স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ বছর : কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র-সংস্কৃতি
—একটি সমীক্ষাভিত্তিক প্রতিবেদন
অংশ আর সমগ্র
কবি জেলে যাবার সময় সঙ্গে ছিল একটা পেনসিল। লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হপ্তাও লাগেনি। মাত্র সাতটা দিন। কিন্তু পেনসিলকে জিজ্ঞাসা কর, সে বলবে একটা গােটা জীবন। নাজিম হিকমত লিখেছেন, তিনি জেলে আসার পর সূর্যকে গুণে গুণে দশ বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। কেটে গেছে দশ দশটা বছর। অথচ সূর্যের বিপুল আয়ুষ্কালের কাছে তা কিছুই না।
কৃষ্ণনাথ কলেজে আমাদের যে তরুণ বেলাটা কেটেছে, প্রবীণ মাস্টারমশাইয়ের চোখে তা তাে পাঁচটা বছর মাত্র। কিন্তু কলেজের ঘড়িঘরকে জিজ্ঞাসা করলে বলবে, কিছুই না। অনেক তারুণ্যকে, এমনকী অনেক তেত্রিশ বছরের কর্মজীবনকেও সে বয়ে যেতে দেখেছে। |
এখন কথা হল, আমরা কি গােটাটা দেখতে চাই, না খণ্ডগুলােকে?
ধরা যাক, উনিশ-শাে সাতচল্লিশ থেকে ছিয়ানব্বই, এই যে পঞ্চাশটা বছর– কালের মন্দিরায় কত না ধ্বনি প্রতিধ্বনি! কত আজাদির স্বপ্ন আর ঝুটা আজাদির স্লোগান। যুক্তফ্রন্ট থেকে বামফ্রন্ট। বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লব। ডাইরেক্ট অ্যাকশান থেকে অপারেশন বাবরি। ‘আ মরি বাংলা ভাষা’থেকে ‘দিল মাঙ্গে মাের’। হাম্পটি ডাম্পটিদের পাঁচিলে চড়া আর পতন। জরুরি অবস্থা আর তার সমাগত রজতজয়ন্তী। ঢেউএর পরে ঢেউ-এ তরঙ্গিত বাংলা। তারই এক স্পর্শকাতর জেলা মুর্শিদাবাদ। জেলার সারস্বতচর্চার অন্যতম ঠিকানা কৃষ্ণনাথ কলেজ। এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী হর্ম্য, সততসঞ্চরমান ভাগীরথী তীরে সােপানরাজি। অনুমান করা যায়, আলােচ্য কালপর্বের পরিবর্তমান সংস্কৃতিকে, তার সুর ও বেসুরগুলােকে ধারণ করেছে এই বিদ্যায়তন এবং তা বিকিরণ করেছে। অথবা, কলেজের বিশেষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে জারিত করে বিকিরণ করেছে। সত্যিই করেছে তাে? না করলে কেন করেনি, করলে কী রূপে করেছে?
