বড়োজোর ছ’মাস।
সেই রাতে ওয়াতানবি ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ফেরেন, স্লথ হাতে রেলিং ধরতে ধরতে পৌঁছান দোতলায়। ছেলের ঘরে। তাকে ঘটনাটা জানাবেন বলে। কিন্তু দরজার বাইরে থেকেই শুনতে পান পুত্র আর পুত্রবধূর কণ্ঠস্বর। এই বুড়োকে আর কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে, কবে পাওয়া যাবে তার পি.এফ এর দখল – এই নিয়ে ক্ষুদ্ধ কথোপকথন। আবার তিনি নেমে আসেন সিঁড়ি দিয়ে। শুয়ে পড়েন অন্ধকার ঘরে। একা।
পরদিন ওয়াতানবির প্রথম কাজই হল পি. এফ এর সমস্ত টাকা তুলে নেওয়া। তিনি ফূর্তি করবেন শেষ কটা দিন। প্রথমে তাঁর সঙ্গী হল অফিসের এক তরুণী সহকর্মী, তারপর এক খ্যাপাটে কবি। টোকিওর নাইট লাইফ জীবনে প্রথম উপলব্ধি করতে গিয়ে ওয়াতানবি বুঝলেন - এখানে শান্তি নেই। তিনি তো কবি নন, শিল্পী নন, ঐ মেয়েটির মতনও নন – যে বাড়তি রোজগারের জন্য পুতুল তৈরি করে, কিন্তু কারও পুতুল হতে রাজি নয়।
পরদিন ওয়াতানবির সঙ্গে দেখা হয় একদল বস্তিবাসী মহিলার। তারা ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত। বস্তির মধ্যে একটুকরো ফাঁকা জমি ক্রমেই জঞ্জালের ভাগাড় হয়ে উঠছে – অথচ পুরসভা কোনও উদ্যোগই নিচ্ছে না। বার বার এ টেবিল থেকে ও টেবিল ফিরতে হচ্ছে তাদের। দিনের পর দিন। ওয়াতানবি হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। ওদের ডেকে শুধোলেন, ওখানে কি একটা খেলার মাঠ তৈরি করা যায়? একটা চিল্ডরেন্স পার্ক? মহিলারা সমস্বরে সম্মতি জানায় এবং সবিস্ময়ে দেখে ওয়াতানবি ধুলো ঝেড়ে তুলে নিচ্ছে তাদের ফাইলটা। নিজেই সেটা হাতে করে রওনা হচ্ছে বড়োসাহেবের ঘরে। জীবনে প্রথম।
তারপর একের পর এক সাহেব। একের পর এক দরজা। একের পর এক লাল ফিতের ফাঁস খোলার আন্তরিক চেষ্টা। অলস সহকর্মীরা তো কেউই জানেন না ওয়াতানবির অসুখের খবর। তারা অবাক হয়, হাসাহাসি করে। ওয়াতানবি কিন্তু অবিচলিত। বিনীত, কিন্তু সংকল্পে দৃঢ়। দ্রুত তাকে শেষ করতে হবে কাজটা। অতি দ্রুত।
পার্কটা তৈরি হয় অবশেষে। তারপরেই আমরা দেখতে পাই অফিসের ঘরে ওয়াতানবির প্রথামাফিক স্মরণসভা, কৃত্রিম ভাষণ, আরোপিত গাম্ভীর্য। অবশেষে, প্রয়াতর স্বাস্থ্যপান করে দু’এক চুমুক মদ্যপানের পরেই খুলে পড়তে থাকে মুখোশ। সহকর্মীরা হাসাহাসি করতে থাকেন বড়োবাবুর হঠাৎ জেগে ওঠা দায়িত্ববোধ নিয়ে।
কিন্তু এখানেই ছবি শেষ করেন নি কুরোশাওয়া। শেষ দৃশ্যে ওয়াতানবির এক ফাঁকিবাজ সহকর্মী ঘরে ফেরবার পথে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় এক ফুটব্রিজের উপরে। নীচেই সেই কুরচা বস্তি। মধ্যিখানে একটা খেলার মাঠ, পার্ক, দোলনা। মায়াবী চাঁদের আলোয় ভরে যাচ্ছে চরাচর। প্রয়াত ওয়াতানবি দোল খাচ্ছেন দোলনায়। আর গুনগুন করে গাইছেন মায়ের কাছে শোনা এক ঘুমপাড়ানিয়া গান। এই অধিবাস্তব দৃশ্যের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিমুরা। তার চোয়াল ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে। হয়তো কোনও সংকল্পে। আমরা বুঝি ওয়াতানবির মৃত্যু হলেও – তাঁর স্বপ্নের মৃত্যু নেই। শেষ শট – পরদিন সকালবেলা। রৌদ্রোজ্জ্বল পার্কে খেলছে শিশুরা। যাদের মধ্যে বেঁচে আছে মনুষ্যত্বের অসম্ভব, অনিঃশেষ সম্ভাবনা। যার মৃত্যু হবে না – নট ইয়েট! এখনও নয়!
