প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
শিল্প শুধু ইতিহাস, মুহূর্তের তোরণে পাহারা
‘কাল্পনিক সংবদল’ নাটকের পাণ্ডুলিপিতে কোনও গান ছিল না। কিন্তু ঝুমুরদল থেকে সংগৃহীত ‘পূ্রূস ও মায়্যা কান’রা ছিলেন। নাটকের শুরুতে তারা ‘ভিন্য ভিন্য পোসাখেতে আর মখসের কাব্য করেন’। কাব্য মানে বিলেতি ও দেশি বাদ্যসহকারে বিদ্যাসুন্দরের গীত । লেবেদফ এই সংযোজন ঘটিয়েছিলেন আমজনতার রুচির কথা ভেবে। কিন্তু প্রাসাদমঞ্চে তো জনরুচির-পোষকতার দায় ছিল না। বেলগাছিয়া রাজারা যখন নাট্যকারের আপত্তি সত্ত্বেও, ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে ছ’টি অপ্রাসঙ্গিক গান সংযোজন করেন তখন বোঝা যায়, গীতসুধার তরে রাজা প্রজা নির্বিশেষে বাঙালীর চিত্ত পিপাসিত ছিল। ন্যাশানাল থিয়েটারের বর্ষপূর্তিতে মনোমোহন বসু ভাষণ দেন, পুরোন যাত্রা থেকে বাংলা থিয়েটারকে যে সব উপাদান আত্মসাৎ করতেই হবে, সংগীত তার মধ্যে প্রধান। এ আমাদের জাতীয় প্রবণতা।
বিশ শতাব্দীর প্রথম দশক জুড়ে নানা পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে গিরিশচন্দ্র এই চিন্তাকে আরও প্রসারিত করেছিলেন। সমসাময়িক ইংরেজি থিয়েটারের অনুসরণে ‘সভ্য নিয়মে বাধ্য থেকে সভ্য কথা’ না ব’লে, পৌঁছতে চাইছিলেন যাত্রা, পাঁচালী, কৃষ্ণলীলার গীতিমধুর অঙ্গনে। গিরিশের নাট্যে কথা, কাব্য আর গানের এক আশ্চর্য চলাচল দেখতে পাচ্ছিল মানুষ। তারপর আসবে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলি। পথ উঠে আসবে মঞ্চে। আর সেই পথ দিয়ে যাবতীয় অচলায়তনকে ভাঙতে ভাঙতে ব’য়ে যাবে গান। লোকজগতের ভাষা হ’য়ে উঠবে সংগীতসমৃদ্ধ নয়, সাঙ্গীতিক। অথচ শিশিরকুমারের চেষ্টা সত্ত্বেও, সর্বসাধারণের কাছে তা পৌঁছবে না। সেগুলির অভিনয়-যোগ্যতা নিয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়বেন অনেকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘বিদেশি নাটেশ্বরে’র তর্জনী-ভীত ‘ইংরেজি পোড়ো’রা। থিয়েটারে কাব্য ও সংগীতময়তার প্রচলন এবং পরিদৃশ্যমান বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান সহজে মেনে নিতে পারবেন না।
তাহলে তিনটে ধারা দেখতে পাচ্ছি আমরা। এক, নাট্যে জনরুচির তাগিদে সংগীত সংযোজন। দুই, বাস্তবতার তাগিদে গীতবর্জন এবং তিন, বাস্তবতার গভীরতর স্তরকে আবিষ্কারের তাগিদে গদ্য-পদ্য-গীতে স্পন্দমান এক ঐতিহ্যমণ্ডিত নাট্যভাষার খোঁজে। শম্ভু মিত্র, আমরা সবাই জানি, তৃতীয় মার্গের অভিযাত্রী ছিলেন। “অভিনেতার পক্ষে কবিতার কণামাত্র বিসর্জন না দিয়ে, একটুও কৃ্ত্রিম না হয়েও যে সবাক ও আবেগময় হওয়া সম্ভব” তা তিনি সারাজীবন প্রমাণ করেছেন। কিন্তু ‘বাংলা মঞ্চ ও অভিনয়ের বিবর্তনরেখা’ প্রবন্ধটি প’ড়ে, একটু বিস্মিত হয়েই আবিষ্কার করি, গিরিশের সঙ্গীত-নিরীক্ষাকে তিনি আমলই দিচ্ছেন না। বাংলা মঞ্চের মূল ধারার উপর গীতিনাট্যের প্রভাবকে অস্বীকার করছেন। বলছেন, শিশিরবাবুর আমল থেকে যে নাট্যে গানের ব্যবহার কমে এল তার কারণ সেটা ছিল সংগীত নয়, সংঘাতের যুগ। সংগীত যে কত সংঘাতময় হতে পারে, তিনিই তা আবিষ্কার করেছিলেন ‘রক্তকরবী’তে! কিন্তু খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ‘জীয়নকন্যা’ করেন নি বা করতে পারেন নি। অপ্রযোজিত থেকেছে ‘চাঁদ বণিকের পালা’। শম্ভু মিত্রের সমগ্র নাট্যকর্মের দিকে তাকালে মনে হয়, নাটকে গানের বদলে তিনি বেশি পছন্দ করতেন এমন নাটক যা নিজেই একটা গান। যেমন, ‘ছেঁড়া তার’ বা ‘রাজা অয়দিপাউস’।