এইভাবে, আমাদের মনে হয়েছিল, বৃহত্তর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কলেজের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের তত্ত্বতালাশ করার জন্য একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করা যেতে পারে। গত অর্ধশতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে যাঁরা কলেজের ছাত্র ছিলেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমকালীন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্রমণ্ডলীর মননজগৎ বিষয়ে বেশ কিছু মতামত সংগৃহীত হতে পারে। তার পর সেগুলােকে প্রণালীবদ্ধ করলেই বেরিয়ে আসবে কলেজীয় সংস্কৃতির দশকওয়ারি অভিজ্ঞান। কিন্তু সত্যিই আসবে কি? পরিসংখ্যান কি আদৌ ছুঁতে পারবে মানুষের মুখ? হয়তাে পারবে, যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয় ছাত্রদের মন্ময় বিবেচনাকে। যদি প্রশ্ন হয় পুঙ্খানুপুঙ্খ। উত্তরদাতাদের সুযােগ থাকে একাধিক বিকল্প উত্তর থেকে বেছে নেওয়ার অথবা নিজস্ব মতামত জানানাের।
সেই অনুসারেই এগিয়ে ছিলাম আমরা। পৌছনাে গেছিল মােট ৩০৯ জন উত্তরদাতাদের কাছে। তাঁরা মতামত জানিয়েছেন বিস্তারিতভাবে। অনেকেই নিজের বক্তব্যের সমর্থনে আলাদা তথ্য দিয়েছেন। ফলে সহজ হয়েছে ব্যষ্টি বিষয়ে ব্যক্তির মতকে গুরুত্ব দেওয়া।
উপাদান ও কালপর্ব
গােপাল হালদার লিখেছিলেন, বাঙালির কালচার’ মানে ১৭৫৭ উত্তর মধ্যবিত্ত কালচার। তার চরিত্র নাগরিক, বৃহত্তর বাংলা, বিশেষত কৃষিনির্ভর গ্রাম-বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন, সমাজ-অর্থনীতি বিষয়ে নিজ স্বার্থের বাইরে উদাসীন, উৎকেন্দ্রিক এবং হিন্দুভাবাপন্ন। (সংস্কৃতির রূপান্তর/ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি/ ১৩৬৫)।
রবীন্দ্রনাথ এই 'কালচার’এর বিপদ সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। কায়মনােবাক্যে চাইতেন। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্ররা যেন ভিন্ন এক সংস্কৃতি’র চাষ করতে শেখে মানবজমিনে। ধীরেন্দ্রমােহন সেনকে ১৯৩৫ সালের ১৫ই জুলাই একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, যে-শিক্ষা-ব্যবস্থা ছাত্রসমাজের চিত্তের ঐশ্বর্যকে অবজ্ঞা করে কেবল জীবনযাত্রা ও বিত্তের সিদ্ধিকেই গুরুত্ব দেয় তা ভ্রান্ত। ওই চিঠিতে তিনি ছাত্র-সংস্কৃতির কয়েকটি প্রতিমান ও আদর্শ নিয়েও কথা বলেছেন। কতকটা তদনুসারে আমরা প্রশ্নপত্রটিকে বিষয়ানুসারে বিন্যস্ত করে নিয়েছিলাম। জানতে চাওয়া হয়েছিল— শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্ভাবনা কতটুকু ছিল। কতখানি ছিল লিঙ্গবৈষম্যের মাত্রা। কেমন ছিল বিদ্যার্জনের পরিবেশ ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ও নানা সামাজিক ইস্যুতে কী ছিল তাদের ভূমিকা। কেমন ছিল ছাত্র সমাজের প্রাত্যহিক অভ্যাস ও আচরণ। প্রতিটি বিষয়েই ছিল একগুচ্ছ উপপ্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নের সুযােগ।
