প্রকাশিত, নতুন বই, 'নিঃসঙ্গ সম্রাট ও অন্যান্য নাটক'।
কেন সত্যজিৎ রায়
শিল্পস্তুতিতে এক অভিনব অভিজ্ঞান আছে, … ‘আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি’- শিল্পসমূহ হল আত্মার সংস্কৃতি। ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণ নিয়ে যতই বিতর্ক থাক এ কথা অনস্বীকার্য যে, সেকালীন অগ্রজরা শিল্পসাহিত্যে এই আত্মসংস্কারের প্রক্রিয়াটির সন্ধান করেছিলেন। জীবন – বচন – বিশ্বাস ও কর্মে সামঞ্জস্য বিধান করতে চেয়েছিলেন।
আজকের শিল্পীদের মধ্যে এই লক্ষণ ভয়াবহরূপে অনুপস্থিত। গণনাট্যের উত্তাপ বা বসন্তের নির্ঘোষে যারা জন্ম নিয়েছিলেন তাদের ঔজ্জ্বল্য কমে আসছে। অনেকেই ম্রিয়মান, আপোষমুখী বা অসৃষ্টিক্ষম। ভোগের ঝড় আছড়ে পড়েছে সমাজ তথা শিল্প ক্ষেত্রেও।
এই উদ্ভ্রান্ত সময়েও শিল্পস্তুতির অভিজ্ঞানকে ধারণ করেছিলেন এক দীর্ঘদেহ মানুষ – এই সেদিন অবধি। সত্যজিৎ রায় নেই, এই শূন্যতা সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কবিকে খুঁজতে হবে জীবনচরিতে নয়, তার সৃষ্টিতে। তা সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায়ের জীবনবৃত্তের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় চিহ্নিত করা যেতে পারে।
ক) পিতৃকুল তাঁর জন্য রেখেছিলেন এক মহান শৈল্পিক উত্তরাধিকার কিন্তু সোনার চামচ রেখে যান নি। এক বৃহৎ আত্মীয় পরিবারের আশ্রিত হিসেবে বিধবা মায়ের সঙ্গে কেটেছে সত্যজিতের শৈশব কৈশোর। প্রেসকর্মী রামদহিন, রাঁধুনীর ছেলে হরেন শ্যামা ঝি-র পুত্র ছেদি – এরা ছিল বন্ধুবান্ধব। তাঁর স্কুলের বন্ধুরাও তথা কথিত ‘ভালো ছেলে’ নয়। কেউ মিচকে, কেউ ডানপিটে, কেউ ফাঁকিবাজ। চালিয়াৎ বড়োলোক পুত্র অনিলের রোলারস্কেট বা ইয়োইয়োর চাইতে ডাংগুলি – ঘুড়ি – লাট্টু ছিল অনেক আকর্ষণীয়। আত্মীয়দের মধ্যে যাদের সঙ্গ ভালো লাগতো তারা সচরাচর অবৈষয়িক, অসফল কিন্তু কোনও না কোনও বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। কেউ রুদ্র স্বভাব পুব বাংলার বেকার, কেউ আধাসন্ন্যাসী, কেউ যুযুৎসুপ্রিয়। এই বিচিত্র পরিবেশ ও নির্জন বাড়ির এঘর ওঘর – রোদ্দুর অন্ধকার – ফেরিওয়ালার হাঁক মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল বালকের সংবেদনশীলতা, তীব্র পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সাধারণের মধ্যে অসাধারণকে খুঁজে নেওয়ার চোখ।
খ) প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হয়েও তিনি স্কলার হন নি। সুপ্রভা প্রার্থনা করতেন ‘মানিক ভ্যাগাবন্ড না হয়ে অন্তত গ্রাজুয়েটটা হোক’। যুবক সত্যজিৎ ছটফট করতেন যা হোক একটা চাকরির জন্য। শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষা সে কাজে কতটুকু সহায়ক হবে জানা ছিল না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন পাশ্চাত্য সংগীত ও সিনেমাকে। সেই শখ মেটানোর পয়সা তাঁর ছিল না। তিলে তিলে ফুটপাথ হাঁটকে কিনেছেন রেকর্ড আর দ্বিতীয় শখটির চরিতার্থতার জন্য বিক্রি করতে হয়েছে সেই সংগ্রহ। ডি. জে. কীমারের আশি টাকা বেতনের কর্মী , আড্ডাবাজ, শিল্প পাগল সত্যজিৎ করতলে আমলকির মতো চিনতেন কলকাতা শহরকে। খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন দু্র্ভিক্ষ ও দেশভাগ। প্রবল আলোড়িত হয়েছিলেন বিল্পবোত্তর রুশ চলচ্চিত্রে। সংগঠিত করেছিলেন এ দেশের প্রথম ফিল্ম সোসাইটি। অনুর্বরতা ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে হাড়হিম লড়াই ক’রে নির্মাণ করেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’।