রচনাটি বহরমপুর প্রবীণসভার মুখপত্র 'গোধূলিবেলা' য় ২০০৩ সালে প্রকাশিত
আধুনিক সাহিত্য বিষয়ক কিছু ভাবনা
কোনও মানুষই যেহেতু স্থিতধী বৃক্ষ নয়, কবিকেও তাই পথ হাঁটতে হয় আজীবন । তিনি শিকড়হীন বা স্বয়ম্ভূ নন, কিন্তু পক্ষবান। তাঁর নিত্যনিরঞ্জন মানসপট ও বৈশ্বিক প্রব্রজ্যার কল্যাণেই প্রাগাধুনিক কাব্য আধুনিক ও ক্রমে আধুনিকোত্তর হয়ে ওঠে, উঠেছে।
আধুনিক বাংলা কাব্যের সূচনাক্ষণটি নানা মেধার প্রচেষ্টায় বিবিধরূপে স্থিরীকৃত হলেও সমূহ আলোচনায় অন্তত তিনটি সাদৃশ্যসূত্র বর্তমান। প্রথমতঃ ,কবিগণ ভাবাদর্শে রবীন্দ্রোত্তর, দ্বিতীয়তঃ কালাদর্শে তাঁরা মহাযুদ্ধোত্তর এবং তৃতীয়তঃ তাঁদের আবির্ভাব আকস্মিক তো নয়ই বরং তাঁরা সমসাময়িক মহাপার্থিব বুধমণ্ডলের চেতনালোকস্নাত।
বক্ষ্যমান আলোচনা মূলত তৃতীয় লক্ষণটির এক বিশিষ্ট প্রকাশকে ঘিরে। সন্দেহ নেই, টমাস স্টার্নস এলিয়ট কোন বিচ্ছিন্ন নাম নয় ; গৌড়বঙ্গের আধুনিক কবিকুল যুদ্ধস্নাত মহাপার্থিব আধুনিকতার সার্থক প্রতিনিধি হিসেবেই তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিষ্ণু দে কথিত এই 'আলোকিত ধাক্কা'র পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়, পূর্বোক্ত অন্য দুটি লক্ষণও অনুপেক্ষনীয় নয়,কেননা যে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিবেশ বিশের কবিদের রবীন্দ্রভাবাশ্রয় থেকে উত্তরিত হবার প্রেরণা যুগিয়েছিল , সেই তাগিদেই তাঁদের পৌঁছে দিয়েছিল এলিয়ট ও আরো কারো কারো সমীপে। সুতরাং সর্বাগ্রে সংক্ষেপে সেই যুগ, সেই মহাপার্থিব আধুনিকতার চরিত্র ও রাবীন্দ্রিক প্রতিক্রিয়াটুকু জেনে নেওয়ার প্রয়োজন আছে । অতঃপর এলিয়ট এবং বাংলা কাব্যের সংযোগ সন্ধান।
১৯১২ সালে তৃতীয়বার য়ুরোপ ভ্রমণে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ টের পেয়েছিলেন এক আত্মিক সংকট। প্রত্যাবর্তনের পরও তাড়িত হয়েছিলেন কোন আশঙ্কায়। সেই আশঙ্কা অচিরাৎ ক্রুর সত্যে বিস্ফোরিত হয়। ১৯১৪য় বাধে প্রথম মহাসমর। আমরা জানি এ সংকট নেহাৎই 'আত্মিক' নয় , কিন্তু সামাজিক ভিত্তিকাঠামোয় বিলোড়ন উপরিস্তরেও ঝড় তোলে।সেই ঝড় ইউরোপীয় সাহিত্য চিত্রকলা দর্শন বিজ্ঞান কাব্য সর্বত্র চিহ্ন রেখে গেছে। এই শতকের প্রথম তেরোটি বছর নব্যশিল্পাদর্শের আত্মপ্রস্তুতির ও পরবর্তী দুটি দশক প্রসৃতির কাল। রবীন্দ্রনাথ ,স্বীয় ভাবালোক থেকে সুমেরুসুমাত্রা দূরবর্তী হলেও, আধুনিকতার এই প্রথম পর্বটিকে অনুধাবন এমনকি স্বীকরণও করেছিলেন কিয়দংশে কিন্তু যুদ্ধোত্তর আধুনিকতাকে, এটা ঐতিহাসিক সত্য -তিনি সহ্যই করতে পারেননি ।