ছাত্র-সংস্কৃতির উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করার পর প্রয়ােজন হয়ে পড়ে অর্ধশতাব্দী কালকে কয়েকটি সময়পর্বে বিন্যস্ত করে নেওয়ার। Changing India ( Cambridge University Press/ first Indian edition 1993) বইতে রবার্ট স্টার্ন স্বাধীনতা-উত্তর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রজন্মের কথা বলেছেন। সংগৃহীত উত্তরপত্রগুলাে পাঁচটি সময়পর্বে ভাগ করার ক্ষেত্রে এই আলােচনা আমাদের সাহায্য করেছে। প্রথম পর্ব, যাঁদের ছাত্রবেলা কাটছে প্রাক্ স্বাধীনতা আমলে। এঁদের আমরা বলতে পারি স্বপ্নদর্শী প্রজন্ম। ঠিক তার পরেই আসবেন ১৯৪৮ থেকে '৫৮র দ্বিতীয় পর্বভুক্ত প্রাক্তন-প্রাক্তনীরা, যারা সদ্যস্বাধীন দেশের বিভ্রান্ত ও ভগ্নস্বপ্ন নাগরিক। নেহেরু মিশ্র অর্থনীতির তত্ত্ব আউড়ে বড়াে বাঁধ, বড়াে শিল্প, বিরাট সংবিধান, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে বড়দার অবস্থান নিয়েও চিড়ে ভেজাতে পারেননি। কারণ দেশটা আরও বড়াে ও বিচিত্র। কোটি টন গম আমদানি করেও স্থায়ী খাদ্যাভাব দূর হচ্ছে না তখনও। পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে চলছে উদ্বাস্তুদের লড়াই। বাংলার ক্যাম্পে ক্যাম্পে অন্তত পঁয়ত্রিশ লক্ষ বেওয়ারিশ মানুষ। চল্লিশের গােড়ায় যেসব শিল্প-আন্দোলন দানা বেধেছিল, এখন তাতে ব্যক্তিক উৎকর্ষ যত বাড়ছে, যুথবদ্ধতা কমছে।
তৃতীয় পর্বে আসবেন ১৯৫৯ থেকে '৬৯ সালের পড়ুয়ারা। মনে রাখা ভালাে, ১৯৫২তে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের দীর্ঘস্থায়ী একছত্র শাসন সূচিত হয়েছিল। সূচিত হয়েছিল ল্যান্ড রিফর্ম লেজিসলেশন, যার ফলশ্রুতিতে পরের দশ বছর জুড়ে উখিত হয়েছেন ভূমিনির্ভর মধ্যবিত্তরা। অন্যদিকে তীব্র হয়েছে বামপন্থার আহ্বান। ১৯৬৭ সালে এসেছিল তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লব’ এবং চতুর্থ নির্বাচনে বিপর্যস্ত হয়ে গেছিল কংগ্রেস দল। কোনাে একাধিপত্যকেই মানুষ আর মানতে চাইছে না তখন। বিশ্বজুড়ে চলছে ছাত্রযুব আন্দোলন। এদেশেও প্রথমে বাংলা তার পর অন্ধ্র, কেরল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল নকশালবাড়ির ডাক।
আমাদের উত্তরদাতাদের চতুর্থ পর্বে যারা আছেন তারা ১৯৭০ থেকে '৮০ এই দুই দশকের ছাত্রছাত্রী ছিলেন। এদের চোখের সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ভােট দিয়েছিলেন মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু '৭৭এর পরে ক্রমে বামপন্থীদের কার্যক্রম ও চরিত্রে গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটল। বিপ্লবী সংস্কৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিকতা দ্রুত এগােল একধরনের বােঝাবুঝির দিকে। পরের দশকে আবিৰ্ভূত হল এমন এক প্রজন্ম যারা ইতিহাস বিষয়ে অসচেতন।
১৯৮১ থেকে '৯৬ হল পঞ্চম পর্ব। এই পর্বেই রামজন্মভূমি বিতর্কের, তথা হিন্দু লহরের শুরু। ১৯৮৫তে প্রথম শােনা গেল লিবারালাইজেশনের সুর। ধূয়া উঠল লাইসেন্স পারমিট রাজের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষের মধ্যে দ্রুত গজিয়ে উঠল 'ইন্ডিয়া'। রাজনীতির অবমানবায়ন, দুবৃত্তায়ন আর সীমাহীন সামাজিক দুর্নীতি গা সওয়া হয়ে এসেছে ততদিনে। এমনকী এসবই গণ্য হচ্ছে স্বাভাবিক বলে।
দৃষ্টিভঙ্গি
‘দ্য নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র ষোড়শ ভলিউমে, ১৮৭১ সালে লেখা ব্রুনেট টেইলরের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। টেইলরের মতে, সংস্কৃতি হল মানুষের "জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবােধ, আইন, আচার-আচরণ, ক্ষমতা ও অভ্যাসসমূহের সমাহার, যা সে অর্জন করে মানব সমাজের সদস্য হিসেবে।"