গ) চলচ্চিত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভের পর সত্যজিৎ রায় হয়ে উঠেছিলেন দলমত নির্বিশেষে শিক্ষিত বাঙালীর সাংস্কৃতিক মরূদ্যান। তাঁর সব ছবি সবাই মেনে নেয়নি, বারংবার তুমুল তর্ক উঠেছে, তৈরি হয়েছে আবেগ উত্তেজনা।তবু তাঁর চলেনি। তিনি এই দুর্ভাগ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অর্থ চিন্তা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। অথচ বাণিজ্যিকতার সঙ্গে ন্যূনতম আপোষ অথবা আপন বিশ্বাস থেকে সামান্যতম সরণ ঘটে নি তাঁর। প্রবল ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় সত্যজিতের অনেক বামপন্থী বন্ধু থাকলেও, রাজনীতি- এমনকি প্রগতি সংস্কৃতি সংঘের সঙ্গেও কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না তাঁর। কিন্তু চীন ভারত যুদ্ধ, খাদ্য আন্দোলন, ভিয়েৎনাম আগ্রাসনের কালে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বাঙালীর সাংস্কৃতিক অনুভূতি আহত হচ্ছে – এমন নানা ঘটনায় তাঁর স্পষ্ট প্রতিবাদী অবস্থান মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে।
ঘ) প্রৌঢ় বয়সে তিনি নিজেকে কিছুটা দূরত্বে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এর জন্য বাঙালীর অবতারপ্রিয়তা, যান্ত্রিক মার্ক্সবাদী বা কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন সমালোচকের আক্রমণ যেমন দায়ী তেমনই তাঁর ক্রমবর্ধমান অহমিকাও দায়ী। বিদেশী বিশেষত ফ্রান্স – ব্রিটেন – আমেরিকার মূল্যায়ণ বেশি গুরুত্ব দেবার যে প্রবণতা সত্যজিতের চিরকালই ছিল, এ সময় তা বৃদ্ধি পায়। তিনি ‘নাস্তিক’ থেকে ‘অজ্ঞেয়বাদী’ হয়ে পড়েন।
দীর্ঘজীবনে ব্যক্তিগত ভোগ, সুখ, আড়ম্বরের হাতছানি সত্যজিৎ ফিরিয়ে দিয়েছেন বারবার। তিনি ছিলেন অতিথিপরায়ণ, রসিক, প্রশ্রয়ী, পণ্ডিত ও শিশুতোষ ব্যক্তিত্ব। নীচু দরজায় ঠোক্কর খাওয়ার আশঙ্কা ছাড়া তাঁকে মাথা নীচু করতে হয় নি। ফলে সব স্তরের মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেও, শিল্পে, বচনে ও জীবনে তিনি ছিলেন আশাবাদী।
(২)
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার জন্য বিপুলাপৃথ্বী ও নিরবধিকাল অপেক্ষমান। আপাতত এ বিষয়ে কয়েকটি সূত্রের অবতারণা করা যেতে পারে।
প্রথমত, সত্যজিৎ রায় ছিলেন একজন মানবতাবাদী শিল্পী। একটি ঔপনিবেশিকতা ও সামন্ত শোষণে জর্জরিত তৃতীয় বিশ্বের দেশে জন্ম নিয়ে উদ্ভিদ্যমান বুর্জোয়া মূল্যবোধগুলি তিনি ধারণ করতে চেয়েছিলেন। সমাজবদলের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত দর্শনকে প্রত্যাখ্যান ক’রে বারংবার ঘোষণা করেছিলেন – শ্রেণিধারণাহীন মানবিকতার তাঁর পথ ও পাথেয়। ফলে স্বপ্নকল্পনাময় মিথ্যাকে ছিঁড়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ‘সমাজ বাস্তবতা’র