অন্য-উপন্যাসের অন্যতম পাইওনিয়র ভার্জিনিয়া উলফ্ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এলিয়ট সম্পাদিত ক্রাইটেরিআন পত্রিকায় লিখেছিলেন , 'On or about December 1910 human character changed'।এই সুনির্দিষ্ট ঘোষণার পিছনে ছিল ১৯১০এর উপান্ত থেকে ১২ অবধি চলিষ্ণু গ্রাফটন গ্যালারিজের এক চিত্রপ্রদর্শনীর স্মৃতি। গথ, পিকাসো, মাতিস, সেজানের ইম্প্রেশানিস্ট শিল্পশোভিত এই প্রদর্শনী তৃপ্তিকর সমগ্রতার বদলে আপাত অর্থহীন খণ্ডাংশের মধ্য দিয়ে ছুঁতে চাইছিলেন ভিন্নতর এক বাস্তবতাকে।
রচনাটি অপ্রকাশিত; রচনাকালঃ আনুমানিক ১৯৯৫।
ঈশ্বরের রাজত্ব
“অন্য সব ভাবনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবো ঈশ্বরের রাজত্ব সম্পর্কে।ভাবো ঈশ্বর তোমার কাছে কী চান”।( ম্যাথু, ৬/৩৩ , বাইবেলের সুসমাচার )
কিন্তু আপনি কি কখনো ‘ঈশ্বরের রাজত্ব’ এই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছেন ?
সম্ভবত করেন নি। কারণ বিষয়টা আপনার কাছে অবাস্তব।কতকটা স্বপ্নরাজ্যের মত । আর স্বপ্ন নিয়ে কেই বা মাথা ঘামায়? কিন্তু ' ঈশ্বরের রাজত্ব' বাস্তব ব্যাপার কারণ ঈশ্বর সত্য। যতক্ষণ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরের সত্যতা উপলব্ধি করতে না পারে, তাঁর রাজত্ব বিষয়েও অনভিজ্ঞ থেকে যায়। প্রভু যীশু আপনাদের আহ্বান করেছেন ঈশ্বরের রাজত্বকে উপলব্ধি করার জন্য। পোশাক পরিচ্ছদ আর খানাপিনার তুচ্ছ গণ্ডির বাইরে গিয়ে, আপনার উচিত এখনই এই চিন্তাতে মগ্ন হওয়া।
“প্রভু যীশু ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং আমাদের প্রকৃত ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার পথ দেখিয়েছেন। আমরা ঈশ্বরপুত্র যীশুর সান্নিধ্য পাই বলেই ঈশ্বরের সঙ্গেও মিলিত হতে পারি।” (১, জন ৫/২৩ /বাইবেলের সুসমাচার )
যখন আপনি প্রভু যীশুকে বিশ্বাস করবেন, তখনই জগৎ-জীবনের যিনি উৎস- সেই ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন। সেই বিশ্বাস আপনার জীবনকে পরিশুদ্ধ করবে। যিনি স্রষ্টা, যিনি যীশুরও পিতা- সেই ঈশ্বরকে স্বর্গীয় পিতা হিসেবে বরণ করে নিতে পারবেন আপনিও।
“তিনি মানুষকে পাপমুক্ত করেন তিনি এবং তাঁর মত সব পুণ্যাত্মাদেরই পিতা সেই এক।”
যখনই ঈশ্বরপুত্রের ওপর বিশ্বাস রাখবেন, আদি পিতার সঙ্গে আপনি আপনাকে সংযুক্ত করবেন, তখন ‘ঈশ্বরের রাজত্ব’ হবে আপনারও। যীশুখ্রিস্টের ওপর বিশ্বাস আপনার জীবনকে নবীন করে তুলবে। আপনার নবজন্ম হবে।
‘ ঈশ্বরের রাজত্ব’ আগে আপনার চোখে একটা ছোট্ট সর্ষে দানার মতো অবান্তর এবং তুচ্ছ ব্যাপার ছিল, এখন তো আপনারই জীবনের মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে উঠবে।