এর পাশে রাখা যেতে পারে শতাধিক বছর পরেকার দুটি ছাত্রপাঠ্য সংজ্ঞাকে। দু-টিই প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৩-তে। ইউরােপীয় চিন্তাবিদরা মনে করেছেন, “প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত, মানবিক বােধ, অর্থ ও চৈতন্যের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়াই হল সংস্কৃতি"। অন্যদিকে সােভিয়েত ব্লকের দাবি হল, “সংস্কৃতি মানে, সমাজ দ্বারা সৃষ্ট যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত মূল্যবােধের প্রবাহ”। (দ্রষ্টব্য, Key Concepts of communication/ Gen. Editor: John Fishke/ Methuen, London & New york. এবং Dictionary of Philosophy/ Editor: I. Frolov/ Progress Publisher, Moscow)
লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, প্রথম সংজ্ঞায় cultural configuration এর ক্ষেত্রে 'মানুষ’ ও ‘মানবসমাজ’ দু-টি বিষয়কেই পারস্পরিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরেরটিতে কিন্তু সমাজ শব্দটাই অনুপস্থিত। আর শেষেরটিতে, বিপরীতভাবে, মানুষ নয়, একমাত্র সমাজকেই দেওয়া হয়েছে উৎসের মর্যাদা। এক-শাে বছরের মধ্যে সংস্কৃতি-চিন্তায় এই দুটি মেরুকরণ ঘটে গিয়েছিল প্রধানত মার্কসবাদের যান্ত্রিক অপব্যাখ্যার দরুন। বেস ও সুপারস্ট্রাকচারের মধ্যে প্রথমটিকে অহেতুক প্রাধান্য দেওয়ার অথবা একেবারেই না দেবার ঝোঁকে।
সমাজবাস্তবতা যে আমাদের চৈতন্যকে ‘Determine' করে – এখানে ‘ডিটারমিনেশন’ কথার অর্থ কী? Problems of Materialism and culture (Verso/ London-New York/ 1989) বইতে রেমন্ড উইলিয়ামস এ নিয়ে চমৎকার আলােচনা করেছেন। তার মতে, ইংরেজি শব্দটি উঠে এসেছে আইডিয়ালিস্ট ও থিয়ােলজিকাল মননভূমি থেকে। বিশ্বজগৎ যেখানে প্রকাশিত হয় প্রাক্ নির্ধারিত সুনিরূপিত এবং নিয়ন্ত্রিত উপায়ে। মার্কস ব্যবহৃত bestimmen শব্দে কিন্তু এই নির্ধারণবাদ একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। বরং এর মধ্যে দিয়ে, “He is opposing an ideology that had been insistent on the power of certain forces outside man, or, in its secular version, on an abstract determining consciousness"। কাজেই, সংস্কৃতির প্রবাহকে বুঝে নেওয়ার জন্য আমরা কয়েকটি সামাজিক সংঘাত, বিশেষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সময়ের কতগুলাে মাইল ফলকের কথা উল্লেখ করেছি বটে, কিন্তু, এই রীতির সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের পূর্বানুমান আর ফলাফল তাই সর্বদা মাপসই হবে না, সেটা অসম্ভব।
যে উত্তরদাতার কাছে আমরা পৌঁছতে পেরেছিলাম, তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম মানুষটি কলেজে ঢুকেছেন ১৯৪১-এ, সর্বকনিষ্ঠজন '৯৯-এ। অর্থনৈতিকভাবে সকলেই মধ্যবিত্ত। মাত্র চারজন ছাড়া সকলেই স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর স্তর অবধি পড়েছেন। প্রশ্নগুলাের মধ্যে তাঁদের সময়ের ছাত্রসংস্কৃতি বিষয়ে নিজস্ব পর্যবেক্ষণপ্রসূত বা অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য ও ধারণা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কোনাে তথ্যই যেহেতু নৈর্ব্যক্তিক হয় না, তাই যে ব্যক্তিমন তা প্রকাশ করছে তাকেও আমরা যাচাই করে নিতে চেয়েছিলাম। উপরন্তু দেখতে চেয়েছিলাম, সেই মনগুলাের উপর কলেজীয় পরিমণ্ডলের কোনাে বিশেষ প্রভাব পড়ছে কি না।