রূপায়ণ ঘটালেও তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক ধারণা ছিল সীমাবদ্ধ। প্রাচীনতর দৃষ্টিভঙ্গীতে আধুনিক সময়কে বিশ্লেষণ করতে যাওয়ায়, তাঁর অনেক ছবিতে এসেছে বিভ্রান্তি, এমনকি প্রগতি পরিপন্থী চিন্তা। আবার মহৎ শিল্পের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব অনুযায়ী, সত্যজিৎ রায়ের অনেক সৃষ্টি- স্রষ্টার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম ক’রে গেছে। তাঁর চলচ্চিত্রাবলী ধারণ করে আছে বহু উজ্জ্বল মানবিক মুহূর্ত, অজস্র শোষিত মানুষের প্রশ্নাতুর মুখচ্ছবি, ক্রমনিম্নগামিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই মণিমুক্তাগুলির চয়ন ও বিশ্লেষণ আজকের আলোচকের প্রধান দায়।
দ্বিতীয়ত, সত্যজিৎ রায়ের সর্বোমোট ত্রিশটি কাহিনিচিত্রের মধ্যে তেইশটি বিখ্যাত বা নাতিবিখ্যাত বাংলা উপন্যাস ও ছোটোগল্প আশ্রয় ক’রে নির্মিত হয়েছে। লেখক তালিকায় আছেন এগারোজন সাহিত্য রথী। দুই শতাব্দীব্যাপী একশ বছরের বাংলা সাহিত্যকে উপাদান হিসেবে গ্রহণ ক’রে, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন দ্বারা নতুন মাধ্যমে তার রূপান্তর ঘটিয়েছেন সত্যজিৎ। প্রায়শই নান্দনিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে সেগুলির আবেদন উন্নততর হয়ে উঠেছে। এই রূপান্তর সাহিত্যপ্রেমী বাঙালীর অভিনিবেশ দাবী ক’রে।
তৃতীয়ত, সত্যজিৎ রায় যুগপৎ ধারণ করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর স্মৃতি, বিশ শতকের অভিজ্ঞতা ও একবিংশ শতাব্দীর সম্ভাবনা। তাঁর সমস্ত ছবিই সময় চিহ্নিত। সতরঞ্চ কি খিলাড়ী, নষ্টনীড়, তিন কন্যা, ঘরে বাইরে, দেবী এই চলচ্চিত্রগুচ্ছে ধরা পড়েছে গতশতকের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার, জলসাঘর, অশনি সংকেত, পরশ পাথর প্রভৃতি ছবিতে বর্তমান শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধের সামাজিক দ্বন্দ্বগুলি। কাপুরুষ, মহানগর, সীমাবদ্ধ, জনঅরণ্য, প্রতিদ্বন্দ্বী – ইত্যাদি ছবি আজকের মানুষের বৃত্তিমুখী অস্তিত্বের সংকট, বিচ্ছিন্নতা, মূল্যবোধকে বিশ্লেষণ করে। পিকু, আগন্তুক, গণশত্রু, শাখা প্রশাখায় রয়েছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্রষ্টার তীব্র অনুসন্ধান। তিনি সচরাচর দুটি বিশ্বাসের সংঘাত ছবির মূলে ক্রিয়াশীল রাখতেন এবং আরোপ করতেন মনোমতো তাৎপর্য। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রাবলীতে বাঙালীর সার্দ্ধশতবর্ষব্যাপী জৈবনিক পরিক্রমা সম্পর্কে তাঁর ধ্যান ধারণা বিধৃত হয়েছে। এর মূল্য বড়ো কম নয়।
(৩)
সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে টেবিলে থাপ্পড় যতটা পড়েছে, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা ততটা হয় নি। রাজনৈতিক শক্তিগুলিও তাঁর সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট মূল্যায়ন করতে পারে নি। কেবলমাত্র তাঁর জনপ্রিয়তা ও তৎসম্পর্কিত আবেগের ব্যবহার করেছে প্রয়োজনের সময়। তাঁর অন্তিমকালে তাড়াহুড়োয় পুরস্কারের মালা পরিয়ে দেওয়া, তাঁর সাহিত্য মূল্যগতভাবে অবৈজ্ঞানিক ও সংস্কারাচ্ছন্ন হলেও, সেগুলো সর্বসাধারণ্যে প্রচার করার