‘ঈশ্বরের রাজত্ব’ বিষয়ে ধারণা- যা প্রাথমিক ভাবে আপনার কাছে ছিল অবাস্তব, কিছু কালের মধ্যেই তা আপনার জীবনকে এমন ভাবে পল্লবিত করে তুলবে যে অন্য যেকোনো বিষয়ের চাইতে এরক্ষেত্রে অনেক বেশি আগ্রহ বোধ করবেন। “ ঈশ্বরের রাজত্ব আর কথার কথা থাকবে না, হয়ে উঠবে এক অসামান্য শক্তির উৎস।”
এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে একজন ছিলেন সন্ত পল।তাঁর আধ্যাত্মিক আকুতি ছিল অসাধারণ।পুনর্জীবিত খ্রীষ্টের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, “প্রভু যীশুকে জানায় এক অমূল্য অভিজ্ঞতা।তাঁর কাছে আমি যা পেয়েছি, জীবনন্র,অন্য সব প্রাপ্তিকে তার বদলে জলাঞ্জলি দিতে পারি।”
ইহজীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে টিমোথি নামে এক তরুণকে সন্ত পল লিখেছিলেন, “জীবনযুদ্ধ শেষ হয়ে এল। এবার আমার বিশ্রাম নেবার পালা। স্বর্গে এক উজ্জ্বল মুকুট আমার জন্য অপেক্ষা করছে।যিনি আমাদের প্রভু। আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের বিচারক, প্রত্যাবর্তনের পর তিনি স্বয়ং তা পরিয়ে দেবেন আমার মাথায়। শুধু আমাকে নয়, যারা তাঁর প্রত্যাবর্তনের জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছে, তাদের সকলকেই তিনি ধন্য করবেন।”
অন্য এক উপলক্ষে প্রভু যীশু বলেছিলেন, “স্বর্গ এবং তার অধীশ্বর যেন জমিনে পড়ে থাকা এক রত্নভাণ্ডার। কোনো কোনো মানুষ তা আবিষ্কার করে। তখন সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সব কিছুর বিনিময়ে কিনে নিতে চায় ঐ জমিটুকু, যাতে রত্নভাণ্ডারটাও জিতে নেওয়া যায়।”(ম্যাথু, ১৩/৪৪)
সব কিছুর বিনিময়ে যে রত্নলাভ করতে হয়, যেমন করেছিলেন সন্ত পল, তাই হল ‘ঈশ্বরের রাজত্ব’। প্রভু যীশু আপনার হাতে সেই রত্ন তুলে দিতে আগ্রহী। আপনি কেন তা গ্রহণ করবেন না ?
“ ঈশ্বর দরিদ্রতমদের নির্বাচন করেছেন ধনী হয়ে উঠবার জন্য।সেই ধন হলো বিশ্বাস। যার ওপর স্বর্গ ও তার অধীশ্বর আসীন। যারা তাঁকে ভালোবাসে তাদের সকলকে সেই ধন দান করার জন্য তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
আসুন, একবার প্রার্থনা করুন, “হে প্রভু যীশু, আমি তোমাকে পরিত্রাতা হিসেবে গ্রহণ করছি। কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করছি তোমার দেওয়া অনন্ত জীবনের ধনকে। স্বীকার করছি ঈশ্বরের রাজত্বকে। তুমি আমার বিশ্বাসকে গ্রহণ করো”।
তারপর থেকে উপলব্ধি করতে থাকুন, কেমন করে বদলে যাচ্ছে আপনার জীবন।।
অপ্রকাশিত। রচনাকালঃ আনুমানিক ২০০০।
বন্ধুদের উদ্দেশ্যে দু'একটি কথা, যা বলা দরকার
কাগজের খবর, কোন এলাকার এক সাংসদ এক পুলিশ অফিসারের কান কামড়ে দিয়েছেন। কোনো দুর্ঘটনার ফলে জনরোষ ঠেকাতে দু’জনেই হাজির হয়েছিলেন। মতবিরোধ ঘটেছিল পরিস্থিতি সামলানোর তরিকা নিয়ে। একজন সাংসদ একজন কমান্ডিং অথারিটি। মতে মিলল না অতএব খ্যাঁক!