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যাবলীর অনেকগুলিতে গান নেই বা প্রায় নেই, অনেকগুলোতে আছে। তার মধ্যে কিছু গান লোকশ্রুতিতে স্মরণীয় হয়েছে। আবার কোনও নাটক লোকে বিস্মৃত হলেও তার গান ভোলেন নি। কোনও নাটককে মনে রেখেছেন তাতে কথায় সুরে মিলে এক অখণ্ড নাট্যভাষা সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে। কথাটা আবার উঠে পড়ল নান্দীকারে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ প্রযোজিত হওয়ার পর। এ নাট্য নিরাভরণ মঞ্চক্ষেত্রটি অনবরত বদলে যেতে থাকে একজন মাত্র কথকের কন্ঠ ও শরীর আশ্রয় ক’রে। গীত বাদ্যসহ উৎসারিত হয় সমগ্র কাব্যটি। কথকতা ও গীতের মিলন রেখাগুলি প্রচ্ছন্ন রয়ে যায়। শঙ্খ ঘোষ একে চিহ্নিত করেন ‘সঞ্চারমানতা’ রূপে। আমরা অনুভব করি সমকালীন বাক্ বিধির সঙ্গেও এক রকমের সাযুজ্য রক্ষা ক’রে চলা যাচ্ছে। মাইকেল আবিষ্কৃত হচ্ছেন ‘এই মুহূর্ত, প্রতি মুহূর্তে’। শঙ্খ মতে, এ ছিল নান্দীকারের ‘ঘরে ফেরা’র পালা।
‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’র প্রস্তাবনায় রুদ্রপ্রসাদ সবিনয়ে বলতেন, নান্দীকার যখন বিদেশী নাটক করেছে, তখন সেটা পরের জিনিস ব’লে ভাবে নি। বরং দেশে দেশে যে আমাদের ঘর আছে, সেইটা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল। কথাটা অনুধাবন করা যাবে একটু পিছিয়ে গেলে। ১৯৬৯ সালে রূপান্তরিত হয় ‘থ্রি পেনি অপরা’। যে নাটকে ব্রেষ্ট লিখেছেন, প্রথম খুঁজে পাওয়া গেছিল এপিক থিয়েটারে সংগীত প্রয়োগের সঠিক রাস্তা। রাস্তাটা হল, নাটকের অন্য সব প্রমোদোপকরণ থেকে সংগীতকে একবারে আলাদা ক’রে ফেলা। ‘তিন পয়সার’র গান রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সমালোচকরা অভিযোগ করেন, মূলের অনেক গান কাব্য বা কাব্যময় গদ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। গানে ও নাটকে ব্রেষ্ট কথিত ‘Separation’ তৈরী হয় নি। অনেক দিন পর ‘নাট্যচিন্তা’ পত্রিকায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এর জবাব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে রীতি তত্ত্বের তাগিদে নিজস্ব কনভেনশনের বাইরে গিয়ে নাটকের রসহানি ঘটানো কোনও কাজের কথা নয়। বরং “ব্রেখটকে ব্রেখটীয় রীতিতে বেঁধে আমরা অন্যতর ব্রেখটের জন্য অপেক্ষা করব”। ‘তিন পয়সার পালা’ আদৌ ব্রেষটীয় ছিল কি না সে তর্ক আপাতত নিষ্প্রয়োজন। প্রয়োজন শুধু কনভেনশন শব্দটা লক্ষ্য করা। কথা, কাব্য আর গানে অবিচ্ছিনতার কনভেনশন।