আহ্ববান; তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা করার অপরাধে জোর ক’রে কলকাতায় সাবানা আজমীর নাটক বন্ধ ক’রে দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডকারখানা যাঁরা করে চলেছেন, সত্যজিৎ রায়ের লড়াকু দিনগুলোয় তাঁদের দেখা পাওয়া যায় নি। রাজ্য সরকার প্রয়াত শিল্পীকে নিয়ে একটি আর্কাইভ গঠনের কথা ঘোষণা করেছিলেন। সম্প্রতি জানা গেল তার টাকা দেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন নামে একটি ইয়াঙ্কী প্রতিষ্ঠান, প্রতিবাদী শিল্পীদের মেরুদণ্ড নুইয়ে দেবার কাজে যাঁদের দক্ষতা বিশ্বে স্বীকৃত। ভিক্ষুক দেশের এ হেন শিল্পপ্রীতি দেখে, দরাজ হাসি হেসে ওঠার জন্য সত্যজিৎ রায় আর আমাদের মধ্যে নেই। আমরা আরো একটু একা হয়ে গেছি।।
[ত্রৈমাসিক রৌরব (সেপ্টেম্বর – ডিসেম্বর’৯২) সংখ্যায় প্রকাশিত,সম্পাদক -শুভ চট্টোপাধ্যায় ]
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ও বাংলা সাহিত্যঃ অতিসংক্ষিপ্ত রূপরেখা
চলচ্চিত্র কনিষ্ঠতম শিল্পমাধ্যম। স্বভাবতই অন্যসব শিল্প থেকে ঋণ গ্রহণ করে সে তিলোত্তমা হয়েছে। সাহিত্যের কাছে তার ঋণ সম্ভবত সর্বাধিক। তাই সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের আলোচনার একটি যৌথ অঙ্গন রয়ে গেছে।
চলচ্চিত্রের জন্মাবধি সাহিত্যকে রূপান্তরিত করার কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন চলচ্চিত্রকারেরা। ইতিহাস প্রমাণ করেছে একাজে সফল হতে গেলে রূপান্তরককে দুটি মাধ্যমের সীমা ও সম্মেলন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও অনুসন্ধিৎসু হতে হয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রে শ্রী সত্যজিৎ রায় এমনই এক ব্যক্তিত্ব, এক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। মোট একত্রিশটি পূর্ণ ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্রের মধ্যে চব্বিশটি ক্ষেত্রে, বারোজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের পূ্র্বপ্রকাশিত বাংলা ছোটোগল্প বা উপন্যাসের সার্থক চিত্ররূপ দিয়েছেন তিনি।
প্রস্তাবিত গবেষণায় আমরা সত্যজিৎ রায়ের রূপান্তর প্রক্রিয়া (adaptation process)বোঝার চেষ্টা করব। প্রথম পর্বে, দুটি মাধ্যমের পারস্পরিকতা এবং সে বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারা বিচারিত হবে। দ্বিতীয় পর্বে, বারোজন সাহিত্যিকের বিশ্লেষণ এবং তাঁদের রচনার সত্যজিৎ-কৃত রূপান্তরের তাৎপর্য।
বাঙালীর গত দেড়শ বছরের সাহিত্যায়িত জীবনেতিহাস সত্যজিৎ রায়ের শিল্প পরম্পরায় প্রাণ পেয়েছে। এ গবেষণা তাই একার্থে, আমাদের আত্মানুসন্ধান।
প্রথম পর্ব
সাহিত্য ও চলচ্চিত্র
সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দুটি পৃথক শিল্প মাধ্যম। গণ সংযোগের উদ্দেশ্যে, আপন আপন ভাষায় এরা বিভিন্ন বার্তাকে সংকেতবদ্ধ করে। সাহিত্যের ভাষা লিপ্যায়িত শব্দ নির্ভর, চলচ্চিত্রের – দৃশ্যায়িত ইমেজ নির্ভর। ইমেজ শুধু চিহ্ন নয়, চিত্র ও প্রতীকও বটে। উপরন্তু সেই চিহ্ন নয়, চিত্র ও প্রতীকও বটে। উপরন্তু সেই চিহ্নের কৃত অর্থ ও অর্থ কারকের মধ্যে সম্পর্কটি সুনির্দিষ্ট। শব্দের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক মনগড়া, সে শুধুই চিহ্ন। এই বিপুল ভাষাগত প্রভেদসত্ত্বেও দ্বিবিধ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সাহিত্যের দ্বারস্থ হয়। প্রথমত, প্লট, চরিত্রায়ণ, মন্তাজ, অলঙ্কার ইত্যাদি রূপগতক্ষেত্রে; দ্বিতীয়ত, কাহিনিচিত্রের মূল উপাদান অর্থাৎ কাহিনিটির জন্য বিষয়গত ক্ষেত্রে।