পণ্ডিতেরা বহকাল পর্যন্ত ক্ষমতাবৃত্তের সন্নিহিত এলিট সংস্কৃতিকেই উচ্চাঙ্গের ও আধুনিক বলে মনে করতেন। লােকসংস্কৃতিকে রাখতেন প্রান্তিক ক্ষেত্রে আর সর্বগ্রাসী জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে দেখতেন নীচু নজরে। ইদানীং এহেন বিভাজনের গােড়ায় গলদ নিয়ে আলােচনা হচ্ছে। নথিভুক্ত হচ্ছে তথাকথিত উচ্চ সংস্কৃতির হেজিমনির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের প্রতিবাদ এবং মধ্যবিত্তের সুবিধেবাদী সাংস্কৃতিক অবস্থান। এ-বিষয়ে অবহিত হলেও, এই সমীক্ষায় আমরা যেহেতু মধ্যবিত্ত দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করছি, তাই প্রথাগত উচ্চ-নীচ ভেদ এখানে স্বীকৃত হল। বিশেষ ক্ষেত্রে উল্লেখিত হল এহেন মূল্যায়নের আলাদা তাৎপর্য।
এটি ছিল,পারিভাষিক বিচারে একটি রান্ডম স্যাম্পেল সার্ভে, যা ‘রেয়ারি ফ্যাকটেড' মতামতকে গ্রাহ্য করছে। অর্থাৎ আমরা পাচ্ছি ঘটনার মধ্যে আছেন এমন নয় বরং ঘটনা পার হয়ে এসেছেন এবং সেই ঘটনাবলি বিষয়ে তার বর্তমান ধারণা পেশ করছেন এমন উত্তরদাতাদের। তাদের উত্তরের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্যাবলি, নিজস্ব মতামত ও মূল্যায়ন-সহ পেশ করা হয়েছে এই নিবন্ধটিতে। বলা বাহুল্য, তথ্যের দায় উত্তরদাতাদের, মূল্যায়নের দায় আমাদের, তা গ্রহণ করার বা অংশত গ্রহণ করার দায় পাঠকের।
ফলাফল
কৃষ্ণনাথ কলেজের পরিবেশ কি সাম্প্রদায়িক ছিল?
পঞ্চাশ বছরের ১০০% উত্তরদাতা বলছেন, না। এজন্য মূল কৃতিত্ব কার? ৭৬% মনে করেন, কলেজের ঐতিহ্যই এজন্য দায়ী। দেখা যাচ্ছে, এই ঐতিহ্য সত্ত্বেও গােড়ার দিকে রক্ষণশীলতা ছিল ভালােরকম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে লেগেছে।
মুর্শিদাবাদ মুসলমানপ্রধান জেলা। গ্রাম- গ্রামান্তরের বহু খানদান পরিবারের ছেলেরা কলেজে পড়তে আসত। দেশভাগের অব্যবহিত আগে পরে শরণাগত হিন্দুদের অনেকেই ভরতি হয়। প্রথম পর্বের উত্তরদাতাদের মতে, এরা বহন করত নিজস্ব ধর্মীয় পরিচয়। কিন্তু তারা ছিল মেধাবী ও পরমতসহিষ্ণু। আজাদ হিন্দ-এর স্বপ্ন-আলােড়িত। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস কিংবা দাঙ্গায় অনুত্তেজিত।
শেষ পর্বের পড়ুয়ারাও বলেছে, ইন্দিরা হত্যা, বাবরি ধ্বংস, কাটরায় নমাজ ইত্যাদি ইস্যুতে ছাত্ররা সংঘবদ্ধ ছিল। কিন্তু, বহমান সুচেতনা সত্ত্বেও এ-পর্বের প্রায় ৫% পড়ুয়া কেন আচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতায় ?
কারণ, “দক্ষিণ-বাম নির্বিশেষে ছাত্র রাজনীতির পাণ্ডারা একবিংশ শতকের শেষেও, ইলেকশনে প্রয়ােজন হলেই খেলত সাম্প্রদায়িক তাস”। একজন আরও স্পষ্ট জানাচ্ছেন, “ঘাঁটি ছিল ছাত্রাবাসগুলি। কুমার হােস্টেল, মেন হােস্টেল, রাজা মিয়া চৌধুরী মেসে চলত বিদ্বেষ প্রচার”।
এ প্রসঙ্গে ১৯৮৯এর কলেজ পত্রিকায় প্রকাশিত সৌম্যেন্দ্রকুমার গুপ্তের একটি সমীক্ষা স্মরণীয়।