১৯৭৭ এ এল ‘ফুটবল’। কলকাতার নাটক, স্বপ্নমুগ্ধ তারুণ্যের নাটক। যে দর্শকরা রঙ্গমঞ্চে সমকালীন বাংলাদেশকে প্রবলভাবে চিনতে পেরেছিলেন, তারা কেউ পিটার টার্সানকে চিনতেন না। কিন্তু ‘ফুটবল’ নাটকের আঙ্গিকও নিজস্ব বলে মনে হয়েছিল তাদের। সমালোচক, অসমালোচক সকলেই দিব্যি আস্বাদ করেছিলেন, চলতি বুলি এমনকি স্ল্যাং-এর মধ্যেই কীভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে নৃত্যছন্দ। ছন্দোবদ্ধ কিছু পদ, অথবা স্রেফ ধ্বনি, আবর্তিত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে গানে। পুরো গান নয়, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কলি। যার মধ্যে রণিত হচ্ছে কীর্তন, দেশাত্মবোধক, আধুনিক, ফিল্ম সং – যা কিছু আছে আমাদের সংস্কার আর দিনযাপনে। তারএ প্রায় একযুগ পর, প্রযোজিত হয় ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’। সেখানে নাকি, অনেকে বলেন, নান্দীকার ব্রেষট-এর প্রতি সব চাইতে নিষ্ঠাবান ছিল। একটি দৃশ্যে, স্বাতীলেখা যখন সম্মুখ মঞ্চে দাঁড়িয়ে গর্ভস্থ সন্তানকে অভ্যর্থনা জানাতেন, নৃত্য ভঙ্গিমা, সংলাপ, আবৃত্তি আর মার্চিং ব্যান্ড থেকে রাগসংগীতের লয়কারি- সব মিলে মিশে এমন একটা সমন্বিত চেহারা পেত, যাকে বলে নাট্য। সেটা বিদেশের আমদানি নয়, দেশীয় যাত্রাও নয়। কথকতা নয়, আবার উক্তি-প্রত্যুক্তিও নয়। আমাদের বিনীত ধারণা, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আরম্ভের আরম্ভ লুকিয়ে ছিল এইসব প্রচেষ্টার মধ্যে।
ঐতিহ্য কোনও স্থানু ব্যাপার নয়। এলিয়টকে ধার ক’রে বলা যায়, শিল্পী যদি কেবল আপন প্রজন্মের মধ্যে না বেঁচে, হাড়ের ভিতর সঞ্চিত রাখতে পারেন বিশ্বের কালাতিক্রমী শিল্প-অভিজ্ঞতাগুলি এবং সেই পটে দেখতে পান স্বদেশের মুখ, যদি কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন অতীতের অতীতত্ব শুধু নয়, তার সাম্প্রতিকতাকে, তবেই তাকে বলা যাবে ঐতিহ্যবান। তখন এই ‘Time-flux’- এর চেতনা উপলব্ধ হবে বিষয়ের সন্নিধি ও রচনার সংস্থানে। শিল্পের ধর্ম হয়ে উঠবে ‘Melopeia, phanopeia, logopeia’ – এককথায় মন্ত্র, গীত ও কথার উৎসার। কিন্তু আজকের জটিলতর কালে, আকাশচারী, অনৈতিহাসিক, শিকড়হীন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত নবপ্রজন্মের কাছে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যাবে সেই উচ্চারণ? যদি যায়ও, তা কি অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারবে জড়মানসে? নান্দীকারের পাঠচক্রে, মহলায়, আলাপচারিতায় এ প্রশ্নটা দেখা দিত নানা বেশে। ব্রেষট আর রবীন্দ্রনাথ, ব্রুক আর ভরতমুনি , বিষ্ণু দে আর সিগারকে সাক্ষী মানা হত একই সঙ্গে। কেউ গদ্য পড়লে পদ্য আওড়াতেন অন্যজন, আর একজন তাতে সুর লাগিয়ে দিতেন তন্মুহূর্তে। তালটা কানে গেলেই পা নেচে উঠত কারও। এরকমই উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘ব্রেষটের খোঁজে’। তারপর ‘এই শহর, এই সময়’, আরও একটু সচেতন তাগিদে। যদিও স্বদেশে-বিদেশে অনেকগুলি অভিনয় করা গেছে ইতিমধ্যে, একযোগে আকর্ষণ করা গেছে দীক্ষিত ও অদীক্ষিত সবধরণের দর্শককেই, তবু বলা বাহুল্য, প্রশ্নের উত্তর মেলে নি। বরং প্রতিপ্রশ্ন উঠেছে অসংখ্য। আমাদের খোঁজ এখনও জারি আছে।
অপ্রকাশিত রচনা। আনুমানিক রচনাকালঃ ২০০৩