সাহিত্য আশ্রিত চলচ্চিত্রঃ সত্যজিতের অভিজ্ঞান
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, রাশিয়া, বৃটেন ও হলিউডের প্রায় সমস্ত ধ্রুপদী ছবিগুলির বিষয় রুশ সাহিত্য সঞ্জাত। অন্যদিকে ফরাসী আভাগার্দ ও নিউ ওয়েভ, ইতালিয় নিও রিয়ালিজ়ম, জার্মান এক্সপ্রেশানিজ়ম এর প্রবক্তারা সাহিত্যের স্পর্শ থেকে মুক্তিপ্রয়াসী।
বিশ শতাব্দীর প্রথম ছ’টি দশক জুড়ে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এই টানাপোড়ন নিবিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। চসার থেকে জয়েস অবধি ছ’শ বছরের সাহিত্য ইতিহাস এবং গ্রিফিথ থেকে গদার অবধি ষাট বছরের চলচ্চিত্র ইতিহাসকে পাশাপাশি রেখে তিনি বুঝেছিলেন, উভয় ক্ষেত্রেই আধুনিক বাগ্ ধারাকে গ্রহণ করার জন্য নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চললেও একটি কাহিনি সূত্রের প্রয়োজন কখনোই ফুরোচ্ছে না। সাহিত্যের চিত্ররূপান্তর হয়েই চলেছে, নানা ভাবে, নানা ভঙ্গিতে।
বাংলা চলচ্চিত্র ও সাহিত্যঃ সত্যজিতের উত্থানভূমি
প্রাক্ স্বাধীনতা যুগের বাংলায় অন্তত কুড়িজন সাহিত্যিকের পঁচাত্তরটি গল্প- উপন্যাস, আঠারোজন নাট্যকারের চল্লিশটি নাটক চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। ন’জন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক পঁচাশিটি গল্প লিখেছেন চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু সত্যজিৎ রায় যথার্থই বুঝেছিলেন, এই কালপর্বে চলচ্চিত্রকে নেহাতই দেখা হয়েছিল বিনোদন হিসেবে।
পাঁচের দশকে প্রধানত সত্যজিৎ এবং আরো তিনজন প্রতিভা চলচ্চিত্রের শৈল্পিক সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করলেন। স্বয়ং স্বীকার করেছেন, যৌবনে দেশের মাটি ও মানুষ বিষয়ে তিনি ছিলেন ‘ক্যালাস’। তবু ১৯৫৫ তে, তাঁরই হাতে ‘বাংলার প্রকৃত আত্মা’ সেলুলয়েডে মূ্র্ত হতে পেরেছিল, কারণ বিভূতিভূষণ ছিলেন মধ্যস্থ।
এরপর থেকেই সত্যজিৎ হয়ে উঠেছেন ‘story teller’ এবং সেই story গুলি উঠে এসেছে দেশীয় সাহিত্যের অমেয় ভাণ্ডার থেকে।
সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রঃ সত্যজিতের রূপান্তর
ষাটের দশকে ফরাসী Auteurist Critic রা দেখিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র যৌথ শিল্প হলেও, যদি কোনও পরিচালক, নির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে অবিসম্বাদী কর্তৃ্ত্ব বজায় রেখে একটি গূঢ় বার্তাকে প্রাকাশ করতে পারেন, তাহলে প্রতিটি ছবিতেই তাঁর ব্যক্তিত্ব মুদ্রিত হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়, এই অর্থেই নিজেকে Auteur বলে চিহ্নিত করেছেন। স্বভাবতই অন্য লেখকদের কাছে ঋণী হলেও, রূপান্তর প্রক্রিয়ায় মধ্যে দিয়ে তাঁর ছবিগুলি বিশেষ চরিত্র লাভ করেছে। সাহিত্য সম্ভূত কিছু চরিত্র ও ঘটনাকে বেছে নিয়ে, এক একটি বিশেষ কালের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক নৈতিক তথা ব্যক্তিক সংকটকে তিনি প্রকাশ করে গেছেন আপন মাধ্যমে। তাই তাঁর ছবি সাহিত্যের অনুসরণ নয়, পুণঃসৃজন।