আমাদের ছেলেবেলার ইস্কুলে একজন বানান-খ্যাপা মাস্টারমশাই ছিলেন। ‘থামস্ আপ’ বানানে বি নেই বলে আর ‘কোয়ালিটি’ বানানে কিউ নেই বলে, কাউকে ঠাণ্ডা খেতে দেখলেই নিলডাউন করে দিতেন। একদিন, ঐ অবস্থাতেই, কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা ক’রেছিলাম, ‘স্যার,ওগুলো তো ব্র্যান্ড নেম। আমরা কী করবো’ ? উনি হুংকার দিয়েছিলেন, ‘স্টপ।আই এমপাওয়ার ইউ’। আশ্চর্য।পানিশমেন্টের মত এত সহজ ‘বাংলা’ থাকতে উনি ঐ গোলমেলে বাক্যটা কেন বলেছিলেন ? বলেছিলেন কারণ ‘পাওয়ার’ শব্দটা অনেকটা চিউইংগামের মত, চুষতে,বলতে,দেখতে, দেখাতে বেশ লাগে। যেমন লেগেছিল আগের প্যারায় বলা সাংসদ বা অফিসারটির। তা নিয়ে লড়াইও লেগেছিল। লড়াই লাগে, মানবসভ্যতা যবে থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তবে থেকে। হলিউডের ভাষায় এরে কয় ‘বেসিক ইন্সটিংক্ট’।
বেন্থাম নামক এক দার্শনিক একটা ছক বানিয়েছিলেন জেলখানার ম্যাপ, নাম প্যান-অপটিকন।একটা গোলবাড়ি, তাতে অজস্র খুপড়ি বা সেল।প্রত্যেকটির সামনে গরাদ। আর মধ্যিখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার।যার মধ্যে ছোটো ছোটো ফোঁকড়। তার ভেতরে বসে আছে অদৃশ্য রক্ষণীরা। উপরে একটা সার্চলাইট। সেটা যখন তখন যেকোনো দিকে ঘোরে। সেল-বন্দীরা তো জানবে না, কখন কার উপরে আলো এসে পড়ে, তাই তারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত হ’য়ে থাকবে। একে কী বলা যাবে? আলোকায়ন, রেনেসাঁস? আমাদের সংসারে, সমাজে, বিদ্যালয়ে এমন প্যানঅপটিকান, এমন দৃশ্য বা অদৃশ্য ক্ষমতার দম্ভ হরবখৎ দেখতে হয় আমাদের। কখনো তার কাছে নতিস্বীকার করি, কখনো ফুঁসে উঠি। কিন্তু কথাটা হল, কোনটা করব ?কোনটা ঠিক ? কখন করব, কখন নয়?
সবচেয়ে সহজ হলো, নিজের অন্দরে তাকানো। আমি কখন ক্ষমতার অপব্যবহার করছি আর কখন সৎব্যবহার করছি- সেটা নিজে বোঝাই তো আসল ব্যাপার। আমি কলেজে এসে মেফিস্টো হব না যীশাস সেটা নিজেকেই প্রশ্ন করো। প্রিন্সিপাল কড়া হবেন না নরম সেটা ওনাকেই বুঝতে দাও। কিন্তু কখনও পাওয়ার-চুইংগাম চুষোনা। ওই ব্যাধিটাই দুনিয়াকে ধ্বংসের দুয়ারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বারবার।
আমার প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য বলে শেষ করি এই ফালতু লেখা। উনি লিখেছিলেন, আমি আর কত ছোট হব? সরু হয়ে যাব ? মিনিবাসের কন্ডাকটরের ভাষায় আর কত পিছনের দিকে এগিয়ে যাবো? মোক্ষম লাইনটা হল, ‘আমি কি নিত্য আমারই সমান- সদরে, বাজারে, আড়ালে!’ এই ‘আমারই সমান হয়ে ওঠার পাঠটা যদি নিতে পারি, তাহলে আমার সঙ্গে আমার দেখা হয়। প্রশ্ন ওঠে, তুই কি কাল বোনের কান মুলে দিয়েছিস ? নাকি দিস নি !
অপ্রকাশিত। রচনাকালঃ আনুমানিক ২০০৬