দ্বিতীয় পর্ব
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রেনেসাঁর ফলশ্রুতিতে রবীন্দ্রনাথ নবজাগ্রতা নারীদের এঁকেছেন বহুরূপে। সত্যজিৎ এই নারীদের রূপায়ণে শুধু উদার ও মানবিক নয়, সর্বাধুনিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করছেন। ‘পোস্টমাষ্টার’, ‘মণিহারা’ ও ‘সমাপ্তি’ ছোটোগল্প অবলম্বনে ‘তিনকন্যা’ ছবিতে নারীর চিরন্তন প্রবৃত্তিগুলির সঙ্গে বিশ শতকীয় পৌরুষের দ্বন্দ্ব বিবৃত হয়েছে। ‘নষ্টনীড়’ গল্পাশ্রিত ‘চারুলতা’য় ত্রিকোণ প্রেমের পটে ফুটে উঠেছে বিদুষীর আত্মস্বাতন্ত্র্য। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বেপথু নায়িকার আত্মদহ।
২। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী
‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে শিশুতোষ ছোটোগল্পটির সারল্য অক্ষুণ্ণ রেখেও বাজানো হয়েছে যুদ্ধ বিরোধী সুর।বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্যবাদের অপজোটের বিরুদ্ধে শিল্পীর ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছে রূপকথার মোড়কে।
৩। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
‘দেবী’ ছোটোগল্প অবলম্বনে সমনামী ছবিটিকে কালীকিঙ্করের অন্ধ সামন্ত সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন তার বুর্জোয়া শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক পুত্রকে। ফলে একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি বৃহত্তর সামাজিক সংঘাতের সাথে যুক্ত হয়েছে।
৪। রাজশেখর বসু
‘পরশপাথর’ ও ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্প আশ্রয়ী ‘পরশপাথর’ ও ‘মহাপুরুষ’ ছবিতে স্বাধীনতা-উত্তর মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-সংকট-শাঠ্য প্রকাশিত হয়েছে। যে সমাজ নিরিহ কেরাণীকে লোভী, প্রতিভাবানকে জালিয়াতে পরিণত করে, তার প্রতি বিদ্রুপ থাকলেও মুখ্য চরিত্রদুটির ওপর চেকভীয় মমত্ব ও হিউমার ছবিদুটির সম্পদ।
৫। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
‘জলসাঘর’ এবং ‘অভিযান’ গল্পদুটির চিত্ররূপে বেনিয়া ও মুৎসুদ্দিদের সঙ্গে অস্তগামী সামন্ততন্ত্রের সংঘাত প্রকাশিত। জমিদার বিশ্বম্ভর রায় কালের গতিতে মহিমের কাছে হেরে গেলেও হৃদয় মাহাত্ম্যে জিতে যান। দরিদ্র কিন্তু জাতিগর্বী নরসিং শেঠজীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
৬। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সংসারে শুভর পাশেই থাকে অশুভ। তবু তার মধ্যে জেগে থেকে আমাদের জাগ্রত বিবেক। ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাস অবলম্বনে সমনামী ছবিটিতে ব্যোমকেশ শুধু সত্যান্বেষী নয়, বিবেকপ্রতিম। মানবচরিত্রের প্রখর বিশ্লেষণ নিছক হত্যা তদন্তটিকে মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য দান করেছে।
৮। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসের চিত্ররূপে, প্রত্যেক স্তরে স্তরে আছে মন্বন্তরক্লীষ্ট এক গ্রাম্য পুরোহিত পরিবারের বিপর্যয়, প্রচ্ছন্ন আছে বিশ্বব্যাপী মারণ চক্রান্ত। এর বিপরীতে ‘পথের পাঁচালী’ও ‘অপরাজিত’ উপন্যাস আশ্রয়ী চিত্রত্রয়ীতে (‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’) গ্রাম্য পুরোহিত তনয় অপু বৃহৎ বিশ্বে মুক্তিলাভ করে। নিজেকে আবিষ্কার ও উত্তরাধিকারীর মধ্যে দিয়ে বিস্তৃত করে দেয়। শত অভাব, বঞ্চনা ও মৃত্যুর মধ্যেও বাঙালী জীবনের চিরপ্রবহমানতা এই ছবিগুলিতে মূ্র্ত হয়েছে।
৮। প্রেমেন্দ্র মিত্র
‘জনৈক কাপুরুষের কাহিনী’ ছোটোগল্প আশ্রয়ী ‘কাপুরুষ’ ছবিতে যৌবনের দুটি রূপ মেরুদণ্ডহীন নায়ক ও দীপ্তা নায়িকার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত। মদ্যপ স্বামী ও ভীরু প্রেমিক উভয়কেই মানসিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে তরুণীটি। পৌঁছতে চায়, ভার্জিনিয়া উলফের ভাষায় ‘a room of once own’ এ।
৯। নরেন্দ্রনাথ মিত্র
‘অবতরণিকা’ গল্প অবলম্বনে তোলা ‘মহানগর’ ছবিতে, জীবিকার চাপে রুদ্ধশ্বাস মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের তুচ্ছতার মধ্যে মহনীয়তার সন্ধান করেছেন সত্যজিৎ। নায়িকা আরতি সংসারের সমস্ত আর্থিক দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে এবং অর্জন করেছে নতুন নীতিবোধ। বুঝিয়ে দিয়েছে, আজকের নারী অন্তর ও বহির্জীবন উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা রাখে।
১০। সত্যজিৎ রায়
‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ উপন্যাসের চিত্র রূপান্তর করতে বসে সত্যজিৎ নিজের প্লটকেই এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করেছেন, যাতে অপরাধীকে প্রথমাবধি সনাক্ত করা যায়, অথচ সাসপেন্স বজায় থাকে।
‘পিকুর ডায়েরী’ গল্প আশ্রয়ী ‘পিকু’ ছবিতে চেতনাপ্রবাহী লিখনরীতি সরল ন্যারেটিভে বদ্ধ হয়েছে। জটিল, আধুনিক সমাজে শিশুর বিচ্ছিন্নতা আরো তীব্র, বিদ্রূপ আরো তীক্ষ্ণ হয়েছে।
‘অতিথি’ গল্প আশ্রয়ী শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ এ স্রষ্টার আত্মদর্শন প্রতিফলিত। একটি সাধারণ সংবেদনশীল কাহিনি – ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও মনুষ্যত্ব বিষয়ক ডিসকোর্স এর মর্যাদা পেয়েছে।
১১। শংকর
‘সীমাবদ্ধ’ ও ‘জনঅরণ্য’ উপন্যাসের চিত্ররূপ অগ্নিগর্ভ সত্তরের দর্পণ। ছবিদুটির নায়কেরা সময়ের সারথী নয়, দ্বিধায় পশ্চাদপর। শ্যামলেন্দু ও সোমনাথ দুজনেই বৃত্তির তাড়নায় মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেয়। তবু অন্ধকারে জেগে থাকে টুটুলের প্রতিবাদ, বৃদ্ধ পিতার প্রশ্নাতুর চোখ।
১২। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসের চিত্ররূপান্তর আপাত উচ্ছল যৌবনের গোপন দীর্ঘনিশ্বাসকে ধারণ ক’রে আছে। প্রথমটিতে অরণ্যের প্রেক্ষাপটে নাগরিক অনুভব, দ্বিতীয়টিতে নগরের কংক্রিটে আরণ্যক হিংস্রতা। উভয়ক্ষেত্রেই তরুণদল বিচ্ছিন্ন, উৎকেন্দ্রিক। তবু সত্যজিৎ বিশ্বাস রেখেছেন, তারা নাম না জানা ফুল ও হারানো পাখির ডাক খুঁজে ফেরে, ফিরবে চিরকাল।
গ্রন্থ / পত্রিকায় অপ্রকাশিত। রচনাকালঃ ১৯৯৩